আল্লামা আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন, বাংলা ১৩৩২-১৩৩৩ সাল মুতাবিক ঈসায়ী ১৯২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। নদীয়া মুসলিম-হিন্দু উভয় জনবসতিতে বেশ বর্ধিষ্ণু জেলা। কৃষ্ণনগর মহকুমার থানা কালিগঞ্জ, ডাকঘর দেবগ্রাম ও গ্রাম খোর্দপলাশীতে আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন-এর জন্ম। পিতা মূসা বিন লুকমান বিন নাসির আল-খাদিম।

সেই ছোট বেলা হতেই মায়ের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা ছিল পুত্রের উচ্চ শিক্ষা দান। গর্ভধারিণী মা যেন বুঝতে পেরেছিলেন তার এ সন্তান মেধা আর স্মৃতিতে অতুলনীয় হবে। ইমাম বুখারী (রহ.) শৈশবে দৃষ্টিহারা হয়ে গেলে মায়ের ইবাদাতে মহান আল্লাহ মহামতি ইমামকে এমন দৃষ্টি দান করলেন, যে চাঁদের আলোয় তিনি লেখা-পড়া করতে পারতেন। মায়ের দু’আয় জগত আলোকিত করলেন আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী। তাই মায়ের দু’আ এক অমূল্য সম্পদ।

শাইখ ‘আলীমুদ্দীন-এর বেলায়ও মায়ের সেই দু’আ আল্লাহর’ কাছে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী কালে তার যথার্থ প্রতিফলন ও উজ্জ্বল স্বাক্ষর তিনি এ পৃথিবীতে রেখে গেছেন।

বাল্য শিক্ষাঃ

গ্রাম্য নিম্ন প্রাইমারী এল. পি. স্কুলে দু’তিন বছর পড়াশুনা করেন। শিক্ষক ছিলেন জনাব আবদুল গনি। অতঃপর ৯ বছর বয়সে প্রখ্যাত আলেম মাওঃ নি’মাতুল্লাহ এবং বিশিষ্ট আলেম ও লেখক মুন্সী ফসিহউদ্দিন সাহেবের ছাত্র মাতৃকুলের মুন্সী শাকের মুহাম্মাদের নিকট পড়াশুনা শুরু করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই কায়দা ও আল-কুরআন পড়া ও সাথে সাথে তা হিফয্ করার তা’লীমে যথেষ্ট মেধার পরিচয় দেন। এক বছর পর মুর্শিদাবাদের মৌঃ আবদুস সাত্তার সাহেবের নিকট কুরআন অধ্যয়নসহ উর্দূ ভাষা শিক্ষা করতে থাকেন।

বাংলা ১৩৪৫ সালে তিনি বড় চাঁদঘর নিবাসী মৌঃ রহমতুল্লার নিকট জানকীনগর জামে মাসজিদে বসে বসে কুরআনুল করীম গভীর মনোনিবেশে অধ্যয়ন করতে থাকেন। এ সময় কালামে পাক সমাপ্ত করেন। ফারসী ভাষাও শিখেন, ফারসী পহেলা আমদনামা মাসদার ফুয়ুয পড়েন।

এক বছর পর তিনি কুলশুনার প্রখ্যাত আলেম মাওঃ নি’য়ামাতুল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় ভর্তি হন। বয়স তখন ১২/১৩ বছর। এক বছরেই মিজান, মুনশায়েব, পাঞ্জেগাঞ্জ, গুলিস্তাঁ প্রভৃতি আরবী, উর্দূ ও ফারসী ভাষা ব্যাকরণ ও সাহিত্যে বেশ বুৎপত্তি অর্জন করেন। পরবর্তী বছর মাওঃ সাহেব ইনতিকাল করলেন। মাদ্রাসাটি যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রায় অচল হয়ে পড়ায় তিনি ঐ মাদ্রাসা ছেড়ে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গার দেবকুণ্ড গ্রামে গমন করেন। এখানে জ্ঞান তাপস মাওঃ কায়কোবাদ সাহেবের নিকট ফারসী গুলিস্তাঁ বুস্তা ও জুলেখার কিয়দংশ, আরবী ব্যাকরণ-সরফে মীর, জোবদা, নাহুমীর অধ্যয়ন করেন। এখানে মাওঃ কায়কোবাদ সাহেবের উস্তাদ বিশিষ্ট পণ্ডিত মাওঃ আবদুল জব্বার সাহেবের নিকটও সবক নেন।

১৩৪৮ বাংলা সালের শেষের দিকে জ্ঞানপিপাসু ‘আলীমুদ্দীন মালদহের কৃতি সন্তান, দিল্লী মাদ্রাসা রাহমানীয়া ও দেওবন্দ ফারেগ প্রখ্যাত আলেম মাওঃ আনিসুর রহমান (মৃত্যু ১৩৫১ বাংলা) সাহেবের নিকট উপস্থিত হন। তাঁর নিকট কুরআন মাজীদ ৫ম পারা পর্যন্ত হিফয করেন। এছাড়া তিনি তিন বছর যাবৎ অর্থাৎ উস্তাদ আনিসুর রহমান সাহেবের মৃত্যু পর্যন্ত ইলমুল কিরাআত, শরহে মিআত আমেল, হিদায়াতুন নাহু, কাফিয়া, শরহে মোল্লা জামি, হানাফী ফিকহের কিতাব মুনিয়াতুল মুসল্লী, কুদুরী, মানতেকের কিতাব-সোগরা-কুবরা, মিরকাত আরবী সাহিত্য-মুফিদুত তালেবীন, কালামে পাকের তরজমা ও মিশকাতের কিয়দংশ অধ্যয়ন করেন। উল্লেখ্য যে, মাওঃ আনিসুর রহমান সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুমের ব্যাকরণ ও বালাগাতের ইমাম নামে খ্যাত প্রখ্যাত আলেম জম্মু-কাশ্মীরের কৃতিমান পণ্ডিত মাওঃ সিদ্দিক হাসানের নাম করা ছাত্র ছিলেন। যেমন উস্তাদ তেমনি ছাত্র, আর সেই ছাত্রের ছাত্রও তেমনি ক্ষুধার জ্ঞান তৃষ্ণার অতৃপ্ত সাধক।

