প্রতিদিনের রুকইয়া ও ঝাড়ফুক

চোখের নজর, কালো যাদু, তাবীজ-কবজ, এক্সিডেন্ট, রোগ-ব্যাধি, জিনের আসর….এইরকম যেকোন ক্ষতি থেকে বেচে থাকার জন্য প্রতিদিন এই দুয়াগুলো পড়তে হয়। এই দুয়াগুলো ওযু ছাড়া, শুয়ে বসে যেকোন অবস্থাতে, এমনকি নারীরা ঋতু অবস্থাতেও পড়তে পারবেন। বিভিন্ন বিপদ-আপদ ও ক্ষতি থেকে নিরিপদ থাকার জন্য আমাদের এই দুয়াগুলো পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

১. জিনের আসর ও দুষ্টু জিনের ক্ষতি থেকে বাচার জন্য আমল

সকাল ও সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসী পাঠ করা – ১ বার করে
জিনেরা মানুষের উপর আসর করে মানুষের মন-মেজাজ, চিন্তা ভাবনা এমনকি কাজের উপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অনেক দুষ্টু জিন মানুষের বিশেষ করে মুমিনদের ক্ষতি করে থাকে, এক সাহাবীকে জিনেরা তীর বিদ্ধ করে হত্যা করেছিলো। অন্য এক সাহাবীর ঘরে একটা জিন সাপ হিসেবে বসে ছিলো। ঐ সাহাবী যখন তাকে সাপ মনে করে হত্যা করতে যান তখন ঐ জিন তাকে দংশন করে হত্যা করে। জিনের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার সহজ একটি আমল হচ্ছে সকাল ও সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসী ১ বার পড়া।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি সকালে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে তাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জিনদের থেকে রক্ষা করা হবে আর, যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে তাকে সকাল পর্যন্ত রক্ষা করা হবে।” সহীহ তারগীব ওয়াত-তারতীবঃ ৬৬২।
নোটঃ সুরা বাকারার ২৫৫ নাম্বার আয়াতকে “আয়াতুল কুরসী” বলা হয়। নিয়মিত আয়াতুল কুরসী পড়লে যাদু, চোখের নজর, জিনের ক্ষতি ও অন্যান্য বিপদ আপদ থেকে সুরক্ষা করে। আর প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে একবার করে পড়লে মৃত্যুর পরে বিনা হিসেবে জান্নাত।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে পারবেনা।” নাসায়ী, ইবনু হিব্বান, হাদীস সহীহ।
২. প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় তিনবার করে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক্ব ও সুরা নাস ৩ বার করে পড়া। ‘সকাল’ হচ্ছে ফযরের পর থেকে যোহর পর্যন্ত যেকোন সময়, আর ‘সন্ধ্যা’ হচ্ছে আসর থেকে নিয়ে মাগরিব পর্যন্ত সময়। এর ফযীলত হচ্ছেঃ এই দুয়া পড়লে যেকোন (ক্ষতিকর) জিনিস থেকে নিরাপত্তা দেবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেনঃ “তুমি প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ (সুরা ইখলাস), ‘ক্বুল আঊযু বিরাবিবল ফালাক্ব’ (সুরা ফালাক্ব) ও ‘ক্বুল আঊযু বিরাবিবন্নাস’ (সুরা নাস) তিনবার করে পড়। তাহলে যেকোন (ক্ষতিকর) জিনিস থেকে নিরাপত্তার জন্য এটা তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।” তিরমিযী ৩৫৭৫, আবূ দাউদ ৫০৮২, নাসায়ী ৫৪২৮, ৫৪২৯, হাসান সহীহ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী, শায়খ আলবানী।
পড়ার নিয়মঃ আউযুবিল্লাহ…, বিসমিল্লাহ…, পড়ে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, সুরা নাস – এইভাবে ১ বার করে পড়ার পরে এই সিরিয়ালে আরো ২ বার, মোট ৩ বার পড়তে হবে। প্রত্যেক সুরার আগে শুধু বিসমিল্লাহ…পড়বেন।

৩. হঠাৎ কোন বিপদ-আপদ ও দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য দুয়াঃ

সকাল ও সন্ধ্যায় ৩ বার
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি সকালে তিনবার ও সন্ধ্যায় তিন বার এই দুআ পড়বে, কোনো কিছুই ঐ ব্যক্তির ক্ষতি করতে পারবেনা।”
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي السّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
আরবী উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হিল্লাযী লা ইয়াদুররু মা আ’সমিহী শাই’উন ফিল আরদি, ওয়ালা ফিস সামা-য়ী, ওয়াহুয়াস সামীউ’ল আ’লীম। (৩ বার)।
বাংলা অর্থঃ আমি সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি, যার নামে শুরু করলে আসমান ও যমীনের কোনো কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী। (৩ বার)।
আবু দাউদ, তিরমিযী ৩৩৮৮, ইবনে মাজাহ ৩৮৬৯, মুসনাদে আহমাদ ৪৪৮, ৫২৯। হিসনুল মুসলিম, পৃষ্ঠা ১৩৮। শাইখ আলবানীর মতে হাদীসটি হাসান।

৪. চোখের নজর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার দুয়া

সকাল ও সন্ধ্যায় ৩ বার
চোখের নজরের কারণে মানুষের অনেক ক্ষতি হতে পারে। হিংসুক লোকের অন্তরে বিদ্বেষ বা লোভ নিয়ে চিন্তা করা, উচ্চ প্রশংসামূলক বাক্য, চিন্তা বা চোখের দ্বারা দৃষ্টির দ্বারা কারো নিজের বা তার পরিবারের লোকজনের স্বাস্থ্য, সম্পদ, ব্যবসা, পড়ালেখা, বিদ্যা-বুদ্ধি, সৌন্দর্যের ক্ষতি হতে পারে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট এমনকি কারো মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।
যা দ্বারা শিশুদের জন্য চোখের নজর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হয়ঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা-এর জন্য এই বলে (আল্লাহ্র) আশ্রয় প্রার্থনা করতেন-

أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ
উচ্চারণঃ উইযুকুমা বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিওঁয়া হা-ম্মাহ্, ওয়ামিন কুল্লি আইনিল্লা-ম্মাহ্।
অর্থঃ আমি তোমাদের দুই জনকে আল্লাহ্র পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের আশ্রয়ে নিচ্ছি, যাবতীয় শয়তান ও বিষধর জন্তু থেকে এবং যাবতীয় ক্ষতিকর চক্ষু (বদনযর) থেকে।” বুখারীঃ ৩৩৭১।
কেউ নিজের জন্য চোখের নজর থেকে বাঁচার জন্য উপরের দুয়াটি পড়ে তবে উইযুকুমা বিকালিমা-তিল্লা-হিত……এর পরিবর্তে أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ আ‘ঊযু বিকালিমা-তিল্লাহিত্তা-ম্মাতি মিন্…এইভাবে পড়তে হবে।

৫. দশজন দাস মুক্ত করার সমান সওয়াব ও সশস্ত্র ফেরেশতা দল দিয়ে নিরাপত্তাসহ অনেক বড় ফযীলতের একটা দুয়া

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণঃ লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু, লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হা’মদু, ইয়ুহ্য়ী ওয়াইয়ূমীতু, ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাই’ইন ক্বাদীর।
অর্থঃ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবূদ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তারই এবং সমস্ত প্রশংসা তাঁর। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন। আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
এই দুয়া ফযর ও মাগরিবের ফরয নামায পড়ার পর পড়লেঃ
ক. আল্লাহ তাআ’লা ঐ ব্যক্তির জন্য সশস্ত্র ফেরেশতাদের দল পাঠাবেন যারা তাকে সকাল পর্যন্ত যেকোন ক্ষতি হতে পাহারা দিয়ে রাখবেন।
খ. তার জন্য ১০টি নেকী লিখে দেওয়া হবে।
গ. তার আমলনামা থেকে ১০টি ধ্বংসাত্মক গুনাহ মুছে দেওয়া হবে।
ঘ. ১০ জন ঈমানদার গোলাম মুক্ত করার সমান সওয়াব তাকে দেওয়া হবে।
সুনানে তিরমিযীঃ ৩৫৩৪, হাদীসটি হাসান সহীহ, দারুস সালাম তাহকীক।
বিঃদ্রঃ এই ফযীলত পাওয়ার জন্য যদি কোনো অসুবিধা যদি না থাকে তাহলে ফযর ও মাগরিবের ফরয নামায পড়ে সুন্নত নামায পড়ার আগেই জায়নামাযে বসেই পড়তে হবে, সুন্নতের পরে নয়। আর লক্ষ্য করুন দুয়াটাতে অতিরিক্ত “ইয়ুহ্য়ী ওয়াইয়ূমীতু” – এই কথাটা অতিরিক্ত আছে, এটাসহ পড়তে হবে।

ঘুমানোর পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুন্নতী আমলঃ

৫. আয়াতুল কুরসী পাঠ করা – ১ বার।
ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসী পাঠ করার ফযীলতঃ
ক. সকাল পর্যন্ত তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন হেফাজতকারী (ফেরেশতা) তাকে নিরাপত্তা দেবে।
খ. শয়তান তার কাছে আসতে পারবেনা।
“যখন বিছানায় ঘুমুতে যাবে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার উপর সব সময় একজন হেফাযতকারী নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর পর্যন্ত শয়তান তোমার ধারে কাছেও আসতে পারবে না।”
সহীহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬১, হাদিস নং- ৫৩০।
*এখানে হাদীসটা আসলে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা আসলে এক জিনের সাথে এক সাহাবীর আশ্চর্যজনক বড় একটা ঘটনা। সম্পূর্ণ কাহিনীটা জানার জন্য আপনারা রিয়াদুস সালেহীন এর বই ৯, হাদিস নং- ১০২২ থেকে দেখে নিতে পারেন।
৬. সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়া – ১ বার।
ঘুমানোর আগে সুরা বাক্বারার শেষ ২ আয়াত (২৮৫+২৮৬) পড়ার ফযীলতঃ
ক. রাত জেগে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার সমান সওয়াব পাওয়া যাবে
খ. বালা-মুসিবত ও যেকোনো ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে।
গ. জিন ও শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে।
ঘ. আয়াতগুলো পড়ে শেষ “আমিন” বললে আয়াতগুলোতে যেই দুয়া আছে সেইগুলো আল্লাহ তাআ’লা কবুল করে নেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি রাতের বেলা সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়বে সেটা তার জন্য যথেষ্ঠ হবে”। সহীহ বুখারিঃ ৫০১০, সহীহ মুসলিমঃ ৮০৭।
বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ “রিয়াদুস সালেহীন” এর লেখক ও সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার, ইমাম আন-নববী (রহঃ) বলেন, “এর অর্থ কেউ বলেছেনঃ কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ বালা-মুসিবত থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। তবে সবগুলো অর্থ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শারহুন নববী আ’লা সহিহ মুসলিমঃ ৮০৭।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার, আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদীস, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) এই অভিমত সমর্থন করে বলেন, উপরের সবগুলো অর্থ নেওয়া সঠিক। আল্লাহ ভালো জানেন। প্রথম অর্থটি (তাহাজ্জুদের সমান সওয়াব পাওয়া) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ (রাঃ) থেকে একটি মারফু হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
ফাতহুল বারী ৮/৬৭৩, হাদীস ৫০১০।
এ কারণেই আলী (রাঃ) বলেনঃ “আমার মতে যার সামান্যও বুদ্ধিজ্ঞান আছে, সে এ দুটি আয়াত পাঠ করা ছাড়া নিদ্রা যাবে না”। মানাকিবুস সাহাবা। ইমাম নববী এটাকে সহীহ বলেছেন, আল-আযকার।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88