বাঙালী মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

একটি দেশের অধিবাসীর সম্যক পরিচয় পেতে হলে সে দেশের মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য, ভাষা ও সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যের পরিচয় নিতে হয়। একটি দেশের মানুষের মধ্যে নানা প্রকার দৈহিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হতে পারে। এইসব দৈহিক পার্থক্যকে কেন্দ্র করে তাঁদের ভাগ করা যেতে পারে একাধিক দৈহিক প্রকারে (Physical types)। নৃতাত্ত্বিকরা বুঝে দেখতে চান কিভাবে এইসব বৈশিষ্টের উদ্ভব হয়েছে। তাঁদের বিশ্লেষণ থেকে অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে সুবিধা হয়, কিভাবে একটা দেশের অধিবাসী বা জনসমাজ গড়ে উঠেছে। বুঝতে সুবিধা হয়, কিভাবে একটা দেশের মানুষের মধ্যে এসে মিলিত হয়েছে নানা সংস্কৃতির ধারা।

নৃতত্ত্বে (Anthropology) সাধারণভাবে মানুষের যে সব দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে বিচার করা হয়, তা হল :

  1. মাথার চুলের বৈশিষ্ট্য ও রঙ।
  2. গায়ের রঙ।
  3. চোখের পাতার বৈশিষ্ট্য ও চোখের তারার রঙ।
  4. দেহের উচ্চতা।
  5. মাথার আকার ও আকৃতি।
  6. নাকের আকার ও আকৃতি।
  7. মুখের গঠন।

এই বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনায় কিছু পরিমাপের প্রয়োজন হয়। নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রে দেহের উচ্চতা ২লতে বোঝায় পূর্ণ বয়স্ক পুরুষের দৈহিক গড় উচ্চতা (height)। লম্বা মানুষ বলতে বোঝায় যাদের গড় উচ্চতা ১৭০ সেন্টিমিটার (৫ ফিট ৭ ইঞ্চি) বা তার উপর। আর খর্বাকৃতি বলতে বোঝায় যাদের গড় উচ্চতা ১০ সেন্টিমিটার (৪ ফিট ৬ ইঞ্চি) বা তার কম। নৃতত্ত্বে মানুষের মাথা ও নাকের আকারের উপর খুব গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মাখার আকার প্রকাশ করা হয় শির-সূচক-সংখ্যা (Cephalic Index)-এর সাহায্যে। আর নাকের আকার প্রকাশ করা হয় নাসা-সচক-সংখ্যা (Nasal Index) -এর সাহায্যে। শিরসুচক হিসাব বের করা হয় মাখার প্রস্থকে দৈর্ঘ্যের সাহায্যে (সমুখ থেকে পশ্চাদভাগের মাঝ) ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করে।

অর্থ্যাৎ শিরসূচক হলঃ (মাথার প্রস্থ)/(মাথার দৈর্ঘ্য)X100

অর্থাৎ যে মাথা যত লম্বা, তার সূচক সংখ্যা হয় তত কম। যে সব মাথার প্রস্থ দৈর্ঘ্যের শতকরা ৭৫ ভাগের কম তাদের বলা হয় লম্বা মাথা (Dolichocephalic)। যে সব মাথার প্রস্থের অনুপাত দৈর্ঘ্যের শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ ভাগের মধ্যে তাদের বলা হয় মাঝারি আকৃতির মাথা (Mesocephalic)। আর যে সব মাথার প্রস্থের পরিমাপ দৈঘোর শতকরা ৮০ ভাগের উপরে, তাদের বলা হয় চওড়া বা গোল মাথা (Brachycephalic)। এসব মাথাকে উপর থেকে দেখলে অপেক্ষাকৃত গোল বলে মনে হয়। নাসাক্ৰম শিরক্রমের মত নাকের প্রস্থকে দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করে হিসাব করা হয়। যে নাকের নাসাক্রম যত কম তা তত সরু ও উন্নত। নাসাক্রম অনুসারে নাককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সরু নাক (Leptorrhine), মধ্যমাকৃতি নাক (Mesorrhine) এবং চওড়া নাক (Platyrrhine)। সরু নাকের প্রস্থ হয় দৈর্ঘ্যের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগের মধ্যে। আর চওড়া নাকের প্রস্থ হল দৈর্ঘ্যের শতকরা ৮৫ ভাগ বা তার উপরে। এভাবে দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও তার পরিমাপের বিচার করে এই উপমহাদেশের মানুষকে প্রথম সাতঠি দৈহিক প্রকার (Physical types) বিভক্ত করেন স্যার হার্বাট রিজল। রিজল তাঁর গবেষণার ফল প্রকাশ করেন ১৮৯০ সালে বিলাতের নৃতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পত্রিকায় (Journal of the Anthropological Institute)। তাঁর প্রবন্ধটির নাম হল The Study of Ethnology in India। রিজলের গবেষণা থেকেই এই উপমহাদেশে নৃতত্ত্বের আরম্ভ। রিজলেই প্রথম বাঙালী মুসলমানের দৈহিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে দেখতে চান এবং তাদের উদ্ভব সম্পর্কে বিশেষ তত্ত্ব দেন।[1]

রিজলের বক্তব্য

রিজলে এই উপমহাদেশের মানুষকে সাতটি দৈহিক প্রকারে ভাগ করেন। এই সাত ভাগ হল, তুৰ্কীয়-ইরান (Turko-Iranian), ভারতীয় আর্য (Indo-Aryan), আর্য-দ্রাবিড় (Aryo-Dravidian), শক্‌-দ্রাবিড় (Schytho-Dravidian), দ্রাবিড় (Dravidian), মোঙ্গল-দ্রাবিড় (Mongolo-Dravi-dian ) এবং মোগলীয় (Mongoloid)। রিজলের এই সাত ভাগের মধ্যে তিনটি বিভাগ হল অবিমিশ্র কিন্তু আর চারটি হল মিত্র। বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে রিজলের বক্তব্য বুঝতে হলে বিশেষভাবে জানতে হয় তাঁর ভারতীয় আর্য-দ্রাবিড় এবং মোঙ্গলীয় মানব প্রকার সম্পর্কে ধারণার কথা। ভারতীয়-আর্য (Indo-Aryan) বলতে রিজলে বুঝিয়েছেন, এমন প্রকারের মানুষদের-যাদের গায়ের রঙ ফর্সা, যারা উচ্চতায় (Stature) লম্বা, যাদের মাথার আকৃতি দীর্ঘ এবং নাকের আকৃতি সরু। দ্রাবিড় বলতে রিজলে বুঝিয়েছেন সেই সব মানুষদের–যাদের গায়ের রঙ বাদামী থেকে কাল, যারা উচ্চতায় খর্বাকৃতি, যাদের মাথা লম্বা কিন্তু নাক খুব চওড়া। মোঙ্গলীয় মানুষ বলতে রিজলে বুঝিয়েছেন তাদের–যাদের গায়ের রঙ পীতাভ বাদামী, মাথার আকৃতি গোল, নাক সরু থেকে চওড়া তবে দ্রাবিড়দের মত মাংসল নয়; যাদের চোখের উপর পাতায় বিশেষ ধরনের ভাঁজ থাকায় চোখ দেখে ছোট মনে হয় এবং যাদের মুখে দাড়ি-গোঁফের মাত্রা খুব কম থাকে। দ্রাবিড়দের বিশুদ্ধ দৃষ্টান্ত হিসাবে রিজলে উল্লেখ করেছেন সাঁওতালদের কথা। আর মোগলয়েড মানুষদের দৃষ্টান্ত হিসাবে রিজলে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন দার্জিলিং-এর ল্যাঞ্চা এবং সাবেক আসামের কেড়োদের কথা।

রিজলে বাঙালীদের বলেছেন মোঙ্গল-দ্রাবিড়। তাঁর মতে বাংলার পশ্চিম থেকে এসেছে সাঁওতাল ও অনুরূপ মানুষেরা। উত্তর ও পূর্ব প্রান্ত থেকে এসেছে মোঙ্গলীয় মার্শ প্রকারের লোকেরা। এদের সংমিশ্রণে উৎপন্ন হয়েছে বাংলার মানুষ। বাংলার মানুষের মাথা গোল। কিন্তু তাদের নাকের আকৃতি ও গায়ের রঙ প্রধানত দ্রাবিড়দের মত। পশ্চিমে দ্রাবিড় প্রভাব বেশী। কিন্তু পূর্বে ও উত্তরে রয়েছে মোঙ্গলীয় প্রভাব। বাঙালী হিন্দুর উচ্চবর্ণের মধ্যে (Higher castes) নাক সরু হতে দেখা যায়। রিজালের মতে বাঙালী হিন্দুর উচ্চ বর্ণের (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য) নাক সরু হবার কারণ, তাদের মধ্যে রয়েছে কিছুটা আর্য রক্তের প্রভাব। কিন্তু বাঙালী হিন্দুর নিম্ন বর্ণের মধ্যে এবং বাঙালী মুসলমানের মধ্যে সরু নাক মানুষ হতে দেখা যায় না। তাদের নাসাক্রম (Nasal Index) হল বেশী। তাদের মধ্যে কোন আর্য রক্তের প্রভাব নেই। বাঙানী নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দৈহিক আকৃতিগত মিলের কারণ হ’ল এই যে, বাংলার অধিকাংশ মুসলমানের উম্ভব হয়েছে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের থেকে। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরাই দলে দমে ইসলাম গ্রহণ করে বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।

এক সময় মনে করা হত আর ধীশক্তি, স্মরণশক্তি এবং কর্মপ্রবণতায় অপরের থেকে শ্রেষ্ঠ। বাঙালী হিন্দুর উচ্চ বর্ণের লোকেরা শ্রেষ্ঠ, কারণ তাদের মধ্যে আছে আর্য রক্তের প্রভাব। কিন্তু নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা তা নয়। কারণ, তাদের মধ্যে নেই আর্য রক্ত। তারা জন্মগতভাবেই নিকৃষ্ট। বাঙালী মুসলমান যেহেতু বেশির ভাগ হল নিম্ন বর্ণের হিন্দুর বংশধর, তাই তারাও হল জন্মগতভাবেই নিকৃষ্ট। রিজলের গবেষণার ফলাফল তাই এ সময়কার শিক্ষিত মুসলমান সমাজে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ ওঠে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ নিয়ে রিজলে যে গবেষণা করেন, তা তিনি প্রকাশ করেন তার ‘Tribes and Castes of Bengal’ নামক বইয়ের প্রথম সংস্করণে। এই বইয়ের বক্তব্যকে বিশেষভাবে সমালোচনা করে মুর্শিদাবাদের নবাবের দেওয়ান খন্দকার ফজলে রাব্বি ফারসীতে একটি মুল্যবান গ্রন্থ রচনা করে। পরে ১৮৯৫ সালে বইটির ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত হয় Origin of the Musalmans of Bengal’ নামে।[2] ফজলে কি সাহেব যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে এই বইতে রিজলের মত খণ্ডন করেন।

ফজলে রাব্বির মত

ফজলে রাব্বি অভিমত প্রকাশ করেন, বাংলায় এত অধিক সংখ্যক মুসলমান, তার কারণ বাংলার বাইরে থেকে এসে বহু মুসলমান বসতি করেছেন। বাংলার মুসলমানরা প্রধানত হলেন বহিরাগত মুসলমানদেরই বংশধর। বাংলার ভূমি উর্বর। বাংলাদেশ ছিল সম্পদশালী। বাংলার ভূমির উর্বরতা ও সম্পদ মুসলমান আমলে বাইরে থেকে বহু মুসলমানকে আকৃষ্ট করেছিল এদেশে বসতি স্থাপন করবার জন্য। এরা ছিল আরব, তুরান, ইরান, আফগানিস্তান থেকে আসা। ইতিহাস থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। রিজলে এই ইতিহাস অনুশীলন করেন নি। রিজলের গবেষণা মোটেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়নি। তিনি মাত্র ১৮৫ জন মুসলমানের পরিমাপ গ্রহণ করেছেন। এয়া অধিকাংশই হল পর্ব বাংলার লোক। কিন্তু রিজলে যখন হিন্দুদের পরিমাপ করেছেন, তখন তা করেছেন গোটা বাংলা থেকে এবং সংখ্যায় অনেক বেশী হিন্দুর পরিমাপ গ্রহণ করে তাদের নাসা-ক্রমের (Nasal Index) হিসাব করেছেন। তাই তাঁর মুসলমানের নাকের মাপের সঙ্গে হিন্দুর নাকের পরিমাপের কোন তুলনা করতে যাওয়া ভুল। রিজলের হিসাব অনুসারে মুসলমানের নাকের প্রস্থ হচ্ছে ৩৮.৩ আর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪১.৪। পক্ষান্তরে হিন্দু ব্রাহ্মণের নাকের প্রস্থ হচ্ছে ৩৫ আর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪৯.৭। কিন্তু মুসলমান ও ব্রাহ্মণের গড় করবার সময় তিনি সমান সংখ্যক মুসলমান ও হিন্দু ব্রাহ্মণ চুপ করেন নি। আর কিছু বেশী মুসলমানের মাপ গ্রহণ করলেই দেখা যেত নাকের মাপের পার্থক্য করা সম্ভব হচ্ছে না।

রিজলে ষে সব মুসলমানের পরিমাপ গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে ২৭ জন হল চট্টগ্রামের, ৫৭ জন ময়মনসিংহের (সাবেক), ১৩ জন কুমিল্লায় (সাবেক ত্রিপুরা), ৩৫ জন ঢাকার, ৩ জন ফরিদপুরের এবং বাদ বাকি ১৭ জন বরিশাল, নোয়াখালী ও পাবনার লোক। সর্বোপরি এই ১৮৫ জন লোকের পরিমাপ রিজলে নিজের হাতে গ্রহণ করেন নি। গ্রহণ করেছেন তাঁর সহকর্মী। কুমুদ বিহারী সামন্ত। রাব্বি সাহেব তাঁর বইতে লিখেছেন, তিনি কুমুদ বিহারী বাবুকে এ বিষয় প্রশ্ন করে জেনেছেন যে, রিজলে কুমুদ বিহারী বাবুকে পূর্ব বাঙলার সেই সব মুসলমানদের মাথা ও নাকের পরিমাপ গ্রহণ করতে বলেছিলেন, যাদের সাধারণভাবে দেখেই মনে হয় মোঙ্গলীয় মানব ধারার প্রভাবে প্রভাবিত। অর্থাৎ রিজলের গবেষণা গোড়া থেকেই ছিল বিশেষভাবে সংস্কায়যুক্ত (biased)। রিজলের আগে ১৮৭২ সালের আদিম শুমারীর রিপোর্টে বিভারলি (Beverly) নামক একজন আই, সি, এস, লেখেন যে, বাঙালী মুসলমান প্রধানত নিম্নবর্ণের বাঙালী হিন্দুর ধর্মান্তরিত বংশধর। রিজলে তাঁর গবেষণায় বিভারলীর অভিমত দ্বারা প্রড়াবিত হন। রিজলের পর বাংলাদেশের মানুষের তত্ত্ব নিয়ে যে গবেষণা হয় তাতে বাংলার মানুষ মোঙ্গল ও দ্রাবিড় মানব ধারার সঙ্কর এই তত্ত্বকে অস্বীকার করা হয়। কারণ, বাংলার অধিকাংশ মানুষের মাথা গোল হলেও, তাদের চোখের পাতায় মোঙ্গলীয় বৈশিষ্ট্যসূচক ভাঁজ থাকতে দেখা যায় না। তাদের মুখে সাধারণভাবে গোঁফ-দাড়ির প্রাচুর্য থাকতে দেখা যায়।[3] তাদের মাথার চুলের প্রকৃতিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মোঙ্গলীয় মানব প্রকারের লোকের মত ঋজু ও খরখরে নয়। বাংলার মানুষের মধ্যে মোঙ্গল প্রভাব আছে। কিন্তু তা বেশী নয়।

অন্যদিকে সাঁওতালদের মাথা লম্বা। কিন্তু বাংলার অধিকাংশ মানুষের মাথা গোল। তাই তাদের সঙ্গেও এই অঞ্চলের মানুষকে খুব এক করে দেখা যায় না। রিজার মেলি-দ্রাবিড় তত্ত্ব তাই এদেশের মানুষ সম্পর্কে সাধারকাবেই খাট না।

রক্তের পরিচয়

নৃতাত্ত্বিকরা এখন মানব প্রকারের বিচারের সময় একটা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কোন্ বিভাগের রক্ত কি পরিমাণ আছে তারও বিচার করে দেখেন। প্রয়োজনের সময় সব মানুষের রক্ত সব মানুষের শরীরে দেওয়া যায় না। একই বিভাগভুক্ত রক্তই একজন মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা চলে। ভুল রক্ত দিলে রোগীর মৃত্যু হয়। মানুষের রক্তকে প্রধানত চার ভাগে বিভক্ত করা হয়ূ, “A” “B”, “AB” এবং “O”। ম্যাকফরেলেন (E. W. E, Macfarlane) নামক একজন (মহিলা) নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ করতে চান, বাঙাল্লী নিম্ন বর্ণের হিন্দুর রক্ত আর বাঙালী মুসলমানের রক্ত একই প্রকারের। অতএব বাঙালী হিন্দুর নিম্ন বর্ণের (Depressed caste) থেকেই হয়েছে বাংগালী মুসলমানের উদ্ভব। তিনি পরীক্ষা করে দেখেন, বাঙালী হিন্দুর নিম্ন বর্গের মধ্যে ‘B’ বিভাগের রক্তে লোকের সংখ্যা হচ্ছে শতকরা ৪২.৭ জন অরি বাঙামী মুসলমানের মধ্যে ‘B’ বিভাগের রক্ত সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা হচ্ছে শতকরা ৪০ জন।[4] ম্যাকফারলেন মাত্র কলকাতার কাছে বজবজ থেকে ১২০ জন মুসলমানের রক্ত নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু তাঁর পরে রক্ত নিয়ে আরো গবেষণা হয়েছে, যা থেকে দেখা যায়, সব অঞ্চলের রক্তের হিসাব এক নয়। দিলিপ কুমার সেনের (D.K. Sen) গবেষণা থেকে দেখা যায় বাঙালী মুসলমানের রক্ত যত না মেলে বাঙালী হিন্দুর নিম্ন বর্ণের সঙ্গে, তার চাইতে বেশী সেলে উচ্চ বর্ণের সঙ্গে। দিলিপ কুমার সেনের মতে বাঙালী মুসলমান কেবল বাঙালী হিন্দুর নিম্ন বর্ণের লোক থেকে হয়েস্থে এই মতবাদকে স্বীকার করা চলে না।[5]

বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণ

বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা যায়, এই অঞ্চলে এক সময় ছিল বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ প্রভাব। বাংলার পাল রাজারা ছিলেন (৭৫০-১০৭৫ খৃঃ) বৌদ্ধ। পালদের পরে আসেন সেন রাজারা (১০৯৫-১২০০ খৃঃ)। সেন রাজারা বাংলার লোক ছিলেন না। এঁরা ছিলেন দাক্ষিণাত্যের লোক। সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। তাঁরাই বাংলায় বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বর্ণাশ্রম (caste system) এবং ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যের কৌলিন্য প্রথা।[6] এ আমলে বৌদ্ধরা হতে থাকেন নিগৃহীত। বৌদ্ধদের হিন্দুরা মনে করতেন অশুচি (unclean) বলে। মুসলমানরা সবার আগে বাংলায় হিন্দু-বৌদ্ধ বিরোধ চলেছিল প্রবল ভাবে। হিন্দুরা নন, বৌদ্ধরাই সম্ভবত দলে দলে গ্রহণ করেন ইসলাম। এ প্রসঙ্গে ১৯১১ সালের আদম শুমারীর রিপোর্টে বলা হয়েছে : সারা ভারতের শতকরা ৩৬ ভাগ মুসলমানের বাস বাংলায়। প্রধানত বাংলার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতেই তাদের সংখ্যা বেশী। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা কখনই পুরাপুরি হিন্দু ছিল না। এই অঞ্চলে মুসলমান আগমনের আগে প্রচলিত ছিল এক ধরনের বিকৃত (debased ) বৌদ্ধ ধর্ম। বৌদ্ধদের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা মনে করতো অশুচি (unclean)। এই অপমানিত বৌদ্ধরাই পাঠান আমলে বিশেষভাবে সাড়া দেয় ইসলামের ডাকে। এ সময় মোল্লারা ঘোষণা করতেন আল্লাহর দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। এই মানব সমতার বাণীই বাংলার বৌদ্ধদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল ইসলামের প্রতি।[7]

তুর্কী প্রভাব

কিন্তু এখন ইতিহাস বিষেজ্ঞদের মতে, বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাকে সত্য বলে গ্রহণ করলেও, কেবল তার সাহায্যে বাংলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ধরে নিতে হয় বাইরে থেকেও অনেক মুসলমানের আগমনের কথা।[8]

‘পাঠান’ শব্দটা হিন্দী। তুর্কীরা আফগানিস্তান হয়ে এই উপমহাদেশে এসেছিলেন। তাই সাধারণ বাংলায় তাদেরও বলা হয় পাঠান। বাংলায় পাঠান রাজত্বকাল ধরা হয় ইবন বখতিয়ার-এর বাংলা বিজয় থেকে মুঘল রাজত্বের আরম্ভকাল পর্যন্ত সময়কে (১২০০-১৫৭৬ খৃঃ)। বাংলায় যে সব মুসলমান আসেন, মনে হয় তাদের মধ্যে মধ্য এশিয়ার তুর্কী মানবধারার লোকেরাই সংখ্যায় ছিল বেশী। তুর্কীদের মাথা সাধারণত গোল। কিন্তু এদের চোখ ও নাক মোঙ্গলীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নয়। এদের চোখের উপর পাতায় মোঙ্গলীয় বৈশিষ্ট্যসূচক ভাঁজ থাকে না। এদের চোখের তারার রং কাল, নাক সরল এবং কিছুটা বিস্তৃত। এদের মুখের অঞ্চল ডিম্বাকৃতি। বাঙালী মুসলমানের মধ্যে এই ধরনের লোক সাধারণভাবেই অনেক হতে দেখা যায়।

বাংলায় এক সময় মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর তুলনায় বেশী ছিল না। ১৮৭১ সালের আদমশুমারীতে বাংলায় হিন্দুর সংখ্যা ছিল মুসলমানের চাইতে বেশী। কিন্তু ১৮৮১ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায় মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর তুলনায় বেড়ে যেতে। তারপর বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। তাই বাংলায় দলে দলে নিম্ন বর্ণের হিন্দু অথবা বৌদ্ধের ইসলাম গ্রহণ দিয়েই এই অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ব্যাখা করা উচিত নয়। মুসলমান আমলে নয়, ইংরেজ আমলেই এদেশে ঘটেছে মুসলমানের সংখ্যা। বুদ্ধি। অরি এর জন্য বিশেষভাবে দাপ্পী মুসলমানের জন্ম বৃদ্ধির হার।[9]

এক সময় এদেশের মুসলমানদের হিন্দুরা সাধারণম্ভাবে বলতেন ‘তুরুক’। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মিথিলার (বর্তমানে বিহারের অংশ কিন্তু প্লাগে তা ছিল বাংলার অংশ) বিদ্যাপতি লিখেছেনঃ

হিন্দু তুরকে মিন বাস,

একক ধম্মে আত্তকো উপহাস।

কতই বাঙ্গ কতহুঁ বেদ,

কতহুঁ মিলিমিশি কতহুঁ ছেদ।[10]

হিন্দু ও তুরকের বসত পাশাপাশি। কিন্তু একের ধর্ম অপরের উপহাসের বস্তু। একের আযান (বাঙ্গ) অপরের বেদ। এদের সমাজে কত মিলমিশ অরি অপর সমাজে কত বিভেদ অর্থাৎ মুসলিম সমাজের সামাজিক ঐক্যের উপর বিদ্যাপতি বিশেষ গুরুত্ব দিস্নেছেন। মুসলমান সমাজে বর্ণ বিভেদ প্রথা ছিল না।

মুঘল আমল

বাংলাদেশ ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দের পর মুঘল শাসনাধীনে আসে। ‘মুঘল’ শব্দটা ফারসী। ফারসীতে মোঙ্গলদের বলা হয় মুঘল। মুঘলরা ছিল মিশ্র প্রকৃতির। এদের মধ্যে ছিল তুর্কী ও মোঙ্গল রক্তের সংমিশ্রণ। এরা প্রকৃত প্রস্তাবে ছিল তুর্কী। এরা খাঁটি মোঙ্গল ছিল না। আকবরের ছবিতে দেখা যায়, তার চোখের উপর পাতায় মোঙ্গলীয় বৈশিষ্ট্যসূচক ভাঁজ আছে। ঐতিহাসিকদের মতে এই হল মোঙ্গল মিশ্রণের প্রভাব। মুঘলদের মাতৃভাষা ছিল জানতাই তুর্কী। তুর্কীদের এই শাখার লোক আগের তুর্কীদের মত অত পুরান মুসলমান ছিল না। তুর্কীদের এই শাখা ইসলাম গ্রহণ করে মাত্র খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে।[11] মুঘলরা ছিলেন তখনকার পারস্যের ভাবধারা ও রীতিনীতির দ্বারা দারুণ প্রভাবিত। এ সময় পারস্য থেকে অনেক লোক এই উপমহাদেশে আসে। এদের কিছু সংখ্যক বাংলায়ও এসে বসতি করে। ইরানীরা প্রধানত ছিলেন শিয়া। বাংলায় শিয়াদের অতি অল্পই প্রসার ঘটাই।[12]

মোটের উপর বলা যায়, মুঘল আমলে বাংলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য উল্লেখযোগ্য নয়। এর আগেই বাংলায় ধর্ম হিসাবে ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ় হতে পেরেছিল।

বাংলায় ইসলাম প্রচারে পীর মুরশিদদের একটা ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে পীরবাদ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে কিন্তু পীরবাদ কেবল বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই এক সময় ছিল এর প্রবল প্রভাব। পীরবাদ সূফীবাদের ছিল অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।[13] খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দী থেকে আব্বাসী খিলাফতের শক্তি কমে আসতে থাকে, বাড়তে থাকে মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কীদের ক্ষমতা। এই মুসলমান তুর্কীরা নতুন করে আরম্ভ করেন সামরিক অভিযান। এই অভিযানের এক ধারা এগিয়ে চলে উত্তর-পশ্চিমে আনাতোলিয়ার দিকে তার অপর একটি ধারা ক্রমে এগিয়ে আসে এই উপমহাদেশের দিকে। তুর্কী সুলতান মুহাম্মদ ঘোরি উত্তর ভারত জয় করেন। আর এই বিজয়ের মন্ত্র দশ বছরের মধ্যেই ইবনে বখতিয়ার করেন বাংলা পশ্চিম ও উত্তর অংশ বিজয়। তুর্কীদের মধ্যেই ইসলামী মরমী চিন্তা বা সূফীবাদ জন্ম নিয়েছিল। মধ্য এশিয়া থেকেই এই ভাবধারা উত্তর ভারত হয়ে বাংলায় আসে। বাংলায় আসেন অনেক সূফী সাধক। আর তাদের সঙ্গে আসেন অনেক ভক্ত শিষ্যের দল। বাঙালী মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় প্রসঙ্গে এই ইতিহাসের কথাও কিছুটা মনে রাখতে হয়। হিস্ট্রির মতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রধানত সূফীদের দ্বারাই। অবশ্য বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস এখনও যথেষ্ট ভাবে পরিজ্ঞাত হয়নি। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার, অনেকের মতে, তুর্কী অভিযানের অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর অনেক আগে থেকেই আরম্ভ। এই মত অনুসারে বাংলায় ইসলাম প্রচার আরম্ভ হয় প্রধানত দক্ষিণ ভাগে, সমুদ্র পথে আগত আরব বণিকদের মাধ্যমে। এক সময় চট্টগ্রামে আরব বণিকরা গড়ে তুলছিল একটি বসতি। পর চট্টগ্রাম থেকে ইসলাম প্রচার লাভ করে বাংলার পূর্বাঞ্চলে।

আরব আগমন

ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে প্রথম পর্তুগীজরা বাংলায় আসে। তারা চট্টগ্রাম (১৫১৭ খৃঃ) ও অন্যান্য আরো অনেক জায়গায় ঘাঁটি গড়ে। পর্তুগীজদের লেখা থেকে আমরা এদেশের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক উপাদান পাই। পর্তুগীজ পর্যটক জোয়াও দ্য বারোজ (Joao de Barros) লিখেছেন, পর্তুগীজরা এদেশে আবার প্রায় একশ’ বছর আগে একজন আরব সম্ভ্রান্ত যুবক তাঁর একশ’ অনুচরসহ দক্ষিণ আরবের এডেন (Aden) বন্দর থেকে চট্টগ্রাম আসেন। তিনি এখানে এসে বুঝলেন, এদেশের রাজত্বে কোন শৃঙ্খলা নেই এবং ইচ্ছা করলে দেশটিকে জয় করে রাজা হওয়া যায়। কিন্তু তিনি তার ইচ্ছা গোপন রেখে নিজেকে আরব বণিক হিসাবেই চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং পরে আরব থেকে আরো তিনশ’ জন অনুচর নিয়ে আসেন। তাঁর অনুচরদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচশ। তিনি চট্টগ্রামের একজন শাসনকর্তা মারফত গৌড়ের মুসলমানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। পরে তিনি গৌড়ের সুলতানকে উড়িষ্যা জয় করতে সাহায্য করেন। সুলতান তাঁকে তার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধানরূপে নিযুক্ত করেন। এই দেহরক্ষী-প্রধান থাকবার সময় তিনি একদিন তদানীন্তন গৌড়ের সুলতানকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন। এই ব্যক্তিটি কে ছিলেন ঐতিহাসিক দের মধ্যে সে ব্যাপারে মতভেদ আছে। তবে ব্লকমান (Blochmann) এর মতে, বারোজ বর্ণিত এই নৃপতিকে হুসেন শাহ অথবা দ্বিতীয় ফিরোজ শাহ-এর সঙ্গে এক করে দেখা যেতে পারে।[14]

আরব উপদ্বীপের মানুষদের মধ্যে দুই প্রকার দৈহিক আকৃতিবিশিষ্ট মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। এক প্রকারের মানুষের মাথার আকৃতি হল লম্বা আর আরেক প্রকারের মাথার আকৃতি হল মাঝারি (Mesocephalic)। লম্বা মাথা আরবরা বাস করে উত্তরাঞ্চলে। এদের বলা হয় বেদুইন। আর মাঝারি বা প্রায় গোলমাথা আরবরা বাস করে দক্ষিণে। এদের বলে হিমেরিত (Himyarite)।[15] দক্ষিণ আরবের লোকেরাই ছিল বাণিজ্য-নিপুণ। তারাই বাণিজ্য করতে অসিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে।

জীববিজ্ঞানে অ্যাটাভিজম (Atavism) বলে একটা কথা আছে। অ্যাটাভিজম বলতে যোঝায়, বংশধারায় কয়েক পুরুষ পর হঠাৎ পুর্বপুরুষের কোন দৈহিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাওয়া। বাঙালী মুসলমান পরিবারে অনেক সময় উত্তল (Convex) নাকযুক্ত সন্তানের জন্ম হতে দেখা যায়। অর্থাৎ তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় আরব বৈশিষ্ট্য। তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে ঘটে অ্যাটাভিজম। এছুাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক মুসলমানের মধ্যে কিছু আরব দৈহিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন উঁচু থন্ডাস্থি (High cheek bones), বক্র নাক (Hooks noses) এবং উপবৃত্তাকার সঙ্কীর্ণ মুখমণ্ডল (Narrow faces)।[16]

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে আরব উপাদান কতটা আছে, তা নিয়ে উপযুক্ত গবেষণা এখনও হয়নি। কিন্তু মনে করা চলে, আরব বণিকদের মারফতই এ অঞ্চলে ঘটেছিল ইসলাম প্রচার। কারণ, আরবরা যেমন নিজেদের অনেকে বলেন ‘শেখ’, বাংলাদেশের বহু মুসলমানও তেমনি নিজেদের নামের শেষে লেখেন শেখ। এটা তাদের উপর আরব ‘রক্তের’ প্রভাব না হলেও আরব প্রচারের ফলে ইসলাম প্রহণের ইতিহাসেরই ইঙ্গিতবহ বলে মনে করা যায়। বাংলার দক্ষিণে সমুদ্র। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলের লোক চিরকালই ছিল সমুদ্রগামী নাবিক। তাই তাদের পক্ষে আরবের বণিকদের সাহচর্যে এসে ইসলাম গ্রহণ অস্বাভাবিক ছিল না। বাংলায় সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। সেন আমলে (১০৯৫-১২০০ খৃঃ) সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। সমুদ্রযাত্রা করলে হিন্দুদের জাতিচ্যুত হতে হত। এই জাহাজে মাঝি মাল্লা হবার জন্যেও অনেকে গ্রহণ করে থাকতে পারে ইসলাম।

মুসলমান আমলে নৌ-বাণিজ্যের খুবই প্রসার ঘটে। মুসলমানরাই প্রধানত করতেন নৌবাণিজ্য। তাঁরাই ছিলেন সওদাগর। কারণ, সমুদ্রযাত্রার ব্যাপারে তাদের ক্ষেত্রে কোন ধর্মীয় বাধা-নিষেধ ছিল না। এছাড়া ইসলাম ধর্ম বাণিজ্যকে সর্বদাই দেয়া হয়েছে প্রাধান্য। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নিজেও তাঁর জীবনে এক সময় ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে দূর বিদেশে যাত্রা করেছেন। ষোড়শ শতকের প্রারম্ভে আগত পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা (Duarte Barbosa) লিখেছেন যে, এদেশে সমুদ্রতীরে ও দেশের অভ্যন্তরভাগে অনেক শহর আছে। ভিতরের শহরগুলোতে হিন্দুরা বাস করে। কিন্তু সমুদ্র তীরের বন্দরগুলাতে হিন্দু-মুসলমান দুইই আছে। এদেশে তুলা, ইক্ষু, মরিচ ও উৎকৃষ্ট আদা পাওয়া যায়। এদেশে নানারকম সূক্ষ্ণ বস্ত্র তৈরি হয়, আরব, পারস্যে যার চাহিদা খুব বেশী। বারবোসা এইসব বন্দরে আরব পারস্য থেকে আগত বণিকদের কথা উল্লেখ করেছেন। তারা বাংলায় এইসব পণ্য নিতে আসতো।

তাই মেনে নিতে হয়, বাংলাদেশে ইসলামের প্রভাব এসেছে দুটি ভিন্ন দিক সাধারণভাবে এটাই সত্য যে হিন্দু মা’দের চাইতে মুসলমান মা’দের সন্তান বেশী হচ্ছে।[17]

ইংরাজ আমলে খৃষ্টান মিশনারীরা উপজাতিদের মধ্যে খৃষ্টধর্ম প্রচার আরম্ভ করেন এবং যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেন। ইংরাজ গবেষকদের তাই প্রথম দিকে ধারণা হয়, এদেশে মুসলমান আমলে ইসলামও প্রচারিত হয়েছিল প্রধানত আদিম উপজাতীয় জনসমাজ এবং তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে। পরে তাঁদের এ ধারণা পরিবর্তিত হয় এবং বাংলার বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনার উপর তারা গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন।

এ প্রসঙ্গে মনে রাখবার মত কথা হল, ইসলাম কোন একটা বিশেষ মানব ধরার (Race) ধর্ম নয়। ইসলাম একটা বিশ্বজনীন (Universal) ধর্ম ব্যবস্থা। ইসলামী ঐক্য রক্তের নয়, একটা জীবন রীতির (Way of Life)। ইসলামী উম্মাহ, আসলে একটি ধর্মসমাজ, যার পিছনে রয়েছে বিশিষ্ট ইতিহাসের ধারা।

[1] রিজলে তাঁর গবেষণার ফলাফল পরে প্রকাশ করেন গ্রন্থের আকারে। বইটির নাম The People of India, বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে কলকাতার Thakur Sink & Co. থেকে।

[2] Khandker Fazle Rabbee, The Origin of the Musalmans of Bengal, Thakur Spink & Co. 1895.

[3] Census of India, 1931, Vol V. Part I, PP. 432-441.

[4] দ্রষ্টব্য : D. N. Majumdar, Racex and Culture of India (Asia Publishing House, Bombay, 1961) PP. 101-110.

[5] দ্রষ্টব্য: D. K. Sen, The Racial Composition of Bengalis in Indian Anthropology (Ed. T.N. Madank G. Sarans, Asia Publishing House, Bombay 1962) PP. 193-220.

[6] দ্রষ্টব্য : V. A. Smith, The Oxford History of India (Ed.P. Spear, Clarendon Press, Oxford, 1967) PP. 201-202.

[7] Census of lodia, 1911, Vol. I, part I, P. 128

[8] দ্রষ্টব্য : Jagadish Narayan Sarker, Islam in Bengal (Patna Prakasan, Calcutta, 1972), PP. 21-22.

[9] ১৯৬১-১৯৭১ সালের মধ্যে জাতে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হল শতকরা ৩০.৯ আর হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হল ২৩.৭। এই বৃদ্ধির হার বজায় থাকলে আগামী ৪০০ (চারশ) বছর পর বর্তমান ভারতে মুসলমান ও হিন্দুর সংখ্যা বাড়াবে প্রায় সমানে সমান। (S. N, Agarwala, Will Muslim Out-number Hindus? The illustrated Weekly of India, July 13, 1974, PP. 16-19)। গোটা উপমহাদেশেই হিন্দুর তুলনায় মুসলমানের জন্ম বৃদ্ধির হার বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

[10] সুকুমার সেন, মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী। (বিশ্ব ভারতী গ্রন্থালয়, কলকাতা, ১৩৫২ অব্দ) পৃঃ ৬-৭ দ্রষ্টব্য।

[11] The Oxford History of India, P. 239

[12] অনেক মুঘল রাজ কর্মচারী ছিলেন শিয়া। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এবং তাঁর জামাই শুজাউদ্দীন ছিলেন শিয়া। এঁদের সময় থেকে বাংলায় মহররম উদযাপন বিশেষ-ভাবে প্রাধান্য পায় এবং বিশেষভাবে তাজিয়া নিয়ে মিছিল করা শুরু হয়। কিন্তু ধর্মের দিক থেকে শিয়াবাদ এদেশে প্রভাব বিস্তার করতে পাঙ্গেনি। সৈয়দ আমীর আলী ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন ছিলেন শিয়া। আমীর আলীর ‘The Spirit of Islam’ বিখ্যাত গ্রন্থ হাজী মুহাম্মদ মহসীন-এর দান বাংলার মুসলমান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

[13] Philip K. Hitti, Islam and the West (Van Nosproud, Prionceton, New Jersey, 1962), PP. 44-46.

[14] H. Blochmann, Contribution to the Geography and History of Bengal, Journal of Asiatic Society for Bengal for 1873. Part I, P. 287

[15] A.C. Haddon, The Races of Man, (University Press, Cambridge, 1924), P.23..

[16] Census of India, 1901, Vol. VI. Part 1, Report, P. 167.

[17] La Population du Bangladesh, pp.39-40, Par Roland Breton (La documentation Francaise) Paris, 1972.

সূত্রঃ বাংলাদেশে ইসলাম, রচনায়: ডক্টর এবনে গোলাম সামাদ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88