মাওঃ আনিসুর রহমানের তিরোধানের পর আলীমুদ্দীন সাহেব তাঁর উস্তাদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা বেলভাঙ্গায় চলে আসেন। এখানে উস্তাদ শাইখ সুলতান আহমাদের নিকট বুলূগুল মারাম ফি আদিল্লাতিল আহকাম, মিশকাতুল মাসাবীহ ও অন্যান্য বিষয়সহ কুরআনুল কারীম অধ্যয়ন করেন। এই আল্লাহওয়ালা পণ্ডিত শাইখ সুলতান আহমাদ সাহেব দিল্লীর সদররূপে মশহুর শাইখুল হাদীস মাওঃ আবদুল ওয়াহাবের ছাত্র ছিলেন।

একনিষ্ঠভাবে জ্ঞান অন্বেষণের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এবার ‘আলীমুদ্দীন সাহেব বাংলা ছেড়ে উত্তর প্রদেশের জ্ঞানকেন্দ্র সাহারানপুরে উপস্থিত হন। গৃহের বন্ধন, স্বজাতির মায়া সব কিছু ত্যাগ করে জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুমে উপস্থিত হন। ইতোপূর্বে উল্লেখিত প্রখ্যাত জ্ঞান তাপস শাইখ সিদ্দিক হাসান সাহেবের নিকট শরহে জামি, কাফিয়া পুনরায় অধ্যয়ন করেন। ফিকহের কিতাব কানজুদ্ দাকায়েক, শরহে তাহজীব, তালধিসুল মিফতাহ ও ইলমে তাজবীদের কিতাব অধ্যয়ন করেন। এখানে ফকীহ আলী আকবর, মুহাদ্দিস জহুরুল হাসান প্রমুখ যশস্বী উস্তাদের নিকট গভীর আগ্রহ সহকারে জ্ঞানার্জন করতে থাকেন। এখানে ৮০০ (আটশত) ছাত্রের মধ্যে তিনি প্রথম স্থানের অধিকারী হয়ে সকলের প্রশংসাভাজন হন।

মেধা প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থানের অধিকারী হওয়ায়, তাতে আবার একজন আহলে হাদীস-ছাত্র হওয়ার কারণে ঈর্ষাকাতর সহপাঠী হানাফী ছাত্ররা তাঁকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। এমতাবস্থায় তাঁর এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করা আর নিরাপদ ছিল না, তাই তিনি দিল্লীর মাদ্রাসা রাহমানীয়ায় চলে যান। তখন ১৯৪৬ সাল সারা ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন প্রায় লক্ষ্যে উপনীত। এই রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে জ্ঞান তাপস ‘আলীমুদ্দীন সাহেব দিল্লীর মাদ্রাসা রাহমানীয়ার দরগাহে অখণ্ড মনোনিবেশে অধ্যয়নে মগ্ন। কুরআনুল কারীমের তাফসীর, তাজবীদ, হাদীস, ভাষা, সাহিত্য, মানতেক ও ফিকহ বিষয়ে মাদ্রাসা রাহমানীয়ায় পড়াশুনা করেন। এ সময়ে রাজনৈতিক অবস্থা খুব অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। তবুও তার লেখাপড়া থেমে থাকেনি।

এ সময়ে গুজরাটের সুরাট জিলার সামরুদে ছিলেন তদানীন্তন ভারতবর্ষের মুহাদ্দিসকূল ভূষণ শাইখুল হাদীস আল্লামা আবদুল জলীল সামরুদী (রহ.)। গভীর পাণ্ডিত্যের যেমন অধিকারী ছিলেন তিনি, তেমনি বাহাস মুবাহাসায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই সময়ে তিনি দিল্লীতে এক বাহাস অনুষ্ঠানে আসেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অপার অনুগ্রহে তাঁরা পরস্পর একত্রে মিলিত হন।

তখন মাদ্রাসা রাহমানীয়ার অবস্থা তৎকালীন রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। দিল্লীর অবস্থা মোটেই নিরাপদ নয় বিধায় ভারত রত্ন শাইখুল হাদীস আল্লামা আবদুল জলীল সামরুদীর সঙ্গে আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন নতুন দিল্লীর পাহাড়গঞ্জে সাক্ষাৎ করেন। সামরুদী সাহেব যুবক ‘আলীমুদ্দীনকে পরীক্ষার উদ্দেশে বেশ আগ্রহ সহকারে লেখাপড়ার খোঁজ খবর নেন। যুবকের মেধা, স্মৃতিশক্তি ও বিদ্যার্জনে গভীর আগ্রহ দেখে সামরুদী সাহেব খুবই প্রীত হন এবং একজন বাঙ্গালী ছাত্রের এহেন প্রতিভায় মুগ্ধ হলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তাঁকে উপযুক্ত তা’লীম দিলে কুরআন ও হাদীসের খিদমাত হবে। ফলে সামরুদী সাহেব তাঁকে নিজ খরচে গুজরাটে নিয়ে যান। সামরুদী সাহেবের নিজস্ব মাদ্রাসায় ভর্তি করে নিজ বাড়ীতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই বছর রজব মাসে আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন গুজরাটে যান।

