ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হাজী শরীয়তউল্লাহর লড়াই

হাজী শরীয়তউল্লাহর জীবনী

রচনায়: মুনতাসীর মামুন

কিভাবে সুদূর গ্রেট ব্রিটেন থেকে একদল ব্যবসায়ী ভারতে ব্যবসা করতে এসে পুরো ভারতবর্ষের রাজা হয়ে গেল সে ইতিহাস তো তোমাদের সবার জানা। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ ১৬০০ সনের ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ‘দি গভর্নর এন্ড কোম্পানী অফ মার্চেন্টস অফ লন্ডন ট্রেডিং ইনটু দি ইস্ট ইন্ডিজ’কে অনুমতি দেন প্রাচ্যে বাণিজ্য করার।

১৬১৩ সনে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি দেন। ভারতে এসে প্রথমে কিন্তু কোম্পানী চেয়েছিল শুধু বাণিজ্য করতে এবং বাণিজ্যের অনুমতি ও অন্যান্য সুবিধা আদায়ের জন্যে মোগল সম্রাট, সুবাদার থেকে শুরু করে যখন যার দরকার তার কাছে দরবার করেছে, অপমানিত হয়েছে কখনো কখনো কিন্তু হাল ছাড়েনি। ধৈর্য হারায়নি। তাই দেখা গেল তাদের ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিপত্তি বেড়েই চলছে। তারপর ১৭৫৭ সনে কোম্পানীর এক সামান্য চাকুরে ক্লাইভ বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে, হয়ে বসলেন বাংলার কর্ণধার। সেই থেকে শুরু। পরবর্তী একশো বছরের মধ্যে দেখা গেল, ভারতবর্ষের অধিকাংশ তাদের পদানত। ভাবো একবার, ছোট্ট একটা কোম্পানী, সেই কিনা হয়ে গেল ভারতবর্ষের মতো এতবড় একটা দেশের মালিক। যা হোক, ১৮৫৮ সনে, সিপাহী বিদ্রোহের পর কোম্পানীর কাছ থেকে গ্রেট ব্রিটেনের রানী ভিকটোরিয়া গ্রহণ করলেন এ দেশের শাসনভার। কোম্পানীর রাজত্বের অবসান হলো তখন।

কোম্পানী আমলের আগে, সেই প্রাচীন যুগ থেকেই ভারতবর্ষের কাপড় ছিল বিশ্ববিখ্যাত। আমাদের এই ঢাকা শহরের কথাই ধর না কেন? এ শহরে তৈরী মসলিন পৃথিবীর কোথায় না যেত! কিন্তু তারপর?

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। শিল্প বিপ্লব কি জানো তো? শিল্প বিপ্লবের আগে ইংল্যান্ড ছিল আমাদের দেশের মতই কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি নতুন কিছু আবিষ্কার ইংল্যান্ডের অর্থনীতিই বদলে দিল। ১৭৬৮ সনে জেমস ওয়াট আবিষ্কার করলেন বাষ্পচালিত ইঞ্জিন। এর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল তাঁতের উড়ন্ত মাকু। জ্বালানি হিসেবে কাঠের পরিবর্তে শুরু হল কয়লার ব্যবহার। ১৭৭৪ আর ১৭৭৬ সনে আবিষ্কৃত হল সুতাকাটার যন্ত্র ‘জেনি’ এবং ‘মিউল’। এসব কিছুর ফলে ইংল্যান্ডে স্থাপিত হতে থাকে একটির পর একটি কল-কারখানা। কল-কারখানায় তৈরী জিনিসপত্র দামে অপেক্ষাকৃতভাবে সস্তা। উৎপাদনও বেশি করা সম্ভব। সুতরাং কিছু দিনের মধ্যে দেখা গেল ইংল্যান্ডের তৈরী জিনিসপত্রে বিদেশী বাজার ভরে উঠছে। আর ইংল্যান্ড দিন দিন ধনী হচ্ছে। একেই বলে শিল্প বিপ্লব।

কিন্তু ভারতের তাঁতের তৈরি কাপড়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডের কলে তৈরি কাপড় প্রতিযোগিতায় পারত না। কোম্পানী দেখল, নিজেদের বাণিজ্য বাড়াতে হলে, ভারতের কাপড় তৈরি বন্ধ করতে হবে। সুতরাং তারা তাই করল। ইংল্যান্ডে ভারতীয় কাপড়ের ওপর চড়া হারে শুল্ক বসানো হল। তাঁতিদের ওপর শুরু হল কোম্পানী কর্মচারীদের অকথ্য অত্যাচার। শুধু কাপড়ের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও।

উদ্দেশ্য একটাই, নিজেদের জিনিসপত্র চালানো। তাই এক সময় দেখা গেল, ভারত রপ্তানিকারক দেশ থেকে পরিণত হয়েছে আমদানিকারক দেশে। তার ফলে কি হলো? ভারতে বেকার কারিগরদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। আর ভারত ক্রমেই হতে লাগলো দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে আরেকটি কাজ করেছিল যার কুফল এখনও আমরা ভোগ করছি। সেটি হচ্ছে জমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কোম্পানীর গভর্নর জেনালে লর্ড কর্ণওয়ালিস ১৭৯৩ সনে জমি-জমার ব্যাপারে এই আইন জারি করেন। এই আইনের আগে জমির ওপর কারো মালিকানা ছিল না। স্বত্ব ছিল শুধু চাষের। গ্রামের পঞ্চায়েত গ্রামের সব জমি দেখাশোনা করত। তারাই সরকারকে খাজনা দিত যৌথভাবে। জমিদার ছিল তখনও কিন্তু তাদের দায়িত্ব ছিল শুধু কর আদায় করা। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন অনুযায়ী জমিদারদের করে দেয়া হলো জমির মালিক। ঠিক হলো, বছরে তারা সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দেবে।

জমির মালিকানার এই পরিবর্তন আমাদের সমাজের পুরো ব্যবস্থাটাই পাল্টে দিয়েছিল। কিভাবে?

জমির মালিক জমিদার। একেকজনের জমিদারিও বিরাট। তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দেয় সরকারকে। কিন্তু কৃষকদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে আদায় করে আরো বেশি। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী বিভিন্ন রকম কর বসায় কৃষকদের ওপর। জমিদারের জামাই আসবে, খাজনা দাও। জমিদারের নাতির জন্মদিন, খাজনা দাও। এমনি হরেক রকমের খাজনা। না দিলে জমিদারের পোষা পাইক পেয়াদা লাঠিয়াল এসে জুলুম করে। এভাবে নানারকম কর আদায়ের ফলে, সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দিয়েও জমিদারের পকেটে প্রচুর টাকা থাকে। সুতরাং সে চলে যায় শহরে। গ্রামের খাজনা আদায়ের ভার দিয়ে যায় আরেকজনকে। সেও জমিদারকে অনুসরণ করে। জমিদার আর কৃষকের মাঝামাঝি এদের বলা হত মধ্যস্বত্বভোগী।

এদিকে আবার খাজনা দিতে না পারায় অনেক জমিদারের জমিদারি নিলামে উঠল। পুরনো অনেক জমিদারি ধ্বংস হয়ে গেল এভাবে। পুরনো জমিদারিগুলো কিনল কারা? প্রায় ক্ষেত্রেই শহরের ব্যবসায়ীরা যাদের সঙ্গে গ্রামের কোন সম্পর্ক নেই। জমিদারি কিনেই তারা খালাস। জমিদারি চালায় তাদের কর্মচারীরা। শহরে বসে নিয়মিত টাকা পেলেই তারা খুশী।

এদিকে গরিব কৃষক খেতে পারুক না পারুক তাকে খাজনা দিতে হয় নিয়মিত। আর যে বছর খরা বা বন্যা হয় সে বছর তো আর রক্ষা নেই। প্রায় সময়ই তাকে ঋণ করতে হয় মহাজন থেকে। বন্ধক দিতে হতো ঘর বাড়ি জমি। এভাবে সৃষ্টি হলো নতুন আরেক শ্রেণী–মহাজন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার জমিদার, মধ্যস্বত্বভোগী মহাজন–এরা কাজ-কর্ম কিছুই করে না কিন্তু কৃষকের রক্তজল করা টাকা পকেটে পোরে। তোমরা তো পরগাছা দেখেছ? এরা ছিল ঠিক সে রকম।

অন্যদিকে দেশ চালায় ইংরেজরা। সুতরাং অফিস-আদালতের ভাষা হয়ে গেল ইংরেজি। মোগল আমলে ছিল ফার্সি। হঠাৎ করে ইংরেজি চালু হওয়াতে অনেকের এতদিনের শিক্ষা-দীক্ষা সব জলে গেল। বিশেষ করে মুসলমানদের। তাদের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো দিন দিন। এদিকে ঝটপট যারা ইংরেজি শিখে নিল, বিশেষ করে হিন্দুরা, সরকারের দেয়া সুবিধা যেমন চাকরি-বাকরি তারাই পেল। এরা খুব ধনী না, গরিবও না। এদের বলা হত মধ্যবিত্ত। জমিদার, মধ্যবিত্ত সবাই কিন্তু আবার ইংরেজদের সমর্থন করত কারণ ইংরেজদের জন্যেই তো সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে টিকেছিল তারা। রাজত্ব চালাতে গেলে এ ধরনের খয়ের খাঁ দরকার। ইংরেজরা তা জানত এবং জেনে শুনেই করেছিল তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

বাকি রইল কৃষকরা। সমাজে যারা সব রকমের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, ফায়দা লুটছে তাদের অধিকাংশই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল এই অগণিত কৃষকের ওপর। কিন্তু সবচেয়ে অত্যাচারিত হতো কৃষকরা। আমরা ‘সোনার বাংলা’ বলে প্রায়ই একটি কথা বলে থাকি। আসলে কথাটা ভুল। বাংলাদেশ কখনও সোনার বাংলা ছিল না। এখানকার অধিকাংশ লোক কৃষক। কিন্তু সেই পুরনো আমল থেকে এ পর্যন্ত তারা দু’বেলা পেট পুরে ভালো করে খেতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। কৃষকের রক্ত চুষেই এখানকার শাসকরা নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে যুগযুগান্ত ধরে।

বাংলাদেশের কৃষকদের সহ্যশক্তি অসীম। কিন্তু সে সহ্যশক্তির বাধও মাঝে মাঝে ভেঙে গেছে যখন অত্যাচার হয়ে উঠেছে চরম। বিদ্রোহ করেছে তারা তখন শাসকের বিরুদ্ধে। অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে সারা বাংলা জুড়ে এরকম অনেক কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে, বড় হলে তার অনেক হয়ত তোমরা জানতে পারবে। তিতুমীরের বিদ্রোহ ছিল এরকম একটি বিদ্রোহ—অত্যাচারী জমিদার আর শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে।

ওয়াহাবী বিদ্রোহের কথা হয়ত তোমরা অনেকেই শুনেছ। উনিশ শতকে ভারত জুড়ে এ বিদ্রোহ হয়েছিল। ১৮৩১ সনে বারাসাতে তিতুমীর যে বিদ্রোহ করেছিলেন, তা ছিল তারই একটি অংশ। ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলন শুরু করেছিলেন রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ নামের একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

ওয়াহাবী আন্দোলন অবশ্য প্রথম শুরু হয়েছিল আরবদেশে। আবদুল ওয়াহাব নামে এক মুসলমান সংস্কারক এ আন্দোলন শুরু করেছিলেন দেখে এর নাম ওয়াহাবী আন্দোলন। ইসলাম ধর্মে যেসব সংস্কার, কুসংস্কার প্রবেশ করেছিল তা দূর করে ইসলাম ধর্মকে শুদ্ধ করে তোলাই ছিল এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য।

রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ যখন মক্কায় যান তখন এ আদেশ দীক্ষিত হন। ভারতে ফিরে এসে ১৮২০-২২ সন ভারতের নানা অঞ্চল ঘুরে তিনি তাঁর আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। বাংলাদেশের দু’জনের সঙ্গে তাঁর এ সময় পরিচয় হয় এবং দু’জনই সৈয়দ আহমদের আদর্শে ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন। এঁদের একজন মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, আরেকজন ফরিদপুরের ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবর্তক ও নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহ। অবশ্য এরা দু’জনই প্ৰথমে সৈয়দ আহমদের মত মক্কায় গিয়ে ওয়াহাবী আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

ওয়াহাবী আন্দোলনকে যদি আমরা শুধু ধর্মীয় আন্দোলন ভাবি তাহলে ভুল হবে। এর সঙ্গে অর্থনীতি, রাজনীতিও জড়িত। ওয়াহাবীরা চেয়েছিলেন ইংরেজ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে। ভারতবর্ষকে তাঁরা বলতেন ‘দারুল-হরব’ বা শত্রুর দেশ।

তিতুমীরের বিদ্রোহও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথমে কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে গোলযোগ শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপর দেখা গেল ব্যাপারটা শুধু ধর্মীয় থাকছে না বরং ধর্মের ব্যাপারটাই হয়ে গেল গৌণ। কারণ দেখ, তিতুমীর যখন বাঁশের কেল্লা স্থাপন করে লড়াই করছিলেন তখন তাঁর পক্ষে ছিল হিন্দু-মুসলমান চাষী কারিগর। আর তাঁর বিরুদ্ধে ছিল কারা? জমিদার আর তাদের সাহায্যকারী বন্ধু ইংরেজরা। লড়াই যখন শুরু হল তখন হিন্দু মুসলমান চাষী কারিগররা একই সঙ্গে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে লড়াই করেছিল শোষক ও শাসক ইংরেজ ও তাদের দালাল জমিদারদের বিরুদ্ধে।

হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীর এবং পরে দুদু মিয়া ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তাতে একটা ধারাবাহিকতা আছে যদিও লড়াইগুলি হয়েছিল বাংলার দুই অঞ্চলে।

এখানে ধারাবাহিক ভাবে এই তিনজন লড়াকু বীরের জীবন ও সংগ্রামের কাহিনী বর্ণনা করব।

মাদারীপুর এখন একটি জেলা। এক সময় মাদারীপুর ছিল ফরিদপুর জেলার একটি মহকুমা। মাদারীপুরের এক ছোট্ট গ্রাম শ্যামাইল। সেই গ্রামের এক তালুকদার — আবদুল জলিল তালুকদার। আগে যাদের অনেক জমিজমা-ভূসম্পত্তি ছিল। তাদের অনেকেরই উপাধি ছিল তালুকদার। কিন্তু তালুকদার হলেই যে বড়লোক হবে এমন কথা নেই। এক সময়ে ধনী ছিল হয়তো, পরে অবস্থা পড়ে গেছে—এমন তালুকদারও অনেক ছিলেন। আবদুল জলিলেরও অবস্থা ভালো ছিল না। যা রোজগার করতেন তা দিয়ে কোনরকমে সংসার চলে যেত। এই আবদুল জলিলের ঘরে ১৭৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন শরীয়তউল্লাহ।

শরীয়তউল্লাহ যখন নেহাৎ শিশু তখন তাঁর মা মারা যান। তাঁর বয়স যখন মাত্র আট তখন তাঁর বাবাও পরলোকগমন করেন। একেবারে এতিম হয়ে গেলেন শরীয়তউল্লাহ। তাছাড়া তাঁকে দেখাশোনা করার জন্য তাঁর কোনো বড় ভাই বা বোনও ছিলেন না। তখন চাচা আজিমউদ্দিন শরীয়তউল্লাহর ভার গ্রহণ করেন। আজিমউদ্দিনের কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। সুতরাং চাচার পরিবারে অতি আদরে মানুষ হতে লাগলেন শরীয়তউল্লাহ। প্রায় সবসময়ই তিনি খেলাধুলা করে, ঘুরেফিরে বেড়াতেন। ইচ্ছে হলে মাঝে-মাঝে কেতাবের পাতা উল্টেপাল্টে দেখতেন।

যখন তাঁর বয়স বারো তখন কি কারণে যে চাচা তাঁকে বকুনি দিয়েছিলেন। অভিমানে গ্রাম ছেড়ে সোজা শরীয়তউল্লাহ চলে গেলেন কলকাতায়। সময়টা তখন ১৭৯৩ সাল। আর বাংলাদেশ শাসন করছে ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

কলকাতায় তো আর আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই শরীয়তউল্লাহর আশ্রয়ের খোঁজে এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়ে গেলেন কলকাতার এক বিখ্যাত মৌলানার, পণ্ডিতের। তাঁর নাম মৌলানা বারাসাত আলী। শরীয়তউল্লাহকে আশ্রয় দিলেন মৌলানা বারাসাত আলী। বারাসাত আলী শুধু যে বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন তাই নয়, শিক্ষক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। একটি স্কুল চালাতেন তিনি। শরীয়তউল্লাহকে তিনি ভর্তি করে দিলেন কুরআন শিক্ষার ক্লাসে।

কুরআন শিক্ষা শেষ হলে শরীয়তউল্লাহ ঠিক করলেন আরো পড়াশোনা করবেন। হুগলির ফুরফুরার তখন খ্যাতি ছিল আরবি-ফার্সি শেখার কেন্দ্র হিসেবে। শরীয়তউল্লাহ চলে গেলেন ফুরফুরা। দু’বছরের মধ্যে মোটামুটি আয়ত্ত করে নিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষা।

মুর্শিদাবাদের নওয়াবের দরবারে কাজ করতেন শরীয়তউল্লাহর আরেক চাচা আশিক মিয়া। তিনিও ছিলেন সুপণ্ডিত। ফুরফুরায় পড়াশোনা শেষ করে শরীয়তউল্লাহ চলে গেলেন মুর্শিদাবাদের তাঁর চাচার কাছে। সেখানেই তিনি আরবি-ফার্সি ভাষার চর্চা করতে লাগলেন। প্রায় এক বছর তিনি ছিলেন সেখানে। এরপর তাঁর চাচা ঠিক করলেন শরীয়তউল্লাহকে নিয়ে বাড়ি যাবেন। সেই মতো শরীয়তউল্লাহ তাঁর চাচা-চাচিসহ নৌকায় করে রওয়ানা হলেন ফরিদপুরের দিকে। মাঝপথে এক দুর্ঘটনায় নৌকা গেল ডুবে। শরীয়তউল্লাহ বেঁচে গেলেন কোনো রকমে। কিন্তু তাঁর চাচা-চাচির কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।

এ ঘটনা খুব নাড়া দিয়েছিল শরীয়তউল্লাহকে। তিনি আর বাড়ি গেলেন না। ফিরে এলেন কলকাতায়। দেখা করলেন তাঁর পুরানো শিক্ষক বারাসাত আলীর সঙ্গে।

কোম্পানি বা ইংরেজ শাসনের প্রতি মৌলানা বারাসাত আলী তখন খুব বিরক্ত। ইংরেজ শাসনের অধীনে তিনি বসবাস করতে চাচ্ছিলেন না। ঠিক করেছিলেন চলে যাবেন ইসলামের পবিত্র কেন্দ্র মক্কায়। বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন সেখানে। শরীয়তউল্লাহ কথা শুনে মৌলানা বারাসাত আলীকে অনুরোধ জানালেন তাঁকে সঙ্গে নেয়ার জন্য। রাজি হলেন তিনি। তারপর ১৭৯৯ সালের একদিন গুরু-শিষ্য মিলে রওয়ানা হলেন মক্কার দিকে।

শরীয়তউল্লাহ যখন মক্কায় যান তখন তাঁর বয়স মাত্র আঠারো। মক্কায় তিনি ছিলেন প্রায় উনিশ বছর। মক্কায় তিনি কী করেছিলেন, কীভাবে দিন কাটিয়েছিলেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় নি। এটুকু শুধু জানা গেছে যে, মক্কায় গিয়ে তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন মৌলানা মুরাদ নামে এক ভদ্রলোকের কাছে। মৌলানা মুরাদ ছিলেন বাঙালি কিন্তু বসবাস করতেন মক্কায়। শরীয়তউল্লাহ দু’বছর তাঁর কাছ থেকে আরবি সাহিত্য ও ইসলামী আইন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য এ দু’বছরের কার্যক্রম তাঁকে সাহায্য করেছিল।

মওলানা মুরাদের কাছে শিক্ষা লাভের পর গেলেন তিনি তাহির সমবলের কাছে। তাহির সমল ছিলেন সে-আমলের নামকরা পণ্ডিত, ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ। অনেকে তাঁকে বলতেন ছোট আবু হানিফা। ইসলামী বিষয়ে এক মহাপণ্ডিত ছিলেন আবু হানিফা। হাজী শরীয়তউল্লাহর অনুসারীরা তাহির সমবলকে ওস্তাদ মানেন, অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। একজন সুফী-সাধক হিসেবেও খ্যাতি ছিল তাহির সমবলের। হজরত আবদুল কাদির জিলানীর অনুসারী ছিলেন তাহির সমবল।

মক্কায় ধর্মীয় বিষয় শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন তাহির সমবল। হাজী শরীয়তউল্লাহ চৌদ্দ বছর তাহির সমবলের কাছে ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশোনা করেন। বলা হয়ে থাকে, তাহির সমবলের আদি বাড়ি রোহিলাখণ্ডের মুরাদাবাদ জেলার সমবল শহরে।

যা হোক চৌদ্দ বছর তাহির সমবলের অধীনে পড়াশোনা করার পর শরীয়তউল্লাহর মনে হল ইসলামের আরো উচ্চপর্যায়ের মূলগুলো জানা দরকার, এজন্য উপযুক্ত স্থান হল বিশ্ববিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। মিসরের রাজধানী কায়রোতে অবস্থিত আল আজহার। শুধু আরবজগতে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও খ্যাতি ছিল আল আজহারের।

শরীয়তউল্লাহ অনুমতি চাইলেন তাহির সমবলের। উদ্দেশ্য, আল আজহারে ‘হিকমত’ বা ‘দর্শন’ নিয়ে পড়াশোনা করার। তাহির সমবলের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না যে, শরীয়তউল্লাহ ‘হিকমত’ নিয়ে পড়াশোনা করেন। কারণ, দর্শন পড়ে যদি তিনি যুক্তিবাদী হয়ে পড়েন তা হলে যে ধর্মীয় শিক্ষা এতদিন গ্রহণ করেছেন তাতে ফাটল ধরতে পারে। কিন্তু যা হোক তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন।

আল আজহারে শরীয়তউল্লাহ নিয়মিত কোনো শিক্ষাক্রমে ভর্তি হয়েছিলেন কিনা জানা যায় নি। তবে জানা যায়, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে তিনি নিয়মিত পড়তে যেতেন। অনেকটা সময় কাটাতেন। আল আজহারে কিছুদিন কাটাবার পর শরীয়তউল্লাহ ঠিক করলেন দেশে ফিরবেন। অনেক দিন তিনি দেশের বাইরে। তাই হয়তো দেশে ফেরার জন্য মন টানছিল তাঁর। এছাড়া মনে তাঁর আরেকটি ইচ্ছা ছিল। তা হল দেশে ফিরে ইসলাম সম্পর্কে প্রচার করার।

ওস্তাদ তাহির সমবলের কাছে অনুমতি চাইলেন তিনি দেশে ফেরার। তাহির সমবল চাচ্ছিলেন না, তখনি শরীয়তউল্লাহ দেশে ফিরে যান। তাঁর ইচ্ছা ছিল, শরীয়তউল্লাহ আরো কিছুদিন মক্কায় থেকে ধর্ম বিষয়ে পড়াশোনা করুক। কিন্তু শরীয়তউল্লাহ মন ঠিক করে ফেলেছেন—তিনি দেশে ফিরবেনই। ১৮১৮ সালে দীর্ঘ কুড়ি বছর পর মক্কা থেকে তিনি রওয়ানা হলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরের দিকে।

মক্কা থেকে ফরিদপুর ফেরার পথে এবং পরে কিছু ঘটনা ঘটেছিল শরীয়তউল্লাহকে ঘিরে। ঘটনাগুলো সত্যি না গল্প সে সম্পর্কে অবশ্য সঠিক কিছু বলা যাবে না। তবে, গল্পগুলো লোকের মুখে মুখে এতদিন পরও টিকে আছে।

এ ধরনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন জেমস ওয়াইজ। পূর্ব বঙ্গের ওপর তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত বইয়ে উল্লেখ আছে ঘটনাটির। তিনি বলছেন, বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতের হাতে পড়েন শরীয়তউল্লাহ। তারা তাঁর বইপত্র থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু লুট করে নেয়। টাকা-পয়সার ব্যাপারে শরীয়তউল্লাহর আক্ষেপ ছিল না। তাঁর দঃখ হয়েছিল বইপত্র হারিয়ে। কারণ তখন তো আর এখনকার মতো এত বইপত্রের ছড়াছড়ি ছিল না যে, চাইলেই পাওয়া যাবে। তিনি ভেবে দেখলেন, এসব ছেড়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে। শরীয়তউল্লাহর সরলতা, ধর্মবোধ কিছুদিনের মধ্যেই ডাকাতের মধ্যে পরিবর্তন আনল। ডাকাতি ছেড়ে তারা অনুসারী হল শরীয়তউল্লাহর। আর তিনি অনুসারী পেয়ে নেমে পড়লেন ধর্ম প্রচারে। ওয়াইজ সাহেবের লেখা এ গল্প অবশ্য বিশ্বাস করা শক্ত।

দ্বিতীয় গল্পটি এরকম—ফরিদপুর আসার পথে তিনি মুঙ্গের জেলা অতিক্রম করছিলেন। মুঙ্গের হলো বিহারে। সেখানে তিনি দেখলেন, মুসলমানরা আসল ধর্মকর্ম কিছুই জানে না। বিভিন্ন সংস্কারে তাদের মন ভরা। এসব দেখে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। সেখানে কিছুকাল থেকে তিনি মুসলমানদেরকে ধর্মকর্ম শিক্ষা দিলেন এবং তারপর এলেন ফরিদপুরে। কিন্তু শরীয়তউল্লাহ ফরিদপুর আসার পথে মুঙ্গেরে ধর্ম প্রচার করেছিলেন এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি।

তৃতীয় গল্পটাতে বরং মনে হয় কিছু সত্য আছে। ঘটনাটি এরকম—মক্কা থেকে সোজা শরীয়তউল্লাহ এলেন মাদারীপুরে তাঁর নিজের গ্রামে। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় ইয়া বড় পাগড়ি। পরনে আলখাল্লা। গ্রামের লোকজন তো কেউ তাঁকে চিনতে পারে না। এত বছর পরে চিনতে পারার কথাও নয়। শরীয়তউল্লাহ দেখা করবেন তাঁর চাচা আজিমউদ্দিনের সঙ্গে। এর মধ্যে মগরেবের নামাজের সময় হয়ে গেছে। শরীয়তউল্লাহ আজান দিলেন। এদিকে তাঁকে দেখার জন্য ভিড় জমে গেছে। সারা গ্রামে রটে গেছে মক্কা থেকে এক হাজী সাহেব এসেছেন শ্যামাইল গ্রামে। আজান দেওয়ার পর শরীয়তউল্লাহ দেখলেন নামাজ পড়ার জন্য কেউ এলেন না। তিনি একাই নামাজ পড়লেন।

শরীয়তউল্লাহর চাচা তখন খবই অসুস্থ। একেবারে মৃত্যুশয্যায়। শরীয়তউল্লাহ নামাজ সেরে বাড়িতে ঢুকলেন চাচাকে দেখার জন্য। চাচাও ভাতিজাকে প্রথমে চিনতে পারেন নি। পরিচয় দেওয়ার পর চিনলেন। বললেন, এবার তিনি নিশ্চিন্তে মরতে পারবেন। কারণ, তাঁর কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। তাঁর মৃত্যুর পর কে দেখবে পরিবার- পরিজনকে! শরীয়তউল্লাহকে তিনি বললেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের দেখাশোনার ভার যেন শরীয়তউল্লাহই নেন। সেদিন রাতেই মারা গেলেন আজিমউদ্দিন।

পরের দিন কবর দেওয়ার সময় তিনি অবাক হলেন। মুসলমানরা দাফনের সময় যেসব নিয়ম-কানুন মানে তার অধিকাংশই মানা হচ্ছে না। শরীয়তউল্লাহ অবাক হলেন, দুঃখও পেলেন। সেদিন থেকে ঠিক করলেন, বাংলার মুসলমানদের মনের অজ্ঞতা, কুসংস্কার দূর করতে হবে। আসল ইসলাম ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেদিন থেকে প্রচারে বেরিয়ে পড়লেন শরীয়তউল্লাহ।

এই প্রচারের সময়ই শরীয়তউল্লাহ তাঁর ভাবনাগুলো গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন। পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজটা কী রকম? কী প্রচার করা উচিত? প্রথম দিকে তিনি শুধু জোর দিয়ে বলতে লাগলেন, মুসলমানদের আর কিছু না হোক ‘ফরয’ বা অবশ্যপালনীয় কর্তব্যগুলো পালন করা উচিত। এ ‘ফরয’ শব্দটি থেকেই এসেছে ‘ফরাযী’ শব্দটি। পরে যখন শরীয়তউল্লাহর মতবাদ আন্দোলনে পরিণত হলো তখন এই আন্দোলন পরিচিত হয়ে উঠল ‘ফরায়েযী আন্দোলন’ নামে। আর এই আন্দোলনের অনুসারীদের বলা হতে লাগল ‘ফরায়েযী’। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে শরীয়তউল্লাহ বুঝলেন—না, কোনো কাজ হচ্ছে না৷ তাঁর মতামত তেমন গুরুত্ব সহকারে কেউ নিচ্ছে না। তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়লেন। ঠিক করলেন আবার ফিরে যাবেন মক্কায়।

শরীয়তউল্লাহ মক্কা ফিরে গিয়েছিলেন ১৮১৮ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে। এ সম্পর্কে নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করা মুশকিল। কারণ শরীয়তউল্লাহ সম্পর্কে নথিপত্রের অভাব। যা হোক, বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে যে ঐ সময়ই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন মক্কায়। অনেকের বিশ্বাস এ সময় তিনি ওয়াহাবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসেন।

ফরায়েযীদের অনেকে বলেন, প্রথমবার মক্কা থেকে দেশে ফেরার সময় শরীয়তউল্লাহ তাঁর শিক্ষকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন নি। শিক্ষক এতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং সে কারণেই তিনি প্রথমবার পূর্ব বাংলায় তাঁর মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপর, একদিন তিনি স্বপ্ন দেখলেন রসূল তাঁকে আবার বলছেন, তাঁর দেশে ফিরে গিয়ে ধর্ম প্রচার করতে। তিনি তখন আবার ফিরে এসেছিলেন ফরিদপুরে।

উপরের ঘটনা কতটা সত্য, কতটা কাহিনী তা বলা মুশকিল। শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, যা আমরা অনুমান করে নিতে পারি, খানিকটা হতাশ হয়েই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন মক্কায়। সেখানে ওয়াহাবীদের সংষ্পর্শে এসে তিনি হয়তো আবার উৎসাহিত হয়ে ফিরে আসেন ধর্ম প্রচার করার জন্য। সে কারণে, আমরা দেখি, দ্বিতীয়বার তিনি বেশি দিন থাকেন নি মক্কায়। ১৮২০-২১ সালের দিকেই ফিরে এসেছিলেন দেশে এবং এবার ফেরার পথে তাঁর ওস্তাদ তাহির সমবলের কাছ থেকে বিদায় নিতে ভোলেন নি। তাঁর গুরু এবার তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন।

শরীয়তউল্লাহর দ্বিতীয়বার ফিরে আসাটাকেই ফরায়েযীরা বেশি গুরুত্ব দেন। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে ফরায়েযী আন্দোলন শুরু হয়েছিল বাংলা ১২২৭ সনে বা ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে।

কী করতে চেয়েছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ? তাঁর মতবাদটাই-বা কী? তিনি চেয়েছিলেন, ইসলাম ধর্মকে শুদ্ধ করে তুলতে। সে জন্য তিনি মুসলমানদের কিছু ‘ফরয’ মানার কথা বলতেন। ‘ফরয’ মানে কর্তব্য, আগেই বলেছি।

কিন্তু ইসলাম ধর্মকে শুদ্ধ করার অর্থ কী? এদেশে তখন ইসলাম ধর্মের ভিতরে লৌকিক এবং হিন্দু ধর্মের অনেক রীতিনীতি প্রবেশ করেছিল। এর একটি কারণ, বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক ছিলেন নিরক্ষর। গ্রামে থাকতেন, চাষবাস করতেন। ধর্ম নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। মোল্লা-মৌলভী যাঁরা ছিলেন তাঁরাও ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না! জেমস ওয়াইজ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, একবার ঢাকার কাছে, নদী তীরে এক গ্রামের লোকেরা ঈদের নামাজ পড়ার জন্য জড়ো হয়েছেন কিন্তু কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না। কারণ, তাঁরা কেউ-ই জানতেন না কীভাবে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। এমন সময় নৌকা করে ঢাকা থেকে শিক্ষিত এক মুসলমান যুবক যাচ্ছিলেন। নৌকা থামিয়ে, তাঁকে নামিয়ে, তাঁর ইমামতিতে ঈদের নামাজ পড়া হয়েছিল। ঘটনাটি খুব বেশি আগের নয়। এক শ’ সোয়া শ’ বছর আগের ঘটনা। এক কথায় মুসলমানরা সংস্কার-কুসংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন না। শরীয়তউল্লাহ ওইসব রীতিনীতিকে অনৈসলামিক—অর্থাৎ ইসলামের বরখেলাপ বলে ঘোষণা করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, গুনাহ্ বা পাপ দু’রকম। বেদাত ও শেরক। কবরপূজা, পীরপূজা, সেজদা দেওয়া এগুলোকে তিনি ঘোষণা করলেন শেরক হিসেবে। কারণ ইসলামে কবরপূজা, পীরপূজা অনুমোদনীয় নয়। আর বেদাত কি? বললেন তিনি, মহররমে মাতম করা, গাজী কালু, খাজা খিজিরের আরাধনা বা পঞ্চপীরের গুণ গাওয়া—এগুলো বেদাত। এখনও অনেক জায়গায় গাজী কালু, খাজা খিজিরের আরাধনা করা হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই করে। কিন্তু ইসলাম মানলে বা এর অর্থ বুঝলে এগুলো করা যায় না। ‘পীর’, ‘মুরিদ’- -এ শব্দগুলোও তিনি পছন্দ করতেন না। কারণ পীর অর্থে বোঝায় প্রভু আর মুরিদ অর্থে অনুগত শিষ্য। শরীয়তউল্লাহ বললেন, মুসলমানদের মধ্যে তো প্রভু থাকতে পারে না। তাঁর শিষ্যদের তিনি ‘পীর’ শব্দের বদলে ‘ওস্তাদ’ এবং ‘মুরিদ’ শব্দের বদলে ‘সাগরেদ’ ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ওস্তাদ মানে শিক্ষক আর সাগরেদ হল গিয়ে ছাত্র।

এ তো গেল ধর্মের দিক। এবার অন্যদিকের কথাও আলোচনা করা যাক। ওই সময় জমিদাররা অন্যায়ভাবে প্রজাদের কাছ থেকে নানারকম কর আদায় করতেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ কৃষক ছিলেন মুসলমান। কিন্তু হিন্দু জমিদাররা পূজোর সময়ও তাদের কাছ থেকে জোর-জবরদস্তি করে নানারকম খাজনা আদায় করতেন। যেমন— দুর্গা পূজার সময় ‘দুর্গা বৃত্তি’, কালী পূজার সময় ‘কালী বৃত্তি’ ইত্যাদি। শরীয়তউল্লাহ তাঁর অনুসারীদের মানা করে দিলেন সেসব কর দিতে। অনেক হিন্দু জমিদার আবার কোরবানীর সময় তার এলাকায় মুসলমান প্রজাদের কোরবানী দিতে দিতেন না। শরীয়তউল্লাহ তাঁর সাগরেদদের নিয়ে কোরবানী দেওয়া শুরু করলেন। জমিদারদের সঙ্গে শুরু হল বিরোধ।

পুরনো কথায় ফিরে আসি আবার। মক্কা থেকে দেশে ফিরে শরীয়তউল্লাহ ইসলাম ধর্মের অনাচারগুলো দূর করার জন্য প্রচারে নেমে পড়লেন। ঢাকার ইংরেজ প্রশাসক জেমস টেলর ছিলেন তাঁর সমসাময়িক। টেলরের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, শরীয়তউল্লাহর মতবাদ এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল যে বলার নয়। দলে দলে মুসলমানরা তাঁর অনুসারী হতে শুরু করলেন। ঢাকা ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের মুসলমানদের ছ’ ভাগের এক ভাগ লোক হয়ে গেলেন তাঁর সাগরেদ। ঢাকা শহরে তো কথাই নেই। সে সময় ঢাকা শহরে যেসব মুসলমান বাস করতেন তাঁদের তিন ভাগের এক ভাগই ছিলেন ফরায়েযী মতবাদ বা শরীয়তউল্লাহর অনুসারী।

শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এ আন্দোলন আরো ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ সালের মধ্যে জে.ই. গ্যাসট্রেল ফরিদপুর, যশোর ও বাখরগঞ্জে জরিপ কাজ চালাচ্ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ঐ সব এলাকাগুলোতেও ফরায়েযী আন্দোলন আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। শুধু তাই নয়, ত্রিপুরার মতো এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল এ আন্দোলন।

জলা-জঙ্গলে ভরা পূর্ব বাংলার নিরক্ষর মানুষের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলে সফল হয়েছিলেন শরীয়তউল্লাহ। তিনি অশিক্ষিত মুসলমানদের বোঝাতে পেরেছিলেন যে তাদের জীবনযাপন-রীতির মধ্যে কোনটি কুসংস্কার। তাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর সাদাসিধে সরল জীবনযাপনও মানুষকে আকর্ষণ করেছিল। তাঁর অনুসারীরা বিপদে-আপদে সব সময় ছুটে যেতেন তাঁর কাছে উপদেশ নিতে। তিনি ছিলেন তাঁদের পিতৃতুল্য।

শরীয়তউল্লাহ যে একেবারে নির্বিঘ্নে তাঁর মতবাদ প্রচার করতে পেরেছিলেন তা নয়। হিন্দু জমিদার, পুরনো ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী মুসলমানরা তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন।

১৮৩১ সালেই এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ওই বছর শরীয়তউল্লাহ ও তাঁর অনুসারীদের নামে মামলা করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল রামনগর গ্রামের শরীয়তউল্লাহর সাগরেদরা তাঁদের মতবাদ প্রচার করছিলেন, কিন্তু পুরানা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী মুসলমানরা এতে বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ মামলায় ফরায়েযী নেতাদের একবছরের কারাদণ্ড ও দুশো টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল। শরীয়তউল্লাহর বিরুদ্ধে অবশ্য কোনো কিছু প্রমাণ করা যায় নি।

অন্যদিকে ধনী হিন্দু-মুসলমান, বিশেষ করে হিন্দু জমিদারদের কথা ধরা যাক। শরীয়তউল্লাহ তাদের অনেক অন্যায় মেনে নিতে মানা করেছিলেন ফরায়েযীদের। শুধু তাই নয়, আগেই উল্লেখ করেছি, কোরবানী দেওয়াও শুরু করেছিলেন। জমিদাররা দেখলেন, কৃষকরা যদি সবাই একজোট হয় তা হলে তাদের অন্যায়-অত্যাচার কৃষকরা মেনে নেবেন না। সুতরাং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে এদের বাধা দিতে হবে এবং এ ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান জমিদার বা ধনীদের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না এবং সেটাই স্বাভাবিক, কারণ উভয়েরই স্বার্থে ঘা লেগেছে।

এ ধরনের একটি বড়সড় বিবাদ হয়েছিল নয়াবাড়িতে। নয়াবাড়ি ঢাকার কাছেই। সেখানে শরীয়তউল্লাহর অনেক অনুসারী ছিলেন। নয়াবাড়িতে শরীয়তউল্লাহ প্রায়ই আসতেন। সে জন্য তাঁর সাগরেদরা সেখানে তাঁর জন্য একটি আস্তানা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এর ফলে ফরায়েযী মতবাদ প্রচারের এক প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল নয়াবাড়ি, এখানেও ফরায়েযীদের সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছিল জমিদারদের।

জমিদারদের অন্যায় খাজনা বন্ধ করে দেওয়া ও কোরবানীর ঈদে কোরবানী দেওয়া স্থানীয় হিন্দু জমিদার ও ধনীদের ক্রুদ্ধ করেছিল। কলকাতার এক কাগজে তো একজন লিখেছিলেন যে, ফরায়েযীদের জ্বালায় আর দেশে থাকা যাবে না। শরীয়তউল্লাহ একক বাদশাহী কায়েম করতে চান। প্রায় বারো হাজার তাঁতি তাঁর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়েছে। তাঁর অনুসারীরা দাড়ি রাখে, তহবন্দ পরে বা ধুতিকে লুঙ্গির মতো করে পরে। হিন্দু দেবদেবীর পূজোয় তাঁরা বাধা দিচ্ছেন। তাঁরা হিন্দুদের বাড়িঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় কোমরে চামড়ার বেল্ট পরে। শুধু তাই নয়। ঢাকা জেলার রাজনগরে দিওয়ান মৃত্যুঞ্জয় রায় বারোটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাও তাঁরা ভেঙে ফেলেছেন। ফরিদপুর আদালতের সব আমলা-মোক্তাররাও তাঁর সমর্থক। পত্রিকাটি আরো লিখেছিল, যেভাবে দিন দিন শরীয়তউল্লাহর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মনে হয় খুব শীঘ্রই দেশে হিন্দুধর্ম লোপ পাবে। শরীয়তউল্লাহ যা করছেন, তিতুমীর তার এক শ’ ভাগের এক ভাগও করেন নি। সুতরাং শরীয়তউল্লাহকে এখনই তিতুমীরের মতো দমন করা হোক।

এর দু’ বছর পর, ১৮৩৯ সালে ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর লিখেছিলেন, ফরিদপুর শহরে দাঙ্গাহাঙ্গামা করার জন্য শরীয়তউল্লাহকে কয়েকবার পুলিশ আটকে রেখেছিল এবং তারপর তাঁর ওপর পুলিশ কড়া নজর রাখতে শুরু করে। হাজী শরীয়তউল্লাহ তখন ঘোষণা করেন, হিন্দুদের পূজা-পার্বণে মুসলমানদের যোগ দেওয়া উচিত নয়। হিন্দু জমিদাররা বিভিন্ন পূজার জন্য মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। শরীয়তউল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা সেই খাজনা দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ ফারায়েযী আন্দোলন আর শেষে শুধু ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে থাকে নি এবং দিনকে দিন তা জমিদার ও কৃষক-প্রজার মধ্যে সংঘর্ষে রূপ নেয়।

ফরায়েযী আন্দোলন যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল তার বড় কারণ অর্থনীতি গবির কৃষকরা নানাভাবে নির্যাতিত হতো জমিদারদের হাতে। খেয়ে পড়ে শান্তিতে থাকাটাই হয়ে উঠেছিল কষ্টকর। শরীয়তউল্লাহ যখন এসব অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন তখন তারা একজন নেতা পেলেন যিনি তাদের স্বার্থ দেখবেন। ধর্মের ব্যাপারটা তখন আর মূল বিষয় থাকে নি।

১৮৪০ সালে মারা যান হাজী শরীয়তউল্লাহ। এরপর ফরায়েযী নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তাঁর ছেলে দুদু মিয়া।

দুদুমিয়ার সময় ফরায়েযী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। বলা যেতে পারে, হাজী শরীয়তউল্লাহ ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে ফরায়েজী আন্দোলনের শুরু করেছিলেন। আর তাঁর ছেলে দুদুমিয়া এ আন্দোলনকে করে তুললেন আরো জঙ্গী।

এই লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে এই বইটি থেকে

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

১টি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan