শাওয়ালের রোজা রাখার আগে রমাযানের কাযা রোজা আদায় করা কি আবশ্যক?
কারো যদি রমাযানের রোজা বাকি থাকে, তাহলে শাওয়ালের ৬টি রোজা রাখার আগে তাকে রমাযানের বাকি রোজা রাখতে হবে, না-কি শাওয়ালের ৬টি রোজা রেখে বছরের যেকোনো সময় রমাযানের বাকি রোজা রাখবে—এ নিয়ে আলিমদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। চার মাযহাবের তিন মাযহাব তথা হানাফী, মালিকী ও শাফিয়ী মাযহাব মতে রমাযানের কাযা রোজা আদায় করার পূর্বে শাওয়ালের ৬টি রোজা রাখা যাবে। আর হাম্বালী মাযহাব মতে প্রথমে রমাযানের কাযা রোজা আদায় করতে হবে এরপর শাওয়ালের রোজা রাখতে হবে। তাদের মতে, রমাযানের কাযা রোজা আদায় করার পূর্বে শাওয়ালের রোজা রাখা বৈধ নয়। এমনকি কেউ কেউ তা বিদআত বলেছেন।[১]
.
তবে এ কথা প্রায় সবাই বলেছেন যে, যদি কাযা রোজার পরিমাণ কম হয় আর শাওয়ালের রোজার পূর্বে তা আদায় করা সহজ হয়, তবে প্রথমে কাযা রোজা আদায় করার পর শাওয়ালের রোজা আদায় করা ভালো।
.
কিন্তু কেউ যদি বিনা কারণে কাযা রোজা প্রথমে আদায় না করে বা কোনো কারণবশত আদায় করতে না পারে, তবে তার ক্ষেত্রে তিন মাযহাবের মত সঠিক। অর্থাৎ রমাযানের কাযা রোজা আদায় করার পূর্বে শাওয়ালের রোজা রাখা বৈধ। কারণ, রমাযানের কাযা রোজা আদায় না করলে শাওয়ালের রোজা রাখা যাবে না—এ মর্মে কুরআন ও হাদীসে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি। তাছাড়া ফরজ রোজার পূর্বে নফল রোজা রাখা যাবে না—এমন কোনো কথাও কিতাব ও সুন্নায় পাওয়া যায় না।
.
যারা বলেন রমাযানের কাযা রোজা আদায় না করার পূর্বে শাওয়ালের রোজা রাখা যাবে না, তাদের দলীল ও আপত্তিগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়। নিম্নে তাদের দলীল ও আপত্তিগুলোর জবাবও প্রদত্ত হল।
প্রথম আপত্তি : কেউ কেউ বলেন, শাওয়ালের রোজা তিনি রাখতে পারবেন, যিনি রমাযান মাসেই রমাযানের পূর্ণ রোজা আদায় করবেন। কারণ, হাদীসে বলা হয়েছে,
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ
যে ব্যক্তি রমযানের রোজার পর শাওয়ালের ছয় দিন রোযা রাখবে, তার সারা বছর রোজা রাখা হবে।[২]
.
অতএব, যে ব্যক্তি রমাযান মাসে রমাযানের রোজা পূর্ণ করেনি তার ক্ষেত্রে বলা যাবে না যে, সে রমাযানের রোজা রেখেছে; বরং সে তো রমাযানের আংশিক রোজা রেখেছে।[৩]
.
জবাব : ক. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ
যাতে তোমরা (রমাযানের রোজা) সংখ্যা পূরণ করতে পারো এবং আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াতের কারণে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করতে পারো।[৪]
.
এ আয়াতের আলোকে আলিমগণ বলেন যে, রমাযান মাস শেষ হলে ঈদুল ফিতরের তাকবীর দেওয়া শুরু করতে হবে।
.
আয়াতের দিকে লক্ষ করুন, আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রমাযানের রোজা পূর্ণ করার পর তোমরা তাকবীর দাও। অথচ কেউ বলেন না যে, ঈদের তাকবীর শুধু সে দেবে যে রমাযান মাসে রোজা পূর্ণ করেছে; যার কোনো কারণবশত বা বিনা কারণে রোজা ছুটে গেছে সে তাকবীর দিতে পারবে না। তারা এ আয়াতের যে জবাব দেবেন সে জবাব শাওয়ালের রোজার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মূলত আয়াতে রোজা পূর্ণ করার দ্বারা উদ্দেশ্য, সামর্থ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী রোজা রাখা। অনুরূপ হাদীসে বর্ণিত রমাযানের রোজা রাখা দ্বারাও একই উদ্দেশ্য।
.
খ. এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে ব্যক্তি রমাযানের রোজা রাখবে ঈমান-সহ নেকির আশায়, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।[৫]
.
শাওয়ালের রোজার ক্ষেত্রে হাদীসে যে শব্দ উল্লেখ রয়েছে, একই শব্দ এই হাদীসেও রয়েছে। তাদের কথামতো শুধুমাত্র তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করা হবে, যে রমাযান মাসে পূর্ণ রোজা রাখবে। আর যে ব্যক্তি কারণবশত পূর্ণ রোজা রাখতে পারবে না, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করা হবে না। অথচ একথা কেউ বলবে না। অতএব, তারা এ হাদীসের যে জবাব দেবেন সে জবাব শাওয়ালের রোজার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
.
দ্বিতীয় আপত্তি : শাওয়ালের রোজা শুধু সেই রাখতে পারবে যে রমাযানের কাযা রোজা আদায় করবে। কেউ শাওয়ালের রোজা ততক্ষণ রাখতে পারবে না, যতক্ষণ না সে রমাযানের ছুটে যাওয়া রোজা আদায় করে। কারণ, যে হাদীসে শাওয়ালের রোজার কথা বলা হয়েছে, সে হাদীসে প্রথমে রমাযানের রোজার কথা বলা হয়েছে এরপর ثُمَّ أَتْبَعَهُ তথা ‘রমাযানের রোজার পর’ শাওয়ালের রোজার কথা বলা হয়েছে।
.
জবাব : ক. তাদের এ আপত্তির জবাবে শাইখ মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ মুখতার শানকীতী বলেন,
ثم نقول: لو كان الأمر كما ذُكِر لم يشمل الحديث مَن أفطر يوماً من رمضان؛ فإنه لو قضى في شوال لم يصدُق عليه أنه صام رمضان حقيقةً؛ وإنما صام قضاءً ولم يصم أداءً.
তার জবাবে আমরা বলব, তারা যে আপত্তির কথা ব্যক্ত করেছেন তা সঠিক হলে, সে ব্যক্তিও শাওয়ালের রোজা রাখতে পারবে না, যে রমাযানের একটি রোজা ছেড়ে দিয়েছে। কারণ, সে ব্যক্তি উক্ত ছুটে যাওয়া রোজা শাওয়াল মাসে কাযা করলেও তার ক্ষেত্রে বলা যাবে না যে, সে রমাযানের রোজা রেখেছে। বরং সে তো কাযা রোজা আদায় করেছে; রোজা আদায় করেনি। [৬]
.
অতএব, তারা এ আপত্তির যে জবাব দেবেন, একই জবাব তাদের আপত্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
.
খ. কোনো কোনো বর্ণনায় ثُمَّ أَتْبَعَهُ তথা ‘রমাযানের রোজার পর’ বাক্য থাকলে কোনো বর্ণনায় بَعْدَ الْفِطْرِ তথা ‘রমাযান শেষে’ বলা হয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, রমাযান মাস শেষ হলে রমাযানের কাযা রোজা আদায় করা ছাড়া শাওয়ালের ৬টি রোজা রাখা যাবে।
.
গ. কোনো কোনো বর্ণনায় রমাযানের রোজার পর শাওয়ালের রোজা রাখতে হবে—এমন কোনো ধারাবাহিকতার কথা বলা হয়নি। যেমন :
o مَنْ صَامَ رَمَضَانَ وَسِتًّا مِنْ شَوَّالٍ فَقَدْ صَامَ الدَّهْرَ
.
যে ব্যক্তি রমাযানের ও শাওয়ালের ৬টি রোজা রাখবে সে গোটা বছর রোজা রাখবে।[৭]
o صِيَامُ شَهْرٍ بِعَشَرَةِ أَشْهُرٍ وَسِتَّةُ أَيَّامٍ بَعْدَهُ بِشَهْرِينِ فَذَلِكَ تَمَامُ السَّنَةِ
রমাযানের একমাস রোজা দশমাস রোজার সমান এবং রমাযানের পর ৬দিন রোজা দুইমাস রোজার সমান। এভাবে (রমাযানের ও শাওয়ালের ছয়দিন রোজা) একবছর রোজার সমান হয়।[৮]
.