১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ৭ বছর আল্লামা সামরুদী সাহেবের একান্ত সান্নিধ্যে অবস্থান করেন জনাব ‘আলীমুদ্দীন। এ সময়ে জ্ঞানের জগতে জনাব ‘আলীমুদ্দীন সাহেব যেন নতুনভাবে প্রবেশ করেন। অসাধারণ বিদ্যাবত্তা, কুরআনের অগাধ পাণ্ডিত্য, হাদীসের নিখুঁত জ্ঞান এবং ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়সহ আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বাস্তব নমুনা যেন আল্লামা আবদুল জলীল সামরুদী (রহ.)।

ইতোপূর্বে অর্জিত জ্ঞান যেন সামরুদী সাহেবের সংস্পর্শে এসে স্নান হয়ে গেল। তিনি পুনরায় মিশকাতুল মাসাবীহ, বুলূগুল মারাম ফী আদিল্লাতিল আহকাম, মুয়াত্তা মালিক, মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, তাহাভী, মুসনাদে আবূ আওয়ানাহ, মুহাররার ফীল হাদীস ও সিহাহ সিত্তাহ অধ্যয়ন করেন। সহীহ বুখারী সুদীর্ঘ তিন বছর ধরে তাহকীকের সাথে অধ্যয়ন করেন। (পরবর্তী জীবনে তিনি ত্রিশ বছরের অধিক কালব্যাপী ছাত্রদেরকে সহীহ বুখারীর দাস দেন)

উসূলে হাদীস : মিশকাতের মুকাদ্দিমা (শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী) এবং তিরমিযীর মুকাদ্দিমা (শাইখ আবদুল কাহির জুরজানী) অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আদ্যোপান্ত অধ্যয়ন করেন।

আবূ দাউদ পড়ার সময় খোদ আবূ দাউদের উসূলে হাদীস সম্পর্কে লিখিত রিসালা, উসূলে হাদীসের বিখ্যাত কিতাব ইবনে হাজার আসকালানী লিখিত শরহে নুখবা, হাফিয ইবনে সালারের কিতাব মুকাদ্দামা, হাফিয আবূ বাকার খতীব বাগদাদীর আল কিফায়াহ, ইমাম হাকেমের উলুমুল হাদীস, ইবনে কাসীরের বায়ানুল হাদীস, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মুনতাকা, মুসনাদ ইমাম শাফিঈ, তাবারানী সগীর, ইমাম বুখারীর আল আদাবুল মুফরাদ, সহীহ মুসলিমের মুকাদ্দিমা, ইরাকীর আলদিয়া ইত্যাদি মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।

তাফসীর : তাফসীরে জালালাইন, তাফসীর জামে’উল বায়ান, তাফসীর ইবনে কাসীর, ফাতহুল কাদীর, তাফসীর ইবনে জারীর আত্ তাবারী। (সর্বমোট ১৪ জন প্রসিদ্ধ আলেমের তাফসীর তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।)

উসূলে তাফসীর : ইমাম ইবনে তাইমমিয়ার কাওয়ায়েদে উসূলে তাফসীর, ফাওযুল কাবীর, আল্লামা সুয়ূতীর ইতকান, আবূ জাফর আন নাআস-এর নাসেখ মানসুখ ইত্যাদি।

রিজাল : মিযানুল ই’তেদাল, তাহযীবুত্ তাহযীব, তাযকীরাতুল হুফফায, আল ইসাবা ও ইমাম ইবনে আবি হাতেমের কিতাবুল ইলাল ইত্যাদি।

তাছাড়া ফারায়েজে সিরাজী, সাহিত্যে সাবআ মুয়াল্লাকাহ, আকায়েদে ইবনে খুজায়মাহ প্রণীত কিতাবুত তাওহীদ। তাছাড়া আকীদায়ে সাবুনীয়া, আবুল হাসান আশ-আরীর আল-ইবানাহ এবং শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ প্রভৃতি কিতাব পড়েন।

সাতটি বছর অত্যন্ত পরিশ্রম করে গুজরাটী ভুট্টার রুটি খেয়ে শাইখ ‘আলীমুদ্দীন সাহেব ভারত রত্ন শাইখুল হাদীস আবদুল জলীল সামরুদ্দী (রহ.) সাহেবের নিকট আরবী ভাষা ও সাহিত্য, মানতেক ও দর্শন, আকীদাহ, ইলমুল কুরআন, ই’জাযুল কুরআন, তাফসীরুল কুরআন, উসূলে তাফসীর, হাদীস, উসূলে হাদীস, আসমাউর রিজাল, ইতিহাস ইত্যাদি যা অধ্যয়ন করেছেন এবং যেভাবে যে কিতাবের মধ্যে বিচরণ করেছেন তা শুধু বিস্ময়কর নয়, বরং বর্তমান যুগে বিদ্যার্থীদের নিকট তা অচিন্ত্যনীয়। এই খ্যাতিমান উস্তাদের নিকট হতে হাদীস পঠন ও পাঠনের সনদ লাভ করে শাইখ ‘আলীমুদ্দীন সাহেব গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্মজীবন :

গুজরাট হতে বিদ্যার্জন শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে শাইখ আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন নিজ গ্রামে ‘মাদ্রাসা মুহাম্মাদীয়া’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। উল্লেখ্য পরবর্তী জীবনে তিনি এছাড়াও আরও তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেন। দু’টি বাংলাদেশে অপরটি পশ্চিমবঙ্গে।

