হাফিয ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

মানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মাদ (সা)-এর তিরোধানের পর হিজরী অষ্টমী শতাব্দীতে যে সব প্রখর প্রতিভাধর মহামনিষী তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হযে আজীবন জ্ঞান সাধনার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর জন্য জ্ঞানের (বিশেষত: হাদীস শাস্ত্রের) এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার উপহার দিয়ে গেছেন, ইবনু হাজার আসকালানী তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে মুহাদ্দিস, বিচারক, ফকীহ, ঐতিহাসিক, রিজালবিদ, পরীক্ষক, কবি এবং মুসলিম ধর্মীয় পান্ডিত্যের সর্বাপেক্ষা আদর্শ প্রতিনিধি ছিলেন। যাঁকে সকলে এক বাক্যে ‘হাফিয’ বলে চিনে, জানে এবং মানে।

নাম ও বংশ পরিচয় :-  তাঁর নাম আহমাদ, কুনিয়াত আবুল ফযল, লক্বব শিহাবুদ্দীন। ইবনু হাজার তাঁর পরিচিতগত নাম।  পুরো নাম আবুল ফযল শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী আল মিসরী। মতান্তরে, আহমাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে মাহমূদ ইবনে আহমাদ ইবনে হাজার। হাফিয সাখাবীর বর্ণনা মতে, ইবনু হাজারের ‘হাজার’ শব্দটি ছিল তাঁর ঊর্ধতম কোন পূর্বপুরুষের উপাধি। ইবনু হাজার ‘বনু কেনানা’ বংশোদ্ভূত। ‘বনু কেনানা’ ছিল আরব দেশের একটি প্রসিদ্ধ গোত্র। তাঁর ঊর্দ্ধতন পূবপুরুষের ছিলেন সিরিয়ার একটি প্রসিদ্ধ শহর ‘আসক্বালান’-এর অধিবাসী। এই দিক দিয়ে ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী’ রুপে পরিচিত।

জন্ম ও শৈশব : ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী মিসরের আল-আতীক (প্রাচীন কায়রো)-এ জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্ম তারিখ ১২ (মতান্তরে ১০, ২২ অথবা ২৩ ) শা’বান, ৭৭৩ হিজরী, ১৮ ফেব্রুয়ারী ১৩৭২ খৃস্টাব্দ। শৈশবেই তার পিতা নুরুদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইন্তিকাল করেন। মাতাও তার শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেন। এ সমপর্কে তিনি নিজেই বলেছেন : যখন আমার পিতা মারা যান তখন আমার বয়স ৪বছর পূর্ণ হয়নি। আজ সেই স্মৃতি আমার কাছে একটি স্বপ্নের ন্যায় স্মরণ আছে। এমনিভাবে স্মরণ আছে যে, তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে ইবনু হাজারের উপনাম আবুল ফজল’। তাঁর পিতা ফিকহ, আরবী সাহিত্যের গদ্য-পদ্য এবং ইলকে ক্বিরআতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। সাথে সাথে তিনি ফাতওয়া প্রদান ও অধ্যাপনায় সনদপ্রাপ্ত ছিলেন। অতঃপর হিতৈষী বিখ্যাত বণিক যাকীউদ্দীন আল-খাররুবী শিশু ইবনু হাজারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার অভিভাবকত্বের পূর্ণ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী পাঁচ বছর বয়সে স্থানীয় মক্তবে ভর্তি হন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আরবী ব্যাকরণ ও ফিকহের প্রাথমিক পুস্তকগুলো অধ্যয়ন করেন। সাথে সাথে কুরআন মাজীদের হিফয শুরু করেন। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি কুরআনের হাফিয হন। এগার বছর বয়সে তিনি স্বীয় অভিভাবকের সাথে মক্কা মুয়াযযমায় গমন করেন। এক বৎসর কাল তিনি হারাম শরীফ এলাকায় অবস্থান করেন। এই সময় তিনি মাসজিদুল হারামে তারাবীহ’র নামাযে কুরআন মাজীদ শুনান এবং হাজ্বব্রত পালন করেন। তখন থেকে জীবনে তিনি কয়েকবার হাজ্ব আদায় করেন।

মক্কা মুয়াযযমায় অবস্থানের সময় তিনি শাইখ  আফীফউদ্দীন আবদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ নিশাপুরীর বুখারীর দরসে যোগদান করেন। হাদীস শাস্ত্রে নিশাপুরীই তার প্রথম ওস্তাদ। তিনি ৭৮৬ হিজরীতে মিসরে প্রত্যাবর্তন করে স্থানীয় শাইখ এবং বহির্দেশ থেকে আগত মুহাদ্দিসীনগণের নিকট হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন।

