
শিয়া-সুন্নী ঐক্য প্রসঙ্গ
আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সংগে লক্ষ্য করে আসছি যে, দ্বাদশ ইমামপন্থী শিয়া মযহাবের পক্ষ থেকে তথাকথিত শিয়া-সুন্নী ঐক্য প্রতিষ্ঠার নামে বিভিন্ন সুন্নী দেশে শিয়াবাদকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ব্যাপক প্রচার কার্য চালানো হচ্ছে। এখন থেকে অর্ধশত বছর পূর্বে আন্তর্জাতিক শিয়া নেতৃত্ব তথাকথিত শিয়া সুন্নী নৈকট্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কাজ করার জন্য মিসরে প্রথম প্রচার কেন্দ্রটি স্থাপন করার সময় থেকেই একটি শক্তিশালী শিয়ারাষ্ট্র পরোক্ষভাবে এর সার্বিক তত্তাবধানে নিয়োজিত রয়েছে এবং যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে এসেছে। এক দশক পূর্বে ইরানে সংঘটিত রাষ্ট্র বিপ্লবের পর শিয়া-সুন্নী ঐক্য আন্দোলনে নতুন প্রাণ ও গতি সঞ্চারিত হয় এবং মিসরের বাইরে অন্যান্য সুন্নী দেশেও এ আন্দোলন দ্রুত প্রসার লাভ করে।
বিগত বছরগুলোতে যেসব সুন্নী দেশে এ শিয়া আন্দোলনটির কাজ খুব জোরেশোরে চলছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, ইসনা আশারিয়া ইমামিয়া শিয়া মাযহাব ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে তথাকথিত নৈকট্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে ত্রিমুখী তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
প্রথমতঃ, শিয়া মযহাব সম্পর্কে আমাদের দেশের সরলপ্রাণ সুন্নী মুসলমানদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের সম্মুখে এর ভুল সংজ্ঞা তুলে ধরা হচ্ছে এবং আমাদের সলফে সালেহীন ও পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম যে শিয়া ফিরকা সমূহকে বাতিল ফিরকা হিসেবে গণ্য করে গেছেন এ সত্যকে চাপা দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালানো হচ্ছে।
দ্বিতীয়তঃ শিয়া মতবাদকে এদেশের জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য অত্যন্ত সুচতুরভাবে একথা প্রচার করা হচ্ছে যে, ‘হানাফী- শাফেয়ী- হাম্বলী’ প্রভৃতির মত শিয়াবাদও ইসলামে একটি প্রচলিত মযহাবের নাম এবং শিয়ারা আকীদা ও আমলের দিক থেকে হানাফীদের অত্যন্ত নিকটবর্তী। এসব প্রচারণা যে আসলে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় তা এ পুস্তকের পাতায় পাতায় আপনারা দেখতে পাবেন।
তৃতীয়তঃ, শিয়া-সুন্নী সম্প্রীতি, ইসলামী বিপ্লব ইত্যাদি চটকদার শ্লোগানের মাধ্যমে শিয়া মতবাদের প্রতি সুন্নী মুসলমানদের সহানুভূতি অর্জন এবং ইসলামের নামে পরিচালিত একটি শিয়া রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতার প্রতি বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের এক অশুভ পায়তারা চালানো হচ্ছে।
শিয়া ও সুন্নী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন এবং শিয়া মযহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা আসলে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। বলা বাহুল্য, প্রথমটি অভিপ্রেত এবং কল্যাণকর কিন্তু দ্বিতীয়টি নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত এবং ক্ষতিকর।
শিয়া কেন অন্য যেকোন ধর্ম বা মতবাদের অনুসারীদের সংগে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন ইসলামে শুধু অনুমোদিত নয় প্রশংসিতও। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, শিয়াদের তাতে মোটেই আগ্রহ নেই। সুন্নীদের সংগে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের চেয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের সাথে ধর্মীয় ঐক্য স্থাপনেই শিয়াদের উৎসাহ বেশী। অবশ্য এজন্য তারা কানাকড়ি মূল্য দিতেও রাজী নয়। তারা চায় যে, আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাহ ও সলফে সালেহীনের তরীকা তথা ইসলামের মূলধারার সংগে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমরা তাদের মতবাদের সংগে একাত্মতা ঘোষণা করি। কিন্তু আমরা কি তা করতে পারি? কোন ধর্ম বা মতবাদের সংগে ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে আমরা কি আমাদের দ্বীন পরিত্যাগ করতে পারি? ইসলাম কি আমাদের কোন ব্যাক্তিগত সম্পত্তি যে একে নিয়ে আমরা খেলা করব?
শিয়া মতবাদ ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র ও ইসলামে একটি নতুন ফিতনা। কিন্তু এ ফিতনা দ্বারা শিয়াদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার কোন আশংকা নেই। কারণ, শিয়া মতবাদ নিজেই ইসলামে একটি ফিতনা। মুহাদ্দিসীন ও মুজতাহিদীনে কেরাম শিয়াবাদকে ইসলামে নতুন উদ্ভাবিত একটি বাতিল ফিরকা বলে গণ্য করেছেন। এ ফিরকা উদ্ভাবনের মাধ্যমে তারা ইসলামের মূলধারা-আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত-থেকে দূরে সরে গেছে। এখন তারা চাচ্ছে আমাদেরকেও এ ধারা থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের সাথে একই সমতলে দাঁড় করাতে। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তারা তথাকথিত শিয়া-সুন্নী ঐক্যের শ্লোগান তৈরী করেছে। ঐক্যের প্রতি আহ্বানে তারা যদি আন্তরিক হতো তবে কি তারা আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, ইসলামের পবিত্রস্থান ও পথিকৃতদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারত? তবে তারা যা-ই ভাবুক বা করুক না কেন আমরা তাদের সংগে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে প্রস্তুত।
কিন্তু একটি শিয়া রাষ্ট্রের পৃষ্টপাোষকতা ও বদান্যতায় বাংলাদেশে শিয়া মতবাদের সমর্থনে ও আহলে সুন্নত ওয়াল জমায়াতের সমালোচনায় যে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা দেখে বিশ্বাস হয়না যে, তারা সুন্নীদের সংগে শান্তি ও ঐক্য চায়। একটি বাতিল ফিরকার স্বার্থে কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করা ও সাধারণ মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাসের উপর বেপরোয়াভাবে আক্রমণ পরিচালনা করা সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। বলা বাহুল্য, শিয়াদের উদ্যোগ ও অর্থে পরিচালিত এসব কার্যকলাপ প্রকৃতপক্ষে মুসলমান ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। আমাদের উলামা, মাশায়েখ ও পীর-মুর্শিদগণের উচিত পূর্বাহেই ষড়যন্ত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান বিশেষতঃ যুবসমাজকে এর খপ্পর থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বাতিল ফিরকাসমূহের আলোচনা শুধু হাদীস, তফসীর ও আকাইদের কিতাবসমূহে সংরক্ষিত থাকলেই চলবেনা বরং সভা-সম্মেলনে ওয়াজ মাহফিলে এবং জুমার খুৎবাতেও অন্যান্য বিষয়ের সংগে এ বিষয়টি আলোচিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
উল্লেখ্য যে, মিসরীয় পন্ডিত আল্লামা মুহিবুদ্দিন আল-খতীব বর্তমান শতকে শিয়া মাযহাব সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষক ও বিশিষ্ট গ্রন্থকার হিসেবে পরিচিত। গ্রন্থ প্রণয়ন ছাড়াও শিয়া মতবাদ সম্পর্কে তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে এ বইটি ইসলামী বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিশেষতঃ এর দ্বিতীয় খন্ডে অন্তর্ভুক্ত নজফ সম্মেলন বইটির মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঐতিহাসিক নজফ সম্মেলনের সভাপতি ও বিচারক আল্লামা আবদুল্লাহ আল- সুয়াইদী (রহঃ) তাঁর স্মৃতিকথায় সম্মেলন সম্পর্কে যেসব তথ্য লিপিবন্ধ করে গেছেন তা যেমন হৃদয়গ্রাহী তেমনি, জ্ঞান সমৃদ্ধ ও চিন্তা উদ্দীপক। বিশেষতঃ নাদির শাহের দরবার ও শিয়া নেতা মোল্লা বাশীর সংগে কথোপকথনের যে চিত্র তিনি স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন তা যেকোন নাটক-উপন্যাসের বর্ণনা ও সংলাপের মতই আকর্ষণীয়।
বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের উপহার দেওয়ার জন্য এ বইটি অনুবাদ করেছেন আবদুশ শাকুর খন্দকার।
উপরোক্ত ভূমিকাটি রচনা করেছেন : উবায়দুল হক, খতীব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, ঢাকা।
এক নজরে বইটি :
শিয়া-সুন্নী ঐক্য প্রসঙ্গ
রচনায় : আল্লামা মুহিবুদ্দিন আল-খতীব
অনুবাদে : আবদুশ শাকুর খন্দকার
প্রকাশনায় : কাওসার পাবলিকেশান্স
পৃষ্ঠা : ১২৯
সাইজ : ৬ মেগাবাইট
ডাউনলোড করতে নিচের লিংক এ ক্লিক করুন