সমাজের সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

রচনায়: আহমদ আলী

সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতি কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং যান্ত্রিক ও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। অবশ্যই সমাজের উন্নতি-অগ্রগতিতে এগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতি পরিমাপের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ তথা প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, সহানুভূতি, বদান্যতা, মানবতা, সততা, সরলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, সাধুতা, ভ্রাতৃত্ব, সৌন্দর্য, মহানুভবতা, পরোপকার ও বিশ্বস্ততা প্রভৃতি পুরো মাত্রায় কার্যকর থাকা।

যে সমাজে এ মানবীয় মূল্যবোধসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে না, সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির কারণে বস্তুতান্ত্রিক উন্নতি সাধিত হতে পারে বটে; কিন্তু সে সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব নয়। সমাজ-জীবনের প্রয়োজন ও উন্নতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বস্তুতান্ত্রিক উন্নতি ও মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ- এই উভয় দিককে স্মরণ রাখতে হবে। সমাজ-জীবনকে সুস্থ, উন্নত ও সমৃদ্ধ করার জন্য উভয় দিকের ভারসাম্য রক্ষা করে মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশকে ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।

সমাজ-জীবন সদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধগুলো চিরন্তন ও শাশ্বত। এগুলো সমাজের এক দিকে নয়; বরং সর্বক্ষেত্রে বিকশিত হয়ে একে সুখী, সমৃদ্ধ ও সোনালী সমাজ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। উন্নতমানের ভারসাম্যপূর্ণ নিপুণ শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যাকে যদি জীবন ও এর মৌলিক মূল্যবোধের আজ্ঞাবহ করে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে জীবনের গুণাগুণগুলো বা সুকুমার বৃত্তিগুলো অধিকতর সমৃদ্ধিশালী হয়ে প্রস্ফুটিত হয়। তবে সামাজিক জীবনে অবশ্যই মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশকে বস্তুতান্ত্রিক উন্নতির উপর প্রাধান্য দিতে হবে। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নবী (সা)-কেও এই মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ ও পূর্ণতা সাধনের জন্যে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন: “নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের উপর কায়েম রয়েছেন।” (আল-কুরআন, ৬৮: ৪) মহানবী (সা)-ও বলেন: “চরিত্রের সৎ গুণসমূহ সম্পূর্ণরূপে বিকশিত করার জন্যেই আমি প্রেরতি হয়েছি।” (মুয়াত্তা)

হযরত মহানবী (সা) সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য কয়েকটি মূলনীতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করেছেন। এগুলো যেমন সমাজের সর্বস্তরের লোকের মধ্যে মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধের প্রবল চর্চা ও বিকাশ ঘটিয়েছিল, তেমনি সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও বিধান করেছিল। তাঁর সমাজের প্রত্যেক সদস্যই এ মূলনীতিগুলো বাধ্যগতভাবে মেনে চলতেন। ফলে যেমন তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই এক-একজন সৎ, আদর্শ, মহানুভব ও পূত-পবিত্র ব্যক্তিতে পরিণত হন, তেমনি তাঁদের সমাজও পরিণত হয়েছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও আদর্শ সোনালী সমাজে। উল্লেখ্য যে, তাঁর অনুসৃত মূলনীতিগুলো সর্বোতভাবে ঈমান ও তাকওয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই উক্ত মূলনীতিসমূহ তাঁর সমাজে স্থায়ী ও যথার্থরূপে বাস্তবায়িত হয়। পরেও যতদিন পর্যন্ত মুসলিম সমাজে ঈমান ও তাওয়ার পূর্ণ চর্চা ছিল এবং কালিমা ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ সঠিক অর্থ ও হক সহকারে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত সেখানে সর্বক্ষেত্রে সুখ ও শান্তির অপার মহিমা বিরাজ করছিল। কারো কোন প্রবৃত্তির লালসা, রিপুর তাড়না ও বিপদের ঝক্কি- ঝামেলা কোনটিই এ মূলনীতগুলোর বাস্তবায়ন ও কার্যকরকরণে কোনরূপ ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারেনি। তদুপরি যুগের কালচক্র, ক্ষমতার রদবদল ও সমাজের পরিবর্তন প্রভৃতিও এগুলোর নির্মলতাকে কোনরূপ কলুষিত করতে পারেনি।

নিম্নে সুস্থ সমাজ গঠনে হযরত মহানবী (সা)-এর অনুসৃত মূলনীতিগুলো উল্লেখ করা হল:

১. আদল (ন্যায়পরায়ণতা)

‘আদল’ তথা ন্যায়পরায়ণতা সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রধান চাবিকাঠি। তাই আল্লাহ তা’আলা সমাজে পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিভিন্ন আয়াতে ন্যায়- নীতি প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও৷ আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন ন্যায়ভিত্তিক মীমাংসা কর।” (আল-কুরআন, ৪:৫৮)। তিনি আরো বলেন: “আল্লাহ তা’আলা ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন।” (আল-কুরআন, ১৬:৯০)

আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে বিভিন্ন নবী-রাসূল ও কিতাব পাঠিয়েছেন। এর পিছনে তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়-নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে।” (আল-কুরআন ৫৭ : ২৫)। তিনি অন্যত্র বলেন: “বলুন, আল্লাহ্ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। উপরন্তু, আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি।” (আল-কুরআন, ৪২ : ১৫)

ইসলামে ন্যায়পরায়ণতার দর্শনটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং যে কোন ধরনের আবিলতা থেকে মুক্ত। এর অনুপম বৈশিষ্ট্য কোন ধরনের শত্রুতা-মিত্রতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মত নয়। উপরন্তু, আত্মীয়তা ও বংশীয় সম্পর্ক এর পবিত্রতায় কোন ধরনের খুঁত সৃষ্টি করতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক। আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য দান কর। তাতে তোমাদের নিজেদের বা পিতামাতার বা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের যদি ক্ষতি হয় তবুও।” (আল-কুরআন, ৪: ১৩৫) তিনি অন্যত্র বলেন: “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাক এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর। এটিই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী।” (আল-কুরআন, ৫ : ৮) তিনি আরো বলেন: “যখন তোমরা কথা বল, তখন সুবিচার কর, যদিও সে আত্মীয় হয়।” (আল-কুরআন, ৬ : ১৫২)

উপরোক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা ন্যায় ও সুবিচারের ক্ষেত্রে নিজের ও পিতামাতার এবং আত্মীয়স্বজনের পরওয়া করা যাবে না। যদি ন্যায়বিচার তাদের বিরুদ্ধেও যায়, তবে তাতেই কায়েম থাকতে হবে। তা ছাড়া কোন শত্রুতার কারণে ন্যায়-নীতি থেকে পশ্চাদপদ হওয়া উচিত নয়। হযরত মহানবী (সা) বলেন: “তোমরা আত্মীয় ও অনাত্মীয় নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ দণ্ডবিধি কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে তোমরা কারো কোন ভর্ৎসনার পরওয়া করো না।”

হযরত মহানবী (সা) সামাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বলতম উদাহরণ রেখেছিলেন। তিনি তাঁর পরিচালিত সমাজ ও রাষ্ট্রে সুবিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে কতোখানি সচেতন ছিলেন নিচের রেওয়ায়েতটি তার প্রমাণ বহন করে। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, একবার মখযুম গোত্রের জনৈকা মহিলা চুরি করে। যখন তার চুরি প্রমাণিত হয় তখন আল্লাহর রাসূল তার হাত কাটার নির্দেশ দিলেন। মাখযুম গোত্রের লোকজন তাদের বংশের একজন নেতৃস্থানীয় লোকের স্ত্রীর হাত কাটতে সংকোচবোধ করল। তাই তারা মহিলাটির ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)- এর একান্ত স্নেহভাজন হযরত উসামা ইবনু যায়দ (রা)-কে ঠিক করল। তিনি আল্লাহর রাসূলের সাথে সেই মহিলার ব্যাপারে আলাপ করলেন। তখন হুযূর (সা) বললেন: “তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ?” অতঃপর তিনি মুসলমানদের ডেকে বক্তৃতা দিলেন এবং বললেন: “তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মত গত হয়েছে তারা এই জন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নিম্নশ্রেণীর অপরাধীদেরকে তারা আইন অনুযায়ী শাস্তি দিত, আর উচ্চশ্রেণীর অপরাধীদেরকে ছেড়ে দিত। সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, [মুহাম্মদের (সা) কন্যা] ফাতিমাও যদি চুরি করতো, তবে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।” (বুখারী)

হযরত মহানবী (সা)-এর এ ধরনের ঘটনা একটি-দু’টি নয়, শত শত। ন্যায় ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকবে। নিচে তাঁর আরো কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হল।

১. বর্ণিত রয়েছে: একবার সোরাকা নামক জনৈক সাহাবী এক বেদুঈনের নিকট থেকে একটি উট ক্রয় করে। কিন্তু সে তার মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি। তাই বেদুঈন ব্যক্তিটি তাঁকে ধরে নিয়ে হুযূর (সা)-এর দরবারে হাযির করল। হুযূর (সা) তাকে মূল্য পরিশোধ না করার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তখন সে বলল: আমার মূল্য পরিশোধ করার সামর্থ্য নাই। হুযূর (সা) বেদুঈনকে বললেন: তুমি তাকে বাজারে বিক্রয় করে সেই মূল্য দিয়ে তোমার পাওনা উসুল করে নাও। বেদুঈন তাই করল। (দারে কুতনী)