ইংরেজী ১৯৬০ সালে স্বগ্রাম ছেড়ে আবার চলে যান সুদূর বোম্বাই। সেই সময়ে সহীহায়েন, সুনানে আরবা’আ, মুয়াত্তা মালিক এবং মুসনাদে আহমাদ- এই আটখানি হাদীস সংকলনের ‘আল মু’জামুল মুফারহাস’ (হাদীস অভিধান) বর্ণমালা ক্রমিক গ্রন্থটি ৬৩ খণ্ডে পাণ্ডলিপি আকারে ছিল। এর মধ্যে মাত্র ৬ খণ্ডে বার্লিনে মুদ্রিত হয়। উক্ত পাণ্ডুলিপি গুলিতে হরকত চিহ্ন ছিল না এবং রাবীদের নামেরও কিছু ত্রুটি ছিল। সেগুলি সংশোধন করে হরকত চিহ্ন দিয়ে সুন্দরভাবে প্রেসকপি প্রস্তুত করে দেয়ার দুরূহ কাজটি করার জন্য শাইখ সাহেবই ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি দীর্ঘ দু’টি বছর সেখানে অবস্থান করে হাফিয আবুল হাজ্জাজ ইউসুফ মিযযী (যিনি ইমাম ইবনে কাসীরের শ্বশুর ও উস্তাদ, ইমাম ইবনে কাইয়িমের উস্তাদ এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়ার সহকর্মী এবং ভক্ত) কৃত ‘তুহফাতুল আশরাফ বি মা’রিফাতিল আতরাফ’ এর পাণ্ডুলিপিতে হরকত দিয়ে ছাপার জন্য প্রস্তুত করেন। এই পাণ্ডুলিপিটি ছিল জিদ্দার বিখ্যাত আলেম ও বিত্তবান আমীর শাইখ নাসিফের গ্রন্থশালায়। তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ এবং আহলে হাদীস পণ্ডিত ছিলেন। বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সাউদ তাঁকে পছন্দ করতেন এবং ঐ গ্রন্থশালাটি বাদশাহর অর্থানুকূল্য লাভ করে সমৃদ্ধ হয়।

পরবর্তীতে শাইখ ‘আলীমুদ্দীন মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে বেলডাঙ্গায় মাদ্রাসা দারুল হাদীস কর্তৃপক্ষের অনুরোধে এক বছর মাদ্রাসা-প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।

মুহাজির বেশে :

১৯৬৪ সালে প্রথমবার শাইখ সাহেব নদীয়া থেকে একাকী সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানের রাজশাহীতে আগমন করেন। ১৯৬৫ সালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব আবদুর রহমান বি.এ.বি.টি. সাহেব ও জনাব শাইখ আবদুল হক হক্কানী সাহেবের আমন্ত্রণে ঢাকায় আগমন করেন এবং মাদ্রাসাতুল হাদীসে দরস্ দিতে শুরু করেন। জমঈয়ত প্রকাশিত মাসিক তর্জুমানুল হাদীসের সাময়িক প্রসঙ্গ-মাসআলা ও মাসায়েল বিভাগটির পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় মাসিক তর্জুমানে তাঁর বহু গ্রন্থ প্রবন্ধ ও ফাতওয়া প্রকাশিত হয়।

১৯৬৭ সালে নদীয়া ছেড়ে সপরিবারে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন, ঢাকা জিলার রূপগঞ্জ থানার ভোলাবো গ্রামে জমি বিনিময় করেন। বসতবাড়ী ও কৃষি জমি মিলে সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২৪ বিঘা। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঐ স্থানে অবস্থান করে তা’লীম, তাদরীস, তাসনীফ ও জমঈয়তের তাবলীগের কাজে ব্যাপৃত থাকেন। ১৯৭৪ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচরুখীতে স্থানীয় দীনী ভাইদের সক্রিয় সহযোগিতায় মাদ্রাসা দারুল হাদীস সালাফীয়া প্ৰতিষ্ঠা করেন। এই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠায় আলহাজ্জ ইউসুফ আলী ফকীর (রহ.)-এর সক্রিয় অবদান উল্লেখযোগ্য। এখানেই তিনি জীবনের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত অবস্থান করেন। ১৯৮২ সালে মেহেরপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এভাবেই ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত শাইখ ‘আলীমুদ্দীন সাহেবের মুহাজির যিন্দেগী নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়।

জমঈয়তে আহলে হাদীস ও শাইখ আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন

১৯৬৫ সাল থেকে ইনতিকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মরহুম জমঈয়তে আহলে হাদীসের অন্যতম শীর্ষনেতা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন ফাতওয়া ও মাসায়েল বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তি। ফাতওয়া প্রদানের বিষয়টি ছিল তাঁর অন্যতম দায়িত্ব এবং তা ছিল সর্বজন স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য। তিনি মাসিক তর্জুমানুল হাদীসে লিখেছেন এবং সাপ্তাহিক আরাফাতেও তাঁর কলাম ছিল স্মরণীয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছর জমঈয়তের মুখপত্র সাপ্তাহিক আরাফাতের কুরআনুল কারীমের তরজমা, মিশকাতের অনুবাদ, প্রবন্ধ ও মাসআলা মাসায়েল-এর দ্বারা যে খিদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন তা সমগ্র তাওহীদী জনতা যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে।

বহু সভা, সমিতি, জলসা, কনফারেন্স, সেমিনারের মধ্যমণি ছিলেন শাইখ সাহেব। অনেক বাহাসে তিনি প্রতিপক্ষকে লা-জবাব করে দিয়েছেন। তিনি সুদীর্ঘ দিন ধরে অর্থাৎ ইনতিকালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের সহ-সভাপতি ছিলেন। আল্লাহর’ নাবী (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামাতের আগে ইল্‌ম উঠিয়ে নেয়া হবে প্রকৃত আলেমের মৃত্যু ঘটিয়ে। উক্তিটি কতই না যথার্থ। যেমন আলেম চলে যাচ্ছেন তেমনটি আর তৈরী হচ্ছে না। শূন্যপদ পূরণ হচ্ছে কিন্তু শূন্যতার পরিধি ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। প্রকৃত ইলমের স্থলে জাহালাত-অজ্ঞতা আসন করে নিচ্ছে। এটা কতই না দুঃখের বিষয়।

গ্রন্থ রচনায় শাইখ :

তিনি যেমন ছিলেন অধ্যয়নকারী, জ্ঞান সাধনায় গভীর অভিনিবেশকারী, তেমনি ছিলেন কলমসেবী। ছাত্রজীবন থেকে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও সেই প্রতিভা বিক্রি করে তিনি নিজেকে ধনাঢ্য করে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কখনও করেননি। পড়াশুনা শেষে গৃহে ফিরে মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করে বিনা বেতনে অধ্যাপনার কাজ করেছেন। ইনতিকালের কিছু পূর্বে পাঁচরুখী দারুল হাদীস সালাফীয়া মাদ্রাসা হতে তিনি বিদায় নেন। কর্তৃপক্ষ তাঁকে যে বেতন দিতেন তা থেকে তার খাওয়া খরচ বাদে বাকী অর্থ তিনি মাদ্রাসার তহবিলে জমা দিতেন। একেই বলে বে-নযীর অধ্যাপনা।

শাইখ আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন যেমন গভীর অভিনিবেশ সহকারে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ পড়েছেন, তেমনি লিখেছেনও অনেক। তার লিখিত গ্রন্থগুলি হচ্ছে :

১। কিতাবুদ দু’আ

২। নতুন চাঁদ

৩। তাফসীর আম্মাপারা

৪। হাজ্জ উমরাহ ও যিয়ারাত (অনুবাদ)

৫। অসূলে দীন

৬। রোযা ও তারাবীহ

৭। ইসলামে বিজাতীয় অনুপ্রবেশ (ফিরকাবন্দীর মূল উৎস)

৮। মুসলিম দুনিয়া ও সমাজতন্ত্রের রূপরেখা

৯। ইসলাম ও দাম্পত্য জীবন

১০। তাকলীদ ও ইসলাম (পাণ্ডুলিপি)

১১। গ্রীক দর্শনে ইসলাম

১২। ইসলাম ও তাসাওউফ

১৩। আল আকীদাতুস সাবুনীয়া (আরবী সংস্করণ) )

১৪। আর রিসালাতুস সানিয়া ফিস সালাত/নামায এবং উহার অপরিহার্য করণীয় (অনুবাদ)

১৫। সহীহুল বুখারীর প্রথম থেকে কিতাবুত তাহারাত পর্যন্ত (অনুবাদ)

১৬। হাদীসে রাসূল ও আধুনিক বিজ্ঞান

১৭। মেহরাবের তত্ত্বসার

১৮। ধর্মীয় শিক্ষানীতি – অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ও ওসীয়াতনামা

১৯। কিতাবুদ দু’আ ও সহীহ নামায শিক্ষা

২০। খুতবাতুত তাওহীদ ওয়াস্ সুন্নাহ

২১। মুসলিম জাতির কেন্দ্রবিন্দু : তাওহীদের তত্ত্ব ও সুন্নাহর গুরুত্ব

২২। ধর্ম ও রাজনীতি

২৩। আমীর ও ইমারতের তত্ত্বকথা

২৪। মৃতদের জন্য জীবিতদের করণীয়

২৫। তাফসীরে সূরা মুলক

২৬। ইমাম ইবনে তাইমিয়া জীবনী (পাণ্ডুলিপি)

২৭। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সালাত এবং আকীদা ও যরুরী সহীহমাসআলা

২৮। কিতাবুল ইলম ওয়াল ‘উলামা (আরবী)

২৯। ইসলাম ও অর্থনীতি সমস্যার সমাধান

৩০। হাকীকাতুস সালাত- ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহার কিরাআত।

এছাড়া মাসিক তর্জুমানুল হাদীসে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক আরাফাতে ১৯৬৭ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এবং পশ্চিম বঙ্গে জমঈয়তে আহলে হাদীসের মুখপত্র ‘আহলে হাদীস’ পত্রিকায়, ঢাকা হতে প্রকাশিত ‘দারুস সালাম’ ও ‘আহলে হাদীস দর্পণ’ পত্রিকায় মরহুমের অনেক মূল্যবান লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখক, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার হিসাবে তিনি উভয় বাংলায় সমধিক পরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন।

নিজস্ব গ্রন্থশালা বা কুতুবখানা :

