গাজা থেকে চিঠি
মূল রচনা: ঘাসান কানাফানি
অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রিয় মুস্তাফা,
এক্ষুনি তোর চিঠি পেলুম, তাতে তুই আমায় লিখেছিস যে স্যাক্রামেন্টোয় তোর ওখানে থাকবার জন্যে যা-যা করা জরুরি ছিল, সব তুই করে ফেলেছিস। আমি এই খবরও পেয়েছি যে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইনজিনিয়ারিং বিভাগে আমাকে নেয়া হয়েছে। তুই আমার জন্যে যা করেছিস, দোস্ত, সবকিছুর জন্যে তোকে ধন্যবাদ শুকরিয়া।
তবে এটা নিশ্চয়ই তোর কাছে একটু অদ্ভুত ঠেকবে যখন আমি এ খবরটা তোকে দেব- আর এ নিয়ে আমার মধ্যে কিন্তু কোনো দ্বিধা নেই, সত্যি-বলতে আমি নিশ্চিত বলতে পারি এখন আমি যেভাবে সবকিছু দেখছি এত স্বচ্ছ প্রাঞ্জলভাবে, এত স্পষ্ট করে, আগে আমি কিছুই দেখিনি। না দোস্ত, আমি আমার মত পালটেছি। আমি তোকে অনুসরণ করে সেই দেশে যাব না, যে দেশ শ্যামল, সজল আর সুশ্রী সুন্দর সব মুখে ভরা’- যেমন তুই লিখেছিস। না, আমি এখানেই থাকব- এবং কোনোদিন এ দেশ ছেড়ে যাব না।
আমি কিন্তু সত্যি বড্ড অস্বস্তিতে আছি, মুস্তাফা – আমাদের জীবন আর কখনোই এক খাতে বয়ে যাবে না। অস্বস্তির কারণ, আমি যেন শুনতে পাচ্ছি তুই আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছিস- কী রে, আমরা না কথা দিয়েছিলুম সব সময় এক সঙ্গে থাকব, যেমন আমরা চিরকাল এক সাথে বলে উঠতাম : ‘আমরা বড়লোক হবই! আমাদের অনেক টাকা হবে!’ কিন্তু দোস্ত, কিছুই আর আমার করার নেই। হ্যাঁ, আমার এখনো সেদিনটা মনে পড়ে যেদিন কায়রোর হাওয়াই আড্ডার হলে দাঁড়িয়ে আমি তোর হাত চেপে ধরেছিলুম, তাকিয়েছিলুম ক্ষিপ্ত মোটরটার ঘূর্ণির দিকে। কান-ফাটানো মোটরের আওয়াজে সময়ের মধ্যে সেই মুহূর্তে সবকিছুই ঘুরে যাচ্ছে, আর তুই দাঁড়িয়ে আছিস আমার সামনে, তোর সুগোল মুখখানা স্তব্ধ।
গাজার শাজিয়া মহল্লায় তুই যখন বড় হচ্ছিলি, তখন যেমন ছিল তা থেকে একতিলও বদলায়নি তোর মুখ— শুধু কতগুলি ক্ষীণ ভাঁজ পড়েছে চোখের পাশে। আমরা দু’জনে এক সঙ্গেই বড় হয়েছি, মুস্তাফা পরস্পরকে আমরা পুরোপুরি বুঝি, আর আমরা পরস্পরকে জবানও দিয়েছিলুম যে শেষ অবধি দু’জনে এক সঙ্গেই যাব। কিন্তু …
‘হাওয়াই জাহাজ ছাড়বার আগে আরো পনের মিনিট সময় আছে হাতে। অমনভাবে হাঁ করে আকাশে তাকিয়ে থাকিস না। শোন। পরের বছর তুই কুয়েত যাবি, মাইনে যা পাবি তা থেকে যথেষ্ট টাকা বাঁচাতে পারবি, গাজার মাটি থেকে শেকড় ওপড়াতে তা-ই যথেষ্ট, তারপর ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে নতুন করে শেকড় পুঁতবি। আমরা এক সঙ্গে সব শুরু করেছি, আর এক সঙ্গেই চালিয়ে যেতে হবে আমাদের…’
সেই মুহূর্তে আমি তোর ঠোঁটের দ্রুত নড়াচড়া দেখছিলুম, মুস্তাফা। তোর কথা বলবার ধরনটাই ছিল ও-রকম, দাড়ি-কমা বাদ দিয়ে হড়বড় করে তোড়ে বলে চলা।
কিন্তু আবছাভাবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তোর এই পালানোতে তুই পুরোপুরি সুখী নোস। পালাবার তিনটে ভালো কারণ তুই দেখাতে পারিসনি। আমিও সর্বক্ষণ এই আক্ষেপে ভুগেছি, কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্ট চিন্তাটা ছিল :
এই গাজাকে ছেড়ে রেখে সবাই মিলে পালিয়ে যাই না কেন আমরা? কেন যাই না/ কেন পারি না?
