অধঃপতিত সমাজের উন্নয়নে মহানবী (সা)-এর যুগান্তকারী সমাজদর্শন

রচনায়ঃ মুহাম্মদ হাসান সিদ্দীকুর রহমান

মানুষ সামাজিক জীব, তার জন্ম ও প্রতিপালন সমাজের বাইরে সম্ভব নয়। একজন পুরুষ ও নারীকে নিয়েই প্রথম গঠিত হয় একটি পরিবার। পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবারগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সমাজ।

বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সা)-এর আবির্ভাবকালে সমগ্র আরব শিরকের পংকে নিমজ্জিত ছিলো। নানা ধরনের কুসংস্কারে এদের মন ছিল আচ্ছন্ন। অনাচার, অবিচার, ব্যভিচার তথা পাপাচারের বিষবাষ্পে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল গোটা আরবের আকাশ-বাতাস।

এদিকে গোত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থার ফলে তাদের মাঝে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। অর্থনৈতিক ভারসাম্য ছিল না, ‘জোর যার মুলুক তার’- এই ছিল তাদের সমাজব্যবস্থার ভিত্তি।

এক কথায় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সকল দিক থেকেই তারা চলে গিয়েছিল ধ্বংসের অতল গহ্বরে।

এমনি একটি পতিত ও নীতিভ্রষ্ট জাতিকে মহানবী (সা) ঐশী দীক্ষায় দীক্ষিত করে, এক যুগান্তকারী অনবদ্য পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও সভ্য জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

ফলে তারা হক ও হক্কানিয়াতের মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

শুধু তাই নয়, আদর্শ ও শান্তিময় সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে এমন আলোকবর্তিকা ও দিশারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন যাদের অনুসরণ করে চলতে পারে পৃথিবীর সকল যুগের সকল প্রান্তের সকল মানুষ।

এমনি একটি অধঃপতিত জাতিকে মহানবী (সা) কি পদ্ধতিতে উন্নতি ও শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষ চূড়ায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন! এ প্রসঙ্গেই এ নিবন্ধে আমরা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার প্রয়াস চালাব।

সমাজ উন্নয়নের মৌলিক উপাদান

সমাজ উন্নয়নের মৌলিক উপাদান তিনটি: ১. একটি সামগ্রিক ও সার্বজনীন আদর্শ; ২. সে আদর্শের ভিত্তিতে মজবুত সংগঠন ও ব্যক্তি গঠন; ৩. সে আদর্শ বাস্তবায়নে উপযোগী নেতৃত্ব। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচালিত সমাজ-উন্নয়ন আন্দোলনে এ তিনটি উপাদান পরিপূর্ণভাবেই বিদ্যমান ছিল।

তিনি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনে যাবতীয় সমস্যার যুক্তিপূর্ণ সমাধানকল্পে আল্লাহ্- প্রদত্ত একমাত্র আদর্শ ‘ইসলাম’-এর প্রচার দ্বারা তাঁর কাজের উদ্বোধন করেন। ফলশ্রুতিতে মহানবী (সা) নিজ হাতে তৈরি লোকদের দ্বারা মদীনায় একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা কায়েম করেন।

পরবর্তীতে বদর, উহুদ ও খন্দকের খুনপিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে গোটা আরবে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। একথা অনস্বীকার্য যে, সমাজ উন্নয়নের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্তই হচ্ছে ব্যক্তি গঠন। কেননা কোন আদর্শ যতই সুন্দর হোক সে আদর্শভিত্তিক ব্যক্তি গঠন করা না হলে তার ভিত্তিতে সমাজ গঠন অকল্পনীয়।

তাই মহানবী (সা) ব্যক্তি গঠনের জন্য এক ব্যাপক নীতিমালা পেশ করেন।

ব্যক্তি গঠনে মহানবী (সা)-র মৌলিক নীতিমালা

এ ক্ষেত্রে মহানবী (সা) চারটি মৌলিক নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন, যথা: ১. তাওহীদ, ২. রিসালত, ৩. আখিরাত, ৪. নৈতিক প্রশিক্ষণ।

মহানবী (সা) প্রথমেই শত ইলাহ্র গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ আরব জাতিকে এক ইলাহ্র দাসত্বে আনয়ন করেন।

তিনি বজ্রস্বরে ঘোষণা করেন : “হে আরব জাতি, তোমরা এক ইলাহ্র দাসত্ব গ্রহণ কর; বল আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই তবেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে।

মহানবী (সা)-এর প্রণীত এই মূলনীতির যৌক্তিকতা ছিল-

১. তাওহীদ মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অপরের কাছে মাথা নত করা থেকে মুক্তি দেয়। ২. তাওহীদ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয়। ৩. তাওহীদ সঠিক ব্যক্তিত্ব গড়তে সহায়তা করে। ৪. তাওহীদ ভ্রাতৃত্ব ও একতার বন্ধন স্থাপন করে। তাওহীদ, রিসালত ও আখিরাতের দীক্ষাদানের পর মহানবী (সা) সাহাবায়ে কিরামের নৈতিক চরিত্র উন্নত করার জন্য হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দান করেন।

নৈতিকতার অর্জনীয় গুণগুলো

নৈতিকতার অর্জনীয় গুণগুলোর মধ্যে রয়েছে-বিনয় ও নম্রতা, দয়া ও সহমর্মিতা, মার্জনা ও ক্ষমাশীলতা, উদারতা ও দানশীলতা, সততা ও সত্যবাদিতা, ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ আমি এর কয়েকটি তুলে ধরছি।

১. দয়া ও সহমর্মিতা

মহানবী (সা) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। তুলনা চলে না তাঁর হৃদয়ের বিশালতার। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই লাভ করেছিল তাঁর দয়া, করুণা ও মুহাব্বত। তাই তো তিনি ইরশাদ করেন, “দেখ, পারস্পরিক দয়া, সহানুভূতি ও স্নেহপ্রীতির দিক দিয়ে সব মুসলমান এক অবিচ্ছেদ্য দেহতুল্য।”

তিনি আরও বলেন: “সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে আমাদের কনিষ্ঠদের প্রতি দয়া দেখায় না এবং প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না। ”

২. বিনয় ও নম্রতা

মহানবী (সা) ব্যক্তিগত জীবনে যেমন বিনয়ী ও মার্জিত রুচিবোধের অধিকারী ছিলেন, তেমনি তাঁর সাহাবীগণকে হাতে-কলমে এর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ইরশাদ করেন, “সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে চরিত্র ও নৈতিকতায় শ্রেষ্ঠ।”

৩. ত্যাগ ও কুরবানী

নৈতিক উৎকর্ষ লাভে এবং সুষ্ঠু সমাজের ফলপ্রসূ উন্নয়নে ত্যাগ ও কুরআনীর ভূমিকা বর্ণনাতীত। মহানবী (সা)-এর চরিত্রে এ গুণটি ছিল পরিপূর্ণভাবে।

সাহাবীগণ ছিলেন মহানবী (সা)-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী। আর এই সাহাবীদের ত্যাগের বর্ণনা প্রসঙ্গেই ইরশাদ হয়েছে: “আর আনসার সাহাবীরা মুহাজির সাহাবীদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও।”

বর্জনীয় গুণাবলী

মানবাত্মায় প্রকতিগতভাবেই কিছু রিপু রয়েছে। যেমন-লোভ, অহংকার, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, কামাসক্তি ইত্যাদি। এ সকল রিপুর তাড়না মানুষকে পশুতে পরিণত করে। তাই মহানবী (সা) এগুলো বিতাড়ণের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত নিবন্ধের এ সীমিত পরিসরে এর বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। কিঞ্চিত অবগতির জন্য মহানবী (সা)-এর নিম্নোক্ত বাণীগুলো প্রণিধানযোগ্য:

১. তোমরা হিংসা করনা, হিংসুক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (বুখারী, মুসলিম)

২. লোভ-লালসা হতে দূরে থাক, অহংকার কর না, সর্বপ্রথম পাপ অহংকারের কারণেই হয়েছিল। অহংকারী জান্নাতী হবে না।

৩. তোমরা পরনিন্দা থেকে দূরে থাক, কারো পরনিন্দা করা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার নামান্তর।

৪. তোমরা বহুবিধ অনুমান থেকে বিরত থাক, কেননা অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ।

৫. নারীর প্রতি তোমার প্রথম দৃষ্টি বৈধ, কিন্তু দ্বিতীয়বারের দৃষ্টি অবৈধ।

৬. তোমরা একে অপরের ছিদ্রান্বেষণ করনা।

৭. ব্যভিচারীকে অবিবাহিত হলে এ অবস্থায় এক’শ বেত্রাঘাত করা হবে; আর বিবাহিত হলে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে।

৮. প্রতারক ও কৃপণ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।- ইত্যাদি মহামূল্যবান বাণী। অধঃপতিত একটি সমাজের উন্নয়নে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা বিধান অপরিহার্য।

তাই মহানবী (সা) তাঁর দীক্ষিত নৈতিকতায় সমৃদ্ধ সাহাবীদের দ্বারা মানব সমাজের উন্নয়কল্পে নিম্নোক্ত অধিকারগুলো নিশ্চিত করেন। যথা:

১. সকলের জন্য মানুষ হিসেবে সম্মানজনক জীবন-যাপনের অধিকার।

২. ব্যক্তি স্বাধীনতা

৩. প্রাণের নিরাপত্তা

৪. সম্পদের নিরাপত্তা

৫. ইজ্জত ও আবরুর নিরাপত্তা

৬. ইনসাফ ও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার

৭. অর্থনৈতিক অধিকার

১. সকলের জন্য সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার: মহানবী (সা) ঘুণেধরা, অধঃপতিত সমাজের উন্নয়নের জন্য সামাজিক সকল অস্পৃশ্যতা উচ্ছেদ করে, যাবতীয় কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করেন।

এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রাক-ইসলামী যুগে চরমভাবে অবহেলিতা, নিপীড়নের বুলডোজারে নিষ্পেষিতা, সর্বোপরি অধিকার-বঞ্চিতা নারী জাতি এবং দাস-দাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। একথা অনস্বীকার্য যে, নারীকে বাদ দিয়ে সামগ্রিকভাবে সামাজিক উন্নয়ন এক অসম্ভব ব্যাপার; বরং নারী ও পুরুষের সমন্বিত প্রয়াসেই সুষ্ঠু ও নির্ভেজাল সুখময় উন্নত সমাজ গড়ে উঠতে পারে। এজন্যই মহানবী (সা) ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা যিন্দেগীর প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি দেন। সংক্ষিপ্ত এ নিবন্ধে আমরা স্রেফ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহানবী (সা) কর্তৃক ঘোষিত নারীর অধিকারগুলো তুলে ধরছি।

ক. উত্তরাধিকার সূত্রে নারীর অধিকার দু’দিক থেকে,- একটি স্বামীর সম্পদে, অপরটি পিতার সম্পদে।

খ. স্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে যেকোন সম্পদ অর্জন করবে তা স্ত্রীরই সম্পদ থাকবে।

গ. বায়তুল মালে নারী-পুরুষের অধিকার সমান

ঘ. স্ত্রীর সারা জীবনের ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর

ঙ. তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম

চ. নারীর আত্মমর্যাদার নিদর্শনস্বরূপ নারীকে বিবাহের মহর দিতে হবে। ইসলাম-পূর্ব যুগে দাস শ্রেণী ছিল সবচেয়ে নিগৃহীত। সমাজে তাদের মর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না। মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা) এই দাস প্রথার যুগান্তকারী সংস্কার সাধন করেন।

তিনি ইরশাদ করেন: “তারা তোমাদের ভাই-বোন। তাদের উপর শক্তি-বহির্ভূত কাজ চাপিয়ে দিও না। কাজের সময় তাদের সহায়তা কর। তোমরা যা খাও তা তাদেরকে খেতে দাও। তোমরা যা পরিধান কর তাদেরকে তা পরিধান করাও।” দাস- দাসীদের আযাদ করার জন্য উৎসাহ দিয়ে তিনি ইরশাদ করেন: “দাস-দাসীদের আযাদ করার চেয়ে উত্তম কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছু নেই।”

২. ব্যক্তি স্বাধীনতা

মহানবী (সা) প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য চিন্তা ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।

মহানবী (সা) ইরশাদ করেন: “সাদা-কালো, ধনী-গরীব, প্রভু-ভৃত্য এবং শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে সব মানুষই সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।”

মহানবী (সা) ভাল-মন্দ গ্রহণ ও বর্জন এবং ধর্মীয় বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ইরশাদ হচ্ছে: “ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই”। এর কারণ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, “প্রত্যেকেই নিজ কর্মের জন্য দায়ী।

৩. প্রাণের নিরাপত্তা

মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা ঘোষণা করে মহানবী (সা) বলেন: “জীবনদাতা আল্লাহ্ মানুষ তো একটি পিপড়ার ডানা সৃষ্টিরও ক্ষমতা রাখে না; সুতরাং যে মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না তার পক্ষে অন্যের প্রাণ হরণের কি অধিকার থাকতে পারে? তাই মহানবী (সা) ঘোষণা করেন: “নরহত্যা হারাম, কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে সে যেন গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করল। আর কেউ কাউকে বাঁচালে সে যেন গোটা মানব জাতিকেই বাঁচালো।”

৪. সম্পদের নিরাপত্তা

সম্পদের নিরাপত্তার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি অধিকার। সমাজ-উন্নয়নে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

তাই মহানবী (সা) এ অধিকার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইরশাদ করেন: “যদি কোন ব্যক্তি জবরদস্তি করে এক বিঘত জমি দখল করে তাহলে রোজ কিয়ামতে সাতস্তর জমীন তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে।” তিনি আরও ইরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি নিজের ধন-সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে, সে শহীদ।”

৫. ইজ্জত ও আবরুর নিরাপত্তা

ইজ্জত ও আবরুর নিরাপত্তা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। কারো দোষচর্চা করা, অপবাদ দেওয়া, উপহাস করা ইত্যাদি কবীরা গুনাহ।

এ ব্যাপারেই কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: “হে বিশ্বাসিগণ! এক পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয়, হতে পারে সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হবে”।

এমনিভাবে অন্যের মানহানি করা, ধর্ষণ করা ইত্যাদি অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত ইসলাম দিয়েছে।

৬. ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার

মহানবী (সা) জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেন। কুরআনের ভাষ্য হচ্ছে-“তোমরা যখন বিচার কর, তখন ন্যায়বিচার কর।”

ইসলামী আইনে কোন নাগরিককে বিনাবিচারে কারাগারে নিক্ষেপ বৈধ নয়। একবার একটি চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহানবী (সা) বলেন: “যদি আমার কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তাহলে এ অপরাধের জন্য তার হাতও কাটা হত।”

৭. অর্থনৈতিক অধিকার

মহানবী (সা)-প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের জন্য তার অর্থনৈতিক মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। মদীনায় কালজয়ী ধর্ম ইসলামের অনবদ্য সমাজব্যবস্থা কায়েমের পর মহানবী (সা) প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ছয়টি অর্থনৈতিক অধিকার ঘোষণা করেন।

অধিকারগুলো হচ্ছে—১. বাসস্থান ২. খাদ্য ৩. বস্ত্ৰ ৪. শিক্ষা ৫. চিকিৎসা ৬. বিয়ে- শাদীর ব্যবস্থা।

সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য তিনি সম্পদের সুষম বন্টনের ব্যবস্থা করেন। জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা এবং সম্পদে ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি দেন; আবার ব্যক্তিমালিকানার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা রোধের জন্য নৈতিক প্রশিক্ষণ এবং আইন প্রণয়ন করেন। এক্ষেত্রে প্রায়োগিক আইন দু’ধরনের: এক. আদেশ বা করণীয়, দুই. নিষেধ বা বর্জনীয়। করণীয় আদেশসমূহের মধ্যে রয়েছে : যাকাত, সাদকা আদায়ের নির্দেশ; যা দ্বারা সমাজে গরীব ও অসহায়জন উপকৃত হয়। বর্জনীয় বিধানসমূহের মধ্যে রয়েছে : সুদ, ঘুষ, লটারি, বাজি, জুয়া, মজুদদারী, কালোবাজারী, নেশাদ্রব্য, অপচয় ইত্যাদি।

অধঃপতিত সমাজের উন্নয়নে মহানবী (সা)-এর সমাজব্যবস্থার যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য: মহানবী (সা)-এর প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যথা-ক. আইনের পরিবর্তে নৈতিকতার উপর সমাজ-ব্যবস্থার ভিত্তি; খ. অধিকার ও কর্তব্যের মাঝে সমন্বয়সাধন। মহানবী (সা) ইরশাদ করছেন: “তোমরা প্রত্যেকেই একজন অভিভাবক; তোমাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর দরবারে নিজের কর্তৃত্বাধীন ব্যক্তিদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”

৩. পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববন্ধন

মহানবী (সা) মাতৃভূমি মক্কা থেকে বিতাড়িত, সর্বস্ব হারানো ছিন্নমূল মুহাজিরদেরকে মদীনার আনসারদের সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন। ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধন এতই দৃঢ় ছিল যে, উদার হৃদয় আনসারগণ নিজেদের যৎসামান্য যা কিছু ছিল, তা দু’ভাগ করে একাংশ ছিন্নমূল মুহাজিরদেরকে সোপর্দ করেন।

আনসারদের এ অবিস্মরণীয় সৌহার্দ্যের প্রশংসায় অবতীর্ণ হয়: তারা নিজেরদের প্রয়োজনের উপর (ছিন্নমূল) মুহাজিরদেরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে; যদিও তাদের নিজেদের অভাবও তীব্রতর।”

৪. পরমত সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

মদীনায় যেহেতু বহু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল তাই মহানবী (সা) পরমত সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য একটি সনদ প্রণয়ন করেন। উদাহরণস্বরূপ এখানে তার ক’টি ধারা পেশ করছি।

ক. জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মদীনাতুন্নবী (সা)-এর প্রত্যেক নাগরিক নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখার অধিকার ভোগ করবে। খ. চুক্তিবদ্ধ কারো প্রতি জুলুম করা চলবে না। প্রত্যেক ব্যক্তিই পূর্ণ নাগরিক অধিকার লাভ করবে।

৫. মহানবী (সা) সামাজিক সমস্যাসমূহের স্থায়ী সমাধান পেশ করেছিলেন যা ছিল সকলের জন্য।

৬. তিনি সমাজে যে সংস্কার এনেছিলেন তা কোন আংশিক সংস্কার নয়; বরং পূর্ণাঙ্গ সংস্কার।

উপসংহার

অধঃপতিত সমাজের উন্নয়নে মহানবী (সা) কি যুগান্তকারী ও অনবদ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এবং এর ফলাফল কি দাঁড়িয়েছিল তা আমরা উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছি।

অতএব আজ আমাদের তথা ঘুণেধরা মুসলিম জাতির, অধঃপতিত এ সমাজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক তথা জীবন চলার প্রতিটি পদে যে আদর্শহীনতা ও নৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে এর থেকে পরিত্রাণের জন্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক মহানবী (সা)-এর উপস্থাপিত জীবনদর্শন অনুসরণ করতেই হবে। তবেই হবে অধঃপতিত এ সমাজের সার্বিক উন্নতি।

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan