বাংলা ভাষা ও সুলতানী শাসনামল (পর্ব ২)
বাংলা ভাষা ও সুলতানী শাসনামল (পর্ব ২)
========================
সেকুলার বুদ্ধিজীবি, সাংস্কৃতিক জমিদার কিংবা নাস্তিক-মুক্তমনা – এই শ্রেণীগুলো প্রাচীন বাংলার সুলতানী আমলের মুসলিম শাসকদের নিয়ে নানা রকমের নেতিবাচক ধারণা পোষণ ও প্রচার করে থাকে। তাদের বিকৃত চিন্তাধারার ছাপ এই বছরের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও পড়েছে। মুসলিম শাসকদেরকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে তাদেরকেই ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় সঙ্ঘাতের কারণ হিসেবে উপস্থাপন করা আর এর পূর্বের পৌত্তলিক শাসকদেরকে ইতিবাচকভাবে দেখানোর জন্য বিকৃত ইতিহাস প্রচার এখন ট্রেন্ডের মতো হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মকে এই বিকৃত ইতিহাস থেকে বাঁচানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাসবিদ এবং ভাষাবিদদের লেখনীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।প্রখ্যাত গবেষক, লোক-সাহিত্যবিশারদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ‘প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ গ্রন্থটিতে উল্লেখ আছেঃ
.
“একথা অস্বীকার করা চলে না যে, এদেশে এখন হি|ন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পূরা মাত্রায় চলিতেছে৷ কিন্তু সমগ্রভাবে ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চ্চা করিলে দেখা যাইবে, এই বিরোধের বিশেষ কোন গুরুত্ব নাই ৷ এই দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চিরকালই চলিয়া আসিতেছে, তাহাতে জনসাধারণের আদর্শের ঐক্য ও ক্রমবহমান প্রগতির কোন গুরুতর অন্তরায় ঘটে নাই। ঋগ্বেদে আৰ্য- অনার্য্যের যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্বন্ধে যে-সকল সূক্ত আছে, তাহা অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করিলে দেখা যাইবে যে, এই যুদ্ধ-বিগ্রহ মূলতঃ দুই ভিন্ন জাতীয় লোকের মধ্যে সংঘটিত হয় নাই ; ইহা দুই ধৰ্ম্মমতের সংঘর্ষ-সূচক । এই সকল যুদ্ধ ঠিক আর্য ও অনার্য্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, আর্য ও অনার্য্য উভয় পক্ষেই ছিলেন । … ”
.
এ থেকে বোঝা গেল ‘বিদেশি’ মুসলিম শাসকদেরকে যেভাবে পাশের দেশে ‘সব নষ্টের গোড়া’ হিসেবে দেখানো হয় (যার প্রভাব এখন আমাদের দেশেও দেখা যায়) তা সত্য নয়। বরং ভা|রতবর্ষে অনেক আগে থেকেই ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত হতো। প্রাচীন বাংলায় ‘অহিংস’ (?) বৌদ্ধ শাসকদের আচরণ কেমন ছিল? ড. দীনেশচন্দ্র সেন উল্লেখ করেছেনঃ
.
“… হি|ন্দু ও বৌদ্ধের মধ্যে সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ বিগ্রহ চরমে উঠিয়াছিল। সম্ভবতঃ, বৌদ্ধ-পালরাজাদের অত্যাচারে শত শত বৈদিক-ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশ ত্যাগ করিয়া গুজরাট্ ও দাক্ষিণাত্যে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন। সেই যুগের ব্রাহ্মণগণ অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ ও মগধাদি বৌদ্ধভাবাপন্ন স্থান বর্জ্জন করিয়া আর্যাবর্ত্তের হিন্দু-সমাজে এই দেশকে একরূপ পতিত বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া ছিলেন …”
.
জৈন ও বৌদ্ধদের প্রতি হি|ন্দু শাসকদের আচরণ কেমন ছিল? কেমন ছিল প্রাচীন বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের নীতি?
.
