কল্যাণ-পরিবার গঠনে হযরত মুহাম্মদ (সা)- এর আদর্শ

 রচনায়ঃ এম. আবদুর রব

স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র সংগঠনটির নাম পরিবার। এটাই হচ্ছে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রথম স্তর। মানবজীবনের প্রথম ভিত্তি। পরিবার থেকে শুরু হয় মানুষের সামাজিক জীবন। সামাজিক জীবনের কল্যাণ নির্ভর করে পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠুতার উপর। পরিবারকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের কল্পনাও করা যায় না। মানব-সভ্যতার শুরু থেকেই পরিবার সমাজজীবনের প্রথম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাই মানবজীবনে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এর সূচনা হয় একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে বিবাহ-বন্ধনের মাধ্যমে।

সুখ-শান্তি এবং তৃপ্তি ও আনন্দ লাভই হচ্ছে প্রতিটি মানব-মনের বাসনা। এতে ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো এবং নর ও নারীর মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। বিবাহের মাধ্যমে মানুষের মনে আনন্দ ও গভীর প্রশান্তি লাভ হয়। বৈবাহিক সূত্রে গঠিত পারিবারিক জীবনযাপনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান, সন্তান লালন-পালন ও ভবিষ্যৎ বংশধর গড়ে তোলা হয়। এবং এরই মাধ্যমে পবিত্র ও নৈতিকভাবে মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ করা হয়। সুতরাং মানবজীবনে বিবাহের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ইসলাম প্রতিটি বয়োপ্রাপ্ত নর ও নারীর জন্য বিবাহ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। তবে আর্থিক অসংগতি বা অন্য কোন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকলে বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা অপছন্দনীয় (মাকরুহ) কাজ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (হারাম)। আর্থিক সংগতি এবং শারীরিক সুস্থতা না থাকলে আর্থিক সংগতি আসা এবং শারীরিক সুস্থ হওয়া পর্যন্ত বিবাহ বিলম্বিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কারো নৈতিক পদস্খলনের আশংকা দেখা দিলে রোজা থেকে বা অন্য কোন উপায়ে সংযম প্রদর্শন করতে হবে। আর এটাই হচ্ছে বিবাহ-বন্ধন সম্পর্কিত ইসলামী বিধান।

বিবাহ যেহেতু পরিবার গঠনের প্রথম ধাপ এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথম স্তর এবং মানুষের সুখ-শান্তি, তৃপ্তি ও আনন্দ পারিবারিক পর্যায়ে এখান থেকে শুরু হয়, সেহেতু বিবাহের পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে এবং বিবাহ-বন্ধন স্থাপনে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে এবং এতে উভয়ের স্বাধীন সম্মতি থাকতে হবে। এ কারণেই ইসলামে বিবাহ- বন্ধন স্থাপিত হয় ইজাব ও ককূলের মাধ্যমে অর্থাৎ একজন বিবাহের প্রস্তাব করবে, অন্যজন তা গ্রহণ করবে। আর এই বিবাহ-বন্ধন ততক্ষণ সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না স্ত্রীর আর্থিক ও সামাজিক স্বার্থ স্বামী কর্তৃক সংরক্ষিত হবে। তাই বিবাহের প্রস্তাব করার সময়ই স্বামীকে তার আর্থিক সংগতি অনুযায়ী স্ত্রীকে নগদ অর্থ প্রদান করতে হবে অথবা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যা মোহরানা হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী অথবা ভদ্রজনোচিতভাবে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বামীকে নিতে হবে যা খোরপোষ হিসেবে পরিচিত। ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী বিবাহ উপলক্ষে যে আপ্যায়ন হয়ে থাকে তার ব্যয়ভারও স্বামীর উপর ন্যস্ত।

বিবাহ উপলক্ষে মেয়ে বা মেয়ে পক্ষকে কোন খরচ বহন করতে বা যৌতুক হিসেবে কোনরূপ অর্থ বা সম্পদ দিতে বাধ্য করা যাবে না। তবে নতুন সংসার স্থাপনে মেয়েকে স্বেচ্ছায় কোন কিছু দিতে নিষেধ নেই।

ইসলাম যেহেতু বিবাহ-বন্ধনকে চিরস্থায়ী বা অটুট রাখার পক্ষপাতি, সেহেতু বিবাহের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বংশ, অর্থ, নৈতিকতা, দীনদারী, স্বভাব-চরিত্র, শিক্ষা- দীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সমতা ও সাদৃশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। এসব বিষয়ে সমতার বদলে বৈসাদৃশ্য থাকলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল দেখা দেয়ার আশংকা থেকে যায়, যা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়াতে পারে। তাই ইসলাম বিবাহে কুফুর (সমকক্ষতা) প্রশ্নকে সমর্থন করে।

