প্যালেষ্টাইনী জনতার অগ্রদূত : ইয়াসির আরাফাত

ইয়াসির আরাফাত। একটি নাম; একটি আপোষহীন সংগ্রাম। একটি প্রজ্জ্বলিত বিদ্রোহ। বিশ্বের নিপীড়িত মানবাত্মার মুক্তি দূত, একটি প্রজ্ঞাশীল ব্যক্তিত্ব।

ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আরাফাতের প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ; পি, এল, ও, র দলীয় প্রধান হিসেবে। তারপরের প্রতিদিনের, প্রতিমূহুর্তের উজ্জ্বল সংগ্রামী অনুচ্ছেদগুলো প্যালেষ্টানী জনগণের কাছে ভবিষ্যতের আশাব্যঞ্জক দ্বার উদঘাটনের বার্তাবহ। আরাফাত চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েই সংগঠনকে সর্বপ্রথম শক্তিশালী করে তুললেন ; প্রতিরোধ সংগ্রামকে অধিকতর প্রাণবন্ত করে তুললেন।

ব্যক্তিগত জীবনে ইয়াসির আরাফাত অত্যন্ত নম্র ও সরল। আদর্শের ক্ষেত্রে তিনি যেমন লৌহ মানব, তেমনি ব্যক্তিগত আচরণে শিশুর মতো কোমল। সেই চিরপরিচিত ছবি ; হাসিমাখা সংগ্রামদৃপ্ত মুখ। মাথায় সাদা কালো চেকের মস্তকাবরণী, পরণে – ঢোলা প্যান্ট ও জেকেট, পায়ে মোটা জুতো,—এই নিয়ে আরাফাত। কখনো মরুভূমির ঊষর প্রান্তরে, কখনো বা পাহাড়ের নির্জন ওহার; কখনো বাবলা দেবদারু বনের মধ্যে বসে গেরিলাদের পরিচালনা করছেন ফিলিস্তিনী জনতার নেতা ইয়াসির আরাফাত। সুখের মুখ হয়তো তিনি দেখেননি। সব সময় তাঁকে অতিবাতিহ করতে হয় অত্যচারী ইহুদীদের দৃষ্টি এড়িয়ে।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর অবিরাম সংগ্রাম। সেই সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, তাদের মাটিতে দাঁড়িয়েই (জাতিসংঘ পরিষদ) আরাফাত তাদের গালাগালি করলেন, ফিলিস্তিনীদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, এ’কথা প্রমাণ করে বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গিতে বিষ ছিল না। আরাফাত যে বিশ্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালের ২রা নভেম্বরে জাতিসংঘে দেয়া তাঁর ভাষণ। আরাফাতের নব্বই মিনিটকাল স্থায়ী বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছিল ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান, বিশ্বপরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁর সুগভীর উপলব্ধি, নিপীড়িত জনগণের দুর্দশা, নিপীড়ক শাসকের নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও ছলা কলা-কৌশল তিনি সারগর্ভ তথা নির্ভর যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। তাঁর এই দূরদর্শী প্রজ্ঞার মাধ্যমে তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবেও বিশ্বের রাজনীতির রঙ্গ মঞ্চে আবির্ভূত হলেন।

ইয়াসির আরাফাত পি, এল, ও, সংগ্রামকে সম্প্রসারিত করলেন। হাজার হাজার মুক্তিকামী ফিলিস্তিনী তাঁর পতাকাতলে এসে জমায়েত হলেন। দুর্দমনীয় গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান ইসরাইলী নৃশংসতার প্রতিকারে কম্যাণ্ডো আক্রমণ পরিচালিত করলো। শুধু পুরুষরাই নয়, এই জীবন-মরণ হোলি খেলায় মেতে উঠলো নারী সমাজও। পুরুষ ভাইদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে এলো নারীরাও। বিশ্বে অগ্নিকন্যা বলে পরিচিত বিপ্লবী লায়লা খালেদ এদের অগ্রগণ্য। পৃথিবীর মানুষকে বিস্ময়ে হতচকিত করে দিয়ে ১৯৭০ সনের সেপ্টেম্বর মাসে লায়লা খালেদ যে অকল্পনীয় দুঃসাহসিক কাজটি সম্পন্ন করলেন: তা হচ্ছে -প্যালেষ্টাইনী মুক্তি যোদ্ধাদের মুক্তিপণের দাবীতে বিমান হাইজ্যাক। এরপর সমগ্র আরব বিশ্ব দুলে উঠলো যুদ্ধে, সংঘাতে, যুদ্ধে, সংঘাতে, আতংকে। ফিলিস্তিনী -কম্যাণ্ডোরা আরও কয়েকবার বিমান ছিনতাই করলেন, মিউনিখের অলিম্পিক (১৯৭২) সেন্টারে ইসরাইলের খেলোয়াড়দের আটক করলেন, জেরুজালেম, তেলআবিবে গোপন আক্রমণ পরিচালনা করলেন। এই সব সক্রিয় পদক্ষেপের মাধ্যমে প্যানেষ্টাইনীদের সংগ্রাম ক্রমশঃ জোরদার হয়ে উঠলো। আরব নেতৃবন্দও তাদের সমর্থন করলেন – লিবিয়ার কর্ণেল মোয়াম্মার গাদাফী, সৌদিআরবের বাদশাহ ফয়সল, সিরিয়ার হাফেজ আল- আসাদ এঁরা সর্ব প্রকার সহযোগিতা ও সমর্থনের হাত প্রসারিত করলেন।

১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধে মিসরের গোলান ফ্রন্টসহ বিস্তৃত এলাকা এবং সিরিয়া ও লেবাননের বিস্তীর্ণ এলাকা ইসরাইল জবর দখল করে আছে। জাতিসংঘে বার বার প্রস্তাব পেশ ও পাশ করেও তঁরা তাঁদের হারানো ভূমিকে ফিরে পাচ্ছেনা। একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলতে থাকে অনেক দিন যাবত। অবশেষে এই “কোল্ড ওয়্যার” ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলো। যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র আরব-বিশ্ব জুড়ে। ইসরাইল এবারে বেশ কিছুটা কাবু হলো। মিসরের কিছু অংশ ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো। যুদ্ধোত্তরকালে মিসরের সঙ্গে ইসরাইল কিছুটা বাধ্য হলো সমঝোতায় আসতে। ডঃ কিসিঞ্জার তাঁর শান্তির থলে নিয়ে বার কয়েক ঘোরাফেরা আলাপ-আলোচনার পর বোঝা যাচ্ছে, ইসরাইল মিসরের সঙ্গে মোটামুটি একটা শান্তির পথে আসতে চায়।

কিন্তু ফিলিস্তিন প্রশ্নে এখনো ইসরাইল অনমনীয়। সমস্যা সমস্যাই থেকে যাচ্ছে। আমরা পর্যালোচনা করলে দেখতে পারবো বিগত ত্রিশ বছর যাবত প্যালেষ্টাইনরা মাতৃভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে টিকে বসেছে ইসরাইল। তার সম্প্রসারণমূলক হামলায় পাশ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রসমুহের শান্তি বিপর্যস্ত ; যদিও ৭৩-এর অক্টোবর যুদ্ধে আরবদের ট্রাটেজিক বিজয়ের পর অবস্থার মোটামুটি পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৭৪-এর নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঊনত্রিশতম অধিবেশনে ইয়াসির আরাফাতের বক্তৃতা দানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন সুস্পষ্ট স্বীকৃতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রহীন প্যালেষ্টাইন অর্গানাইজেশনের প্রধান আরাফাতকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দিয়ে জাতিসংঘে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্যালেষ্টাইনীদের ন্যায্য অধিকারকে এড়িয়ে যাওয়া যে অসম্ভব, তা এখন প্রমাণিত সত্য।

১৯৭০ সালের ১২ থেকে ১৫ই জুলাইর জেদ্দা সম্মেলনে প্যালেষ্টাইনীদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ব মুসলিম স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের বিষয়টি গৃহীত হয়। এর ফলে প্যালেষ্টাইন ইস্যু আজ আর কোন আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জাতীয় সমস্যা, আন্তর্জাতিক সমস্যা। সমগ্র বিশ্বের শান্তির স্বার্থেই এর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। আর সেই সমাধান হল, ইসরাইলের পরিবর্তে স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্র গঠন এবং বিশ্বজনমতের স্বীকৃতি। ইসলামী পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে (১১৭৫–১৫ই জুলাই) গৃহীত প্রস্তাব এই দাবীর রাজনৈতিক ভিত্তিকে করে তুলেছে আরো সুদৃঢ়।

জেদ্দা সম্মেলনের পর এ’ কথা ঐতিহাসিক সত্য রূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্যালেষ্টাইন প্রশ্নে সমস্ত আরব এবং মুসলিম দেশগুলো নিপীড়কের বিরুদ্ধে, জবরদখলকারীর বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার এবং অত্যাচারিত মুক্তিকামীজাতি এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার ঐতিহাসিক ও শাশ্বত নীতিকেই মেনে নিয়েছে।

বিগত ১৯৭৪ সালের ১৩ই নভেম্বর ইয়াসির আরাফাত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন, তা সত্যিই উল্লেখযোগ্য ভাষণ। তিনি প্যালেষ্টাইনী সংগ্রামের মূল সুর ব্যক্ত করেন।

জাতিসংঘে ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থাকে (PLO) ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। গত ২রা নভেম্বর ১৯৭৪, সাধারণ পরিষদে মুক্তিসংস্থার নেতা ইয়াসির আরাফাতের ভাষনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেয়া হল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জাতিসংঘে মুক্তিসংস্থার জনাব ইয়াসির আরাফাতকে রাষ্ট্রীয় প্রধানের ন্যায় সম্বর্ধনা জানান হয়েছিল।

জনাব সভাপতি !

সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আপনাকে এবং যাদের প্রচেষ্টায় ফিলিস্তিন সমস্যা পেশ করার জন্য আমার সুযোগ হয়েছে তাদের সকলকে আমার ধন্যবাদ জানাই। ফিলিস্তিনের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সংস্থায় বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরী। এই পদক্ষেপ আমাদের প্রয়াস-প্রচেষ্টার সাফল্য যেন নির্দেশ করছে তেমনি এটি এই আন্তর্জাতিক সংঘের অগ্রগতির চিহ্নও বটে। এ এক নূতন দিকের ইঙ্গিত। আজকের দুনিয়া যেমন কালকের দুনিয়া থেকে আলাদা তেমনি আজকের জাতিসংঘ গতকালের জাতিসংঘ নয় !

জাতিসংঘ এখন দুনিয়ার ১৩৮টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। বলতে গেলে গোটা দুনিয়ারই প্রতিনিধি বনে গেছে। এখন মানবাধিকার সনদ প্রনয়নের যোগ্যতা যেমন এর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি সাম্য, ন্যায়বিচার ও কার্যকরী শান্তি প্রতিষ্ঠার শক্তিও বেড়েছে।

কেবল আমরাই নয় এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সকল জাতিই আজ এটা অনুভব করছেন। এটাই দুনিয়ার সকল জাতির চোখে এই সংস্থার মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচার-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার এবং জাতিগুলোর আজাদী হাসিলে পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আশা ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে। এর প্রয়াস প্রচেষ্টায় এমন এক দুনিরা আত্ম- প্রকাশ করবে যা পুরোনো ও নূতন সমস্ত রকম জাতিগত ও বর্ণগত আগ্রাসন থেকে হবে মুক্ত।

আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যখন দুনিয়ার মানুষ সাম্য সুবিচার ও ইনসাফের আকাঙ্খা পোষন করছে। নিপীড়িত জাতি গুলো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং জাতি বৈষম্যের নাগপাশ হতে মুক্তি কামনা করছে। আজাদী হাসিল ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য এরা সংগ্রাম করে চলেছে। তারা চায়, পারস্পরিক সহযোগীতা ও মর্যাদা প্রদর্শন, অন্য রাষ্ট্রের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। অনাহার, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ঝড়-তুফান ইত্যাদি মোকাবেলার জন্য সংগ্রাম চলুক আজকের মানুষ তাও কামনা করে। মানবিক কল্যাণের জন্য তথ্য ও প্রয়োগিক ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বেশী বেশী ফায়দা হাসিল করা চাই—যাতে করে উন্নত ও উন্নয়নগামী দেশ গুলোর মধ্যে ব্যবধান কমে আসে।

কিন্তু দুনিয়া জোড়া অশান্তি, জুলুম ও জাতিগত শোষণের জাতা- ফলে এই আকাঙ্খা পিষে মারা হচ্ছে। জুলুম ও নিপীড়নের এই সয়লাৰ নতুন নতুন যুদ্ধ, অশান্তি ও বিঘ্ন সৃষ্টি করে চলেছে।

জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিস্তিন ইত্যাদি দেশগুলো ষড়যন্ত্র, আক্রমণ ও লুটরাজের শিকার হয়েছে। এজন্য এসব এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়েছে। দুনিয়া দেখছে আগ্রাসী এবং বর্ণ বৈষম্যবাদী শক্তিগুলোই এই অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে।

নিরুপায় দেশগুলোকে এর মোকাবেলার জন্য তৈয়ার হতে হয়েছে। নিপীড়িত দেশগুলোর জন্য এই মোকাবেলা যে কোন দিক দিয়েই ন্যায় সঙ্গত এবং আইন সিদ্ধ।

জনাব সভাপতি !