তোর অবস্থা অবিশ্যি ভালো হতে শুরু করেছিল। কুয়েতের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তোকে কন্ট্র্যাক্ট দিয়েছিল, যদিও আমাকে দেয়নি। যে-দুরবস্থার দাবনার মধ্যে আমি গড়াগড়ি যাচ্ছিলুম, সেটা যেন আর পালটাবেই না। তুই মাঝে-মাঝে আমাকে কিছু টাকা পাঠাতিস। তুই চেয়েছিলি আমি যেন ঋণ হিসেবেই তাকে গ্রহণ করি, কারণ তোর ভয় ছিল নইলে আমি অপমানিত বোধ করব। আমার বাড়ির হালচাল তো তুই ভেতরে-বাইরে আগাপাশতলা জানতিস। তুই জানতিস যে স্কুলের চাকরিতে আমি যে সামান্য মাইনে পেতুম, তাতে আমার আম্মা, আমার ভাবি- দাদার বিধবা স্ত্রী, আর তার ছেলেমেয়ে সমেত সংসারটা চালানোই অসম্ভব ছিল।
‘ভালো করে শোন। রোজ আমাকে চিঠি লিখবি… প্রতি ঘণ্টায়… প্রতি মিনিটে বিমান ছেড়ে দিচ্ছে। চলি। খোদা হাফিজ। কিংবা ফির মিলুঙ্গা’।
তোর ঠাণ্ডা হিম ঠোঁট দুটো আলতো ছুঁয়ে গেল আমার গাল, ভুই তোর মুখ ফিরিয়ে নিলি আমার দিক থেকে, হাওয়াই জাহাজের দিকে তাকালি— পরে ফের যখন আমার দিকে তাকিয়েছিলি তখন তোর চোখে টলমল করছিল পানি।
পরে কুয়েতের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাকেও কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল। তোর কাছে ফিরে আওড়াবার দরকার নেই আমার জীবন কেমন কাটছিল, কী ছিল সব খুঁটিনাটি। আমি তোকে সবকিছু জানিয়েই চিঠি লিখতুম। সেখানে আমার বেঁচে থাকাটা ছিল কেমন একটা চটচটে ফাঁকা দমবদ্ধ দশা, যেন আমি একটা খুদে ঝিনুক, হারিয়ে গিয়েছি চেপে বসা এক নিঃসঙ্গতায়, আস্তে-আস্তে লড়ছি এমন এক ভবিষ্যতের সঙ্গে মরুভূমির হঠাৎ নামা রাতের সূচনার মতোই যা অন্ধকার, একটা পচা পোকায়-কাটা রুটিনে আটকা পড়ে গিয়েছিল, সময়ের সঙ্গে চিবিয়ে চিবিয়ে জাবর কাটতে কাটতে লড়ছি দ্বৈরথ। সবকিছু তেতে ওঠা, চটচটে, আঠালো। আমার গোটা জীবনটাই কেমন যেন পিচ্ছিল হয়ে গেছে, মাসের গোড়া থেকেই পরের মাস পয়লার জন্যে একটা উগ্ৰ বাসনা আমায় কুরে কুরে খায়।
বছরের মাঝামাঝি, সেই বছরটার মাঝামাঝি, ইহুদিরা সাভার মাঝখানে মূল মহল্লায় বোমা ফেলে, হানা দেয় আমাদের গাজায়, বোমা আর আগুন ছোড়া নিয়ে। সেই ঘটনাটা আমার রুটিন খানিকটা পালটে দিয়ে থাকবে- তবে সেদিকে নজর দেবার খুব একটা ফুরসৎ বা উপায় আমার ছিল না। এই গাজা পেছনে ফেলে রেখে আমি চলে যাব, ক্যালিফোর্নিয়া, নিজেকে নিয়ে নিজে বাঁচব, আমার এই হতভাগা বেচারি জীবন কত ভুগেছে, কত সয়েছে! গাজা আর গাজার লোকজনদের আমি অবজ্ঞা করতে শুরু করেছিলুম- তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা আর ঘৃণা। সেই কাটা-ছেঁড়া শহরে সবকিছু আমায় মনে করিয়ে দিত কোনো মানসিক রোগীর ছাই রঙে আঁকা ব্যর্থ সব ছবির কথা। হ্যাঁ-হ্যাঁ, আম্মা, ভাবি আর তার বাচ্চাদের জন্যে সামান্য