বাংলা ভাষা ও সুলতানী শাসনামল (পর্ব ১)
সেকুলার বুদ্ধিজীবি এবং সাংস্কৃতিক জমিদারেরা বাংলার মুসলিম শাসনামল এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নানা ধরণের বিকৃত চিন্তাধারা লালন ও প্রচার করে। বাস্তব ইতিহাস যাদের চিন্তাধারা থেকে অনেক ভিন্ন। নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তকেও সুলতানী আমলের মুসলিম শাকদের ব্যাপারে বিভিন্ন নেতিবাচক চিন্তাধারা ঢোকানো হয়েছে, আকারে ইঙ্গিতে তাঁদেরকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা বিদেশি’ হিসেবে বোঝানোর চেষ্টা করে এর পূর্বের হিন্দু শাসকদেরকে ইতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে প্রাচীন হি|ন্দু শাসনামল অধিক অনুকূল ছিল নাকি মুসলিম সুলতানী আমল অনুকূল ছিল? এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ভাষা পরিকল্পনা পর্যালোচনা ও প্রস্তাব’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
“হিন্দু আমলে অবহেলিত ও ঘৃণিত বাংলা ভাষাকে মুসলমান শাসকগণ মর্যাদা দান করেন। মুসলমান শাসকগণের অবলম্বিত উদারনীতির ফলে নিম্নশ্রেণীর শিক্ষিত হি|ন্দুদের নিকটও শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয় এবং তারা বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখার সুযোগ পায়।” [১]
ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল হক উল্লেখ করেছেনঃ
“হোসাইন শাহের সময়েই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি আরম্ভ হয়। তাঁহার সময় প্রসিদ্ধ কবি পরমেশ্বর ‘মহাভারত’ গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁহার পৃষ্ঠপোষকতায় বিজয় গুপ্ত প্রসিদ্ধ পদ্মপুরাণ’ বাংলায় অনুবাদ করেন। দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেন : “মুসলিম সম্রাট ও প্রধানদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুগ্রহই বাংলা ভাষাকে হি|ন্দু রাজাদের দরবারে অনুমোদনের সূচনা করে।” [২]
.
এই প্রসঙ্গে অসাধারণ তথ্যনির্ভর একটি গ্রন্থ মোশাররফ হোসেন খান সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান’। এই বইটির প্রসঙ্গ কথা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে –
.
“বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস— দীর্ঘতম এক ইতিহাস। এই ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে আছে মুসলিম অবদান প্রসঙ্গটিও। ব্রা|হ্মণ্যবাদী শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসন যখন বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন থেকেই সূচিত হলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিবর্তন। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন :
.
“১২০৩ খ্রীষ্টাব্দেই তুর্কীবীর ইখতিয়ারু-দ্-দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকে লখনৌতী হইতে বিতাড়িত করিয়া, বাংলায় সংস্কৃত চর্চার মূলে কুঠারাঘাত হানিয়া বাংলা চর্চার পথ উন্মুক্ত করেন। ”
.
মূলত ১২০৩ থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রযাত্রা শুরু। আর পলাশীর বিপর্যয়, অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত—এই সাড়ে পাঁচশ’ বছর ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত অর্থে স্বর্ণকাল। এরপর ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে আবার নেমে এলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর ঘনঘোর কাল মেঘ। এই অশুভ কাল মেঘে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সূর্য আচ্ছাদিত ছিল ততদিন, যতদিন না তাদের শাসন ও শোষণের অবসান ঘটেছে।
পৃথিবীর আর কোনো ভাষার ওপর বাংলা ভাষার মত এত বিপর্যয় নেমে আসেনি। বাংলা ভাষা বারবার ধাক্কা খেয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। তবুও আজ যখন পেছনের দিকে তাকাই, তখন দেখি—এই বাংলা ভাষাতেই শ্রেষ্ঠ ফসলগুলি ফলেছে। সন্দেহ নেই, এর পেছনে অন্যতম অবদান— মুসলমানের। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যে ক্রমোন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে, এর মুখ্য কারণ হলো সচেতনশীল মুসলিম লেখক, বিগত কালের মুসলিম শাসক এবং ইসলামপ্রচারকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ।” [৩]
.
(ইন শা আল্লাহ আগামীকাল পোস্টের ২য় কিস্তি আসবে)
___ ___ ___
.
.
[১] ‘বাংলাদেশের ভাষা পরিকল্পনা পর্যালোচনা ও প্রস্তাব’ – জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ (বাংলা একাডেমি), পৃষ্ঠা ৬৫
[২] ‘ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস’ – ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল হক, পৃষ্ঠা ১১৫
[৩] ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান’ মোশাররফ হোসেন খান সম্পাদিত
১টি মন্তব্য