সৈয়দ আমীর আলী’র জীবনী

রচনায়: মুহম্মদ হবীবুল্লাহ

সৈয়দ আমীর আলী

গোড়ার কথা

দুনিয়ায় কতো লোক আসে, কতো লোক যায়, তার মধ্যে ক’জনকে মানুষ শ্রদ্ধা করে, ক’জনকে মনে রাখে, ক’জনই বা মানুষের মনে চিরদিন ছাপ রেখে যেতে পারে। ইংরেজ আমলে মুসলিম ভারতে বহু লোক জন্মেছে। একজন নয়, দু’জন নয়, অনেক অনেক~~শত শত, লাখো লাখে, কোটি কোটি। এই কোটি কোটি লোকের মধ্যে কয়েকজন মাত্র বড় হয়েছেন, মাত্র কয়েকন সমাজের নজরে পড়েছেন, মন্ত্র কয়েকজনকে জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে।

আমীর আলী ছিলেন ঐ অল্প কয়েকজনেরই একজন—যাঁরা জীবনকালে সম্মান পেয়েছেন, যাদের মৃত্যুতে লোকে চোখের পানি ফেলেছে, সুদূর ভবিষ্যতেও যাদের কথা সকলে স্বীকার করবে।

সংসারে এলে মরতে হয়। আমি, তুমি সকলেই মরবো। আমীর আলীও মারা গেছেন। তার মৃত্যুতে বিশেষত্ব কিছুই নেই, কিন্তু বিশেষত্ব না থাকলেও তার মৃত্যুতে সকলেই কেঁদেছে—হিন্দু-মুসলমান কেঁদেছে, ইংরেজ-বাংগালী কেঁদেছে, ইরান-তুরানী কেঁদেছে। আমীর আলীর মৃত্যুতে কেনো কেঁদেছে—তাঁর নামে সকলের চোখের পাতা কেনো ভিজে উঠেছিলো, সে-কথাই আমরা আলোচনা করবো।

সিপাহী যুদ্ধের পর বৃটিশ কোম্পানীর হাত থেকে উপমহাদেশের শাসনভার যখন মহারাণীর হাতে চলে গেলো, তখন মুসলমানদের বড় দুদিন। দেশের সে. দুদিনে, সমাজের সে দুঃসময়ে মুসলমান নিরাশার আঁধারে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। দুঃখের দরিয়া থেকে উদ্ধার করে মুসলমানদেরকে তরক্কির রাজপথে তুলে দেবার জন্য যে সকল মহাপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, আমীর আলী ছিলেন তাদেরই একজন।

সেই আঁধার যুগে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন আমীর আলী, গোড়াপন্থীদের প্রতিবাদ তুচ্ছ করে ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেছিলেন আমীর আলী, স্বাধীন চিন্তার আলোকে মনকে আলোকিত করে দেশের দিকে দিকে সে আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আমীর আলী।

যে জাতির অতীত গৌরবময়, সহজে সে জাতির মৃত্যু হয় না–আমীর আলী বুঝেছিলেন একথা। এ কারণেই তিনি সারাসিন ইতিহাসের গৌরবময় কথা সমাজের সম্মুখে তুলে ধরেছিলেন। ইসলামের তেজে যে তেজীয়ান, সে কখনো ধ্বংস হতে পারে না–

আমীর আলীর একথা জানা ছিলো। এ জন্যই তিনি আমাদের শ্যামল জন্মভূমিতে মরুভূমির দেশ থেকে ইসলামী চেতনা বয়ে এনেছেন। মুসলিম জাহানের একতা বিনষ্ট হলে মুসলমানের উদ্ধার নেই – তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একথা। এ জন্যই তিনি মিলনের বাণী প্রচার করেছিলেন দেশে-বিদেশে।

বিদেশীদের হাতে পড়ে মুসলমান আইন দূষিত হচ্ছিলো–আমীর আলী তা’ দেখে চুপ করে থাকেননি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর গবেষণা করে বিরাট মুসলিম আইন-সাহিত্য তৈরি করেছিলেন তিনি।

মায়ের জাতি না জাগলে দেশ জাগে না, জাতি উন্নতির পথে এগুতে পারে না, একথা অজানা ছিলো না আমীর আলীর। ইসলামে নারীর স্থান কতো উচ্চে, ইসলাম মায়ের জাতিকে কতোখানি শ্রদ্ধা দিয়েছে, তা তিনি ভালো করেই দেখিয়ে দিয়েছেন তার লেখায়, বক্তৃতায় অর পুঁথি-পুস্তকে।

মোট কথা, আশি বছর ধরে যে মানুষটি এ উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে উদার, মহৎ ও সুন্দর করার জন্য সবচেয়ে বেশী চেষ্টা করেছেন, তিনি আর কেউ নন—রাইট অনারেবল সৈয়দ আমীর আলী, সি-আই-ই।

জন্ম ও শৈশব শিক্ষা

১৮৪৯ সালের ৬ই এপ্রিল পশ্চিম বংগের চুঁ চুঁড়ায় আমীর আলীর জন্ম হয়। সৈয়দ বংশের উজ্জ্বল রত্ন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষ মহাত্মা ইমাম আলী আর-রেজা মেঙ্গেদের একজন মশহর মহাপুরুষ ছিলেন।

ইমাম রেজার বংশের অনেকেই ইরানের রাজদরবারে কাজ করতেন। এঁদের কেউ ছিলেন উজির, কেউ নাজির, কেউ কাজী, কেউ বা সেনাপতি। শাহ দ্বিতীয় আব্বাসের সময় এ পরিবারের মুহাম্মদ সাদিক গৌরব অর্জন করেছিলেন। তারপর নাদির শাহের সময় খ্যাতিলাভ করেন আহমদ ফাজিল খান।

১৭৩৯ সালে নাদির শাহের আদেশে দিল্লীর পথে-ঘাটে খুন-খোশরোজের অভিনয় হয়েছিলো। আহমদ ফাজিল ছিলেন সে উৎসবে নাদির শাহের সহকারী। লাখো প্রাণের বিনিময়ে সে যুদ্ধের অবসান হলো।

নাদির শাহ ধুমকেতুর মতো এসেছিলেন, ধুমকেতুর মতোই চলে গেছেন। আহমদ ফাজিল কিন্তু থেকেই গেলেন আমাদের এ উপমহাদেশে—-মোগলের রাজধানী দিল্লীতে।

আহমদ ফাজিলের পুত্র তাহের খান মারাঠা বিদ্রোহের সময় অযোধ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি উনাও জেলার মোহনে বাস করতেন। নবাব আসফদ্দৌলার সময় তাঁর মৃত্যু হয়।

তাহের খানের পুত্রদের মধ্যে দু’জন–আমীর আলীর পিতামহ সৈয়দ মনসুর আলী খান ও সৈয়দ আলী খান বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। এঁদের দু’জনেই লখনৌর নবাব দরবারে কাজ করতেন। বীর বলে মনসুর আলীর খ্যাতি ছিলো। জনৈক বিদ্রোহী রাজাকে দমন করতে গিয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেন। কবি সওদা তাঁর অমর কবিতায় মনসুর আলীর বীরত্বের কাহিনী বর্ণনা করে গেছেন।

আমীর আলীর পূর্বপুরুষরা এতোদিন নবাব দরবারেই কাজ করতেন। সৈয়দ আলী খানের পুত্র জাফর আলী খান সবার আগে ইংরেজ সরকারের অধীনে কাজ আরম্ভ করেন। তিনি ছিলেন উড়িষ্যার সেটেলমেন্ট বিভাগের পরিচালক। তাঁর আতিথেয়তা, মানবতার কথা এখনো উড়িষ্যার মানুষ কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ।