উপর্যুক্ত দুই হাদীসে রমাযানের রোজার পর শাওয়ালের রোজা রাখতে হবে এমন কোনো কথা বলা হয়নি। যা থেকে প্রমাণ হয়, রমাযানের পর শাওয়াল এমন ধারাবাহিকতা মূল উদ্দেশ্য নয়; মূল উদ্দেশ্য রমাযান মাসের রোজা রাখা এবং শাওয়ালের রোজা রাখা।
.
তৃতীয় আপত্তি : ফরয রোজার পূর্বে যেকোনো ধরনের নফল রোজা যাবে না। কারণ, নফল রোজা আদায় করা ছাড়া কেউ মারা গেলে তাকে পাকড়াও করা হবে না কিন্তু ফরয রোজা আদায় করা ছাড়া কেউ মারা গেলে তাকে পাকড়াও করা হবে।
.
জবাব : ক. তারা তাদের মতে পক্ষে নিম্নের হাদীসটি দলীল হিসেবে পেশ করেন :
وَمَنْ صَامَ تَطَوُّعًا وَعَلَيْهِ مِنْ رَمَضَانَ شَيْءٌ لَمْ يَقْضِهِ فَإِنَّهُ لَا يُتَقَبَّلُ مِنْهُ حَتَّى يَصُومَهُ
যে ব্যক্তি নফল রোজা রাখে আর তার ওপর রমাযানের কোনো থাকে অথচ তা কাযা আদায় করেনি, তার নফল রোজা কবুল করা হবে না, যতক্ষণ না কাযা রোজা রাখে।[৯]
.
এ হাদীস দুর্বল। কারণ, এর সনদে ইবন লাহিয়্যাহ নামক একজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছে। তাছাড়া হাদীসের শব্দে ইযতিরাব বা বিশৃঙ্খলা রয়েছে।
.
এ ব্যাপারে আবূ বাকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর একটি উক্তিও পেশ করা হয়। উক্তিটি হল,
وَأَنَّهُ لاَ يُقْبَلُ نَافِلَةٌ حَتَّى تُؤَدَّى الْفَرِيضَةُ
ফরয আদায় করা পর্যন্ত নফল কবুল করা হয় না।[১০]
আবূ বাকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ আসারটি দুর্বল। কারণ, সনদে ইনকিতা বা বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। এ ছাড়া দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছে।
.
আবূ হুরাইরাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুর একটি আসার তথা উক্তিও উল্লেখ করা হয়। আসারটি হল,
وسأله رجل قال إن علي أياما من رمضان أفأصوم العشر تطوعا قال لا ولم إبدأ بحق الله ثم تطوع بعد ما شئت
আবূ হুরাইরাহকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, আমার রমাযানের কিছু রোজা কাযা আছে। এমতাবস্থায় আমি কি যূলহজ্জ মাসের দশদিনের নফল রোজা রাখব? তিনি বললেন, না। কেন এমন করবে? আল্লাহর হক প্রথমে আদায় করো এরপর তোমার ইচ্ছামতো নফল রোজা রাখো।[১১]
.
আবূ হুরাইরাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ হাদীস থেকে প্রমাণ হয় না যে, তিনি ফরযের পূর্বে নফল রোজা রাখার পক্ষে ছিলেন না। সম্ভাবনা আছে, তিনি নফল রোজার পূর্বে ফরয রোজা পূর্ণ করাকে উত্তম মনে করতেন। কারণ, তিনি হারাম মনে করলে তাকে বলে দিতেন, ফরযের পূর্বে নফল রোজা রাখা হারাম। তা না বলে তিনি তাকে বলেন, আল্লাহর হক প্রথমে আদায় করো এরপর তোমার ইচ্ছামতো নফল রোজা রাখো।
.
ইমাম ইবন হাজার আসকালানী এ ধরনের কথা উল্লেখ করার পর বলেন,
وظاهر قوله جواز التطوع بالصوم لمن عليه دين من رمضان إلا أن الأولى له أن يصوم الدين أولا.
তার কথা থেকে বোঝা যায়, যার ওপর রমাযানের রোজা কাযা আছে তার জন্য নফল রোজা রাখা বৈধ। তবে প্রথমে কাযা আদায় করে নেওয়া উত্তম।[১২]
.
ইবন হাজার আসকালানী যে কথা বলেছেন তা আরও শক্তিশালী হয় স্বয়ং আবূ হুরাইরাহ রাযিয়াল্লাহ আনহুর আরেকটি আসার থেকে। তিনি বলেন,
اِبْدَأ بِالْفَرِيضَةِ لاَ بَأْسَ أَنْ تَصُومَهَا فِي الْعَشْرِ.
তুমি ফরয দিয়ে শুরু করো। যূলহজ্জ মাসের দশদিনে তা পালন করতে কোনো সমস্যা নেই।[১৩]
.
খ. সকল আলিম এ ব্যাপারে একমত যে, কোনো কারণ ছাড়াই শাবান মাস পর্যন্ত কাযা রোজা আদায়ে বিলম্ব করতে পারে।[১৪]
.
যদি বিনা কারণে শাবান মাস পর্যন্ত কাযা রোজা বিলম্ব করা বৈধ হয়, তবে শাওয়ালের রোজার কারণে বিলম্ব করা কেন বৈধ হবে না। কেউ শাওয়ালের রোজার কারণে বিলম্ব করলে তাতে দোষ ও সমস্যা কী?! কী বিস্ময়কর কথা যে, বিনা কারণে শাবান পর্যন্ত কাযা আদায়ে বিলম্ব করা হালাল কিন্তু শাওয়ালের রোজার কারণে বিলম্ব করা হারাম! কেউ যদি শাওয়ালের রোজা রাখার কারণে কাযা রোজা শাবান মাস পর্যন্ত বিলম্বে করে এবং কাযা রোজা আদায় করার পূর্বে মারা যায়, তবে তাকে পাকড়াও করা হবে; অপরপক্ষে কেউ যদি বিনা কারণে কাযা রোজা শাবান মাস পর্যন্ত বিলম্বে করে এবং কাযা রোজা আদায় করার পূর্বে মারা যায় তবে তাকে পাকড়াও করা হবে না—এমন কথাও কি চরম উদ্ভূত নয়?
.
শাইখ হামদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল আযীয হামদ বলেন,
قال شيخ الإسلام : الرجل يؤخر الصوم من رمضان ، يريد أن يؤخر قبيل رمضان الآخر ، فإن هذا جائز له والقضاء من رمضان إلى رمضان وقت موسع ، فالفضيلة في الاستعجال بذلك ، ولكن الجواز وقته موسع ، فإذا أخر القضاء – حيث يجوز له – فمات قبل أن يقضي فلا إثم عليه بالإجماع .
শাইখুল ইসলাম বলেছেন, কেউ যদি এ নিয়্যাতে রমাযানের কাযা রোজা আদায়ে বিলম্ব করে যে, সামনের রমাযানের কিছুদিন পূর্বে কাযা আদায় করে নেবে, তবে তা জায়েয। কারণ, এক রমাযান থেকে আরেক রমাযান পর্যন্ত যেকোনো সময় তার জন্য কাযা আদায় করা জায়েয। তবে তাড়াতাড়ি আদায় করে নেওয়া উত্তম। কিন্তু আরেক রমাযান পর্যন্ত বিলম্ব করা জায়েয। অতএব, কেউ যদি জায়েযের ভিত্তিতে বিলম্ব করে এবং কাযা আদায়ের পূর্বেই মারা যায়, তবে ইজমা অনুযায়ী সে পাপী হবে না।[১৫]
.
গ. নফলের পূর্বে ফরয আদায়ের তাকিদ তখন দিতে হবে, যখন সময় এত সংকীর্ণ হবে যে, ফরয ও নফলের যেকোনো একটা আদায় সম্ভব হবে। ফরয আদায় করলে নফল আদায়ের সময় হবে না অথবা নফল আদায় করলে ফরয আদায়ের সময় হবে না। এ ক্ষেত্রে অবশই নফলের পূর্বে ফরয আদায় করতে হবে। কিন্তু যদি সময় এত প্রশস্ত হয় যে, ফরয ও নফল দুটোই আদায় করা যাবে, তখন ফরযের পূর্বে নফল আদায়ে কোনো সমস্যা নেই। এ ক্ষেত্রে ফরযের পূর্বে নফল আদায়ের শিক্ষা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন। যেমন যোহরের ফরযের পূর্বে চার রাকাআত এবং ফজরের ফরযের পূর্বে দুই রাকাআত সুন্নাত আদায় করতে তিনি ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছেন। একই কথা রমাযানের কাযা রোজা আদায়ের পূর্বে শাওয়ালের রোজা রাখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এক রমাযান থেকে আরেক রমাযান পর্যন্ত যেহেতু কাযা আদায়ের সময়, তাই কাযা আদায় না করে এর মাঝে যেকোনো নফল রোজা আদায় করা জায়েয। এ কারণে উম্মুল মুমিনীন আয়েশাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা শাবান পর্যন্ত কাযা রোজা আদায়ে বিলম্ব করতেন।[১৬]
.
আর আয়েশাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা গোটা বছরে কোনো নফল রোজা রাখতেন না, তা হতেই পারে না। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
لأن عائشة أخبرت أنها كانت تقضي رمضان في شعبان، ويبعد أن لا تكون تطوعت بيوم، مع أن النبي ﷺ كان يصوم حتى يقال: لا يفطر، ويفطر حتى يقال: لا يصوم، وكان يصوم يوم عرفة وعاشوراء، وكان يكثر صوم الاثنين والخميس، وكان يصوم ثلاثة أيام من كل شهر.
আয়েশাহ জানাচ্ছেন, তিনি শাবান মাসে রমাযানের কাযা আদায় করতেন। আর এটা হতেই পারে না যে, তিনি এর মাঝে একদিনও নফল রোজা রাখতেন না। অথচ নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে রোজা রাখতেন যে, বলা হত তিনি আর রোজা ছাড়বেন না, আবার এমনভাবে রোজা ছাড়া শুরু করতেন যে, বলা হত তিনি আর রোজা রাখবেন না। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফা ও আশুরার রোজা রাখতেন, বেশি বেশি সোম ও বৃহস্পতিবারের রোজা রাখতেন এবং প্রত্যেক মাসে তিনদিন রোজা রাখতেন।[১৭]
বরং আয়েশাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা শাবানের পূর্বে নফল রোজা রাখতেন তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। তিনি বলেন,
مَا مِنَ السَّنَةِ يَوْمٌ أَحَبُّ إلَيَّ أَنْ أَصُومَهُ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ.
আরাফার দিনের তুলনায় বছরে এমন কোনো দিন নেই, যেদিন রোজা রাখা আমার কাছে বেশি প্রিয়।[১৮]
.
ইবন শিহাব যুহরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
أن عائشة وحفصة زوجي النبي صلى الله عليه وسلم أصبحتا صائمتين متطوعتين فأهدي لهما طعام فأفطرتا عليه
নবী-পত্মী আয়েশাহ ও হাফসা দুজন নফল রোজা অবস্থায় ছিলেন। উভয়ের কাছে খাবার হাদিয়া দেওয়া হয়। তারা সেই খাবার খেয়ে ইফতার করেন।[১৯]
.
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় তিনি কাযা আদায়ের পূর্বে নফল রোজা রাখতেন অথচ তিনি তাতে বাধা দেননি। অতএব, প্রমাণ হয়, কাযা রোজা আদায়ের পূর্বে নফল রোজা রাখতে কোনো অসুবিধা নেই।
.
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, রমাযানের কাযা রোজা আদায়ের পূর্বে শাওয়ালের রোজা রাখতে কোনো সমস্যা নেই।
.
বারো চান্দের ফযীলত বই থেকে
তথ্য-সূত্র :
১. আল-বুরহানুল মুবীন ফিত তাসাদ্দী লিল-বিদা ওয়াল আবাতীল, ১/৫২৭
২. সহীহ মুসলিম, ২৬৪৮; সুনানুত তিরমিযী, ৭৫৯
৩. শারহু যাদিল মুস্তাকনী, ৩/১৫
৪. সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫
৫. সহীহুল বুখারী, ৩৮
৬. শারহু যাদিল মুস্তাকনী, ১১/২১, মাকতাবাতুশ শামিলাহ
৭. মুসনাদ আহমাদ, ২৩৫৫৬, হাদীসটি গ্রহণযোগ্য
৮. আস-সুনানুন কুবরা লিন-নাসায়ী, ২৮৭৩, হাদীসটি সহীহ
৯. মুসনাদ আহমাদ, ৮৬২১
১০. মুসান্নাফ ইবন শাইবাহ, ৩৫৫৭৪
১১. মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, ৭৭১৫, এই আসারটি সহীহ
১২. ফাতহুল বারী, ৪/১৪৯
১৩. মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বাহ, ৯৬১০, আসারটি সহীহ
১৪. আল-ফুরূ ওয়া তাসহীহুল ফুরূ, ৫/৬২
১৫. শারহু যাদিল মুস্তাকনী লিল-হামদ, ৩/১৮, আল-মাকতাবাতুশ শামিলাহ
১৬. সহীহুল বুখারী, ১৯৫০
১৭. শারহুল উমদাহ লি-ইবন তাইমিয়্যাহ, কিতাবুস সিয়াম, ১/৩৫৮
১৮. মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ, ৯৮০৯, আসারটি সহীহ
১৯. মুআত্তা মালিক, ১০৮৪