টাকা পাঠাতুম আমি, যাতে তারা কোনোক্রমে টিকে থাকতে পারে, তবে এই শেষ বন্ধনটাও আমি ছিঁড়ে ফেলে নিজেকে মুক্ত করে ফেলব, ওখানে, সবুজ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই হার, এই পরাজয়ের পচা গন্ধ থেকে বাঁচাব নিজেকে গত সাত-সাত বছর যে দুর্গন্ধ আমার নাকে হু-হু করে ঢুকে পড়েছে। যে সহানুভূতি, যে-সমব্যথা আমাকে আমার ভাইজানের বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল, তাদের আম্মা আর আমারও আম্মা- এরা কেউই কোনোকালে এই খাড়াই থেকে উড়াল ঝাঁপকে কোনো মানে দিতে পারবে না। অনেকদিন কেটেছে- আর এই পিছুটান টানাহেঁচড়া চলবে না। আমাকে পালাতেই হবে।
এসব অনুভূতি তোর চেনা, মুস্তাফা, কারণ তোরও তো সত্যি এই অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। গাজার সঙ্গে এ-কোন ঠিকঠাক -না-জানা বন্ধন আমাদের, যা আমাদের পালাবার সব তাড়া সব উৎসাহকেই ভোঁতা করে ফেলে? কেন আমরা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখিনি এটা, কেন তন্নতন্ন বিশ্লেষণ করে দেখিনি, যাতে স্পষ্ট কোনো তাৎপর্য পাওয়া যায়? কেন আমরা এই হার, এই ঘা, এই জখম পেছনে ফেলে রেখে যেতে পারি না ঝলমলে কোনো ভবিষ্যতের পানে, যা আমাদের গভীরতর কোনো সান্ত্বনা দেবে? কেন? আমরা ঠিক জানতুম না, মুস্তাফা।
যখন আমি জুন মাসে ছুটিতে গেলুম, আমার যাবতীয় পার্থিব সম্পত্তি জড়ো করলুম এক জায়গায়, মধুর পলায়নের জন্যে উদ্বেল হয়ে উঠলুম, সেই ছোটখাটো সব জিনিসের দিকে যাবার জন্যে উন্মুখ জীবনকে যা দেয় সুন্দর ঝলমলে কোনো অর্থ, আমি দেখতে পেলুম গাজা আছে যেমনকে তেমন, আগের মতোই, যেমন তাকে চিরকাল জানি, একটা জং-ধরা শামুকের খোলা দিয়ে আটকানো ভেতরমুখো গুঁজে বসে থাকা একটা কিছু, ঢেউ যে-শামুককে ছুড়ে ফেলেছে কসাইখানার পাশে আঠালো বেলেমাটির তীরে। ভয়াবহ কোনো দুঃস্বপ্নের আগটায় কারু মন যেমন গুটিয়ে যায় গাজা তার চেয়েও কুঁচকানো। তার সব সরুগলি, তাদের বিশেষ বিশেষ সব গন্ধ, পরাজয়ের গন্ধ, অভাব-অনটনের গন্ধ, পেটফোলা অলিন্দ সমেত তার সব ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি… এই গাজা। কিন্তু কী সেই অস্পষ্ট আবছায়া যা কোনো লোককে তার পরিবারের কাছে, যেমনভাবে কোনো ঝরনার জল টেনে নিয়ে আসে পাহাড়ি ছাগলদের? মুস্তাফা, আমি জানি না। আমি শুধু জানি- আমি আম্মার কাছে গিয়েছি, আমাদের বাড়িতে, সেদিন সকালবেলায়। আমি যখন গিয়ে পৌঁছেছি, আমার ভাবি, আমার মরহুম ভাইজানের স্ত্রী, আমার সঙ্গে দেখা করল, আর ফুঁপিয়ে বলল তার মেয়ে নাদিয়া জখম হয়ে গাজার হাসপাতালে আছে, আমাকে দেখতে চায়, আমি কি তাকে দেখতে যাব সেদিন সন্ধ্যেবেলায়? তোর মনে আছে নাদিয়াকে, তের বছর বয়েস, আমার দাদার মেয়ে, রূপ তার ফেটে পড়ত?
সেদিন সন্ধ্যেয় আমি এক পাউন্ড আপেল কিনে নিয়ে নাদিয়াকে দেখতে হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লুম। আমি জানতুম কিছু একটা রহস্য আছে, আমার আম্মা আর আমার ভাবি আমার কাছে যা চেপে গিয়েছে, এমন একটা কিছু যা তারা মুখ ফুটে বলতে পারছে না, কিছু একটা অদ্ভুত, যার ওপর কিছুতেই আমি আঙুল বসাতে পারছিলুম না। নাদিয়াকে আমি ভালবাসতুম নিছক অভ্যাসবশেই, সেই একই অভ্যাস যা আমাকে ভালবাসিয়েছে তাদের প্রজন্মের সবকিছুকে- সেই যে প্রজন্ম বড় হয়ে উঠেছে পরাজয়, হতাশায় আর স্থানচ্যুতিতে, যে প্রজন্ম ধরেই নিয়েছে যে সুখী জীবন বোধকরি কোনো সামাজিক সত্যের বিরোধী।
কী ঘটেছিল সেই মুহূর্তে? আমি জানি না, মুস্তাফা। খুব শান্তভাবেই আমি ঢুকেছিলুম ধবধবে সাদা ঘরটায়। অসুস্থ ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন একটা কিছু থাকে যা মনে করিয়ে দেয় পীর ফকিরদের, আর সেটা সে আরো বেশি মনে করায় যদি সেই বাচ্চা হয় কোনো জঘন্য, নিষ্ঠুর, যন্ত্রণাময় ক্ষতের শিকার। নাদিয়া শুয়ে আছে তার বিছানায়, একটা মস্ত বালিশে পিঠ দিয়ে যার ওপর তার চুল কালো এক ঘন পশলার মতো ছড়িয়ে আছে। তার ডাগর চোখদুটোয় কী রকম একটা ছমছমে গভীর স্তব্ধতা, তার কালো চোখের তারায় টলমল করছে পানি। তার মুখখানি শান্ত আর নিশ্চল, কিন্তু কোনো বিদীর্ণ পয়গম্বরের যন্ত্রণাহত মুখের মতোই মুখর। এখনো বড্ড ছেলেমানুষ আছে নাদিয়া, কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে কোনো বাচ্চার চেয়েও বেশি, আরো বেশি,
কোনো বাচ্চার চেয়ে বড়, অনেক বড় ৷
‘নাদিয়া!’
আমার কোনো ধারণাই নেই সে কি আমি ঐভাবে আর্ত চেঁচিয়ে উঠেছিলুম চেরাগলায়, না কি আমার পেছন থেকে অন্য কেউ বলেছিল। কিন্তু সে তার চোখ তুলে তাকিয়েছিল আমার দিকে, আর যেন গরম চায়ের পেয়ালায় চিনির দানা গলে গেল, এমনিভাবে সেই চাউনি গলে গেল আমার ভেতর। তার ক্ষীণ, মৃদু হাসির সঙ্গে আমি তার গলা শুনতে পেলুম।
‘চাচা! তুমি কি এক্ষুনি কুয়েত থেকে এলে?’
তার কণ্ঠস্বর কী-রকম যেন ভেঙে গেল তার গলায়, দুই হাতে ভর দিয়ে কোনোমতে সে উঠে বসল, গলাটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, আমি হালকাভাবে তার পিঠ চাপড়ে তার পাশে বসে পড়লুম।
‘নাদিয়া! আমি তোর জন্যে কুয়েত থেকে উপহার নিয়ে এসেছি, অনেক উপহার। বিছানা ছেড়ে উঠবি যখন, একেবারে সেরে যেতে হবে কিন্তু, ততদিন আমি সবুর করব- তারপর তুই আমার বাড়ি আসবি আর এক-এক করে সব আমি তোকে দেব। তুই যে লাল শালোয়ারগুলো আনতে লিখেছিলি সেগুলো এনেছি। একটা নয়- অনেক’।
মিথ্যে কথা। এ-রকম মিথ্যে অনর্গল উপচে পড়ে কোনো প্রতিকূল চাপের মধ্যে,
কিন্তু আমি এমনভাবে কথাগুলো বললুম যেন জীবনে এই প্রথম আমি কোনো পরম সত্য কথা বলছি। যেন বিদ্যুৎ ছুঁয়েছে, এমনিভাবে নাদিয়া কেঁপে উঠল, ভয়ঙ্কর এক স্তব্ধতার মধ্যে সে তার মাথা নোয়াল। আমি টের পেলুম, তার চোখের জল আমার হাতের পিঠ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
‘কিছু বল, নাদিয়া ! লাল শালোয়ারগুলো তোর চাই না?’
সে তার ডাগর চোখ দু’টি তুলে আমার দিকে তাকাল, কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থতমত খেয়ে থেমে গেল, তারপর দাঁতে দাঁত চাপল। আমি তার গলা শুনতে পেলুম আবার, অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
‘চাচা!’
সে তার হাত বাড়িয়ে দিল, আঙুল দিয়ে তুলে ধরল গায়ের সাদা ঢাকা। আঙুল তুলে দেখাল তার পা, উরুর কাছ থেকে কেটে বাদ দেয়া।
দোস্ত, মুস্তাফা… আমি কোনোদিন নাদিয়ার পা-দুটো ভুলব না- উরুর কাছ থেকে কাটা। না! কোনোদিনও ভুলব না যে কোন শোক তার মুখখানিকে গড়ে তুলেছে, চিরকালের মতো তার ডৌল তার ছাঁচ তৈরি করে দিয়ে গেছে। গাজার হাসপাতাল থেকে সেদিন আমি বেরিয়ে গিয়েছিলুম, নীরব-কোনো উপহাসের মতো হাতের মধ্যে মুঠো করা দুটি পাউন্ড, নাদিয়াকে দেব বলে এনেছিলুম টাকা। জ্বলজ্বলে সূর্য রাস্তা ভরিয়ে দিয়েছে টকটকে রক্তের রঙে। আর গাজা যেন হঠাৎ আনকোরা নতুন কিছু হয়ে উঠেছে, মুস্তাফা ! তুই আর আমি গাজাকে কোনোদিন এভাবে দেখিনি। শাজিয়া মহল্লার মুখটায় ডাঁই করে রাখা পাথর, মনে আছে ঐ যে রাস্তায় আমরা থাকতুম, কেন যে পাথরগুলো ওখানে এমনভাবে স্তূপ করে রাখা তার কোনো কারণ ব্যাখ্যা করবার দরকার নেই। এই গাজা, যেখানে আমরা থেকেছি, যার সৎ মানুষজনের সঙ্গে আমরা কাটিয়েছি পরাজয়ের সাত-সাতটি বছর, হঠাৎ এই গাজা কেমন যেন নতুন হয়ে উঠেছে। আমার মনে হলো এ শুধুই সূচনামাত্র। জানি না কেন, তবু আমার মনে হলো এটা যেন কোনো সূচনা। আমার মনে হলো, যে বড় রাস্তাটা ধরে আমি হেঁটে ফিরেছিলুম বাড়ি, সে যেন সাফাদের দিকে ছুটে যাওয়া দীর্ঘ, দীর্ঘ কোনো পথের আরম্ভ। এই গাজায় সবকিছু দপদপ করছে বিষাদে, মনস্তাপে, যা শুধুই কোনো রোদনের মধ্যে আবদ্ধ নয়। যুদ্ধের আহবান এই বিষাদ। তারও বেশি, এ যেন কাটা পা ফিরে পাবার জন্যে একটা প্রচণ্ড নাছোড় দাবি!
গাজার রাস্তায়-রাস্তায় আমি হেঁটে বেড়ালুম, চোখ ধাঁধানো আলোয় ভরা সব রাস্তা। ওরা আমাকে বলেছে- নাদিয়া তার পা হারিয়েছে, যখন সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ছোট-ছোট ভাইবোনদের ওপর, তাদের ঢেকে দিয়েছিল নিজের ছোট্ট শরীরটা দিয়ে, বোমা আর আগুন থেকে তাদের বাঁচাতে, যে-আগুনের হিংস্র থাবা তখন বাড়িটায় পড়েছিল। নাদিয়া নিজেকে বাঁচাতে পারত, সহজেই সে ছুটে পালিয়ে যেতে পারত লম্বা-লম্বা পা ফেলে, রক্ষা করতে পারত তার পা। কিন্তু সে তা করেনি।
কেন?
না, মুস্তাফা, দোস্ত আমার, আমি স্যাক্রামেন্টো যাব না- আর তাতে আমার কোনো খেদ নেই। না। আর ছেলেবেলায় এক সাথে আমরা যা শুরু করেছিলুম, তা- ও আমরা শেষ করব না। সেই আবছা মতো অনুভূতি যা তুই গাজা ছেড়ে যাবার সময় অনুভব করেছিলি, সেই ছোট্ট বোধটাকে বিশাল হয়ে গড়ে উঠতে দিতে হবে তোর ভেতরে। ছড়িয়ে পড়তে দিতে হবে তাকে, নিজেকে ফিরে পাবার জন্যে হাতড়াতে হবে তোকে, তন্নতন্ন করে তোকে নিজেকে খুঁজতে হবে পরাজয়ের এই ধ্বংসস্তূপে।
আমি তোর কাছে যাব না, মুস্তাফা। বরং তুই, তুই আমাদের কাছে ফিরে আয়। ফিরে আয়, মুস্তাফা, নাদিয়ার কাটা পা-দু’টি থেকে শিখতে, উরুর ওপর থেকে কাটা, ফিরে আয় জানতে কাকে বলে জীবন, অস্তিত্বের মূল্য কী আর কতটা!
ফিরে আয়, মুস্তাফা, দোস্ত আমার, দোহাই, ফিরে আয়! আমরা সবাই তোর জন্যে উদ্গ্রীব, অপেক্ষা করে আছি।
লেখকের পরিচয় :
[ঘাসান কানাফানি ছিলেন ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’-এর প্রধান প্রবক্তাদের একজন এবং এই সংগঠনের সাপ্তাহিকপত্র ‘আল-হাদাফ’-এর সম্পাদক। কিন্তু আরবিভাষী জগতে তাঁর আরো একটা পরিচয় ছিল- তাঁকে গণ্য করা হতো আরব জগতের একজন প্রধান কথাসাহিত্যিক হিসেবে আর কবিতায় যেমন মাহমুদ দারবিশ, গদ্যে তেমনি ঘাসান কানাফানি ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য ফিলিস্তিনি লেখক।
তাঁর জন্ম হয়েছিল আক্রায় ১৯৩৬-এ. কিন্তু ১৯৪৮ সালে তাঁর পরিবার পালিয়ে যায় এখান থেকে, পরে গিয়ে আশ্রয় নেয় দামাস্কাস-এ। লেখাপড়া শেষ করে তিনি গোড়ায় সিরিয়ার রাজধানী এবং পরে কুয়েত-এ শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পরে তিনি বৈরুত-এ চলে আসেন, এবং ১৯৬৯ থেকে ‘আল- হাদাফ’ প্রকাশ করতে শুরু করেন। জুলাই ১৯৭২ তাঁর গাড়ির মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী টাইম বোমা রেখে দেয়। বিস্ফোরণে গাড়িটি যখন উড়ে যায় তখন গাড়িতে ছিলেন তিনি আর তার ভাগ্নি। মৃত্যুর সময় তাঁর বিধবা পত্নী ও দু’টি শিশু সন্তান জীবিত ছিল। ইসরায়েলি এজেন্টরা কয়েকবার তাঁদেরও হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। এ যাবত তাঁর যে সমস্ত লেখা বই হয়ে বেরিয়েছে, তার মধ্যে আছে পাঁচটি উপন্যাস (তার মধ্যে দুটি অসমাপ্ত), পাঁচটি ছোটগল্পের সংকলন, দুটি নাটক এবং ফিলিস্তিনি সাহিত্য বিষয়ে দুটি আলোচনাগ্রন্থ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ঘাসান কানাফানি পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। কেন, পাঠক তা উপলব্ধি করতে পারবেন ‘গাজা থেকে চিঠি’ এই গল্পটি পড়েই। কোথায় এক জায়গায় এটা আমাদের দেশের গল্পও যেন- বিশেষত সাম্প্রতিক পশ্চিম প্রীতি ও ব্রেনড্রেনের (Brain Drain) পরিপ্রেক্ষিতে এই গল্পটির সামাজিক তাৎপর্য এবং সংলগ্নতা নিশ্চয়ই বিশেষ করে বলবার দরকার নেই। অনুবাদক]
গল্পটি সংগ্রহ করা হয়েছে “আফ্রিকার সাহিত্য সংগ্রহ-২, কাগজ প্রকাশন” নামক গল্পসমগ্র থেকে।