মরহুম শাইখ সাহেব পাঠ্যাবস্থাতেই সাধ্যমত কিতাব সংগ্রহ শুরু করেন। কর্ম-জীবনে এসে তাঁর ঐ সংগ্রহের আগ্রহ আরও বহুগুণে বর্ধিত হয়। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ সহজে করা যেতে পারে এ উদ্দেশে তিনি কুরআন, হাদীস, তাফসীর, উসূলে হাদীস, শরাহ, ফিক্‌হ, ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস বিষয়ে মূল্যবান গ্রন্থরাজি তাঁর কুতুবখানায় সংগ্রহ করেন। ইসলামী বিশ্বকোষ নামক আল আ’লাম, মু’জামুল কুরআন, মু’জামুল হাদীস, অভিধান এবং রিজালের দুষ্প্রাপ্য কিতাবসমূহ তাঁর সংগ্রহে বিদ্যমান। বিভিন্ন তাফসীরকারকের কেবল তাফসীরই আছে ১৪ খানি। আরবী, উর্দু ও ফারসীতেও শাইখ সাহেব খুবই পারদর্শী ছিলেন বিধায় ঐ তিন ভাষারই কিতাব তাঁর সংগ্রহে আছে। ফাতওয়ার কিতাব আছে বেশ ক’টি, যার মধ্যে ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ অন্যতম যা ৩৭ খণ্ডে সমাপ্ত। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এত বিশাল গ্রন্থের সমাবেশ এবং তা দর্শনে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়।

হাজ্জ পালন :

শাইখ ‘আলীমুদ্দীন সাহেব বাংলা ১৩৬৫ সালে প্রথমবার হাজ্জ পালন করেন। ১৯৭৫ সালে দ্বিতীয়বার জ্যেষ্ঠা কন্যা ফাতিমাকে নিয়ে হাজ্জে যান। ২ মাস মদীনায়, আর ১ মাস মক্কা মুয়াযযামায় অবস্থান করেন। ১৯৮০ সালে তৃতীয়বার মাক্কা মুকাররামায় যান এবং তিন মাস অবস্থান করে দেশে ফিরেন। ১৯৮২ সালে চতুর্থবার পবিত্র হারামাইন শরীফাইনে গমন করে ৪ মাস অবস্থান করেন। এই বছরই সউদী আরব সরকার তাঁর অনূদিত ‘হাজ্জ উমরাহ ও যিয়ারাত’ বইটি বাংলাদেশে ৫০ হাজার কপি ও ভারতে ১০ হাজার কপি মুদ্রণ করতঃ বিনামূল্যে বিতরণ করেন। অনেকবার তিনি পবিত্র হারামাইনে গমন করেছেন, আর মিলিত হয়েছেন বিশ্বের সেরা জ্ঞানী পণ্ডিত ও শাইখদের সাথে। পরিচিত হয়েছেন নতুন নতুন গ্রন্থের সাথে। সাথে করে কখনো এনেছেন মূল্যবান কিতাব, আবার কখনো আরব শাইখদের তরফ থেকেও তাঁকে দেয়া হয়েছে অসংখ্য কিতাবের উপহার

আলহাজ্জ ইউসুফ আলী ফকীর (রহ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র আলহাজ্জ ফকীর বদরুজ্জামানকে শাইখ সাহেব সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। তাঁর সাথে ১৯৮৬ সালে পবিত্র হাজ্জ পালন করেন। আলহাজ্জ ইউসুফ আলী ফকীর (রহ.)-এর তৃতীয় সন্তান আলহাজ্জ ফকীর মনিরুজ্জামানকেও শাইখ সাহেব সন্তানের মত অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ১৯৯৯ সালে পবিত্র রামাযান মাসে তাঁর সাথে একত্রে উমরাহ পালন করেন।

তিনি দেশে যেমন ছিলেন সকলের ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র, তেমনি সৌদী আরবের পণ্ডিত মহলেও তাঁর পরিচিতি ছিল সুবিদিত। তিনি বিশ্বখ্যাত আলেম মরহুম শাইখ আবদুল্লাহ বিন বায-এর সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিদ্যাবত্তার গভীরতা, আরবী সাহিত্যে পাণ্ডিত্য এবং হাদীস ও রিজাল শাস্ত্রে গভীর বুৎপত্তি সৌদি আরবেও সুপরিচিত ছিল। সউদী আরব সরকারের অধীনস্থ দারুল ইফতা দাওয়াত ও ইরশাদ বিভাগের প্রকাশনা দফতরের মহা পরিচালক ডঃ আবদুল্লাহ বিন আহমাদ আল যায়েদ, মাক্কার উম্মুল কু’রা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ ওযায়ের ফারুক ও মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সালেহ আল-জুবাইদীসহ আরও অনেকে আল্লামা ‘আলীমুদ্দীনের নিকট হতে সনদ গ্রহণ করেন, যেহেতু আল্লামা শাইখের সনদে ইমাম বুখারী (রহ.) পর্যন্ত ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। সর্বশেষ ২০০০ সালে জীবনের শেষবারের মত তিনি পবিত্র হাজ্জব্রত পালন করেন।

মহানাবী (সাঃ)-এর হাদীসকে যারা বিকৃত, জাল বা মিথ্যা মোড়কে সাজিয়ে সমাজে চালু করেছে তাদের সেই ঘৃণ্য অপচেষ্টা নস্যাৎ করে যুগ স্মরণীয় মুহাদ্দিসকুল যে আসমাউর রিজাল পেশ করে দীন হিফাযত ও শরীয়তকে নিখাদ করেছেন, সেই অমূল্য জ্ঞান ভাণ্ডার রিজাল শাস্ত্রের সুপণ্ডিত ছিলেন আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন। উল্লেখ্য উপমহাদেশে রিজাল শাস্ত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পণ্ডিত হিসাবে তিনি স্বকীয় মর্যাদায় খ্যাতি অর্জন করেন। আরবী ভাষা, সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কার বাগধারা, কুরআনের তাফসীর, হাদীস, উসূলে হাদীস, শরাহ, ফিক্হ এবং ইতিহাসে যাঁর বিচরণ বিস্ময়কর- তিনিই শাইখুল হাদীস আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন। অধ্যয়ন আর গ্রন্থ সংগ্রহে তাঁর জুড়ি নিতান্তই দুর্লভ। এমন এমন দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান কিতাব তাঁর সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত যা দর্শনে পণ্ডিত হৃদয় শুধু পুলকিত নয়, বরং পরিতৃপ্ত। লেখার জগতেও তাঁর কলম থেমে ছিল না। ত্রিশটির মত গ্রন্থ ছাপার হরফে প্রকাশিত, আর অনেকগুলো এখনও পাণ্ডুলিপি আকারে। সংগৃহীত গ্রন্থ কেবল আলমারিতে সাজিয়ে নয়, বরং প্রতিটি গ্রন্থ অখণ্ড মনোনিবেশে অধীত, টীকা টিপ্পনী সংযোজন বা ত্রুটি নির্দেশনায় চিহ্নিতকৃত।

পারিবারিক জীবন :

শাইখ সাহেবের ৮ জন পুত্র এবং ৪ জন কন্যা। তিন পুত্র ও তিন কন্যা ইহজগতে নেই। জ্যেষ্ঠা কন্যা ফাতিমাকে ১৯৭৪ সালে মুর্শিদাবাদের শাইখ আবূ আবদুল্লাহ নুসরতুল্লাহ সাহেবের সাথে বিবাহ দেন। তিনি তখন মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করতেন। ফাতিমা ১৯৮২ সালে মাদীনায় বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় মারা যান এবং জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফন করা হয়। শাইখ সাহেব তখন মাদীনাতেই অবস্থান করছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মাদের জন্ম বাংলা ১৩৬১ সালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এ. অনার্স সহ এম.এ. পাশ করেন। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ বছর যাবৎ চাকুরীরত আছেন। ২য়, ৩য় ও ৪র্থ পুত্ৰ যথাক্রমে ইয়াহইয়া, আহমাদ এবং ইসমাঈল মেহেরপুরে ব্যবসায়ে রত। ছোট ছেলে ইসহাক মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে।

বিচিত্র এক জীবন শাইখের। কোথায় জন্ম, কোথায় লেখাপড়া, কোথায় কর্মস্থল, কোথায় বসতি, আর শেষ শয্যা কোথায় হল! এজন্যই আল-কুরআন ঘোষণা করছে : ‘কিয়ামাতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর’ নিকট রয়েছে, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা জরায়ুতে আছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ব বিষয়ে অবহিত।” (সূরা লুকমান ৩৪)

পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমান বাংলাদেশে হিজরত করে এসে তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছেন। ছেলে-মেয়ে, সংসার নিয়ে কত জায়গায় ঠাঁই খুঁজেছেন

কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় সেই স্থান ত্যাগ করতে হয়েছে। এত বড় একজন আলেমে দীন, রিজাল শাস্ত্রের চলন্ত ডিকশনারী, হাদীসের অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী যেখানে পাওয়ার কথা একটু নিরাপত্তা ও সম্মানের স্থান, সেখানে তাকে যাযাবরের মত ঘুরতে হয়েছে জীবনের শ্রেষ্ঠাংশে। তার আত্মপ্রচার ছিল না। ছিল না ইল্‌ম ও ‘আমলের বাহাদুরী। ছিল না বিদ্যাবত্তার অহমিকা প্রদর্শন। এই সরল সহজ সাদামাটা মানুষটিকে সমাজ যথাসময়ে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

১৯৮১-১৯৮২ সালের স্বচক্ষে দেখা একটি বর্ণনা। কত দীর্ঘ সময় ধরে অন্তর ঢেলে হৃদয় জুড়ে কুরআন তিলাওয়াত করেই চলেছেন। বিষয়বস্তুর অনুধাবনে কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে কাঁপছে। দু’ চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে রুকূ, সিজদাহ করছেন, আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, আর কত দু’আ ইসতিগফার করছেন! জায়নামায সিক্ত হল। দেহ মন-প্রাণ উজাড় করে প্রভুর নিকট আত্ম-নিবেদনের যে আকুতি তা কতই না কাম্য, অথচ কতই না দুর্লভ! এমনিভাবে ফজর হয়ে গেল। সেদিনের দুর্লভ রাত আমার জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। সত্যিই তিনি সাধক ছিলেন।

ইংরেজী ২০০১ সালের শুরু থেকেই তাঁর শরীর মোটেই ভাল যাচ্ছিল না। বাতের বেদনা ছাড়াও নানা অসুবিধা ভোগ করছিলেন। তবুও তাঁর লেখাপড়া থেমে ছিল না।

শাইখ আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীনকে তাঁর রোগ শয্যায় বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে দেখেছি, আল্লাহর নাবী (সাঃ)- এর হাদীস গ্রন্থ হাতে নিয়েই আছেন— মুহব্বতে রাসূলের তৃষ্ণায়। সারাটা জীবন দিয়ে যেন তিনি দেখতেন মুহাদ্দিসকুল শিরোমণি ইমাম বুখারীকে, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে, ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন প্রমুখকে। তাঁদের নযীরবিহীন ইলুমের সরোবরে যেন অবগাহন করতেই শাইখ আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন বাংলার যমীনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রোগের কোন উন্নতি হওয়ার আশা না থাকায় তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁকে তাঁর মেহেরপুরের নিবাসেই নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু না- তাঁর জীবনের দিন যে ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। তিনি আবার অস্থির হয়ে উঠেন, ঢাকা নিবাসী তাঁর স্নেহধন্য ইউসুফ ইয়াসীন ও বেগম ইউসুফের বাসায় আসার জন্য। অবশেষে তাঁর আদেশের কাছে নত হয়ে মেহেরপুর থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে ইউসুফ ইয়াসীন সাহেবের বাসায় আসেন, সেখান থেকে তাঁর বড় ছেলে আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ-এর বাসায় এবং শেষে ইবনে সিনা হাসপাতালে পুনরায় ভর্তি করা হয়। সব চেষ্টা, সব রোগ প্রতিকারের ব্যবস্থা বাতিল করে তিনি চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে, আলমে বারযাখে।

১২ জুনের দিবাগত রাতে ইলমে হাদীস ও রিজাল শাস্ত্রের একটা অধ্যায়ের ইতি টেনে দুই বাংলার অসংখ্য ভক্ত-ছাত্র-শিক্ষক গুণগ্রাহীকে পিছনে ফেলে রেখে এ পৃথিবীর মায়া মমতা ত্যাগ করে চলে যান মহান মা’বুদের ডাকে- ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাযিউন’। তাঁরা আজ শোকাহত-বিচ্ছেদ বেদনায় মুহ্যমান। ১৩ জুন, ২০০১ তারিখ বাদ যোহর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বংশাল আহলে হাদীস জামে মাসজিদে তাঁর জানাযা হয়। শেষ হল ৭৫ বছর ব্যাপী একটি জীবন, যে জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায়, নানা প্রতিকূলতায় অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা এবং বেনযীর অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়ে ভরপুর। বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের মুহতারাম সভাপতি ডঃ এম, এ বারী, মধ্যপ্রাচ্যের বিদেশী সংস্থার আরব ভ্রাতৃবৃন্দসহ সকল স্তরের আহলে হাদীস নেতা কর্মী এবং বিপুল সংখ্যক শোকাকুল মানুষ বাদ যোহর তাঁর জানাযায় শরীক হন। অতঃপর ঐতিহাসিক বালাকোটের মুজাহিদ গাজীসহ অনেক খ্যাতনামা উলামায়ে কেরামের অন্তিম আবাসস্থল ঢাকার বংশাল মালিবাগের পেয়ালাওয়ালা মাসজিদের কবরস্থান— ১৯৯৩ সালের ৩০শে মার্চে মৃত্যুবরণকারী মরহুমের জীবনসঙ্গিণীও যেখানে চির-নিদ্রায় নিদ্রিত সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।

অর্ধ শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন ছিলেন এপার বাংলা-ওপার বাংলার বরেণ্য ও শ্রেষ্ঠ আলেম। তার ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, আর বিস্ময়কর স্মরণশক্তি। হাদীসের রাবীদের জীবনকথা যেন তাঁর মুখস্থ। যে কোন রাবীর নাম করলেই তিনি তাঁর ইতিবৃত্ত সাথে সাথে বলে দিতেন।

নদীয়া থেকে সুদূর দিল্লী- দিল্লী থেকে বহুদূরে গুজরাটের সামরুদ। সেখানেই জ্ঞান পিপাসা নিবারণে ছুটে যাওয়া। বছরের পর বছর পেরিয়ে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে যখন মশগুল তখনই নদীয়াতে শৈশবেই মাতৃবিয়োগ হল। জীবনে তিনি অনেক দুঃখ-অনেক বেদনা সবই সইলেন। কিন্তু জ্ঞানার্জনে ছেদ পড়ুক এটা কোন দিন চাননি।

তিনি একাধারে শিক্ষক, শিক্ষা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, মুবাল্লিগ, মুবাহিস, মুফতী, দাঈ, গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক, পাঠক, রিজাল শাস্ত্রের অনন্য পণ্ডিত, গ্রন্থ সংগ্রাহক (আপন সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করণে), বহুদর্শী আধ্যাত্মিক পুরুষ। সাধারণ মানের খাদ্য গ্রহণে প্ৰফুল্ল হৃদয়ে পরিতৃপ্ত হতেন। কিন্তু তাঁকে কখনও জ্ঞানার্জনে, অধ্যয়নে পরিতৃপ্ত হতে দেখিনি। অতৃপ্ত জ্ঞান পিপাসা যেন তাঁকে অস্থির করে তুলত। নতুন মূল্যবান বই পেলেই তা পড়ে শেষ না করা পর্যন্ত তাকে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করত না।

তিনি ছিলেন আত্মপ্রচার বিমুখ। অন্যের নিকট হতে ইল্‌ম ও ‘আমলের বিনিময়ে কিছু প্রাপ্তি— এ যেন তাঁর নিকট ছিল অনাবশ্যক চাহিদা। তাঁর চাহিদার সীমা ছিল ঠিক ততটুকু যতটুকু একটা মানুষের মামুলিভাবে খেয়ে পরে থাকা যায়। ব্যস এতটুকু। কোথাও যেতে হলে যেতেন নিজের নিকট যথেষ্ট পাথেয় থাকলে অন্যেরটা নিতেন না কিংবা না থাকলে ততটুকু নিতেন যা গন্তব্যে পৌঁছে দিবে, বাড়তি নয়। এসব স্মরণীয় অনুকরণীয় বরেণ্য দীনের জন্য নিবেদিত মর্দে মু’মিন তো ঐ জীবনকে অনুসরণ করেন যা নাবী ও রাসূলগণ করেছেন দেশ ও জাতির সুপথ প্রদর্শনের জন্য। তাদের প্রসঙ্গে আল-কুরআন ঘোষণা করেছে যা নাবী-রাসূলগণ তাদের জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন :

“আমি তোমাদের নিকট- এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট।” (সূরা শু’আরা ১০৯)

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan