ফিলিস্তিন : রাষ্ট্রিক স্বরূপ
সমগ্র বিশ্বের একনিষ্ঠ মনোযোগ অধিকার করে যে বহুল আলোচিত বিষয়বস্তু সামগ্রিক চিন্তাধারাকে প্রবল ভাবে নাড়া দিচ্ছে, তা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। আরব বিশ্বের অন্য সব ঘটনাপ্রবাহকে ছাপিয়ে যে সুর উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে, সে সুর ‘ফিলিস্তিন’ বা প্যালেষ্টাইনের কয়েক লক্ষ উদভ্রান্ত উদ্বাস্তু’র উদ্ভূত সমস্যা। বিশ্বের প্রত্যন্ত প্রান্ত পর্যন্ত আজ এ’ কথা আর অনুদঘাটিত নয় যে, সাম্রাজ্যবাদী ইসরাইল তার পূজিবাদি প্রভুদের সাহায্য, সহযোগিতায় পরিপুষ্ট হয়ে মানবতার জঘণ্যতম কার্য প্যালেষ্টাইনী জনসাধারণের অধিকার নিঃশেষে। হরণ করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে, আগুন জ্বালিয়ে, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করেছে হাজার হাজার ঘর বাড়ী ; হত্যা করেছে অসংখ্য নিরীহ, নিষ্পাপ শিশু, বৃদ্ধ ও নারী; বন্দী শিবিরে আটকে রেখেছে যুবকদের ; তাদের প্রতি চালাচ্ছে অকথ্য নির্যাতন।
হানাদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে আজকের বিশ্ব-মানবতা, একত্রিত হয়েছে আরব বিশ্ব। প্যালেষ্টাইনের বীর জনসাধারণ সংগ্রামী জননায়ক ইয়াসির আরাফাতের পতাকা তলে এসে জমায়েত হয়েছেন। গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছেন মুক্তিকামী প্যালেষ্টাইনীরা।
কিন্তু এরপরও কথা থেকে বায়। এই যে ক্ষুদ্র একটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এত আয়োজন, এত যুদ্ধ, এত সংগ্রাম কিন্তু সফলতা আসেনা কেন ? একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এতোগুলো আরব-শক্তিকে পর্যুদস্ত করে ছাড়ছে কোন্ অদৃশ্য শক্তির সক্রিয় পদক্ষেপে।—এর প্রত্যুত্তর বিশ্বের মানুষের অজানা নয়। ইসরাইল যুদ্ধ করছে, একা নয়, তার মুরুব্বীকে নিয়েই। মুরুব্বীর দয়া-দাক্ষিণ্যের সৌভাগ্য অর্জন করেই ইসরাইল তার প্রতিপক্ষদের নৃসংশভাবে পর্যুদস্ত করছে, হটিয়ে দিচ্ছে! বৃহৎ শক্তি আমেরিকা দরাজ হাতে অঢেল সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে ইসরাইলের মাটিতে ; পক্ষান্তরে ন্যায় ও মানবতার সলিল সমাধি ঘটানোর জন্যই।
এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তাহলে ইসরাইলের বর্তমান অধিকৃত ভূমি কি তাদের ন্যায্য পাওনা ? প্যালেষ্টাইন কি তাহলে উড়ে এসে জুড়ে বসবার প্রয়াস চালাচ্ছে? তা না হলে ইসরাইল এত ‘সিরিয়াসলি’ আরবদের বিরুদ্ধে এমন কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো কেনো ?
বিষয়টা নিঃসন্দেহে পর্যালোচনার। আমরা এখন প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্রের মূল স্বরূপ পর্যবেক্ষণ করবো।
ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দশ হাজার একশ’ বাষট্টি বর্গমাইল জুড়ে ফিলিস্তিন রাজ্য। জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ১৯১৮ সালে বৃটিশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে এর লোক সংখ্যা ছিল ৭০৮০০। এর মধ্যে আরব ছিল শতকরা ৯৩ ভাগ এবং বাদ বাকী ৭ ভাগ ছিল দেশীয় ইহুদী। ১৯৪৮ সালে ইহুদীদের অবৈধ্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বৃটিশ যখন পাততাড়ি গুটায়, তখন ফিলিস্তিনের লোক সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩,৫০,০০০ আরব, অন্যদিকে ইহুদীদের জনসমষ্টি ২ লক্ষ। ইহুদীরা জোড় পূর্বক তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে মাত্র ২লক্ষ ৪৭ হাজার আরব ফিলিস্তিনে থেকে যায়। অবশিষ্ট দশ লক্ষ আরব ইহুদী সন্ত্রাসের মুখে স্বদেশের মায়া-মমতা বিসর্জন দিয়ে ভিটে-মাটি পরিত্যাগ করে বিদেশে বসবাস শুরু করে।
তাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের মোটামুটি চিত্র এই রূপ। কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পূর্ব ইতিরত্ত ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। এই নামে পরিচিত ভূ-খণ্ডের পরিচয় খৃষ্টান ধর্মগ্রন্থ বাইবেল এবং মুসলিম ধর্মগ্রন্থ কোরআনেও উল্লেখ আছে। বাইবেল ও কোরআনে ফিলিস্তিনকে ‘কেনান’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ‘ক্রিট’ এবং ‘এজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জ থেকে আগত ফিলিস্তিনীদের নামানুসারে এই অঞ্চল ফিলিস্তিন নামে পরিচিত হয়। খৃষ্টানদের আগমনের পূর্বেই এরা এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে।
ফিলিস্তিনীরা ‘অগনন’ সম্প্রদায় থেকে আসে। তবে অধিকাংশই আরব-বংশসম্ভূত। সপ্তম শতাব্দীতে হজরত মুহাম্মদ (দঃ) বৈপ্লবিক চিন্তা- ধারায় প্লাবিত ইসলামের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা সেই চিন্তাধারায় অবগাহন করে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তখন থেকেই এ’অঞ্চল মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্গত রূপ লাভ করে। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন মুসলিম দেশ ছিল। অবশ্য ১০৯৬ সাল থেকে ১১৮৭ পর্যন্ত ক্রসেডিয়রা একে অধিকারে রেখেছিল। চারশত বছর ধরে এই এলাকা ওসমানিয়া শাসনাধীনে ছিল। ফিলিস্তিন সে সময় স্বতন্ত্র ধ্যান-ধারণা বা ভিন্ন রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে আরবেরই একটি অখণ্ড অংশ হিসেবে প্রতীয়মান হতো। ওসমানিয়া শাসনাধীনে থাকাকালীন ফিলিস্তিনের আরবেরা তুর্কীদের মতোই রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাধারণ অধিকার ভোগ করেছে। তাদের নিজস্ব সরকার ছিল, ছিল পৌরসভা এবং কনস্টান্টিনোপলে ওসমানিয়া পার্লামেন্টে নির্বাচিত প্রতিনিধিও।
এরপর, মহাপ্রলয়ের মতো দেখা দেয় বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধের দাবানল। ফিলিস্তিনের ভাগ্যাকাশেও নেমে আসে সীমাহীন বিপর্যয়। ১৯১৯ সালে ভার্সাই সম্মেলনে উপস্থিত সকল জাতি ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং জর্ডানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একই সময়ে এসব দেশকে অস্থায়ীভাবে ‘লীগ অব নেশনে’র অবির্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনকে নিয়ে নেয় বৃটেন।
১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বৃটেনের মহারাণীর উপনিবেশ হিসেবে ফিলিস্তিন শানিত হয় এবং সকল প্রকার প্রতিনিধিত্ব এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে পদদলিত করে বৃটেন ‘বালাফোর’ (১৯১৬) ঘোষণা অনুসারে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ১৯১৮ সাল থেকে বহিরাগত ইহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।