২. বর্ণিত রয়েছে: একদিন ঘটনাক্রমে নবী করীম (সা)-এর হতের ছড়ির খোঁচায় এক ব্যক্তি সামান্য আহত হয়। তিনি সাথে সাথেই সে ব্যক্তিকে প্রতিশোধ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে সে ব্যক্তির দিকে নিজকে এগিয়ে দিলেন। লোকটি লজ্জিত স্বরে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি মাফ করে দিলাম। (আবূ দাউদ)

হযরত মহানবী (সা) কেবল নিজের আমলের মাধ্যমে নয়; বরং লোকদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতাবোধ জাগ্রত করার মহান উদ্দেশ্যে অসংখ্য বাণীর সাহায্যেও ন্যায়- নীতির গুরুত্ব ও মহিমা এবং অন্যায় ও অবিচারের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। নিচে তাঁর এ ধরনের কয়েকটি বর্ণনা পেশ করা হল।

ক. কিয়ামতের দিন সাত প্রকারের লোক আরশের ছায়ার নিচে অবস্থান করবে, তন্মধ্যে অন্যতম প্রকার হল ন্যায়পরায়ণ শাসক। (বুখারী ও মুসলিম)

খ. ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ আল্লাহর অতি প্রিয় বন্ধু। পক্ষান্তরে অত্যাচারী বাদশাহ আল্লাহর ঘোর শত্রু এবং ভীষণ দণ্ড ভোগের উপযোগী। (কিমিয়ায়ে সা’আদত)

গ. কোন শাসনকর্তার একদিনে ন্যায় ও সুবিচারের সাথে রাজ্যশাসন করা একাধারে ৬০ বছর যাবত লাগাতার আল্লাহর ইবাদত করা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। (কিমিয়ায়ে সা’আদত)

ঘ. বিচারকগণ তিন শ্রেণীর। এক শ্রেণীর বিচারকগণ জান্নাতী, অন্য দু’শ্রেণীর বিচারকগণ জাহান্নামী। জান্নাতী হল সেই বিচারকগণ যারা সত্যকে জেনে সেই অনুযায়ী সঠিক ফায়সালা করে। আর যারা সত্যকে জানার পরেও অন্যায় ফায়সালা করে তারা জাহান্নামী। এ ছাড়া যারা না জেনেও ফায়সালা করে তারাও জাহান্নামী।

হযরত মহানবী (সা) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেও সমাজে ন্যায় ও ইনসাফের একান্ত প্রতিভূ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। রবী ইবনু খায়ছম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেও লোকেরা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদ মীমাংসা করার জন্য হুযূর (সা)-এর নিকট মুকাদ্দমা দায়ের করতো।” (শিক্ষা) বর্ণিত রয়েছে, ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে কাবা গৃহ সংস্কারের সময় কুরায়শগণ ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে কেন্দ্র করে এক তুমুল সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। গোত্রপতিগণ এই মর্মে শপথ করল যে, প্রয়োজনে আমরা প্রাণ উৎসর্গ করব, তবু এই হাজরে আসওয়াদ অন্য কোন গোত্রকে সংস্থাপন করতে দিব না। এ সঙ্গীন অবস্থায় আবূ উমাইয়া বিন মুগীরা নিজের জাতিকে এই অত্যাসন্ন ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য বললেন: “যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম কাবা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করবেন তাঁর হাতে এর নিষ্পত্তির ভার অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হও।”

সকলে এ প্রস্তাব মেনে নিল এবং উদ্বিগ্ন হৃদয়ে আগন্তুকের অপেক্ষায় কাবার চারদিকে পলকহীন নেত্রে নিরীক্ষণ করতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ সহস্র কণ্ঠ থেকে আনন্দ ধ্বনি উত্থিত হলো: “হাজা মুহম্মদুন হাজাল আমীনু, কুদ রদীনা বিহ”- অর্থাৎ এ আমাদের সাধুবর বিশ্বস্ত মুহাম্মদ, আমরা সকলেই তাঁর মীমাংসায় সম্মত। মুহাম্মদ (সা) সমস্ত ঘটনা অবগত হয়ে নিজেই একখণ্ড চাদরের উপর হাজরে আসওয়াদটি সংস্থাপন করলেন এবং গোত্রপতিদেরকে হাজরে আসওয়াদসহ ঐ চাদরটি নবনির্মিত গৃহের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আনতে বললেন। অতঃপর তিনি স্বয়ং চাদর থেকে তা উঠিয়ে নিয়ে যথাস্থানে সংস্থাপন করলেন। এভাবে হুযূর (সা) এক অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ যুদ্ধ থেকে সমাজকে রক্ষা করলেন। এভাবে মহানবী (সা) নবুয়ত লাভের পূর্বে সামজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। এ কারণেই দেখা যায়, হাজরে আসওয়াদ সংস্থাপনের ঘটনার ফায়সালা শোনার পূর্বেই প্রত্যেক পক্ষই তাঁর ফায়সালার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জাহির করেছিল (শিফা)

হযরত মহানবী (সা)-এর পরে দীর্ঘদিন মুসলিম সমাজে এ ন্যায়পরায়ণতার মহান আদর্শটি এভাবে কার্যকর ছিল যার নজীর গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায় না। তখন মুসলিম সমাজগুলো অনাবিল সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরপুর ছিল। তখনকার মুসলমানগণ সামাজিক অনাচার ও অবিচার, দুর্নীতি ও নির্যাতনমুক্ত এমন সাবলীল আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার তুলনা বিরল। বর্তমানেও এ মহান নীতিটি যথার্থভাবে কার্যকর করা হলে এটি সমাজের সর্বক্ষেত্রে অনাবিল সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বয়ে আনবে, এতে লেশমাত্র সন্দেহ নেই।

বর্ণিত রয়েছে : “জারাহ ইবনু আবদুল্লাহ হুকমী ছিলেন খোরাসনের গভর্নর। সেখানকার লোকদের চাল-চলন ও আচার-ব্যবহার ছিল খুবই খারাপ। গভর্নর আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনু আবদুল আজীজ (র)-কে এক পত্রে সব লিখে আরয করলেন: “কোড়া এবং তরবারী ছাড়া অন্যকিছু এ লোকদের ঠিকপথে আনতে পারবে না। আপনি ভাল মনে করলে অনুগ্রহ করে এ কাজের অনুমতি দিবেন।” গভর্নরের চিঠির জবাবে আমীরুল মু’মিনীন তাকে লিখে পাঠান: খোরাসানের লোকদের কোড়া আর তরবারী ছাড়া অন্য কোন জিনিসই সঠিক পথে আনতে পারবে না-তোমার এ বিবেচনা নেহাত ভুল। মূলত ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শই কেবল মানুষকে সঠিক পথে আনতে সক্ষম। সুতরাং সর্বত্র তুমি আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করো।”

এটিই হচ্ছে সমাজে শান্তির দর্শন, যা দুনিয়ার সামনে শান্তির মহাদূত হযরত মুহাম্মদ (সা) পেশ করেছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা পরিবর্তীকালে অমুসলিম সমাজদর্শনের শিক্ষা লাভ ও তার অনুবর্তন করার ফলে খোদ তাদের সমাজগুলোই অশান্তি ও ফ্যাসাদে ভরপুর হয়ে গিয়েছিল।

২. সাম্য (Equality)

সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বুঝানো হয় সকল মানুষ সমান। জন্মগতভাবে তাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, যদিও ক্ষমতা ও যোগ্যতার দিক থেকে এক জনের সাথে অন্য জনের পার্থক্য রয়েছে এবং এর ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধারও তারতম্য হয়ে থাকে; কিন্তু জাতি, বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও পেশার কারণে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নেই; বরং মানুষ হিসেবে সকলে একই সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হবে এবং সকলের জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।

‘সাম্য’ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মূলনীতি। ইসলাম জন্মগতভাবে কেউ উৎকৃষ্ট ও কেউ নিকৃষ্ট-এ ধারণাকে অস্বীকার করে এবং সমগ্র মানব জাতির সমান মর্যাদা ও ঐক্যের সূত্র উপস্থাপন করে। উপরন্তু, তা আজকের বর্ণবাদ, কৌলীন্যবাদ এবং আশরাফ ও আতরাফের মূলে চরম কুঠারাঘাত হানে। ইসলামের আলোকে জাতি, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলগত বিভক্তি কোন ভেদাভেদ বা বৈষম্য সৃষ্টির জন্য করা হয়নি; বরং মানুষের পারস্পরিক পরিচয়ের সুবিধার জন্য করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: “হে মানুষ! আমি তোমাদের সবাইকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে ও জাতিতে বিভক্তি করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মর্যাদাবান হচ্ছে সে ব্যক্তি যে তাঁকে অধিক ভয় করে।” (আল-কুরআন ৪৯ : ১৩)।

হযরত আলী (রা) বলেন :

“আকৃতির বিচারে, সকল মানুষ সমান

পিতা তাদের আদম (আ), আর মা হল হাওয়া।

তাদের বংশে যদি, থাকে কিছু গৌরবের

নাহি মূল্য তার,

কারণ মাটি ও পানিই তাদের মূল।”

মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্য যখন সমগ্র দুনিয়ায় চরম অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে যাচ্ছিল, তখনি হযরত মুহাম্মদ (সা) ভেদাভেদ ও বৈষম্যের যাবতীয় প্রাচীর ধ্বসিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সাম্যের সুমহান নীতি। আরবের কুরায়শরা বংশ-মর্যাদার অহংকার করতো। হযরত মুহাম্মদ (সা) মক্কা বিজয়ের দিন ঘোষণা করেন: “হে কুরায়শগণ! আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জাহিলী যুগের অহংকার এবং গোত্রীয় অহমিকা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। তোমরা সকলে আদম (আ)-এর সন্তান। আর আদম (আ)-কে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (দায়লামী) বিদায় হজ্জের শেষ ভাষণে হুযূর (সা) এই ঘোষণার দিগন্তকে বিশ্বব্যাপ্ত করে জাগদ্বাসীকে শুনিয়ে দেন: “হে মানুষ! তোমরা প্রত্যেকেই আদমের সন্তান। আর আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। অতএব বংশের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। অনারবদের উপর আরবদের এবং আরবদের উপর অনারবদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নিকট অধিকতর মর্যদাবান হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে। (আহমদ)।

হযরত মহানবী (সা) কেবল সাম্যের ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হন নি; বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রকৃষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি হাবশী ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রা) – কে মসজিদে নববীর মহামর্যাদাবান ‘মুআজ্জিন’-এর পদে অধিষ্ঠিত করেন। তাঁর ফুফাতো বোন হযরত যয়নব (রা)-কে তিনি ক্রীতদাস যায়দের সাথে বিয়ে দেন। বর্ণিত রয়েছে: হযরত যয়নুল আবেদীন (রা) একজন খাঁটি ফাতেমী সাইয়েদ ছিলেন। তিনি বাস্তবভাবে বংশ-গৌরব মিটিয়ে দেবার জন্য নিজের একটি কন্যাকে গোলামের সাথে বিয়ে দেন এবং একটি দাসীকে আযাদ করে দিয়ে নিজে তাকে বিয়ে করেন। খলীফা আবদুল মালিক ঘটনা জানতে পেরে এক চিঠিতে তাঁকে নিন্দা জ্ঞাপন করেন। চিঠির জবাবে ইমাম তাকে লিখে পাঠান: “আল্লাহর রাসূলের জীবনদর্শই আমাদের জন্য একমাত্র অনুসরণীয়। তিনি দাসী সফিয়া বিনতে হুয়াইকে আযাদ করে দিয়ে তাঁকে বিয়ে করেন এবং নিজ গোলাম যায়দ ইবনে হারেসাকে আযাদ করে দিয়ে নিজ ফুফাতো বোন যয়নব বিনতে জাহশকে তাঁর নিকট বিয়ে দেন। আমি এবং তুমি কেউই আল্লাহর রাসূল (সা)-এর চেয়ে সম্মানিত নই।”

এ ছাড়া হযরত মহানবী (সা) যায়দের পুত্র উসামাকে রোমকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এই অভিযানে কুরায়শ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন আরব গোত্রের বিশিষ্ট সৈনিকরা ছিলেন। এভাবে তিনি সকল দেশের সকল গোত্রের সকল বর্ণের সকল ভাষার লোকদের নিয়ে গড়ে তোলেন এক বিশাল ভ্রাতৃসমাজ। সেখানে আমীর-গোলাম, সাদা কালো, হাবশী-রূমী, ইরানী-আরবী সবাই একে অপরের ভাই ছিলেন। কারো সাথে কারো কোন ভেদাভেদ ছিল না। এভাবে তাঁর জীবদ্দশায় সাম্যের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন।

মোট কথা, হযরত মহানবী (সা)-এর প্রতিষ্ঠিত সমাজে সকল মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী ছিল। বলা হয়: মানুষ চিরুনির মতই। চিরুনির দাঁতগুলো যেমন সমান তেমনি মানুষও পরস্পর সমান। এ কথার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর সমাজে। তাঁর মতে বর্ণ, জাতি, ভাষা ও অঞ্চল কোনটিই শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নয়। কেবল ইম (জ্ঞান-গরিমা), তাওয়া (পরহেজগারী) ও মানবসেবা এ তিনটি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একজন অন্য জনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে। তাঁর সমাজে জ্ঞানী, আল্লাহভীরু ও মানবসেবাকারীদের যথার্থ কদর ছিল। তিনি জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে কোন সময় অজ্ঞ ও মূর্খদের সমান পর্যায়ে দেখেন নি; তদুপরি আল্লাহভীরু ও মানবসেবাকারিগণ আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদা ও ফযীলত লাভ করবেন। তাঁর নিম্নোক্ত বাণীসমূহ এ কথার প্রমাণ দেয়। তিনি বলেন:

ক. “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে চলে এবং তাঁর কথা বেশি স্মরণ রাখে। সুতরাং কোন আরবী লোক অন্য কোন অনারবী বা আজমী লোকের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। তদ্রূপ শ্বেতকায় কোন ব্যক্তি কৃষ্ণকায় লোকের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। হ্যাঁ, মর্যাদা ও সম্মানের যদি কোন মাপকাঠি থাকে তবে তা একমাত্র তাকওয়া তথা পরহেজগারী।” (বিদায় হজ্জের ভাষণ থেকে সংগৃহীত)

খ. “অশিক্ষিত ইবাদতকারীর উপর আলিম ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব তোমাদের মধ্যকার নিকৃষ্টতর ব্যক্তির উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব-সদৃশ।” (তিরমিযী)।

গ. “সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজনস্বরূপ। যে তাঁর পরিজনদের অধিক উপকার করে সে আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় ব্যক্তি।” (বাযযার)।

উপরোক্ত রেওয়ায়েতসমূহ দ্বারা বোঝা যায়, তাঁর সমাজে একদিকে সাদা-কালোতে প্রভেদ ছিল না, উঁচু-নীচুতে পার্থক্য ছিল না, ধনী-গরীবের মধ্যে বিভেদ ছিল না এবং আরব-অনারবের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না; অন্যদিকে সেখানে জ্ঞানী, সৎ ও আল্লাহভীরু লোকদের যথার্থ সম্মান ছিল। ফলে সেখানে যেমন অপূর্ব সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় তেমনি জ্ঞান, তাকওয়া, সততা ও পরোপকারিতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের প্রভূত বিকাশ সাধিত হয়। এভাবে অতি অল্প দিনের মধ্যে তাঁর সমাজ একটি অনুপম ও আদর্শ সোনালী সমাজে রূপান্তিরিত হয়, যার নজীর গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যায় না। টমাস কার্লাইল বলেন: “The revolution brought by prophet Mohammad (SM) was a great spark of fire which within a twinkle of eye, burn out all rubishes of inhumanity and untruths that errect- ed their heads from Delhi to Granada and from earth to sky.” “হযরত মুহাম্মদ (সা) কর্তৃক সংঘটিত বিপ্লব ছিল প্রচণ্ড এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যা দিল্লী থেকে গ্রানাডা এবং মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত যে অসত্য ও অমানবিকতার আবর্জনা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল তা চোখের পলকে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলল।”

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদিও নীতিগতভাবে স্বীকার করে নেয়া হয় যে, সকল মানুষ সমান; জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভাষা ও পেশাগত কারণে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু বাস্তবে এর কার্যকারিতা খুবই দুর্লভ। বর্তমানে দেশে দেশে জাতিগত সংগ্ৰাম চলছে। চলছে বর্ণগত সংঘাত। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার অপরাধে শ্বেতাঙ্গদের হোটেলে, রেস্তোঁরায়, অফিস-আদালতে, এমনকি বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে দেখা যায়। এখনো কৃষ্ণাঙ্গদেরকে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের বর্ণবাদী ঘৃণার শিকার হতে দেখা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের বর্ণবাদী ঘৃণার মারাত্মক রূপ সবাই লক্ষ্য করেছে। আবার বর্ণবাদী ইসরাইল আরব মুসলমানদের উপর এবং বর্ণবাদী খ্রিস্টান সার্বগণ বসনিয়া ও কসোভোর মুসলমানদের উপর নির্যাতনের যে স্টীম রোলার চালিয়েছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে সমগ্র বিশ্ব অবহিত।

৩. সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা

হযরত মহানবী (সা)-এর সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ন্যায়পরায়ণতা ও সামাজিক সাম্যের সুবাদে সকলেই সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। তিনি যেমন সকল মানুষকে একই চোখে দেখেন এবং সমাজের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেন, তেমনি তিনি সমাজের প্রতিটি সদস্যের জন্য তার সকল সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত রাখেন, যাতে প্রত্যেকেই নিজ নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা ও শক্তি অনুপাতে আত্মবিকাশের সুযোগ লাভ করতে পারে।

‘সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা’ বলতে প্রত্যেকেই একই ধরনের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে- তা উদ্দেশ্য নয়। কেননা ক্ষমতা ও যোগ্যতার দিক থেকে মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে এবং থাকবেও। তাই প্রত্যেকেই সমাজের নিকট থেকে একই ব্যবহার ও সুযোগ-সুবিধা দাবি করতে পারে না। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা চিন্তাবিদ পণ্ডিতকে যে বেতন-ভাতা দেয়া হয় একজন দারোয়ান বা পিয়ন তা দাবি করতে পারে না। একজন রাষ্ট্রনায়ক বা বিচারককে যে সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় সমাজের প্রত্যেককে এ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, এটা জরুরি নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- সকলের সামনে সমাজের সুযোগ- সুবিধার সকল দ্বার উন্মুক্ত রাখা। অর্থাৎ সমাজ জীবনের পরিবেশকে এমন সুষমরূপে গড়ে তোলা যাতে প্রত্যেক নাগরিক আনুপাতিক হারে সমানভাবে আত্মবিকাশের সুযোগ পায়।

হযরত মহানবী (সা)-এর সমাজে যেমন প্রতিটি মানুষের জন্মগত আনুপাতিক সমান অধিকার সুনিশ্চিত ছিল এবং তাদের মধ্যে জাতি, বর্ণ, ভাষা ও পেশাগত কারণে কোন ভেদাভেদ ছিল না, তেমনি তিনি প্রতিটি মানুষের আইনগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নাগরিক সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সুনিশ্চিত করেছিলেন। আইনের চোখে সকলেই সমান—এটিই হল আইনগত সমানাধিকার। তাঁর সমাজে বৈষম্যমূলক কোন আইন ছিল না এবং সকলের আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ ছিল। তদুপরি, সেখানে জাতি, বর্ণ, বংশ ও ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের এবং জীবনধারণের জন্যে অর্থনৈতিক কাজে জড়িত হওয়ার সমান অধিকার লাভ করেছিল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুসারে আত্মবিকাশের সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিল। প্রত্যেকেই নিজের সামনে তার যোগ্যতা বিকাশের সমস্ত পথকে উন্মুক্ত অবস্থায় পেয়েছিল। জাতি, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল কোনটিই এ পথে তাদের প্রতিবন্ধক ছিল না। বর্তমানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদিও নীতিগতভাবে সকলের সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার কথা স্বীকার করে নেয়া হয়, কিন্তু বাস্তবে এর কার্যকারিতা দুর্লভ। আমরা বিভিন্ন দেশে দেখতে পাই, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা সকলের জন্যে সমানভাবে উন্মুক্ত নয়; বরং কোথাওঁ জাতি, কোথাও বর্ণ, কোথাও ধর্ম, কোথাও অঞ্চল, কোথাও পেশা, কোথাও ভাষা, আবার কোথাও দল ও মতের ভিত্তিতে সমাজের সুযোগ-সুবিধাগুলো বৈষম্যপূর্ণভাবে বন্টন করা হয়।

‘সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা’ মানব জীবনের উন্নতি এবং সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনের জন্যে অতীব প্রয়োজনীয়। কারণ যে সমাজে প্রত্যেকের যোগ্যতা ও আত্মার বিকাশের সমান সুযোগ থাকবে সেখানে প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার যথার্থ প্রমাণ রাখতে সমর্থ হয়। তদুপরি প্রত্যেকে আন্তরিকভাবে কামনা করে, সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধার দ্বার তাঁর কাছে উন্মুক্ত হোক এবং জীবনের মহান উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের পথ তার জন্য হোক অবারিত ও নিষ্কন্টক। হযরত মহানবী (সা)-এর প্রতিষ্ঠিত সমাজে যেমন নীতিগতভাবে এ সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার স্বীকৃতি ছিল, তেমনি এর নীতিমালাও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এই সুবাদে বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন বর্ণের ও বিভিন্ন ভাষাভাষীর যৌথ প্রয়াস ও সাধনার ফলে ইসলামী সভ্যতার উজ্জ্বল ও সোনালী সৌধ বিনির্মিত হয়েছিল। এ সভ্যতায় নির্দিষ্ট কোন জাতির বা নির্দিষ্ট কোন বর্ণের বা নির্দিষ্ট কোন ভাষাভাষীর একক কোন প্রয়াস ছিল না। হযরত মহানবী (সা) সমাজে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে কতোটা সচেতন ছিলেন বর্ণিত ঘটনাসমূহ তার প্রোজ্জ্বল প্রমাণ বহন করছে।

ক. বর্ণিত রয়েছে, বদর যুদ্ধের সময় মুসলমানদের নিকট মাত্র কয়েকটি উট ছিল। সিদ্ধান্ত হলো, সাহাবায়ে কিরাম উটগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবেন এবং তাঁরা পালাবদল করে মরু ময়দান পাড়ি দিয়ে বদরের দিকে এগিয়ে যাবেন।

নিয়মানুযায়ী মহানবী (সা)-এর দলেও দুজন সাহাবী ছিলেন। তাঁরা ভাবলেন- আল্লাহর প্রিয় রাসূলও অন্য দলের মত পালাবদল করে উটে আরোহণ করবেন তা কী করে হয়! তাঁরা প্রিয় নবীর খিদমতে আরয করলেন: “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি পুরো পথ এককভাবে উটে চড়ে গেলে ভাল হয়।” সেনাপতি রাসূল (সা) তাতে রাযী হলেন না। সেনাপতি বলে তিনি আরাম করবেন, আর সাধারণ সৈন্য বলে তারা পুরো পথ হেঁটে যাবে-এ বৈষম্য তিনি পছন্দ করলেন না। তিনিও অন্যদের মতই পালাবদল করে উটে আরোহণ করলেন।

এ ছিল হযরত মহানবী (সা)-এর সমান অধিকারের নীতি, যে নীতি থেকে তাবৎ পৃথিবী- জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই শিক্ষা নিতে পারে।

খ. একদা হঠাৎ সংবাদ এসে পৌঁছল যে, কাফিররা সম্মিলিতভাবে বিরাট রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে মদীনা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। হুযূর (সা) খবর শুনে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মদীনার চতুর্দিকে পরিখা খনন করে শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে।

সিদ্ধান্তমতে দৃশ-দশ জন দল বেঁধে দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন। আল্লাহর নবী ঘুরে ঘুরে দেখলেন। হযরত বিলাল (রা)-এর দলে নয়জন দেখে বললেন: তোমাদের দলে যেহেতু নয়জন সুতরাং আমাকেও তোমাদের সাথে নিয়ে নাও। সাইয়্যেদুল মুরসালীন আমাদের মত মাটি কাটবেন! সবাই কাজ করবেন তিনি করবেন না-এমনটি তাঁর পছন্দ নয়, তাই তাঁকে সাথে নিতেই হল।

এক পর্যায়ে হযরত বিলাল (রা) হুযূর (সা)-এর মস্তক মুবারকে এক টুকরী মাটি তুলে দিলেন। তখন হুযূর (সা) বললেন: “আরেক টুকরী দাও।” হযরত বিলাল (রা) আরয করলেন: “ইয়া রাসূলাল্লাহ! সকলেই তো এক টুকরী করেই নিচ্ছে।” হুযূর (সা) মৃদু হেসে বললেন: “আমি তোমাদের মত সাধারণ মানুষ হিসেবে এক টুকরী নিয়েছি। আরেক টুকরী নিতে হবে আমার নেতৃত্বের দায়িত্বের কারণে।” অবশেষে হযরত বিলাল (রা)-কে প্রিয় নবীর মাথায় আরেক টুকরী তুলে দিতে হল।

এভাবে নেতা-কর্মীর মধ্যে সমতা রক্ষা করে আদর্শ নেতৃত্বের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রাহমাতুললিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সা)। তিনি নিজে কর্মীদের চেয়ে অধিক পরিশ্রম করে তাবত পৃথিবীর নেতা ও কর্মীর জন্যে সমান অধিকার-ভিত্তিক আদর্শ নেতৃত্বের শিক্ষা রেখে গেছেন।

হযরত মহানবী (সা) এর পর দীর্ঘদিন মুসলিম সমাজে এ নীতিটি কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়। ফলে তখনো মুসলিম সমাজগুলো এক অনাবিল সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরপুর ছিল। ইসলামের সোনালী যুগে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কতটুকু কঠোরতা ছিল নিচের ঘটনাটি তার উজ্জ্বল প্রমাণ দিচ্ছে।

আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর (রা)-এর দুই পুত্র আবদুল্লাহ ও ওবায়দুল্লাহ একদা কোন এক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ইরাকে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তাঁরা বসরার গভর্নর হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা)-এর নিকট উপস্থিত হন। হযরত আবূ মূসা (রা) প্রিয়জনের সন্তানদের পেয়ে তাঁদের খুবই আদর-যত্ন করেন। সেখান থেকে মদীনার উদ্দেশে যাত্রাকালে তিনি তাঁদের বললেন:

“ভাতিজা! আমার নিকট কিছু সাদকার মাল আছে। এগুলো আমীরুল মু’মিনীনের নিকট পাঠাতে হবে। এ মাল তোমরা নিয়ে যাও, এগুলো দিয়ে ব্যবসার পণ্য খরিদ করে নিয়ে নিয়ো এবং মদীনায় গিয়ে বিক্রি করে লভ্যাংশ তোমরা গ্রহণ করবে এবং আসল মাল আমীরুল মু’মিনীনকে দেবে।”

“এমনটি করলে আমীরুল মু’মিনীন রাগান্বিত হবেন”- তাঁরা উভয়ে বললেন।

 “আমি আমীরুল মু’মিনীনকে জানিয়ে দিচ্ছি”- গভর্নর বললেন।

মদীনায় এসে ব্যবসায়-সামগ্রী বিক্রি করলে তাঁদের বেশ মুনাফা হয়। হযরত আবূ মূসা (রা)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা আমীরুল মু’মিনীনের খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন:

“আব্বাজান! এটা গভর্নর- প্রদত্ত মালের অর্থ; আর এটা আমাদের মুনাফা।” “কিন্তু আমাকে বলো, আবূ মূসা প্রত্যেকটি সৈনিকের সাথে কি এরূপ করেছে?- আমীরুল মু’মিনীন জিজ্ঞেস করলেন।

“জ্বী-না, আব্বাজান”- ছেলেরা আরয করলো।

“তবে এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আমার পুত্র হিসেবে সে তোমাদের এ সুযোগ দিয়েছে।” আমীরুল মু’মিনীন বললেন।

“জ্বী-হা।”

“তবে আসল এবং মুনাফা সবই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে দাও”-আমীরুল মু’মিনীন নির্দেশ দিলেন।

৪. শূরা (পারস্পরিক পরামর্শ)

শূরার আভিধানিক অর্থ মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করা। যেমন বলা হয়: ‘আমি মৌচাক থেকে মধু আহরণ করলাম’। তবে ‘পরস্পর সলা-পরামর্শ’ করা অর্থে এটি বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়। ইমাম রাগিব বলেন যে, এর অর্থ পরস্পর আকৃষ্ট হয়ে একে অপরের রায় জানতে চাওয়া। আর ‘শূরা’-এর অর্থ: এমন বিষয় যা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে পরামর্শ করা প্রয়োজন।

ইসলামী রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ড যেভাবে পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তেমনি ইসলামী সামাজের সমস্ত কার্যও পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হয়। এটি ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যতদিন সমাজের সামষ্টিক কার্যাবলী পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে থাকবে, ততদিন সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, ঐক্য-সংহতি এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভালবাসা বিরাজ করবে। ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব কতটুকু এটা অনুমান করা যেতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল (সা)-কেও সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরমর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন:

“গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনি তাদের সাথে পরামর্শ করুন।” (আল-কুরআন, ৩ : ১৫৯)

আল্লাহর রাসূল পরামর্শ করে এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি পরমুখাপেক্ষী হওয়ার কথা নয়। কেননা আল্লাহ পাক ইচ্ছে করলে ওহীর মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ের সঠিক সিদ্ধান্ত তাঁকে জানিয়ে দিতে পারেন। এতদসত্ত্বেও তিনি কিছু কিছু বিষয়ে তাঁকে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশ দেন। এর পিছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর উম্মতকে পরামর্শ গ্রহণ ও এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের শিক্ষাদান করা। এ ছাড়া আল্লাহ্ তা’আলা অন্য একটি আয়াতে ঈমানদারদের মৌলিক গুণাবলী উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:

“তাঁদের কাজ-কর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়।” (আল-কুরআন ৪২ : ৩৮)

এ আয়াতের মধ্যেও পরামর্শের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এতে আমাদের প্রতি কোন কাজে তাড়াহুড়া না করার, নিজস্ব মতকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ না করার এবং জ্ঞানী ও সুধীবর্গের নিকট থেকে পরামর্শ নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে।

‘শূরা’ সমাজের সার্বিক সুখ ও শান্তির জন্য অতীব প্রয়োজন। কারণ যখন সমাজের সমস্ত কাজ সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে চলতে থাকবে, তখন প্রতেক্যেই নিজেকে সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য মনে করবে এবং সমাজের সিদ্ধান্তকে নিজের সিদ্ধান্ত হিসেবে বরণ করে নিবে। এর ফলে যেমন সমাজের লোকদের মধ্যে পারস্পরিক সংহতি ও ঐক্য বৃদ্ধি পাবে, তেমনি প্রত্যেকেই সমাজের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে সমাজের সম্মিলিত কাজে আত্মনিবেদন করতে থাকবে। এ জন্যেই হযরত মহানবী (সা) প্রত্যাদিষ্ট বিষয়গুলো ছাড়া প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চাই তা ধর্মীয় বিধি-বিধান সংক্রান্ত হোক বা সামরিক ব্যাপারে হোক বা রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক সমস্যা হোক— গণ্যমান্য মুহাজির ও আনসার নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

“রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চেয়ে আমি কাউকে অধিক পরামর্শ গ্রহণকারী হিসেবে দেখতে পাইনি।” (তিরমিযী)

নামাযের পূর্বে আযান দেয়ার প্রথা প্রথম পর্যায়ে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়। হযরত উমর (রা)-এর পরামর্শ মতে প্রথমে হযরত মহানবী (সা) নামাযের সময়সমূহে উঁচুস্বরে লোকদের ডাকার জন্য হযরত বিলাল (রা)-কে নিয়োগ করেন। তিনি নামাযের সময় হলে আস্সালাতু জামিখা বলে আহ্বান করতেন। পরবর্তীতে আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রা)-এর স্বপ্নের আলোকে আযানের বর্তমান নিয়ম চালু করা হয়। বদর যুদ্ধের সময় মুহাজির ও আনসার সকলের সাথে পরামর্শ করে তিনি শত্রুদের মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে ৭০ জন কাফির বন্দী হয়। তিনি তাদেরকে হযরত আবূ বকর (রা)-এর পরামর্শক্রমে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেন।

উহুদ যুদ্ধের সময়ও তিনি সাধারণ সভা আহ্বান করে যুদ্ধের স্থান নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি নিজে মদীনার মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করে শত্রুদের মুকাবিলা করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী, বিশেষ করে নওজোয়ানগণ মদীনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তাই হযরত মহানবী (সা) নিজের মতের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের মতকে প্রাধান্য দিয়ে মদীনার বাইরে উহুদ প্রান্তরে গিয়ে শত্রুদের মুকাবিলা করেন। অনুরূপভাবে আহযাব (খন্দক) যুদ্ধের সময় তিনি সকলের সাথে আলোচনা করে মদীনার ভিতরে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর পরামর্শক্রমে মদীনার চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন। এ যুদ্ধে কাফিরদের কঠিন অবরোধের সময় হুযূর (সা) গাতফানগোত্রের লোকদের সাথে মদীনার এক তৃতীয়াংশ ভাগ ফলের বিনিময়ে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হযরত সা’দ ইবনু মুআয ও সা’দ উদাবা (রা)-এর পরামর্শক্রমে তাদের সাথে সমঝোতা করার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। হুনায়ন যুদ্ধে হাওয়াযেন গোত্রের ৬ হাজার কয়েদীকে হুযূর (সা) সর্বসাধারণের সাথে আলোচনা করেই তাঁদের সর্বসম্মত মত নিয়ে মুক্ত করে দেন। এভাবে দেখা যায়, মহানবী (সা) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ না করে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না

৫. পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব

ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার সুরম্য প্রাসাদ যেসব মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তন্মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব অন্যতম। ইসলামী সমাজে পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি পুরোমাত্রায় কার্যকর থাকে। যে ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থা তার সদসদের মধ্যে সঞ্চার করে থাকে পৃথিবীর অন্য কোন সমাজ -ব্যবস্থায় তার নজীর খুঁজে পাওয়া য়ায় না। এ অকৃত্রিম ভালবাসা ও নিখুঁত ভ্রাতৃত্ব কুরআন ও সুন্নাহর অমিয় প্রস্রবণ থেকে প্রবাহিত বলে তা মানব- সম্পর্ক রচনার একমাত্র গ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। উপরন্তু তা মুসলমানদের সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবনে সুদৃঢ় ও আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করে।

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, পেশা ও অঞ্চল নির্বিশেষে যেকোন মুসলমান অন্য মুসলমান ভাইয়ের সাথে যে সূত্রে আবদ্ধ হয় তা হল আল্লাহর প্রতি ঈমান। এটি মুসলমানদেরকে পরস্পর ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে থাকে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” (আল-কুরআন, ৪০ : ১০)। এই ঈমানের সূত্রে যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তা সর্বাধিক সূদঢ়, পবিত্র, সমুন্নত ও নিখুঁত

হয়ে থাকে।

এই অনুপম ভ্রাতৃত্ব মুসলমানদের মধ্যে স্বচ্ছ, গভীর ও স্থায়ী ভালবাসা ও সম্প্রীতির অপূর্ব চেতনা সৃষ্টি করে থাকে। ইসলামে এ সুমহান ভালবাসাকে ‘আল-হু ফিল্লাহ’ (আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা) নামে আখ্যায়িত করা হয়। সত্যিকার মু’মনিগণ এ ভালবাসায় তাদের ঈমানের অপরিমিত স্বাদ ও অপার্থিব সুধা লাভ করে থাকেন।

হযরত মহানবী (সা) বলেন: ‘যার মধ্যে তিনটি স্বভাব রয়েছে সে ঈমানের স্বাদ ভোগ করতে পারবে: ১. যার নিকট আল্লাহ্ ও রাসূল (সা) সকলের চাইতে প্রিয় হবে; ২. যে কেবল আল্লাহ্ ওয়াস্তেই লোকদেরকে ভালবাসবে; ৩. আল্লাহ্ তা’আলা যাকে কুফর থেকে রক্ষা করার পর পুনরায় কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ন্যায় অপছন্দ করবে।” (বুখারী ও মুসলিম) হযরত মহানবী (সা) অনেক হাদীসের মধ্যে এ ভালবাসার গুরুত্ব ও ফযীলত তুলে ধরেছেন। এক হাদীসে তিনি বলেন: “হাশরের ময়দানে যখন কোথাও কোন ছায়া থাকবে না তখন সাত ধরনের লোক আল্লাহর আরশের ছায়ায় অবস্থান করবেন। তন্মধ্যে এক ধরনের লোক, যাঁরা আল্লাহর ওয়াস্তেই পরস্পর একে অপরকে ভালবাসেন। তাঁরা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য পরস্পর মিলিত হন এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হন।” (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত মহানবী (সা) আল্লাহ প্রদত্ত প্রখর অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা বুঝতে পারেন যে, মানবমন থেকে কুপ্রবৃত্তি, পরশ্রীকাতরতা ও হিংসা-বিদ্বেষের বীজ কেবল অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ববোধই উৎপাটন করতে পারে। যতদিন সমাজে পারস্পরিক ভালবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও হিতকামিতার পরিবর্তে হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতার চর্চা হতে থাকবে ততদিন সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধান করা কোন মতেই সম্ভব নয়। তাই তিনি সমাজে অনুপম ও অনাবিল ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার জন্যে পরস্পর সালাম বিনিময়ের প্রথা চালু করেন। এ সালাম মুসলমানদের অন্তর হিংসা- বিদ্বেষের কদর্যতা থেকে মুক্ত করে সেখানে ভালবাসা ও সম্প্রীতির পবিত্র মনোভাব সঞ্চার করে থাকে। তিনি বলেন: “সে সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনবে। আর তোমরা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পর একে অপরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি বিষয়ের দিকে নির্দেশনা দেব না যা তোমরা পালন করলে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হবে? তা হল: তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রসার কর।” (মুসলিম)

পার্থিব স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের উর্দ্ধে উঠে কেবল মহান আল্লাহর জন্য ভালবাসা স্থাপন করা চাট্টিখানি আমল নয়। এই মহান আমল কেবল তার পক্ষেই সম্ভব যার আত্মা অতি পরিচ্চন্ন, সুমহান এবং আল্লাহর রেজামন্দীর বিপরীতে পার্থিব জগত যার কাছে অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। এ জন্যে যারা এ ভালবাসার নজীর স্থাপন করতে পারবেন আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে যথাযথ পুরস্কারে ভূষিত করবেন।

হযরত মহানবী (সা) বলেন: “আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন: যারা আমার জন্যেই পরস্পর এক অপরকে ভালবাসবে তাদের জন্যে অনেক আলোকস্তম্ভ রয়েছে, যা দেখে নবী-রাসূলগণও তা লাভ করার আশা পোষণ করবেন।” (তিরমিযী)।

এছাড়া আল্লাহ্ তা’আলা নিজেও তাদেরকে ভালবাসবেন। হুযূর (সা) বলেন : “একদা এক ব্যক্তি অন্য গ্রামে তার এক ভাইকে দেখার জন্য গমন করল। পথিমধ্যে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর জন্য এক ফেরেশতা মোতায়েন করলেন। ব্যক্তিটি যখন ফেরেশতার নিকট আসল তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল: এই গ্রামে আমার এক ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য যাচ্ছি। ফেরেশতাটি জানতে চাইলেন; তার ব্যাপারে তোমার কি কোন দায়িত্ব রয়েছে? সে বলল: না, অতঃপর ফেরেশতা বললেন: আমি তোমার প্রতি প্রেরিত আল্লাহর দূত। তুমি যেভাবে আল্লাহর জন্য তোমার ভাইকে ভালবাসছ তেমনি আল্লাহ্ও তোমাকে ভালবাসেন” (মুসলিম)।

অন্য হাদীসেও হুযূর (সা) বলেছেন: “আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-আমার ভালবাসা সেসব লোকদের জন্যে সাব্যস্ত হয়েছে: (১) যারা পরস্পর একে অপরকে আমার জন্যেই ভালবাসে; (২) যারা আমার জন্যেই পরস্পর একে অপরের সাথে উঠাবসা করে; (৩) যারা আমার জন্যই একে অপরের সাথে দেখা করে (৪) এবং যারা আমার জন্যে খরচ করে।” (মুয়াত্তা)

হযরত মহানবী (সা) কেবল ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং তিনি এমন একটি সোনালী সমাজের গোড়াপত্তন করেছিলেন যেখানে প্রত্যেকেই অপরের অকৃত্রিম বন্ধু ও হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কি আরবী, কি আজমী, কি মনিব, কি গোলাম, কি রাজা, কি প্রজা এবং কি ধনী, কি গরীব সবাই সেখানে একে অপরের ভাই ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ এতই প্রগাঢ় ছিল যে, একজন অপরজনের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। হযরত মহানবী (সা) আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে যে অপার্থিব ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা গড়ে তুলেছিলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে কিয়ামত পর্যন্ত বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে মুদ্রিত থাকবে এবং যুগ যুগ ধরে সকল মুসলমানকে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে।

আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালবাসে। মুহাজিরকে যা দেয়া হয়েছে তজ্জন্যে তারা অন্তরে আশা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফল”। (আল-কুরআন, ৫৯:৯)

ইসলামের এই প্রথম প্রজন্ম যারা ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, হযরত মহানবী (সা) তাঁদের মাধ্যমেই ইসলামের প্রাসাদ বিনির্মাণ করতে এবং মহান আল্লাহর অমিয়বাণী পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হন।

হযরত মহানবী (সা) যে অপূর্ব ও অনুপম ভালবাসার সূত্র ধরে মানব-ইতিহাসের সর্বাধিক স্বর্ণোজ্জ্বল সমাজ বিনির্মাণে সক্ষম হন, বর্তমানেও যদি আমরা পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি, হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি পরিত্যাগ করে নিষ্ঠাপূর্ণভাবে সে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার অপার্থিব বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি, তা হলে আমাদের সমাজও নিঃসন্দেহে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজে রূপান্তরিত হবে এবং এর পরতে পরতে প্রবাহিত হবে শান্তির স্নিগ্ধ হাওয়া। আমাদের প্রত্যেকেরই ঈমানী কর্তব্য অপরকে ভালবাসা, সহযোগিতা করা, দুঃখে-সুখে অংশগ্রহণ করা। হুযূর (সা) বলেন: “এক মু’মিন অন্য মু’মিনের জন্য দালানস্বরূপ। যেমন দালানের একটি অংশ অন্য অংশকে সুদৃঢ় করে, তেমনি এক মু’মিন অন্য মু’মিনকে শক্তিশালী করে।” (মুসলিম)

অন্য হাদীসে তিনি বলেন: “পারস্পরিক ভালবাসা, দয়া ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রে মু’মিনগণ একটি দেহের ন্যায়। যদি শরীরের কোন অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তা হলে গোটা শরীর অনিদ্রা ও জ্বরে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।” (মুসলিম)

৬. দান

দান ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। ইসলামী সমাজের প্রত্যেক সদস্য নিজ নিজ সাধ্যমত আল্লাহর পথে খরচ করে থাকে। ইসলামে এই দান- খয়রাত এতই অনাবিল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে, এর পিছনে কোন ধরনের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য কিংবা কোন প্রদর্শনের বা গৌরব প্রকাশের মনোভাব কার্যকর থাকে না; বরং একান্তভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনই এর একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তা’আলা সূরা দাহরের মধ্যে সৎকর্মশীল লোকদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, তারা এতই মহান দানশীল যে, তারা তাদের দান ও বদান্যতার বিনিময়ে কোন পার্থিব প্রতিদান বা শুকরিয়া কামনা করে না। তিনি বলেন: “তারা আল্লাহর ভালবাসায় অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে, আমরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।” (আল-কুরআন, ৭৬ : ৮-৯)

এটি অত্যন্ত কঠিন আমল যে, মানুষ তার সম্পদ ব্যয় করবে অথচ এই ব্যয়ের পশ্চাতে সে কোন ধরনের উপকার বা শুকরিয়া পেতে চাইবে না। ইসলামের সুমহান আদর্শ লোকদেরকে এই কঠিন আমলের উপর অভ্যস্ত করে গড়ে তোলে। মুসলমানগণ কেবল বিচারদিনের মহান প্রতিদানের আশায় এ কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ হয়।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: “যারা আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে এক শ’ করে দানা থাকে। আর আল্লাহ্ যাকে চান তাকে অনেকগুণ বেশি দান করেন।

আল্লাহ্ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ। যারা আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ ব্যয় করে এবং ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না, তাদের জন্যে তাদের রবের কাছে পুরস্কার এবং তাদের কোন আশংকা নেই। তারা চিন্তিতও হবে না। (আল-কুরআন, ২: ২৬১ -২৬২)

হযরত মহানবী (সা)-এর স্বর্ণোজ্জ্বল সমাজের সুরম্য প্রাসাদ যেসব বুনিয়াদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল তন্মধ্যে ‘দান-খয়রাত’ অন্যতম। হযরত মহানবী (সা)-এর জীবনাদর্শ ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ইতিহাস এই সুমহান ও পবিত্র দান- খয়রাতের অসংখ্য ঘটনায় সমুজ্জ্বল।

হযরত নবী করীম (সা)-এর মজ্জাগত স্বভাব ছিল দানশীলতা। তাঁর হাতে কোন মাল এসে পৌঁছলে তা বন্টন করে না দেয়া পর্যন্ত তিনি স্বস্তিবোধ করতেন না। উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা (রা) বলেন: ‘একদিন আমি হুযূর (সা)-কে চিন্তিত দেখে তার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তাঁর হাতে ৭টি সোনার আশরফী জমা হয়ে আছে, তা এখনও বন্টন করা হয়নি।” (বুখারী)। অন্য রেওয়ায়েতে রয়েছে: “একদিন হুযূর (সা) আসরের নামাযের পর বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে পুনরায় ফিরে আসলেন। সাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, নামায পড়ার সময় খেয়াল হল ঘরে কিছু স্বর্ণমুদ্রা জমা আছে। তাই তা দান করে দেয়ার ব্যবস্থা করে এলাম।” (বুখারী)। হযরত আবূ যর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “একদা রাতে হুযূর (সা)- এর সাথে পথ চলার সময় তিনি বললেন: উহুদ পাহাড়টি যদি স্বর্ণ হয়ে আমার হাতে আসে তবুও আমি ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়া তিন দিনের প্রয়োজনের বেশি এক কানা-কড়িও হাতে রাখব না” (বুখারী)।

বর্ণিত রয়েছে: একদা হুযূর (সা) তাঁর হুযরা শরীফে বসে আছেন। এমন সময় এক বালক এসে একটি কাপড় চাইলো। বলল: মা একটি কাপড়ের কথা বলেছেন। রাসূল (সা)-এর গায়ে তখন একটি মাত্র কাপড়। তিনি বালকটিকে বললেন: ঠিক আছে, এখন যাও, কোন কাপড় এলে অবশ্যই পাবে; এখন আমার কাছে গায়ের চাদরটি ছাড়া আর কোন কাপড় নেই।

চলে গেল বালকটি। কিছুক্ষণ পর সে আবার ফিরে এসে বলল: মা বলেছেন আপনার গায়ের চাদরটিই দিয়ে দিতে। এবার আর তিনি না করতে পারলেন না। কারণ, কাউকে কোন বিষয়ে না করতে তাঁর দারুণ কষ্ট হয়। একমাত্র গায়ের চাদরটি খুলে দিলেন। কিন্তু খালি গায়ে বেরোবেন কি করে! তাই হুযরাখানায় বসে রইলেন।

এদিকে নামাযের আযান হয়েছে। সাহাবীগণ মসজিদে অপেক্ষা করছেন। নবী (সা) আসছেন না। এমন তো কখনো হয় না। কোন বিপদ হয়নি তো! ইত্যবসরে একজন সাহাবী উঠে আসলেন। ডাকলেন নবীজীকে হুযরাখানার বাইরে থেকে। নবীজী কথা বললেন। দেরি হবার কারণ বললেন। সাহাবীটি দ্রুত একটি কাপড় এনে পবিত্র খিদমতে পেশ করলেন। তখন হুযূর (সা) বেরিয়ে এলেন এবং মসজিদে গিয়ে ইমামতি করলেন।

এভাবে দানশীলতার ক্ষেত্রে নবীজী এমন অসংখ্য নজীর স্থাপন করেন, পৃথিবীর ইতিহাসে যেগুলোর তুলনা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। নবীজী যখন যা হাতে পেতেন সাথে সাথে তা অন্যকে দান করে দিতেন। দান করার ক্ষেত্রে তাঁর আনন্দ, দান গ্রহণকারীর চেয়েও অনেক বেশি ছিল। নিজের প্রয়োজনের চেয়ে তিনি অন্যের প্রয়োজনকে বড় করে দেখতেন। নবীজী নিজে অনেকদিন অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতেন। কখনো এ নিয়ে তাঁর কোন দুশ্চিন্তা কিংবা দুঃখ ছিল না। কিন্তু একজন অভাবী লোকের অভাব ঘোচানোর পূর্বে তাঁর চোখে ঘুম আসত না।

শুধু হুযূর (সা) নন, তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল সমাজের সদস্যগণও দানশীলতার ক্ষেত্রে প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিচে উদাহরণস্বরূপ হযরত আবূ বকর (রা)-এর একটি ঐতিহাসিক বদান্যতার ঘটনা উল্লেখ করা হল:

ইযযত ও আত্মসম্মানবোধ জীবনের চেয়েও মানুষের প্রিয় হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির সামনে দুনিয়ার সবচাইতে প্রিয়বস্তুরও কোন মর্যাদা নেই। ষষ্ট হিজরীতে হযরত আয়েশা (রা)-এর প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনা সংঘটিত হলে হযরত আবূ বকর (রা)-এর একজন প্রিয় ব্যক্তি মিসতাহ ইবনু উছাছা (রা) মুনাফিকদের বানানো এ ফিতনার শিকার হয়ে পড়েন। হযরত আবূ বকর (রা)-এর উপর ন্যস্ত ছিলো মিসতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব। আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে হযরত আয়েশা (রা)-এর পূত-পবিত্র হওয়ার কথা ঘোষিত হবার পর হযরত আবূ বকর (রা) মিসতাহর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন। তিনি বলেন: “এই বিরাট ফেতনা রটানো এবং সাংঘাতিক অপবাদ ছড়ানোর পরও আমি কী করে তার লালন- পালনের দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে পারি?

কিন্তু সাথে সাথেই আল্লাহর রাসূলের প্রতি ওহী নাযিল হয়: “তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও সামর্থ্য রাখে তারা যেন নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন এবং আল্লাহর পথের মুহাজিরদের সাহায্য না করার শপথ না করে। বরং তারা যেন ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শন করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের ক্ষমা করুন? আর আল্লাহ্ তো ক্ষমাশীল, দয়াময়।” (আল-কুরআন, ২৪: ২২)। হযরত আবূ বকর (রা) বলেন: “আল্লাহ্ তা’আলার ফরমান শোনার সাথে সাথেই আমি মিসতাহর যাবতীয় ত্রুটি ক্ষমা করে বললাম: কসম আল্লাহর ! আমি চাই তিনি আমাদের ক্ষমা করুন।” অতঃপর তিনি পূর্বের মতোই মিসতাহর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব চালাতে থাকেন।

এইভাবে দান-খয়রাত হযরত মহানবী (সা)-এর আমলে সকলের একটি অধিকতর প্রিয় আমলে পরিণত হয়। তাঁরা কেবল অভাব-অনটন ও দুঃসময়ে দান করতেন, তা নয়; বরং এটি ছিল তাঁদের নিত্যকর্ম যা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা সাধ্যমতো কি যুদ্ধ কি শান্তি, কি দুঃসময় কি সুসময় তথা সর্বাবস্থায় দান করতেন। বর্ণিত রয়েছে, হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (রা)-এর ইন্তিকালের পর তাঁকে গোসল করানোর সময় তাঁর শরীরে নীল দাগ দেখা গেলো। আলাপ- আলোচনার পর জানা গেলো, এ মহান ব্যক্তি রাতের বেলা গরীবদের জন্যে পিঠে করে আটার বস্তা বয়ে নিয়ে যেতেন। এ দাগ সে বস্তারই দাগ। কোনো ভিক্ষুক এলে তিনি বলতেন:

“আমার রসদখানাকে আখিরাতের দিকে বহনকারী! মারহাবা।” উঠে গিয়ে নিজ হাতে দান করতেন এবং বলতেন:

“দানপ্রার্থীর হাতে পৌঁছার পূর্বেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়।”

এ মহান ও পবিত্র দান-দক্ষিণা মুসলমান ভাইদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন সুদৃঢ় করেছিল এবং তাঁদের মধ্যে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার শক্তিশালী প্রাণসঞ্চার করেছিল। তদুপরি এটি তাঁদের জীবনে মানবীয় মূল্যবোধের প্রভূত বিস্তার সাধন করেছিল। ফলে তখনকার সমাজে সুখ-শান্তির অমিয় ধারা সূচিত হয়েছিল। আধুনিক বস্তুবাদী সভ্যতায় দান-দক্ষিণার কোন মূল্য নেই। এতে কেবল নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখা হয়। মানবীয় চেতনা ও মূল্যবোধের কোন ধরনের গুরুত্বও সেখানে নেই। এ জন্যে আধুনিক বস্তুবাদী সমাজসমূহে অকৃত্রিম ভালবাসা, সৌহার্দ্য, দয়া ও অনুগ্রহের প্রমাণ খুব একটা পাওয়া যায় না। বস্তুবাদী দর্শনের ফলে লোকেরা ক্রমশ মানবীয় চেতনা ও মূল্যবোধ হারাতে বসেছে এবং এর বিপরীতে তাদের মধ্যে স্বার্থপরতা, কুমনোবৃত্তি, সর্বোপরি মানুষের পরিবর্তে অন্যান্য প্রাণীর প্রতি আকর্ষণ ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। একদা প্যারিসের পশুসম্পদ সংরক্ষণ দপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, ফরাসীরা কেন কুকুরের সাথে মানুষের মতই আচার-ব্যবহার করে থাকে? সে জবাব দেয়: “ফরাসীরা ভালবাসতে চায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন কাউকে দেখতে পায় না যাকে তারা ভালবাসা নিবেদন করবে।”

৭. আত্মত্যাগ ও কুরবানী

‘আত্মত্যাগ ও কুরবানী’ ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামী সমাজের প্রত্যেকেই নিজের জন্য যা ভাল মনে করে অপরের জন্যেও তা ভাল মনে করে। নিজের জন্য যা খারাপ মনে করে অপরের জন্যও তা খারাপ মনে করে। উপরন্তু প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থের চাইতে অন্যের স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার নিজের কল্যাণ ও স্বার্থকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে অপরের কল্যাণসাধন করে। হযরত মহানবী (সা)-এর আমলে মুসলমানগণ আত্মত্যাগ ও কুরবানীর যে প্রকৃষ্ট নজীর পেশ করেছিলেন তার বদৌলতে তখন ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল সমাজের সুদৃঢ় প্রাসাদ রচিত হয়েছিল। মক্কার মুহাজিরগণ যখন অসহায় ও কপর্দহীন অবস্থায় হিজরত করে মদীনায় আগমন করেন তখন মদীনার আনসারগণ তাদের মুহাজির ভাইদের জন্যে যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেন, তার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাঁরা তাঁদের জন্যে সর্বস্ব নিবেদন করেন। এমন কি তাঁদের কেউ কেউ তাঁর মুহাজির ভাইকে উদ্দেশ করে বলেন: “এগুলো আমার সম্পদ, তুমি এর অর্ধেক নিয়ে যাও। আর এরা দু’জন আমার স্ত্রী, তন্মধ্যে তোমার কোটি পছন্দ হয় দেখ এবং নাম উল্লেখ কর আমি তাকে তালাক দেব এবং ইদ্দত পূরণের পর তুমি তাকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নাও।” মুহাজিরগণও তাদের আনসারী ভাইদের এই মহান অনুভূতির সুন্দরতম জবাব দেন। তাঁরা বলেন: “আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের পরিবার ও ধন- সম্পদে বরকত দান করুন। আমাদের এগুলোর প্রয়োজন নেই; বরং তোমরা আমাদেরকে কাজের নির্দেশনা দাও।”

আনসারগণ মুহাজিরদের আতিথেয়তা প্রদান করতেন। অনেক সময় তাঁদের ঘরে ছোট বাচ্চাদের অল্প খাবার ছাড়া অন্য কোন খাবার থাকত না। তবুও তাঁরা নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনদের উপর তাঁদেরকে অগ্রাধিকার দান করতেন। বর্ণিত রয়েছে: “একদা এক আনসারী তাঁর স্ত্রীকে বললেন: তোমার ছেলেমেয়েদেরকে ঘুম পাড়াও এবং বাতি নিভিয়ে দাও। অতঃপর তোমার নিকট যে খাবার রয়েছে তা মেহমানের জন্যে পরিবেশন কর। আর আমরাও তার সাথে দস্তরখানায় বসবো যাতে সে ধারণা করে যে, আমরাও তার সাথে খাচ্ছি অথচ আমরা খাব না। এভাবে তাঁরা ঠিকভাবে দস্তরখানার পাশে বসলেন। কিন্তু মেহমান একাই ভক্ষণ করলো, আর স্বামী- স্ত্রী দুজনেই উপোসে রাত কাটালেন। সকালে আনসারীটি রাহমাতুল লিল আলামীনের দরবারে হাযির হলে তিনি তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন: আল্লাহ তা’আলা তোমাদের রাত্রিবেলার আমলে মুগ্ধ হয়েছেন।” (কুরআন ও মুসলিম)

মুহাজিরদের প্রতি আনসারদের আত্মত্যাগ ও সহানুভূতি এতই প্রবল ছিল যে, তাঁরা দরবারে রহমতে হাযির হয়ে আরয করেন: আমাদের ও আমাদের মুহাজির ভাইদের মধ্যে খেজুর বৃক্ষগুলো ভাগ করে দিন। হুযূর (সা) বললেন: না, তা হতে পারে না। তখন আনসাররা বললেন: তা হলে তোমরা ক্ষেতকর্মে আমাদের সাথে শরীক হও এবং আমরা তোমাদের ফলের অংশ দান করবো। মুহাজিরগণ বললেন: আমরা এটিই মেনে নিলাম (বুখারী)। মুহাজিরগণ আনসারদের এই অনুপম ব্যবহারে অত্যন্ত অভিভূত হন। তাঁরা হযরত নবী করীম (সা)-এর দরবারে আরয করেন: হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আমরা যাদের কাছে আগমন করেছি তাঁদের চেয়ে অধিক সহমর্মী ও ত্যাগী কোন কওম দেখিনি। তাঁরা আমাদের খাদ্যের সংস্থান করেছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের শরীক করেছেন। আমাদের আশংকা হচ্ছে যে, তাঁরা সম্পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবেন। হুযূর (সা) বললেন: না, যতদিন তোমরা তাঁদের প্রশংসা করবে এবং তাঁদের জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আ করবে। (আহমদ)

আনসারদের এই অনন্য ত্যাগ ও কুরবানী আল্লাহ্ তা’আলার নিকটও অতিশয় পছন্দনীয় হয়। তিনি তাঁদের প্রশংসায় আয়াত নাযিল করেন, যা যুগ যুগ ধরে তাদের অনুপম ত্যাগের মহিমা বর্ণনা করতে থাকবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তারা মুহাজিরদের ভালবাসে। মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে তজ্জন্যে তারা অন্তরে আশা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।” (আল-কুরআন, ৫৯:৯)।

পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে আনসারদের ত্যাগের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা কিয়ামত পর্যন্ত লোভ-লালসা, কার্পণ্য ও সংকীর্ণতার নিগড়ে আবদ্ধ মানুষদের জন্য আলোর দিশারী হয়ে থাকবে এবং দান, ত্যাগ ও কুরবানীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে সকল যুগে সকল মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে থাকবে।

আনসারগণ ঈমানী ভ্রাতৃত্বের তাৎপর্য কি তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। রাসূল (সা) তাঁদের ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের যে সুসম্পর্ক গড়ে দিয়েছিলেন সে সুবাদে তারা এমন সত্যিকার মু’মিনে পরিণত হন যে, তাঁরা নিজেদের ভাইদের জন্য তাই পছন্দ করতেন যা তারা নিজেদের জন্য পছন্দ করতেন। তাঁরা দুনিয়ার কোন সম্পদ নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করে রাখেন নি; বরং তাঁরা নিজেদের স্থাবর ও অস্থাবর সকল সম্পদের অর্ধেক অংশ স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টচিত্তে নিজেদের ভাইদের জন্যে ত্যাগ করেছেন।

হিজরতের প্রথম পর্যায়ে আনসারগণ মুহাজিরদেরকে আত্মীয়তা ছাড়াই কেবল ঈমানী ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত করতেন। হযরত ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “মুহাজিরগণ যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন আনসারগণ অনাত্মীয় মুহাজিরদেরকে কেবল হযরত মহানবী (সা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে উত্তরাধিকারী বানাতেন। অতঃপর যখন “আত্মীয়গণ পরস্পর একে অপরের অধিক হকদার” এই আয়াত নাযিল হয় তখন উক্ত উত্তরাধিকারের ধারা রহিত হয়ে যায়।” (বুখারী) এ উত্তরাধিকারের ধারা বন্ধ হলেও বাকি থেকে যায় আত্মত্যাগ ও কুরবানীর মহান নির্দেশ। অবশিষ্ট থাকে ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও সমবেদনার মানবিক আদেশ।

হযরত মহানবী (সা)-এর পর আত্মত্যাগ ও কুরবানীর এই পবিত্র চেতনা যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে সঞ্চারিত হয়। মুসলমানগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী এই মহান চেতনা নিয়ে লালিত হয়েছে। এভাবে হযরত মহানবী (সা) আত্মত্যাগ ও কুরবানীর যে অনুপম ধারা সূচনা করে গেছেন তার সূত্র ধরে মুসলিম সমাজ যুগে যুগে অনাবিল শাস্তির পরশে ধন্য হয়।

পরিশেষে বলা যায়, হযরত মহানবী (সা) যেসব মূলনীতি অনুসরণের মাধ্যমে সমাজে পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন, বর্তমানেও যদি সেসব মূলনীতির আলোকে সমাজের ভিত রচনা করা যায়, তা হলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আইয়ামে জাহিলিয়ার পর ইসলামের স্বর্ণযুগে সমাজে যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল, বর্তমান অশান্ত পৃথিবীর বিশৃঙ্খল সমাজগুলোতেও শান্তির সে অনাবিল ধারা ফিরে আসবে। এটি কেবল আমাদের বক্তব্যই নয়; বরং অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিতও বর্তমান সমাজের ক্রমবর্ধবান অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার দিকে লক্ষ্য করে এটি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন: ইসলামই একমাত্র সফলভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান করতে সক্ষম। বিখ্যাত পাশ্চাত্য দার্শনিক জর্জ বার্নাড শ’-ও এটি অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন:

Islam is the only religion which appears to me to possess assim- ilating capacity to the changing phases of humanity which can make its appeal to every age. I believe, if a man like Muhammad (peace be on him) were assured dictatorship of the modern world, he would bring much needed peace and happi- ness. –“আমার নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা মানবজাতির পরিবর্তনশীল সকল অবস্থাকেই সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম এবং প্রত্যেক যুগেই প্রযোজ্য। আমি বিশ্বাস করি, যদি মুহাম্মদ (সা)-এর ন্যায় একজন লোক বৰ্তমান জগতের ডিক্টেটর হতেন তবে তিনি এমন এক উপায়ে জগতের সমস্যাবলীর সমাধান করতে সক্ষম হতেন যা অত্যাবশ্যক সুখ-শান্তি আনয়ন করত।”

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88