সন্ধানী দৃষ্টিতে ইসলাম

রচনায়: দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, যুগ জিজ্ঞাসা সিরিজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

হিজরী চৌদ্দশত বর্ষপুর্তি উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

দুনিয়ার কোন বিষয়েরই বিচারের কোন স্থায়ী ও চিরন্তন মাপকাঠি নেই। একই বিষয়কে এক যুগের মানুষ যে দৃষ্টিতে দেখে—পরবর্তী যুগে সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না। একদা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য বলে যে তাজমহলের খ্যাতি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল ; তা ক্রমেই ম্লান থেকে ম্লানতর হয়ে পড়েছে।

এ তাজমহলেরই সৌন্দর্য্যে অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ উল্লসিত সুরে বলেছিলেন –‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল—এ তাজমহল’। কিন্তু এ বিংশ শতাব্দীতেই কবি সাহির লুধিয়ানভী তাজমহল সম্বন্ধে তার বিখ্যাত কবিতায় বলেছেন—’তোমার দেয়ালের গায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্থি পঞ্জর ব্যতীত আমি আর কিছুই দেখতে পাইনে’। মাত্র অর্ধশতাব্দীর ব্যবধানে তাজমহলের সে অপূর্ব সৌন্দৰ্য্য অন্তর্হিত হয়ে তার মধ্যে মানব জীবনের সবচেয়ে বীভৎস দিক—হত্যা ও লুণ্ঠনের দৃশ্য ফুটে উঠেছে। বিচারের দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন হ’লেও-কোনও একটা মূল্যমানের আলোকে এ দুনিয়ার সকল কিছুরই মানুষ বিচার করে। বিগত শতাব্দীতে মানুষ হয়ত সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তাজমহলের বিচার করেছে। বর্তমান যুগে তার বিচার করছে মানুষের মঙ্গলামঙ্গলের দৃষ্টিতে। দৃষ্টিকোণ ও মঙ্গলবোধের পরিবর্তন হলে এবং সে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যমানগুলোর পরিবর্তন হলেও, সে মূল্যমানগুলোর মধ্যে যে ধারাবাহিকতা বর্তমান, তা অনস্বীকার্য। পুৰ্বতর মূল্যমানের সাক্ষাৎ বংশধর রূপে অথবা তার তীব্র প্রতিবাদ রূপেই নানাবিধ মূল্যমান জগত সভ্যতায় দেখা দিয়েছে। মানব-জীবনের কল্যাণের জন্য যেসব মূল্যমান সুদুর অতীতে মানব সভ্যতায় দেখা দিয়েছিল সেগুলোকে অতি আধুনিক কালের মানুষ যেমন সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেনি, তেমনি অতি আধুনিক কালে যেসব মূল্যমানের উৎপত্তি হয়েছে, সেগুলোকেও অবহেলা করেনি। বরং কালের ধারায় সমুৎপন্ন সকল মুল্যমানকেই মানুষ তাদের যথোপযুক্ত মর্যাদা দান করেছে। এ জন্য মানুষের বিচারবুদ্ধির সার্থকতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে, তার জীবনে বা সভ্যতায় যেসব মূল্যমানের উৎপত্তি হয়েছে, সে সম্বন্ধেও সম্যক আলোচনা করা দরকার।

মূল্যমানের উৎপত্তি ও কার্যকারিতা

জগতের উৎপত্তির আদি থেকে এ বিশ্বে যতগুলো মূল্যমানের আবির্ভাব হয়েছে সেগুলো কালের ক্রম অনুসারে সাজানো কারো পক্ষেই সম্ভবপর নয়। কারণ ইতিহাসের পাতায় এ ধারাবাহিকতার সব ঘটনা লিপিবদ্ধ করার সাধনা মানুষের জীবনে খুব দীর্ঘকালের ব্যাপার নয়। বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ ও ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের মধ্যে আমরা মানব-জীবনে উদ্ভূত যে সব মূল্যমানের পরিচয় পাই, তাদের মধ্যে হোমারের ‘ইলিয়ড’ ও ‘অডিসি’তে আমরা দেখতে পাই, সেখানে ন্যায়-অন্যায় বোধ সম্বন্ধে মানব জীবনের চেতনা, নারীর সতীত্ব সম্বন্ধে সজাগতা এবং নারীর মর্যাদাহানিকর কার্যাবলীর তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে—পিতৃসত্য পালনের জন্য পুত্রের প্রস্তুতি, ভ্রাতৃগণের মধ্যে প্রেম, মৈত্রী, করুণা ও সহানুভূতির আদশ চমৎকার ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তিনিও হোমারের সঙ্গে একমত হয়ে নারীর সতীত্ববোধ ও তার মর্যাদা রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য বলে গণ্য করেছেন। মহাভারতে নারী সম্বন্ধে ধারণার বিভিন্নতা প্রকাশ পেলেও, দুর্যোধন কর্তৃক প্রকাশ্য সভায় দ্রৌপদীর অপমানকে মহাকবি ব্যাস পরোক্ষে নিন্দা করেছেন। পুরাকালের ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্যে সত্যের জয় এবং অসত্যের পরাজয় দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব সাহিত্য ব্যতীত বিভিন্ন ধর্মে যে সব মূল্যমান প্রতিষ্ঠার জন্য মানবকূলকে আহ্বান করা হয়েছে—তার মধ্যে ইহুদি ধর্ম প্রবর্তক হযরত মূসা (আঃ), খৃস্টান ধর্ম প্রবর্তক হযরত ঈসা (আঃ) এবং ইসলাম ধর্ম প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) নানাবিধ নীতি ও তাদের আনুষঙ্গিক নানাবিধ মূল্যমান এ জগতের বুকে প্রবর্তন করে, এ দুনিয়ার মানুষের প্রভূত কল্যাণ সাধনের জন্য আজীবন প্রতিকূল পরিবেশে সংগ্রাম করেছেন। প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত তিনজন নবী মুরসালীনের বাণী ছিল—তাদেরই পূর্ববর্তী নবী হযরত ইবরাহীমের (আঃ) প্রচারিত নীতির বিকশিত রূপ। তিনি আল্লাহকে এক, অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান প্রভু বলে স্বীকার করে—তাঁরই আদেশে তাঁর আপন পুত্রকেও কোরবানী করতে প্রস্তুত হয়ে, এ দুনিয়ায় আল্লাহর আসনের যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারই পরবর্তী বিকশিত রূপ দেখা যায়—হযরত মুসা (আঃ) প্রবতিত ধর্মে। তিনি হযরত ইবরাহীম প্রবর্তিত আল্লাহর ধারণার সঙ্গে তাঁর ন্যায় বিচারকে অপর একটা সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ বলে ঘোষণা করে, মানব জীবনে আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে তার ন্যায়বিচারকে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ বলে ঘোষণা করেন। ন্যায়বিচার সব সময়েই অত্যন্ত কঠোর এবং ভাবাবেগশূন্য ক্রিয়া বলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মানব সমাজের আইন কানুনে একটু কঠোরতার ভাব প্রকাশ পায়। তাঁর পরবর্তী নবী মুরসাল হচ্ছেন হযরত ঈসা রুহুল্লাহ। তিনি আল্লাহর প্রধান গুণ হিসাবে প্রেম ও ভালবাসাকে গণ্য করে, মানব জীবনে প্রেমের প্রতিষ্ঠা করার সাধনা করেছেন। যেক্ষেত্রে হযরত মুসার নীতি ছিল— Eye for eye, tooth for tooth-(চোখের পরিবর্তে চোখ ও দাঁতের পরিবর্তে দাঁত) সেক্ষেত্রে হযরত ঈসার নীতি ছিল—Fatherhood of God and brotherhood of men—অর্থাৎ আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ পিতা বলে স্বীকার করে, মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা। হযরত মোহাম্মদের (সাঃ) ধারণায় আল্লাহর নিরানব্বই গুণ প্রতিভাত হয়েছিল বলে—তিনি মানুষকে আল্লাহর সবগুলো গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য তাগিদ করেছিলেন। তাঁর সুবিখ্যাত বাণী, ‘তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ’-আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও—আজও মুসলিমদের জীবনে অমোঘ নির্দেশ হিসাবে কার্যকরী।

মানবতাবাদের বিকাশ

ভারতীয় ধর্মপ্রবর্তকদের মধ্যে মহাবীর জিন অথবা অমিতাভ বুদ্ধ খৃষ্টপূর্ব যুগে মুক্তির উপায় হিসাবে যে সব মাধ্যম বা শীসের প্রবর্তন করেছেন, তাতেও প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষে নানাবিধ মূল্যমান এ বিশ্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এভাবে ধরে মাধ্যমেই কেবল নানাবিধ মূল্যমান এ জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি, দর্শনের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। দার্শনিকদের মধ্যে মহানুভব স্পিনোজা মানব-জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসাবে যে মহাপ্রশান্তি বা Beatitude এর আদর্শ মানব সমাজে তুলে ধরেছেন এবং তার রূপায়ণের জন্য যে জ্ঞান-সাধনার পদ্ধতির নির্দেশ দিয়েছেন, ভারতীয় দশনে শংকরাচার্য কৃত বেদান্ত ভাষ্যের সঙ্গে তার সাদৃশ্য রয়েছে। স্পিনোজার মতবাদ অনুসারে মানুষ যখন এ বিশ্বের সব কিছুর উৎপত্তির মূলে সারবস্তুকেই উপলব্ধি করে, তখনতার জীবনে দুঃখকষ্ট বলে কোন কিছুই থাকে না। একই আধার থেকে সব কিছুরই উৎপত্তি হয় বলে ‘ভালমন্দ দ্বিধাদ্বন্দ্ব’ সব কিছুই একাকার হয়ে যায়।

কাজেই আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশে নানা সূত্রে অনেকগুলো মুল্যমান যে কার্যকরী ছিল, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে, সঙ্গে সঙ্গে এ সত্যও আমাদের স্বীকার করতে হয়—মানব সভ্যতার বিকাশে মূল্যায়নেরও তারতম্য দেখা দেয়। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মানব-সভ্যতার এ বিকাশে ধর্মীয় মূল্যমানের প্রাধান্য স্বীকৃত হলেও, পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ধর্মীয় মূল্যমানগুলো ক্রমশ যবনিকার অন্তরালে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালীতে রেনেসাঁয় যে সুর ওঠে তার মূল মন্ত্র ছিল—মানুষের পক্ষে মানুষের প্রাধান্য স্বীকার করাই জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পরকালের ধ্যান-ধারণা বা চিন্তা ভাবনার আলোকে মানব-জীবনের বিচার না করে, ইহলোকে মানুষ কিভাবে আত্মমর্যাদা বজায় রেখে-মাথা তুলে সুখে ও স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারে,—তাই হওয়া উচিত মানব-জীবনের সর্বপ্রধান লক্ষ্য। এ মতবাদকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে—মানবতাবাদ। এ মানবতাবাদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যষ্টিকে তার মননের বা গ্রত্যয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে এবং মানুষকে কোন অবস্থায়ই চিন্তার ক্ষেত্রে অপরের দাস রূপে গণ্য করা হবে না। এ আন্দোলনের ফলে–মানুষের চিন্তাধারা পৃথিবীকেন্দ্রিক বা ইহলোককেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। পরলোকে মানুষ বেহেশতে না দোজখে যাবে-সে চিন্তা পরিত্যাগ করে, মানুষ ইহলোকের সুখ দুঃখকেই জীবনের ভাবনা চিন্তার বিষয় বলে গণ্য করে। তার পরিণতিতে মানুষের পাপ পুণ্যের বিচারের জন্যও পরকালের অপেক্ষার কোন প্রয়োজন ছিল না। এ জগতের বুকেও যে তার বিচার হয়, সে নীতি স্বীকার করে বিচারের ক্ষেত্রকে পরকাল থেকে ইহকালে স্থানান্তরিত করা হয়। শেক্সপীয়রের সবগুলো নাটকের নটনটীর পরিণতির মূলে প্রাচীন গ্রীসদেশীয় Poetic justice বা কবিজনোচিত বিচারের নিদর্শন পাওয়া যায়। ভাল, মন্দ, পাপ, পুণ্যের বিচার তখন থেকে আর পরকালের অপেক্ষা রাখেনা এ জগতেই তা হয়ে যায়।

ইউরোপীয় রেনেসাঁ—মানবতাবাদের পরিণতি

পঞ্চদশ শতাব্দীর এ মানবতাবাদ আরও পুষ্টি লাভ করে, যখন বেকন কর্তৃক এ্যারিষ্টটলের ন্যায়শাস্ত্রের নীতিগুলোর পরিবর্তে নব্য ন্যায়শাস্ত্রের পত্তনের জন্য তিনি কতকগুলো canon বা নীতির প্রবর্তন করেন। এ নীতিগুলো আলোকেই পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ড মিল আবোহশাস্ত্রের সূত্রগুলোর সংজ্ঞা দান করেন এবং বৈজ্ঞানিক জগতে কার্যকারণ পরম্পরানীতি সর্বশ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর অপর অবদান হচ্ছে লাপল কর্তৃক সৌরজগতের বিবর্তনের সূত্র আবিষ্কার এবং ডারউইন ও লেমার্ক কতৃক জীব-জগতের বিবর্তনের সূত্রের প্রচার। এতে এ জগতের বুকে পূর্বে প্রচারিত আল্লাহর সৃষ্টির নীতি সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। কেবল আল্লাহর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেই এ সব আবিষ্কারের ফল থেমে যায়নি, পূর্বতন সকল মুল্যমানকেই তা উপহাসের বিষয় বলে অবজ্ঞা করতে প্রস্তুত হয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সিগমুণ্ড ফ্রয়েড তার সর্বকামিতাবাদ প্রচার করে পূর্বতন মানগুলো একেবারে ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। যে মানুষকে একদা সৃষ্টির সেরা জীব বলে সম্মান করা হত, যার মধ্যে প্রেম, করুণা, মুদিতা প্রভৃতি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ এবং যার মধ্যে বিচার বুদ্ধিকে বলা হ’ত সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ন্ত্রক ফ্রয়েড তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, তা’ মোটেই সত্য নয়। তার মতবাদ অনুসারে মানব-জীবনের ভিত্তিমূলে রয়েছে এক মহা বেগবান কামের স্রোত এবং তাই তাকে অন্ধ নিয়তির মত এক পর্যায় থেকে অপর পর্যায়ে অনিবার্য গতিতে ঠেলে নিয়ে চলেছে। এ স্রোত থেকে নিস্তার পাওয়ার তার কোন উপায় নেই। এ স্রোতের আধারও আবার মানবদেহের মধ্যে অবস্থিত নিতান্ত ঘৃণ্য কেন্দ্রগুলো। কাজেই মানুষকে দেবতারূপে ধারণা করার কোন অর্থ নেই। অন্যান্য জীবের মত মানুষও কাম সর্বস্ব জীব। অন্যান্য জীবও মানুষের মধ্যে প্রভেদ শুধুমাত্র এই জায়গায়, পশুরা তাদের কাম বাসনা চরিতার্থ করার জন্য বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয় না, অন্ধ আবেগে তার বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর দিকে ধাবিত হয়। মানুষের জীবনে রয়েছে যুক্তি ও বুদ্ধিজাত নানাবিধ সংকোচ ও প্রতিবোধ। তাই মানুষ যা চায় তাকে অনেক সময়ই প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতে চায় না। কারণ যুক্তির সে সেন্সার (Censor) তাকে এভাবে আত্মপ্রকাশ করতে বাধা দেয়। তবে ঠিক একটা ছাগশিশু যেভাবে তার গর্ভ ধারিণী জননীর প্রতি কামভাব প্রণোদিত আকৃষ্ট হয়, তেমনি মানব-শিশুরাও তাদের পিতামাতার প্রতি আকৃষ্ট হয়।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি—মানব-জীবন সম্বন্ধে পঞ্চদশ শতকের রেনেসাঁয় যে সব ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল, সে যুগের অব্যবহিত পরে বেকন কার্যকারণ পরম্পরা নামক যে নীতির অস্পষ্ট সূত্র প্রচার করেছিলেন, উনবিংশ শতাব্দীতে জন স্টুয়ার্ট মিল-যে নীতি আবিষ্কারের জন্য সুস্পষ্ট সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাতে মানব জীবনে যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখা দিয়েছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীতে লাপলা বা ডারউইন কতৃক বিবর্তনবাদ প্রচার হওয়ার ফলে—মানব জীবন সম্বন্ধে মানুষের ধারণাতে কোন উচ্চ ভাব পোষণ করার অবকাশ থাকেনি। সর্বশেষে ফ্রয়েড প্রকারান্তরে মানুষকে এ জগতের অন্যান্য নানা শ্রেণীর জীব বলেই তাতে তার গৌরবকে সর্বতোভাবে বিনষ্ট করেছেন। অপরদিকে রেনেসার সূচনা থেকে বৈজ্ঞানিক জগতের নানাবিধ আবিষ্কারের ফলে মানুষের পক্ষে স্থান ও কালের ব্যবধানকে লঙ্ঘন করার ক্ষমতা আয়ত্ব হয়েছে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে সমর্থ হয়েছে। এতে এ সত্যই প্রমাণিত হয়, মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ লাভের পক্ষে উপযোগী বৈজ্ঞানিক নীতিগুলোর আবিষ্কার ও প্রচার যতই মানুষের পক্ষে সহজ হচ্ছে, মানব-জীবনকে মানুষ ততই হেয় ও শূন্য বলে ধারণা করতে বাধ্য হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম সম্বন্ধে এ দুনিয়ার মানুষ কী ধারণা পোষণ করে তাই এখানে আলোচ্য।

ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে এ উপমহাদেশ

এশিয়া মহাদেশে বা সমগ্র প্রাচ্যদেশে ইউরোপবাসী বিভিন্ন জাতির লোকেরা শোষণের জন্য উপস্থিত হওয়ার পূর্বে এ উপমহাদেশবাসী তাদের স্বকীয় ধর্মের নানাবিধ প্রত্যয়ে ছিল আস্থাশীল। তারা তাদের পিতৃপিতামহের ধর্ম পালন করেছে। তাদের জীবনে তাদের ধরে সঙ্গে অপরাপর ধরে তুলনামূলক আলোচনা করার কোন প্রবৃত্তি দেখা দেয়নি। এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরে কোন কোন মনীষী হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে একটা সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিলেন। তার মধ্যে রামানন্দ ও কবীরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নানক ও চৈতন্যদেব ইসলামের সাম্যবাদমূলক নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অপর দু’টো ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। এদের মধ্যে কেউই এক ধর্মের আলোকে অপর ধর্মকে সমালোচনা করার চেষ্টা করেননি।

প্রকৃতপক্ষে অন্য ধর্ম বা পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আলোকে সমালোচনা করার প্রবৃত্তির উৎপত্তি হয় এদেশীয় লোকের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার পর থেকে। একথা আজ সর্বজনবিদিত যে ১৮২৭ খৃষ্টাব্দে কোলকাতায় হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠার পরে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এদেশীয় ধর্মগুলোকে সমালোচনা করার প্রবর্তন করেন মহামতি ডিরোজিও। তিনি হিন্দু ধর্মের দেবতাবাদ, অবতারবাদ ও পুনর্জন্মবাদের কঠোর সমালোচনা করতে প্রবৃত্ত হলে হিন্দু ছেলেরা তাদের পিতৃ পিতামহের সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে, কেউ বা খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করে, আবার কেউ বা নাস্তিক হয়ে যায়। এদের এ আচরণকে রোধ করার জন্য রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মকে উপনিষদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে ব্রহ্মবাদ প্রচার করেন। তাঁর পরবর্তী কালে শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হিন্দু ধর্মের সমন্বয়মূলক দিককে হিন্দু যুব সমাজের সামনে তুলে ধরেন।

এক্ষেত্রে বিশেষ প্রনিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই, তখন থেকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে এদেশীয় ধর্মের বিচারের সূচনা হলেও, তা তখন পর্যন্ত এমন কঠোর রূপ গ্রহণ করেনি। নূতন যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের নীতি দ্বারা সমৃদ্ধ ইউরোপের সভ্যতার আলোকে যতই আমাদের সংস্কৃতি সভ্যতার অন্দর মহলে প্রবেশ করতে থাকে, ততই আমাদের জীবনে সমালোচনা করার প্রবৃত্তি কঠোর রূপ ধরে আত্মপ্রকাশ করে।

ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে ভারতীয় মুসলিম

পরাজিত মুসলিমদের পক্ষে, প্রথম দিকে বর্জিত ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্যক পরিচয় হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পরবর্তী কালে, অর্থাৎ এদেশীয় মুসলিমদের চরম বিপর্যয়ের দিনে। ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত যে জাতির জীবনে দেখা দিয়েছিল চরম অভিশাপ, ১৮৫৭ সালের পরাজয়ে তাদের মেরুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। এ দারুণ দুর্যোগের পরে এদেশীয় মুসলিমেরা মিসরে হিজরত করার জন্য প্রস্তুত হয়। এ সংকটে মরহুম স্যার সৈয়দ আহমদ আবির্ভূত হয়ে সিপাহী বিপ্লবের এক অপ্রকৃত ব্যাখ্যা দান করে, মুসলিমদের মনে স্বস্তি এবং মনিবদের মনের আগুন প্রশমিত করেছেন সত্যি, তবে তিনিই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে কুরআন-উল-করীম বা হাদিসের বাণীগুলোর ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক ধারার প্রবর্তন করেন। তাঁরই অনুসরণ করে অধ্যাপক খোদা বখশ বা আল্লামা ইউসুফ আলী সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে ইসলামী শাস্ত্রের আলোচনা ও সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। তার ফলে বিদেশী এবং বিজাতীয় লোকের চোখেই এখন আমরা ইসলামের মর্মবাণী পাঠ করার সাধনা করছি। এ ধারাটি কত মারাত্মক তা’ আলোচনাতেই প্রকট হবে।

ইউরোপ

স্যার সৈয়দ আহমদের চিন্তাধারার সঙ্গে নওয়াব আবদুল লতিফের চিন্তার সামঞ্জস্য থাকায় উভয়ে একত্রে বসে কোলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার এক কামরায় ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিতব্য ‘মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে’র পাঠ্যসূচী তৈরী করেছিলেন। তা’তে নামেমাত্র কুরআন হাদিসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ইউরোপের প্রচারিত জ্ঞানবিজ্ঞানের নানাবিধ বিষয়কে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৮৬৩ সালে নওয়াব আবদুল লতিফ মুসলিমদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য কোলকাতায় Mohemedan Literary Society নামে একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ সমিতিরও মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল-মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত চিন্তাধারার ব্যাপক প্রচার। তাতে অবশ্য কারো কোন আপত্তি থাকতে পারে না। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার ফলে মুসলিম জীবনে যে হীনমন্যতাবোধের সৃষ্টি হয়েছে—তা সত্যিই ভয়াবহ।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের কোন অবদানকে ইউরোপের লোকেরা স্বীকৃতি দান করেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কারলাইল, গিবন প্রমুখ মনীষী হজরত রসুল-ই-আকরামের (সাঃ) ব্যক্তিগত জীবনের ভূয়সী প্রশংসা করলেও ইসলামকে বিশ্বধর্ম বলে স্বীকার করেননি। এঁদের পন্থা অনুসরণ করে ইসলামকে পাঠ করা কালে মুসলিমেরাও এদের দৃষ্টি দিয়ে ইসলাম থেকে পাঠ গ্রহণ করেছেন। এ দেশীয় মুসলিম জীবনে এ জাতীয় চিন্তাধারার স্রোত এখনও প্রবহমান।

এখনও আমরা রেনেসার মানবতাবাদের আলোকে কুরআন-উল-করীমের নানা সুরা ও আয়াতের ব্যাখ্যা করি। ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতার বাণী পঞ্চদশ শতকের রেনেসাঁতে উদাত্ত সুরে ঘোষিত হয়েছে সত্যি, কিন্তু তারও পুর্বে কুরআন-উল-করীমে তা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে।

কুরআন-উল-করীম আল্লাহ ও মানুষের মধ্যবর্তী কোন যাজক বা পুরোহিতের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেনি। এতে ব্যষ্টির সর্বধর্মীয় জীবনে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার নীতি প্রচারিত হয়েছে। কুরআন-উল-করীমের এ নীতি আমরা রেনেসাঁ থেকে পাইনি, পেয়েছি খোদ আল্লাহ থেকে; অথচ রেনেসাঁর সার্টিফিকেট পেয়ে তাকে আমরা সর্বান্তকরণে গ্রহণ করছি।

রেনেসাঁ-পূর্ব যুগে মুসলিম মনীষা

রেনেসাঁ আন্দোলনের দু’শত বৎসর পূর্বে অর্থাৎ খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রজার বেকন (Roger Bacon) মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আল হামরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি মুসলিমদের নিকট থেকে কার্যকারণ পরম্পরা নীতির সূত্র শিক্ষা করে, সর্বপ্রথমে ইংলণ্ডে প্রচার করেন। তাঁরই এ শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) পরবর্তীকালে অবরোহ পদ্ধতিতে জ্ঞান আহরণের জন্য কতকগুলো সূত্র আবিষ্কার করেন। অবরোহ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য কার্যকারণ পরম্পরা সূত্রের আবিষ্কার। এ কার্যকারণ পরম্পরা সূত্র আবিষ্কার করার জন্য কুরআন উল-করীমে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মানুষকে চোখ খুলে এ বিশ্ব জগতের মধ্যে ক্রিয়াশীল নীতির আবিষ্কারের জন্য জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কাজেই কুরআন থেকেই রোজার বেকন এ সূত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন, কুরআন তাঁর কাছ থেকে এ নীতির শিক্ষা গ্রহণ করেনি। উনবিংশ শতাব্দীতে চার্লস ডারউইন জীবজগতে বিবর্তনের সূত্র আবিষ্কার করে এ বিশ্বের চিন্তাধারাতে বিপ্লবের সৃষ্টি করেছেন সত্য, তবে তারও বহু আগে ইবনে মসকাভি দুশম শতাব্দীতে জীবজগতের ক্রমবিকাশের ধারার সূত্র প্রকাশ করেছিলেন। তবে ইসলামী জগতে ক্রমবিকাশের ধারাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কেননা –কুরআন-উল-করীমে সৃষ্টির (Creation out of nothing) উপর জোর দেওয়া হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত এ বিশ্বের সাংস্কৃতিক মহলে বিবর্তনবাদ ছিল অবিসংবাদী সত্য। বর্তমানে তাতে নানা ফাঁক বের হওয়ায়, তাকে আর অভ্রান্ত সত্য বলে গণ্য করা হয় না। তবে বিবর্তনের ধারণার আলোকে ইতিহাস বা সাহিত্য প্রভৃতি কলাবিভাগের সকল শাস্ত্রকেই পাঠ করা হয়। যদি মানবজীবনের সংস্কৃতি ধারা পাঠ করার জন্যও তার প্রয়োজনীয়তা থাকে, তা হলেও এ সুত্রের আবিষ্কারের জন্য ইবনে মসূকাভিকেই প্রশংসার পাত্র বলে গণ্য করতে হয়। অথচ আমরা ইবনে মাভির তত্ত্বকে যাচাই করছি ডারউইনের চিন্তাধারার আলোকে।

ডারউইনের বিবর্তনবাদের পরে এ জগতের সংস্কৃতির ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ মতবাদ প্রচার করেছেন সিগমুণ্ড ফ্রয়েড়। তার সর্বকামিতা বা Pan-Sexualism এখনও সাংস্কৃতিক জগত থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। তবে এ্যাডলারের শক্তির জন্য অদম্য বাসনার অতি আধুনিক নীতির প্রবর্তনে তা যে কিছুটা ম্লান হয়েছে—সে সত্য অস্বীকার করা যায় না। কাম-বাসনার স্থিতি সর্বজনবিদিত। তার সন্তোষবিধানের জন্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে অদম্য আগ্রহ মানুষের মনে রয়েছে—তাও অনস্বীকার্য। ইদিপাসএষণা বা ইলেকট্রাএষণা যে মানব জীবনে কার্যকরী হতে পারে, তাও স্বীকার করতে কোন আপত্তি নেই। তবে কামবাসনার চরিতার্থতার জন্য উৎকট বা অপ্রাকৃতিক পদ্ধতি গ্রহণ মানব-জীবনে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক ব্যাধির সৃষ্টি করতে পারে এবং সমাজের স্বীকৃতি ব্যতীত নারী পুরুষের অবৈধ যৌন সম্মেলনকে ইসলাম গোড়া থেকেই অত্যন্ত গর্হিত কর্ম বলে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে। কাজেই ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের কাম প্রবণতা এমন কোন অভিনব মতবাদ নয়। কাম সর্বস্বতাই (Pan-Sexualism) এক অদ্ভুত ও উৎকট মতবাদ।

এতে এ কথাই প্রমাণিত হচ্ছে বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে ইসলাম প্রচারিত সত্যগুলোকে আমরা যাচাই করতে অভ্যস্থ। এতে যে আমরা কত অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি তার প্রমাণ রয়েছে ইসলাম সম্বন্ধে এ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন মনীষীর মন্তব্যের উদ্বৃতি থেকে। যেহেত মিঃ গিব স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান সার টমাস আরনলড, জর্জ বার্নার্ড শ’ প্রমুখ মনীষী ইসলামের বিভিন্ন দিকের প্রশংসা করেছেন, সেজন্য ইসলাম প্রকৃতপক্ষে এটা সত্যিকার ধর্ম এতে যে হীনমন্যতাবোধ প্রকাশ পাচ্ছে, তা অতি সহজেই বুঝতে পারা যায়। অথচ এ সব মন্তব্যের মধ্যে যা প্রকাশিত হচ্ছে তাতে ইসলামের এক একটা আংশিক রূপের সুখ্যাতি কীর্তন করা হচ্ছে। তাতে ইসলামের সুখ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে তার সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণারও সৃষ্টি হতে পারে।

আমাদের বিচারের পদ্ধতি : তার অসঙ্গতি

কোন ব্যক্তি, সমাজ, ধর্ম বা মতবাদের আলোচনাতে সব সময়ই কোন না কোন মানদণ্ডের আলোকে বিচার করা হয়। মানব জীবনের আলোচনাকালেও একটা মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়। সে মানদণ্ড মানুষ অন্য কোন উৎস থেকে সংগ্রহ করে না, তার নিজের জীবন থেকেই গ্রহণ করে। অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricists) তার জীবনের মধ্যে পঞ্চেন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে জ্ঞানের একমাত্র সত্যিকার রূপ বলে গ্রহণ করে, তারই আলোকে মানবজ্ঞানের বিভিন্ন রূপ ও পর্যায়ের আলোচনা করেন। তেমন যুক্তিবাদী, যুক্তির ক্ষমতাকে মানব-জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবৃত্তি বলে গণনা করে-তারই আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরের বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করেন।

এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রনিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে মানব-জীবনের সত্যিকার রূপের উদ্ঘাটন এবং তারই আলোকে ইসলাম তথা অন্যান্য ধর্ম, দর্শনবিজ্ঞান বা সংস্কৃতির মূল্য নির্ধারণ। মানব-জীবনের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে নানাবিধ বৃত্তি ও প্রবৃত্তি এবং মানব-জীবনে সেগুলোর সন্তোষ বিধানের জন্য অনিবার্য প্রচেষ্টা। সেগুলোর সন্তোষ বিধানের জন্য মানুষের পক্ষে এমন সব কাজ করতে হবে যাতে এসব বৃত্তি বা প্রবৃত্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব না দেখা যায় এবং জীবনের ভারসাম্য বিনষ্ট না হয়। মানুষের প্রকৃত স্বরূপের আলোকে তাকে বিচার করলে দেখা যাবে—মানুষ যেমন শুধুমাত্র উদর-সর্বস্ব নয়, তেমনি শুধুমাত্র কাম সর্বস্বও নয়। মানুষের জীবনে এ সব বৃত্তি ক্রিয়াশীল রয়েছে সত্যি, তবে এগুলো ব্যতীত আরও নানাবিধ বৃত্তি রয়েছে—যেগুলোর সন্তোষ বিধানও তার পক্ষে অবশ্য কর্তব্য।

এসব বৃত্তি বা প্রবৃত্তিগুলোকে শুধুমাত্র একটা বৃত্তির বিভিন্ন রূপ বলে প্রকাশ করা এবং সবগুলোকে একই বৃত্তির মধ্যে ঢালাই করে নেয়া—বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটা রূপ। তবে এ পদ্ধতিতে একটা মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। এতে যে ঐক্যের নীতির আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়, তার ফলে মানুষের মনে এ ধারণাই বদ্ধমূল হয় যে এ ব্যাখ্যার সূত্র বা নীতিই বুঝি এ জীবনে বা জগতে একমাত্র কার্যকরী। এজন্য এ জড় জগতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জড়বাদীরা যখন কেবলমাত্র পরমাণুর অস্তিত্বের দ্বারা তার উৎপত্তি ও বিকাশের ধারা প্রদর্শন করতে চান, তখন রূপ-রস-গন্ধে ভরা এ পৃথিবীর নানাবিধ গুণাবলীকে হয় অস্বীকার করতে হয়, না হয় তাদের উৎপত্তির জন্য এ প্রাণহীন জড় অণু ও পরমাণুর অভ্যন্তরে তাদের অস্তিত্ব বর্তমান বলে স্বীকার করতে হয়, না হয় তাদের আবির্ভাবকে আকস্মিক অ্যুদয় বলে গণ্য করতে হয়। বর্তমান কালে দার্শনিক মহলে এ জন্য জড়বাদ শব্দের পরিবর্তে প্রকৃতিবাদ (Naturalism) শব্দটিই অধিকতর ব্যবহৃত হচ্ছে।

মানব-জীবনে জড় ও চৈতন্যের লীলাখেলা চলছে আদি থেকেই। এতে বুদ্ধির কলাকৌশলও দেখা দিয়েছে সুদূর অতীত থেকেই, এ বুদ্ধির দওলতেই মানুষ এ বিশ্বে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করছে। তবে এ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সে তার নিজের আবিষ্কারেরও দাসে পরিণত হচ্ছে। পরমাণুতত্ত্ব আবিষ্কারের ফলে মানুষ এ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কত দ্রুত গতিতে গমনাগমন করে। বৈদ্যুতিক শক্তির ক্রিয়াশীলতা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে তাকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে কত সহজভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছে। তবে এ সব শক্তির আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছে চরম অভিশাপ। মানুষের উন্নতি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য এ সব শক্তি যেমন ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনি মানুষের ধ্বংসের জন্যও তা ব্যবহৃত হতে পারে। আবিষ্কৃত শক্তিগুলোর মধ্যে এমন কোন বিধি নিষেধ নেই যাতে সেগুলো কেবলমাত্র মানুষের কল্যাণের জন্যই ব্যবহৃত হবে। এ জন্য জগত সভ্যতায় দেখা দিয়েছে এক মহা সংকট। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ যতই অগ্রসর হচ্ছে মানব জীবনের পক্ষে ততই দেখা দিচ্ছে ভয় ও ভীতি। মানুষের নিজের আবিষ্কারের ফলগুলোই মানব-সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। মানব সভ্যতার এ সংকটের মূলে কোন কারণ বর্তমান ? তার মূলে রয়েছে—মানব জীবন সম্বন্ধে পুর্ণ ধারণার অভাব। মানুষকে শুধুমাত্র বুদ্ধিপ্রধান জীব বলে ধারণা করে তার নৈতিক দিক সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মানুষ তার জীবনে এবংবিধ অভিশাপকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এ জন্য আজকে মানবতার নামে দোহাই দিয়ে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য, পরলোকগত মহাবিজ্ঞানী আইনস্টইন, মহাদার্শনিক বাট্রাণ্ড রাসেল প্রমুখ মানব-প্রেমিক মহামানব আহ্বান জানিয়েছেন।

ইসলামী বিচারের বিশেষত্ব

ইসলামের বিশেষত্ব রয়েছে এখানেই। ইসলাম মানুষকে তার সত্যিকার রূপেই দেখেছে। তার কোন আংশিক রূপকে তার সামগ্রিক রূপ বলে ধারণা করে—তার এক বিমূর্ত রূপকে তার সর্বাত্মক রূপ বলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোন চেষ্টা করেনি। মানব-দেহ বা মানব-মানসে যে বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ বা নানাবিধ বৃত্তি ও প্রবৃত্তি রয়েছে—তাকে স্বচ্ছন্দ মনে গ্রহণ করে, মানব-জীবনে তাদের যথাযথ কার্যকারিতার নির্দেশ দিয়েছে। এ সব বৃত্তি ও প্রবৃত্তির ক্রিয়াশীলতা ব্যতীত মানব-জীবনে নৈতিক নির্দেশ বলে যে আরও একটা দিক রয়েছে—ইসলাম গোড়াতেই তা স্বীকার করে বুদ্ধির সঙ্গে বোধির এবং বুদ্ধির আবিষ্কারের সঙ্গে নৈতিক নির্দেশের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। এ জন্য ইসলামী জীবনধারাতে বুদ্ধির সঙ্গে নৈতিক জীবনের কোন সংঘর্ষ হওয়ার উপায় নেই।

আধুনিক জগতে যে সব আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক জগতে সম্ভব হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ বিকশিত না হওয়ায়, যে কোন সময়ে সে আবিষ্কারের অপব্যবহার হয়ে জগত সভ্যতা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে। তাই ইসলামী মূল্যবোধকে গ্রহণ করা কেবল মুসলিমদের জন্যই প্রয়োজনীয় নয় এ জগতের সকল মানুষের জন্যেও প্রয়োজনীয় এ জগতে। যে কেবল পরমাণু শক্তিরই খেলা চলেছে—এ তত্ত্বটি সর্বাঙ্গসুন্দর নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে এ জগতে এমন একটা নৈতিক শাসন (Moral order) রয়েছে— যার বিরুদ্ধে বললে মানব-জীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এ-রূপ নীতিরও স্বীকৃতির প্রয়োজন। সে নীতির প্রকাশ চাক্ষুষ না হলেও তার অস্বীকৃতিতে মানব জীবনে নানা অভিশাপ দেখা দিতে পারে। এতত্ত্বটি ইসলাম তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই স্বীকার করে নিয়েছে।

ইসলামী জীবনদর্শনকে তাই কেবলমাত্র রেনেসাঁজাত মানবতাবাদের একরূপ, বেকন কর্তৃক আবিষ্কৃত কার্যকারণ পরম্পরা সূত্রের রূপ, ডারউইন কতৃক আবিষ্কৃত বিবর্তনবাদের অথবা ফ্রয়েডকৃত সর্বকামিতার সমর্থক এক মতবাদ বললে সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ হবে। যেভাবে একজন জীবন্ত মানুষের বর্ণনা প্রসঙ্গে যদি বলা হয়—সে একখানা হাত বা একখানা পা সেভাবে এরূপ এক একটা বিমূর্ত সূত্রের আলোকে ইসলামকে বিচার করা তার প্রতি সম্পূর্ণ অবিচার করা হবে। ইসলাম হচ্ছে জীবন্ত মানুষের জীবনের পক্ষে একটা জীবন্ত ব্যবস্থা—তাতে মানব-জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় সবগুলো নীতির নির্দেশ রয়েছে। তাকে এক একটা দিক থেকে বিচার করলে—অন্ধের হাতি দেখার মত তার প্রতি অবিচার হবে। এ প্রসঙ্গে বর্তমান কালের রাজনীতিতে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে সে সম্বন্ধে আলোচনা করলেও দেখা যায়, মানুষ সম্বন্ধে অপূর্ণ ধারণার জন্যই এসব পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের উৎপত্তি হয়েছে। পুজিবাদে মানুষকে গ্রহণ করা হয়েছে সম্পূর্ণ একক স্বার্থপর জীব হিসাবে। আবার সমাজতন্ত্রবাদে তাকে গ্রহণ করা হয়েছে শুধুমাত্র সামাজিক জীব হিসাবে। এ দুটো ধারণাই সম্পূর্ণ অমূর্ত (Abstract)। মানুষ শুধুমাত্র স্বার্থপর জীব নয় এবং কেবলমাত্র পরার্থপর সামাজিক জীবও নয়। মানুষের জীবনে এ দু’টো পরস্পর বিরোধী বৃত্তির অস্তিত্ব রয়েছে বর্তমান। এ উভয় বৃত্তির সন্তোষ বিধানের জন্য তার জীবনকে এমনভাবে পরিচালনা করা দরকার, যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক উন্নতি বিধানের জন্যও সে প্রস্তুত হতে পারে। জীবন প্রভাতেই তার মনে এমন সব ধারণা বদ্ধমূল করতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে সামাজিক স্বার্থ অক্ষুন্ন না থাকলে—তার ব্যক্তিগত স্বার্থ বজায় রাখা সম্ভবপর নয় এবং তাকে এমন শিক্ষা দিতে হবে—যাতে সে বুঝতে পারে মানুষের জন্যই সমাজব্যবস্থা—সমাজের মঙ্গল ব্যক্তি বিশেষের মঙ্গলের পরিপন্থী নয়। ইসলামী জীবনদর্শন মানব-জীবনকে পুর্ণাঙ্গ দৃষ্টিতে দেখা হয় বলে—মানুষের জীবনে—পুজিবাদী মনোবৃত্তির সঙ্গে সমাজতন্ত্রবাদী মনোভাবের সংঘর্ষ দেখা দেয় না। তাই আজকের এই সংঘর্ষময় জীবনে ইসলাম থেকেই পাঠ গ্রহণ করে রাজনীতিতে এ দ্বন্দ্ববহুল সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। পুজিবাদের জয়যাত্রার দিনে ইসলামকে পুজিবাদের সমর্থক এবং বর্তমান জগতে সমাজতন্ত্রবাদের জয়যাত্রার দিনে সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থক বলে ইসলামকে প্রদর্শন করলে, ইসলামের অবমাননা করা হবে। পুজিবাদের ‘নীতির সমর্থক এ্যাডাম স্মিথ অথবা সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থক মার্কস ও এঙ্গেলস—ইসলামেরই দু’টো দিকের বিশদ আলোচনা করে তাদের দ্বারা সমর্থিত দিকগুলোকে মানব-জীবনের একমাত্র দিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রেও অন্ধের হাতি দেখার মত এক একটা দিককে মানব-জীবনের সম্পূর্ণ দিক বলে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা মানব-জীবনের বিকৃত রূপই প্রকাশ করেছেন। তাই আজকের দিনের মানবতাবাদী মানুষের পক্ষে ইসলাম থেকেই নীতি গ্রহণ করে এ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক মতবাদ যে মানুষের সম্বন্ধে আমাদের মৌলিক ধারণা দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছে সে সম্বন্ধে আমরা মোটেই ওয়াকিবহাল নই।

এ্যাডাম স্মিথের (Adam Smith) পুঁজিবাদের মৌলিক সূত্র হচ্ছে—মানুষ স্বার্থপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী জীব। তার কাছে নিজের স্বার্থই একমাত্র কাম্য। অন্যের স্বার্থকে সে স্বীকার করতে চায় না। তাই তাকে উপার্জন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। এ্যাডাম স্মিথের (Adam Smith) মতবাদ ‘ব্যষ্টিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাও’ বা Laissaz faire এর মূলে ব্যষ্টিজীবনের মূলে স্বার্থপরতার সে নীতিই রয়েছে কার্যকরী। তাই স্বীকার করা হয়েছে। তা’ না হলে তিনি উপার্জনের বা বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যষ্টির এরূপ স্বাধীনতার জন্য ওকালতি করতেন না। এ মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ যে মোটেই সত্য নয়—তার প্রমাণ-ব্যষ্টি-জীবনে অপত্য-স্নেহের প্রবল ক্রিয়াশীলতা, সন্তানের মঙ্গলের জন্য পিতামাতা অনেক সময় আপনাদের প্রাণ-বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত হয়। দেশের ও দশের মঙ্গলের জন্য যুগে যুগে কত মহামানব তাদের জীবন-উৎসর্গ করেছেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য অসত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে রয়েছেন। এঁদের কাছে আত্ম থেকে আদর্শ ছিল অনেক বড়, সুখের থেকে সত্য প্রতিষ্ঠার দাবী ছিল অনেক বড়। কাজেই মানুষের আদিতে কেবলমাত্র আত্মসুখ বা আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের প্রবৃত্তিই বর্তমান এ কথা বলার কোন অর্থ হয় না এবং এ মতবাদের ভিত্তিতে এক অর্থনৈতিক দর্শন গঠন করা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।

অপরদিকে সমাজকে মানব-জীবনের আদিসংখ্যা বলে গণনা করার মুলে রয়েছে মানুষ সম্বন্ধে তেমনি এক একদেশদর্শী মনোভাব। মানুষকে সর্বদাই নিজের জন্য চিন্তাভাবনা পরিত্যাগ করে—সমাজের জন্যই চিন্তা করতে হবে—এরূপ নৈতিক বিধানের মূলে রয়েছে—মানব জীবনে পরার্থপরতা (Alternistic instinct) নামক সহজাত বৃত্তিই একমাত্র ক্রিয়াশীল বলে অযথা স্বীকৃতি। যদি এ বৃত্তির ক্রিয়াশীলতা স্বীকার না করা যায় তাহলে মানুষকে পরার্থপর হয়ে সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য প্রস্তুত হতে হবে বলে নির্দেশ দান, নিতান্তই হাস্যকর ব্যাপার। মানুষের সহজাত বৃত্তির মধ্যে বা তার স্বভাবের মধ্যে এরূপ কোন প্রবৃত্তির অস্তিত্বও ক্রিয়াশীলতা না থাকলে—তার স্বভাবের বিরুদ্ধে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দান অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার। মহাজ্ঞানী ক্যান্ট তার নৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠার পূর্বে বলেছিলেন—Thou oughtest therefore thou Caust. তোমার পক্ষে কোন কাজ করা উচিত বলার অর্থ তা সম্পাদন করার তোমার ক্ষমতা রয়েছে।

সমাজকে আদি সংখ্যারূপে গণনা করে যখন বলা হয়—তোমার পক্ষে সর্বদাই সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে গণ্য করে সমাজসেবা করা উচিত —তখন পরোক্ষে এতে এ সত্যটিই স্বীকার করা হয়—তোমার স্বভাবের মধ্যে এরূপ প্রবৃত্তি বর্তমান। এরূপ প্রবৃত্তি যে বর্তমান–তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের স্বভাবে কি একমাত্র এরূপ প্রবৃত্তিই বর্তমান? অন্য কোন প্রবৃত্তি নেই? সেখানে কি স্বার্থপরতার বীজ নেই? সেখানে কি আত্মপ্রতিষ্ঠার বীজ নেই ? কাজেই একটি মাত্র বৃত্তিকে মানুষের সমগ্র রূপ বলে ধারণা করে অন্ধের হাতি দেখার মত যে উদ্ভট মতবাদের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, তার ফলেই এ দুনিয়ায় দেখা দিচ্ছে যত দ্বন্দ্ব কোলাহল।

অতি আধুনিক দ্বন্দ্বের নিরসন

তাই এ দ্বন্দ্ব কোলাহল থেকে মানব-সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে পূর্ণ মানুষ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভের দরকার এবং তারই আলোকে মানব-জীবনের রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি সম্বন্ধে মতবাদ গঠন করা উচিত। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে তাই মানুষকে পূর্ণাঙ্গ রূপে পাঠ করার রয়েছে সাধনা। এক্ষেত্রে আধুনিক যুগে ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে কর্মক্ষেত্রে যে দু’জন মনীষী অগ্রসর হয়েছেন তারা বাস্তবিকই সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক, এইচ, জি, ওয়েলস তাঁর The Fate of the Homo sapiens নামক পুস্তকে জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতিকে একত্র সংযুক্ত করে Ecology বলে একটা বিজ্ঞানের সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তাতে জৈব-প্রয়োজনে কিভাবে মানুষের জীবনে অর্থনীতির সৃষ্টি হয়—তা’ প্রদর্শন করেছেন। তবে এতে মনোবিজ্ঞানের কোন সূত্রের উল্লেখ করেননি। তেমনি বাট্রাণ্ড রাসেল পদার্থ বিদ্যা ও মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানের একত্র সমাবেশ করে একটি নুতন বিজ্ঞানের সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। এগুলো ইসলামী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এক একটা পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। কারণ ইসলামী দৃষ্টিতে এগুলো হচ্ছে মানব-জীবনের এক একটা দিক। ভবিষ্যতের বিজ্ঞানে সামগ্রিকভাবে মানব-জীকে পাঠ করার জন্য একটা সামগ্রিক বিজ্ঞান গড়ে উঠবে—যাতে সুদূর ভবিষ্যতে মানুষের এক রূপের সঙ্গে অন্য রূপের কোন সংঘর্ষ দেখা না দেয়—তাই হবে মানব-জীবনের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ। ইসলামী দৃষ্টিতে তাই হবে মানব-জীবনের সর্বাঙ্গসুন্দর নীতি এবং তারই আলোকে বিশ্ব-সভ্যতায় দেখা দেবে শান্তি, প্রেম ও আনন্দ।

মূল পিডিএফ বইটি ডাউনলোড করতে চাইলে

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88