দুনিয়ার যে সকল জাতি নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে এই আন্তর্জাতিক সংস্থার উচিত তাদের সাহায্য সহযোগীতা করা। ইন্দোচীনের জনগণ এখনও ষড়যন্ত্র ও হুমকির শিকার হয়ে আছে। ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে এক শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য কোরিয়া এখন প্রতীক্ষমান। কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের পরামর্শদান সত্ত্বেও এ ব্যাপারে শাস্তির কোন মঞ্জিল নজরে আসছে না।

সাইপ্রাসের লড়াই মাত্র কয়েক মাসের ব্যাপার। এ দেশের জনসাধারণ যে দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে চলেছেন সারা দুনিয়া তা অনুভব করছে। আমি এ ব্যাপারে ব্যথিত। এ সম্পর্কেও জাতিসংঘের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত যাতে একটা ন্যায়সঙ্গত মীমাংসায় আসা যার এবং এ অঞ্চলের জনসাধারণের আজাদী হেফাজত হয়।

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে এক নগ্ন হামলার সামনে এদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে ; যার মোকাবেলা বাধ্য হয়েই এদের করতে হচ্ছে, গরীব দেশগুলো স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে তাদের কাছে যে কাঁচা মাল আছে তার লুটতরাজ বন্ধ করতেই হবে। নিজেদের কাঁচামালের ন্যায্যমূল্য আদায়ের অধিকার তারা পেতে চায়।

এসব দেশের সামনে অসংখ্য সমস্যা রয়েছে যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মৌলিক পরিবর্তন সাধনের জন্য জাতিসংঘকে এসব দেশের সঙ্গ দিতে হবে। যাতে করে উন্নয়নগামী ও প্রগতিশীল দেশগুলো আগে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং দুনিয়ার বড় বড় শক্তিগুলো ধমক দিয়ে কাঁচামালের লুট চালিয়ে যেতে না পারে।

জনাব সভাপতি !

দুনিয়াব্যাপী যে অস্ত্রপ্রতিযোগীতা চলেছে তাতে দুনিয়ার শান্তি ও জাগতিক সম্পদই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, বিশ্বযুদ্ধের হুমকিও সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এই অবস্থায় জরুরী হয়ে পড়েছে আণবিক অস্ত্রকে সীমিত করার এবং আস্তে আস্তে তাকে বিনষ্ট করে দেয়ার। যত সম্পদ এই কাজে ব্যয় করা হচ্ছে তা উন্নয়ণ, প্রগতি ও গঠণমূলক কাজে নিয়োগ করার জন্য জাতিসংঘ চেষ্টা চালিয়ে যাবে- দুনিয়ার জাতি সমূহ তাই চায়।

আমাদের কথায় আসি। ইসরাইলের অস্তিত্ব আমাদের জন্য অশান্তির কারণ হয়ে আছে। আরবদের উপর ইহুদীবাদ জবরদখলই শুধু করেনি, আক্রমণ ও যুদ্ধের এক ধারা সৃষ্টি করে চলেছে এবং এমনি করে তার সম্প্রসারণবাদ লিঙ্গ। পূর্ণ করে চলেছে। ধ্বংস ও বিভীষিকার রাজত্ব আরও বাড়ানোর জন্য পঞ্চম বার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এরা।

জনাব সভাপতি !

দুনিয়া এখন শান্তি-সৌহার্দ, বিচার-ইনসাফ, স্বাধীনতা ও সাম্যের জন্য লড়াই করে চলেছে। এজন্য উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও ইহুদীবাদ তথা যে কোন প্রকারেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একযোগে আওয়াজ উঠেছে। দুনিয়ার এই সংগ্রাম জাতিসংঘের নীতির জন্য সংগ্রাম। আজকের দুনিয়ার অবস্থা সকলের সামনেই উন্মুক্ত। জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন ও ইহুদীবাদের অধিকারের মধ্যেও উপনিবেশবাদী ও বর্ণবাদীদের পুরোনো দুনিয়া ভেঙ্গে পড়েছে। এক নতুন দুনিয়া সৃষ্টি হচ্ছে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস দুনিয়ার সামনে যে ইনসাফভিত্তিক সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে তার সমাধানের জন্য সহযোগীতা করা হবে এবং আমরা সফল হব।

এই আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমার এই আওয়াজ এটাই প্রমাণ করবে আমরা শুধু মাত্র রণক্ষেত্রে নর রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেও আমাদের সমস্যার সমাধান করতে চাই। এটাও পরিষ্কার জাতিসংঘ আজ দুনিয়ার সমস্যাগুলো মীমাংসা করার পুরো যোগ্যতা রাখে। অতীতের ইতিহাস এবং বর্তমানের ঘটনাবলীই নয়, আমাদের দৃষ্টি ভবিষ্যতের পানেও নিবন্ধ আছে। কিন্তু বর্তমানকে বিশ্লেষণ করে আগামীর আওয়াজ তুলতে গিয়ে অতীতের দিকে ফিরে যেতেই হচ্ছে। যাতে দুনিয়ার স্বাধীনতাপ্রিয় জাতিগুলোর সঙ্গে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে পৌঁছতে পারি।

আর এখন যখন আমি আমার সমস্যাকে তুলে ধরতে চাইছি তার পূর্বাহ্নে একথা জানিয়ে দিতে চাই, এখন এখানে এমন সব লোকও উপস্থিত আছে যারা আমাদের ঘরে বসবাস করছে, আমাদের ক্ষেতের ফসল তুলছে, আমাদের গাছের ফল খাচ্ছে। তা সত্ত্বেও ওদের কথা হচ্ছে আমাদের কোন অস্তিত্বই নাই, আমরা শুধুমাত্র পরগাছা। না আছে আমাদের কোন জমি জায়গা আর না আছে আমাদের কোন ভবিষ্যত। কিছু কিছু এমনও লোক আছেন যারা হয়ত ভাবেন এ এক উদ্বাস্তু সমস্যা এবং আমরা আমাদের জন্য এমন সব অধিকার চাইছি যার হকদার আমরা নই। তারা ভাবেন এরা আইনসঙ্গত ও সন্তোষ- জনক কারণ ছাড়াই অন্যদের ভীতি ও সন্ত্রস্ত করার জন্য যুদ্ধ করে চলেছে।

এখানে মার্কিনী ও অমার্কিনী এমন সব প্রতিনিধি আছে যারা আমাদের শত্রুকে যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করেছে, গোলাগুলি তথা হত্যা ও ধ্বংসলীলার সাজ-সরঞ্জাম জুগিয়ে যাচ্ছে। এমনি করে আমাদের সঙ্গে শত্রুর মত ব্যবহার করছে এবং আমাদের আসল সমস্যা বিকৃত করে দুনিয়ার সামনে পেশ করছে। আর এ সবের জন্য যে লোকসান হচ্ছে আজাদীপ্রিয় আমেরিকাবাসীকে তা বরদাস্ত করতে হচ্ছে। আমি এই অমূল্য সময় নষ্ট না করে এখান হতেই আমেরিকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানাইঃ তাঁরা মৃত্যু ও ইনসাফের সঙ্গে থাকবেন এবং আমাদের বীর জাতিকে তাদের সমস্যা সমাধানে সহযোগীতা করবেন। আমেরিকার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন সেই মহান জর্জ ওয়াশিংটন, আমেরিকাবাসী নিশ্চয়ই তা ভুলে যাবেন না। আমি আমেরিকা বাসীদের জিজ্ঞেস করতে চাই আমাদের এই ব্যাপারে আমেরিকা আমাদের শত্রুতামূলক ব্যবহার কেন করছে ? এটা কি আমেরিকার জন্য লাভজনক ? আমেরিকার জনগণের জন্য লাভজনক ? কখনই তা নয়। আমার বিশ্বাস আরব দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুত্ব অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই বন্ধুত্ব অধিক মজবুত ও লাভ জনক হবে।

জনাব সভাপতি !

ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এগিয়ে যাওয়ার সময় যে বুনিয়াদী গলদের কারণে দুনিয়ার অসংখ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়ে চলেছে তার দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার।

আমাদের সমস্যা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে শুরু হয়েছে। কথায় ঔপনিবেশবাদের নয়া নয়া দখলদারীর আমলেই এর ভূমিকা। এই সময়েই ফিলিস্তিনের উপর হামলা করার জন্য ইহুদীবাদীরা পরিকল্পনা তৈরী করে। ইউরোপ থেকে ইহুদী দেশ ছেড়ে ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে। এই যুগেই এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া নয়া হামলা চলছিল। এই তিন মহাদেশে আগ্রাসন ও লুটতরাজ চলতে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনে এর চেহারা এখনও দেখা যাচ্ছে। ফিলিস্তিন দখল করার জন্য ব্যাপক আকারে ইহুদীদের দলে দলে আগমন অব্যাহত থাকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বর্ণ, জাতি, ভাষার ভিত্তিতে আফ্রিকার দেশগুলোতে আগ্রাসন চালিয়ে গিয়েছিল। একইভাবে ফিলিস্তিনেও লুটতরাজ চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।

এখন ইহুদীরা বলছে যে, তাদের সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা হতে এসে অন্য একটি জাতির ভূমিকে কেড়ে নিয়ে নিজেদের মাতৃভূমি করে নেবে। এটা ঠিক সেই নীতি, যে নীতি জারেরা অনুসরণ করেছিল। এই জন্য যোয়েস এবং হারতাজালের চিন্তা ও কার্যকলাপে সমতা পরিলক্ষিত হয়, কেননা যোয়েস দক্ষিণপূর্ব আফিকায় সাদামানুষের উপনিবেশ সৃষ্টি করেছিল, আর হারতাজাল ব্রিটেনের সাহায্যে ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে বসবার পরিকল্পনা তৈরী করে। এইভাবে ইহুদীরা আমাদের দেশে আক্রমণ চালানোর জন্য নানা ভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমি ফিলিস্তিনের কিছু সত্য উদ্ঘাটন করার জন্য আপনাদের অনুমতি চাইছি।

১৮৮১ সালে, যখন পাশ্চাত্য দেশ হতে প্রথম ইহুদীরা আসতে শুরু করে তখন ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ছিল মোট ৫ লক্ষ। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল মুসলমান। কিছু খৃষ্টান এবং প্রায় বিশ হাজারের মতো ইহুদী—এরা সবাই আরবী। এরা ছিল প্রতিবেশী। এদের মধ্যে ভ্রাতত্ত্ব বোধ ছিল। ছিল ভালবাসা। আমাদের ভূমি ছিল শান্তিপূর্ণ। এরপর ইহুদীচক্র পাশ্চাত্য দেশ হতে ৫০ হাজার ইহুদীকে এনে প্যালেষ্টাইনে বসাবার সিদ্ধান্ত নিল। এই সমস্ত ইহুদীরা ১৮৮২ হ’তে ১৯১৭ পর্যন্ত উদ্বাস্তু হিসেবে এসে বসবাস করতে থাকে। ব্রিটেনের বেলফোর ঘোষণার সাহায্যে তারা সেখানে বসবাসের সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হয়। ৩০ সাল ধরে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইহুদীদের পাঠিয়ে দেওয়ার সুযোগ অব্যাহত থাকল। ক্রমশঃ এই ভাবেই ইহুদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হ’তে এসে আমাদর মাত ভূমি দখল করতে থাকল। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ইহুদীদের সংখ্যা দাড়ালো ৬ লাখ এবং ঐ সময় আরবদের সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ আর ঐ ১৯৪৭ সালেই কয়েকটি রাষ্ট্রের সহায়তায় এবং অন্য কয়েকটি রাষ্ট্রের চাপে রাষ্ট্রসংঘ ঐ ইহুদীদের জন্য পৃথক ভাবে মাতৃভূমি বণ্টন করে দেন।

(এর পরে তিনি হজরত সোলেমানের বিচারের ঘটনার উল্লেখ করেন।)

ফিলিস্তিনের ৫৪% জায়গায় এই বহিরাগত ইহুদীদেরকে দিয়ে দিল। কিন্তু ইহুদীরা এতে সন্তুষ্ট না হয়ে আগ্রাসনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ৮১ শতাংশ দখল করে নিল। ১০ লাখ আরব বাসিন্দাকে মাত ভূমি থেকে বের করে দিল। ৫২৪টি শহর ও গ্রামকে দখল করে নিল এর মধ্যে ৩৮৫টি শহর ও গ্রামকে একেবারে ধ্বংস করে দিল। এই ভাবে আমাদের ক্ষেতে, বাগানে ও বসতিতে নতুন নতুন আবাদী সৃষ্টি করল এখান হতেই ফিলিস্তিন সমস্যার শুরু।

ফিলিস্তিনের সমস্যা দু’একদিনের কিংবা দুটো জাতির মধ্যকার কোন সমস্যা নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সংঙ্গে সংঘর্ষের সমস্যা মাত্রই এটা নয়। এটা এমন এক জাতির সমস্যা যাদেরকে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাদেরকে ক্যাম্পে জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়েছে।

ইহুদীরা উপনিবেশবাদী শক্তির সাহায্যে চেষ্টা করে চলে যাতে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যপদ না পায়। এভাবে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ করে নিল। এদের সহযোগিতায় প্রচার করতে থাকল আমাদের সমস্যা উদ্বাস্তুসমস্যা, আমাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা দরকার এবং আমাদিগের অন্য দেশে বসবাস করার সুযোগ করে দিতে হবে।

ইহুদীবাদীরা একদিকে এধরণের প্রোপাগাণ্ডা চালাতে লাগল অন্য দিকে উপনিবেশবাদী শক্তির সাহায্যে – অস্ত্র সংগ্রহ করে আগ্রাসনের মাধ্যমে নিজেদের এলাকা বাড়াতে লাগল। প্রতিবেশী দেশগুলো শত- সহস্রবার এদের আগ্রাসী নীতির শিকার হয়েছে। ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালে তাদের সম্প্রসারণবাদ চরিতার্থ করার জন্য যে নগ্ন হামলা করা হ’ল তা দুনিয়া কেবল দেখলই না, বিশ্বের জন্য এক মারাত্মক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। ১৯৬৭ সালের হামলায় ফিলিস্তিনি এলাকা ছাড়িয়ে লেবানন, মিশরের সুয়েজ এবং সিরিয়ার গোলান এলাকাও দখল করে বসল। এতে করে এই এলাকায় এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। আর এটাকেই মধ্যপ্রাচ্যের সমস্তা বলা হচ্ছে। ইসরাইলের সমস্যাকে জিইয়ে রাখার অর্থ আরবের মাথায় এক আন্তর্জাতিক হুমকি -চাপিয়ে রাখা। আগ্রাসনবাদকে খতম করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং সাধারণ পরিষদে যে সব সুপারিশ পেশ করা হয়েছিল তা ইসরাইল অগ্রাহ্য করে চলেছে।

শান্তির কোন চেষ্টাই সফল হল না। এই পরিস্থিতিতে ইহুদী- বাদের সম্প্রসারণকে রোধ করার জন্য সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা ছাড়া আরব দেশগুলোর বিশেষ করে মিসর ও সিরিয়ার আর কি উপায়। দখলীকৃত এলাকা উদ্ধার ও ফিলিস্তিনী জনগণের অধিকার আদায় এই একটি মাত্র পথ বাকী ছিল। এভাবেই ইসরাইল বুঝতে পারে ‘জোর যার মুল্লক তার’ নীতি অবলম্বনে সম্প্রসারণবাদ এক ভুল রাজনীতি। কিন্তু এখন অবধি ইসরাইলের এ হুঁশ হচ্ছেনা। পঞ্চম বার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে যাতে আরবদের সঙ্গে জোর গলায় আলোচনা চালাতে পারে।

জনাব সভাপতি !

আমাদের দেশ মরুভূমি ও বিরান ছিল। ইহুদীরা এসে তা আবাদ করেছে—ইহুদীবাদীদের এই প্রোপাগাণ্ডা শুনে আমাদের দেশবাসী দুঃখিত হয়। বিশ্বসংস্থার সদস্যদের এই মিথ্যা প্রপাগাণ্ডার গতিরোধ করতে হবে। ফিলিস্তিন তাহজীব ও তমুদ্দনের অতি প্রাচীন নিদর্শনের সমৃদ্ধ, হাজার বছর ধরে আমাদের জাতি এই সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। ফিলিস্তিন বিশ্বের স্বাধীনতা ও পবিত্র জায়গা সমূহের নিদর্শন স্বরূপ ছিল। এখানে সহনশীলতা ও স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। ইসরাইলী জবর দখলের পূর্বে বায়তুল মোকাদ্দাসে ভ্রাতৃত্বের যে উন্নত আদর্শ পরিবেশ ছিল তার ছবি এখনও আমাদের মানসপটে অঙ্কিত আছে। ইসরাইল একে অতীতের ইতিহাসে পর্যবসিত করতে চাইলেও ৰায়তুল মোকাদ্বাসের এক সুযোগ্য সন্তান হিসেবে এটা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে দিতে চাই, মানবীয় ভ্রাতত্বের এই অতুলনীয় নমুনাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তা ফিরিয়ে আনবই। ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয়া হবে না।

আমরা পিতৃপুরুষের উত্তারাধিকারকে ছেড়ে দিতে পারি না। দেশ ও জাতির এই ঐত্যিকে আমরা টিকিয়ে রাখবই। ইসরাইল জাতি-বৈষম্যের প্রবক্তা ; উপনিবেশবাদীদের মিত্র ও সহযোগী। একটু স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে দেখলেই দেখা যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়া, এ্যাঙ্গোলার বর্ণবাদীদের সঙ্গে এদের গভীর যোগাযোগ আছে। এ থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় আমাদের সংগ্রাম সম্প্রসারণবাদীদের বিরুদ্ধে যারা আমাদের দেশকে জবর দখল করেছে। আর আমরা চেয়ে আছি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পানে। যেখানে আমাদের শত্রুরা আমাদের অতীতকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।

জনাব সভাপতি !

ইহুদীরা যদি এমনি উদ্দেশ্য নিয়ে হিজরত করে আসতেন যে, এখানে এসে ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে আর্মেনীয় ও তুর্কীদের মত ভাইয়ের ন্যায় বসবাস করতে চায় তাহলে আমাদের কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দেশকে কেড়ে নিয়ে আমাদেরকেই এখান থেকে বিতাড়িত করবে, না হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিবর্তিত করে দেবে। আমরা এটাকে কোন মতেই বরদাস্ত করতে পারি না। তাই আমাদের আন্দোলনে জাতিবৈষম্যের কোন গন্ধ নেই ; না আছে এতে ইহুদীদের প্রতি কোন শত্রুতা। আমাদের বিপ্লবী আন্দোলন জাতি বৈষম্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের আন্দোলন মানবীয় সভ্যতার আন্দোলন। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান একই অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে কোন বিভেদ করা হবে না।

জনাব সভাপতি !

আমরা ইহুদীবাদ Zionism ও ইহুদীয়াতের সঙ্গে পার্থক্য করি। ইহুদীবাদ সম্প্রসারণবাদের এক বিশেষ চেহারা। এই জন্য আমরা এর বিরোধিতা করি। কিন্তু ইহুদী ধর্মের কথা উঠলে আমি জানিয়ে দিতে চাই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি এবং আমাদেরই এক উত্তারাধিকার মনে করি। এক শতাব্দী পূর্বে ইহুদীবাদ কাজ শুরু করেছে। কিন্তু আজ তা খোদ ইহুদীদের জন্য আরবদের জন্য ও শান্তিকামী দুনিয়ার জন্য এমন এক বিপদ সৃষ্টি করে চলেছে যা থেকে কোন মতেই দৃষ্টি সরিয়ে রাখা যায় না।

এই সুযোগে আমি সকল জাতি ও রাষ্ট্রকে ইহুদীদের অনাগত দেশ-ত্যাগ আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টি-আকর্ষণ করছি। এ আন্দোলন আমাদের দেশকে গ্রাস করার জন্য চলছে। জাতি ও বর্ণের ভিত্তিতে দুনিয়ার কোথাও যাতে বিভেদ না করা হয় সেদিকেও সকলের মনোযোগ দেয়া দরকার।

জনাব সভাপতি !

আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, আরবদের এই মূল্য দিতে হচ্ছে কেন ? ইহুদীদের হিড়িক আমাদের দেশেই কেন এসে পড়ছে ? এর পরেও কারুর মনে কোন সংশয় বাকী থেকে থাকলে আমি তাদের বলে দিতে চাই, ঐ দেশত্যাগীদের জন্য তাদের বড় বড় দেশের দরজা কেন খুলে দেন না ?

জনাব সভাপতি !

তারা আমাদের ন্যায় ইনসাফের আন্দোলনকে অন্যায় ও অবিচার বলে দেখাতে চায়। যারা—ইহুদীবাদ ও সম্প্রসারবাদের কবল হতে নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করছে তাদের কোন মতেই সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেয়া যায় না। আমেরিকা যখন বুটেনের অধীনতা হতে মুক্ত হবার জন্য অস্ত্রধারণ করেছিল, যখন ইউরোপ নাৎসীবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন তাকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেয়া হয়নি। তাই এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার জনগণের আজাদী সংগ্রামকে সন্ত্রাস আন্দোলন বলা যায় না।

জনাব সভাপতি !