আমীর আলীর পিতা সৈয়দ সাদত আলী, মনসুর আলী খানের কনিষ্ঠ পুত্র। এর মামা হেকিম সিরাজ উদ্দিন খান এখনৌর নবাব গাজীউদ্দিন হায়দরের দরবারে সভা-হেকিমের কাজ করতেন। তারই কাছে সাদত আলী হেকিমী শাস্ত্র শিক্ষা করেন। মা আমিনা বেগমের মৃত্যুর পর সাদত আলী কটকে জাফর আলী খানের কাছে চলে যান। এখানেই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডঃ মোয়াট ও বিচারপতি মেলেটের সাথে তাঁর পরিচয় হয়।

এদের পরামর্শেই সাদত আলী চুঁ চুঁড়ায় এসে হেকিমী ব্যবসা গুরু করেন। এদেরই কাছে এসে তার ইংরেজী শেখার প্রতি আগ্রহ জন্মে।

আমীর আলী জন্মেছিলেন দেশের এক ঘোর দুর্দিনে। অধীনতার ব্যথা তখন উপমহাদেশবাসী মর্মে মর্মে অনুভব করছিলেন। সিপাহীরা তৈরি হচ্ছিলো বিদ্রোহের জন্য, মোল্লা-মওলবীর দল জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন ইংরেজী শিক্ষার বিরুদ্ধে। সাথে সাথে গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দৈত্যের মতো মাথা উঁচু করে দেশের আকাশ-বাতাস বিষময় করে তুলেছিলো। সে বিষাক্ত আবহাওয়ার মধ্যে জন্মেও আমীর আলী কেমন করে ইংরেজী শিক্ষা লাভ করলেন, তা সত্যি ভাববার বিষয়।

উনিশ শতকের প্রথম ভাগের মানুষ হলেও সাদত আলী ঠিক সেকেলে লোক ছিলেন না। কেমন করে বলতে পারিনে, তাঁর মনে আধুনিকতার হাওয়া লেগেছিলো। সেই সুদূর অতীতে তিনি বিশ শতকের তরুণ মনোবৃত্তি নিয়ে জন্মেছিলেন। গোঁড়ামির পাকে তাঁর মন এতোটুকু কলুষিত হয়নি। মোল্লাদের ফতোয়া তাঁকে এতোটুকু বিচলিত করেনি।

আমীর আলী ছিলেন উদার পিতার যোগ্য পুত্র। সাদত আলী কুসংস্কারকে জয় করেছিলেন। কাজেই, আমীর আলী যে মাদ্রাসায় আগ্রহী হবেন, তাতে অবাক হবার আপন ভাই সৈয়দ ওয়ারেস আলী হুগলী জেলাস্কুলে পড়তেন। আমীর আলীও উপযুক্ত বয়সে ভাইয়ের পথ অনুসরণ করলেন।

সৈয়দ ওয়ারেস আলী পরিশ্রমী ও মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরিশ্রমের পুরস্কার স্বরূপ তিনি দু’বছর মাসিক তিরিশ টাকা করে সিনিয়র বৃত্তি পেয়েছিলেন। কলেজের শিক্ষা শেষ করে তিনি হুগলী কলেজের এংলো পারসিয়ান বিভাগের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন।

তবে, একাজ তিনি বেশীদিন করেননি। তার অসাধারণ কর্মশক্তির পরিচয় পেয়ে ইংরেজ সরকার তাকে ডেপুটি কালেক্টরের পদ দান করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য আমীর আলী সহোদর সৈয়দ ওয়ারেস আলীর কাছে অনেকখানি ঋণী।

ইংরেজীতে একটি কথা আছে -‘মর্নিং শোজ দি ডে’। আমীর আলীর জীবনে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। পরিণত বয়সে আমীর আলী বিদ্যা-বুদ্ধির জন্য জগৎজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ছেলেবেলায়ও তাঁর লেখাপড়ার প্রতি ছিলো দারুণ আগ্রহ।

আমীর আলীর পিতা সাদত আলী অর্থশালী লোক ছিলেন না। এজন্য ছেলেবেলায় আমীর আলীকে খুব কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রতি বছরই তিনি ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করতেন।

স্বনামধন্য সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার সরকার আমীর আলীর সহপাঠী ছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় অক্ষয় কুমার প্রথম স্থান অধিকার করেন। আমীর আলী প্রথম বারোজনের মধ্যে একজন হয়ে প্রথম শ্রেণীর বৃত্তি লাভ করেন। প্রবেশিকা পাশ করে আমীর আলী হুগলী কলেজে ভর্তি হন।

দেখতে দেখতে তার কলেজের পড়া শেষ হয়ে এলো। ১৮৬৭ সালে তিনি বি. এ. পাশ করেন। তারপর ইতিহাস ও অর্থনীতিতে এম. এ. পাশ করে সম্মানের সাথে বি. এল. ডিগ্রী লাভ করেন। বাংগালী মুসলমানদের মধ্যে আমীর আলীই সকলের আগে এম. এ পাশ করেন। স্বনামধন্য ডক্টর ত্রৈলোক্যনাথ মিত্র ঐ সময় হুগলী কলেজের আইনের অধ্যাপক হিলেন। আমীর আলী তাঁরই ছাত্র।

বলতে ভুলে গেছি. আমীর আলী ছাত্রজীবনে মুহসিন ফান্ডের সাহায্যও পেয়েছিলেন। আজকাল মুসলিম সমাজের প্রথম সারিতে আছেন যাঁরা, তাদের অনেকেরই উৎসাহ উদ্যম সফল হয়েছে, দানবীর হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের দানের বদৌলতে। মুহসিনের দানের হাত প্রসারিত না হলে মনীষী আমীর আলীর শিক্ষালাত সম্ভব হতো কিনা কে বলতে পারে। দানবীর মুহসিনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আজ আমরা তসলীম জানাই।

ওকালতী-ব্যারিস্টারী

বি. এল. পাশ করে আমীর আলী কোলকাতা হাইকোর্টে ওকালতী শুরু করেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। তা সত্ত্বেও প্রথম প্রথম তার মোটেই পসার জমেনি। এক এক সময় হাইকোর্ট ছেড়ে তাকে পুলিশ কোর্টে গিয়েও কাজ করতে হয়েছে। তবু আমীর আলী পিছিয়ে যাননি। কর্মজীবনের কঠিন পরীক্ষার সময়েও দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি কাজ করে গেছেন।

শৈশবেই আমীর আলীর মনে বিলেত যাবার ইচ্ছা জেগেছিলো। পারিবারিক অসুবিধার জন্য তখন তা বাস্তবে পরিণত হয়নি। দিন যায়, মনের আকাংখা উঁকি মারে মনের কোণে। অবশেষে মনের ইহারই জয় হলো। স্টেট-স্কলারশীপ দিয়ে ১৮৬৮ সালে তৎকালীন ভারত সরকার আমীর আলীকে বিলেতে পাঠিয়ে দেন আইন পড়ার জন্যে।

১৮৭৩ সালে বিয়েতের ইনার টেম্পল থেকে আমীর আলী ব্যারিস্টারী পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে তার আগে খুব বেশী লোক ব্যারিস্টারী পাশ করেননি। দেশে এসে আমীর আলী আবার হাইকোর্টে যোগদান করেন। অল্প দিনের মধ্যে তাঁর যশোসৌরভ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যারিস্টার হিসেবে, বক্তা হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশেবিদেশে।

১৮৭৪ সালে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য নির্বাচিত হন। তার পর বন্ধুর প্রেসিডেন্সী কলেজে আইনের অধ্যাপকের আমীর আলী পদ লাভ করেন। এ পদে তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর কাজ করেন।

আমীর আলী যখন কর্মক্ষেত্রে নামেন, তখন বাংলার মুসলমান হতাশায় ভেংগে পড়ছিলো। গৌড়ের মসনদ হারিয়েছিলো মুসমান পলাশীর আমবাগানে, সাথে সাথে তাদের মনের মসনদও বুঝি ভেংগে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো।

ঊনিশ শতকের মুসলমানের মা ছিলো কোন মত, না ছিলো পথ, না ছিলো উৎসাহ-উদ্যম, না ছিলো অর্থ। আমীর আলী বুঝলেন, ঘুমন্ত আর সর্বহারা মুসলিমকে না জাগালে উপমহাদেশের মুক্তি নেই।

সেদিনের পথহারা, রাজাহারা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অভাব ছিলো নায়কের অভাব। চালকবিহীন জাতীয় তরণী দিকে দিকে ফরিয়াদ করে ফিরছিলো—‘নেতা চাই, নেতা চাই’।

আমীর আলীর মনে হলো, জাতির এ অভাব তাঁকেই দূর করতে হবে, সমাজের ও দেশের দাবী তাঁকেই মেটাতে হবে। সমাজের এ দাবী মেটাবার জন্য আমীর আলীর প্রেরণায় ১৮৭৬ সালে ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’-এর জন্ম হয়েছিলো।

‘সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’ মুসলমান সমাজের জীবনপথে কতোটুকু আলো দান করেছে, তা আলোচনা করার সময় এ নয়। তবু আজ আমরা একথা বলবো—বাংলার ইতিহাসের সেই আঁধার যুগে এ সমিতি সমাজের মরাপ্রাণে যে কর্মের প্রেরণা জাগিয়েছিলো, বাংগালী মুসলমানের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। পঁচিশ বছর আমীর আলী এ সমিতির সম্পাদক ছিলেন। এ সুদীর্ঘ সময় তিনি মুসলমানদের উন্নতির জন্য তার সমস্ত শক্তি, সমস্ত সামর্থ্য ব্যয় করেছেন।

রাজপদে-কাউন্সিলে

আগেই বলেছি, আমীর অলী আর দশ জনের মতো ছিলেন না। তিনি ছিলেন অসাধারণ পরিশ্রমী ও প্রতিভাশালী। হাইকোর্টে যোগদান করার সাথে সাথেই তার উপর সরকারের নজর পড়ে।

১৮৭৮ সালে ছোটলাট স্যার এসলি ইডেনের সময় তিনি প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের পদ বিরাট দায়িত্বপূর্ণ হলে একাজে তিনি অসামান্য যোগ্যতার পরিচয় দেন সরকার বদ্ধ হন তাঁর অদ্ভুত কর্মশক্তির পরিচয় পেয়ে। রাজু-দরবার থকে যোগ্যতার পুরস্কার আসে। তিনি অস্থায়ীভাবে প্রধান প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের পদ লাভ করেন।

স্বাধীন আবহাওয়ায় আমীর আলী মানুষ। বাধাধরা চাকুরী জীবন তাঁর ভালো লাগলো না। হাতছানি দিয়ে মুক্ত আলো-বাতাস তাঁকে ডাকে। তাঁর ইচ্ছা জাগে আবার আইন ব্যবসায়ে ফিরে যাবার জন্যে। বন্ধুরা অনুরোধ করেন চাকুরী ধরে থাকতে। সরকার বেঁধে রাখতে চান নানা লোভ দেখিয়ে। অবশেষে মুক্ত মনের জয় হলো। রাজশক্তিকে অবাক করে দিয়ে, বন্ধুবান্ধবের অনুরোধ উপেক্ষা করে ১৮৮১ সালে তিনি চাকুরীতে ইস্তফা দেন। যুগে যুগে যুক্ত মন এ ভাবেই খাঁচা ভেংগে বিরাট বিশ্বে মেলে দেয় তার ডানা।

চাকুরী ছেড়ে দিয়ে আমীর আলী ব্যারিস্টারীতে ফিরে আসেন। এবার ঘরে তার মক্কেলের ভীড় জমে ওঠে। টাকা আসে স্রোতের মতো। কর্মক্ষেত্রও চারদিকে বেড়ে চলে। জনসাধারণ তাঁকে প্রীতি অর্ঘ দান করে। সরকারী মহলেও তার আদর-কদর হয় খুব।

শিগগিরই তাঁকে বংগীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচন করা হয়। ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে আসীন ছিলেন। এ সময় বড়লাট লর্ড রিপন মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাঁকে উপমহাদেশের ব্যবস্থাপক সভায় পাঠিয়ে দেন। আইন পরিষদে আমীর আলী একটা স্থায়ী কীর্তি রেখে এসেছেন। কি বক্তৃতায়, কি তর্কযুদ্ধে, কি সমাজের অধিকার আদায় করে নিতে—সব কিছুতেই আমীর আলী সত্যি অসাধারণ জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। এ সময় তার সহযোগিগণ–কেবল সহযোগী কেনো, দোস্ত-দুশমন সবাই তার তারিফ করেছেন।

লর্ড ডাফরিন এ সময় আমীর আলীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। ১৮৮৭ সালে রাজ-দরবার থেকে এনাম আসে—তিনি সি-আই-ই উপাধিতে ভূষিত হন। ১৮৯৪ সালে তিনি ঠাকুর-আইন অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

বিচারক পদে

বাদশাহী আমলে রাজ-দরবারে বিজিত জাতির যথেষ্ট অধিকার হিলো। উজির, নাজির, সুবাদার এমনকি সিপাহশালারের পদ পর্যন্ত যোগ্যতা থাকলে যে-কোনো হিন্দুও লাভ করতে পারতেন। ইংরেজ রাজত্বের প্রথম ভাগে কিন্তু আমরা অন্য রকম ব্যবস্থা দেখতে পাই। বৃটিশ উপমহাদেশে সুবাদার সেনাপতির পদ তো দূরের কথা, জজ-ম্যাজিস্ট্রেট পদের কথাও কেউ ভাবতে পারেনি। সুতরাং ১৮৯০ সালে স্যার রমেশচন্দ্র মিন্ত্রের পর আমীর আলী যখন হাইকোর্টের বিচারপতির পদ লাভ করেন, তখন মুসলমান সমাজ অনিন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলো।

আমীর আলীর আগে একজন মাত্র মুসলমান জজিয়তি পেয়েছিলেন। সে ভাগ্যবান আর কেউ নন-মরহুম স্যার সৈয়দ আহমদের পুত্র জাস্টিস সৈয়দ মাহমুদ।

জজের পদে নিযুক্ত করে আমীর আলীকে সরকার বাহাদুর দয়া দেখিয়েছিলেন, এমন কথা তাঁর শত্রুও বলতে পারবে না। বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতা আমীর আলীর অবশ্যই ছিলো। বরং বলা যায়, তাঁকে স্থান দেওয়ায় হাইকোর্টেরই গৌরব বেড়েছিলো। ব্যারিস্টারীতে, আইন অধ্যাপনায়, ব্যবস্থা পরিষদে, সবার উপরে প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমীর আলী যে জ্ঞান ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাতে তাকে নিযুক্ত না করলে সরকারের পক্ষেই অগৌরবের বিষয় হতো।

নিরপেক্ষতা, নির্লোভ মনোবৃত্তি, ঠাণ্ডা মাথা না থাকলে কেউই বিচারক হিসেবে সফল হতে পারেন না। আমীর আলী এ সকল দুর্লভ গুণের আধার ছিলেন। এ কারণেই তিনি শত্রু-মিত্র, আসামী ফরিয়াদী, সাক্ষী-ব্যারিস্টার সকলেরই প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।

মুসলমান আইনে আমীর আলীর ছিলো অসাধারণ জ্ঞান। মুসলিম আইনের জটিল সমস্যাগুলো তিনি সহজেই মীমাংসা করে দিয়েছেন। যখনই কোন ব্যাপার নিয়ে গোলযোগ দেখা দিতো, হাইকোর্টের বিচারকগণ আমীর আলীর কাছে ছুটে যেতেন। মুসলিম আইনে আমীর আলীর দৃষ্টি কতো সূক্ষ্ণ ছিলো, জ্ঞান কতো গভীর হিলো, নীচের ঘটনা হতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

একবার হাইকোর্টে ফুলবেঞ্চে একটি ওয়াকফ মোকদ্দমার বিচার হচ্ছে। ‘রায়’ প্রকাশের সময় দেখা গেলো, বিচারপতিগণ সকলেই একমত, কেবল আমীর আলী ভিন্নমত পোষণ করছেন। যথাসময়ে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রিভি-কাউন্সিলে আপীল করা হলো।

প্রিভি-কাউন্সিল অন্যান্য সকলের মত অগ্রাহ্য করে আমীর আলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করলেন।

১৯১১ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উপমহাদেশীয় ব্যবস্থাপক সভায় ওয়াকফ বিল আনেন। দু’বছর পরে এই বিল আইনে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে আমীর আলীই ছিলেন এ বিলের জন্মদাতা।

বিচারক হিসেবে আমীর আলী যে ভদ্রতা ও নম্রতার পরিচয় দিয়েছেন, হাইকোর্টের ইতিহাসে তার নজির নেই। অনেক সময় দেখা গেছে, ‘জুনিয়র’ উকিল-ব্যারিস্টারগণ পয়েন্ট হারিয়ে ফেলে মুল থেকে দূরে সরে গিয়ে বাজে বিষয় নিয়ে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করছেন। অন্য বিচারক হলে এসময় একটু উষ্ণতারই পরিচয় দিতেন। আমীর আলীর ব্যবহারে কিন্তু উগ্রতা প্রকাশ পেতো না কখনো ৷ ধীরভাবে তিনি ভুল সংশোধন করে দিতেন।

ডঃ ত্রৈলোক্যনাথ মিত্র ছিলেন আমীর আলীর শিক্ষক। অনেক সময় তিনি ব্যবহারজীবী হিসেবে ছাত্রের কোর্টে উপস্থিত হতেন। শিষ্য বিচারকের আসনে সমাসীন। গুরু নীচে দাঁড়িয়ে মোকদ্দমা বুঝিয়ে মক্কেলের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করছেন। আমীর আলী গুরুর মর্যাদা রক্ষা করেছেন, শিক্ষকের পায়ে শ্রদ্ধার অঞ্জলি দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে পক্ষপাতিত্ব দেখাননি কোনোদিন।

বিচারক হিসেবে আমীর আলীর যে খ্যাতি তা কেবল ভদ্রতার জন্য নম্র, তাঁর …অন্য কারণও বর্তমান। আইন শাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, গান্ধীরভাবে সবকিছু দেখবার ক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি প্রভৃতির জন্যই তিনি স্মরণীয়। সতেজ, সাবলীল ও নির্ভুল ভাষার জন্যই তাঁর বিচারের রায় ব্যবহারজীবিদের কাছে ছিলে আদরের সামগ্রী।

বিলেতে প্রবাস জীবন

দীর্ঘ চৌদ্দ বছর যোগ্যতার সাথে জয়িতি করে ১৯০৪ সালে জাস্টিস আমীর আলী অবসর গ্রহণ করেন।

রাজকার্য শেষ করে তিনি সমস্যায় পড়লেন-কোথায় থাকবেন, উপমহাদেশে না বিয়েতে, স্বদেশে না বিদেশে। তাঁর স্ত্রী ইংরেজ মেয়ে। তাঁর ইচ্ছে স্বামীকে নিয়ে বিলেতে চলে যান। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বলেন দেশে থাকতে।

আমীর আলী কর্মবীর, কর্মই তাঁর ধর্ম, কর্মেই তাঁর আনন্দ। বিরাট বিশ্বের বিরাট কর্মক্ষেত্র ডাকে শ্বেত দ্বীপের দিকে। জন্মভূমি সবুজ আঁচল দুলিয়ে হাতছানি দেয়, বেঁধে রাখতে চায় স্নেহের আঁচলে। অবশেষে কর্মেরই জয় হয়। আমীর আলী ঠিক করেন অবশিষ্ট জীবন বিলেতেই থেকে দেশের, সমাজের-সবার উপরে ইসলামের সেবা করে কাটাবেন।

লণ্ডনের কোলাহল আমীর আলীর ভালো লাগেনি। বার্কশায়ারের জন-বিরল ছায়াঘেরা পল্লীতে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ‘ল্যাম্বডেনস’ ভবন। এ বাড়িটিকে কেন্দ্র করে আফটনের লর্ড পরিবারের কতো কীর্তি, কতো কাহিনী মূর্তি পরিগ্রহ করেছে। পাহাড়ের পাদদেশে দেশীয় স্টাইলে তৈরি বাড়ি। একদিকে বীনহাম, অন্যদিকে ইংগল ফিল্ড উদ্যান, সামনে লাইম বৃক্ষ-শোভিত ছোট একটি হ্রদ। এ বাড়িটি আমীর আলীর পছন্দ হয়। বেগম আমীর আলী উপমহাদেশের সারাসিন শিল্পের নিদর্শনসমূহ সংগ্রহ করেছিলেন। রূপ-রংগের এ সকল উপকরণ দিয়ে ল্যাম্বডেনসকে তিনি বিচিত্র ছন্দে মনোহর করে তুলেছিলেন।

সাহিত্য সাধনায়

আমীর আলী যে কেবল একজন দেশপ্রাণ কর্মী ছিলেন বা একজন বিচক্ষণ বিচারক ছিলেন, তাই নয় ; তিনি একজন সত্যিকারের সাহিত্যিকও ছিলেন। বৃটিশ ভারতের মুসলমান সাহিত্য সাধকদের কথা আলোচনা করতে গেলে সবার আগে আমাদের মনে পড়ে আমীর আলীর কথা।

বিরাট একটা কবিপ্রাণ নিয়ে জন্মেছিলেন আমীর আলী। সত্যিকারের দরদ দিয়ে তিনি লিখেছেন। এ জন্যই এক এক জায়গায় তার রচনা ব্যথার রংগে রংগিন হয়ে উঠেছে।

আমীর আলীর প্রথম লেখা মৌলিক রচনা নয়—অনুবাদ মাত্র। মুহসিন ফাণ্ডের মোতাওয়াল্লী মরহুম সৈয়দ কেরামত আলী সাহেবের একটি ছোট্ট উর্দু বইয়ের ইংরেজী তরজমা করেন তিনি। এ লেখাটির হয়তো সাহিত্যের দরবারে বিশেষ কিছু মূল্য নেই। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, এ লেখার ভাষা ছিলো সাবলীল ও সতেজ, বলবার ভংগীও ছিলো চমৎকার। ব্যারিষ্টারী পড়ার সময় আমীর আলী ‘এ ক্রিটিক্যাল একজামিনেশন অব দি লাইফ এন্ড টিচিংস অব মুহাম্মদ’ নামে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধটি বিলেতের সাহিত্য সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। তাঁর বন্ধু-বান্ধবগণ পঞ্চমুখে এর প্রশংসা করেছিলেন।

জাস্টিস আমীর আলী সাহিত্যের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ‘স্পিরিট অব ইসলাম” অর্থাৎ ইসলামের চেতনা লিখে। তারপর একে একে ‘আরব জাতির ইতিহাস’, ‘এথিকস অব ইসলাম’, ‘মডার্ণ সিরিজ অব ইসলাম’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আগেই বলেছি, উনিশ শতকের মুসলমানদের না ছিলো কোন মত, না ছিলো কোন পথ ; নিরাশার অন্ধকারে তারা খাবি খাচ্ছিলো শুধু।

মুসলমান অর্থে সভ্য-জগত বুঝতো-লম্বা দাঁড়ি, বিরাট আল-খেল্লা, তৈলসিক্ত রুমী টুপি। এক হাতে কোরআন, অন্য হাতে তরবারি নিয়ে মুসলমানগণ ধর্ম প্রচার করছেন। ইসলামে নারীর মর্যাদা নেই, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বহু-বিবাহ কলুষিত যাদুকর ইসলামের প্রবর্তন করেছেন—এ সকলই ছিলো সে-যুগে ইসলাম সম্বন্ধে বিশ্ববাসীর ধারণা।

আমীর আলী দেখলেন, এ সকল কলংক ঘুঁচাতে না পারলে জীবন বৃথা। অতীতের গৌরবময় ছায়াছবি জাতির সামনে হাজির করতে না পারলে, মুসলমান সমাজের কোন উন্নতি নেই। এ আশায় বুক বেঁধেই সত্য-মুসলিম আমীর আলী কলম ধরেছিলেন-স্পিরিট অব ইসলাম এবং আরব জাতির ইতিহাস সমাজের সামনে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

আমীর আলীর সাধনা আজ অনেকটা সফল হয়েছে। ইসলামের নামে ইউরোপের শিক্ষিত সমাজ আর নাক সিটকায় না। অগ্রদূতের পথ অনুসরণ করে ইউরোপে ইসলামের আলো বড় করে জানবার জন্য অনেকেই আজ জীবন উৎসর্গ করেছেন। আলহাজ্ব লর্ড ফারুক হেডলী, মিঃ মার্মাডিউক পিকথল প্রমুখ মনীষী ইসলামের শান্তিছায়ায় আশ্রয় নিয়ে আজ ‘স্পিরিট অব ইসলামের’ জয় ঘোষণা করছেন।

আমীর আলী আমীর আলীর প্রতিভা ছিলো বহুমুখী। ধর্মপুস্তক ও ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য তিনি যেমন অমর, তেমনি আইন পুস্তকের জন্যও তিনি স্মরণীয়। তাঁর রচিত আইন প্রন্থাবলী এখনো উকিল-ব্যারিষ্টার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ যত্নের সাথে পাঠ করে থাকেন। তাঁর সম্পাদিত আইন গ্রন্থের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি সবচেয়ে বেশী নাম করেছে

  • স্টুডেন্টস হ্যাণ্ড-বুক অব মোহামেডান ল’।
  • মোহামেডান ল’।
  • দি পারসোনাল ল’ অব দি মোহামেডান
  • সিভিল প্রসিডিউর ইন বৃটিশ ইণ্ডিয়া।
  • এ কমেনটারী অন দি বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট।
  • দি ল’ অব এভিডেন্স এপ্‌লিসেবল টু দি ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া।

ঠাকুর ল’ লেকচারে আমীর আলী মুসলিম আইনকে সিস্‌টেমেটাইস করে সকলের শ্রদ্ধা ভাজন হয়েছেন। যিনি এ বক্তৃতা পাঠ করেছেন, তিনিই তাঁর তীক্ষ্ণ বিচার-বুদ্ধির প্রশংসা করবেন। অল্পদিন হলো এ বক্তৃতা জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বই হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

আমীর আলী চিরকালই উদার মতাবলম্বী। যেমন বিচারক হিসেবে, তেমনি গ্রন্থকার হিসেবে। সব সময়ই তিনি আইনের নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন। যুগ-ধর্মের প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি প্রায়ই মুসলিম আইনের নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন, যুগ ধর্মের প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি প্রায়ই মুসলিম আইনের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মুসলমান আইন যে আজ অনেকটা বিস্তার লাভ করেছে, তার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা আমীর আলীরই প্রাপ্য।

আমীর আলী বিলেতী মাসিক পত্রিকা সমূহের নিয়মিত লেখক ছিলেন। ‘নাইনটিন্‌থ সেঞ্চুরি এণ্ড আফটার’ পত্রিকায় তাঁর বহু মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিলেতী কাগজে উপমহাদেশের অভিযোগ নিয়ে এমনভাবে আন্দোলন করতে, মুসলমানের দুঃখ-দৈন্য এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে আর কেউ পেরেছেন কিনা আমাদের জানা নেই। আগেই বলেছি, আমীর আলীর লেখায় দরদ ছিলো, প্রাণ ছিলো—সত্যকে বুঝবার বুঝাবার বিপুল একটা চেষ্টা ছিলো। এজন্য আমীর আলীর প্রবন্ধ বৃটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তুলতো। অনেক সময় শাসন ব্যাপারে আমীর আলীর মত তাঁরা গ্রহণও করতেন।

প্রিভি-কাউন্সিল

একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, আমীর আলী বিলেত গিয়ে বসে থাকেন নি। দেশের ও দশের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্ম নিয়োগ করার জন্যই তিনি বিলেত গিয়েছিলেন। তাঁর প্রবাস-জীবন কেটেছে জনসাধারণের, বিশেষ করে পাক-ভারত ও বাংলাদেশের মুসলমানদের কাজে-কর্মেই।

প্রবাস জীবনের প্রথম ভাগে আমীর আলীর কাজ ছিলো মুসলিম লীগের বাণী প্রচার। এ ব্যাপারে সুবিধার জন্য তিনি লণ্ডনে মুসলিম লীগের শাখা সমিতি স্থাপন করেন। আজীবন তিনি ছিলেন এ সমিতির সভাপতি। দীর্ঘকাল তিনি এ দায়িত্বপুর্ণ পদে থেকে যেভাবে মুসলিম সমাজের মংগলের জন্য চেষ্টা করেছেন, উপমহাদেশের ইতিহাসে তা সত্যই অনবদ্য।

লর্ড মর্লি যখন মর্লি-মিন্টো শাসন-সংস্কারের খসড়া তৈরি করছিলেন, তখন মুসলমান হাঁটি হাঁটি পা পা করে সবেমাত্র রাজনীতির দিকে এগুচ্ছিলো। আন্দোলন করে রাজনৈতিক অধিকার আদায় করবার মতো ‘পলিসি’ বা ‘ডিপ্লোমেসি’ মুসলমান তখনো শিখে উঠতে পারেনি। সর্বহারা মুসলমান সমাজের স্বার্থ রক্ষার জন্য আমীর আলী এ সময়ে রাতের আরাম ও দিনের বিশ্রামকে হারাম করেছিলেন।

ডেপুটেশন পাঠিয়ে, প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখে আমীর আলী ভারত সভার সভ্যগণকে মুসলমান সমাজের দাবী-দাওয়ার কথা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবং সাথে সাথে মুসলিম সমাজকে তাদের অধিকার সম্বন্ধে সজাগ করে তুলেছিলেন। রাজনীতিতে দুর্বলের স্থান নেই। সার্ভাইভেল অব দি ফিটেস্ট (অর্থাৎ-বসুন্ধরা বীরভোগ্যা)–এটাই রাজনীতির মূল কথা, একথা আমীর আলী মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন।

এ বিষয়ে মুসলমানকে সচেতন করে তোলার জন্য তিনি চেষ্টার ত্রুটি করেননি। তাই ভারত শাসন ব্যাপারে মুসলমান যে অধিকার ভোগ করছে, তা অনেকটা আমীর আলীরই দৌলতে। আমীর আলী না থাকলে প্রবল প্রতিবেশীর প্রতিযোগিতায় মুসলমানের যে কী অবস্থা হতো, তা ভাবলে শরীর শিউরে উঠে। নতুন যুগের আলোকময় প্রভাতে, জাতীয় জাগরণের শুভমুহর্তে উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমান আমীর আলীর স্মৃতির প্রতি তসলীম জানায়।

শাসন-সংস্কারের ব্যাপারে মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে আমীর আলী যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাতে অনেকে আশা করেছিলেন, তিনি তখন থেকে ভারতসভার সভ্য মনোনীত হবেন। ভারত-সভার মেম্বার হতে হলে যে সকল গুণের দরকার, আমীর আলীর তার কোনোটারই অভাব ছিলো না।

তিনি ছিলেন একাধারে নেতা, কর্মী, বাগ্মী, সাহিত্যিক এবং আইনজ্ঞ। ভারত-শাসন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিলো যথেষ্ট, বিলেতের রাজনৈতিক মহলে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিলো প্রচুর। সুতরাং তাঁকে মনোনীত করলে বৃটিশ সরকারের অন্যায় ত’ হতোই বরং তাঁরা সুবুদ্ধিরই পরিচয় দিতেন; কিন্তু নির্বাচনের ফল যখন প্রকাশিত হলো, তখন দেখা গেলো লর্ড মর্লি আমীর আলীর দাবীকে পদদলিত করে অন্য লোককে মনোনীত করেছেন। এভাবে জনপ্রিয় নেতার দাবী উপেক্ষিত হলো দেখে উপমহাদেশের মুসলমানগণ সত্যি সত্যি সেদিন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

যা হোক, মুসলিম সমাজের ক্ষোভের কারণ শিগগিরই দূর হলো। আমীর আলী ভারত-সভায় প্রবেশ করতে না পারায় তাদের অন্তরে যে ব্যথা বেজেছিলো, ইংরেজ-মন্ত্রিসভা তা দূর করলেন আমীর আলীকে প্রিভি-কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত করে।

১৯০৯ সালের ১৩ই নভেম্বর আর্মীর আলী প্রিভি-কাউন্সিলের সভ্য নিযুক্ত হন। প্রিভি-কাউন্সিলের জুডিসিয়াল কমিটি উপমহাদেশ ও বৃটিশ উপনিবেশগুলোর সকল মামলা-মোকদ্দমার চূড়ান্ত মীমাংসা করেন। সমাজের শ্রেষ্ঠ আইনবিদদেরকে নিয়ে এ কমিটি গঠিত। আমীর আলী এ কমিটিতে বহু দিন যোগ্যতার সাথে কাজ করেছেন। তাঁর আগে এ উচ্চ দায়িত্বপূর্ণ পদলাভ করার সৌভাগ্য তৎকালীন কোন ভারতবাসীর হয়নি।

প্রিভি-কাউন্সিলে প্রবেশ করে আমীর আলীর গৌরব বেড়েছে কিনা জানি না, তবে তাঁর মতো আইনবিদকে পেয়ে জুডিসিয়াল কমিটির শক্তি যে অনেকখানি বেড়েছিলো, একথা আমরা জোর করে বলতে পারি।

আমীর আলী ও মুসলিম ভারত

সংসারে যতো লোক আসে তার মধ্যে প্রায় সকলেই ঋণী হয়ে যায়, জগৎকে ঋণী করে যেতে পারে খুব কম লোকই। আমীর আলী ছিলেন এ ক’জন লোকের একজন, যাঁরা বলতে পারতেনঃ দেশকে, সমাজকে, সবার উপর মানুষকে ঋণী করে গেলাম।

উপমহাদেশ ও মুসলিম জগৎ আমীর আলীর ঋণ শোধ করতে পারবে না। যৌবনের সোনার ঊষায় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেই আমীর আলী সমাজ সেবায় ব্রতী হয়েছিলেন। সর্বহারা মুসলমানদেরকে সভা করে, বক্তৃতা করে, বই লিখে তিনি কর্মের পথে, জ্ঞানের পথে, স্বাধীন চিন্তার পথে আগ্রহী করে তুলেছিলেন।

মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করার জন্য, মুসলিম জমিদারগণকে মামলা-মোকদ্দমা, ঋণজাল হতে মুক্ত করার ও মুসলমান সমাজকে শিক্ষার পথে টেনে আনার জন্য আমীর আলীর মতো চেষ্টা ক’জনে করেছেন?

আমীর আলীর শেষ জীবন বিদেশে কেটেছে; কিন্তু তা হলেও উপমহাদেশের জন্য তাঁর ভাবনার অন্ত ছিলো না। জীবনের শেষ মুহর্ত পর্যন্ত তিনি তার প্রিয় জন্মভূমির সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা করে গিয়েছেন। বাংলার জন্যও তিনি চিরকাল নাড়ীর টান অনুভব করতেন, বাংলার প্রবাসী ছাত্রগণ সব সময়ই তার স্নেহ-সহানুভূতি পেয়ে ধন্য হতো।

আমীর আলীর সমাজ-সেবা কেবল উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ আমীর আলী ছিলো না, মুসলিম জগতের দিকে দিকে তিনি কর্মের হাত প্রসারিত করেছিলেন। ১৯০৮ সালে তুরস্কে তরুণ আন্দোলন জেগে ওঠে। নবীন তুর্কী যে কেবল অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধেই মাথা তুলেছিলো তা নয় ; অত্যাচার, অবিচার, গোড়ামি, কুসংস্কার সবকিছুর বিরুদ্ধেই ছিলো এদের বিদ্রোহ।

অনেক দিনের অন্ধ বিশ্বাসের গোড়ায় আঘাত লাগায় তুরস্কের প্রাচীনপন্থীর দল সেদিন একেবারে ক্ষেপে উঠেছিলো। শেখুল ইসলাম কোফরী ফতোয়া জারি করে তরুণ আন্দোলনের টুটি টিপে ধরতে এগিয়ে এসেছিলেন। তুর্কী-তরুণের এ বিপদের দিনে আমীর আলী নীরব থাকতে পারেন নি। সমস্ত শক্তি নিয়ে তিনি শেখুল ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।

জন-সমুদ্র মন্থন করে আমীর আলী সেদিন প্রমাণ করেছিলেন, তরুণ আন্দোলন ইসলাম বিরোধী নয়, বরং নব্যতুর্কীই হবে ভবিষ্যতে ইসলামের নিশান-বরদার ; নবীন তুরস্ককে নেতা করে কর্মের পথে, জ্ঞানের পথে, স্বাধীন চিন্তার পথে মুসলিম জগতের নতুন করে যাত্রা শুরু হবে। তুরস্কের সে দুর্দিনে আমীর আলী শেখুল ইসলামের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে তরুণ আন্দোলনের পরিণাম কি হতো তা কে বলতে পারে?

পারস্যের জন্যও আমীর আলীর সহানুভূতি কম ছিলো না। পারস্যকে যখন ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবার কথা চলছিলো, এ সম্পর্কে আলোচনা করবার জন্য রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ এম, সাজোনভ মখন বিলেত গিয়েছিলেন, তখন আমীর আলী খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। বিলেতের ‘টাইমস’ প্রভৃতি সংবাদপত্র সুযোগ বুঝে পারস্যের অযোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো।

আমীর আলী এ সময় বিরাট প্রবন্ধ লিখে ইংরেজের পারস্য-নীতির প্রতিবাদ করেন। প্রবন্ধটি এতো সুচিন্তিত হয়েছিলো যে, মতভেদ সত্ত্বেও ‘টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় এ প্রবন্ধ স্থান পেয়েছিলো।

আমীর আলী এমন একটি অমূল্য রত্নের অধিকারী ছিলেন, যা মানুষকে সত্যিকারের মানুষে পরিণত করে। এ রত্ন আর কিছুই নয়-মানুষের প্রতি বেদনা-বোধ। মানুষের দুঃখে তাঁর প্রাণ কেঁদেছে, মানুষের বেদনায় তাঁর চোখ পানিতে ভরে এসেছে। তুর্ক-ইতালী ও তুর্ক-বলকান যুদ্ধের সময় যখন লাখো লাখো তরুণ যোদ্ধা মৃত্যুর কোলে চলে পড়ছিলো, তখন আমীর আলীর দরদী মনে সত্যই আঘাত লেগেছিলো। এ সময় আহতের সেবা করবার জন্য, আর্তের চোখের পানি মুছবার জন্য তিনি বৃটিশ রেডক্রস সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন।

তাঁর চেষ্টায় মুসলিম জগৎ থেকে হাজার হাজার টাকা চাঁদা উঠেছিলো, শত শত লোক স্বেচ্ছাসেবক হয়ে তুরস্কের যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে গিয়েছিলেন। মুসলিম-জগতে সেবা-সমিতি করবার, খাদেমুল ইসলাম গড়বার যে একটা আকাংখা দেখা যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে আমীর আলীর নীরব সাধনা।

বিগত মহাযুদ্ধের শুরুতে আমীর আলী আশা করেছিলেন, তুরস্ক ইংরেজের পক্ষে যোগদান করবে, কিন্তু সুলতান যখন মিত্র-শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন, তখন তিনি সত্যি শংকিত হয়ে পড়লেন।

যাহোক, ইংরেজ-মন্ত্রী লয়েড জর্জের ঘোষণা বাণী শুনে তাঁর শংকা অনেকটা কেটে গেলো। লয়েড জর্জ প্রচার করলেন-‘তুরস্কের স্বাধীনতা হরণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, ইস্তাম্বুল, থ্রেস বা এশিয়া মাইনর দখল করার ইচ্ছাও আমাদের নেই’।

যুদ্ধ শেষ হলো। লয়েড জর্জ কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা একেবারে ভুলে গেলেন। তুরস্কের ভাগ-বাটোয়ারার আয়োজন চলতে লাগলো। ইসলামের মৃত্যু-দুন্দুভি বেজে উঠলো। তুরস্কের এ বিপদে আমীর আলীর মনে কম ব্যথা বাজেনি।

খেলাফতের চিন্তায় এ সময় তিনি আহার-নিদ্রা ত্যাগ করেছিলেন। ১৯১৯ সালের ১৪ই জুন আমীর আলী, আগা খাঁ ও আব্বাস আলী বেগের নেতৃত্বে লণ্ডনের মুসলমানগণ তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। তারপর আমীর আলী প্রবন্ধ লিখে, সভা-সমিতি করে এক বিপুল অন্দোলন গড়ে তোলেন।

মুসলিম জগতের দিকে দিকে এ আন্দোলন প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। তুরস্ক যে তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে, সেজন্য সমস্ত গৌরব কামাল পাশারই প্রাপ্য সন্দেহ নেই। তা হলেও বলতে পারা যায়, আমীর অলীর আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। উপমহাদেশ ও মুসলিম জগতে আন্দোলন না জাগলে স্বাধীনতা-সংগ্রাম চালানো কামালের পক্ষে হয়তো খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো।

বিশ্বের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল লণ্ডনে আমীর আলী পঁচিশ বছর অবস্থান করেছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মুসলিম জগতের স্বার্থরক্ষার জন্য যখনি প্রয়োজন হয়েছে, তিনি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে মুসলিম জাহানের যে ক্ষতি হয়েছে, কবে তার পূরণ হবে, কে বলতে পারে ?

মত ও পথ

আমীর আলীর যা কিছু শক্তি, যা কিছু প্রতিভা-তার বেশীর ভাগই তিনি ব্যয় করেছিলেন মুসলিম সমাজের উন্নতির চেষ্টায়। মুসলমানকে বড় করবো—এটাই ছিলো তাঁর সাধনা, ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবো—এটাই ছিলো তাঁর কামনা। কিন্তু সাম্প্রদায়িক নেতা বলতে যা বোঝায়, তিনি ঠিক তা ছিলেন না। গোঁড়ামির লেশমাত্র তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

আমীর আলী ইসলামের সেবায় দেহ-মন উৎসর্গ করেছিলেম। কিন্তু অমুসলমানদের সাথেও বিরোধ বাধাবার চিন্তা তার মনে কখনো স্থান পায়নি। তিনি ছিলেন খাঁটি মুসলমান। তা’ বলে তিনি ভুলে যাননি যে—সাথে সাথে তিনি স্বদেশেরও। তিনি জানতেন, উপমহাদেশের প্রতি তার একটা কর্তব্য আছে। কারণ, এ তার জন্মভূমি, এর জলবায়ুতে তিনি মানুষ। এর দুঃখ-দৈন্য আমীর। আলীকে ব্যথিত করে তুলতো, এর অশিা-আকাংখা তাকে প্রেরণা যোগাতো।

যে সকল নেতা হিন্দু-মুসলমান মিলনের বাণী প্রচার করে গেছেন, আমীর আলী ছিলেন তাদের একজন। মনীষী সৈয়দ আহমদ হিন্দু-মুসলমানকে সুন্দরী মেয়ের দুটো চোখের সাথে তুলনা করেছিলেন। একটি চোখ নষ্ট হলে যেমন সুন্দরীর সৌন্দর্যের অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি হিন্দু-মুসলমানের একটি শক্তি পংগু হয়ে থাকলে, দেশ কখনো উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে না—হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে স্যার সৈয়দের মতো এটাই ছিলো আমীর আলীর ধারণা। আমীর আলী বুঝেছিলেন, হিন্দু-মুসলিম মিলন না হলে দেশের মুক্তি নেই, মুসলমান হিন্দুর সমকক্ষ না হলে হিন্দু-মুসলিম একতা সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক ব্যাপারে আমীর আলী মধ্যপন্থী ছিলেন। বিদ্রোহ করে শাসনযন্ত্রকে অচল করবার ইচ্ছে তার ছিলো না। ধামাধরা নীতিও তিনি পছন্দ করতেন না। বিলেতী রাজনীতিকরা এদেশবাসীর অযোগ্যতা, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের কথা বলে যখনি উপমহাদেশকে লোকচক্ষুতে হেয় করার চেষ্টা করেছে, তখনি আমীর আলী বজ্রকণ্ঠে তার প্রতিবাদ করেছেন। উপমহাদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন দেশের দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার জন্য আমীর আলী কম আন্দোলন করেননি।

আজকাল যোগ্যতা থাকলে উপমহাদেশের যে কেউ জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, এমনকি মন্ত্রীর পদ পর্যন্ত লাভ করতে পারে। তখন এ ব্যবস্থা ছিলো না। উচ্চ রাজপদ-সমুহ ইউরোপীয়দের জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিলো। বিগত শতকের শেষভাগে এ অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। আমীর আলী ছিলেন এ আন্দোলনের একজন পুরোধা। দেশের সেনাদলে দেশীয় সেনাপতি নিযুক্ত করবার জন্য এদেশবাসী বহুদিন থেকে আন্দোলন করে আসছিলো। এ আন্দোলনেও আমীর আলী অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশবাসীকে সেনাপতি হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করায়, এদেশবাসীর শৌর্য-বীর্য কেমন করে লোপ পেতে বসেছে, তা তিনি শাসক-সম্প্রদায়কে ভালো করে বুঝিয়ে দেন।

শাসকগণের সহানুভূতির অভাব দেখে আমীর আলী অনেক সময় ব্যথিত হতেন। শাসক ও শাসিতের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আমীর আলী আজীবন চেষ্টা করেছেন। শাসক ও শাসিতের মধ্যে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে তিনি ছিলেন মিলন-সেতু।

বাংলায় আমীর আলীর মতো রাজনীতিকের অভাব নেই, তাঁর মতো আইনবিদও এদেশে অনেক জন্মেছেন; কিন্তু স্বাধীন চিন্তার অগ্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে, বিশেষ করে মুসলিম বাংলায় তার নজির নেই। আইনবিদ আমীর আলীকে হয়তো লোকে একদিন ভুলে যাবে, রাজনীতিবিদ আমীর আলীর কথাও হয়তো ভবিষ্যতে লোকের মনে থাকবে না। কিন্তু মুক্ত-বুদ্ধির নিশান বরদার আমীর আলী মুসলমানের মনে চিরন্তন হয়ে থাকার দাবী রাখেন।

আমীর আলী যখন বাংলাদেশে জন্মেছিলেন, তখন চারদিকে অশুভ রাত্রির অন্ধকার বিরাজ করছিলো। মুসলমান সমাজ ইসলামের মর্মকে অস্বীকার করে আরম্ভ করেছিলেন অক্ষরের দাসত্ব। প্রাচীন-পন্থীদের অত্যাচারে স্বাধীন চিন্তা লোপ পেতে বসেছিলো। মানুষের চিন্তাকে বন্দী করে, মনকে খাঁচায় পুরে তথাকথিত নায়েবে-নবীর দল তাঁদের কর্তব্য সম্পাদন করছিলেন। নানারূপ অন্ধবিশ্বাস ও শতবর্ষের কুসংস্কার ইসলামের সত্যিকার রূপকে ঢেকে ফেলেছিলো। অন্ধ বিশ্বাস তৌহিদকে নির্বাসিত করেছিলো, আর যুক্তি-তর্কের স্থান অধিকার করেছিলো অন্ধ অনুকরণ। এ অন্ধকারের মধ্যে আমীর আলী দীপ-শিখা হাতে সমাজের সামনে দাঁড়ান–তরুণ মুসলিমের জন্য স্বাধীন চিন্তার পথ রচনা করেন। সেদিন আমীর আলী বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন। অন্ধ বিশ্বাস ইসলাম নয়, মুক্ত বিচার বুদ্ধির সাথে ইসলামের বিরোধ নেই।

বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টি নিয়ে জন্মেছিলেন আমীর আলী। ইসলামের প্রত্যেকটি বিধি-ব্যবস্থা, প্রত্যেকটি অনুশাসন তিনি বৈজ্ঞানিকের মন নিয়ে বিচার করেছেন। শতবর্ষের জঞ্জাল সরিয়ে ইসলামের যে রূপ তিনি উদ্ঘাটিত করেছিলেন, মানুষের মনে আজো তা উজ্জ্বল হয়ে আছে।

আমীর আলী ছিলেন একজন জীবন্ত মানুষ। আধুনিক যুগের ভাবধারাকে তিনি পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করেছিলেন। অন্তরের অনুভূতি দিয়ে, অধুনিকের দৃষ্টি দিয়ে, হজরতের জীবন ও কোরআনের শিক্ষাকে তিনি নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। পুরোনকে আমীর আলীর এ যে নতুন করে আবিষ্কার—জ্ঞানের পথে, মংগলের পথে এখনো তাই মুসলমানের সম্বল এবং পাথেয়।

অবসান

১৯২৯ সালের ৩রা আগষ্ট ইসলামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এদিন মুসলমানের বড় গর্বের, বড় বেদনার। এ দিনটিতেই আমীর আলী ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন।

১৮৪৯ সনে যে সুর্য বাংলার আকাশে দিগন্ত আলো করে উদিত হয়েছিলো, উনাশি বছর পরে পশ্চিম আকাশ আঁধার করে তা অস্তমিত হলো।

৩রা আগষ্ট সাসেক্সের বাড়িতে আমীর আলী ইকোল করেন। ৭ই আগস্ট ব্রুকউডের সমাধিক্ষেত্রে তাকে দাফন করা হয়। সৈয়দ ওয়ারেস আলী, লর্ড হেডলী, স্যার আব্বাস আলী বেগ, মওলানা মুহাম্মাদ আলী, ডক্টর জিয়াউদ্দিন খালেদ, শেলড্রেক প্রমুখ মনীষী সমাধির পাশে হাজির থেকে পরলোকগত মহাপুরুষের জন্য শেষ প্রার্থনা নিবেদন করেন।

ওকিং মসজিদের ইমাম মুফতি আবদুল মুহী এ জানাজা পাঠ করেছিলেন।

আমীর আলী পথের দাবী মিটিয়ে, দুনিয়ার দেনা চুকিয়ে পরপারে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তিনি আর ফিরবেন না। কিন্তু তাঁর স্মৃতি আমাদের মনে অক্ষয় হয়ে থাকবে। তাঁর উদারতা, তাঁর জ্ঞানপিপাসা, তাঁর বেদনা-বোধ আমাদেরকে জ্ঞানের পথে, কর্মের পথে, সত্য ও সুন্দরের পথে উৎসাহ দেবে।

আমীর আলী পঞ্চাশ বছরেরও বেশী কাল ধরে জাতীয় গগনে প্রভাতী তারার মতো দীপ্তমান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে মুসলমানের বুকের স্পন্দন থেমে গিয়েছিলো। মুসলিম জাহানের গগনে পবনে সেদিন কোন্ পুত্রহারা মায়ের বুক ফাটানো কাতরবাণী যেন গুমরে গুমরে ফিরছিলো — ‘হায় মেরি ফরজন্দ, ওগো আমার পুত্র’। সেদিনকার সে বেদনা-উৎসবের জন্য আমাদের জাতীয় কবি যে অশ্রুর মালা গেঁথেছিলেন, তা পাঠকের সামনে উপহার দিয়ে আজ আমরা বিদায় গ্রহণ করি :

‘একি বেদনার উঠিয়াছে ঢেউ দূর সিন্ধুর পারে

নিশীথ অন্ধকারে।।

পুরবের রবি ডুবিল গভীর বাদল-অশ্রু—ধারে

নিশীথ অন্ধকারে।।

ঘিরিয়াছে দিক ঘন ঘোর মেঘে,

পূবালী বাতাস বহিতেছে বেগে,

বন্দিনী মাতা একাকিনী জেগে কাঁদিতেছে কারাগারে।

শিয়রের দীপ যত সে জ্বালায় নিভে যায় বারে বারে।

নিশীথ অন্ধকারে।।

মুয়াজ্জিনের কন্ঠ নীরব আজিকে মিনার-চূড়ে,

বহে না শিরাজ-বাগের নহর, বুলবুল গেছে উড়ে।

ছিল শুধু চাঁদ, গেছে তরবার,

সে চাঁদও আঁধারে ডুবিল এবার,

শিরাজ-হারা কাঁপে মুসলিম অস্ত তোরণ দ্বারে।

উঠিতেছে সুর বিদায় বিধুর পারাবার পরপারে।

নিশীথ অন্ধকারে।।

ছিল না সে রাজা-কেঁপেছে বিশ্ব তবু গো প্রতাপে তার,

শক্ত দুর্গে বন্দী থাকিয়া খো লেনি সে তরবার

ছিল এ ভারত তারি পথ চাহি,

বুকে বুকে ছিল তারি বাদশাহী,

ছিল তার তরে ধুলার তখত মানুষের দরবারে।

আজি বরষায় তারি তরবার ঝলসিছে বারে বারে।

নিশীথ অন্ধকারে।।

তথ্যসূত্র: ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত সৈয়দ আমীর আলী (রচনায়: মুহম্মদ হবীবুল্লাহ বাহার) বইয়ের পিডিএফ থেকে সংগৃহীত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88