ভালোবাসা ব্যতিরেকে বিবাহিত জীবন মধুর হতে পারে না। প্রেম-ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে পছন্দ করা। তাই ইসলাম বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রী পরস্পর পরস্পরকে দেখে নেয়া জরুরী বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী হচ্ছে: “তোমরা বিবাহ কর সেই মহিলাকে যাকে তোমার ভাল লাগে, যে তোমার পক্ষে ভাল হবে।” স্বামী-স্ত্রীর অপছন্দের বিবাহ পারিবারিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এই ধরনের বিবাহ মানবিক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

বিবাহে পাত্র-পাত্রী পছন্দের দায়িত্ব যেহেতু ইসলাম তাদের উপর ছেড়ে দিয়েছে এবং যেহেতু বিবাহের মাধ্যমে মানুষের মনে আনন্দ ও প্রশান্তি আসে এবং যেহেতু বৈবাহিক সূত্রে গঠিত পারিবারিক জীবনযাপনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান, সন্তান লালন-পালন ও ভবিষ্যৎ বংশধর গড়ে তোলা হয় এবং এরই মাধ্যমে পবিত্র ও নৈতিকভাবে মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ করা হয়, সেহেতু উপরোক্ত কাজগুলো যে বয়সে করা সম্ভব অন্তত বিবাহ সে বয়স পর্যন্ত বিলম্বিত করা উচিত। এসব কাজ যে বাল্যবয়সে সম্ভব নয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ব্যতিক্রম বাদে বাল্যবিবাহ ইসলাম পছন্দ করে না। ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রে ইসলাম এই ধরনের বিবাহ বহাল রাখা বা ভেঙ্গে দেয়ার অধিকার বালেগ হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর উপর ছেড়ে দিয়েছ। ইচ্ছা করলে যে কোন একজন বালেগ হওয়ার পর বাল্যবিবাহ ভেঙ্গে দিতে পারে।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বয়সের পার্থক্য বেশি হলে পারিবারিক জীবনে অনেক ধরনের সমস্যা ও জটিলতা দেখা দেয়। মানসিক পরিপক্বতার ভিন্নতার কারণে পরস্পর পরস্পরকে বুঝতে পারে না। সংসারে সব সময় খিটিমিটি লেগে থাকে, যা বিবাহ বিচ্ছেদসহ নানা ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি করে। তাই বর-কনের পারস্পরিক বয়সের বেলায় ইসলামী নীতি হচ্ছে সাধারণভাবে পাত্র-পাত্রীর বয়সের পার্থক্য বেশি হওয়া উচিত নয়। পিতা-মাতা বা অভিভাবককে বলা হয়েছে তারা যেন নিজেদের মেয়েকে বয়সের দিক দিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন লোকের কাছে বিবাহ না দেয়। তবে বিভিন্ন অপরিহার্য কারণে ব্যতিক্রম হতে পারে। এই বলে কোন স্বার্থের বশবর্তী হয়ে থুথুরে বুড়োর সাথে যুবতী মেয়ের বিবাহ সমর্থনযোগ্য নয়। এরূপ কাজ অত্যন্ত অপত্তিকর ও অভিসম্পাতযোগ্য। কোন কোন ফিকাহবিদ এই ধরনের বিবাহকে হারাম মনে করেন।

মানব-মনের প্রশান্তি, নৈতিকতা রক্ষা, বংশধারা রক্ষা ও পারিবারিক শৃঙ্খলা বিধানের জন্য বিবাহ। এই সব কারণে যদি একাধিক বিবাহ অপরিহার্য হয়ে ওঠে তা হলে শর্তসাপেক্ষে একাধিক বিবাহের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে, তবে চারের অধিক নয়। আর কোন বিবাহ যদি অশান্তির কারণ হয়, তা একটি কিংবা একাধিক হোক তার অনুমতি নেই। একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা হচ্ছে “বাস্তব ইনসাফ ও সমতা রক্ষা”। আর যদি ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করতে না পারার ভয় থাকে তা হলে এক বিয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, একাধিক বিবাহের যত অপরিহার্যতাই দেখা দিক না কেন বিভিন্নতা সৃষ্টি করে পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট করা যাবে না। ইসলাম অপরিহার্যতার কারণে একাধিক বিবাহের অনুমতি দিলেও উৎসাহ দিয়েছে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণের জন্য। আর এটাই হচ্ছে বিবাহের ক্ষেত্রে মানবিকতা।