“… কথিত আছে কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের আদেশ ছিল- সেতুবন্ধ হইতে হিমগিরি পর্য্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে— বালক-বৃদ্ধ-নিব্বিশেষে তাহাদিগকে হত্যা করিবে, যে না করিবে তাহার মৃত্যুদণ্ড হইবে। কুমারিল ভট্ট ‘বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য’ এই মত প্রচার করেন; জৈন সম্প্রদায়ের প্রতি হি|ন্দুদের যে কি ভীষণ আক্রোশ ছিল, তাহা দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে বিশেষরূপে দৃষ্ট হইবে। মাছরার রাজা অষ্টম শতাব্দীতে কবি ও সাধু সম্বন্দরের সম্মতিক্রমে আট হাজার গোড়া জৈন পণ্ডিতকে শূলে চড়াইয়াছিলেন … ‘শঙ্কর বিজয়ে’ উল্লিখিত আছে- রাজা সুধন্বা অসংখ্য জৈন ও বৌদ্ধ পণ্ডিতের মস্তক উলুখলে নিক্ষেপ করিয়া ঘোটনদণ্ডে নিষ্পেষণ পূর্ব্বক তাহাদের দুষ্টমত চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়াছিলেন। ‘অষ্টম শতাব্দীতে গাড়োয়ালের হি|ন্দু-রাজা –তিব্বত রাজা লাঃলামা ইয়োর্সী- হোতকে বৌদ্ধধৰ্ম্ম ত্যাগ করাইবার চেষ্টায় তাঁহাকে যেরূপ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়াছিলেন, তাহার বর্ণনা শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র দাস প্রণীত “Indian Pandits in the Land of Snow” নামক পুস্তকে পাওয়া যাইবে ।”
.
পূর্ববঙ্গ থেকে বৌদ্ধদের বিনাশ কে বা কারা করেছে? ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি? মুসলিম সুলতানরা? নাকি এর পূর্বের হি|ন্দু শাসকরা? দীনেশচন্দ্র সেন উল্লেখ করেছেনঃ
.
“ বৌদ্ধধর্ম্মকে পরাভূত করিয়া হি|ন্দুরা যেভাবে বৌদ্ধ-ইতিহাস লোপ করিয়াছিলেন, তাহা অকথ্য অত্যাচার-লাঞ্ছিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় লিখিয়াছেন—“বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দগুলি জনসাধারণের ভাষা হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে। যে জনপদে ( পূর্ব্ববঙ্গে ) এক কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১১৫০০ ভিক্ষু বাস করিত সেখানে একখানি বৌদ্ধগ্রন্থ ত্রিশ বৎসরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই। যে পূর্ব্ব-ভারত বৌদ্ধধর্ম্মের প্রধান লীলাক্ষেত্র ছিল, তথায় বৌদ্ধধর্ম্মের যে অস্তিত্ব ছিল, তাহাও য়ুরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিকগণের চেষ্টায় অধুনা আবিষ্কার করিতে হইয়াছে।” (Discoveries of Living Buddhism in Bengal, p. I.) এদিকে শত শত ডোমাচার্য্য ও হাড়ি জাতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধশ্রমণকে হি|ন্দুরা চূড়ান্ত শাস্তি দিয়। সমাজের অতি অধস্তন স্থানে নিপাতিত করিয়াছেন।
.
… ইহা ছাড়া হি|ন্দুরা বৌদ্ধ-কীর্ত্তি একেবারে লোপ করিবার জন্য যেখানে যেখানে তাঁহাদের প্রাচীন কীর্ত্তি ছিল, তাহা মহাভারতোক্ত পঞ্চ- পাণ্ডব অথবা আর কোন হি|ন্দু রাজ-রাজড়ার সম্পর্কিত এইরূপ পরিকল্পনার দ্বারা বৌদ্ধাধিকারের চিহ্নমাত্র লোপ করিবার চেষ্টা পাইয়াছিলেন। … হি|ন্দুরা বৌদ্ধাধিকারের সমস্ত চিহ্ন ইতিহাস হইতে লুপ্ত করিয়াছিলেন। এমন কি, আমরা অশোক ও বিক্রমপুরবাসী দীপঙ্করের নাম পৰ্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলাম ।”
.
প্রাচীন ভারতবর্ষ তথা বাংলার ইতিহাস উল্লেখ করতে গিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন পরিশেষে উল্লেখ করেছেনঃ
.
“ এই হি|ন্দু-মুসলমানের মধ্যে আমরা যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লক্ষ্য করিতেছি, তাহার গুরুত্ব কিছুই নাই। বৈদিক যুগের যুদ্ধাদি এবং পরবর্ত্তী যুগে হি|ন্দু-জৈন-বৌদ্ধের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের সঙ্গে তুলনা করিলে, এখনকার এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা ষট্ প্রকোষ্ঠ রাইফেলের গুলির কাছে পটকার আগুনের মত নগণ্য ।” [১]
.
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কাদের আমলে বিকশিত হয়েছে? আর কাদের আমলেই বা তা হুমকির মুখে পড়েছে? ‘বিদেশি’ মুসলিম সুলতানদের আমলে? নাকি এর পূর্বের পৌত্তলিক শাসনামলে? এ ব্যাপারে অসাধারণ তথ্যনির্ভর একটি বই কাজী জাফরুল ইসলাম রচিত “মধ্যযুগের মুসলিম শাসকেরাই বাংলা সাহিত্যের স্থপতি”। [২]
.
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রান্তিকাল কখন এলো? এ ব্যাপারে মোশাররফ হোসেন খান সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান’ গ্রন্থের প্রসঙ্গ কথা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে –
.
“পলাশীর বিপর্যয়ের পর মুসলিম শাসকরা যেমন ক্ষমতা হারালেন, সেইসাথে বাংলা ভাষাও হয়ে পড়লো অভিভাবকহীন। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গ্রন্থমালা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইংরেজ ও ইংরেজ মদদপুষ্ট শিক্ষিত হি|ন্দু এবং ব্রা|হ্মণ্যবাদী সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে বাংলা ভাষা জিম্মি হয়ে পড়লো। সেইসাথে যুক্ত হয়েছিল সুযোগসন্ধানী খ্রী|ষ্টান মিশনা|রীদের বহুমুখী অপকৌশল ।
.
মুসলমানদের চলছে তখন রাজনৈতিকভাবে চরম সংকটকাল। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার ক্ষমতা তখনো তারা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এই সুযোগে হি|ন্দু ব্রা|হ্মণ এবং খ্রীস্টা|নরা মুসলমানদের সযত্নে লালিত বাংলা ভাষার শরীর থেকে তাদের ঐতিহ্যাশ্রিত শব্দকে ছুড়ে ফেলে সংস্কৃতনির্ভর এক ব্রা|হ্মণ্য ভাষার জন্ম দিল। এই ভাষায় রচিত হলো তাদের যাবতীয় গ্রন্থ এবং তা ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ করে ছড়িয়ে দিল সর্বত্র। গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, অভিধান, ব্যাকরণসহ পাঠ্যপুস্তকের ভাষাও হয়ে গেল সংস্কৃতনির্ভর। সত্য বলতে, এই ব্রা|হ্মণ্যভাষার নাগপাশ থেকে আজও আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত নই। হি|ন্দু ব্রা|হ্মণরা সচেতনভাবে যে সংস্কৃত ভাষার বীজ বপন করে গেছেন, আজকের অনেকেই তো সেই ভাষাই চৰ্চা করে যাচ্ছেন। পশ্চিম বাংলার হি|ন্দু লেখকরা যে ভাষা এদেশের মানুষকে শিখিয়েছেন, এখনো এদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ চেতনে- অবচেতনে সেই ভাষারই লালন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন ।
.
অথচ আমাদের বুঝা উচিত, ভৌগোলিক দিক দিয়েই আমরা কেবল ভা|রত থেকে পৃথক নই। আমরা পৃথক ভাষা, সাহিত্য, জাতি, ধর্ম, ঐতিহ্য এবং আবেগের দিক দিয়েও। ভা|রতের সাথে আমাদের পার্থক্য সামান্য নয়, বরং আকাশ-পাতাল। এই পার্থক্য চিরন্তন। এই পার্থক্য এবং প্রভেদ মনের, চিন্তার, ধর্মের, আচার-অনুষ্ঠানের, ভাষার, ঐতিহ্যের, কর্মের, নামের, জীবনাদর্শের, আদব-লেহাজের, সাহিত্য ও সংস্কৃতির।”
.
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রান্তিকালের ধারক ও বাহক কারা? এ ব্যাপারে আলোচ্য গ্রন্থটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছেঃ
.
“বাংলা ভাষার ওপর বারবার আঘাত এসেছে, তবুও শেষ পর্যন্ত এই মুসলমানরাই, এই ঐতিহ্যবাদী লেখকরাই আবার ঠিকই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হাল ধরে এগিয়ে গেছেন। আর আজ, পেছনে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, ঐতিহ্যবাদী সেইসব সংগ্রামী অগ্রজেরা আমাদের জন্য নির্মাণ করে গেছেন একটি আলোকিত পর্বত ।”
মুসলিম শাসক ও ইসলাম প্রচারকরা বাংলাকে যেমন রাজনীতি এবং ধর্মপ্রচারের জন্য ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত করেছেন, ঠিক তেমনি তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় তখনকার লেখকদের হাতে অবহেলিত এবং মৃতপ্রায় এই বাংলা ভাষা নবজীবন লাভ করেছে।” [৩]
.
.
[১] ‘প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ – দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ১০-১৪
[২] ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://xeroxtree.com/…/modhozuger_muslim_shasokerai…
[৩] ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান’ মোশাররফ হোসেন খান সম্পাদিত