ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের লড়াই

মীর নিসার আলী তিতুমীরের জীবনী

রচনায়: মুনতাসীর মামুন

বারাসাত ছিল চব্বিশ পরগণার একট মহকুমা। ঐ মহকুমার বসিরহাট থানার অন্তর্গত চাঁদপুর নামে ছোট এক গ্রামে তিতুমীরের জন্ম ১৭৮২ সালে। তিতুমীরের আসল নাম মীর নিসার আলী। অবশ্য আসল নামের চেয়ে ডাকনামেই তিনি বেশি পরিচিত। তিতুমীরের বাবার নাম মীর হাসান আলী এবং মার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন।

তিতুমীরের বাবা মা খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর পড়াশোনার ওপর বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। তাঁর হাতেখড়ি হয় সাড়ে চার বছরে। ছোটবেলায়ই তাঁকে ফার্সি, আরবি, উর্দু, বাংলা এবং অংক শেখাবার জন্যে রাখা হয়েছিল দু’জন পণ্ডিত। পড়াশোনায় বেশ মনোযোগীই ছিলেন তিতুমীর। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই স্থানীয় মাদ্রাসার পড়াশোনা শেষ করেন তিনি।

বাংলাদেশে ঐ সময় শরীরচর্চা ছিল জনপ্রিয়। শরীরচর্চা শিক্ষা দেয়ার জন্যে তখন গড়ে উঠেছিল অনেক আখড়া। তিতুমীরও এরকম একটি আখড়ায় ভর্তি হয়ে শিখেছিলেন ডন, কুস্তি, লাঠিখেলা। কুস্তিগীর হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। কলকাতায় তো একবার বেশ নামী এক কুস্তিগীরকে হেলায় হারিয়ে দিয়ে বেশ হৈ চৈ সৃষ্টি করেছিলেন।

বিয়ের বয়স হলে তিতুমীর বিয়ে করেন মায়মুনা খাতুন সিদ্দিকাকে। তিনি ছিলেন চব্বিশ পরগণারই খালপুর নামে এক গ্রামের বিখ্যাত দরবেশ শাহ সুফী মহম্মদ আসমতউল্লাহ সিদ্দিকীর মেয়ে।

আগেই বলেছি লাঠিয়াল, কুস্তিগীর হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল তিতুমীরের। বোধ হয় এ কারণেই নদীয়ার এক জমিদারের অধীনে তিনি চাকরি পেলেন। তখন জমিজমা নিয়ে এক জমিদারের সঙ্গে আরেক জমিদারের বিরোধ লেগেই থাকত। একবার তিতুমীর যে জমিদারের অধীনে চাকরি করছিলেন তার সঙ্গে আরেক জমিদারের বিরোধ শুরু হল। নিজের জমিদারের পক্ষ নিয়ে দাঙ্গা করতে গিয়ে তিতুমীর হলেন গ্রেফতার। বিচারে দেয়া হল তাঁকে কারাদণ্ড।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিতুমীর দিল্লীর এক পুরনো অভিজাত পরিবারে চাকরি নিলেন। পরিবারের কর্তা তাঁকে আবার বিশেষ স্নেহ করতেন। ১৮২২ সালে এই পরিবারের কর্তাই তিতুমীরকে মক্কায় নিয়ে যান হজ করতে। মক্কায়ই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সৈয়দ আহমদ শহীদের যার কথা আগেই বলেছি। তিতুমীর প্রভাবিত হলেন সৈয়দ আহমদের ব্যক্তিত্ব ও আদর্শে। পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৮২৭ সালে তিতুমীর ফিরে এলেন নিজ দেশে। আস্তানা গাড়লেন নিজ গ্রামের পাশে, হায়দারপুরে।

হায়দারপুরে তিতুমীর শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর মতবাদ প্রচার শুরু করলেন। কী প্রচার করেছিলেন তিতুমীর? ইসলাম ধর্মে যেসব অনাচার প্রবেশ করেছিল তা তিনি চেয়েছিলেন দূর করতে। যারা তাঁর শিষ্য হলেন তাদের তিনি বললেন দাড়ি রাখতে এবং লুঙ্গীর মত করে ধুতি পরতে। বললেন, একমাত্র খোদার কাছেই মাথা নত করতে আর ‘শিরক’ না করতে। পীর ফকির, মাজার প্রভৃতির প্রতি বেশি ভক্তি প্রদর্শনকেই বলা হত ‘শিরক’। ফাতিহা এবং মিলাদ পড়তেও নিষেধ করলেন তিনি। এভাবে তিতুমীর চেয়েছিলেন ইসলাম ধর্মকে শুদ্ধ করতে।

এক বছরের মধ্যেই দেখা গেল আশেপাশের অঞ্চলের অনেকেই তাঁর শিষ্য হয়ে উঠছে। তিতুমীরের শিষ্যদের রীতি-নীতি পোশাক- আষাক দেখে সহজেই তাদের আলাদাভাবে চেনা যেত। এমনকি নদীয়া জেলার কৃষকরা পর্যন্ত তিতুমীরের ভক্ত হয়ে উঠেছিল। তবে সব মুসলমান যে তিতুমীরের ভক্ত ছিলেন এমন নয়। অনেক ধনী, গোঁড়া মুসলমান আবার তিতুমীরের এসব কার্যকলাপকে বিষ নজরে দেখতেন।

তবে তিতুমীরের প্রচারে আর শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধিতে বেশি চটলো জমিদাররা। তিতুমীর যে গ্রামে বাস করতেন তাঁর জমিদার ছিলেন কৃষ্ণদেব রায়। পুড়ার জমিদার নামেই অবশ্য তিনি ছিলেন বেশি পরিচিত। তিতুমীরের কার্যকলাপ গোড়া থেকেই অপছন্দ করলেন তিনি। অবশ্য এর কারণও আছে। ধর্মীয় মত প্রচার করলেও কৃষকরা তো তিতুমীরের অধীনেই জোট বাঁধছে আর কৃষকরা একজোট হলেই তো বিপদ। কৃষ্ণদেব চাইলেন তাই প্রজাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে। আর এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করলেন আশেপাশের জমিদার বন্ধুরা। তারপর এক সময় দেখা গেল কৃষ্ণদেব রায়ের পক্ষে আছেন, তারাগোনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ নাগ, এগরপুরের জমিদার যোগী প্রসাদ চৌধুরী, সরফরাজপুরের জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, গোরগাছির জমিদারণী এবং কলকাতার বিখ্যাত ধনী ও জমিদার লাটুবাবুর গোমস্তা। এদের সাহায্য করেছিলেন কোম্পানীর কর্মচারী এবং নীলকররা। নীলকরদের অধিকাংশ ছিল ইংরেজ। প্রজাদের জোর করে তারা নীল চাষ করাতে বাধ্য করত কারণ নীল ব্যবসা তখন ছিল লাভজনক। তিতুমীরের অঞ্চল ছিল নীলচাষের কেন্দ্র। নীলকররা তাই ভাবল, কৃষকরা যদি তিতুমীরের অধীনে একজোট হয় তাহলে হয়ত এক সময় বলবে আমরা নীলচাষ করব না। তখন তো বিপদ! অন্যদিকে শুধু ছিলেন তিতুমীর আর তাঁর অনুগত শিষ্যরা। তারপর এক সময় দেখা গেল লড়াই শুরু হয়ে গেছে শোষক আর শোষিতের।

তিতুমীরের সঙ্গে বিরোধের সূত্রপাত কিন্তু করলেন কৃষ্ণদেব রায়। তিতুমীরের প্রভাব প্রতিপত্তি তার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া তিনি চাইছিলেন প্রজাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে যার ফলে খাজনা আদায় ও তার শোষণের পথ অব্যাহত থাকে। কৃষ্ণদেব ঘোষণা করলেন, তাঁর জমিদারিতে যারা দাড়ি রাখবে তাদের প্রত্যেককে আড়াই টাকা করে খাজনা বা ট্যাক্স দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে হয়ত তোমাদের অনেকেরই রাশিয়ার সম্রাট পিটারের কথা মনে হতে পারে। অনেক আগে পিটারও প্রজাদের দাড়ির ওপর ট্যাক্স ধার্য করেছিলেন। কিন্তু পিটার এ কাজটি করেছিলেন প্রজাদের আধুনিক করে তোলার জন্যে। আর কৃষ্ণদেব ট্যাক্স ধার্য করলেন প্রজাদের অপমান ও নাজেহাল করার জন্যে। অবশ্য এর সঙ্গে যদি বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যায় ট্যাক্স হিসেবে তবে মন্দ কি।

পুঁড়া গ্রামের কৃষ্ণদেবের এই অন্যায় ট্যাক্সে কেউ তেমন আপত্তি করেনি। সেখান থেকে কৃষ্ণদেব নির্বিঘ্নেই দাড়ি ট্যাক্স আদায় করলেন। তারপর চাইলেন তিনি সরফরাজপুর গ্রাম থেকে দাড়ি ট্যাক্স আদায় করতে। এই গ্রামের দু’জন থেকে কৃষ্ণদেব ট্যাক্স আদায়ও করেছিলেন কিন্তু তারপরই তিতুমীর এগিয়ে গেলেন তাঁর শিষ্যদের রক্ষা করতে।

সরফরাজপুরে ঐ সময় ছিল বেশ পুরনো একটি মসজিদ। অবশ্য বর্গীয় হামলায় তা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তিতুমীর মসজিদটি মেরামত করে সেখানে একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন তার মতামত প্রচারের জন্যে এ কারণে ঐ অঞ্চলে তিতুমীরের বেশ প্রভাব ছিল।

কৃষ্ণদেব সরফরাজপুরের জমিদার কাছারীতে তিতুমীরের শিষ্যদের ডেকে পাঠালেন। বললেন, দাড়ির জন্যে জরিমানা এখানে জমা দিতে হবে। প্রজারা সময় চাইল দশ দিনের। কিন্তু পেরিয়ে গেল দশ দিন, খাজনা জমা দিতে এল না কেউ কাছারীতে। কৃষ্ণদেব তখন চারজন পেয়াদা পাঠালেন প্রজাদের ডেকে আনার জন্যে। পেয়াদারা প্রজাদের ডাকবে কি, বরং প্রজারা পেয়াদের তাড়া করল। তারা তো দে দৌড়। তিনজন পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু একজন ধরা পড়ল প্রজাদের হাতে।

দিনটি ছিল শুক্রবার। জুমার দিন। সরফরাজপুরের সেই মসজিদে তিতুমীরের শিষ্যরা সব জমা হয়েছেন নামাজ পড়ার জন্যে। পেয়াদা তিনজন এ সময় এসে কৃষ্ণদেবকে জানাল তাদের নাজেহালের কথা। কৃষ্ণদেব তো ক্ষেপে অস্থির। এত বড় সাহস প্রজাদের যে জমিদারের পেয়াদাকে সেলাম না জানিয়ে তাড়া করে! উচিত শিক্ষা দিতে হবে বেটাদের। দাঁত কিড়মিড় করে ভাবলেন কৃষ্ণদেব। তারপর তার লাঠিয়াল, পাইক সব নিয়ে সেই মসজিদ আক্রমণ করলেন। পুড়িয়ে দেয়া হলো মসজিদটি। নামাজ পড়ারত অবস্থায় মারা গেলেন দু’জন, আহতও হলেন বেশ কয়েকজন। শুধু তাই নয় কৃষ্ণদেব প্রজাদের কিছু বাড়িঘরও লুট করলেন।

সরফরাজপুরের কাছেই কলিঙ্গ থানা। মসজিদ পুড়িয়ে, গ্রামে লুটপাট করে কৃষ্ণদেব হাজির হলেন কলিঙ্গ থানায়। এজাহার দিলেন থানায় এ বলে যে, সরফরাজপুরের প্রজারা তার কয়েকজন চাকরকে জোর জবরদস্তি করে আটকে রেখেছে। প্রজারাও চুপ করে বসে নেই।

তারাও থানায় এজাহার দিয়ে জানাল যে, জমিদার কৃষ্ণদেব তাদের মসজিদ পুড়িয়ে দিয়েছে। কলিঙ্গ থানার জমাদারতো দু’পক্ষের এজাহার শুনে ভড়কে গেলো। খবর পাঠালো ওপরঅলাকে যে, এখানে ঝামেলা বেধে গেছে। তদন্তের জন্যে একজন দারোগা পাঠালে ভালো হয়। কর্তারা বশিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তীকে পাঠালেন তদন্তের জন্যে।

তা কোম্পানী আমলে দারোগা প্রজার পক্ষ নেবে এ কথা ভুলেও কেউ ভাবত না। সুতরাং দেখা গেল রামরাম তার রিপোর্ট লিখলেন, ভালো মানুষ জমিদারকে বিপদে ফেলার জন্যেই তিতুমীরের শিষ্যরা নিজেদের মসজিদ নিজেরাই পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রজারা কিন্তু এতেও দমল না। তারা সোজা গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাল যে, রামরাম ঘুষখোর। ঘুষ খেয়ে জমিদারের পক্ষ নিয়েছে। সুতরাং সাক্ষী তলব করা হোক। ম্যাজিস্ট্রেট পড়লেন বিপদে। কোন দিক রাখেন তিনি। শেষে দু’পক্ষকেই খালাস করে দিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বলে দিলেন, দু’পক্ষের কেউই নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে না। শুধু তাই নয় নিজ নিজ এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলাও রক্ষা করতে হবে।

তিতুমার ও তাঁর শিষ্যরা কিন্তু সব সময় শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধের মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জমিদার কৃষ্ণদেব তাতে রাজি ছিলেন না। কারণ শুধু থানার দারোগা নয়, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটও ছিল তাঁর পক্ষে। সুতরাং আর ভয় কি! তিনি ফের প্রজার বিরুদ্ধে দায়ের করতে লাগলেন মিথ্যা মামলা, আদায় করতে লাগলেন জরিমানা। ইংরেজদের তদন্ত রিপোর্টেও একথা স্বীকার করা হয়েছে। তিতুমীরের বিদ্রোহ চুকেবুকে গেলে আলিপুরের জর্জ ও’কেনলী এই ঘটনার তদন্ত করে একটি রিপোর্ট দিয়েছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, এর পর জমিদারের পক্ষ থেকে শুরু হল তিতুমীরের ওপর নানারকম অত্যাচার। অহরহ তিতুমীরের শিষ্যদের নাজেহাল করার জন্যে তাদের ধরে নিয়ে আসা হত কাছারিতে। উদ্দেশ্য দাড়ির জন্য কর আদায় করা। দেওয়ানি আদালতে প্রজাদের নামে দায়ের করা হল মিথ্যা মামলা। এর ফলে অনেকের ওপর ডিক্রী পর্যন্ত জারি করা হয়েছিল।

তিতুমীর তবুও চুপ করে রইলেন। তিনি ভাবলেন, কলাকাতায় উঁচু আদালতে আপীল করবেন। এ সময় তাঁর সব কাজকর্মের ডানহাত ছিলেন ভাগ্নে গোলাম মাসুম। ১৮৩১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভাগ্নেকে পাঠালেন তিনি কলকাতায় আপীল করার জন্যে। গোলাম মাসুম গেলেন কলকাতা। গিয়ে দেখলেন জজ সাহেব চলে গেছেন বাখরগঞ্জ। গোলাম মাসুম ফিরে এলেন গ্রামে। এদিকে ন্যায়বিচারের কোন আশা নেই দেখে তিতুমীর অবশেষে ঠিক করলেন শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সংগ্রামে নামতে হবে। কারণ না হলে জমিদার ও ইংরেজদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। সুতরাং ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে তিতুমীর ও তাঁর অনুচররা ঠিক করলেন, লড়াইয়ের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করে তুলতে হবে।

নারকেলবাড়িয়া গ্রামে জৈনুদ্দীন বিশ্বাস নামে তিতুমীরের এক শিষ্য ছিলেন। অক্টোবরের ২৩ তারিখ থেকে তিতুমীরের শিষ্যরা নারকেলবাড়িয়ায় জমা হতে লাগলেন। এ সময় তিতুমীরকে সাহায্য করেন মিস্কিন শাহ্ নামের এক ফকির। মিস্কিন শাহরও কিছু শিষ্য ছিল। তারাও যোগ দিলেন তিতুমীরের দলে। নিঃশব্দে প্রস্তুত হলেন তিতুমীর।

চর মুখে কৃষ্ণদেবও খবর পেলেন এই জমায়েতের। কৃষ্ণদেব নিজেতো প্রস্তুত হলেনই, আশেপাশের জমিদারদের সঙ্গেও জোট বেঁধে ফেললেন।

১৮৩১ সালের ৬ নভেম্বর। ভোরবেলা। প্রায় তিনশো অনুচর নিয়ে তিতুমীর আক্রমণ করলেন কৃষ্ণদেবের নিজ গ্রাম গুঁড়া। তাদের অত্র লাঠি, বল্লম আর তরবারি। কৃষ্ণদেব খবর পেয়ে বন্ধ করে দিলেন জমিদার বাড়ির সিংহ দরজা। আর তার বাড়ির লোকজন ছাদে উঠে ইট পাটকেল ছুড়তে লাগলো তিতুমীরের দলের ওপর। তিতুমীর ও তাঁর শিষ্যরা জমিদার বাড়ি ছেড়ে অগ্রসর হলেন গ্রামের দিকে। তারপর গ্রামের বারোয়ারি তলায় জবেহ করলেন একটি গরু। এভাবে তারা জমিদারের মসজিদ পোড়ানোর প্রতিশোধ নিতে চাইলেন। এর পর গ্রামের বাজার ও যেসব ধনী মুসলমান তিতুমীরের বিরোধিতা করেছিল তাদের বাড়ি তচনচ করে দিলেন।

আপোষের পথ শেষ—এখন লড়াই। কারণ ধনী ও গরিবের মধ্যে কোন আপোষ হতে পারে না। সুতরাং জমিদারের অত্যাচারের হাত থেকে যদি গরিব কৃষকদের বেঁচে থাকতে হয়. তাহলে লড়াই করতে হবে। পুঁড়া গ্রাম থেকে ফিরে তিতুমীর তাই ঘোষণা করলেন, তাঁর অঞ্চলে আর ইংরেজ শাসন চলবে না। সুতরাং জমিদারদের এখন তাঁকেই খাজনা দিতে হবে।

জমিদাররা একজোট হলেন ভয় পেয়ে। সঙ্গে যোগ দিল স্থানীয় নীলকররা। কারণ এমনিতেই তারা জমিদারদের বন্ধু। তাছাড়া তাদের ভয়, তিতুমীরের কারণে যদি নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এমনিতে তারাও তো কম অত্যাচার করেনি গরিব কৃষকের ওপর। সুতরাং তারা সবাই মিলে তোড়জোড় বাঁধতে লাগলেন তিতুমীরের বিরদ্ধে।

গোবরগঙ্গার জমিদার ছিলেন কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার লাটু বাবুকে লিখলেন তিনি সাহায্যের জন্যে। লাটুবাবু ‘দুশো হাবশী পাইক’ পাঠালেন। কালী প্রসন্নের নিজের ছিল চারশো পাইক, দুশো লাঠিয়াল ও কয়েকটি হাতী। সুতরাং কালী প্রসন্ন জানালেন তিতুমীরকে তিনি কর দেবেন না।

কালী প্রসন্নের সাহায্যে এগিয়ে এলেন মোল্লাহাটির নীলকুঠির ম্যানেজার ডেভিস। দুশো লাঠিয়াল ও বন্দুকধারী পাইকদের নিয়ে আক্রমণ করলেন তিনি তিতুমীরকে। ডেভিসের দল গ্রামে ঢোকা মাত্র তিতুমীরের দল ঘিরে ফেলে তাদের। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ডেভিসের দল পালিয়ে যায়। ডেভিস কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান।

গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার ছিলেন দেবনাথ রায়। তিনি আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছিলেন ডেভিস ও তার দলবলকে। সুতরাং তিতুমীরের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধল দেবনাথের। পাঁচশো লাঠিয়াল নিয়ে তিতুমীর আক্রমণ করলেন গোবরা-গোবিন্দপুর গ্রাম। লাউঘাটিতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হল দু’পক্ষের। দেবনাথসহ অনেকেই নিহত হলেন এ যুদ্ধে।

এই যুদ্ধের পর হু হু করে আশেপাশের অঞ্চলে তিতুমীরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে এসে যোগ দেয় তাঁর সঙ্গে। সবার মুখে এখন এক কথা-গ্রামের অত্যাচারীর জমিদার ও সাহায্যকারী ইংরেজদের শিক্ষা দিতে হবে। শুধু তাই নয়, ধনী হিন্দু-মুসলমান যেই তিতুমীরের বিরোধিতা করবে তাকেও রেহাই দেয়া হবে না।

তিতুমীর এর পর আবার তাঁর খাজনা দাবি করলেন। অনেক ধনী জোতদার তালুকদার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাল। তিতুমীর তখন প্রজাদের নির্দেশ দিলেন জমিদারকে খাজনা না দেয়ার। প্রজারাও সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল সেই নির্দেশ। বলা যেতে পারে, ঐ সময়, নদীয়া ও চব্বিশ

পরগণার বিরাট এক অংশে তিতুমীর স্থাপন করলেন মুক্ত অঞ্চল যেখানে জমিদার বা ইংরেজ শাসন অচল। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল আগে ধর্মীয় সংস্কারের জন্যে, তা এখন রূপ নিল জমিদারের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনে।

জমিদার ও নীলকররা নিরুপায় হয়ে তখন খবর পাঠাল কলকাতায়, কোম্পানী সরকারকে–আমাদের রক্ষা কর।

তিতুমীরের ব্যাপারে সব কিছু শুনেটুনে বিভাগীয় কমিশনার বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে হুকুম করলেন ঘটনাস্থলে যেতে। ১৪ নভেম্বর, ১৮৩১ সালে আলেকজান্ডার পৌঁছলেন বশিরহাট থানায়। বিশ্রাম নিলেন সেদিন। পরদিন, মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর। একজন হাবিলদার, একজন জমাদার ও কুড়িজন সিপাই নিয়ে রওয়ানা হলেন আলেকজান্ডার। এবার সঙ্গে আছে দারোগা রামরাম চক্রবর্তী। সকাল ন’টার দিকে আলেকজান্ডার দলবল নিয়ে এসে পৌঁছলেন বাদুড়িয়ায়। নারকেলবাড়িয়া সেখান থেকে ছ’মাইল। আবার মার্চ শুরু করলেন আলেকজান্ডার এবং দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছলেন নারকেলবাড়িয়া।

সিপাই নিয়ে যে আলেকজান্ডার রওয়ানা হয়েছেন, সে খবর আগেই পেয়েছিলেন তিতুমীর। সুতরাং প্রস্তুতই ছিলেন তিনি। পাঁচ-ছ’শো অনুচর নিয়ে তিনি অপেক্ষা করছিলেন নারকেলবাড়িয়ায়। দু’পক্ষ মুখোমুখি। আলেকজান্ডার কথা বলার জন্য এগোলেন একটু অমনি ইট পাটকেল পড়তে লাগলো বৃষ্টির মতো। পিছিয়ে গেলেন আলেকজান্ডার। দলবল নিয়ে এগোলেন তিতুমীর। আলেকজান্ডার তখন জমাদারকে হুকুম করলেন গুলি করার জন্যে। গুলি করল জমাদার। কিন্তু তিতুমীরের দলের কেউ নড়ল না একচুল। হঠাৎ আলেকজান্ডার দেখলেন খোলা তলোয়ার নিয়ে কে যেন ছুটে আসছে তার দিকে। বুক কেঁপে উঠল তাঁর। পেছনে ফিরে দেখলেন, তাঁর সেপাইরা সব পালাচ্ছে ভয়ে। আলেকাজান্ডার আর কি করেন, অনুসরণ করলেন তাদের। আর তিতুমীর ও তাঁর দল খোলা তলোয়ার নিয়ে ছুটল তাদের পিছু।

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছেন আলেকজান্ডার। সামনে পড়ল ভরভরিয়ার খাল। ঝাঁপিয়ে পড়লেন খালে কিন্তু তারপরই দেখলেন আটকে গেছেন কাদায়। কলিঙ্গা গ্রামের কয়েকজন তখন উদ্ধার করল তাকে। আবার দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছলেন বাদুরিয়া। সেখান থেকে নৌকো করে সন্ধের দিকে এসে পৌঁছলেন বশিরহাটের বাঘমুন্ডি নামে এক গ্রাম।

তিতুমীর আর এতদূর পর্যন্ত তাড়া করলেন না। তবে তারা ধরে ফেললেন রামরাম চক্রবর্তীকে এবং পুরনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তখনই হত্যা করা হল তাকে।

এর পর আর তিতুমীরকে রোখে কে? দলে দলে কৃষকরা এসে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিল। কিন্তু তিতুমীর জানতেন, ইংরেজ বা জমিদাররা এত সহজে ছাড়বে না। আবার ফিরে আসবে তারা এবং যখন আসবে তখন প্রস্তুত হয়ে দলে ভারী হয়েই আসবে। সুতরাং নিজেকে আরো প্রস্তুত ও সুরক্ষিত করে তোলা দরকার। আর নিজেকে সুরক্ষিত করতে হলে প্রয়োজন কেল্লার। সুতরাং তিতুমীর ঠিক করলেন নারকেলবাড়িয়ায় স্থাপন করবেন একটি কেল্লা। এই সিদ্ধান্তের ফলেই তৈরি হল বিখ্যাত ‘বাঁশের কেল্লা’ যা আমাদের কাছে এখনও সংগ্রামের প্রতীক।

ইট, পাথর ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর এবং মজবুত করে কেল্লা তৈরি করতে দরকার কয়েক বছরের। কিন্তু তিতুমীরের অত সময় কোথায় ?

তাই তিনি আদেশ দিলেন আশেপাশের গ্রাম থেকে বাঁশ যোগাড় করে আনতে। অনুচররা তাই আনল। তারপর বাঁশ ও মাটি দিয়ে তৈরি হল তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। কেল্লার মধ্যে তৈরি করা হল অনেকগুলো আলাদা আলাদা ঘর। এর কোনটিতে রাখা হল তলোয়ার, কোনটিতে বা লাঠি-সড়কি। এছাড়াও সংগ্রহ করা হলেন অনেক ইটের টুকরো ও বেল। এভাবে কেল্লা তৈরি করে তিতুমীর তৈরি হলেন পরবর্তী আক্রমণের জন্যে। তাঁর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করলেন ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে।

অন্যদিকে, নৌকো করে সুন্দরবন হয়ে ১৬ নভেম্বর বিকেলে আলেকজান্ডার পৌঁছলেন কলকাতায়। ইংরেজ কর্তাদের জানালেন বিপর্যয়ের খবর। কোম্পানী সরকার ভাবল, না বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মিলিটারী পাঠানো দরকার এবার। সঙ্গে সঙ্গে মেজর স্কট, ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড ও লেফটেনান্ট শেকসপীয়রের অধীন একদল অশ্বারোহী গোলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনী ঠিক করে পাঠানো হলেন নারকেলবাড়িয়ার দিকে। আর আলেকজান্ডার তাদের আগেই রওয়ানা হয়ে গেলেন সব বন্দোবস্ত ঠিকঠাক রাখতে।

ইংরেজ বাহিনী এগিয়ে আসছে নারকেলবাড়িয়ার দিকে। কিন্তু জমিদার ও নীলকররাও বসে নেই। তারাও ইতোমধ্যে জোট বেধেছে এবং ইংরেজরা পৌঁছার আগেই তিতুমীরের সঙ্গে তাদের একচোট লড়াই হয়ে গেল।

নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ ১৭ নভেম্বর ডেভিড এনড্রুজ নামে একজন নীলকর, চারজন সহকারী ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পৌঁছলেন বারঘরের নীলকুঠিতে। এর আগে, তিতুমীরের দল সেখানে স্টম নামে এক নীলকরের কুঠি আক্রমণ করে তচনচ করে দিয়েছিল। জমিদাররা তখন খবর পাঠিয়ে বলেছিল, ইংরেজরা যদি তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে চায় তবে তারা প্রস্তুত।

ইংরেজদের দেশী দালালরা তাদের খবর পাঠিয়ে জানাল তিতুমীরের দল তেমন ভারী নয় সুতরাং আক্রমণ করা যেতে পারে। সুতরাং নিশ্চিন্ত হয়ে স্মিথ, ডেভিড ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা পানসি থেকে নেমে হাতির পিঠে চড়ে তিতুমীরের খোঁজে বেরুলো। সঙ্গে তাদের প্রায় তিনশো লোক, বারো চৌদ্দটি দো-নলা বন্দুক। এভাবে প্রস্তুত হয়ে বারোঘর থেকে তারা যাত্রা শুরু করল নারকেলবাড়িয়ার দিকে। নারকেলবাড়িয়ার কাছাকাছি পৌঁছে তারা দেখল, অদূরে তিতুমীর ও তাঁর দলের বিরাট এক জমায়েত। সঙ্গে সঙ্গে তারা বুঝল, ব্যাপার সুবিধের নয়, দালালেরা তাদের ভুল খবর দিয়েছে। পালিয়ে যাওয়াটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। সুতরাং পালানোর জন্যে তারা পিছন ফিরল। ততক্ষণে তিতুমীরের দল ছুটছে তাদের পিছে। ধরা পড়ল স্মিথের দলের কয়েকজন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের কেটে ফেলা হলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে স্মিথ ও ডেভিড গিয়ে কোন রকমে উঠলেন তাদের পানসিতে। পানসিতে উঠে ফের তারা গুলি চালাতে লাগলেন তিতুমীরের দিকে। তারা গুলি ছুড়েন আর তিতুমীরের দলের লোকজন মাথা নিচু করে ফেলে, ফলে গুলি আর লাগে না। ইতোমধ্যে নীলকরদের বেশ কিছু লোকজনকে হত্যা করা হয়েছে। পানসি করে তখন স্মিথ আর ডেভিড তাড়াতাড়ি নদী পার হলেন। তারপর আরো মাইলখানেক দৌড়ে হাতিতে চড়ে পৌঁছলেন ডেভিডের নীলকুঠিতে। ডেভিডের তো প্রচুর ক্ষতি হলোই, এছাড়া তারা হারালো দুটি বজরা, একটি পানসি, কয়েকটি জেলেনৌকা ও ডিঙি, একটি হাতি এবং একটি পাকি। লোকলস্করের কথা বাদই দিলাম।

অন্যদিকে ১৮ নভেম্বর শুক্রবার, ভোরবেলায় আলেকজান্ডার ঘোড়সওয়ারদের একদল নিয়ে পৌঁছলেন বাদুরিয়ায়। সেখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড। তাঁকে নিয়ে রওয়ানা হলেন তিনি নারকেলবাড়িয়ার দিকে। পথে তিতুমীরের অনুচরদের সঙ্গে ছোট-খাট কিছু সংঘর্ষ হল তাদের। সাদারল্যান্ড তখন স্কটকে খবর পাঠালেন গোলন্দাজ বাহিনী পাঠাবার জন্যে। সন্ধ্যে পর্যন্ত নারকেলবাড়িয়াতেই দু’পক্ষের ছোট-খাট সংঘর্ষ হলো। তিতুমীরের প্রধান অস্ত্র ছিল ইটের টুকরো, বেল, তার প্রভৃতি। সন্ধ্যের সময় ইংরেজরা ফিরে গেল তাদের শিবিরে।

পরদিন ১৯ নভেম্বর, ১৮৩১ সাল। ভোরবেলায় ইংরেজ সৈন্যরা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ঘিরে ফেলল। শুরু হলো এবার সম্মুখ যুদ্ধ। কামান দাগতে লাগলো ইংরেজরা। আর কামানের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল বাঁশের কেল্লা। তিতুমীরসহ নিহত হলো প্রায় পঞ্চাশ জন আটশো জন হল বন্দী। আহতদের হিসাব জানা নেই। ধ্বংস হলো তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আর সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল গরিব রাজত্ব স্থাপনের এক প্রচেষ্টা। ইংরেজরা তিতুমীর ও তাঁর নিহত সঙ্গীদের মৃতদেহ তখুনি পুড়িয়ে ফেলল কারণ মৃতদেহ দেখে যদি কেউ আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

শেষ হল বাঁশের কেল্লার লড়াই। বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হলো কলকাতার আলীপুর আদালতে। প্রাথমিক শুনানীর পর অভিযুক্ত করা হলো সাড়ে তিনশো জনকে। দীর্ঘদিন বিচার চলার পর একশো চল্লিশ জনকে দেয়া হলো বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড। আর তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি, গোলাম মাসুমকে নারকেলবাড়িয়ার সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাঁশের কেল্লার সামনে দেয়া হলো ফাঁসি।

ব্যর্থ হল কেন তিতুমীরের বিদ্রোহ? সমস্ত ঘটনাটা খতিয়ে দেখলে হয়ত কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে আমরা যদি বর্তমান সময়ের মানদণ্ডে তিতুমীরকে বিচার করি তাহলে ভুল হবে। ঐ সময়ে, তিতুমীর ও তাঁর বাঁশের কেল্লা যে শোষিতের পক্ষে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল তা অস্বীকার করা যায় না।

তিতুমীর যখন বিদ্রোহ করেছিলেন তখন আমাদের দেশের লোকজনের রাজনীতি সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। কলকাতার ইংরেজি শিক্ষিত কিছু মধ্যবিত্ত বা ভদ্রলোকদের হয়ত কিছু ধারণা ছিল, কিন্তু তা খুবই সামান্য। আর আমরা তো দেখেছি ভদ্রলোকরা এসব বিদ্রোহ টিদ্রোহ খুব একটা পছন্দ করে না। তাই আমরা দেখি, তিতুমীর যখন গরিব কৃষকদের নিয়ে সংগ্রাম করছেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে তখন কলকাতার বাবু ভদ্রলোকরা নিজেদের নিয়ে মত্ত। এমনকি কলকাতার তখনকার খবর কাগজগুলোতেও এ বিষয়ে তেমন কোন সংবাদ ছাপা হয়নি।

তিতুমীর প্রথমে ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়েই আন্দোলন করেছিলেন। এ ধরনের আন্দোলনে কি হয় জান? সব কিছু একজনকে কেন্দ্র করেই চলে। সুতরাং মধ্যমণি নিহত হলে বাকিরা কি করবে ভেবে পায় না বা সংগ্রামকে চালিয়ে নিতে হবে সে কথাও মনে থাকে না। তিতুমীরের বেলায়ও তাই হয়েছিল।

এছাড়া তিতুমীর যেখানে বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেছিলেন তার আশেপাশে একশো বর্গ মাইলের মধ্যেও লুকোবার কোন জায়গা ছিল সোজাসুজি না। সুতরাং যুদ্ধের দিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয়, লড়াই করে তিতুমীর ভুল করেছিলেন। তবে একটা কথা বোধ হয় আমাদের মনে রাখা উচিত যে, লড়াইয়ে হারজিত আছেই। সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া, আজীবন !

এই লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে এই বইটি থেকে

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

১টি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88