পারিবারিক জীবন মাধুর্যময় ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য ইসলামী দিক নির্দেশনা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কল্যাণ কামনায় একাত্ম হবে। একে অপরের সাথে উত্তম আচরণ করবে। ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল হতে হবে। পারিবারিক সিদ্ধান্তসমূহ আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। মহানবী (সা) বাচ্চাকে বুকের দুধ কত দিন খাওয়াবে এমন ক্ষুদ্র সিদ্ধান্তও স্বামী-স্ত্রীকে পরামর্শ করে নিতে বলেছেন। মহানবী (সা) নিজে হযরত খাদীজা (রা), হযরত আয়েশা (রা)-সহ অন্যান্য সকল উম্মেহাতুল মু’মিনিনের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন। সুখ- শান্তির সময় যেমন দুঃখ-কষ্টের সময়ও তেমনি একে অপরের অংশীদার হবে। অংশীদারিত্ব থাকবে সর্বক্ষেত্রে, সর্বসময়ে।

পারিবারিক জীবনের অন্যতম কাজ হচ্ছে সন্তান জন্মদান ও সন্তান লালন-পালন করে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা। পারিবারিক কল্যাণ ও সুখ-শান্তির জন্য সন্তান জন্মদান যেমন অপরিহার্য তেমনি সন্তান জন্মদানই অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন তা পারিবারিক সম্পদের সাথে অসংগতিপূর্ণ হয়ে যায়। দু’টি সন্তান লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষা দেয়ার আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন পরিবারে যদি এই সংখ্যা দু’য়ের অধিক হয়ে যায় তখন এই পরিবারের জন্য অধিক সন্তান হয়ে যায় অশান্তির কারণ। অসুস্থ মা যদি একের পর এক সন্তান জন্ম দিতে থাকে তখন মায়ের জন্য তা হয়ে যায় মৃত্যুতুল্য আজাব। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তার সাধ্যাতীত কোন কষ্ট দেন না। পবিত্র কুরআন মজীদে এ কথাটি তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে যদি পিতা-মাতার জন্য তাদের ভরণ-পোষণ, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা দেয়া সাধ্যাতীত হয়ে যায় তখন তা থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে কুরঅেেনর উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে সামঞ্জপূর্ণ। দৈনন্দিন ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায়। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া ফরয। কিন্তু যদি শারীরিক কোন অসুবিধা থাকে তাহলে বসে পড়ার অনুমতি রয়েছে। রমযান মাসে রোজা রাখা ফরয। অসুস্থ কিংবা সফরে থাকলে সুস্থ হয়ে কিংবা বাড়ি ফিরে তা আদায় করতে বলা হয়েছে। অজু করা ফরয। কিন্তু পানি না থাকলে তায়াম্মুম করার বিকল্প ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে সন্তান জন্মদান ভাল কাজ। যদি তা কষ্টের কারণ হয়, তখন তা থেকে বিরত থাকা কোন দোষ নয়, বরং জরুরী।

স্বামী-স্ত্রীর মিলন মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য। সন্তান জন্ম স্বীয় সাধ্যের মধ্যে সীমিত রাখতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক মিলনকে বাধাগ্রস্ত না করে মানব জীবন ধারণের উপাদানগুলোকে (শুক্রকীট ও ডিম্বাণু) পৃথক রাখার কৌশল অবলম্বনে ইসলামে কোন বিধি-নিষেধ নেই। পবিত্র কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার সময়কালে অপ্রত্যাশিত সন্তান গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য তখনকার লোকজন আজল (শুক্রকীট ও ডিম্বাণু পৃথক রাখার একটি কৌশল) করতেন। কিন্তু কুরআন মজীদে তা নিষিদ্ধ করার কোন বিধান নাযিল হয়নি।

গর্ভধারণ থেকে শুরু করে বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের প্রতি পিতামাতার কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ভ্রুণ থেকে শুরু করে সন্তানের