এ আন্দোলন সন্ত্রাস সৃষ্টির আন্দোলন নয়। এ ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাও এটা স্বীকার করে। যারা অপরের দেশ আক্রমণ করে লুটতরাজ করার জন্য হাতিয়ার হাতে নেয় তারাই আসলে সন্ত্রাসবাদী। এরাই ভর্ৎসনার যোগ্য। সব অস্ত্র ধারণকারীই অপরাধী নয়। যারা অন্যের আজাদী হরণ করার জন্য অস্ত্র ধারণ করে তারাই অপরাধী। নিজের ও নিজের দেশের মুক্তির জন্য হাতিয়ার ধারণকারী অত্যাচারী নয়, দেশের বীর মুজাহিদ। সন্ত্রাসবাদী আমরা নই, যারা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে ভেড়া ছাগলের মত হত্যা করেছে তারাই আসল সন্ত্রাসবাদী। ওদের সন্ত্রাসবাদ হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে গৃহহীন করেছে এবং প্রিয় শহর বায়তুল মোকাদ্দাসকেও দখল করেছে। তারা আরব, ইসলামী, ঈসায়ী চরিত্রকে বদলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। মসজিদে আকসায় অগ্নি সংযোগ ও ক্যানসিয়ার চুরি এর জলন্ত প্রমাণ। আমার বক্তব্যকে আমি দীর্ঘ করতে চাই না; কিন্তু এটা অবশ্যই বলতে চাই-তাদের এসকল প্রয়াস সন্ত্রাসবাদের প্রমাণ বহন করছে। তাদের সন্ত্রাসবাদ জনগণের ক্ষতিই শুধু হচ্ছে না, সভ্যতা সংস্কৃতিরও অপুরণীয় ক্ষতি হ’তে চলেছে।

বায়তুল মোকাদ্দাস তিন আসমানী ধর্মের মিলন ভূমি। কিন্তু আজ ভবিষ্যতের পথ কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়েছে। ইহুদীদের সন্ত্রাসবাদের এটাই শেষ কথা নয়—তাদের এই সন্ত্রাসবাদে দখলীকৃত আরব ভূমি দিন রাত হয়রানী হয়ে আসছে। মিসরের কলেজ, কারখানার প্রতি বোমাবর্ষণ, লিবিয়া বিমান বন্দরে ধ্বংসসাধন, সিরিয়া কান্তারা বিনাশ কি ইহুদী সন্ন্যাসবাদের উজ্জ্বল প্রমাণ নয় ? ইহুদীদের এই সন্ত্রাসবাদ সকলেই খালিচোখেই দেখতে পাচ্ছে। লেবাননে ইহুদী সন্ত্রাসবাদ এক লোমহর্ষ ঘটনা হয়ে রয়েছে। লেবাননে ইহুদী সাম্রাজ্যবাদ রাস্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি এক চ্যালেঞ্জ। এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থা স্বাধীনতা সংগ্রামের আইনতঃ অধিকারী। এর পেছনে ফিলিস্তিনী জনসাধারণ তাদের সংগঠন এবং সমগ্র আরব জগতের সমর্থন রয়েছে। আরব শীর্ষ সম্মেলন ও ফিলিস্তিনের উপর ফিলিস্তিনীদের অধিকার সমর্থন করেছে। ফিলিস্তিনীদের এই মুক্তি সংগ্রামে দুনিয়া অন্যান্য অঞ্চলের আজাদী আন্দোলনগুলোও সমর্থন করেছে। এখানে আমি অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি — গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশসমূহ, কম্যুনিষ্ট দেশসমূহ এবং ইসলামী দেশগুলো আফ্রিকার দেশসমূহ এবং ইউরোপের বন্ধু দেশগুলো আগেকার দেশ ও জাতির এই সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। আমাদের সংগ্রামে তারা আমাদের সঙ্গে আছে। আমাদের মুক্তি সংস্থা ফিলিস্তিনী জাতির প্রতিনিধি এ অধিকার নিয়েই আমি ফিলিস্তিনীদের মুক্তির আকারকে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। ফিলিস্তিনী সমস্যার ব্যবস্থা আপনাদের উপর ঐতিহাসিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

জনাব সভাপতি !

আমরা বিপ্লবী, স্বাধীনতা পীপাসু এই সভাকক্ষে যারা বসে আছে, তাদের অনেকেই কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত আমাদের মতই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। তাদের সৌভাগ্য যে তাদের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। এখন আমি আপনাদেরকে প্রশ্ন করছি আমরাও ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য এই যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি তা ন্যায় সঙ্গত কিনা ? আদালতে সাক্ষ্য দেবার সময় বলেন, “আমি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অন্তর্ভূক্ত নই। আমি ফিলিস্তিনে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী।” এই নির্ভীক ইহুদীবীর, “আহোদরি” তাঁর সঙ্গীসহ আজ ইসরাইলের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন কারাগারে দিন অতিবাহিত করছেন আমি সেই বন্দী বীরকে এইখান থেকেই শুভেচ্ছা কৃতজ্ঞতা জানাই। শুধু তাই নয় ইসরাইলের খৃষ্টীয় চার্চের এক পুরোহিত স্পষ্টভাবে সরকারের কাছে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি প্যালেস্টাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লেশ -চেষ্টা করে চলেছেন, যে এই শান্তিময় ভূমিতে সবাই শান্তির সঙ্গে বসবাস করতে পারে আমার আশংকা এই মহান নেতাকেও অচিরে কারাগারে অবরুদ্ধ করা হবে। আমি তাঁর কাছেও আমার কৃতজ্ঞ মোবারকবাদ শেষ করছি।

আমরা সবাই একই পথের পথিক। আমরা সবাই আশা আকাঙ্খাকে এক নতুন রূপ দেবার চেষ্টা করছি। আমি আমার জাতির সঙ্গে নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে এসে এই ইহুদী বীর ও খৃষ্টান পুরোহিত নেতা এবং তাঁর ভাইদের সঙ্গে এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় জীবন অতিবাহিত করতে চাই। এই রাষ্ট্রে ইহুদী খৃষ্টান ও মুসলমান ভায়েরা শান্তি, ভ্রাতৃত্ব এবং ন্যায় বিচারের মধ্যে বসবাস করবে। আমি ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার নেতা এবং এক বিশিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আজ আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি যে, যখনই আমি আমাদের কোন আশা আকাঙ্খা এবং বাসনার কথা বলেছি এর মধ্যে আমার এই সব ইহুদী ভায়েরাও রয়েছে যারা আজও আমাদের সঙ্গে ফিলিস্তিনে থেকে আমাদের আশা-আকাঙ্খা রূপায়নে সহযোগিতা করে চলেছে। এবং কোন বর্ণ ও ধর্ম বৈষম্য ব্যতিরেকে আজও তারা আমাদের সঙ্গে বসবাস করতে আগ্রহী। ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদী ভাইদের আমি অনুরোধ করছি, ইহুদী সাম্রাজ্যবাদীরা তাদেরকে ধ্বংসের যে ভয়াল পথে নিয়ে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এর উপর যেন তাঁরা চিন্তা করেন। বর্তমান ইহুদী সাম্রাজ্যবাদ এক অনন্ত যুদ্ধ এবং ধ্বংসের পথ। এই সাম্রাজ্যবাদীরা আপনাদেরকে এই যুদ্ধাগ্নির ইন্ধন বানাতে চায়, অপরপক্ষে আমি আপনাদেরকে ফিলিস্তিন এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জীবন যাপনের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার নেতা হিসেবে আমি আপনাদের কাছে ঘোষণা করছি। ফিলিস্তিনে শান্তি এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবার পর কোন কোন ইহুদী কিংবা আরবের রক্তপাত আমার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক হবে। ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার নেতা হিসেবে আমি আজ আপনাদেরকে অনুরোধ করছি আপনারা আমাদের এই মুক্তির তার সংগ্রামে সর্ব প্রকারে সহযোগিতা করুন। আপনার এই আন্তর্জাতিক সংস্থাও বিভিন্ন সময়ে আমার এই কথার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। আপনাদেরকে পরভূমি ছেড়ে নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে দেয়া হোক নিজের বাড়ী-ঘর ক্ষেত-খামারে আমরা আবার ফিরে স্বাধীনতা স্পর্শ পাই। আমাদের অধিকার আমরা যেন প্রাপ্ত হই। পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস যেন আমরা আবার ফিরে পেয়ে আমাদের এই যাত্রায় পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের রক্ষী হয়ে অগ্রসর হতে পারি। আর দুনিয়ার বিভিন্ন ধর্মের এই কেন্দ্রস্থল পবিত্র বায়তুল মুকাদ্বাস যেন সন্ত্রাস হ’তে মুক্ত হয় যেমনটি পূর্বে ছিল।

জনাব সভাপতি !

আমি একহাতে শান্তির পাত্র এবং অন্য হাতে বিপ্লবের বন্দুক নিয়ে আপনার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছি। এখন এটা আপনার দায়িত্ব আপনি যেন আমার হাত হতে এই শাস্তির পাত্র পতিত হ’তে না দেন।

জনাব সভাপতি !

জেনে রাখুন ফিলিস্তিন হতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ শিখাও উত্থিত হতে পারে আর নির্গতও হতে পারে শাস্তির আমিয় ধারা।

********

ইয়াসির আরাফাত মানে ফিলিস্তিন, আর ফিলিস্তিন অর্থাৎ আরাফাত। দুনের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। পি, এল, ওর সামগ্রিক গতি প্রবাহিত হচ্ছে আরাফাতের অঙ্গুলি নির্দেশেই। কিছুদিন পূর্বে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন তৎপরতা সম্পর্কে বিষদ বর্ণনা দিয়ে ছিলেন। তার মতে :-

ফেদায়ীন তৎপরতা : —বিদেশে ইসরাইল এবং ইহুদীদের বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা কিছু সুফল পেতে পারে, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য-রাজনৈতিক আলোচনা এবং কুটনৈতিক প্রচেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

ইসরাইলী রণনীতি : – প্যালেষ্টাইনী জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে ইহুদী-মার্কিন তৎপরতা চলছে। এ বিশ্ব হয়তো জানেনা যে, ইসরাইলীরা পশ্চিম তীরে ৮৮০০টি বাড়ী এবং ‘গাজা’ এলাকায় ১০০০ বাড়ী ধুলিস্যাত করে দিয়েছে। কিন্তু প্যালেস্টাইনী জনগণ নিশ্চিহ্ন হতে রাজী নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইণ্ডিয়ানদের মতো এরা ভাগ্যকে মেনে নিতে পারবে না।

মার্কিন নীতি : ২৫ বছর ধরে আমেরিকা ইসরাইলকে সমরাস্ত্রসহ সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে। এই এলাকায় ইসরাইলদের পক্ষে মার্কিন সমর্থন ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন সাধিত করেছে। কিন্তু এই ভারসাম্য তারা আর কতদিন বথা করতে পারবে ?

মধ্যপ্রাচ্য:- মধ্যপ্রাচ্য প্রসঙ্গে আরাফাত আরো দুঃখ কষ্ট এবং ত্যাগ ছাড়া আর কিছুই দেখছেন না। তাঁরা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জয়ী হওয়া এক উম্মত্ত শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। এমন একটি শত্রুর মোকাবেলা করছে, যে প্যালেষ্টাইনী জনগন, নেতা এমনকি নারীদের হত্যা করতে পেরে আনন্দে উৎফুল্ল।”

ইসরাইল এক সময় পরিকল্পনা করেছিল সিনাই বদ্বীপের পশ্চিমাঞ্চলে প্যালেষ্টাইনীদের পূনর্বাসিত করার জন্য। কিন্তু ফিলিস্তিনীরা তা মেনে নিতে চায়নি। হতে পারে তারা উন্নততর জীবন যাত্রার জন্য আর অভিলাষী নয়, তা’ছাড়া ‘গাজাতে’ স্বায়ী চাকরী-বাকরীও পাওয়া যায় ; কিন্তু তাতে যদি ফিলিস্তিনীদের মনে হয় যে, মাত, ভূমিতে ফিরে যাবার স্বপ্ন তাদের জলাঞ্জলি দেয়া হচ্ছে, তাহলে চাকরী ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে তারা নির্বিকারে। সিনাইতে স্থায়ী চাকরী এবং গাঙ্গায় বেকারত্ব- এই দু’ পক্ষের একটিকে বেছে নিতে বললে তারা নির্দ্বিধায় দ্বিতীয় পথটি অনুসরণ করবে। ফিলিস্তিনীদের এই মনোভাবের সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে আর্নল্ড টরেনবী যাদুকরী ভাষায় তিনি বলেছেন : “ত্যাগ তিতিক্ষাই তাদের প্রাণ। স্তম্ভ ধ্বসিয়ে হলেও তারা চায় ইসরাইলী দুশমনের মাথায় ছাদটা ধ্বসিয়ে নামাতে’।

প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংগ্রামের একজন অন্যতম প্রধান সমর্থক ও সাহায্যদানকারী মহান ব্যক্তি ছিলেন ১৯৭৪-এর ‘শ্রেষ্ঠ মানব’ শহীদ বাদশাহ, ফয়সল। সৌদী আরব গোড়া থেকেই প্যালেষ্টাইনের মদদ জুগিয়ে এসেছে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে প্যালেষ্টাইনের গেরিলা নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বাদশাহ ফয়সল আশা প্রকাশ করেন যে, মৃত্যুর পূর্বে তিনি পবিত্র মসজিদ, জেরুজালেমের “বায়তুল মোকাদ্দাসে’ নামাজ পড়তে চান। তিনি বলেন, জেরুজালেমের মুসলমানদের মুক্তির দায়িত্ব শুধু প্যালেষ্টাইনীদেরই নয়, সম্মিলিত আরবশক্তিবর্গের এটি পবিত্র কর্তব্য। আরব জাহানের একাত্মতা ভিন্ন এ দায়িত্ব সম্পাদন করা সম্ভব নয়।

হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য অস্ত্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশে তেল সরবরাহ বন্ধও নিয়ন্ত্রণ করবার যে পদক্ষেপ আরব নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, বাদশাহ ফয়সল ছিলেন তাঁদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। আরবদের তেল অস্ত্র প্রয়োগের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র কর্তক আরব তেল খনি- সমূহ সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকী কিসিঞ্জার দিয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডও একই সুরে সুর মিলিয়ে ছিলেন। কিন্তু সামরিক বিশেষজ্ঞগণ মনে করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র যদি এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করতে চায়, তাহলে বিশ্ব জুড়ে-মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চীফ অব ষ্টাফের সাবেক এডমিরাল এলমো জাম ওয়ান্ট মন্তব্য করেন, “মধ্য প্রাচ্যের তেল খনি দখলের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেই। যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ধরণের ঝুঁকি নিয়ে বসে, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নও বসে থাকবে না।” প্যালেষ্টাইন নেতা ইয়াসির আরাফাতও একই বক্তব্য পেশ করেছেন। আমেরিকা শেষতক মধ্য প্রাচ্যের এই ঝুঁকি গ্রহণে এগোবার সাহস করেন। আরাফাত বাদশাহ ফয়সলের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। ১৯৭৩ সালের ২১ শে ডিসেম্বর মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি আলোচনার ব্যাপারে প্যালেষ্টাইনীদের তরফ থেকে জেনেভায় যোগদান করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইসরাইলের ঘোরতর বিরুধীতার ফলে তিনি আলোচনায় যোগ দিতে পারেন নি।

এ ধরণের প্রেক্ষাপট থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইয়াসির আরাফাত বা প্যালেষ্টাইন মুক্তি-আন্দোলন শুধু মাত্র রণ-ক্ষেত্রের অগ্নিঝরা পথ বেয়েই প্রবাহিত নয়, এরা শাস্তির পথেও প্রবাহিত হতে চান ; পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেও ইয়াসির আরাফাত তাঁর ইপ্সিত আকাঙ্খাকে বাস্তবায়িত করতে আগ্রহী, কিন্তু মাঝপথে কণ্টক হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইসরাইলের অনমনীয় কঠোর ও একমুখী মনোভাব ; যে জন্ম শুধু প্যালেষ্টাইন নয় ; সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব জাহানের মূল সমস্যা অধিকৃত ‘আরব ভূমি’র কোন সমাধান আজতক হয়ে উঠেনি। অন্যদিকে ইসরাইলের একনিষ্ঠ সাহায্যদানকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র মানবতার প্রশ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্যালেষ্টাইন সম্পর্কিত সকল প্রস্তাবকে অকপটে নাকচ করে দিচ্ছে।

কিছুদিন পূর্বে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদে শতাধিক রাষ্ট্র এক বাক্যে প্যালেটাইনীদের ভূমি তাদের ফিরিয়ে দেয়াসহ ফিলিস্তিনীদের সকল অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রস্তাব পাশ করেন। বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক জনমত ইসরাইলের আগ্রাসী নীতিকে চরমভাবে অবজ্ঞা করেছেন। প্যালেষ্টাইনীদের ন্যায্য অধিকার তাদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষই প্যালেষ্টাইনীদের সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

ইয়াসির আরাফাত এবং প্যালেষ্টাইনী জনসাধারণের সংগ্রাম আজও অব্যাহত আছে ; বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হচ্ছে সংগ্রামের গতিময়তা। সম্প্রতি ফিলিস্তিনীরা একটি শহরও দখল করেছেন। প্যালে- ষ্টানীদের ন্যায় অধিকার এড়িয়ে যাওয়া যে অসম্ভব, তা এখন প্রমাণিত সত্য। প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংস্থা আজ বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশ এবং তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে প্যালেস্টাইনী জনগণের এক মাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত। প্যালেষ্টাইন ইস্যু আজ আর আরব বা মধ্য প্রাচ্যের আঞ্চলিক সমস্যার ব্যাপার নয় ; এটি এখন আন্তর্জাতিক সমস্যা। সমগ্র বিশ্বের শান্তির স্বার্থেই এর দ্রুত সমাধান আশু প্রয়োজন। আর এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, এই সমাধান হচ্ছে ইসরাইলের পরিবর্তে স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্র গঠন এবং তার প্রতি সকলের স্বীকৃতি।

১৯৭৪ সালের ১২ ই নভেম্বরে জাতিসংঘের বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আরাফাত যে কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অভিমত “হত্যায় আমরা বিশ্বাস করিনা। কিন্তু হত্যা এবং সন্ত্রাস সেদিনই বন্ধ হবে, যে দিন ৪০ লক্ষ ছিন্ন মূল প্যালেষ্টাইনী তাদের ন্যায্য অধিকার এবং আশা-আকাঙ্খার বাস্তব রূপায়ন ঘটাতে পারবে।”

কিন্তু ইয়াসির আরাফাতের এমন সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকেও ইসরাইলের কোন কার্যকরি প্রতিক্রিয়া সংসাধিত হয়নি। ইসরাইলের প্রভূ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারো হুমকী দিয়েছে। প্যালেষ্টাইনীদের দখলীকৃত ভূমি ফিরিয়ে দেবার যে-কোন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রদান করবে।

প্যালেষ্টাইনের ভাগ্যাকাশে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য এখনো সুদূর পরাহত। যুদ্ধের মাধ্যমে এই সমস্যা সহজেই মিটে যাবার নয়। তাহলে প্যালেষ্টাইনের আগামী লক্ষ্য পথ কি হবে ? ইয়াসির আরাফাত এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু দিন পূর্বে যে বক্তব্য রেখেছিলেন ; তা অবশ্যই সুষ্ঠু গঠনমূলক অভিমত হিসেবে গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন: “আমরা কমাণ্ডো আক্রমণকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রয়োগ করি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের জনগণের টিকে থাকা নিশ্চিত করা ; তারা যেন তাদের বাড়ী-ঘর ফিরে পায় এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করা। আমরা যখন দেখি, পৃথিবীর যে কোন দেশের লোক ইসরাইলে বসতি স্থাপন করতে পারেন; কিন্তু আমাদের সেখানে যেতে দেয়া হয় না; তখন আমাদের কেমন অবস্থা হয় ভেবে দেখেছেন ? ………. ইসরাইল যদি পৃথিবীর এই অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে সত্যিই আগ্রহী হয়, তাহলে লেবাননের মত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র—যেখানে ইহুদী খ্রীষ্টান এবং মুসলমানরা এক সঙ্গে বসবাস করতে পারে – তার প্রয়োজনীয়তা আছে। সেটাই হবে সর্বোত্তম এবং আদর্শ সমাধান। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই আমাদের ইসরাইলের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনার প্রয়োজন আছে।”

প্যালেষ্টাইন সম্পর্কে আরাফাতের এই বক্তব্য তাদের ভূমি ফিরে পাবার প্রচেষ্টায় স্বয়ংসম্পূর্ণ অভিমত।

সূত্র : প্রবাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত  এবং নজমুল হক ও আবদুস সালাম রচিত “ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম” নামক বই থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88