ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের আলেখ্য

১৯৬৪ সালের বর্ষ শুরুর প্রাক্কালে একদল ফিলিস্তিনী কমাণ্ডো জর্দান এবং ইসরাইলী যুদ্ধবিরতি এলাকা দিয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করে ফিলিস্তিনে ইহুদী হানাদারদের উপর হামলা করার জন্যে। এ অভিযানে অংশ নেন একদল অশিক্ষিত, অস্ত্রশস্ত্রহীন উদ্বাস্তু। কিন্তু এই ক্ষুদ্র অভিযান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক কাঠামো এবং এ এলাকার সংঘর্ষের প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করে। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনীদের ভাগ্য নির্ধারণে আরব রাষ্ট্রবর্গ বা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠির ভূমিকার চেয়ে আত্মনির্ভরতা ও আত্মপ্রত্যয়ের অভিব্যাক্তি ঘটে।

সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে বৈশিষ্ট্যহীন এই প্রথম অভিযান পরিচালনা করেন ফিলিস্তিন জাতীয় মুক্তি আন্দোলন আল-ফাতাহর সামরিক বিভাগ। এটা শুধু ইসরাইল নয় বরং আরব রাষ্ট্রবর্গের জন্যেও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। ১৯৪৮ সালে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রসমূহ ফিলিস্তিনীদের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার ভোগ করে আসছিল। পরবর্তী ১৬ বছরে ফিলিস্তিনীদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা শত্রু কবলিত উদ্বাস্তু শিবিরে অথবা রাষ্ট্রহীন ভাবে আরব ভাইদের শাসিত রাষ্ট্রেই রয়ে গেলো। ফিলিস্তিনী হিসেবে পরিচয় দানের স্বাধীন ইচ্ছা অবদমিত রয়ে গেলো। সুতরাং রাজনীতি সচেতন ফিলিস্তিনীরা আরব ন্যাশনালিষ্ট মুভমেন্ট এবং বাথ পার্টি’র মত চরমপন্থী আরব জাতীয় আন্দোলনে ঢুকে পড়ল।

১৯৫৬ সালে মিশরের বিরুদ্ধে ত্রিপক্ষীয় হামলার পর একদল ফিলিস্তিনী গাজা এলাকায় রাজনৈতিক পদ্ধতি সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। এটাই স্বাধীন প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্ম দেয়। কায়রোর ফিলিস্তিন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত এবং তার কয়েকজন সহকর্মী ‘আলফাতাহ’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। যা ফিলিস্তিনীদের ব্যাপারে আরব রাষ্ট্র বর্গে’র একচেটিয়া কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার জন্যে স্বাধীনভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে।

এই স্বাধীন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি আরব রাষ্ট্রবর্গের চাপ এবং বিরোধিতা সত্ত্বেও ক্রমেই আলফাতাহ সংগঠিত হয় এবং আলজিরিয়ার বিপ্লবী এবং ১৯৬৩ সাল থেকে সিরিয়ার বাথদলীয় সরকারের কাছ থেকে সাহায্য লাভ করে। এই সাহায্য নিয়েই তারা প্রথম অভিযান পরিচালনা করে।

১৯৬০ সালে আরব রাষ্ট্রবর্গ ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (P.L.O) গঠন করলে আল-ফাতাহ ফিলিস্তিনীদের উপর আরব রাষ্ট্রবর্গের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার পুনঃ প্রচেষ্টা হিসেবে এটাকে দেখে! আরাফাত এবং তাঁর সহকর্মীরা জর্দান নদীর প্রধান স্রোত পরিবর্তনের ইস্রাইলী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে আরব রাষ্ট্রবর্গের অক্ষমতা এবং অনিচ্ছা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।

তারা পি, এল, ও কে কার্য ক্ষমতাহীন কাগুজে কমিটি হিসেবে বাতিল করেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখেন।

১৯৬৫ সালের ১লা জানুয়ারী প্রথম অভিযান চালানো হয় এবং আল-ফাতাহর সামরিক বিভাগ আল-আসিফা তাদের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করে। ১৯৪৮ সালের পর প্রথম বারের মত ফিলিস্তিনীরা সংগঠিত হলো। প্যালেষ্টাইনীদের নেতৃত্বাধীন সংস্থা ফিলিস্তিনের জন্যে লড়তে এবং মরতে অঙ্গীকার করল এবং আরব রাষ্ট্রবর্গের মনোভাবের প্রতি অমনোযোগী হল।

১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধের আগে মাত্র আড়াই বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের নিমিত্তে গড়ে ওঠা আল-ফাতাহ এবং অন্যান্য ছোট ছোট সংস্থা দু’দিকের শত্রুর মোকাবিলায় বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হলো।

ইসরাইল ছাড়াও জর্দানের হাশেমীয় বংশোদ্ভূত সরকারের সঙ্গে তাদের সমস্যা ছিল। জর্দান ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর পুরাতন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরস্থ অবশিষ্টাংশ নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছে। জর্দান কোন স্বাধীন ফিলিস্তিনী সংস্থাকে নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখে আসছে। আল-আসিফার প্রথম শহীদ ইসরাইলের হাতে নয়, জর্দানী সৈন্যের হাতে। জর্দানী গোয়েন্দা বাহিনী ১৯৬৭ সালে ধীরে ধীরে সংহত প্রতিরোধ বাহিনীর গেরিলা এবং তাদের সমর্থকদের বিরাট তালিকা প্রস্তুত করেছিল ইসরাইলীদের দেয়ার জন্যে। এছাড়া অন্য কয়েকটি আরব রাষ্ট্রও প্রতিরোধ সংগ্রামের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। আরব লীগ আরব সংবাদপত্র সমূহের প্রতি আবেদন জানিয়েছে আল-ফাতাহর সামরিক ইশতেহার প্রকাশ না করার জন্যে। সরকারী উদ্যোগে পত্রিকাগুলোকে বলা হয়েছিল যে, গেরিলা কার্যক্রম ইসরাইলী চরদের দ্বারা সংগঠিত হচ্ছে। পি, এল, ও, আল-ফাতাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।

প্রতিরোধ আন্দোলন যখন কিছুটা সংগঠিত হলো এবং ইসরালীদেৱ উত্যক্ত করা শুরু করল তখন তারা পার্শ্ববর্তী আরব গ্রামে প্রতিশোধাত্মক হামলা শুরু করলো, অপরদিকে ৬৭’র জুন যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগেই জাতিসংঘে ইসরাইলী প্রতিনিধি অধিকৃত ফিলিস্তিনে আক্রমণের ধারা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বিশেষভাবে আল ফাতাহকে দায়ী করেছে। ইসরাইলী নির্যাতন বা আরবদের চাপ কোনটাই প্রতিরোধ সংগ্রামকে প্রতিহত করতে পারলো না। আল-ফাতাহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পি, এল, ও, সদস্যেরও মন জয় করতে পেরেছে। জুন যুদ্ধ যখন শুরু হলো ফিলিস্তিনী গেরিলারা আরবদের সঙ্গে তাদের শক্তি যুক্ত করল এবং পশ্চিম তীরও গাজা এলাকায় অগ্রসরমান ইসরাইলীদের মোকাবিলার আরব বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলে গেরিলারা প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে, জুন যুদ্ধের পর গেরিলারা দেখতে পেলেন যে, তারা বিরাট রাজনৈতিক সুযোগ হস্তগত করেছে। আরবদের পদক্ষেপে ফিলিস্তিন মুক্ত হবে এ পৌরাণিক কথা বাতিল হয়ে গেলো। যুদ্ধের পর প্রতিটি ফিলিস্তিনী হয় বিদেশীদের দখলীকৃত এলাকায় নতুবা প্রবাসে ছিল। জুনের শেষে আল-ফাতাহ নেতৃবৃন্দ গেরিলা তৎপরতা শুরু করার জন্য আলোচনা করতে বসলেন। অন্য তিনটি দলের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছতে না পেরে আল-ফাতাহ আগষ্টে পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করে। অন্যান্য দলগুলো পরবর্তীকালে পপুলার ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অব প্যালেষ্টাইন (P.F.L.P.) নামে আরব জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত একটি সংস্থা গঠন করে। এ সময় আল-আসিফার বহু অফিসার শহীদ হন এবং গেরিলারা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন। অপর দিকে ইসরাইল জর্দানী গোয়েন্দা বাহিনীর রেকর্ড দখল করে অনেক গেরিলা সমর্থককে গ্রেফতার করে।

জুন যুদ্ধে পরাজয়ের মারাত্মক গ্লানি সত্ত্বেও গেরিলারা প্রতিরোধ তৎপরতা শুরু করায় প্যালেষ্টাইনী এবং আরব জনগণ বুঝতে পারল যে গেরিলারা শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত। মিশর এবং সিরিয়া নিজেরা অভিযান চালাতে অসমর্থ হয়ে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামকে সাহায্য করতে লাগল। কেবল মাত্র জর্দানের বাদশাহ হোসেন গেরিলাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান এবং তার বাহিনীকে নির্দেশ দেন গেরিলাদের জর্দান নদী অতিক্রম প্রতিহত করার জন্যে। সেনাবাহিনী বেশীর ভাগ আদেশ অবজ্ঞা করে, কেননা তাদের অনেকে নিজেরাই ফিলিস্তিনী ছিলেন। কমাণ্ডোদের হামলায় ইসরাইলীরা বিরক্ত হয়ে উঠে, অবশেষে ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে ইসরাইল জর্দানের ওপর প্রতিশোধাত্মক হামলা চালায়। ফলে গেরিলারা রাজনৈতিক স্বীকৃতি লাভ করে যা আরব বিশ্বে গেরিলাদের প্রাধান্যের জন্যে প্রয়োজনীয় ছিল।

কারামেহ গ্রামে ইসরাইলী হামলা প্রতিরোধ সংগ্রামীদের প্রথম সামরিক সাফল্য বয়ে আনে। তারা এতে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার সুযোগ লাভ করে। সমস্ত দিনব্যাপী প্রতিরোধের পর ইসরাইলীদেরকে জর্দান নদী পার হয়ে যেতে বাধ্য করে।

পশ্চাতে বিরাট সংখ্যক ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য যানবাহন ও সঙ্গে অগণিত লাশ নিয়ে ইসরাইলীরা পশ্চাদাপসরণ করে। কারামেহ হাজার অভিযানের পর আরব বিশ্বে আল-ফাতাহর সমর্থন বেড়ে যায় এবং হাজার ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তু আশা ও গর্বের নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়ে আল-ফাতাহর সমর্থনে এগিয়ে আসে। এ পরিবর্তন অনেকটা বৈপ্লবিক।

নতুন রিক্রটদের সাহায্যে গেরিলা সংস্থা ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে এবং অধিকৃত এলাকায় তাদের অভিযানের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে, দেয়।

১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মে ফিলিস্তিন ন্যাশনাল কাউন্সিল, আল-ফাতাহ এবং সিরিয়ার বাথ পার্টি’র সমর্থক আসাইকার প্রথম বৈঠকে পি, এল, ও, আছমদ সুকাইরীকে নেতৃত্বচ্যূত করে। ইয়াসির আরাফাত ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পি, এল, ওর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং কার্য নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। আল-ফাতাহ সংগঠনের কলেবর বৃদ্ধি করে এবং প্রতিরোধ সংগ্রামের অসামরিক শাখা যেমন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে এবং গেরিলা সংগঠনগুলোর সমন্বয়ের জন্য ফিলিস্তিন সশস্ত্র সংগ্রাম কমাণ্ড (পি, এ, এস, সি,) গঠন করে।

প্রতিরোধ সংগঠনের ঐক্য আসেনি। কারণ প্রতিরোধে অংশ গ্রহণ- কারী আরব রাষ্ট্রবর্গের মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। পি. এফ. এল, পি বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে যেমন পি, এফ, এল, পি. জেনারেল কমাণ্ড, ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্যে পপুলার ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট।

পরের সংগঠনটি কড়া মার্কসীয় দর্শনের অনুসারী। কিন্তু ইসরাইলের বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত ভাবে বাড়তে থাকে। ১৯৭০ সালের গ্রীষ্মে একমাসে প্রতিরোধ সংগ্রামীরা অধিকৃত এলাকায় কয়েকশ অভিযান চালায়। এতে ইসরাইলীরা সামরিক দিক থেকে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়। ফলে তারা জর্দান এবং লেবাননী এলাকায় গেরিলা অবস্থান গুলোর উপর প্রতিশোধাত্মক হামলা চালায়।

শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থের প্রতি হুমকি আঁচ করতে পেরে পি, এফ, এল, পি, র একটি ছিনতাই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে জর্দানকে গেরিলাদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” অভিযান চালাতে প্ররোচিত করে। জর্দান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয় যা ইসরাইলীরাও পারেনি।

“ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের” সময় প্রতিবাদ ছাড়া জর্দানী নৃশংসতা থেকে ‘প্রতিরোধ সংগ্রাম’কে রক্ষার জন্যে তেমন কোন কাজ আরব রাষ্ট্র করেনি। ১৯৭১ সালের জুলাইতে গেরিলা আন্দোলন জর্দান থেকে বহিষ্কৃত হলেও মার্কিন, ইসরাইলী এবং জর্দানী বিমানগুলো শেষ লক্ষ্যে পৌঁছতে সমর্থ হয়নি। আম্মান এবং জেরাস সংঘর্ষে প্রতিরোধ সংগ্রাম যে সংহতি অর্জন করেছিল তা অটুট রয়েছে, গেরিলাদের উৎখাতের জর্দানী ও ইসরাইলী উদ্দেশ্যের ঐক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাদশাহ হোসেন এবং প্রধান মন্ত্রী গোল্ডামেয়ার সহ উল্লেখযোগ্য ইসরাইলী নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা আঁচ করতে পেরে গেরিলারা বাদশাহ হোসেনকে উৎখাত করার নীতি গ্রহণ করে। সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচনায় ১৯৭৩ সালের মে মাসে লেবানন সরকার এবং গেরিলাদের মধ্যেও সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষও প্রতিরোধ সংগ্রামকে ধ্বংস করতে সমর্থ হয়নি।

১৯৪৮ সাল থেকে যে সব এলাকা ইসরাইলী জবর দখল করে আছে সে সব এলাকায় ইহুদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করা হয়। কারণ আল-ফাতাহ এবং পি, এল, ওর অন্যান্য অঙ্গদলগুলো তখন লোকদেরকে সংগঠনভূক্ত করেছে যারা ২০ বছর পর্যন্ত ইসরাইল অধিকৃত এলাকায় বসবাস করেছে। তারা মুক্ত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ইহুদীবাদের অবিশ্বাসী এমন কিছু ইহুদীর সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এসব ইহুদীও প্রতিরোধ সংগ্রামীদের সাহায্য করতে শুরু করেছে। ১৯৭৩ সালে ইসরাইলী পার্লামেন্টের জনৈক সদস্যের পত্রকে গেরিলাদের সাথে সংযোগ রক্ষার অভিযোগে জেলে দেয়া হয়েছে।

১৯৭০-৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার একটা সমাধান চাপিয়ে দিতে মার্কিন প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম সারির কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ইসরাইলী শত্রুদের বিরুদ্ধে গেরিলাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আরব রাষ্ট্রবর্গের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে পি, এল, ও,র আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আলোচনায় জটিলতা দেখা দিলেও গেরিলারা ক্রমেই ইহুদীদের জন্যে ভয়ানক রূপ নিতে থাকে। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে বৈরুত অভিযানে ইসরাইলীরা কয়েকজন নেতৃস্থানীয় গেরিলাকে শহীদ করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্যে গেরিলাদের স্বাতন্ত্র্য ও শক্তি সুসংহত থেকে যায়।

১৯৭৩ সালের অক্টোবর যুদ্ধে গেরিলারা শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা বাড়াবার সুযোগই শুধু পায়নি বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধের সময় মিশর এবং সিরিয়া রণক্ষেত্রে অধিকৃত এলাকার মধ্যে থেকে গেরিলারা যুদ্ধ করেছে এবং অসংখ্য ইসরাইলী সৈন্যকে হতাহত করেছে।

যুদ্ধের পর অধিকৃত এলাকায় গেরিলাদের সমর্থনে গণঅভ্যুত্থান দেখা দেয়। অধিকৃত এলাকায় ইসরাইলী শহরগুলোতে অব্যাহত গেরিলা তৎপরতায় ইহুদীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালের ফিলিস্তিন অভিযানের পর ইহুদী নরপশুরা তিনজন গেরিলার লাশকে আগুনে পুড়ে ক্ষোভ মিটায়।

অক্টোবর যুদ্ধের পর পি, এল, ও, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কুটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে।

তারা বিশ্ববাসীকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মূল কারণ আরব-ইসরাইল সংঘর্ষ নয়। প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে ফিলিস্তিনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের। সতর্ক প্রচেষ্টার ফলে পি, এল, ও জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সমর্থন লাভ করে, আফ্রিকান ঐক্য সংস্বার সমর্থন লাভ করে এবং ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করে পি, এল, ওর চেয়ারম্যান হিসেবে ইয়াসির আরাফাত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ভাষণ দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সমর্থকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন পরবর্তী কালে পি, এল, ও, কে স্থায়ী পর্যবেক্ষক এবং প্যালেষ্টাইনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে দু’টি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

রাবাতে আরব শীর্ষ সম্মেলনের পরই জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত আসে। রাবাত শীর্ষ সম্মেলন জর্দান নদীর পশ্চীম তীর থেকে জর্দানী দাবী প্রত্যাহারে জর্দানকে বাধ্য করে। ফিলিস্তিনীদের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হিসেবে ইসরাইলী দখল থেকে ফিলিস্তিনের যে কোন এলাকা মুক্ত করলেই তা পি, এল, ওকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তও শীর্ষ সম্মেলন গ্রহণ করে।

গত দশকে প্রতিরোধ সংগ্রামের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে! পি, এল, ও,কে শুধু ইসরাইলীদের সশস্ত্র হামলার মোকাবিলাই করতে হয়নি উপরন্ত দুনিয়ার বুক থেকে সংস্থাকে জর্দানের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তও মোকাবিলা করতে হয়েছে। সংস্থার অস্তিত্ব এবং প্রতিনিধিত্বকে অস্বীকার করার জন্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সুসংগঠিত প্রচেষ্টার মোকাবেলাও করতে হয়েছে। সকল ষড়যন্ত্র বানচাল হয়েছে।

দশ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের পর আজ ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ অতীতের যে কোন সময়ের চাইতে শক্তিশালী। এর সামরিক অভিযান গুলো শত্রুর মনে দারুণ ভীতির সঞ্চার করেছে। এর কুটনৈতিক অভিযান আন্তর্জাতিক সংস্থার ব্যাপক স্বীকৃতি যুগিয়েছে। এখন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ফিলিস্তিনী জনগণের জাতীয় ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ব্যতিরেকে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

দশ বছর আগে কয়েকজন গেরিলা তামাদী অস্ত্র নিয়ে ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ইসরাইলের ছিল বিশ্বব্যাপী সমর্থন, সর্বাধুনিক অস্ত্র ও সৈন্য এবং মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতা।

ফিলিস্তিন প্রতিরোধের প্রথম দশক সমস্যা এবং সাময়িক অসুবিধা সত্ত্বেও অতুলনীয় সাফল্যের দশক হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।

সূত্র : প্রবাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত  এবং নজমুল হক ও আবদুস সালাম রচিত “ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম” নামক বই থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan