কবি গোলাম মোস্তফা এর জীবনী

রচনায়: বন্দে আলী মিয়া, আহমদ পাবলিশিং হাউস

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

যশোহর জেলার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে কবি গোলাম মোস্তফা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম কাজী গোলাম রব্বানী। পিতামহ কাজী গোলাম সরওয়ার। তিনি ছিলেন আরবী ও ফারসী ভাষায় সুপণ্ডিত।

এই পরিবারের আদি বাসস্থান ছিলো ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত পাংশা থানার অধীন নিবে-কৃষ্ণপুর। বিদ্যাচর্চার জন্য এই পরিবার পূর্ব হতেই প্রসিদ্ধ ছিলো। তারা নিয়মিত আরবী এবং ফারসী ভাষার চর্চা কতেন। বাংলা ভাষাতেও তাঁরা সুপণ্ডিত ছিলেন।

এই স্থানে তৎকালীন বঙ্গদেশের পল্লী অঞ্চলের কিছুটা পরিচয় দিচ্ছি। ফিরিঙ্গী সাহেবেরা গ্রামের মাঠে মাঠে নীলের চাষ করতো। মনোহরপুরের পার্শ্বেই বিজুলিয়া গ্রাম। সেই গ্রামে সাহেবদের নীলকুঠি ছিলো। সাহেবেরা জবরদস্তি করে গরীব চাষীর জমিতে নীলের চাষ করতো। উৎপীড়িত গ্রাম বাসিগণ সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে শেষ অবধি সাহেবদের এই অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। এই বিদ্রোহে কাজী গোলাম সরওয়ার সাহেব বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নির্যাতন এবং অন্যায়ের কাহিনী বর্ণনা করে একটি নীতিদীর্ঘ কবিতা রচনা করেছিলেন। এই কবিতাতে পল্লীবাসিগণ অন্তরে প্রেরণা লাভ করেছিলো। মোস্তফা সাহেবের পিতা কাজী গোলাম রব্বানীও গ্রাম্য কবিরূপে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তৎকালীন ‘বঙ্গবাসী’, ‘হিতবাদী’, ‘মিহির ও সুধাকর’ প্রভৃতি পত্রিকার তিনি গ্রাহক ছিলেন। নিয়মিতভাবে তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিলো। সান্ধ্য বৈঠকে সমবেত গ্রাম্য লোকজনের মাঝে তিনি সুর সংযোগে কাসাসুল আম্বিয়া, আমীর হামজা, অন্নদা মঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি পুঁথি পাঠ করতেন।

কবি গোলাম মোস্তফার হাতে খড়ি হয় চারি বৎসর বয়সে। গোলাম রব্বানী সাহেব নিজের বাটীতে এবং পার্শ্ববর্তী দামুকদিয়া গ্রামে পাঠশালা স্থাপন করেছিলেন। সেই স্থানে পাঠশালাতেই গোলাম মোস্তফার বিদ্যাশিক্ষার শুরু হয়। গ্রামের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশের মধ্যে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হতে থাকে।

এই স্থানে কিছুকাল বিদ্যা অর্জনের পরে গোলাম রব্বানী পুত্রকে নিকটবর্তী ফাজিলপুর গ্রামের পাঠশালাতে ভর্তি করে দেন। এই পাঠশালার দোর্দণ্ড প্রতাব পণ্ডিত ছিলেন ত্রৈলক্ষ্যনাথ দত্ত। তাঁর মতো রাশভারী পণ্ডিত সে কালে ছিলো না বললেই হয়।

দু’ বৎসর এই পাঠশালায় কেটে গেল। অতঃপর তাঁকে ভর্তি করা হলো শৈলকূপা হাইস্কুলে। নীচের ক্লাশ থেকেই তিনি পাঠ আরম্ভ করলেন। হিন্দু-মুসলমান নানা শ্রেণীর সহপাঠী বালকদের সহচর্যে তাঁর দিন কাটতে লাগলো।

বাৎসরিক পরীক্ষাতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করলেন। সেই থেকে প্রতি বৎসর বাৎসরিক পরীক্ষাতে তিনি উচ্চ স্থান অধিকার করতেন এবং প্রতিবার নানা প্রকার পুরস্কার লাভ করতেন।

তবে একবার একটি মজার কাণ্ড ঘটেছিলো। তিনি তখন থার্ড ক্লাশে। সামগ্রিকভাবে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে প্রতি বৎসর প্রথম পুরস্কার লাভ করেছেন। সুতরাং সেবারে বাৎসরিক পুরস্কারের দিনে তিনি যে প্রথম পুরস্কার পাবেন, ইহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু পুরস্কারের দিন যখন এলো, তখন হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কোনো পুরস্কারই তাকে প্রদান করা হবে না। কারণ অঙ্কে তিনি ফেল হয়েছেন–মাত্র নয় নম্বর প্রাপ্তি তার ভাগ্যে ঘটেছে। শিক্ষকেরা সেই হেতু সিদ্ধান্ত করেছেন, যে ছাত্র এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে, তাকে প্রথম পুরস্কার তো দুরের কথা, পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন পুরস্কারই তাকে প্রদান করা হবে না। সেই দিকে তিনি বঞ্চিত হলেন বটে তবে সদ্ব্যবহার (Good conduct), আবৃত্তি (Recitation), সঙ্গীত (Music) প্রভৃতি বিষয়ে পুরস্কার লাভ করলেন।

কাব্যের উন্মেষ :

মোস্তফা সাহেবের জন্মভূমি মনোহরপুর গ্রামটি সত্যই মনোহর। শৈলকূপা থেকে, ইহা দু’মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। শৈলকুপার পাদদেশ দিয়ে দক্ষিণ মুখে কুমার নদ বয়ে চলেছে। ঠিক তার পূর্ব তীরে মনোহরপুর গ্রাম। গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে সমান্তরাল ভাবে একটি সদর রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তার পূর্ব ধার ঘেসে মনোহরপুরের সুন্দর মাঠখানি শোভা পাচ্ছে। এই মাঠের একটি চমৎকার বর্ণনা কবি অন্যত্র দিয়েছেন। আমরা এখানে তা উদ্ধৃত করছিঃ

“রাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব দিগন্তের দিকে তাকালে দূরের কালো কালো গ্রামগুলি পুঞ্জিভূত স্বপ্নের মতো মনে হয়। ঐ মইষাভাঙা, ঐ পাইকপাড়া, ঐ ধল্লা, ওই বগুড়া—আরও কত কি নাম। যুগ যুগ ধরে গ্রামগুলি একই জায়গায় নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। কি যেন কি রহস্যের ছাপ ওখানকার তরুপল্লবে পুঞ্জিভূত হয়ে আছে। একবার ভাবি : কোন বিশ্বশিল্পী বড় বড় চিত্র একে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে রেখেছে। আবার ভাবি নীলাম্বরী শাড়ী পরা কোনো লাজুক পল্লীবধু ঘোমটা টেনে হয় ততা ওখানটায় দাঁড়িয়ে আছে। তার না দেখা যায় মুখ, না দেখা যায় পা। শুধু দেখা যায় সবুজ শাড়ী, আর জমিন ছোঁয়া কালো পাড়।

মাঠ আমাদের চমৎকার। ধান-পাট হয়, কলাই মশুরি হয়। শীত-গ্রীষ্মে শুকনো থাকে। বন্যায় ডুবে যায়। মেঘ-রৌদ্র, আলো-বাতাস আর পানি নিয়ে সব সময় তার খেলা। এই মেঠো বুড়ির কাণ্ডকারখানা দেখলে অবাক হতে হয়। চিরদিন সে সোনার ফসল ফলায় আর দু’হাতে তা সবাইকে বিলিয়ে দেয়।

মানুষ, গরু, পাখ-পাখালি–সবাইকে সে খেতে দেয় কাকেও বঞ্চিত করে না। তার ভাণ্ডার চির অবারিত। তার ক্ষেত-খামারের কোনো বেড়া নেই, সীমা-প্রাচীর নেই। মুক্তির কঠিন বন্ধনে তার চারি পাশ ঘেরা। বুড়ির এমনই কড়া শাসন যে, সেই মুক্তি-প্রাচীর পার হয়ে কোনো চোর-ডাকাতই তার সম্পদ লুঠ করতে আসে না। বুড়ি বেজায় হুশিয়ার। আদি কালে যখন গ্রাম মাঠ খাল বিল নদী নালার মধ্যে জমা জমির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গণ্ডগোল হলো, তখন বুড়ি একাই অনেক জায়গা দখল করে বসলো। দু’হাত দিয়ে গ্রামগুলিকে সরিয়ে দিয়ে বললো : দ্যাখ, এই আমার সীমানা। এই সীমানার এদিকে পা বাড়াবি তো ঠেঙিয়ে জব্দ করবো। গ্রামগুলো ভয়ে জড়সড় হয়ে সরে দাঁড়াল। বুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করবে কে। সেই যে সরে দাড়ল তো দাড়ালোই ! গ্রামগুলো সেই থেকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। বুড়ির জায়গা বেদখল করতে সাহস করে। বুড়িও মরে না, ওদের আশা পূর্ণ হয় না।

“এমনি সুন্দর গ্রাম আমাদের।”

এই গ্রামের দক্ষিণ ভাগে নদীর ধারে ছিলো মোস্তফা সাহেবের পৈত্রিক বসতবাটী। এই পরিবেশ তার মনের ওপরে প্রভাব বিস্তার করেছিলো। তা ছাড়া কাব্য উন্মেষের পরিবেশ তার নিজের বাড়ীতেই ছিলো। গোলাম রব্বানী সাহেব তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের নিকটে বিদ্যাসুন্দর পড়ে ব্যাখ্যা করতেন এবং সুর করে কিতাব পড়তেন, শিশু মোস্তফা তাহা নীরবে শুনতেন।

সে যুগে বিবাহ-সাদীর দাওয়াতপত্র কবিতায় লিখবার রেওয়াজ ছিলো। তিথি এবং মাস মিলিয়ে সুকৌশলে বিবাহের তারিখ কবিতাতেই লেখা হতো। শিক্ষিত লোকেরা এইরূপ ধরণের দাওয়াতপত্র লিখে দিবার জন্যে কবির পিতার নিকটে এসে অনুরোধ করতেন। এই সব পত্র লেখাও তিনি দেখতেন। এই রূপেই অলক্ষ্যে মোস্তফা সাহেবের মনে কাব্যের রঙ লেগেছিলো। ১৯১১ সালে তিনি যখন বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর (Class VIII) ছাত্র, সেই সময়ে তিনি একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মাবকাশ শেষে তিনি তার এক ছাত্র বন্ধুকে কবিতায় চিঠি লিখেছিলেন :

এস এস শীঘ্র এস ওহে ভ্রাতৃধন

শীতল করহ প্রাণ দিয়া দরশন।

ছুটি ও ফুরাল

স্কুলও খুলিল,

তবে আর এত দেরী কিসের কারণ।

‘মানময়ী গার্লস্ স্কুল’ রচয়িতা পরলোকগত রবীন্দ্রনাথ মৈত্র সেই সময়ে বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র।

পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং বন্ধুবর্গের প্রেরণায় গোলাম মোস্তফার অবরুদ্ধ কাব্য প্রবাহ ঝর্ণা প্রবাহের মতো বাহিরে আত্মপ্রকাশ করলো। সেই সময়ে ইউরোপ ভূখণ্ডে বলকান যুদ্ধ চলছিলো। তুরস্ক সেনা বাহিনী বুলগেরিয়ানদের হস্তে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ায় সমগ্র মুসলিম জাহানে একটা বিমর্ষতার ছায়া নেমে এসেছিলো। এমন সময়ে সহসা সংবাদ পাওয়া গেল, কামাল পাশা বুলগেরিয়ানদের নিকট থেকে ‘আদ্রিয়া নোপল’ পুনরুদ্ধার করেছেন। এই খবরে স্বজাতি বৎসল কিশোর কবির প্রাণ আনন্দে নেচে উঠলো। তিনি ‘অদ্রিয়া নোপল উদ্ধারে’ নাম দিয়া এক রাত্রির মধ্যে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখে ফেললেন। অতঃপর কবিতাটি তিনি ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে’ পাঠিয়ে দিলেন। পরবর্তী সপ্তাহে কবিতাটি মুদ্রিত হলো! উহার সূচনা ছিলো এইরূপ :

‘আজিকে প্রভাত কি বারতা নিয়ে

ধরায় আসিল নামিয়া’।

কবিতার ছন্দ, ভাব এবং প্রকাশ-ভংগী তখনকার দিনে সবই ছিলো নুতন। এই কবিতায় পাঠক মহলে তাই একটা সাড়া পড়ে গেল। বাংলার মুসলিম সমাজে যে একজন আধুনিক কবির আবির্ভাব হয়েছে, এ কথা সহজেই স্বীকৃতি লাভ করলো। গোলাম মোস্তফাও নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন। সেই থেকে তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে শুরু করলেন।

১৯১৩ সাল থেকে হিসাব করলে দেখা যাবে ১৯৬৩ সালে কবির কাব্য-জীবনের পঞ্চাশ বৎসর পূর্ণ হয়েছে। ১৯৬৩ সালের মে মাসে শৈলকূপা হাইস্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রবৃন্দ তাই কবিকে নিয়ে তার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছেন।

১৯১৬ সালে গোলাম মোস্তফা দৌলতপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তৎপর কলিকাতায় গিয়ে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৮ সালে উক্ত কলেজ থেকে বি-এ ডিগ্রী লাভ করেন। যশোহর নিবাসী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রিপন কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন। ‘পথের পাঁচালি’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে উত্তরকালে বিভূতিভূষণ বঙ্গ সাহিত্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।

চাকুরী জীবন :

বি.এ পাশ করার পরে গোলাম মোস্তফা অধিক দূর পড়াশুনা করবার সুযোগ পান নাই। অভাব-অনটনের জন্য তিনি চাকুরীর অন্বেষণ করতে বাধ্য হন। ১৯২০ সালে জানুয়ারী মাসে তিনি ব্যারাকপুর গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে শিক্ষকতা পদ গ্রহণ করেন। দুই বৎসর পরে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে তিনি বি টি ডিগ্রী লাভ করেন।

১৯২৪ সালে ব্যারাকপুর হাইস্কুল থেকে তিনি কলিকাতায় হেয়ার স্কুলে বদলি হয়েছিলেন। এই স্থানে তাঁর একাদিক্রমে নয় বৎসর কাল অতিবাহিত হয়। অতঃপর তিনি কলিকাতা মাদ্রাসায় বদলি হয়ে গেলেন। সেখান থেকে ১৯৩৫ সালে বালিগঞ্জ গভর্ণমেন্ট, ডিমনস্ট্রেশন হাইস্কুলে যোগদান করেন। এই স্থানে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে উন্নীত হন। কয়েক বৎসর এই স্থানে অবস্থানের পর উক্ত বিদ্যালয়েই প্রধান শিক্ষকের পদ লাভ করেন। এই স্থানে বলা আবশ্যক, কলিকাতার গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে তিনিই সর্ব প্রথম মুসলমান হেডমাষ্টার।

এই স্থানে কিছুকাল কার্য করার পরে তিনি বালিগঞ্জ থেকে বদলি হলেন হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৪০ সালে সেইস্থান হতে তিনি বদলি হয়েছিলেন বাঁকুড়া জেলা স্কুলে। সর্বশেষে ১৯৪৬ সালে তিনি বদলি হয়ে গিয়েছিলেন ফরিদপুর জেলা স্কুলে।

অবসর গ্রহণ :

চাকুরী জীবনে কাব্য ও সাহিত্য সাধনায় ব্যাঘাত ঘটছিলো, তাই তিনি অবসর গ্রহণের বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন। অতঃপর মনস্থির করে দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর চাকুরীর পরে ১৯৫০ সালে অবসর গ্রহণ করলেন। সরকারী নিয়মানুসারে তিনি আরও তিন বৎসর অথবা তদুকাল পর্যন্ত চাকুরী করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাহা করলেন না। অবসর গ্রহণের পরে তিনি তার ঢাকাস্থ শান্তিনগর বাসভবনে অবস্থান করতে লাগলেন।

সাহিত্য সাধনার ফল :

গোলাম মোস্তফার সাহিত্যিক অবদান মুসলিম বাংলার এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর দান সাহিত্যের নানা শাখায় পল্লবিত হয়ে আছে। তিনি যে কেবলমাত্র কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হয়েছেন তাহা নহে—সাহিত্যের বিবিধ বিভাগে তিনি দান করেছেন। খণ্ডকাব্য, মহাকাব্য, গীতি কবিতা, ছোটো গল্প, উপন্যাস, রস রচনা, তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা, কোরান শরীফের অনুবাদ, নব নব ছন্দ প্রবর্তন, ইখওয়ানুস শাফা, মুস:দ্দাস-ই-হঃলী, ইক্বালের অনুবাদ প্রভৃতি নানা দিকে গোলাম মোস্তফার দান স্বীকৃতি লাভ করেছে।

তিনি সুকণ্ঠ গায়করূপেও জনসমাজে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। হারমোনিয়াম, পিয়ানো এবং অর্গান বাজিয়ে গান করতে পারতেন। তাঁর নিজের কণ্ঠে গাওয়া কয়েকখানি গান অবিভক্ত বাংলায় রেকর্ড হয়েছিলো।

ইংরাজী সাহিত্যেও তাঁর প্রচুর অধিকার ছিলো। The Musalman, The star of India, The Morning News, The Pakistan observer, The Dawn প্রভৃতি ইংরাজী পত্রিকায় বহু তথ্যপূর্ণ মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

Morning News তাই তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন : He is also a fine Prose writer both in Bengali and English.

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’। কিন্তু তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রূপের নেশা’ নামক একখানি সামাজিক উপন্যাস। তিনি যখন রিপন কলেজে বি,এ পড়তেন, সেই সময়ে নুর লাইব্রেরী’র স্বত্বাধিকারী মঈনউদ্দীন হোসাঈন তাঁর সহধ্যায়ী ছিলেন। তিনি গোলাম মোস্তফার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ‘রূপের নেশা’ এবং ‘রক্তরাগে’র পাণ্ডুলিপিগুলি তিনি প্রকাশার্থ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ের খাতিরে উপন্যাসখানিই তিনি প্রথমে প্রকাশ করেছিলেন।

অতপর ওরিয়েন্টাল পাবলিশার্স লিমিটেড কবির ‘রক্তরাগ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ‘রক্তরাগ’ কাব্যগ্রন্থখানা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে প্রদান করলে তিনি নিম্নের দু’লাইন কবিতা দ্বারা কবিকে অভিনিত করেছিলেন :

“তব নব প্রভাতের রক্তরাগ খানি

মধ্যাহ্নে জাগায় যেন জ্যোতির্ময়ী বাণী।”

তৎপরে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি পর পর প্রকাশিত হয়েছিলো–খোশবোজ (কাব্যগ্রন্থ)

ভাংগা বুক (উপন্যাস)

হাস্নাহেনা (কাব্যগ্রন্থ)

কাব্য-কাহিনী (কাব্যগ্রন্থ)

সাহারা (কাব্যগ্রন্থ)

বুলবুলিস্তান (কাব্য চয়ন)

অনুবাদেও কবির শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। আরবী ও উর্দু সাহিত্য হতে নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি ভাষান্তরিত করে বাংলা সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।

১। ইখওয়ানুস সাফা।

২। মুসাদ্দাস-ই-হালী।

৩। কালাম-ই-ইকবাল।

৪। শিকওয়া।

৫। জবাব-ই-শিক্ওয়া।

৬। আল্-কুরআন।

ইহা ব্যতীত তাঁর অপর কয়েকখানি গ্রন্থেও চিন্তাশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহাতে নব নব তথ্য সন্নিবিষ্ট হয়েছে। তার প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি যথা :

১। বিশ্বনবীর বৈশিষ্ট্য।

২। ইসলাম ও কমিউনিজম।

৩। ইসলামে জেহাদ।

৪। আমার চিন্তাধারা।

বাংলা সাহিত্যের বিশেষ সম্পদরূপে গণ্য হতে পারে।

ছন্দ বৈচিত্র্যে

যে সকল গুণে কবি বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন, তন্মধ্যে তাঁর ছন্দ বৈচিত্র্য অন্যতম। সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের পরেই যদি কাহারও নাম করতে হয় তবে তিনি গোলাম মোস্তফা। আরবী ছন্দের সমুদয় সূত্র তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তাতে বাংলা ভাষা অধিক সমৃদ্ধ হয়েছে। এই সমুদয় ছন্দ তৎকালে “প্রবাসী’ মাসিক পত্রিকায় তার ‘নূতন ছন্দ’ নামক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো। ইহাতে তিনি বলেছেন, বিশ্ব প্রকৃতি ছন ও সুরে পরিপূর্ণ। শুনবার উপযোগী কান থাকলে সে সকল ছন্দ ও সুর সাহিত্যে ধরে রাখা যায়। প্রত্যেকের নামের মধ্যেও যে এক একটি ছন্দ রয়েছে, গোলাম মোস্তফাই ইহা আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সূত্রে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তিনি যে কয়েকটি লাইনে ছড়া রচনা করেছিলেন ইহা অনবদ্য হয়ে আছে। ছড়াটি এইরূপ :

কাজী নজরুল ইসলাম

বাসায় একদিন গিছলাম,

ভায়া গান গায় দিনরাত

হেসে লাফ দেয় তিন হাত,

প্রাণে হর্ষের ঢেউ বয়।

ধরায় পর তার কেউ নয়।

এই ছয়টি লাইনের মধ্যেই নজরুল চরিত্রের সকল বৈশিষ্ট্যই ধরা পড়েছে।

আরবী কিয়ামের ছন্দ ও সুরে তার রচিত বাংলা কিয়াম এক অপূর্ব সৃষ্টি। মিলাদ শরীফের সর্বত্র শোনা যায় :

ইয়া নবী সালাম আলাইকা

ইয়া রসুল সালাম আলাইকা।

ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা

সালাওয়া তুল্লাহ্ আলায়ইকা।

অনুরূপ ছন্দে গোলাম মোস্তফা রচনা করেছেন :

তুমি যে নুরের-ই রবি

নিখিলের ধ্যানের ছবি

তুমি না এলে দুনিয়ায়

আঁধারে ডুবিত সবই।

ইত্যাদি—

বর্তমান যুগ খণ্ড-কাব্যের যুগ। তৎসত্ত্বেও তিনি মহাকাব্য রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। ইহা তাঁর দুঃসাহসিকতার পরিচয়। ‘বনি আদম’ গ্রন্থখানিকে অনবদ্য কাব্য বলা যায়। ইহার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় নাই। কাব্যখানি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত।

কবি গোলাম মোস্তফা অপর একটি কার্যে তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। কুরআন শরীফকে তিনি মুক্ত ছলে (Free verse) অনুবাদ করছিলেন। এ কার্য প্রায় অর্ধেক সম্পন্ন হবার পরে তিনি পরলোক গমন করেছেন।

তিনি মুসাদ্দাস-ই-হালী এবং ইকবালের বহু কবিতা অনুবাদ করে খ্যাতিলাভ করেছিলেন।

তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ‘বিশ্বনবী’। এই অমর গ্রন্থ গদ্যে রচিত। কিন্তু সে গদ্যও কবিতার মতো ছন্দময় এবং মধুর। হযরত মুহম্মদের সমগ্র কর্মময় পবিত্র জীবন, শিক্ষা এবং চরিত্র মাধুর্যের উপরে ইতিপূর্বে অপর কোনো লেখক এরূপ চমৎকার আলোকপাত করেছেন বলে মনে হয় না।

স্কুল-পাঠ্য সাহিত্য রচনাতেও কবি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অবিভক্ত বাংলায় তিনি ‘আলোক মালা’ এবং ‘আলোক মঞ্জরী’ সিরিজ লিখে যেন একটি যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজও তার “আলোক মালার’ শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছিলো।

সংগীতে :

গায়ক এবং গীত রচয়িতারূপেও তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার অনেকগুলি গান আব্বাস উদ্দীন রেকর্ড করেছিলেন। ইহা ব্যতীত তিনি নিজের কণ্ঠেও যে গানগুলি রেকর্ড করেছিলেন, সেগুলির প্রথম লাইন যথা :-

১। বাদশা তুমি দীন ও দুনিয়ার।

২। নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি।

৩। হে খোদা দয়াময় রহমানুর রহিম।

৪। আমার মুহম্মদ রসুল।

পাকিস্তানের গান :

গোলাম মোস্তফার অপর একটি উল্লেখযোগ্য দান ‘পাকিস্তানের গান’। বিগত ১৯৪০ সাল থেকে তিনি যদিও গেজেটেড অফিসার রূপে শিক্ষা বিভাগে সরকারী চাকুরী করতেন, তবুও পাকিস্তান আন্দোলনের সহিত সর্বদাই যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছেন। কোনো কাজে সক্রিয় অংশ গ্রহণ না করলেও ইহার চিন্তা ও দার্শনিকে তিনি নানাভাবে রূপ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের স্বপ্নে তিনি বিভোর ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের বহু পূর্ব হতেই তিনি পাকিস্তান সম্পর্কে নানা ধরনের গান রচনা করেছিলেন। সেগুলি কিরূপে রেকর্ড করা সম্ভব, সে সম্পর্কে তিন চিন্তা করেছিলেন। তিনি এবং গায়ক আব্বাস উদ্দীন একদিন হিজ মাষ্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানীর প্রতিনিধি হেমচন্দ্র সোম মহাশয়ের সহিত এ সম্পর্কে আলোচনা করেন। সোমবাব, অতিশয় আন্তরিকতার সহিত উক্ত প্রস্তাবে স্বীকৃত হন। তবে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার অর্থাৎ বড়ো সাহেবের সম্মতি গ্রহণ করতে তাঁদের উপদেশ প্রদান করেন।

অতঃপর একদিন গোলাম মোস্তফা কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজারের সহিত সাক্ষাৎ করলেন। ইংরাজী ভাষায় উভয়ের বাক্যালাপ হলো। মোস্তফা সাহেব তাকে বুঝিয়ে দিলেন, ইসলামী সংগীতের ন্যায় পাকিস্তানী গানেরও বহুল বিক্রয়ের সম্ভাবনা আছে। সাহেব অতঃপর মোস্তফাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ Have you composed any Song ?

তদুত্তরে মোস্তফা সাহেব জবাব দিয়েছিলেন : দু’খানি গান প্রস্তুত আছে।

এই কথা বলে তিনি নিম্নলিখিত দু’খানি গীত সুর করে গাইলেন। (১) সকল দেশের চেয়ে পিয়ারা (২) আমার ময়ূরপঙ্খী নাও।

সাহেব উক্ত গান দু’খানি ইংরাজী তর্জমা শুনতে চাইলেন। মোস্তফা সাহেব তৎক্ষণাৎ গান দু’খানির ইংরাজী অনুবাদ করে তাকে শোনালেন। সাহেব খুশী হলেন এবং রেকর্ড করবার অনুমতি প্রদান করলেন।

স্থির হলো গান দু’খানি কোরাসে গীত হবে। উহাতে অংশ গ্রহণ করবেন আব্বাস উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, বেদার উদ্দীন এবং অপর একজন মহিলা। সোমবাবু কয়েকজন হিন্দু যন্ত্রশিল্পীকে স্থির করলেন তাঁদের গানের সংগে সংগত করবার জন্য কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ কলিকাতায় দ্বিতীয়বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হওয়ায় সেই সকল শিল্পী পাকিস্তানী গানে অংশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো।

অতঃপর কি অবস্থায় পাকিস্তানের গান রেকর্ড করা হয়েছিলো, সে সম্পর্কে আব্বাস উদ্দীন তাঁর “আমার শিল্পী জীবনের কথা” নামক আত্মজীবনীতে লিখেছেন :

“কিন্তু সমস্যা দাঁড়ালো এই যে, গ্রামোফোন কোম্পানীর যন্ত্রীরা এই গানের সংগে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করলো। অগত্যা ক্যাসানোভার ইংলিশ অর্কেষ্ট্রার সাথে গ্রান্ড-হোটেলে গিয়ে গানের স্বরলিপি করিয়ে দিলাম। দু’খানা বাংলা গান এবং দু’খানা উর্দু গান ঠিক করলাম ৷ বাংলা গান দু’খানি কবি গোলাম মোস্তফা রচিত। সকল দেশের চেয়ে পিয়ারা দুনিয়াতে ভাই সে কোন, স্থান’ এবং ‘ঝির ঝির ঝির পুবান বাতাসে ধাও’ ইত্যাদি। উর্দু গান দু’খানি ফৈয়াজ হাশামী রচিত। ‘জমি ফেরদৌস পাকিস্তান কি হো গি জমানেছে’। পাকিস্তানের উপরে বাংলাদেশে, বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে ইহাই প্রথম রেকর্ড।

কলকাতায় তখনো দাঙ্গা চলেছে। ওয়ার্ক ডে’তে রেকর্ড করতে যাওয়া বিপদজনক, তাই সোমবাৰু স্থির করলেন কোনো এক রবিবারে শুধু স্টুডিও খোলা রাখা হবে। তদনুসারে চার-পাঁচজন গায়ক আর ক্যাসানোভার অর্কেস্ট্রা পাটি সহ রওয়ানা হলাম দমের পথে। দু’তিনবার আমাদের মোটরের রুট বদলাতে হলো। চলতে চলতে হঠাৎ হয়তো দেখি, উন্মত্ত জনতা কোথাও চলেছে মুসলমানের পিছনে কোথাও চলেছে হিন্দুর পিছনে।

মনে জেগেছিলো, এই রেকর্ড করে বাসায় না-ও ফিরতে পারি। কারণ, এই পরিস্থিতিতে প্রাণ নিয়ে বাসায় যে ফিরতে পারব তার নিশ্চয়তা কি। তাই দমদম রওনা হবার আগে আমার কাছে কে কত টাকা পাবে, আর আমিই বা কার কার কাছে কি কি পাবে সবকিছু একখানা কাগজে লিখে রেখে বাসা থেকে রওনা হয়েছি।

বেলা দু’টোর সময়ে দমদমে পৌছুলাম। কারখানা বন্ধ। কারখানার পিছন দরজা দিয়ে স্টুডিওতে ঢুকলাম। চারখানা গান রেকর্ড করলাম আমি, কবি গোলাম মোস্তফা, বেদার উদ্দীন, কাদের জমিরী এবং ক্যাপ্টেন মোস্তফা আনোয়ার মিলে। স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেল। বাসায় ফিরবার পথে মনে হচ্ছিলো, প্রাণ যদি এখন যায়, মৃত্যুর পূর্বক্ষণে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পিরবো এই ভেবে যে, এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পাকিস্তানের। প্রথম প্রশস্তি গাইবার সৌভাগ্য তো অর্জন করে গেলাম।

পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহরে আসবার জন্য প্রস্তুতি আরম্ভ হয়েছিলো। আমার জীবনে যা কিছু নাম, যশ, সম্মান, প্রতিপত্তি সব কিছুর লীলাক্ষেত্র এই কলিকাতা মহানগরী চির দিনের জন্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। কদিন ধরে শুধু এই কথাই মনে হচ্ছিলো। দেখবার, শুনবার, শিখর, দিবার আর নেবার এমন মহাতীর্থ কবে যে পাকিস্তানে গড়ে উঠবে, এই কথা বার বার মনে হতে লাগলো।

শুধু একটু মাত্র আশার আলো প্রাণের আর এক কোনে জ্বলে উঠলো। তার আলোকে স্পষ্ট পড়তে লাগলাম. অনাগত কালের পাতায় লেখা রয়েছে, ‘লাখো শুকুর গড়ে যাবার নসিব যাদের হয়’। নব সৃষ্টির উল্লাসের ঢেউ এসে পৌঁছুলো প্রাণের কূলে। সেই ঢেউয়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম।

এলাম ঢাকায় সম্পূর্ণ এক অপরিচিত পারিপার্শ্বিকে। চৌদ্দই আগষ্ট, ১৯৪৭-শবে কদরের রাত। রাত ঠিক বারোটার পরে ঢাকা রেডিওতে প্রথম কোরআনের আয়াত গম্ভীর সুরে আবৃত্তি করলেন জনৈক মওলানা। তার পরেই আমার সৌভাগ্য হলো পাকিস্তানের রেডিওতে প্রথম পাকিস্তানের গান গাইবার :

সকল দেশের চেয়ে পিয়ারা

দুনিয়াতে ভাই সে কোন্ স্থান!

পাকিস্তান সে পাকিস্তান।

সোমবাবুর কল্যাণে ১৪ই আগষ্টের দুই-একদিন পূর্বেই পাকিস্তানের রেকর্ড বাজারে বের হয়েছিলো। সিনেমায়, রেস্তোরাঁয়, চায়ের দোকানে সর্বত্র পাকিস্তানের সঙ্গীত সত্যই এক নূতন যুগ সৃষ্টি করেছিলো।

১৯৪৮ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে কায়েদে আজম ঢাকায় এসেছিলেন। রেস্-কোর্সের ময়দানে বিপুল জনতার সম্মুখে তিনি বক্তৃতা দান করলেন। সেই ঐতিহাসিক দিনেও পাকিস্তানের গান কোরাসে গীত হলো। আব্বাস উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা এবং অপর দু’তিন জন শিল্পী উহাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সংগীত সমাপ্ত হলে কায়েদে আজম মৃদু হেসে গোলাম মোস্তফা এবং আর্কাস উদ্দীনের সহিত করমর্দন করেছিলেন। তৎকালীন মন্ত্রী বাহার সাহেব তাদের পরস্পরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের গান অতি অল্প দিনের মধ্যে অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। উহার বিক্রয়াধিক্য দর্শন করে গ্রামোফোন কোম্পানী ঐদিকে মনযোগ প্রদান করলেন। সোমবাবু দু’তিনজন কর্ম চারীকে সংগে নিয়ে পাকিস্তানের আরও কিছু সংখ্যক গান রেকর্ড করবার জন্য যন্ত্রপাতি সহ ঢাকায় এসে হাজির হলেন। গোলাম মোস্তফা সে সময়ে ফরিদপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাকে আহবান করা হলো। তাঁর রচিত নিম্নলিখিত গানগুলি সেই সময়ে রেকর্ড করা হলো।

(১) আল্লা আল্লা বলো রে ভাই যত মোমিনগণ

পাকিস্তানের বয়ান করি শোননা দিয়া মন।

(২) ওরে ও মোমিন ভাই, তুই করিস কেন ভয়-

পাকিস্তানের দুর্দিন যাবে—হবে হবে জয়।

(৩) চল্ চলরে মুকুল দল—

(৪) পাকিস্তানের গুলিস্তানে আমরা বুলবুলি।

(৫) উড়াও উড়াও আজি কওমী নিশান।

(৬) পাকিস্তানের কওমী ফৌজ আমরা পাহারাদার

চোরবাজারের শয়তান যত হুশিয়ার হুশিয়ার।

এই গানগুলির সুর দিয়েছিলেন সুর-শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী।

নজরুল ইসলামের সহিত সাক্ষাৎ

১৯২০ সালে ব্যারাকপুর গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে গেলাম মোস্তফা সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি কলিকাতাযু ২৯নং মীর্জাপুর স্ট্রীটে থেকে ডেলিপ্যাসেঞ্জারী করতেন। সেই সময়ে তিনি একদিন শুনতে পেলেন, হাবিলদার। কাজী নজরুল ইসলাম কলিকাতায় এসেছেন। তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস’-৩২ নং কলেজ ষ্ট্ৰীটে অবস্থান করছেন। একদিন অপরাহ্নে গোলাম মোস্তফা চললেন কাজী নজরুল ইসলামের সংগে সাক্ষাৎ করতে।

এই প্রথম সন্দর্শন সম্পর্কে গোলাম মোস্তফা নিজেই লিখেছেন :

“ঘরে ঢুকিয়াই দেখিলাম, বাবড়ি চুল মাথায় একজন সুদর্শন বলিষ্ঠ যুবক বিছানার উপরে বসিয়া হারমোনিয়াম সহযোগে গাহিতেছেন. “আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি”—

আমার পরিচয় পাইয়া তিনি উল্লাস ভরে তক্তপোষ হইতে লাফাইয়া নীচে নামিলেন এবং করমর্দন ও কোলাকুলি করিয়া কাছে বসাইলেন। আমি গানটি শেষ করিবার জন্য অনুরোধ জানাইলাম। নজরুলের কণ্ঠ দরাজ এবং বলিষ্ঠ তথাপি সুরেলা এবং দরদপূর্ণ। তাই গানটি মধুর লাগিল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আমি তাহার নিকট হইতে গানটি শিখিয়া লইলাম। দেখিলাম, তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের অত্যন্ত অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথের স্বরলিপি পুস্তক অনেকগুলি তাহার নিকটে দেখিলাম। কেমন করিয়া স্বরলিপি হইতে হারমোনিয়ামে গান তুলিতে হয়, তাহা আমি জানিতাম না। তিনি আমাকে সে পদ্ধতি শিখাইয়া দিলেন। পরে আমিও রবীন্দ্রনাথের সমুদয় স্বরলিপির পুস্তক কিনিয়া লইয়াছিলাম।

নজরুলের অনুরোধে আমাকেও সেদিন দুই-একটি গান গাহিতে হইয়াছিলো। গান শুনিয়া তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছিলেন। এইরূপে প্রথম দিনেই নজরুলের সহিত আমার ‘সুরে সুরে গানে গানে পরিচয় ঘটিয়াছিলো।”

বিদ্রোহী কবিতা

নজরুল ইসলামের সহিত গোলাম মোস্তফার যথেষ্ট হৃদ্যতা থাকা সত্ত্বেও একটি কারণে উভয়ের মধ্যে আদর্শের দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। ১৯২১ খ্ৰীষ্টাব্দে কাজী নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি প্রথমতঃ ‘বিজলী’ নামক পত্রিকায় এবং পরে ‘মুসলিম ভারত’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। কবিতাটি সমগ্র দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলো। ইহার ছন্দ, ভাষা, ভাব এবং প্রকাশ ভংগী সেই সময়ে অভূতপূর্ব ছিলো তজ্জন্য এই কবিতাটি প্রত্যেকের হৃদয়ে বিপুল আলোড়ন এনেছিলো। কিন্তু আদর্শের দিক হতে মুসলিম সমাজের অনেকেই এই কবিতাটিকে প্রাণের সংগে গ্রহণ করতে পারেন নাই।

বল বীর,

বল উন্নত মম শির,

বল বীর।

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’

ভূলোক দ্যুলোক গোলাক ভেদিয়া

খোদার আসন আরশ ছেদিয়া

উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি

বিশ্ব-বিধাত্রীর।

উপরোক্ত ভাবধারা সাধারণ মুসলমান সমাজ বরদাশত করতে পারলো না। চারিদিক থেকে তাই এই কবিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠলো। গোলাম মোস্তফার মনেও ইহার প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। তিনি ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামকরণ করে একটি কবিতা রচনা করলেন। ইহাকে বিদ্রোহী কবিতার জবাব বলা চলে। কবিতাটি ‘বিদ্রোহীর’ ছন্দেই রচিত, তবে ভাব ও ভাষা ও আদর্শের দিক হতে ‘বিদ্রোহীর’ সম্পূর্ণ বিপরীত।

ওগো বীর,

তুমি সংযত করো

সংহত করো

উন্নত তব শির।

ইহাই ‘নিয়ন্ত্রিত’ কবিতার প্রারম্ভ। কবিতাটি ‘বিদ্রোহী’র পাল্টা জবাব হলেও কেবলমাত্র তরল উচ্ছ্বাসে পূর্ণ নহে। ইহার মূলে দর্শন আছে। বিশ্ব প্রকৃতিতে কোথাও উচ্ছৃঙ্খলতা অথবা বিদ্রোহ নাই। একটা নৈতিক নিয়ম ও শৃঙ্খলার দ্বারা ইহা পরিচালিত হচ্ছে। মানুষের উচিত, সেই বিশ্ব বিধানের সহিত নিজের সংগতি বিধান করে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলা। বাধা বিপ্ন থাকতে পারে বটে কিন্তু তাকে জয় করাই মানুষের ধর্ম। আল্লাহের সাহায্য গ্রহণ করে দুঃখকে জয় করাই ইসলামী দর্শন। গোলাম মোস্তফা তার নিয়ন্ত্রিত কবিতায় এই ভাবধারাই ব্যক্ত করলেন। এই কারণেই ‘নিয়ন্ত্রিত কবিতাটি সস্তা গালাগালি না হয়ে অন্যতম একটি সাহিত্য সৃষ্টি রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিলো। নজরুল ইসলামও এ-কথা স্বীকার করেছিলেন। এই কবিতাটি যখন প্রকাশিত হয়েছিলো সে সময়ে ‘রক্তাম্বরধারিনী মা’ শীর্ষক কবিতা লিখবার অপরাধে কাজী নজরুলের জেল হয়েছিলো। গোলাম মোস্তফার কবিতাটি এবং অন্যান্য প্রতিবাদগুলি তার এক বন্ধু নিয়ে তাঁকে জেলখানায় দেখিয়েছিলেন। সবগুলি প্রতিবাদ পাঠ করে তিনি বলেছিলেন : গোলাম মোস্তফা দিয়েছেন জবাব—অপর সকলে দিয়েছে গালাগালি।

নজরুলের সহিত সম্পর্ক

১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে গোলাম মোস্তফার প্রথম স্ত্রী কলিকাতায় ইনতিকাল করলেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন বর্ধমান জেলার আসানসোল নিবাসী সৈয়দ নুরুল আবসার সাহেবের কন্যাকে। বিবাহ সভাতে তিনি জানতে পারলেন কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তাঁর নানা শ্বশুর। তিনি নূরুল আবসার সাহেবের স্ত্রীর চাচা। নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ সহোদর কাজী সাহেবজানও উক্ত বিবাহ মজলিশে হাজির ছিলেন। তিনি আসানসোলে চাকুরী করতেন। তাঁর নিকট থেকে গোলাম মোস্তফা কাজী নজরুলের বাল্য জীবনের বিষয় জানতে পারলেন। তিনি বাল্য বয়সে আবদুল ওয়াহেদের যে রুটির দোকানে ময়দা মাখতেন সেই দোকানও মোস্তফা সাহেব নিজে দেখে আসলেন।

বিবাহের পরে কলিকাতায় ফিরে গোলাম মোস্তফার সহিত কাজী নজরুলের সাক্ষাৎ ঘটলো। কাজী সাহেব যখন এই বিবাহের বিষয় জানতে পারলেন তখন সেই মধুর সম্পর্ক নিয়ে উভয়ের মধ্যে আনন্দ আর হাসির ঝড় বয়ে গেল।

বস্তুতঃ আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট প্রীতি এবং ভালোবাসা বিদ্যমান ছিলো। ‘নিয়ন্ত্রিত’ কবিতা লিখবার জন্য নজরুল ইসলাম কোনো দিনই অসন্তুষ্ট হন নাই। পক্ষান্তরে কিছু দিন পরে ‘হলাম মস্ত বাঃ ইয়ে ইটি’ এই নাম দিয়ে নজরুল ইস্লাম যখন গোলাম মোস্তফার সম্পর্কে একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখলেন তখনও নজরুলের প্রতি মোস্তফা ক্রুদ্ধ হন নাই।

গ্রামোফোন ক্লাব ছিলো, কণ্ঠশিল্পী, সুর-শিল্পী এবং কবিদের মিলন কেন্দ্র। এই স্থানে গোলাম মোস্তফা ও আব্বাস উদ্দীন প্রায়ই কাজী নজরুলের সহিত সাক্ষাৎ এবং মেলামেশা করতেন। ওস্তাদ জমির উদ্দীন খানের নিকটে কাজী নজরুল, গোলাম মোস্তফা এবং আব্বাস উদ্দীন ঋণী—কারণ, ইহারা নিজনেই জমির উদ্দীন খানের নিকটে সংগীত শিক্ষা করতেন।

গোলাম মোস্তফা সহসা বদলি হয়ে কলিকাতার বাইরে চলে গেলেন। অতঃপর দীর্ঘকাল আর উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ হবার সুযোগ ঘটে নাই।

সর্বশেষ উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটেছিলো ১৯৫৫ সালের ৩রা জুলাই তারিখে। গোলাম মোস্তফা সাহেব তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ক্যাপ্টেন মোস্তফা আনোয়ার (মরহুম) এবং তৃতীয় পুত্র শিল্পী মোস্তফা মনোয়ারকে সংগে নিয়ে কাজী নজরুলকে দেখতে গিয়েছিলেন। কাজী নজরুল সে সময়ে ঘোর উন্মাদ। সেই অবস্থায় গোলাম মোস্তফা কাজী নজরুলের পাশে বসে তার মুখে সন্দেশ তুলে ধরলেন। দৃশ্যটি অতিশয় করুণ। উভয় কবি নির্বাক। অথচ মনে হচ্ছিলো, কত কথাই যেন নীরব ভাষায় মুখর হয়ে উঠেছে।

গোলাম মোস্তফা ছিলেন কাজী নজরুল অপেক্ষা দুই বৎসরের বড়ো। কাজী নজরুল জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে। কিন্তু সাহিত্য ক্ষেত্রে আগমনের ব্যবধান ছিলো কিছু বেশী। গোলাম মোস্তফার সর্বপ্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯১৩ সালে। পক্ষান্তরে কাজী নজরুলের প্রথম লেখা ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে।

এই প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশিত নিম্নোদ্ধৃত অংশ বিশেষ এই স্থানে উল্লেখযোগ্য—“কবি শাহাদাৎ হোসেন ১৮৯৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কবি গোলাম মোস্তফা অপেক্ষা তিনি চারি বৎসরের বয়ঃজ্যেষ্ঠ- হইলেও সাহিত্য ক্ষেত্রে অনেক পরে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ ১৮৯৯ সালে ‘সওগাত’ মাসিক পত্রিকায় তাঁহার লেখা প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল। সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের মধ্যে কবি জসিম উদ্দীনের জন্ম ১৯০২ সালে এবং কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম ১৯০৬ সালে। কাজেই দেখা যাইতেছে, আধুনিক যুগের বাঙালী কবিদিগের মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফাই সকলের পুরোভাগে রহিয়াছেন। বস্তুতঃ আধুনিক যুগে যে বিশিষ্ট ছন্দ ও সুর—তাহা গোলাম মোস্তফার কাব্যে সর্বপ্রথম সার্থকভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। হিন্দু সমাজও তাঁহাকে এ স্বীকৃতি দিয়াছেন।”

শিশু সাহিত্য :

গোলাম মোস্তফা সাহিত্যের নানা বিভাগে লেখনী পরিচালনা করেছেন। শিশুদিগকেও তিনি উপেক্ষা করেন নাই। ছোটদের উপযোগী নানা ধরনের রচনা দ্বারা তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

১৯২২ সালে ‘কিশোর’ শীর্ষক তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো। এই সময়ে তিনি ব্যারাকপুর গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষক। এই কবিতা প্রকাশ সম্পর্কে গোলাম মোস্তফা তার ডায়েরীতে লিখে গেছেন :

“একদিন হেড মাষ্টার বেণীবাবু আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘মোস্তফা সাহেব আপনাকে একটি লেখা দিতে হবে। গতকল্য আমি কোলকাতায় গিয়েছিলাম। কিশোর পত্রিকার সম্পাদকের সংগে দেখা। তিনি একটি কবিতা চেয়েছেন। আপনি একটি কবিতা দেবেন।

আমি আনন্দের সহিত সম্মতি জানাইলাম। বাসায় ফিরিয়া ভাবিলাম, ‘কিশোর’ সম্পর্কেই একটি কবিতা লিখিব। চারি পাঁচ দিবস পরে কবিতাটি লিখিয়া লইয়া বেণীবাবুর নিকটে গেলাম এবং আবৃত্তি করিয়া তাহাকে শুনাইলাম। বেণীবাবু গুণগ্রাহী লোক ছিলেন। তিনি কবিতাটির ভূয়সী প্রশংসা করিলেন। পরদিন বেণীবাবু, কলিকাতা হইতে কিশোর সম্পাদকের একখানি পত্ৰ আনিয়াছিলেন, তাহা আমার হাতে দিলেন। পত্রখানি সংক্ষিপ্ত। তাহাতে এইরূপ লেখা ছিলো :

‘প্রিয় মুস্তফা সাহেব,

আপনার কবিতার জন্য ধন্যবাদ। রবীন্দ্রনাথের কাব্য-পরিধি মাপিলে হয়তো তিন মাইল লম্বা হইয়া যাইবে। কিন্তু দীর্ঘ পরিধির মধ্যেও এমন একটি কবিতা তাহার নাই যাহা কিশোর মনে স্বপ্ন সৃষ্টি করিতে পারে। আমি ভবিষ্যতবাণী করিতেছি, এই কবিতা আপনাকে অমর করিয়া রাখিবে।

চিঠিখানি পাঠ করিয়া প্রীতি লাভ করিলাম।”

ঢাকায় অবস্থান :

দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর কাল সরকারী চাকুরী করবার পরে তিনি স্থির করিলেন এইবার অবসর গ্রহণ করবেন এবং নিশ্চিন্ত মনে সাহিত্য সাধনা করবেন। একথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। ১৯৫৩ সালে অবসর গ্রহণ করে সাহিত্যের চর্চায় আত্মনিয়োগ করলেন।

পর বৎসর ১৯৫১ সালে গোলাম মোস্তফার ৫৫ বৎসর পূর্ণ হয়। তাঁর এই ৫৫তম জন্ম বার্ষিকীতে তাকে যশোহরবাসীর পক্ষ থেকে মানপত্র প্রদান করা হয়েছিলো। তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন :

বন্ধুগণ,

জীবনে নানা স্থান থেকে অভিনন্দন লাভ করবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু যশোহরের এই অভিনন্দন ও সম্বর্ধনার মধ্যে আছে একটা অনন্য সুলভ বৈশিষ্ট্য। এটা আমার প্রথম জন্ম-বার্ষিকী। দীর্ঘ ৫৫টি সৌর বৎসরে আজ আমার কাব্য জীবনের একটি বৎসর পূর্ণ হলে। ৫৫ বৎসরের শিশু কবি আমি। কবিরা মহাকালের কাছে শিশু!……….

…………. যশোহর আমার মাতৃভূমি। যশোহরেই আজ এই উৎসবের আয়োজন। মা-বোন ও ভাইদের আশীর্বাদ এবং প্রীতির ছায়াতলে আপনারা আমাকে অভিনন্দন করছেন।

……. রক্তের সম্বন্ধ এবং অন্তরের টান যাবে কোথায়। যশোহরের এই মাটি, এই আকাশ, এই আলো, এই নারিকেল, সুপারি, খেজুর গাছের স্নিগ্ধ রূপ–সবার সাথেই আমার আছে নিবিড় যোগ।….এই শুভক্ষণে আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি, যশোহর যেমন আমাকে ভালোবাসে—আমিও তেমন যশোহরকে ভালোবাসি।…….অন্তরে জেগেছে আজ বৃহত্তর স্বদেশ প্রেম। সবার মাঝারে আজ জেগে আছে আমার জন্মভূমির মুখচ্ছবি। ঢাকায় থাকলেও যশোহরের স্মৃতি ঢাকা পড়েনি। আপনারা হয়তো জানেন, সেখানকার যশোহর সমিতি’র সংগে আমি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

……..যশোহরের খেজুর গাছে মধুর রস। ‘গৌরজন’ যা নিরবধি পান করে তৃপ্ত হচ্ছে। যশোহরের মাটিতে মাইকেল মধুসূদনের জন্ম তাই অনিবার্য হয়েছিল। ‘অমৃত বাজার’, ‘আনন্দ বাজার’ এমন নামকরণ যশোহরেই সম্ভব। এই মাটিতেই জন্মেছেন মুনশী মেহের উল্লাহ—জন্মেছেন গরীব শাহ ফকীর—জন্মেছেন রস-কবি পাগলা কানাই। শিল্পী উদয় শঙ্কর—অভিনেতা শিশির কুমার এই মাটিরই সন্তান। এই দেশে আমার জন্ম। আমি কি গৌরব বোধ করবো না।—-

আমার লক্ষ্য ও আদর্শঃ

যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানদের অবসানের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যে না ছিলো কোনো স্বাতন্ত্র—না ছিলো কোনো স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির —– ধ্যান ধারণা ও আশা আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয় তার মাতৃভাষার মধ্যে। ……বাংলার মুসলমানদের কোনো সাহিত্যই তখন রচিত হয়নি। আমি তাই ছোট বেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলিমের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে। রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও আমার মনে জেগেছিলো আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাকিদে নয়—সহজভাবেই আমি বাংলা সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রূপায়ণ। বাংলা ভাষা বাঙালীর ভাষা। সেই বাঙালীর অর্ধেকের বেশী হলো মুসলমান। কাজেই বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের জীবনের প্রকাশ যদি না থাকে তবে সে সাহিত্য কিছুতেই পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ইসলামী রূপায়ণ তাই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই অনিবার্য হয়েছিল এবং এখনও আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির দিক দিয়েও এর প্রয়োজন রয়েছে। কোনো সত্যকার কবি সাহিত্যিকই নিজের পরিচিত পরিবেশ, প্রকাশভঙ্গী ও বিষয়বস্তু ছেড়ে কাব্য-চর্চা করতে পারে না। কোনো মুসলিম কবি যদি আরবী ফারসী শব্দ বা ভাবধারা ব্যবহার করে তবে তাতে কোনোই অন্যায় হয় না—বরং সেইটাই হয় স্বাভাবিক। হাফিজ, ওমর খৈয়াম, মিলটন, সেক্সপীয়ার, রবীন্দ্রনাথ—প্রত্যেকেই আপন আপন আদর্শে কাব্য রচনা করেছেন। বাংলার মুসলিম কবিকেও ঠিক তাই করতে হবে। …..প্রত্যেক জাতির কবি সাহিত্যিকদের স্বভাব ধর্ম হলো তার জাতির প্রতিনিধিত্ব করা।

নূতন ভবিষ্যৎঃ

এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না যে, পাকিস্তান শুধু একটা ভৌগোলিক পরিবর্তনই আনে নাই—একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকেও সে টেনে এনেছে। আমাদের আকাশে দেখা দিয়েছে নব নব সম্ভাবনার ইংগীত। এক নূতন ভবিষ্যতের সম্মুখে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। এত দিনের অনেক কিছু আজ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কাল যাকে চেয়েছিলাম, আজ আর তার প্রয়োজন নাই। এই ভাঙাগড়া শুধু যে পাকিস্তানেই শুরু হয়েছে তা নয়—ভারতেও। পাকিস্তানেই শুধু ইসলামী রাষ্ট্ররচনার জল্পনা কল্পনা চলছে না, ভারতেও চলছে রাম-রাজত্বের পরিকল্পনা। রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এখানেও যেমন সমস্যা জেগেছে—ওখানেও তেমনি জেগেছে। এখানেও উর্দু ঢুকেছে—ওখানেও হিন্দী ঢুকেছে : উভয় রাষ্ট্রেই ঢুকেছে আজ নব সৃষ্টির চঞ্চলতা।

মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিঃ

পাকিস্তানের তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের দায়িত্ব আজ অসীম। নুতন জাতি গঠনের মুথে এসে তারা দাঁড়িয়েছেন। মুসলিম জাতিকে বাঁচতে হলে তার কালচারকে পুনর্গঠিত করতেই হবে। ইস্লাম এক নুতন ঐতিহাহিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। পাকিস্তান হবে তার প্রধান পটভূমি। সে শোনাবে বিশ্ব মানবের মুক্তির বাণী।

আজ পর্যন্ত কুরআন শরীফের একটি নির্ভরযোগ্য অনুবাদ বাংলা ভাষায় হয় নাই। এই অভাব মিটাতে গেলে সাধনা করতে হবে। আশা করি, এ বিষয়ে আলিম সমাজ অবহিত হবেন। ….চিন্তার নেতৃত্ব করাই হবে যশোহরের নূতন ঐতিহাসিক ভূমিকা। “What Jessore thinks today, the rest of Pakistan thinks to-morrow”.

ঢাকার দিনগুলি :

কবি গোলাম মোস্তফা ঢাকা শহরের ইসলামপুর রোতে একটি ছাপাখানা এবং একটি লাইব্রেরী স্থাপন করলেন। প্রেসে নিজের লিখিত পুস্তকগুলি ধীরে ধীরে ছাপাতে লাগলেন। ঐ পুস্তকগুলির বিক্রয় কেন্দ্র হলে আপনার লাইব্রেরী। লাইব্রেরীর নামকরণ করেছিলেন “মুসলিম বেঙ্গল লাইব্রেরী”। প্রেসের নাম রেখেছিলেন “মুসলিম বেঙ্গল প্রেস।”

কিন্তু কয়েক বৎসরের মধ্যেই বুঝতে পারলেন, অতঃপর প্রেসের বিরক্তিকর ঝামেলা সহ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হবে না। নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য সাধনার পথে ইহা বিঘ্ন সৃষ্টি করে। সুতরাং প্রেস তিনি বিক্রয় করে দিলেন। তৎপর “মুসলিম বেঙ্গল লাইব্রেরী” নামে একটি নূতন লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন।

নানা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সহিত তিনি বিজড়িত হয়ে পড়লেন। এতে তিনি একজন গণ্যমান্য নাগরিক রূপে পরিগণিত হলেন।

ইতিমধ্যে বাঙালী মুসলিম কবি রূপে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ৫০০০ (পাঁচ হাজার) টাকা লাভ করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করলেন।

গোলাম মোস্তফা ছিলেন সদা হাস্যময়। ধীর, শান্ত, সদালাপী ও বন্ধু বংসল। নবীন সাহিত্যিক এবং কবিদিগকে নানা রূপে উৎসাহ দিয়েছেন এবং তাঁদের রচনা প্রকাশে যথাসাধ্য সাহায্যও করেছেন। তাঁর নিকটে আধুনিক কবি এবং সাহিত্যিকের দল ঋণী একথা বলে সত্যের অপলাপ হবে না।

ইনতিকালঃ

১৯৬৪ সালের গোড়ার দিক থেকে চোখে cataract হওয়ায় দৃষ্টিশক্তি এবং পুর্বাপেক্ষা লেখাপড়া করবার ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে আসছিলো। এজন্য তিনি বাইরে কোথাও যাওয়া আসা একরূপ কমিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু দেশবাসীর দুর্ভাগ্য। বিগত ৮ই অক্টোবর (১৯৩৪) তারিখের রাত্রিতে তিনি সহসা সেরিব্রাল থ্রমবসিস রোগে আক্রান্ত হন। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে স্বীয় বাসভবন শান্তি নগরস্থ ‘মোস্তফা মঞ্জিল’ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর দেহের দক্ষিণ অংশ পক্ষাঘাতে সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে যায়। দক্ষিণ চক্ষু একেবারে নষ্ট হয়। যান্ত্রিক উপায়ে শ্বাস প্রশ্বাস এবং আহারের কাজ চলতে থাকে। তাঁর আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এবং অনুরাগীবৃন্দ রোগ মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানান এবং আকুল আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু শেষ অবধি সবাইকে নিরাশ হতে হয়। কয়েকদিন রোগযন্ত্রণা ভোগের পরে বিগত ১৩ই অক্টোবর রাত্রি এগারোটার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১নং কেবিনে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

(ইন্না নিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন)

তথ্যসূত্র: কবি গোলাম মোস্তফা, রচনায়: বন্দে আলী মিয়া, আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে ১৯৭৫সালে প্রকাশিত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan