শাইখ মুহাম্মাদ উযাইর শামস রাহিমাহুল্লাহ’র জীবনী – ০১
শাইখ মুহাম্মাদ উযাইর শামস রাহিমাহুল্লাহ’র জীবনী – ০১
অনুবাদ: নাঈম সিদ্দীকী
শাইখ মুহাম্মদ উযাইর শামস ১৯৫৭ সালে ভারতের বিহার প্রদেশে মাধুবানি এলাকার বাঙ্কাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শামসুল হক এবং পিতামহ রাযাউল্লাহ ছিলেন নিজ এলাকার বিশিষ্ট আলেম। তার পিতা তার নাম রাখেন উযাইর কিন্তু পরে তিনি আগে ‘মুহাম্মাদ’ এবং পরে ‘শামস’ যোগ করেন, তাই তার নাম ‘মুহাম্মদ উযাইর শামস’ রাখা হয়।
[তাঁর উম্মুল কুরার সহপাঠী, শাইখ এ. কে. এম. শামসুল আলাম বলেন: তাঁর মা মুর্শিদাবাদের বাঙালি, আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মুজীবুর রহমান স্যারের নিকট আত্মীয়। যাহোক উযাইর শামস বাঙলা ভাষা বলতে পারলেও বাংলা বর্ণ চিনত না।]
তার পড়াশোনা: শাইখ উযাইর শামস মাও-এর মাদ্রাসা ফাইযে আম-এ পড়াশোনা শুরু করেন যেখানে তিনি ফারসি স্তর সমাপ্ত করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে দারুল উলুম আহমদিয়াহ সালাফিয়াহ (দ্বারভাঙা, বিহার) থেকে তার আরবি শিক্ষা শুরু করেন। তিনি দারুল হাদিস (বেলডাঙা, মুর্শিদাবাদ)-এ দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করেন। তিনি মাদ্রাসা রাহমানীয়াহ (বানারাস)-এ আরবির তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষ অধ্যয়ন করেন।
১৯৭০ সালে, তিনি জামিয়াহ সালাফিয়াহ বানারাস-এ প্রবেশ করেন, সেখানে তিনি ৪ বছরে আলিমিয়াত এবং ২ বছরে ফাযিলাত শেষ করেন এবং ১৯৭৬ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি ইংরেজি ভাষাও অধ্যয়ন করেন।
[শাইখ আবদুর রাকীব বুখারী বলেন: বর্তমান উত্তর দিনাজপুরের একটি নব প্রতিষ্ঠিত সিনিয়ার মাদ্রাসায় প্রয়োজন হয়েছিল কিছু মেধাবী ছাত্রের, যাদের ভালো রেজাল্ট অনেকটাই নির্ভর করছিল সেই মাদসার গ্রান্ট হওয়ার উপর। সে সময়ের মানটিক, হিকমত, ইত্যাদি সাবজেক্ট যথেষ্ট কঠিন মনে করা হতো। তিনি পরীক্ষা দিয়ে বোর্ড ফার্স্ট করে ফেলেন অনায়াসে।]
জামিয়াহ সালাফিয়াহ থেকে স্নাতক হওয়ার পর, তিনি দিল্লি, পাটনা, লাখনৌ, আলীগড়, কলকাতা এবং অন্যান্য শহরের বিভিন্ন গ্রন্থাগার এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন, এই ভ্রমণে তিনি দেড় বছর ব্যয় করেন। এই সময়ে, তিনি অনেক আলেমের সাথে সাক্ষাত করেন এবং অনেক দল ও সংগঠনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।
এই সময়কালে, তিনি পাটনার বিখ্যাত গ্রন্থাগার যাকে “খোদা বক্স গ্রন্থাগার” নামে ডাকা হয়, এর আরবি পাণ্ডুলিপিগুলির তালিকাকরণের জন্য বহু দিন কাজ করেছিলেন। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ভ্রমণ কালে তিনি জানতে পারলেন যে তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের জন্যে গৃহীত হয়েছেন।
তিনি ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মদীনায় পৌঁছান। সেখানে তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্যের উপর ৪ বছরে বিএ সমাপ্ত করেন। এমএ করার জন্য, তিনি মদীনা এবং মক্কাস্থ উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় উভয়েই গৃহীত হন, কিন্তু তিনি মক্কাকে বেছে নেন যেখানে তিনি ৪ বছর অধ্যয়ন করেন এবং এমএ সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল হালীর কবিতার উপরে।
উল্লেখ্য যে, তিনি প্রতি বছর মদীনায় এবং উম্মুল কুরা মক্কায় প্রথম স্থানের অধিকারী ছিলেন। [এ. কে. এম. শামসুল আলাম বলেন: উযাইর হাজারের মধ্যে ৯৯৬ মার্কস পেয়ে আরবি সাহিত্যের উপর অনার্স সম্পন্ন করেন। মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমাদের পাঠ্য আবদুল কাহের জুরজানীর বিখ্যাত গ্রন্থ ইসরারুল বালাগাহ পড়ছিলাম। শিক্ষক ছিলেন মিসরের ড. আহমদ মাক্কী আল আনসারী, জটিল কঠিন ইবারত, এক পর্যায়ে শিক্ষকের সাথে উযাইর দ্বিমত পোষণ করেন, উসতায পড়া বন্ধ করে চলে গেলেন, পরদিন সকালে উসতায হাসিমুখে এসে বললেন আমি গতকাল ভুল বলেছিলাম।
আহমাদ মাক্কী আল আনসারী জামে আযহারের ব্যকরণবিদ, একজন আরব ব্যকরণ বিশেষজ্ঞ ,তাঁর বাপ দাদা ও সাত পুরুষ জামে আযহারের ব্যকরণবিদ ছিলেন, অথচ তিনি যোগ্য ছাত্রের কাছে সারেনডার করে নিজ ডাইরি এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন: এসো, তুমি এতে (ডাইরি) একটা স্বাক্ষর কর। আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করি, ভবিষ্যতে তুমি একজন স্মরনীয় ও খ্যতিমান ব্যক্তি হবে।]
তিনি “ভারতে আরবি কবিতা : সমালোচনামূলক পর্যালোচনা” বিষয়ে তার পি.এইচ.ডি. থিসিসটি সম্পন্ন করেন তবে তার সুপারভাইজারের সাথে কিছু মতপার্থক্যের কারণে এটি জমা দিতে পারেননি। [আবদুর রাকীব বুখারী বলেন: পি. এইচ. ডি. গবেষণা থিসিস শেষ হলে মুশরিফ যাকে পি এইচ ডি. থিসিসের সুপার ভাইজার বলা হয়। তার সাথে কোনো এক বিষয়ে ইলমী মতভেদ হয়। তিনি নিজের তথ্য সঠিক ও অপরিবর্তনীয় মনে করেন। মুশরিফের সাথে এমন বিতর্কের ফলে তাঁর আর PhD সনদ নেওয়া সম্ভব হয় নি। কিন্তু তিনি ডজন ডজন পি. এইচ. ডি. গবেষককে গবেষণার কাজে পরামর্শ দিতেন। রত্নকে রত্ন চেনে এমনটাই ছিল তার জীবন।]
তিনি উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি থেকে দেশে ফিরে যান কিন্তু শীঘ্রই আবার মক্কায় ফিরে আসেন। যেখানে তিনি উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি, মদীনাস্থ মাজমাহ মালিক ফাহাদ এবং জেদ্দার ইসলামী ফিকহ একাডেমি এবং আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউটে কাজ করেন।
[আবদুর রাকীব বুখারী বলেন: গবেষণা অনেক রকমের হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে প্রাচীন যুগে লিখিত পাণ্ডুলিপির তাহকীক করা। অর্থাৎ মনে করুন পাঁচ সাত শত বছর পূর্বে মারা গেছেন ইসলামের কোনো বড় লেখক আর তার হাতের লেখা বই জীর্ণ শীর্ণ আকারে বিশ্বের বড় বড় লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত। সেই লেখা গুলি রিসার্চ করে বই আকারে প্রকাশ করা কিংবা কোথাও ইতিপূর্বে ভূল ছাপানো হয়েছে তা সঠিক করে আবার প্রকাশ করা। এ কাজ পৃথিবীতে হাতে গোনা কিছু মানুষ করতেন, তার মধ্যে একজন ছিলেন শাইখ উযাইর শামস রাহিমাহুল্লাহ।]
তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইমাম ইবন তাইমিয়া এবং তাঁর ছাত্র ইবন কাইয়িমের মাখতুতাত (Manuscript) এর পাঠোদ্ধার, এক্ষেত্রে তিনি সফল ছিলেন, এজন্য তিনি সারা বিশ্বে সমাদৃত ছিলেন। তাকে এ যুগের ইবন তাইমিয়া বলে অভিহিত করা হত।
শাইখ রাহিমাহুল্লাহ গতকাল [অক্টোবর ১৫, ২০২২] রাতে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক এ মৃত্যুবরণ করেন।
[শাইখ নাবিল নিসার সিন্ধি বলেন: শাইখ উযাইর শামস তার সারা জীবন যার উপর ছিলেন তার উপরই ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি তার সাথে ছিলাম, আর আমার সাথে দারুল হাদীস খায়রিয়াতে সদ্য ভর্তি হওয়া একজন ছাত্র সেখানে উপস্থিত ছিল। মৃত্যুর পূর্বে শাইখের শেষ বক্তব্য ছিল এই ছাত্রের প্রতি দেওয়া নাসীহা। শাইখ সেই ছাত্রকে উপদেশ দেন, সে যেন ভালো করে পড়া লেখা করে এবং সে যা পড়ে বা শোনে তা সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে রাখে। তিনি তাকে সঠিক যাবত (vowelisation) জানার পরামর্শও দেন: আল মুজামুল ওয়াসীত এবং আল জাবির মুজামুল আলাম।]
[হাফিয খালীল সানাবালি বলেন: শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ ৬৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং আমাদের সময়ের ইবন তাইমিয়া (আল্লামা উযাইর শামস)ও চন্দ্র ক্যালেন্ডার অনুসারে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: মানুষ যাকে ভালবাসবে সে তারই সঙ্গী হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের ইল্লিয়িনের উঁচু স্থান দান করুন এবং তাদের প্রিয়জনের সাহচর্য দান করুন। আমীন।]
[চলবে …]
অক্টোবর ১৬, ২০২২
সম্পাদনা ও সংযোজনা: মুহাম্মাদ ওমার ফারুক মিল্কি