মাদকাসক্তি ও অপসংস্কৃতিমুক্ত সমাজ গঠনে হযরত মুহাম্মদ (সা)

রচনায়ঃ মুহাম্মদ রিজাউল করীম ইসলামাবাদী

আল্লাহ তা’আলা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বমানবের হিদায়তের জন্য প্রেরণ করেছেন আদর্শ মানব ও শ্রেষ্ঠ রাসূলরূপে। তাঁর নবুয়ত লাভের পূর্বে বিশ্বে নানা কুসংস্কারের প্রচলন ছিল। পৃথিবী অপসংস্কৃতি, অনাচার, অত্যাচার ও কুফরীর ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।

চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, অপহরণ, ধর্ষণ, স্বাধীন নরনারী ও শিশুকে জোরপূর্বক বিক্রি করা, রাজা- বাদশা ও গোত্রীয় প্রধানকে পরম পূজনীয় ধারণা করা, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করা, সাধারণ ব্যাপারে গোত্রে গোত্রে অনেক বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, বিবাহ, তালাক ও ক্রয়-বিক্রয়ে অদ্ভুত প্রথার অনুসরণ, কন্যা সন্তানকে জীবিত কবস্থ করা, জুয়া, পাশা, মাদকাসক্তি, দেবদেবীদের নামে পশু উৎসর্গ করা, খাদ্যদ্রব্য দিয়ে তৈরি-মূর্তিকে সাদরে ক্ষুধার তাড়নায় ভক্ষণ করা, একজন পুরুষের বহুনারী বিবাহ, করা, একজন নারীর বহু পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, বিবস্ত্র অবস্থায় কা’বা শরীফ তাওয়াফ করা, বিভিন্ন মূর্তির নাম সংযোগ করে হজ্জের তালবিয়া পড়া, বেচা-কেনা ও লেনদেনে নানা প্রতারণামূলক পন্থা অবলম্বন, নারী জাতিকে বিরক্ত করা, ওজনে কম দেওয়া, আভিজাত্যের অহমিকা ও বর্ণবৈষম্য ইত্যাদি অপসংস্কৃতিতে সমাজ ছিল জরাগ্রস্ত। এ হল তৎকালীন সমাজের সাধারণ চিত্র। তবে তাদের মধ্যে অনেক সদগুণও ছিল। সে অন্ধকার সমাজেও অনেক জ্ঞানী লোক মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকতেন, সূরা পান করতেন না, মেহমানের সেবা, পথিক মুসাফিরের সেবা করাকে পুণ্য কাজ মনে করতেন। তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না।

উপরোক্ত অপসংস্কৃতি ও মাদকাসক্তিতে পূর্ণ একটি সমাজকে আল্লাহর প্রিয় নবী বিশ্বসংস্কারক হযরত মুহাম্মদ (সা) অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিকূল অবস্থায় কিভাবে পরিশোধিত করলেন এবং যারা মূর্তি পূজা করতো তাদের দ্বারা মূর্তি পূজার অবসান ঘটালেন; যাবতীয় অপসংস্কৃতি থেকে সমাজকে মুক্ত করলেন; এমনকি সে সমাজকে তিনি রূপান্তরিত করলেন আদর্শ সমাজে, রূপান্তরিত করলেন তাঁর অনুগামীদেরকে সৎপথের নক্ষত্ররূপে। সে পরিশীলিত সমাজে ছিল না কোন অপসংস্কৃতি, ছিল না কোন মাদকাসক্তি, ছিল না অন্যায়ের পক্ষ সমর্থন, ছিল না কোন ঘুষ, সুদ ও অন্যায় সুপারিশ। হযরত উসামা (রা) একবার সুপারিশ করলে মহানবী (সা) অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর বিধান প্রয়োগ না করার জন্য তোমরা সুপারিশ করছো? আল্লাহর কসম, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদও যদি চুরির অপরাধ করত তবে আমি তার হাতও কর্তন করতাম।’ যেসব অপরাধে শাস্তি কঠোর, যেমন প্রস্তর নিক্ষেপ করে প্রাণ সংহার, সেসব অপরাধ নিজে স্বীকার করে শাস্তি প্রয়োগের জন্য নিজেকে মহানবী (সা)-র আদালতে হাযির হয়ে কাকুতি করার নজীর এ সমাজের, এ সংস্কৃতির একটি অনুকরণীয় চিত্র। এতে বোঝা যায় যে, মহানবী (সা) কত বড় সংস্কারক, কত মহান পরিশোধক। হযরত মুহাম্মদ (সা)-প্রদত্ত রাষ্ট্রনীতি ও সামজ ব্যবস্থায় দলীয় লোক, নিকটাত্মীয় এবং প্রিয়জনদের বেলায় কোন ছাড় ছিল না, আইনের প্রয়োগ ছিল সবার জন্য সমান। মহানবী (সা)-র সঙ্গে একজন খাদেম ছিল যে মালে গনীমতের রক্ষণাক্ষণের দায়িত্ব পালন করত। তার মৃত্যু হলে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, সে জাহান্নামী। সাহবীগণ দেখলেন যে, সে একটি জুব্বা অনুমতি ছাড়া গনীমতের মাল থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। বুখারী শরীফ: ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩২।

ন্যায়নীতির অনুসরণে মহানবী (সা) নিজেও ছিলেন অতি কঠোর। একবার তিনি তাঁর শয্যায় একটি খেজুর পেয়ে তা আহার করলেন। পরক্ষণেই খেয়াল হল যে, এ খেজুরটি সাদকার নয় তো? এ চিন্তায় তিনি সারা রাত ঘুমালেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) এমন এক ব্যক্তির উল্লেখ করলেন, যে লম্বা সফর করে হাত তুলে দোয়া করে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! কিন্তু সে যা আহার করে তা হারাম, যা পান করছে তা হারাম, যা পরিধান করছে তা হারাম, সে লালিত হয়েছে হারাম দ্বারা, তাই তার দোয়া কবূল হবে কিরূপে?

হযরত বিশর ইবন হারিস (র) বলেন, আমার গোশত খাওয়ার বাসনা, হয় কিন্তু হালাল দিরহামের ব্যবস্থা করতে না পারাতে আমি চল্লিশ বছর যাবত গোশত আহার করিনি। বিশ্বনবী (সা)-এর আদর্শ মেনে চলা, আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের জবাবদিহিতা ইত্যাদি মৌলিক ন্যায়-নীতির প্রতি বিশ্বাসী হয়ে চলা ছাড়া আদর্শ সমাজ গঠন, অপসংস্কৃতি ও নৈতিক অবক্ষয় রোধের অন্য কোন বিকল্প নেই। আমাদের ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, শিল্পে, সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে যে সব অন্যায় ও অপসংস্কৃতি প্রবেশ করেছে সেগুলো থেকে মুক্তিলাভ করতে হলে মহানবী (সা)- প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থার দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে। এছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। রাসূলুল্লাহ্ (সা) চেষ্টা করেছেন মানুষের হৃদয়ে পরিবর্তন আনতে এবং অন্তরে তাকওয়া ও আনুগত্য সৃষ্টি করতে। যখন কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে কা’বা শরীফের দিকে পরিবর্তন করা হলো, এ হুকুম নাযিল হওয়ার পর মদীনার পবিত্র মসজিদে নববীতে কাবা শরীফের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা হল। মদীনার অন্য এক মসজিদে যারা দু’রাকাত সালাত আদায়ের পর সালাতের মধ্যেই ঘোষণা শুনতে পেলেন যে, কাবা শরীফের দিকে মুখ করে সালাত আদায়ের নির্দেশ অবতীর্ণ হয়েছে, তখন তাঁরা সালাতে থাকা অবস্থায় অবশিষ্ট দু’রাকাত কাবা শরীফের দিকে মুখ করে আদায় করলেন। এই ছিল সাহাবীগণের আনুগত্য। অনুরূপ সুরা বা মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মদীনার বাসিন্দাগণের মধ্যে যারা সুরা পান করতেন তারা এমন আনুগত্য প্রকাশ করলেন যে, কারো হাতে সুরার পাত্র আছে, এক চুমুক পান করেছেন; হুকুম শুনার পর পাত্র মুখ থেকে পৃথক করে ফেলেন এবং দ্বিতীয়বার আরেক চুমুক পান করা থেকে বিরত থাকলেন এবং পাত্র হাত থেকে ফেলে দিলেন। যাদের ঘরে সুরা মওজুদ ছিল তারা সব সুরা নালা-নর্দমায় ফেলে দেন। মহানবী (সা) মানুষের মনে নৈতিক উন্নয়নের যে বিপ্লব সৃষ্টি করেন তা ছিল অনন্য ও অসাধারণ। এরূপ পরিবর্তন সাধন ওয়াহীপ্রাপ্ত নবী অথবা তাঁর খাঁটি অনুগামী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে মাদকাসক্তি ও অপসংস্কৃতির চিত্র

বর্তমান বিশ্বে মাদক সমস্যা একটা মারাত্মক সমস্যা। মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়িতে বিভিন্ন দেশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে। মাদকদ্রব্যের পাচারের কারণে সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে এবং দেখা দিচ্ছে না ধরনের অপরাধ। এ অপরাধপ্রবণতা সামাজিক জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছে। যুব সমাজের এ বিভ্রান্তির ফলে জাতীয় জীবনের সার্বিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে সহিংসতা, সন্ত্রাস, মাস্তানী ও জীবন সম্পর্কে নৈরাশ্যবাদিতা। বৃদ্ধি পাচ্ছে হত্যা, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটতরাজ, ডাকাতি এবং পকেট মারার মত ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্বের সামাজিক পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিবে শিগগিরই। বিড়ি-সিগারেট, পাইপ-হুঁকো, নস্যি, দোক্তা, জর্দাপাতা, কোকেন, হেরোইন, ওপিয়াম, গাঁজা, ফেনসিডিল সবই ক্ষতিকর। সাম্রাজ্যবাদ একদা তার উপনিবেশের প্রজাবর্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্থানকে অবদমনে নীরব মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল নেশাকে। ইংরেজরা ভারতে আফিম আবাদে উৎসাহিত করেছিল। ধূমপান, গাঁজা, মদ ইত্যাদি থেকে অনেক রোগের উৎপত্তি হয়, তামাকের মারাত্মক বিষ প্রতিবছর কমপক্ষে ৩০ লাখ জীবন ছিনিয়ে নেয়। ধোঁয়াবিহীন গুল সিগারেটের চেয়ে মারাত্মক।

ধূমপানে মানুষ ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি ইত্যাদি ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তামাক ব্যবহারে সহজে যেসব রোগ হতে পারে সেগুলো হল: ঠোঁটের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, জিহবার ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, হৃদরোগ, মস্তিকে রক্তক্ষরণ, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস ইত্যাদি। আমেরিকা ও বৃটেনের ক্যান্সার সমিতি ১৯৫৪ সালে দু’টি পৃথক জরিপে প্রমাণ করে যে, ধূমপায়ীদের মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার অধিক। তামাকের উৎপাদন অর্থিৈনতক দিক থেকে যতটুকুন সুখকর, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণের দিক থেকে তা হাজারগুণ বেশি অসুখ ও ক্ষতির উপকরণ। বর্তমানে দেশী-বিদেশী মদ, সিগারেট ও গাঁজার নেশা গ্রাস করতে বসেছে যুব সমাজকে। গ্রাম- গঞ্জের খালবিলে, বন-জংগলে, ঝোপ-ঝাড়ে, আম-কাঁঠালের বাগানের আড়ালে- আবডালে এক শ্রেণীর উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরার দল গাঁজার আসর জমায়। পাড়ার মাস্তান, গ্রামের টাউট-বাটপাড় ও ভণ্ড পীর-ফকীরদের আস্তানায় তাদের সাঙ্গপাঙ্গ ও চেলারা গাঁজার আসর জমায় একরকম প্রকাশ্য স্থানেই। কোন কোন গাঁজার আসরে সমস্বরে কোরাস চলে:

গাঁজা কে খাবিরে আয়,

গাঁজা খেলে স্বৰ্গ পাবে বসে নিরালায়।

গাঁজা কে খাবিরে আয়।

এক ছিলিমে যেমন তেমন

দুই ছিলিমে মজা।

তিন ছিলিমে উজির নাজির

চার ছিলিমে রাজা।

গাঁজা কে খাবিরে আয়,

গাঁজা খেয়ে শুয়ে থাকি

টুয়াতে আংগিনা দেখি,

বাজার দেখি তাল গাছের আগায়।

গাজা কে খাবিরে আয়।

গাজা কে খাবিরে আয়।

পরিমাণ ও প্রকারের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করাটাই শয়তানী ও কুৎসিত কাজ বলে ইসলামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং নেশার জিনিস হবার ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র ও ধরন-পরিমাণের প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। কি দিয়ে তৈরি, দেশী না বিদেশী, কম বা বেশির প্রশ্ন কিংবা উপকারের দোহাই দেওয়ার কোন অবকাশ নেই।

‘আর খেজুর গাছের ফল ও আংগুর থেকে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক। এতে অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন। দ্বিতীয় আয়াত অবতীর্ণ হয় হযরত উমর ও মুয়ায ইবন জাবল (রা)-এর প্রশ্নের উত্তরে:

‘লোকে আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বলুন, উভয়ই মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও আছে; কিন্তু উহাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।’ বাকারা: ২১৯।

যেহেতু পাপ অধিক, তাই অনেকে এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মদ ছেড়ে দিয়েছেন।

তৃতীয় আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রাসঙ্গিক ঘটনা: হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা)-এর ঘরে কয়েকজন সাহাবীর দাওয়াত ছিল। মদ পান করার পর তাঁরা মাগরিবের সালাতে দাঁড়ালেন। ইমাম সূরা কাফিরুন’ তেলাওয়াত করলেন, এতে যত ‘লা’ অক্ষর আছে সব বাদ দিয়ে পাঠ করলেন। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হল:

‘হে মুমিনগণ, মদ্যপানোন্মত্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হবে না। নিসা : ৪৩

ইতবান ইবন মালেক (রা)-এর ঘরে দাওয়াত ছিল। খাওয়া-দাওয়া হল। এত হযরত সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা)-ও শরীক ছিলেন। একজন কবিতা আবৃত্তি করলেন। তাতে আনসারদের নিন্দা ছিল। একজন আনসারী সে কবির মাথায় আঘাত করলো। নবী করীম (সা)-এর দরবারে এ ঘটনা জানানো হলো। হযরত উমর (রা) দোয়া করলেন, হে আল্লাহ্! এ ব্যাপারে স্পষ্ট হুকুম নাযিল করুন। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হল:

হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। তাই তোমরা তা বর্জন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। মায়িদা: ৯০

শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণে ও সালাত আদায়ে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না? ৫: ৯১।

সাহাবা (রা) এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বললেন, আমরা নিবৃত্ত হলাম, আমরা নিবৃত্ত হলাম।’

এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল এ জন্য যে, ইসলাম সব পার্থিব স্বার্থ পরিত্যাগ করে কেবল মাত্র আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও তাঁর রাসূল (সা)-এর অনুসরণকে মানুষের সকল প্রয়াস-প্রচেষ্টা, ইচ্ছা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র ও অভীষ্ট লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে। দীন ইসলাম এর মানেই হচ্ছে: বান্দা তাঁর প্রভুর সন্তুষ্টির সামনে মাথা নত করে দিবে এবং যাবতীয় কাজে তাঁর ইচ্ছার অনুগত থাকবে। ইসলাম মানুষকে আল্লাহর খলীফা ও প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছে। মানুষ তাঁর স্রষ্টার ইচ্ছা ও সন্তুষ্টিকে সামনে রেখেই তার জীবনের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিবে। সে এমন কোন কাজ করবে না, এমন কোন কথা বলবে না যাতে তার প্রতিপালক তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। মনে রাখতে হবে, কেবল মাত্র বৈষয়িক উন্নতি– যাতে আধ্যাত্মিকতার কোন স্থান নেই,তা মানুষকে কখনো স্বস্তি দান করতে পারে না।

শিল্প ও সাহিত্যের যাবতীয় কর্ম – মন্দ, অন্যায় ও অশ্লীলতা দমনে সহায়ক না হবে তা ইসলামী সাহিত্য-শিল্প বা সংস্কৃতি হতে পারে না। ইসলামী সংস্কৃতির আসল কথা হল পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান; সচ্ছলতা, মানবীয় মর্যাদা, ঈমান, তৃপ্তি ও সত্যপথ অনুসরণে উৎসাহিত করা। ইসলামী সংস্কৃতির পথপ্রদর্শক হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। তার সংবিধান হল আল কুরআন; তার লক্ষ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি। এ সংস্কৃতি মানুষকে সসীমে সীমাবদ্ধ রাখে না; বরং তাকে নিয়ে যায় অসীমের দিকে। ড. ইকবাল বলেন:

‘নিজেদের মিল্লাতে ইসলামিয়াকে তোমরা পাশ্চাত্য সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ ও তাদের সংস্কৃতির সাথে তুলনা করো না, কারণ রাসূলে হাশেমীর উম্মতের গঠনবৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের, যা অন্য সম্প্রদায়ের আচার ও রীতিনীতির সাথে তুল্য নয়।

কাফির সম্প্রদায় পৃথিবী ও পরিবেশ নিয়ে মত্ত থাকে, আর মুমিনের পরিচয় হল: পরিবেশ তাকে ঘিরেই সৃষ্টি হয় এবং পৃথিবী তার পিছনে চলে’।

আজকের উন্নতির দাবিদার সম্প্রদায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, মানবতার জন্য কি উৎসর্গ করবে! তারা তো জাতীয় স্বার্থের প্রতিমা পূজার ঊর্ধ্বে এখনো উঠতে পারেনি। তারা দেহের তৃপ্তি ছাড়া আত্মার তৃপ্তি, আখিরাতের সাফল্য সম্পর্কে মানবজাতিকে কিছুই দিতে পারেনি। এ সম্বন্ধে তারা অজ্ঞ। মহানবী (সা) উভয় জাহানের কল্যাণের শুধু সন্ধানই দেন নি; তিনি দু’জাহানের কল্যাণ লাভের বাস্তব পথে নিজেও চলেছেন এবং মানব জাতিকে সে পথে চলতে উৎসাহিত করেছেন। সাহাবীগণ (রা) সে পথে চলে নিজেরাও সফলকাম হয়েছেন এবং মানবজাতির অভূতপূর্ব কল্যাণ ও উপকার সাধন করেছেন।

‘আল্লাহর কাছ থেকে অন্তর্দৃষ্টি কামনা কর-চোখের নূর ও অন্তরের নূর এক জিনিস নয়।’ বর্তমানে আমাদের মধ্যে অনেক রকমের অপসংস্কৃতি প্রবেশ করেছে। আমরা এসব সম্বন্ধে সতর্ক না হলে এবং এসবের প্রতিরোধে সোচ্চার না হলে আমাদের সমাজের অধঃপতন অনিবার্য হয়ে পড়বে।

আমাদের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী নারীমূর্তি তৈরী করে দোকানে প্রদর্শন করছে। অথচ এসব শরীয়তে নিষিদ্ধ, কিন্তু তারা তা লংঘন করছে।

পণ্যদ্রব্য বিক্রির জন্য মডেল কন্যার ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন প্রায় দোকানেই ক্রেতা পণ্য ক্রয় করতে গেলে তিনি দেখতে পাবেন দোকানে, এমনকি রাস্তায় ও সেন্টারপ্লেসে পণ্যের বিজ্ঞাপনসম্বলিত মডেল কন্যার ছবি। এসব অপসংস্কৃতি ও গর্হিত কাজ। যে স্থানে ছবি থাকে সেখানে ফেরেশতা প্রবেশ থেকে বিরত থাকেন, অর্থাৎ তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন।

সুন্দরী প্রতিযোগিতা

সুন্দরী প্রতিযোগিতা আমাদের দেশে ছিল না। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীজাতির সৌন্দর্যকে পণ্যদ্রব্য হিসাবে ব্যবহার ও তার মর্যাদাহানি করা মহাপাপ। এদের দাইয়ূস বলা হয়। এটা অপসংস্কৃতি। কিন্তু পত্রিকা মারফত প্রকাশিত হল যে, আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকাতেও ও গর্হিত শয়তানী কাজটি চালু হয়ে গেছে।

এছাড়া আরো অনেক অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে প্রবেশ করেছে। ইবাদত, লেনদেন, বেচাকেনা, সমাজনীতি, ও রাজনীতি প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে অনেক অন্যায় ও অপসংস্কৃতি ঢুকেছে। যথাসময়ে সেগুলোর প্রতিরোধ না করতে পারলে আমাদের পতন অবধারিত।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ, পরিশীলিত ও অনুসরণীয় ধর্ম। নবী করীম (সা) আমাদের অপসংস্কৃতিমুক্ত সমাজ উপহার ও আমানত রেখে দুনিয়া থেকে তশরীফ নিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা সে পরিশীলিত ধর্মকে তার আসল রূপে টিকিয়ে রাখতে পারিনি। নানা কুপ্রথা ও অপসংস্কৃতি এতে স্থান পাওয়াতে আজ আমাদের মর্যাদা ও গৌরব ভূলুণ্ঠিত। সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায় আজ বিপর্যস্ত।

কিন্তু নিরাশ হলে চলবে না। আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হওয়া মুমিনের শান নয়। সারা বিশ্বের অপসংস্কৃতি দূর করতে, মানুষকে মুক্তির দিশা দিতে মুসলিম যুবসমাজ ও হক্কানী আলেম ও মুজাহিদদের এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর প্রেমে, মানুষের কল্যাণে উদ্বুদ্ধ হয়ে, আল্লাহ্ প্রেমের পথ দেখিয়ে মানব সমাজকে বিধ্বংসী নেশা ও যাবতীয় অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে প্রকৃত কল্যাণ ও আল্লাহর মুহাব্বতের পথ দেখাতে হবে।

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button