কুচক্রের পরিণতি
যে সময় সারা দুনিয়া অগণিত ছোট বড় রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং রাজা বাদশাহ দ্বারা দেশ শাসিত হ’ত, সে সময়ের একটি কাহিনী।
এক রাজা একদিন অতি চিন্তিত মনে রাজদরবারে বসে আছেন। এ সময়ে উযীর তাঁর মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, রাজা চিন্তায় বিভোর। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রাজা মশায়! আপনি মনে হয় কিছু চিন্তা করছেন? রাজা বললেন, আপনার অনুমান সঠিক। আমার বিবাহিত জীবনের বার বছর কেটে গেল, অথচ আমার কোন সন্তান হ’ল না। এত বড় একটি রাজ্য, এর উত্তরাধিকার নেই। আমার অনুপস্থিতিতে রাজ্যটির অবস্থা কী হবে? এ চিন্তায় আমি মুষড়ে পড়েছি। আমার স্ত্রী সম্ভবত আর সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। আমি আমার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসি। তাই আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতেও অনিচ্ছুক।
উযীর বললেন, আপনার এত বড় রাজ্য, একজন উত্তরাধিকারের অভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, এটা তো হ’তে দেওয়া যায় না! তাই আমি আপনাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে অনুরোধ করছি এবং এটা রাজ্যের জন্য মঙ্গলজনকও বটে। অনুমতি পেলে আমি আপনার জন্য অতিসত্বর একজন উপযুক্ত পাত্রী নির্বাচন করতে পারি।
রাজা বললেন, পাত্রী আমার নির্বাচন করাই আছে। তবে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছি। কেননা এ কাজে আমার স্ত্রীর প্ৰতি ভালবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সম্ভবত স্ত্রীরও সম্মতি পাব না। কেননা নারীরা সতিন চায় না। তারা স্বামীকে একান্ত আপন করে নিতে চায়। আর আমার নির্বাচিত পাত্রীটি হচ্ছে আপনারই মেয়ে।
রাজার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সময় একদিন অচেনা এক ফকীর এসে রাণীর নিকট খাবার চাইল। ফকীরের সারা দেহ ঘায়ে ভরা, সে ঘা হ’তে দুৰ্গন্ধও ছড়াচ্ছে। রাণী তাকে পেট পুরে খাওয়ালেন। ফকীর খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে দোআ করল, “হে আল্লাহ! তুমি রাণীমাকে অতি সত্বর একটি পুত্র সন্তান দান কর’। দোআ করার কিছুক্ষণ পরেই ফকীরকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আল্লাহ পাক ফকীরের দো’আ কবুল করেছেন। রাণীমা সন্তান সম্ভবা হয়েছেন।
উযীরের যুক্তি ও পরামর্শে রাজা বিয়ে করতে স্থির সংকল্প করেছে। বিয়ের দিন-তারিখও ধার্য হয়েছে। বিয়ের কথা জানতে পেরে রাণীমা রাজাকে বললেন, আপনি এ বিয়ে বাতিল করুন। আল্লাহ পাকের অশেষ দয়াতে আমি সন্তান সম্ভবা হয়েছি। অন্ততঃ কিছুদিন ছবর করুন। উযীর রাণীর কথা শুনে বললেন, বিয়ে বাঞ্চাল করতে রাণীমার এটি একটি কৌশল মাত্র । কারণ বার বছর যার সন্তান হয়নি, দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে তার গর্ভে সন্তান এসেছে, এটা হ’তে পারে না। উযীরের নিজ কন্যার সাথে রাজার বিয়ে হবে, এতে তিনি গড়িমসি করতে পারেন না। তাই তিনি রাণীর কথায় কান না দিতে রাজাকে প্ররোচিত করলেন।
রাজার দ্বিতীয় বিয়ে হয়ে গেল। দ্বিতীয় স্ত্রীই এখন রাজার হৃদয়মন জয় করে ফেলেছে। তার যে কোন কথাই এখন রাজার শিরধার্য। সে যখন বুঝতে পারল, রাণী সত্যি সত্যিই সন্তান সম্ভবা, তখন সে এক চাল চালল। সে সঠিকভাবে বুঝেছিল যে, রাণীর সন্তান হ’লে রাজার সমুদয় ভালবাসা তার প্রতি অৰ্পিত হবে। তাই সে রাণী সম্বন্ধে রাজার নিকট অপবাদ দিল। বলল, যেদিন আপনি শিকার করতে গেছেন, ঐদিন আমি তাকে সেনাপতির সাথে গোপনে কথা বলতে দেখেছি। একথা শুনামাত্র রাজা একেবারে অগ্নিশৰ্মা হয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ সেনাপতিকে তলব করতে চাইলেন। উযীর কন্যা বলল, আপনি একাজ না করে রাণীকে নির্বাসন দিন। সেনাপতিকে ক্ষেপিয়ে কাজ নেই। রাজা বুঝলেন যে, উযীর কন্যার কথা উযীরের মতই। তাই তিনি তার পরামর্শ গ্ৰহণ করলেন।
রাজা এক রক্ষীকে দিয়ে রাণীকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন। দুই রাজ্য সীমানা দিয়ে এক নদী প্রবাহিত। রক্ষী তাকে নদী তীরের এক বনভূমিতে রেখে ফিরছে। রাণী রাজাকে তার গর্ভবতী হওয়ার সংবাদ দিতে রক্ষীকে অনুরোধ জানান। রক্ষী রাণীকে বনবাস দেওয়ায় রাণীর নিকট ক্ষমা চাইল। সে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, আমাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একাজ করতে হয়েছে। আমরা হুকুমের দাস।। হুকুম অমান্য করলে আমাদের গর্দান যাবে। রক্ষী রাজাকে সংবাদ দিতে অঙ্গীকার করল।
রাণী নির্বাসিত হয়ে করুণ কান্নায় আল্লাহর নিকট আবেদন-নিবেদন করছিলেন। এমন সময় নদী পথে এক সওদাগর যাচ্ছিলেন। নারীর কান্না শুনে তিনি নৌকা ভিড়িয়ে তীরে নামলেন। দেখলেন, এক পরমা সুন্দরী নারী ক্ৰন্দন করছে। তাকে ক্ৰন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে রাণী সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। রাণী বললেন, আপনি আমার প্রতি দয়া করুন ভাই! আমাকে আশ্রয় দিলে আল্লাহ। আপনার প্রতি খুশী হবেন। আমি একজন গর্ভবতী নারী।
সওদাগর লোকটি একটু বয়সী ছিলেন। তাঁর কোন বোন ছিল না। রাণীর ভাই ডাকে তিনি খুশী হ’লেন। তিনি রাণীকে উপযুক্ত আশ্রয় দিলেন। যথাসময়ে রাণী একটি সুদৰ্শন পুত্ৰ সন্তান প্রসব করলেন। সন্তানের নাম রাখলেন আলম। সে ঐ আশ্রয়ে থেকেই বড় হ’তে লাগল।
এদিকে, রক্ষী রাজাকে রাণীর সন্তান সম্ভবার সংবাদ দিলেন এবং কোন সূত্রে দ্বিতীয় রাণীর চক্রান্তও রাজার নিকট প্রকাশিত হ’ল। রাজা এর যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে দৃঢ়চিত্ত হ’লেন। সেনাপতি পালিয়ে যেতে চাইল। দ্বিতীয় রাণী তাকে বলল, তুমি নাকি সেনাপতি? তুমি একজন কাপুরুষ! একা তুমিই এ রাজ্যের সর্বেসর্বা হ’তে পারো, প্রয়োজন কেবল বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করা। প্রথমতঃ তুমি তোমার সৈন্যদেরকে হাত কর। এরপর প্রজাদেরকে অধিকহারে খাজনা প্রদানের ঘোষণা দিয়ে ক্ষেপিয়ে তোল। তারপর রাজাকে বন্দী করে প্রজাদের জানিয়ে দাও, রাজার ঘোষণা অনুযায়ী খাজনা দিতে হবে না। এখন থেকে অর্ধেক খাজনা গ্ৰহণ করা হবে।
যে পুরুষ বা নারী অন্যের নামে অপবাদ দেয়, সে নারী বা পুরুষ সচ্চরিত্রের হয় না। এ নারীও তাই। রাজাকে বাদ দিয়ে তার মনোরাজ্যে এখন সেনাপতিই আসন করেছে। উযীর কন্যার পরামর্শ মোতাবেকই সেনাপতি কাজ করে চলেছে। রাজাকে বন্দী করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সাব্যস্ত হয়েছে। এদিকে যে রক্ষী রাণীকে নির্বাসন দিয়ে এসেছিল, সে-ই রাতের অন্ধকারে রাজাকে বন্দীশালা হ’তে উদ্ধার করে যেখানে রাণীকে নির্বাসন দিয়ে এসেছিল, সেখানে রেখে এল।
ভাগ্য যখন প্ৰসন্ন হয়, তখন বিপদ আপনা। আপনি কেটে যায়। তাই রাজা ঘুরতে ঘুরতে রাণীর আশ্রিত স্থানে এসে পৌঁছলেন। রাজারাণীর সাক্ষাৎ হ’ল। উভয়ে তখন পুনর্মিলন সুখের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রাণী ছেলেকে পিতার সাথে পরিচয় করে দিলেন। রাজা ছেলেকে বুকে তুলে নিলেন।
রাজা লোক মারফত গোপনে নিজ রাজ্যের লোকদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখলেন। এ রাজ্যের রাজার সহায়তায় অতি সহজেই রাজা নিজ রাজ্য ফিরে পেলেন। কারণ তিন ব্যক্তি ছাড়া সবাই রাজার প্রতি আনুগত্যশীল ছিল। সেনাপতি, উযীর ও উযীর কন্যা। অবশেষে তারা ধৃত হয়ে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হ’ল। কুচক্রীদের পরিণাম এরূপই হয়ে থাকে।
রচনায়ঃ আতাউর রহমান, সন্ন্যাসবাড়ী, বান্দাইখাড়া, নওগাঁ।