সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক হযরত রাসূলে করীম (সা)
রচনায়: মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
মহানবী হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। তিনি ছিলেন কালজয়ী, ইতিহাস সৃষ্টিকারী মহান রাষ্ট্রনায়ক। জনকল্যাণ সাধনের এবং জনসাধারণের জীবন যাপনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সুযোগ- সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন। জনসাধারণের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং তাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে অভিভাবকত্ব প্রদান করাও এ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করাও একটি বড় দায়িত্ব ছিল।
জনসাধারণের যাবতীয় কাজকর্ম, চলাফেরা, আচার-ব্যবহার এবং পরস্পরের আদান- প্রদান ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখা একজন আদর্শ সংস্কারকের জন্যে ছিল অত্যন্ত জরুরী দায়িত্ব। তাই প্রিয়নবী হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মহান দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে অনাগত ভবিষ্যতের সকল মানুষের জন্যে এক অনিন্দ্যসুন্দর আদর্শ রেখে গেছেন। তিনি আল্লাহ তা’আলার সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়া সত্ত্বেও হাটে-বাজারে গমন করতেন, মানুষকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিয়ম- কানূন শিক্ষা দিতেন। ব্যবসায়ীদেরকে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পথ ও পন্থার নির্দেশ দিতেন। আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব পালন করার তালিম দিতেন। স্বামীকে স্ত্রীর প্রতি, স্ত্রীকে স্বামীর প্রতি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের তাগিদ করতেন। তেমনিভাবে পিতাকে সন্তানদের প্রতি এবং সন্তানদেরকে পিতার প্রতি সঠিকভাবে কর্তব্য পালনের নির্দেশ দিতেন।
বস্তুত যতদিন পর্যন্ত জনগণের নৈতিক মান উন্নত না হয়, ততদিন পর্যন্ত একটা উন্নত সমৃদ্ধিশালী জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। শাসনকর্তা ব্যক্তিগতভাবে যত আদর্শবানই হোন না কেন, যদি তার উপদেষ্টা এবং সহকর্মিগণ সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ না হয় এবং যদি জনসাধারণও সচ্চরিত্রের অধিকারী না হয় তবে কোন জাতি বা সমাজ উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করতে পারে না। মানবতার উৎকর্ষ সাধনের চিন্তাও করা যায় না।
মূলত এজন্যেই প্রিয়নবী হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কা মুয়াজ্জমায় সুদীর্ঘ সময় অক্লান্ত সাধনা করতে হয়েছে এবং তিনি ব্যক্তি-চরিত্রের সংশোধনের মাধ্যমে আত্মোন্নতি এবং আত্মপ্রত্যয় লাভের সুযোগও সৃষ্টি করেছেন। ফলে একদিকে সৎ, যোগ্য, কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান, আদর্শ মানুষ তৈরি হয়েছে এবং জনসাধারণও এই আদর্শের অনুসরণে অভ্যস্ত হয়েছে। শাসনকর্তা ও জনসাধারণের এই সমস্ত গুণের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে তখন, যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের পর ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে একটা নতুন জাতি গঠন করেছিলেন, কিভাবে তিনি জাতীয় চরিত্রের সংস্কার এবং সংশোধন করেছিলেন, কিভাবে তিনি একটা পতনোন্মুখ জাতির মধ্যে নবজীবনের স্পন্দন এনে দিয়েছিলেন, একটা পথ-ভ্রষ্ট, লক্ষ্যচ্যুত, আদর্শচ্যুত, দিশেহারা জাতিকে সত্যের পথনির্দেশ করলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষিত রয়েছে হাদীস গ্রন্থসমূহে। তাই কল্যাণধর্মী সমাজ কায়েম করতে হলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের অনুসরণ করতে হবে এবং তাঁর মহান বাণীকে স্মরণ করতে হবে। এতদ্ব্যতীত এর কোন বিকল্প পন্থা নেই- একথাও আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে হবে। আমরা এ পর্যায়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি মহান বাণীর উদ্ধৃতি দিতে চাই, যা মানব-চরিত্রের সংশোধনের জন্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তিনি ইরশাদ করেছেন:
“উত্তম চরিত্র ধারণ করা দীন-ইসলামের অর্ধেক।”
তিনি আরও বলেছেন:
“মু’মিনদের মধ্যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিই সর্বোত্তম।”
“আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাগণের মধ্যে তাকে অধিক পছন্দ করেন যার চরিত্র উত্তম”।
তিনি আরও বলেছেন:
“উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ অবিরাম নামাযী এবং রোযাদারের মর্যাদা পেয়ে থাকে।”
“উত্তম চরিত্র গুনাহ থেকে মানুষকে এমনভাবে পাক করে দেয় যেরূপ সূর্য চামড়াকে শুষ্ক করে দেয়।”
“মানুষ তার উত্তম চরিত্রের কারণে পরকালে সম্মানিত এবং উচ্চ মর্যাদায় আসীন হয়- সে যদি ইবাদতের দিক থেকে কিছুটা পেছনেও পড়ে থাকে তবুও। আর ইবাদতগুজার ব্যক্তিও মন্দ-চরিত্রের কারণে জাহান্নামের নিম্নশ্রেণীর অন্তভু হয়ে পড়ে।”
“মানুষের মধ্যে সে উত্তম, যার চরিত্র সর্বোত্তম।”
“কিয়ামতের দিন যখন মানুষের সমস্ত আমল পরিমাপ করা হবে তখন সবার আগে উত্তম চরিত্রের পরিমাপ হবে।”
“তোমাদের মধ্যে যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী তাদের মজলিস আমার কাছে পছন্দনীয় এবং তারাই পরকালে আমার অধিক নিকটে থাকবে। আর যাদের চরিত্র ভাল নয় তারা আমার কাছে পছন্দনীয় নয় এবং পরকালে তারা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে থাকবে।”
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমানতদারীর উপর গুরুত্ব আরোপ করে ইরশাদ করেছেন:
“আমানতদারী রিযক বৃদ্ধি করে আর খেয়ানত দারিদ্র্য বৃদ্ধি করে।”
“সতর্ক হও! যে ব্যক্তি আমানত ঠিক রাখে না তার ঈমান নাই। ”
কানযুল উম্মাল কিতাবে এ বিষয়ে ১৮ খানি হাদীস সংকলিত হয়েছে। বুখারী, মুসলিম এবং হাদীসের অন্যান্য কিতাবে এর চাইতে অধিক হাদীস আছে। সমস্ত হাদীসের ভাবার্থ একই। প্রত্যেক বর্ণনাকারী হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে শোনা এই একটি কথাই বলেছেন।
একথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সাহাবী (রা) এবং দেশের প্রতিটি মানুষকে আমানতদার ও দেয়ানতদার বানাতে চেয়েছিলেন, এজন্যে প্রত্যেককে এ কথাটি অবশ্যই বলেছেন।
এখানে উল্লেখ্য, যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয়, তখন আমানতদারী বলতে কোন কিছুই ছিল না। মহান সংস্কারক হিসেবে তিনি মানুষকে একদিকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়ার তাগিদ করেছেন, অন্যদিকে তিনি তাদেরকে আমানতকারীর গুণ অর্জনের শিক্ষা দিয়েছেন।
আমানতদারীর ন্যায় মুসলমানমাত্রকে বিনয়ের গুণ অর্জন করাও জরুরী ছিল। তাই তিনি প্রত্যেককে বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্যে বিনয়স্বভাব অবলম্বন করে, আল্লাহ পাক তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করে থাকেন।”
“আল্লাহ তা’লা ওহীর মাধ্যমে ইরশাদ করেছেন: এতটা বিনয়ের সাথে তোমরা কাজ করবে যাতে একে অপরের সাথে গর্ব করতে না হয় অথবা কারো সাথে বাড়াবাড়ি বা বে-ইনসাফী না করতে হয়।”
“বিনয় মানুষকে শুধু উচ্চ মর্যাদাই এনে দেয়। অতএব, সকলে বিনয়ী হও, আল্লাহ্ পাক তোমাদের মর্যাদা উচ্চ করে দেবেন। ক্ষমা ও সহনশীলতা শুধু ইজ্জতই বাড়িয়ে দেয়। তাই তোমরা ক্ষমাসুন্দর এবং সহনশীল হও, আল্লাহ পাক তোমাদেরকে সম্মানিত করবেন।”
বিনয়ের সাথে সাথে সহনশীলতাও একটি বিশেষ গুণ। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই গুণটি প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এজন্যে তিনি বারবার ইরশাদ করেছেন:
“মানুষ নরম-মেজাজ, গাম্ভীর্য এবং সহনশীলতার মাধ্যমে অবিরাম-রোযাদার এবং রাতের পর রাত ইবাদতকারী ব্যক্তির ন্যায় মর্যাদা লাভ করতে পারে।”
“নরম-মেজাজ সহনশীল ব্যক্তি দুনিয়াতে সরদার হবে এবং পরকালেও।”
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে বিনয়ের গুণ অর্জনের, বিনম্র স্বভাবের অধিকারী হওয়ার তাগিদ করেছেন; আর এ উদ্দেশ্যে ক্রোধ দমনেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
“সহনশীল নরম-মেজাজী ব্যক্তি যেন নবীর মর্যাদা পেয়ে ফেলেছে।”
তিনি আরও ইরশাদ করেছেন:
“আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ক্রোধ দমনের সওয়াব সর্বাধিক।”
একথা সত্য যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথা দ্বারা সৎ চরিত্রের সব দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষ যখন ক্রোধ দমন করতে শিখবে, নিজের ভাই, বোন ও সহকর্মীদের আচরণে দুঃখিত না হবে, তখন সমাজে ফাসাদ ও গোলযোগ থাকবে না- হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি খুব ভালভাবে জানতেন। তাই তিনি প্রত্যেক মুসলমানকে ক্রোধ দমন করতে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি প্রত্যেককে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেন:
“যে ব্যক্তি দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হবে না।”
“যে ব্যক্তি ছোটদেরকে স্নেহ করে না এবং বড়দেরকে সম্মান করে না, সে আমাদের দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন :
“যার অন্তরে মানুষের প্রতি ভালবাসা নাই সে ক্ষতিগ্রস্ত।”
“যে ব্যক্তি মুসলমানদের প্রতি দয়া করে না আল্লাহ পাক তার প্রতি দয়া করেন না।”
“যার হাতে আমার প্রাণ সেই পবিত্র সত্তার শপথ! দয়ালু ব্যক্তি ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
উপস্থিত সকলে আরয করলেন, “আমরা তো সবাই দয়ালু।”
হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, “কিছুতেই না। কেউ সে পর্যন্ত দয়ালু হতে পারে না যতক্ষণ না সে জনসাধারণের প্রতি দয়া করে। ” এ সম্পর্কে অন্য একখানি হাদীসে রয়েছে :
“আল্লাহ পাক সেই ব্যক্তির প্রতি দয়া করেন না যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না।” হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতে দুর্বল, দরিদ্র, ইয়াতিম, বিধবা এবং মুহতাজের প্রতি ভালবাসা ও অমায়িক ব্যবহার ব্যতীত সমাজের সংশোধন হওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্যে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সকল মুহতাজ লোকের কি ‘হক্ক’ ছিল তা সাহাবাগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে তিনি সমাজ-সংস্কার করেছিলেন। ইয়াতিম সম্পর্কে তিনি ইরশাদ করেছেন:
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এক অথবা দু’জন ইয়াতিমকে প্রতিপালন করবে এবং সহনশীলতার সাথে তাদের দেখাশুনা করবে, আমি এবং সে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যে এই দু’অঙ্গুলীর ন্যায় কাছাকাছি থাকবো।”
কথাটি তিনি আরও বিশদভাবে ইরশাদ করেছেন:
“জান্নাতে একটি বাড়ি আছে যার নাম ‘দারুল ফারাহ’ (আনন্দময় বাড়ি)। সেখানে শুধু তারাই প্রবেশ করতে পারবে যারা মুসলমানদের ইয়াতিম বাচ্চাদের আনন্দ দিয়ে থাকে।”
অপর একটি ভঙ্গিতে এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে :
“আমি কিয়ামতের দিন ইয়াতিম জিম্মিদের পক্ষ সমর্থন করবো। আল্লাহ পাকের দরবারে আমি তাদের তরফ থেকে উকিল হয়ে দাঁড়াবো।”
বিষয়টি সেক্ষেত্রে কত বড় বিপদের হবে? আর এমন কোন মুসলমান আছে কি, যে এই বিপজ্জনক সতর্কবাণী শ্রবণ করেও সতর্ক হবে না !
ইয়াতিমদের ন্যায় দুর্বলের প্রতিও ভালবাসা রাখা তিনি জরুরী মনে করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :
“তোমাদেরকে রিষ্ক দেয়া হয়, তোমরা সাহায্য পেয়ে থাক দুর্বলদের কারণেই, তারাই তোমাদের উন্নতির কারণ।”
এভাবে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজ-সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর সংস্কারের কারণে মানব জীবনে এসেছিল এক মহা বিপ্লব, আর সেই বিপ্লবের মহানায়ক ছিলেন হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই মহা বিপ্লবের সংবিধান হলো পবিত্র কুরআন, যা আজও সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমান অশান্ত বিশ্বে শান্তি স্থাপিত হতে পারে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান আদর্শের পরিপূর্ণ অনুসরণে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন পরোপকারের; স্বার্থপরতা, হীনমন্যতা পরিহার করার। তিনি এমনি এক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, যার বৈশিষ্ট্য ছিল সুবিচার। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং মমত্ববোধ যেখানে ছিল অত্যন্ত জাগ্রত, সমাজ জীবনে সম্প্রীতি এবং শান্তি ছিল এর সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য।
সর্বাধিক বিস্ময়কর বিষয় এই যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনি এক সমাজের মধ্যে এ সমস্ত মানবিক গুণের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, যারা সর্বদা কলহ- দ্বন্দ্ব, ঝগড়া-ফাসাদ এমনকি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। যারা ছিল আত্মকেন্দ্রিক, ছিল পৌত্তলিক, যারা অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার করাকে বীরত্ব মনে করতো, সে সমাজে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বিস্ময়কর ইনকিলাব এনে দিলেন। তাদের শুধু তিনি সংশোধনই করলেন না; বরং তাঁর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়ে, তাঁর মহান আদর্শের অনুসারী হয়ে তাঁরা হলেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যে আদর্শ। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
“আমার সাহাবাগণ নক্ষত্রপুঞ্জের ন্যায়, তোমরা তাঁদের মধ্যে যাঁকেই অনুসরণ করবে হিদায়েত লাভ করতে সক্ষম হবে।”
আর এজন্যেই কবি বলেছেন:
“হে রাসূল! আপনার মুক্তা ছড়ানোর মাধ্যমে বিন্দুকে সমুদ্রে পরিণত করেছেন, অন্তরকে করেছেন আলোকিত; আর বন্ধ চোখগুলোকে দেখবার শক্তি দিয়েছেন, যে নিজেই দিশেহারা ছিল তাকে করেছেন দিশারী। সে দৃষ্টি কত শক্তিশালী ছিল যার বরকতে মৃত শুধু জীবিতই হয়নি; বরং অন্য মৃতকে জীবিত করার শক্তি অর্জন করেছে।”
বস্তুত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বের বুকে এক বিস্ময়কর বিপ্লব ঘটিয়েছেন এবং তিনি বিশ্ব-সভ্যতায় অমর অবদান রেখেছেন, যার কোন দৃষ্টান্ত নেই। তিনি ইরশাদ করেছেন:
“তোমার ভাই-সে জালিমই হোক আর মজলুমই হোক তাকে সাহায্য কর।” আরজ করা হলো, “জালিমকে সাহায্য কিভাবে করা যাবে?” ইরশাদ হলো: “তাকে জুলুম করা থেকে বাধা দাও, এটাই তাকে সাহায্য করা হবে।”
“সে ব্যক্তির উপর আল্লাহ পাকের লা’নত, যে মজলুমকে দেখলো, অথচ তাকে সাহায্য করলো না। ”
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিতে জুলুম একটি মস্ত বড় গুনাহ। আর যে ব্যক্তি মজলুমের সাহায্য করে না অথবা মজলুমের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে চেষ্টা করে না তার অভিশপ্ত হওয়া স্বাভাবিক।
মজলুম ভাইকে সাহায্য করা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিতে একটি মহান ইবাদত। তিনি ইরশাদ করেন :
“মুসলমান ভাইয়ের একদিন সাহায্য করা এক মাস ই’তিকাফের চাইতেও উত্তম।”
আরও ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :
“যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইয়ের কাজে সাহায্য করে থাকে, তার সেই কাজটি আমার কাছে এক মাস রোযা অবস্থায় মসজিদুল হারামে ই’তিকাফ করার চাইতে অধিক পছন্দনীয়।”
তিনি কোন মুসলমানের লাঞ্ছিত হওয়াকে বরদাশত করতে পারতেন না। ইরশাদ হয়েছে :
“যার সম্মুখে কোন মুসলমানকে অপমানিত করা হয়, অথচ সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার সাহায্য করে না, তাকে আল্লাহ পাক সবার উপস্থিতিতে কিয়ামতের দিন অপমানিত করবেন।”
কত বড় কঠিন শাস্তির কথা এটা, যা আল্লাহ পাক সেই ব্যক্তির জন্যে নির্ধারিত করে রেখেছেন, যার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মজলুম ভাইয়ের সাহায্য করে না !
পরস্পর সাহায্য করাকে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বড় নেকী মনে করতেন এবং এ কাজকে তিনি দুনিয়া ও আখিরাতের উন্নতির ভিত্তি হিসাবে গণ্য করেছেন। বিশেষ করে কোন ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সাহায্য করাকে তিনি একটি মহান সওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন, তিনি ইরশাদ করেছেন :
“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাহায্য তার অনুপস্থিতিতে করবে, আল্লাহ পাক তাকে দুনিয়াতে ও পরকালে সাহায্য করবেন।”
যে ব্যক্তি তার অভাবী এবং পেরেশান ভাইয়ের সাহায্য করে না, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মানবগোষ্ঠীর নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হিসাবে গণ্য করেছেন।
তিনি কৃপণ ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশের অধিকারী মনে করেন নি। কৃপণ সম্পর্কে তিনি ইরশাদ করেছেন:
“আল্লাহ পাকের কসম! কৃপণ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না”।
যা কিছু সমাজের জন্যে ক্ষতিকর, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সেই সকল মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ঐ সকল অভ্যাস পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যার দ্বারা কোন ভাইয়ের অন্তরে অপর ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়।
তিনি আরো ইরশাদ করেছেন :
“কোন মুসলমানের বদনাম করো না, কারো কোন রহস্য উদঘাটন করো না। যে ব্যক্তি কোন ভাইয়ের গোপন কথা জানতে চেষ্টা করে আল্লাহ পাক তার সমস্ত গোপন বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেবেন।”
“হিংসা সমস্ত ভাল কাজের সওয়াবকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেমন অগ্নি জ্বালানি কাঠকে খেয়ে ফেলে।”
অতএব, এ সমস্ত চারিত্রিক দুর্বলতা পরিহার করা কল্যাণকামী মানুষ মাত্রেরই একান্ত কর্তব্য; প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই সমাজ ও জাতির সংস্কার করেছিলেন, তিন ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক।
***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।