কেবল তাই নয়, দেশের অর্থনীতিতে বহিরাগত ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণাধিকার দিয়েও আইন প্রণয়ন করে। ইহুদীরা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অপমাণিত, বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত আরব নাগরিকেরা এই অন্যায় আচরণ, অবৈধ ও অপমানাত্মক পরিস্থিতির প্রতিকার প্রার্থনা করে ‘লীগ অব নেশান’শের কাছে প্রার্থনা জানালো। এই জোর জবরদস্তিমূলক অন্যায় আচরণের প্রতিকার প্রার্থনা করে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার জন্য আরব- ফিলিস্তিনীরা বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের আশ্রয় নিলো, কিন্তু বৃটিশ বাহিনী প্রাণ-নাশ করে হলেও নৃশংসভাবে তা প্রতিহত করলো। এরপরও আরবদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা গেলো না। তারা বিদ্রোহ প্রকাশ করলো ১৯২০ সালে, ১৯২৮, ১৯২৯ এবং ১৯৩৬ সালে। আরবদের ‘এই মারমুখী তৎপরতা রোধ করার জন্য ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৯ সালে ফিলিস্তিনে বৃটিশ সৈন্য সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ। এরপর তারা জরুরী আইন প্রয়োগ করে সমগ্র ফিলিস্তিনকে বন্দী শিবিরে পরিণত করলো। নির্যাতনের শিকারে পরিণত হলো ১ লক্ষ আরব, শেষ রক্ত বিন্দু আত্মাহুতি দিল ১৫ হাজার ফিলিস্তিনী, আহত হলো ত্রিশ সহস্ৰাধিক।
ফিলিস্তিনে তখন ভয়ানক গোলমেলে পরিস্থিতি। সামরিক চক্র কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না প্যালেষ্টাইনী নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে। এই পরিস্থিতি সরে জমিনে পর্যবেক্ষণ করার জন্য অনেক বৃটিশ কমিশনারকে ফিলিস্তিনে পাঠানো হলো। তাঁরা বললেন, ফিলিস্তিনকে কোনক্রমেই অবিভুক্ত রাখা সম্ভব নয়। এ জন্যই যে, সেখানকার জনগোষ্ঠী মূলতঃ দুই বিপরীত প্রান্তিক’। একদিকে লাঞ্ছিত আরব, অনুদিকে সুবিধাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ইহুদী। বিশেষজ্ঞদের এই অভিমত প্রকাশের প্রেক্ষিতে ১৯৩৯ সালে বৃটিশ সরকার ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ফিলিস্তিনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার থাকবে এবং বহিরাগত ইহুদীদের আগমনও সীমিত করা হবে।
এই ঘোষণা প্রকাশের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক ইহুদী চক্র ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সন্ত্রাসবাদী ইহুদী দল সমূহ বৃটিশ বাহিনী, বৃটিশ সরকার এবং সাধারণ আরব নাগরিকদের উপর বর্বরোচিত পন্থায় সন্ত্রাসমূলক তৎপরতা শুরু করলো। বৃটিশ সরকার ইহুদী চক্রের সক্রিয়তায় বিপর্যয় বোধ করলো ; তারা কোন ক্রমেই পরিস্থিতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধিকারে আনতে সক্ষম হলো না।
অবশেষে, ১৯৪৭ সালে বৃটিশ ব্যাপারটিকে জাতিসংঘে বিবেচনার্থে প্রেরণ করলো। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এক বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হয়। এ’ সময় ফিলিস্তিনে আরবদের সংখ্যা ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার ; এবং দেশীয় ইহুদীর সখ্যা ২ লক্ষ। বহিরাগত ইহুদীরা ছিল ৪ লক্ষ। পশ্চিমা শক্তি সমূহের চাপ ও প্ররোচণায় ১৯৪৭ সালের ২৯ শে নভেম্বর সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনের বিভক্তির সুপারিশ সম্বলিত প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবে একটি আরব রাষ্ট্র, একটি ইহুদী রাষ্ট্র এবং জেরুজালেমের জন্য আন্তর্জাতিক অঞ্চল গঠনের কথা বলা হয়।
ফিলিস্তিন খণ্ডিত করণের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরপরই শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। বৃটিশ শাসকদের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে ফিলিস্তিনী আরবরা হয়ে উঠলো দুর্বার, দুর্দমনীয় ও বিশৃঙ্খল এবং সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্তি থেকে হলো বঞ্চিত। অপর দিকে ইহুদীরা সুশিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্রের অধিকারী হলো। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও ফিলিস্তিনী আরবরা ইহুদীদের উপর বিজয়ী হতে থাকে। আরবরা ফিলিস্তিনের ৮২ ভাগ এলাকার উপর প্রাধাণ্য প্রতিষ্ঠিত করলো। আরবদের এই বিজয় লাভ পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে দৃষ্টিকটু প্রতীয়মান হলো, তাদের আঁতে ঘা লাগলো, বিচলিত হয়ে পড়লো পশ্চিমাশক্তি গুলো।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ইহুদী সংস্থা এবং সশস্ত্র ইহুদী দলগুলো আক্রমণ পরিচালনা করলো আরব গ্রাম ও শহরগুলোতে ; বর্বরোচিত হামলা। যে সব কুচক্রী এসব হামলার নায়ক রূপে প্রকাশিত, তারা হচ্ছে ‘হাগানা’ ও ‘ইরগুন’। ‘দেরিয়াসী’নের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে এরাই। বর্বর নাজীদের নৃশংসতাকেও অতিক্রম করে এরা হত্যা করলো ৩৫০ জন আরব বৃদ্ধ, নারী এবং শিশুকে। জাতিসংঘের নিরাত্তা পরিষদ এগিয়ে এলো হস্তক্ষেপ করার জন্য। নিরাপত্তা পরিষদ যখন আরব-ইহুদীদের মধ্যে সেনাবাহিনী চাপিয়ে দিচ্ছিল, তখন আরব এলাকা দখলের জন্য গ্রাম ও শহরে ইহুদীরা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল অবিরাম। সহযোগী বৃটিশ সেঞ্চুরিয়ান ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে ইহুদীদের মদদ যোগাচ্ছিল। বৃটিশ সৈনরা ইহুদীদের হয়ে আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করে তুলছিল।
বৃটিশ ও ইহুদী চক্রান্ত আরো এগোলো। তারা সম্মিলিতভাবে ১৯৪৮ সালের ১০ই এপ্রিল- ‘দেরিয়াসীন’, ১৮ই এপ্রিল ‘টিবেরিয়াস’, ২১শে এপ্রিল ‘হাইফা’, ২৭শে এপ্রিল ‘সামাখ’, ২৮শে এপ্রিল ‘সালামেহ, ‘ইয়াজুর’, ‘বিতদাজুন’, ও ‘জাফফার পাশ্ববর্তী এলাকা ৩০শে এপ্রিল ‘বেইসান’, ‘জেরুজালেমের নতুন আবাস, ১০ই মে ‘সাফাদ’ এবং ১৩ই মে ‘জাফফা’ থেকে জোরপূর্বক নিরীহ আরব জনসাধারণকে অকারণে, বিনা অপরাধে বহিষ্কার করে দেয়া হলো। এরা ৫২৪টি গ্রাম ও শহর দখল করলো, অন্যদিকে ৩৮৫টি শহর ও গ্রাম বিধ্বস্ত করলে। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত বৃটিশ সেনা সুপরিকল্পিতভাবে এই সব আরব গ্রাম ও শহর দখলে প্রভূত সাহায্য করলো। ইহুদী সন্ত্রাসে ভীত সন্ত্রস্ত আরবদের প্রতি বৃটিশ কমাণ্ডাররা আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিল। এমনকি পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়ার জন্য তাদেরকে ট্রাকে ট্রাকে পূর্ণ করে পৌঁছে দিয়ে আসা হলো।
বৃটিশ সাহায্যপুষ্ট সংখ্যালঘু ইহুদীরা দশ লক্ষ আরব ফিলিস্তিনীকে তাদের পৈত্রিক ভিটে মাটি থেকে উৎখাত করে তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করলো। অতঃপর সেই সব হতভাগ্য আরবীয়দের একমাত্র সম্বল, সকল শক্তির মহাশক্তিমান আধার আল্লাহর অনন্ত রূপা এবং ঊষর মরুভূমির তপ্ত বালুর উপর এতটুকু তাঁবুর আশ্রয়।
১৯৪৮ সালের ১৪ই মে বৃটেন এক তরফা ভাবে ‘অচি’ প্রথা প্রত্যাহার করে নিল। বিশ্ব ইহুদী সংস্থা ইহুদী নেতাদেরকে সংগ্রহ করে উপস্থাপিত করলো এবং ঘোষণা করলো ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের কথা। ইহুদীদের ঘোষণার কয়েক মিনিট পরেই ডঃ উইজম্যান গোপন চুক্তি অনুসারে ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে স্বীকার করে নিলেন। এদের এই একচেটিয়া সমর্থনে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো আরব রাষ্ট্রগুলো। তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে এই অস্বাভাবিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুখরিত হলো। অনেকেই একে প্রতিহত করবার পদক্ষেপ নিতে চাইলেন ; কিন্তু এখানেও প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালো বৃহৎ শক্তিবর্গ। তারা প্রত্যক্ষ প্রভাব খাটিয়ে, এমনকি অস্ত্র সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেও ফিলিস্তিনকে মুক্ত করবার আরব প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিল। আরব রাষ্ট্রসমূহ যদি ঠিক সেই মুহর্তেই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারতো, তাহলে ফিলিস্তিন সমস্যা আজ এমন পর্বত প্রমাণ উদ্ধতরূপে সম্প্রসারিত হবার সুযোগ পেতোনা। লক্ষ লক্ষ আরব জনতা ধুঁকে ধুঁকে মরতোনা তপ্ত মরুভূমিতে সামান্য তাঁবুর এতটুকু আশ্রয়ে ! ধ্বংস হতোনা অসংখ্য বাড়ী ঘর ; মৃত্যুর হিমশীতল বন্যায় ভেসে যেতোনা হাজার হাজার আরব-নাগরিক ; বন্দী শিবিরগুলো পরিপূর্ণ হতোনা নির্যাতিত মানুষের আর্ত-বেদনায় !
বহিরাগত সংখ্যালঘু ইহুদী কর্তৃক অবৈধ ও অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করে ৮০ ভাগ ফিলিস্তিনী ভূমি জবর দখল ও প্রতিষ্ঠা, সংখ্যাগুরু ফিলিস্তিনীদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত, ভৌগলিক সংহতি লংঘন, ধর্মীয় পবিত্র স্থান সমূহের অমর্যাদা, আন্তর্জাতিক – আইন ও ‘জাতিসংঘ’ সনদ লংঘন করার মতো সীমাহীন অপরাধ করা সত্ত্বেও বহৎ শক্তি বর্গ ১৯৪৯ সালে তাদের উদ্ধত প্রভাব প্রয়োগ করে তথাকথিত ইসরাইল রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্য করে নিলো।
ফিলিস্তিনী আরব জনসাধারণের ভাগ্য বিপর্যয়ের করুণ পরিণতির সূত্রপাত এখান থেকেই।
ইসরাইল মানবতার সমাধি ঘটিয়ে তার অবস্থান, সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিলো। কিন্তু সে তার আগ্রাসী দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন না করে বরং আরব ফিলিস্তিনীদের ধর্মীয় জীবনেও হস্তক্ষেপ করলো। মসজিদে আগুন দিলো, মুসলমানদের ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠানে মাথা ঘামালো, সামান্যতম সন্দেহের বশবর্তী হয়েও নৃশংস শান্তি দান করতে দ্বিধা করলোনা। আরব-মুসলিমদের অবস্থা দু’দিক থেকেই অত্যন্ত নাজুক হয়ে দাঁড়ালো ; সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দিকেও। এই যখন তাদের পরিণতি, এমতাবস্থায় চোখ বুজে ইস্রাইলের খামখেয়ালীপনা আচরণ সহ্য করা যায়না। জেগে উঠলেন আরব নেতৃবৃন্দ। মানবতার অবমাননার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতার এক চেটিয়া দখলের বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়ালেন। ১৯৬০ সালে আরব রাষ্ট্রবর্গ গঠণ করলেন “প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংস্থা” (P. L. O )। এরা প্রথম অভিযান পরিচালনা করলেন ১৯৬৫ সালের ১লা জানুয়ারীতে।
অন্তরের দিক থেকে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, হৃদয়ের অভ্যন্তরে শোষিতের ক্ষত-বিক্ষত রূপে সংগ্রামী মনোবৃত্তির ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, নিষ্ক্রীয় স্বাধীনতালোপী ফিলিস্তিনীরা আশার আলো দেখতে পেলেন। তাঁরা মাতৃভূমি হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কে ডাক দেবে তাঁদের নতুন সুর্যোদয়ের সোনালী দিগন্তে ; যেখানে অনস্ত স্বাধীনতার ফল্গুধারা প্রবহমান ! কে ডাক দেবে তাঁদের স্বাধীনতার সাগরে অবগাহন করতে। এর সঠিক পথ-নির্দেশ তাঁরা পাচ্ছিলেন না। পি, এল, ও, শুনালো তাঁদের ইস্পিত সূর্যের আগমন বার্তা। ফিলিস্তিনী আরবগণ ১৯৪৮ সালের পর এই প্রথমবারের মতো সংঘবদ্ধ হলো, সংগঠিত হলো। বজ্র শপথে উদ্দীপ্ত হলো। ছয় প্রাণ দেবে, না হয় মাতৃভূমি অধিকার করবে ! ফিলিস্তিনী অবহেলিত উদ্বাস্তুরা নতুন আশা ও নতুন সূর্যের আকাঙ্খার সমর্থনে এলো এগিয়ে।
পি, এল, ও, তাদের স্বাধীনতা অর্জনের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন ; কিন্তু সংগঠনটি যেন তেমন আশাব্যঞ্জক ফলোদয় করতে পারছেনা। তেমন সক্রিয় ফলাফল লাভে ‘সক্ষম হচ্ছেনা ; হয়তো এ’জন্যই ১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মে ফিলিস্তিন ন্যাশনাল কাউন্সিল, ‘আলফাতাহ’ এবং সিরিয়ার ‘বাথ’ পার্টির সমর্থক আস সাইকার প্রথম বৈঠকে “প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংস্থা”র আছমত সুকাইরীকে নেতৃত্বচ্যুত করলেন। এর পরেই এলেন বিশ্বের অন্যতম সংগ্রামী জননায়ক ইয়াসির আরাফাত, ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। তিনি পি,এল,ও,র দায়িত্বভার নিজস্কন্ধে গ্রহণ করলেন; নিযুক্ত হলেন কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান।
ইতিপূর্বে, প্যালেষ্টাইনী সংস্থা আলফাতাহর শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের অনমনীয় সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আকর্ষণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যালেষ্টাইনীদের সংগ্রাম নিজের শক্তির প্রতি হুমকী স্বরূপ মনে করে। আর এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে পি, এল, এল, পি-র একটি ছিনতাই ঘটনাকে অযুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে জর্ডানকে প্ররোচিত করে গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে, যার রক্তাক্ত ফসল “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সময় প্রতিবাদ ছাড়া জর্ডানী নৃশংসতা থেকে প্রতিরোধ সংগ্রামকে রক্ষার জন্য তেমন কোন কাজ আরব রাষ্ট্র সমূহ করেনি। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর প্রসঙ্গে পরবর্তী কালে ইয়াসির আরাফাতের বক্তব্য :— “জর্ডানে প্যালেষ্টাইনী বিপ্লব ও জনগণের বিরূদ্ধে পরিচালিত ধ্বংস যজ্ঞের পরই ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের অভ্যুদয়। আমরা ২৫০০০ হতাহতকে হারিয়েছি এবং কারারুদ্ধ হয়েছেন ৮০০০ জন। জর্ডানের পূর্বতীরে এ আমাদের এ’ আমাদের জনগণের জন্য এক বিভীষিকাময় স্মৃতি। জর্ডানে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরাইল এবং সি, আই, এ, রাই দায়ী।”
ইসরাইল সবচে’ নগ্ন ও বেপরোয়া হামলা পরিচালনা করে ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালে। তাদের সম্প্রসারণবাদ চরিতার্থের এই হীন পন্থা অবলম্বণ বিশ্ববাসী কেবল চোখ দিয়েই প্রত্যক্ষ করলোনা, সমগ্র বিশ্বের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের পথ থেকে এ’ একটি মারাত্মক হুমকী ও ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ১৯৬৭ সালের আক্রমণ পরিচালনা করে সায়া- -জবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনী এলাকা ছাড়াও লেবানন, মিশরের সুয়েজ এবং সিরিয়ার গোলান ও গাজা এলাকার বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করে নিলো। বিশ্ব হতচকিত হয়ে দেখলে। ইসরাইলের এই বর্বরতম পৈশাচিক পদক্ষেপ। হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন আরব নেতৃবৃন্দ।
ইসরাইলের আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তি চরিতার্থের জন্য এবার তারা শুধু ফিলিস্তিনীদেরই নয়, সমগ্র আরব বিশ্ব এমন কি, পৃথিবীর ধর্ম প্রাণ মুসলমানদের অন্তরের প্রচণ্ডতম আঘাত হানলো। তারা পবিত্র স্থান “বায়তুল মোকাদ্দাসে” আগুন জ্বালিয়ে অনেক খানি অংশ ভস্মীভূত করলো। এরপরও, প্রতিনিয়ত পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্র, লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানের ভূমিতে ঢুকে গ্রাম ও শহরের নিরীহ জনসাধারণের প্রতি চালাতে লাগলো আকষ্মিক আক্রমণ। ধ্বংস হতে লাগলো জনপদ, প্রাণ ও বাড়ী-ঘর। কিন্তু নির্বিকার ইসরাইল।
ইসরাইলের এই রণ-মূর্তির প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন ফিলিস্তিনী জনতা এবং তাদের অগ্রদূত জন-নায়ক ইয়াসির আরাফাত।
সূত্র : প্রবাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এবং নজমুল হক ও আবদুস সালাম রচিত “ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম” নামক বই থেকে সংগৃহীত।