মাদকাসক্তি নিরোধে মহানবী (সা)-এর শিক্ষা

আ.ফ.ম. খালিদ হোসেন

মাদক কি

যে বস্তু বা পানীয় পান করলে বা সেবন করলে বা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দিলে নেশা ধরে এবং যা স্নায়ুতন্ত্রকে (Nervous System) উত্তেজিত করে তাই মাদক। সাধারণত আঙ্গুর, খেজুর, গম, যব, মধু, আপেল, নাশপাতি, ইক্ষু, পীচফল ইত্যাদি থেকে যে মাদক তৈরি হয় তা পানীয়। ওপিয়াম গাছ থেকে যে মাদক তৈরি হয় তা গাঁজা, মরফিন ও হেরোইন নামে পরিচিত।

হাশিশ গাছ থেকেও মাদক তৈরি হয়। অন্যান্য বিভিন্ন গাছ থেকেও মাদক তৈরি হয়। বিভিন্ন বৃক্ষ বা বৃক্ষের ফলকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বর্ণহীন তরল পদার্থে পরিণত করে Alcohol বানানো হয়। এ্যালকোহল ঔষধ তৈরি ও শিল্প কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এর পাশাপাশি এ্যালকোহল ব্যাপকভাবে মদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে দুনিয়াব্যাপী। এ্যালকোহল দিয়ে যে উন্নতমানের মদ তৈরি হয় তার নাম হচ্ছে ব্রাণ্ডি, বিয়ার, হুইস্কি, রাম, জিন, ভদ্‌কা, এইল ইত্যাদি।

আরবী ভাষায় মদকে বলা হয় ‘খামর’, যার আভিধানিক অর্থ হলো আচ্ছন্ন করা। কথিক আছে ‘আল খামরু মা’ খা’মারাল আকুলা’ অর্থাৎ ‘খামর’ ওটাকে বলে, যা পান করলে জ্ঞান ও বুদ্ধি আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। বুখারীর একটি হাদীসে জানা যায়, তৎকালীন আরবে ৫ প্রকার বস্তু দিয়ে মদ তৈরি করা হতো। এগুলো হচ্ছে আঙ্গুর, খেজুর, গম, যব ও মধু। ইসলামে সর্ব প্রকার নেশাজাতীয় বস্তুই হারাম- নাম তার যাই হোক।

মাদকাসক্তির সংজ্ঞা দিতে দিয়ে আমেরিকার National Council on Alcoholism: Alcoholism is an addiction to alcohol that entails several harmful consequences including damage to the brain, liver or other organs as well destructive effects on the alco- holic’s own life and that of alcoholic’s family.’

অর্থাৎ মাদকাসক্তি হচ্ছে এ্যালকোহলজাতীয় পানীয় সেবনের প্রতি অভ্যাস, যা মস্তিষ্ক, যকৃতসহ মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়। শুধু তাই নয়, মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার নিজ জীবন ও তার পরিবারের অন্যদের জীবনও বিপন্ন করে দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ লাখ মানুষ নিয়মিত মাদকাসক্ত এবং আরো ৬০ লাখ মানুষ অনিয়মিত মদ পান করে। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আমেরিকায় যে ২০ হাজার মানুষ মারা যায় তার জন্য এসব মদ্যপায়ীরাই মূলত দায়ী। আমেরিকায় বছরে ২৫ হাজার হত্যাকাণ্ড ও আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। তার পেছনেও রয়েছে মদ ও মাদকের অপব্যবহার। মৃত্যু ছাড়াও মাদকের অপব্যবহারজনিত অপরাপর ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

মাদকের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া

২ অথবা ৩ আউন্স পরিমাণ হুইস্কি পান করলে পানকারীর চিন্তা ও বিচারশক্তি ভোঁতা হয়ে যায়। উদ্বেগ-অস্থিরতা হ্রাস পেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হলেও তা তাৎক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদী। রক্তে এ্যালকোহলের মাত্রা যদি ৩০% ভাগ হয় তাহলে সুরা পানকারীর মানসিক বিভ্রাট ঘটবে এবং ক্রমশ চৈতন্য হারিয়ে ফেলবে; যদি রক্তে এ্যালকোহলের মাত্রা ৪৫% ভাগ হয় তাহলে প্রগাঢ়ভাবে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে; যদি ৭০% ভাগ হয় তাহলে মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যাবে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। অত্যধিক সুরাপানের ফলে কিডনীর সন্নিহিত অঞ্চল উত্তেজিত হয়ে বেশি প্রস্রাব উৎপন্ন করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি অমাদকসেবীর তুলনায় ১০ থেকে ১২ বছর আগে মারা যায়। স্নায়ুতন্ত্র এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তি লোপ পেতে পারে। অমাদকসেবীর তুলনায় মাদকাসক্তদের মুখগহবর, গলা ও স্বরযন্ত্র (Voice Box) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সুরার সাথে যারা ধূমপান করে তাদের পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। গর্ভবতী মহিলা যদি সুরা ও ধূম একসাথে পান করে তা হলে Fetal Alcohol Syndrome দেখা দিতে পারে, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে গর্ভজাত শিশু মানসিক ও শারীরিক বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেবে।

মাদকের ইতিহাস

আজ থেকে ৬০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় সুরা তৈরি হতো এবং তখনকার মানুষ এটা পানে ছিল অভ্যস্ত। অনুরূপভাবে প্রাচীন মিসর, গ্রীস ও রোমেও মদ তৈরি হতো। Mycenaean সভ্যতার যুগে মদ পবিত্র পানীয়-রূপে সমাজে প্রচলিত ছিল। অ্যাসিরিয়ান রাজারাও দ্রাক্ষাক্ষেত করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে বিশাল মদ ভাণ্ডার ছিল এবং যত্নসহকারে বিভিন্ন প্রকার মদের তালিকা সংরক্ষণ করা হতো।

মদ উৎপাদন ও বিপণন

ফ্রান্স পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় মদ উৎপাদনকারী দেশ। পৃথিবীর বার্ষিক মদের চাহিদা হচ্ছে ৪,৫০০,০০০,০০০ গ্যালন। চাহিদার এক-চতুর্থাংশ উৎপাদন করে একা ফ্রান্স। ফ্রান্সের পর জার্মানীর অবস্থান। মদ রফতানীকারী দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার অবস্থান আট-এ। ৯০% ভাগ মদ উৎপন্ন হয় ক্যালিফোর্নিয়ায়। ইতালী, স্পেন, আলজিরিয়া, পর্তুগাল, আর্জেন্টিনা, গ্রীস, যুগোশ্লাভিয়া, চিলি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম মদ উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানীকারক দেশ। ১৯৮০ সালের প্রারম্ভে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে বছরে প্রায় ১৮০ মিলিয়ন ব্যারেল মদ উৎপাদন করে (১ ব্যারেল=৩১ গ্যালন অথবা ১১৭.৩ লিটার)। এ উৎপাদন ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ।

মহানবী (সা)এর বৈপ্লবিক শিক্ষাধারা

ইসলামের মহান পয়গাম্বর সরওয়ারের দো’আলম হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর বহুমাত্রিক শিক্ষার অন্যতম বড় অবদান হচ্ছে: মদ, নেশা ও মাদকাসক্তির ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মানব জাতিকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন। বিশ্বনবী (সা)-এর মাদক- বিরোধী এ শিক্ষা সপ্তম শতাব্দীর এমন এক সন্ধিক্ষণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে, যখন গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজ নেশার জগতে হাবুডুবু খাচ্ছিল; সাদা পানি পান করা তখন দোষের বিষয় ছিল। ইরানী জনগণ শরাবের পেয়ালাকে সমীহ করত প্রাচীন পারস্য-সম্রাট জামশেদের পানপাত্র মনে করে; ভারতে দেবতা ও ঠাকুরের সান্নিধ্য অর্জনের জন্য মদের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত জরুরী। দীন ও দুনিয়ার অনেক রীতি-প্রথা তখন মদের ব্যবহার ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকত; আরবের অনেক কবির কাব্যভাণ্ডার মদ ও মাদকের প্রশস্তি ও প্রশংসায় ছিল পূর্ণ। আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভীর মতে, মদ নিজে পান করা ও অপরকে পান করানো ছিল সে যুগের অভিজাতবর্গের বিলাসিতার অন্যতম মাধ্যম। স্বামী স্ত্রীকে ও ছোটরা বড়দেরকে নিজ হাতে মদ পান করাতো। ঠিক এমন এক নাজুক মুহূর্তে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের মুকাবিলায় মহানবী (সা) মদ পরিহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, মাদক হচ্ছে সব অপরাধের প্রসূতি— “উম্মুল খাবা’য়িছ”। ফিতনা-ফাসাদের অগ্নিশিখাকে প্রজ্বলিত করে দেয় মাদকতা; মাদকাসক্ত মানুষ ভাল-মন্দের পার্থক্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলে; মাদক মানুষকে অন্ধ করে দেয়; মা-বোন-কন্যার পার্থক্য বিলুপ্ত করে দেয় মদের নেশা; দৈহিক তেজ ও মানসিক ভারসাম্য বিলুপ্ত হয়ে যায় মাদকাসক্তির কারণে; মানুষের হাত থেকে ন্যায়-ইনসাফ এবং সত্য ও সততার দাড়িপাল্লা খসে পড়ে একমাত্র মদ ও মাদকতার কারণে। যে সমাজে মাদকাসক্তির প্রাদুর্ভাব ঘটে সেখানে নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ মহামারি আকার ধারণ করে।

বিশ্বনবী (সা) সমাজে প্রজ্বলিত মাদকাসক্তির জাহান্নাম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। এতে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। তিনি অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে মদ্যপান ও মাদক সেবনের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। কারণ মাদকাসক্তি দুনিয়া ও আখিরাতকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেয়; পরিণাম হয় অতি ভয়াবহ। আল্লাহর রাসূল (সা) দাওয়াতের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের মন-মেজায গড়ে তোলেন; তাদের অন্তরে মাদকের ক্ষতির অনুভূতি জাগ্রত করেন। অতঃপর মাদক পরিহারের | হুকুম জারি করেন: “মদ ফেলে দাও এবং এর পান পাত্রগুলো ভেঙ্গে ফেল’। বিশ্বনবী (সা) মদ, জুয়া, কুবা, গোরায়বা প্রভৃতিকে নিষিদ্ধ করে বলেন: নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক বস্তুই মদ এবং তা হলো হারাম। যে বস্তু অধিক পরিমাণে ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি করে, এর সামান্য পরিমাণও হারাম। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, যে ব্যক্তি একবার মদ পান করে আল্লাহ পাক ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামায কবুল করেন না। অবশ্য যদি সে তাওবা করে তবে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। যদি সে দ্বিতীয়বার পুনরায় মদ পান করে, আল্লাহ্ ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামায কবুল করেন না। আবার যদি সে তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবূল করেন। যদি সে আবারও তৃতীয়বার মদ্য পান করে, আল্লাহ্ তার ৪০ দিনের নামায কবুল করেন না। এবার যদি সে তাওবা করে, তাহলে আল্লাহ্ তার তাওবা কবূল করবেন না এবং আল্লাহ তাকে ‘নাহরে খাবাল’ হতে অর্থাৎ জাহান্নামীদের রক্ত ও পুঁজের নহর হতে পানি পান করাবেন। যে ব্যক্তি মদ পান করা হালাল মনে করবে সে কাফির হয়ে যাবে। তিন শ্রেণীর লোকের জন্য আল্লাহ্ পাক বেহেশত হারাম করেছেন। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীভুক্ত হচ্ছে নিত্য মদ্যপানকারী। নিত্য মদ পান অবস্থায় যার মৃত্যু ঘটবে সে মূর্তিপূজকের ন্যায় আল্লাহ্ পাকের সম্মুখীন হবে। অর্থাৎ মাদক সেবন ও মূর্তিপূজা এ দু’য়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন: “আমার মহাপরাক্রমশালী রব তাঁর মহাক্ষমতার শপথ করে বলেছেন: আমার বান্দাদের মধ্যে যে বান্দা এক ঢোক মদ পান করবে, আমি নিশ্চয় তাকে অনুরূপ দোযখীদের পচা পুঁজ পান করাব। আর যে লোক আমার ভয়ে এটা পান করা বর্জন করবে, আমি অবশ্যই পবিত্র কূপ হতে (শরাবে তহুর) তাকে পান করাবো।”

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মাদক সেবনের দ্বারা সাময়িক দেহের বাহ্যিক উপকার ও উন্নতি দেখা গেলেও এর পরিণতি কিন্তু ধ্বংসাত্মক। মাদক সেবনের বিরুদ্ধে ইসলামের স্পষ্ট ও জোরালো ঘোষণা রয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন: “হে রাসূল! মদ ও জুয়ার ব্যাপারে জনগণ আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে। আপনি বলে দিন এ দু’টো হচ্ছে জঘন্য পাপ। এতে মানুষের কিছু উপকার হলেও গোনাহের পরিমাণ কিন্তু বেশি।”

পনর’শ বছর আগে রাহমাতুল লিল আলামীন (সা) মদপান ও মাদক সেবনের মারাত্মক কুফল সম্পর্কে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, আধুনিক বিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিদগণ গবেষণার মাধ্যমে এখন তার সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করে রীতিমত হতবাক হচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, মদ, গাজা, তাড়ি, ভাঙ, ভদকা, হুইস্কি, ব্রাণ্ডি, হিরোইন, ফেন্সিডিলজাতীয় মাদকদ্রব্য কোন ঔষধ নয়; বরং এগুলো নিজেই রোগ। বিশ্বনবী (সা) মদপান ও মাদক সেবনকে শুধু নিরুৎসাহিত করেন নি, মাদকাসক্তদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন: কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তি শুধু নিজকে ধ্বংস করে না, ধ্বংস করে তার পরিবারকে, পুরো সমাজকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

সাহাবী হযরত দায়লামে হিমইয়ারী (রা) বলেন: আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)- এর নিকট আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা শীতপ্রধান দেশে বাস করি এবং সেখানে আমরা কঠোর পরিশ্রম করে কাজ করি। আমরা গম দ্বারা এক প্রকার মদ প্রস্তুত করি। এটা পানে আমাদের দেহে শক্তির সঞ্চার হয়; কঠিন কাজে আমাদের শরীরে শক্তি যোগায়; দেহ ও মনকে সতেজ ও চাঙ্গা করে তোলে। তদ্বারা আমাদের অঞ্চলের শীত হতে আত্মরক্ষা করি। মহানবী (সা) জিজ্ঞেস করলেন: ওটাতে কি নেশা হয়? আমি বললাম, জ্বি হ্যাঁ, তাতে নেশা হয়। তিনি বললেন: ওটা হতে বেঁচে থেকো, পান করো না। আমি বললাম, আমাদের দেশের লোকেরা ওটা বর্জন করবে না। এবার তিনি বললেন, যদি তারা ওটা পরিহার না করে তবে তাদের সাথে যুদ্ধ কর।

মদ ও মাদকদ্রব্যের সাথে সম্পর্কিত ১০ জনের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা) অভিসম্পাত দিয়েছেন: (১) মদ প্রস্তুতকারক (২) মদ প্রস্তুতের উপদেষ্টা (৩) মদ পানকারী (৪) মদ বহনকারী (৫) যার নিকট মদ বহন করা হয় (৬) যে মদ পান করায় (৭) মদ বিক্রেতা (৮) মদের মূল্য গ্রহণকারী (৯) মদ ক্রয়-বিক্রয়কারী (১০) যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়।

মাদক সেবনের দণ্ডবিধি

দুনিয়া ও আখিরাতে মাদকাসক্তির ভয়াবহতা জনগণের সামনে তুলে ধরার পরও যারা এ ভয়ংকর নেশা ছাড়বে না তাদের জন্য মহানবী (সা) দণ্ডবিধি প্রবর্তন করেন, যাতে তারা সংশোধিত হয় এবং অন্যরা যাতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিশ্বনবী (সা) মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে খেজুর গাছের ডাল ও জুতা দ্বারা ৪০টি আঘাত করে শাস্তি দিতেন। হযরত আবূ বকর (রা), হযরত উমর (রা) ও হযরত আলী (রা) মাদকাসক্তদের জন্য এ শাস্তি বহাল রাখেন। মাদকাসক্তির মাত্রা যখন বৃদ্ধি পায় তখন হযরত উমর (রা) তাঁর শাসনামলে আশিটি বেত্রাঘাত করার হুকুম জারি করেন। সমস্ত ইমাম ও উম্মতের এ বিষয়ে ইজমা রয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, মাদকাসক্তদের শাস্তি প্রদানের কতিপয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে- যেমন, জনগণকে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, অমুক ব্যক্তি মাদকাসক্ত অথবা মদ্যপ অথবা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যদি কাউকে পাওয়া যায় অথবা মুখ হতে নেশার গন্ধ পাওয়া যায় অথবা সে যদি মাদকাসক্তির বিষয়টি স্বীকার করে তখন তার উপর দণ্ড (হদ) আরোপ করা হবে। শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক মাদকাসক্তির প্রতিক্রিয়ার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, মাদক কিছু সময়ের জন্য হলেও মানুষের মস্তিষ্কের উপর এমন একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যদ্দ্বারা মানুষের জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় এবং ঐ সময় তার উপর পশুস্বভাব সওয়ার হয়ে বসে। কারণ মানুষের মধ্যে তো পশুস্বভাব আছেই, কিন্তু তার অমূল্য রত্ন জ্ঞান ও বিচার-বিবেচনা শক্তি ঐ স্বভাবের প্রাবল্য প্রতিরোধ করে রাখে। অধিকন্তু মদ মানুষের পশুস্বভাব ও পশুত্ব শক্তির মধ্যে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে দেয়। এ ধরনের বহু দোষ মদের মধ্যে রয়েছে; এ কারণে সৃষ্টিকর্তা এটাকে অপবিত্র ও শয়তানী কাজের বস্তু নামে আখ্যায়িত করে তাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ পাক মানব জাতির জীবন ধারণের জন্য যেসব ফলমূল দিয়েছেন, তা এক অফুরন্ত নেয়ামত। এগুলো দিয়ে মাদক তৈরি করা আল্লাহ্ নেয়ামতের সাথে বিদ্রোহের শামিল। আল্লাহর নেয়ামতকে অবৈধ পন্থায় ব্যবহার করা হারাম। যেসব বস্তু আল্লাহ্ পাক পবিত্র ও হালাল করেছেন সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার থেকে বিরত থাকাও ধৃষ্টতা। মহান আল্লাহ বলেন: “খেজুরবৃক্ষ ও আঙ্গুর ফল থেকে তোমরা মাদকদ্রব্য ও উন্নত খাদ্য তৈরি করে থাক। এতে অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”

আল্লাহ্ পাক মানুষকে ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, যা প্রয়োগ করে মানুষ হালাল রিযিক অন্বেষণ করতে পারে; আবার হারামের পথেও ধাবিত হতে পারে। বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা কখনো হারামের পথে অগ্রসর হয় না। মদ ও মাদক এমন এক ভয়ংকর নেশা, যা অনেক অপরাধের জন্ম দেয়; সৃষ্টি করে বিদ্বেষ ও শত্রুতা। মাদকসেবী ক্ৰমান্বয়ে জুয়া ও নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ে; রুচিকে বিকৃত করে দেয়। এক কথায় খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, আত্মহত্যাসহ নানাবিধ পাপাচারের পথে নিয়ে যায় মদ ও মাদক এবং আল্লাহর স্মরণ, তথা নামায ও রোযা থেকে গাফেল করে রাখে। আল্লাহ্ পাক বলেন :

“হে মু’মিনগণ! এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্যনির্ধারক শরসমূহ শয়তানের ঘৃণ্য কাজ। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা এখনো কি নিবৃত্ত হবে না!”

মাদক পরিহারকারীদের পরকালীন সুসংবাদ

যারা দুনিয়ায় মদ ও মাদকদ্রব্য সেবন থেকে নিজেদের বিরত রাখবে আল্লাহ্ পাক পরকালীন জীবনে বেহেশতে আমোদ-স্ফূর্তি উপভোগের জন্য তাদের এক ব্যতিক্রমধর্মী পানীয় সরবরাহ করবেন, যার তুলনা পৃথিবীতে নেই। আর যারা দুনিয়ায় মাদকাসক্ত, বেহেশতের এ নেয়ামত থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে যাবে। জান্নাতের পানীয় ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :

“তার বর্ণ হবে নির্মল, স্বচ্ছ, তা পানে হবে অতি সুস্বাদু। তার মধ্যে এমন কোন ক্রিয়া থাকবে না যদ্দরুন মস্তিষ্কে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মাথায় চক্র বা মাতলামির ক্রিয়া তাতে মোটেই থাকবে না।”

মহানবী (সা)-এর শিক্ষার প্রভাব

মহানবী (সা)-এর মাদক-বিরোধী এ শিক্ষার ফলে তৎকালীন সমাজে মাদক সেবন শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। সাহাবাগণ ছিলেন মাদক সেবনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদকারী। মাদক উৎপাদন, বিপণন, সেবন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এমন কি হুযূর (সা)-এর তা’লীমের ফলে ধূমপানের প্রবণতাও অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়। শুধু আরব দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও মহানবী (সা)-এর শিক্ষা সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইংল্যান্ডে ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ নিজে মদ পান পরিত্যাগ করেন এবং মদ পানের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্তমানে মাদক উৎপাদনের উপর নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে মহানবী (সা) মাদক-বিরোধী যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তার সুন্দরপ্রসারী প্রভাব দুনিয়ার সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ!

মাদকের করাল গ্রাসে বাংলাদেশ

মদ ও মাদকদ্রব্যে বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রামাঞ্চল ছেয়ে গেছে ব্যাপকহারে। যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত অনেক মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে মাদক বেচা-কেনা হয় ৫,০০০ কোটি টাকার বেশি।

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মাদকনিয়ন্ত্রণ বোর্ডের প্রণীত প্রতিবেদনে জানা যায় যে, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ১০ থেকে ১২ লাখ। শুধু রাজধানী ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজার পয়েন্টে দিবারাত্রি চলছে মদ গাঁজা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, প্যাথেড্রিনজাতীয় মাদক ব্যবসা। সব ধরনের মাদকে ভেজাল মিশ্রিত থাকায় মাদকসেবীদের মৃত্যু ঘটছে অহরহ। বস্তি, লঞ্চ, ও বাস টার্মিনাল এবং রেলওয়ে স্টেশন হচ্ছে মাদক পরিবহনের ট্রানজিট-রুট। সীমান্তের ওপার থেকে আসে ফেনসিডিল, হেরোইন ও প্যাথেড্রিনজাতীয় মাদকদ্রব্য। এদেশের মাদক ব্যবসায়ীরা বোতল ও লেবেল ঠিক রেখে মাদকে ভেজাল মিশিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে চালান দেয়। কয়েক বছর আগে মিথানল-মিশ্রিত পরিশোধিত সুরাসার (Rectified Spirit) থেকে নরসিংদীতে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার বাঞ্ছারামপুরে বিষাক্ত মদ খেয়ে মৃত্যু ঘটেছে ১০ জনের। সারা দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টর, সাব ইন্সপেক্টর ও সেপাই মিলে ৮৫০ জন লোকবল থাকা সত্ত্বেও অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সিআইডি (Criminal Investigation Department ) পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী পুরো দেশে দু’লাখ ট্রাক ড্রাইভার মাদক সেবনে অভ্যস্ত। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে নিত্য দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। প্রতি ১০টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৬টি হচ্ছে উচ্চ মাত্রায় মাদক সেবনের ফলশ্রুতি। এভাবে মাদকাসক্ত ড্রাইভাররা অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে নিয়মিত। International Drug Control Programme (I D CP)-এর পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশে ৪ লাখ ৪০ হাজার জন শিক্ষিত মানুষ মাদক সেবন করে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ জন্য রয়েছে ছাত্র-ছাত্রী। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ১৫% ফেন্সিডিল ও হেরোইনের প্রতি, ১৩% প্যাথেড্রিন ইনজেকশনের প্রতি, ৬% হাশিশের প্রতি এবং ৩% এ্যালকোহলের প্রতি আসক্ত। গাড়ি চালক ও স্বল্পআয়ের লোকেরা সাধারণত ফেন্সিডিল সিরাপ এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি মদ পান করে। অপর দিকে বিত্তবান ও শিক্ষিতরা হেরোইন ও ফরেইন লিকার পান করে। একজন মাদকসেবীর প্রতিদিন মাদক বাবদ খরচ হয় গড়ে ১৩০ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে মন্তব্য করেন যে: “It is major threat to us that more than one-thrid of the edu cated people are taking drugs which can cripple the nation” te “এটা আমাদের জন্য বিরাট হুমকি যে, শিক্ষিতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মাদক সেবন করছে, যা জাতিকে পঙ্গু বানিয়ে দিতে পারে।”

অপরদিকে ধূমপান তো আমাদের দেশে কোন সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না; বরং এটাকে আভিজাত্যের প্রকাশ ও ফ্যাশন মনে করা হয়।

হাটে-বাজারে, গাড়িতে-বাসে, ট্রেনে-লঞ্চে, মার্কেটে দোকানে সর্বত্র ধূমপায়ীদের রাজত্ব। (সুখের কথা, সরকার সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বিল এনে প্রকাশ্য স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করার আইন পাশ করেছে।) ধূমপান আমাদের কি ক্ষতি করে তার সামান্য ধারণাও আমাদের নেই। ধূমপায়ীরাই মাদক সেবনে অগ্রগামী। পাকিস্তান চেষ্ট সোসাইটির সহযোগিতায় জিন্নাহ পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল সেন্টারের চেষ্ট মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের (JPMC)-র পরিচালক প্রফেসর আবদুল মজিদ বালুচ সম্প্রতি করাচীতে অনুষ্টিত এক সেমিনারে ধূমপায়ীদের সতর্ক করার জন্য এক চ্যাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন; বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত পাকিস্তানে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক লোক বছরে প্রায় ৭০০ সিগারেট পান করে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রায় ১২০০ গ্রাম তামাক সেবন করে। শরীরের ২৫টি রোগের জন্য তামাক দায়ী।

সুতরাং মহানবী (সা)-এর শিক্ষাই মাদকের সর্বনাশা অভিশাপ থেকে আমাদেরকে, আমাদের সমাজকে, আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারে।*

*প্রবন্ধটি ১৯৯৯ সালে লেখা। সুতরাং এ প্রবন্ধে উল্লেখিত তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান সে প্রেক্ষিতেই বিবেচনা করতে হবে। ধুমপান নিষিদ্ধের আইনের বিষয়টি সম্পাদক কর্তৃক এখন সংযোজিত।–সম্পাদক।

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88