অতঃপর ৭৯৩ হিজরী সালে মুসলিম জাহানের তদানীন্তন প্রসিদ্ধ শিক্ষকগণের নিকট বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য বিদেশ ভ্রমণে বের হন এবং ৮০৮ হিজরী সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর দেশ থেকে দেশান্তরে গমন করেন।তিনি এই দীর্ঘ সময়ে তদানীন্তন মুসলিম জাহানের প্রায় সবগুলো প্রসিদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র এবং বিভিন্ন বিষয়ের খ্যাতনামা ওস্তাদগণের খিদমাতে উপস্থিত হয়ে সর্ব বিষয়ে – বিশেষ করে হাদীস শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তার ভ্রমণকৃত স্থানসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে  উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মক্কা, মদীনা, দিমাস্ক, বায়তুল মাকদ্বিস, ইস্কান্দারিয়া, আল খালাল, নাওলুস ও ইয়ামানের বিভিন্ন শহর, রামলাহ প্রভৃতি। তাঁর ওস্তাদগণের সংখ্যা অগণিত।

আল্লাহ প্রদত্ত সহজাত অনন্য প্রতিভা ছাড়াও ইবনু হাজার জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দক্ষতা অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন। তাঁর শাগরিদে রশীদ এবং জীবনী লেখক সাখাবী বিদ্যার্জনে তাঁর শ্রম সাধনা এবং এর ফলশ্রুতি সম্পর্কে বলেনঃ “ তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কঠোর পরিশ্রম ও অক্লান্ত সাধনার ফলস্বরূপ সাফল্যের সরবোচ্চস্তরে পৌঁছেন।

ইবনু হাজার আল আসক্বালানী’র কর্মজীবনের বৃহত্তর অংশ ইলমে দীন, বিশেষ করে হাদীস শাস্ত্রের অনুশীলন, হাদীসের দরস তাদরীস , হাদীস গ্রন্থের সঙ্কলন এবং হাদীস গ্রন্থের অতুল্য ব্যাখ্যা গ্রন্থসহ বহু সংখ্যক মৌলিক গ্রন্থ রচনায় এবং হাদীস ভিত্তিক ফাতাওয়া প্রদানে অতিবাহিত হয়েছে। এ ছাড়া তিনি কায়রো শহরের প্রসিদ্ধ মাদ্রাসাসমূহে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কুরআনের তাফসীর , হাদীস এবং ফিকহের অধ্যাপনায় নিয়োজিত থেকেছেন। একটি সুবৃহৎ মাদ্রাসায় তিনি শাইখুল হাদীস এবং অধ্যক্ষের পদেও ব্রত হন। জামে আযহার এবং আমর ইবনুল আসের নামের সাথে সংযুক্ত জামে মাসজিদে তিনি বেশ কিছু সময় খাতীবের দায়িত্বও পালন করেন। একটি মাদ্রাসার গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বও তাঁর উপর ন্যস্ত করা হয়। এতদ্ব্যতীত এক সহস্রাধিক মাজলিসে তিনি শ্রোতাবৃন্দকে স্বীয় স্মৃতি থেকে হাদীস পাঠ করে শুনান। এসব মজলিসে বহু বিশেষজ্ঞ আগ্রহের সাথে যোগদান করতেন।

এছাড়া তাঁর বন্ধু প্রধান বিচারপতি জামালুদ্দীন আল বুলাকিনীর অনুরোধে তিনি তাঁর সহকারী হতে রাযি হন। ৮২৭ হিজরীতে তিনি নিজে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি মত একুশ বছর পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।

একজন সার্থক গদ্য লেখক ছাড়াও ইবনু হাজার একজন কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর ছোট বড় গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ১৫০ টি বলে জানা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হল সহীহুল বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’। ৮১৩ হিজরীতে তিনি এই গ্রন্থের ভূমিকা শেষ করেন এবং ৮৪২ হিজরীর রজব মাসে তিনি গ্রন্থটি সম্পূর্ণ করেন। গ্রন্থটি শেষ করার পর তিনি ৫০০ দিনার খরচ করে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং রাজারা ৩০০ দিনার দিয়ে তাঁর কাছ থেকে এই বিখ্যাত গ্রন্থটি ক্রয় করেন।

‘ফাতহুল বারী’  ছাড়াও ইবনু হাজার রহঃ এর আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘বুলুগুল মারাম’ যা বাংলায় অনুবাদ করে আল্লামা আলবানী রহঃ এর তাহকীক সহ হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী প্রকাশ করেছে।

হাফিয ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী ৮ জুলহাজ্ব, ৮৫২ হিজরীতে ইশার সলাতের পর ইন্তিকাল করেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক। আমীন।

সূত্রঃ প্রায় সকল তথ্য নেওয়া হয়েছে সহ হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনীর ‘বুলগুল মারাম’ বই থেকে। কিছু নেওয়া হয়েছে দারুস সালাম প্রকাশনীর ওয়েব থেকে।

ইনার জীবনী সম্পর্কে জানতে নিম্নোক্ত বইটি ক্রয় করতে পারেন:

হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানি (রহ)
লেখক : আব্দুল্লাহ আল মাসূম
প্রকাশনী : নবপ্রকাশ

বই অর্ডার করতে

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88