স্বাভাবিক শারীরীক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এজন্য দরকার সন্তান ও সন্তানের মায়ের পরিমিত পুষ্টিকর খাদ্য। পরিমিত পুষ্টিকর খাদ্য দেহের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে এবং সন্তান মেধাবী হয়ে বড় হয়। সন্তানের সুন্দর নাম রাখা এবং অসুখ- বিসুখে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান পিতার দায়িত্ব। জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়লে দীনি শিক্ষাসহ কর্ম করে খাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান এবং কর্মসংস্থান হওয়ার পর বিবাহ দেয়া সন্তানের প্রতি পিতার অন্যতম দায়িত্ব। এই সময়টায় যাতে সন্তান বিপথগামী না হয় তা দেখার ভারও পিতার উপর। সন্তান যদি দুশ্চরিত্র, হাইজাকার ও সন্ত্রাসী হয় তার দায়িত্ব পিতার উপর বর্তায়। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ হচ্ছে: “তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পরিবারকে দোযখের আজাব থেকে রক্ষা কর।” মহানবী (সা) বলেছেন: “তোমাদের সন্তানদের ভাল স্বভাব-চরিত্র শিক্ষা দাও।” কোন সন্তান যদি অপুষ্টির কারণে মেধাহীন হয়, পঙ্গু হয়, বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, মূর্খ ও বেকার থেকে যায় তার দায়িত্বও পিতার উপরই বর্তায়। নবী করীম (সা) বলেছেন: “সন্তানদের এমন গুণে তৈরি করে তোল যাতে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মুখাপেক্ষিহীন হয়ে ওঠে। এটা অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর কাজ। এটি যে বেশি করবে আল্লাহ্ তাকে বেশি পুরস্কার দেবেন।” সুতরাং উপরোক্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম না হলে সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে উত্তম।

সন্তানদের মধ্যে কোনরূপ তারতম্য ইসলামে নিষিদ্ধ। সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে সুবিচার, ইনসাফ ও নিরপেক্ষতা প্রদর্শন পিতামাতার কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা) বলেছেন: “তোমরা তোমাদের সন্তানদের মধ্যে সুবিচার কর, ন্যায়পরায়ণতা স্থাপন কর ও ইনসাফ কর।”

ইসলামে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে তেমনি সন্তানের উপর পিতামাতার হক আছে। ইসলামে পিতা-মাতার হকের স্থান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলার হকের পরপরই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ হচ্ছে: “তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে অবশ্যই সর্বোত্তম ব্যবহার করবে। তাদের জন্য দোয়া করবে এবং বলবে, ‘হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতার উপর রহমত নাযিল কর, যেমন তাঁরা দু’জনই আমাকে আমার ছোট অবস্থায় লালন-পালন করেছেন।” পিতা-মাতার সাথে আচার-আচরণের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত কঠোর নীতি অবলম্বন করেছে। তাদের সাথে কোন অবস্থাতেই কোনরূপ খারাপ আচরণ করা যাবে না। পিতা-মাতার সাথে খারাপ আচরণ বা সম্পর্ক ছিন্ন করা কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হক আদায়ের ক্ষেত্রে পিতার চেয়ে মা এক ধাপ এগিয়ে। মর্যাদার ক্ষেত্রেও অনুরূপ। পিতা-মাতার প্রতি হক আদায়ের বিষয়ে মহানবী (সা) বলেছেন: পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ অবস্থায় যদি কেউ তাদের খেদমতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করে বেহেশতে যাওয়ার অধিকারী না হয় তার মতো বদ-নসীবওয়ালা আর কেউ নয়।

ইসলামে পরিবার গঠন উৎকৃষ্ট কাজ, প্রশান্তির কাজ; ভাঙন নিকৃষ্টতম কাজ – মর্মন্তুদ কাজ। তাই ইসলাম পরিবার গঠন এবং তা পরিচালনার নীতিমালা এমনভাবে প্রদান করেছে যাতে দ্বিতীয় কাজটির প্রয়োজন না হয় (যা বর্ণনা করা হয়েছে)। এসব নীতি যথাযথভাবে অনুসরণ না করার কারণে যদি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক এতদূর খারাপ হয়ে যায় যে, তা সংশোধন বা পরিবর্তনের শেষ আশাটুকুও বিলীন হয়ে গেছে, তখন উভয়ের ভবিষ্যৎ জীবনকে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও তিক্ততার বিষাক্ত পরিণতি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পারিবারিক কল্যাণের স্বার্থে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাককে একটি ঘৃণিত কাজ হিসেবে ইসলাম অনুমতি দিয়েছে। তারপরও এটা সম্পন্ন হতে হবে সর্বোত্তম পন্থায়। এক সাথে, এক কথায় নয়। সংশোধনের সময় নিয়ে তিনমাসে, তিন বার।

এভাবে ইসলাম পারিবারিক অশান্তির কারণ চিহ্নিত করে তার প্রতিবিধানের মাধ্যমে মানবজাতিকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন উপহার দিয়েছে। যার মূল সুর হচ্ছে পারিবারিক কল্যাণ ও প্রশান্তি। ইসলামের এই অনুপম বিধানাবলি মহানবী (সা) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করে বিশ্বমানবকে একটি কল্যাণ-পরিবার তথা কল্যাণ-সমাজ গঠনে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন৷

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan