আল্লাহর ওপর ঈমানের অর্থ

অনুবাদক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ

সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

প্রশ্ন: আল্লাহর ওপর ঈমান গ্রহণের ফযীলত আমি অনেক শুনেছি ও অনেক পড়েছি, তাই আমি জানতে চাই ‘আল্লাহর ওপর ঈমানের অর্থ কি?’, যেন প্রকৃত ঈমান আমি পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হই এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণের ঈমান পরিপন্থী ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে নিজেকে হিফাযত করতে পারি?

উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ।

আল্লাহর ওপর ঈমানের অর্থ: তার ১. পবিত্র ও সুমহান অস্তিত্বের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা, ২. রুবুবিয়্যাত ও ৩. উলুহিয়্যাতকে স্বীকার করা, ৪. নামসমূহ ও গুণাবলির ওপর ঈমান আনয়ন করা। এ চারটি বিষয় আল্লাহর প্রতি ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, যে চারটি বিষয়সহ ঈমান গ্রহণ করল সেই প্রকৃত মুমিন।

এক. আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর ঈমান আনয়ন করা।

ইসলামি শরী‘আতের বহু দলীল ছাড়াও মানুষের সুস্থ বিবেক ও পরিচ্ছন্ন স্বভাব-প্রকৃতি আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করে। যেমন,

১. মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে রয়েছে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি ঈমান। কোনো শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়াই প্রত্যেক মখলুক তার স্রষ্টার স্বীকারোক্তি প্রদান করে, তাদের প্রকৃতি এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কারো অন্তরে স্বভাব বিরুদ্ধ কোনো বিষয় প্রবেশ না করা পর্যন্ত কেউ তার স্বভাবের স্বীকৃতিকে অস্বীকার করে না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلَّا يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ»

“এমন কোনো নবজাতক নেই, যে স্বাভাবিক-প্রকৃতি তথা ইসলামের ওপর জন্ম গ্রহণ করে না, অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহূদী বানায় অথবা খৃস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়”।[1]

২. আল্লাহর অস্তিত্বের স্বপক্ষে বিবেকও সাক্ষী, কারণ সকল সৃষ্টির জন্য অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা জরুরি, যে তাদেরকে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বশীল করেছে। কোনো বস্তুর নিজেকে নিজে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, অনুরূপ সম্ভব নয় মাধ্যম ব্যতীত কোনো বস্তুর অকস্মাৎ সৃষ্টি হওয়া। অতএব, কোনো প্রাণী নিজকে নিজে সৃষ্টি করে নি নিশ্চিত, নিজকে সৃষ্টি করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, সৃষ্টির পূর্বে তার নিজের অস্তিত্বই ছিল না, তাই কীভাবে সে নিজের স্রষ্টা হবে?

আবার আকস্মাৎ বিনা কারণেও সৃষ্টি হওয়াও সম্ভব নয়, কারণ প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা জরুরি। দ্বিতীয়ত মখলুকের সৃষ্টি, গঠন ও তাদের উপকরণের মাঝে গভীর ও ধারাবাহিক সম্পর্ক; এক বস্তুর সাথে অপর বস্তুর ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করে তারা সহসা সৃষ্ট নয়, কারণ হঠাৎ সৃষ্ট বস্তু কোনো নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় না, তাই পরবর্তী ধাপে তার মাঝে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নই উঠে না। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, মখলুক আপনা আপনি কিংবা অকস্মাৎ সৃষ্ট হয় নি, তার একজন সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই রয়েছে, আর তিনিই হলেন আল্লাহ তা‘আলা। এটা বিবেকের স্পষ্ট ও যৌক্তিক দলীল, এ দলীল সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ أَمۡ خُلِقُواْ مِنۡ غَيۡرِ شَيۡءٍ أَمۡ هُمُ ٱلۡخَٰلِقُونَ ٣٥ ﴾ [الطور: ٣٤]

“তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারাই স্রষ্টা”। [সূরা আত-তূর, আয়াত: ৩৪] অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত তারা সৃষ্ট হয় নি এবং তারা নিজেরাও নিজেদেরকে সৃষ্টি করে নি। অতএব, তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। জুবাইর ইবন মুত‘ঈম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর একটি ঘটনা, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সূরা তূর তিলাওয়াত করতে শুনেন, যখন তিনি তিলাওয়াত করেন:

﴿أَمۡ خُلِقُواْ مِنۡ غَيۡرِ شَيۡءٍ أَمۡ هُمُ ٱلۡخَٰلِقُونَ ٣٥ أَمۡ خَلَقُواْ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۚ بَل لَّا يُوقِنُونَ ٣٦ أَمۡ عِندَهُمۡ خَزَآئِنُ رَبِّكَ أَمۡ هُمُ ٱلۡمُصَۜيۡطِرُونَ ٣٧﴾ [الطور: ٣٥،  ٣٧]

“তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারাই স্রষ্টা। তারা কি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে না। তোমার রবের গুপ্ত ভাণ্ডার কি তাদের কাছে আছে, না তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণকারী”? [সূরা আত-তূর, আয়াত: ৩৫-৩৭] জুবাইর তখন মুশরিক ছিলেন, তিনি বলেন:

«كَادَ قَلْبِي أَنْ يَطِيرَ، وذلك أول ما وقر الإيمان في قلبي»

“আমার অন্তর বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখনি আমার অন্তরে ঈমানের প্রথম বীজ বপন হয়”।[2]

আরো স্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি: যদি কোনো ব্যক্তি আপনাকে একটি প্রাসাদের বর্ণনা দেয়, যার চারপাশ বাগান দ্বারা সজ্জিত, যাতে স্রোতস্বিনী প্রবহমান, যেখানে রয়েছে গালিচা, পালঙ্ক, সবধরনের সৌন্দর্য ও বিনোদন উপকরণ। অতঃপর সে আপনাকে বলল: এ প্রাসাদ ও তাতে বিদ্যমান আসবাব পত্র নিজে নিজে তৈরি হয়েছে অথবা সংঘটক ব্যতীত অকস্মাৎ সংঘটিত হয়েছে, তাহলে আপনি তৎক্ষণাৎ অস্বীকার করবেন, তাকে মিথ্যাবাদী বলবেন। অতএব, একটি সাধারণ ঘটনাকে অস্বীকার করে আপনি কোন বিবেকে সমর্থন করেন প্রশস্ত জমিন, বিশাল আসমান ও নক্ষত্রসমূহ নিজকে নিজে সৃষ্টি করেছে কিংবা কোনো সংঘটক ব্যতীত সৃষ্টি হয়েছে?

জনৈক আরব বেদুইনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘তোমার রবকে তুমি কীভাবে চিনেছ’? সে তার ভাষায় বলেছে:

«البعرة تدل على البعير ، والأثر يدل على المسير ، فسماء ذات أبراج ، وأرض ذات فجاج ، وبحار ذات أمواج ، ألا تدل على السميع البصير »؟!!

“উটের বিষ্ঠা উটের প্রমাণ বহন করে, পায়ের চিহ্ন পথচারী ব্যক্তিকে বুঝায়। অতএব, কক্ষপথ বিশিষ্ট আসমানসমূহ, গিরিপথ বিশিষ্ট জমিন, তরঙ্গশীল সমুদ্রসমূহ কি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা আল্লাহর প্রমাণ বহন করে না”?!!

দ্বিতীয়: আল্লাহর রুবুবিয়াতের প্রতি ঈমান অর্থাৎ তিনি একাই রব, তার কোনো অংশীদার ও সাহায্যকারী নেই।

আরবিতে ‘রব’ বলা হয় সৃষ্টি, রাজত্ব, পরিচালনা ও পরিকল্পনার মালিককে। অতএব, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সৃ্ষ্টিকর্তা নেই, তিনি ব্যতীত কোনো মালিক নেই, তিনি সকল বস্তুর পরিকল্পনাকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ ٥٤﴾ [الاعراف: ٥٣]

“জেনে রেখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তারই”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]

অন্যত্র তিনি বলেন:

﴿قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١﴾ [يونس : ٣١]

“বলুন, ‘আসমান ও জমিন থেকে কে তোমাদের রিযিক দেন? অথবা কে (তোমাদের) শ্রবণ ও দৃষ্টিসমূহের মালিক? আর কে মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন, আর জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? কে সববিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। সুতরাং তুমি বল, তারপরও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না’? [সূরা ইউনূস, আয়াত: ৩১]

অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ ثُمَّ يَعۡرُجُ إِلَيۡهِ ٥﴾ [السجدة : ٥]

“তিনি আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত সকল কার্য পরিচালনা করেন, তারপর তা একদিন তার কাছেই উঠবে”। [সূরা আস-সাজদাহ: ৫]

অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ لَهُ ٱلۡمُلۡكُۚ وَٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمۡلِكُونَ مِن قِطۡمِيرٍ ١٣﴾ [فاطر: ١٣]

“তিনি আল্লাহ, তোমাদের রব; সমস্ত কর্তৃত্ব তারই, আর আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাক তারা খেজুরের আঁটির আবরণেরও মালিক নয়”। [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৩]

আমরা সূরা ফাতিহায় প্রত্যহ পাঠ করি:

﴿مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤﴾ [الفاتحة: ٤]

“বিচার দিবসের মালিক”। [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৪] এ আয়াতের অপর প্রসিদ্ধ কিরাত: مَلِكِ يَوْمِ الدِّينِ “বিচার দিবসের রাজা”। মালিকের তুলনায় রাজার ক্ষমতা অধিক; কিন্তু কখনো রাজত্ব হয় নাম সর্বস্ব, কর্তৃত্ব করার অধিকার রাজার থাকে না, এমতাবস্থায় তিনি রাজা ঠিক, কিন্তু মালিক নন। আল্লাহ যেহেতু রাজত্ব ও মালিকানার অধিকারী, তাই তিনি একাধারে মালিক ও কর্তৃত্বের অধিকারী। দুই কিরাত থেকে আমরা এ অর্থই পাই।

তৃতীয়: আল্লাহর উলুহিয়াতের উপর বিশ্বাস অর্থাৎ তিনি সত্যিকার প্রভু, তার কোনো অংশীদার ও শরীক নেই।

‘ইলাহ’ অর্থ উপাস্য অর্থাৎ মহব্বত ও সম্মানের সাথে যার ইবাদত করা হয় তিনি ইলাহ ও উপাস্য। এটাইلا إله إلا الله  এর অর্থ। আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোনো মা‘বুদ নেই, তিনি বলেন:

﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣﴾ [البقرة: ١٦٣]

“আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরমদয়ালু”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৩]

অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨﴾ [ال عمران: ١٨]

“আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফেরেশতারা ও জ্ঞানীগণও। তিনি ন্যায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]

আল্লাহর সাথে যাকেই ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যার ইবাদত করা হয়, তার প্রভুত্ব বাতিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ٦٢﴾ [الحج : ٦٢]

“আর এটা এ জন্য যে, নিশ্চয় আল্লাহই সত্য এবং তারা তার পরিবর্তে যাকে ডাকে, অবশ্যই তা বাতিল। আর নিশ্চয় আল্লাহ মহান-সর্বোচ্চ, সবচেয়ে বড়।”। [সূরা আল-হজ, আয়াত: ৬২]

বাতিল মা‘বুদকে ইলাহ বলা হলেই মা‘বুদ হয় না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা ‘লাত, উয্যা ও মানাত’ সম্পর্কে বলেন:

﴿إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ ٢٣﴾ [النجم : ٢٣]

“এগুলো কেবল কতিপয় নাম, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ নাযিল করেন নি”। [সূরা আন-নাজম আয়াত: ২৩]

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করেন, তিনি তার দু’সাথীকে বলেছেন:

﴿ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ ٣٩ مَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ أَسۡمَآءٗ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ ٤٠﴾ [يوسف: ٣٩،  ٤٠]

“বহু সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন রব ভালো নাকি মহাপরামক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা তাকে বাদ দিয়ে কেবল নিছক কতগুলো নামের ইবাদাত করছ, যাদের নামকরণ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা করেছ, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ প্রমাণ নাযিল করেন নি”। [সূরা ইউসুফ আয়াত: ৩৯-৮০]

এসব বাতিল উপাস্যদের যদিও মা‘বুদ বলা হয়েছে; কিন্তু তাদের কেউ ইবাদাতের উপযুক্ত নয়, সকল ইবাদাত একমাত্র আল্লাহকে নিবেদন করতে হবে। কারণ, তার কোনো অংশীদার নেই, না নৈকট্যপ্রাপ্ত কোনো ফিরিশতা, না প্রেরিত কোনো রাসূল। তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল রাসূলের দাওয়াত ছিল: لا إله إلا الله আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [الانبياء: ٢٥]

“আর তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল আমরা পাঠাই নি, যার প্রতি আমরা এ অহী নাযিল করি নি যে, আমি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা আমার ইবাদাত কর”। [সূরা আল-আম্বিয়া আয়াত: ২৫]

অপর আয়াতে তিনি বলেন,

﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ٣٦﴾ [النحل: ٣٦]

“আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]

কিন্তু মুশরিকরা তাদের দাওয়াতকে অস্বীকার করল, তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে উপাস্য স্থির করে নিলো, তারা তাদের ইবাদাত করে, তাদের নিকট সাহায্য চায় ও ফরিয়াদ তলব করে।

চতুর্থ: আল্লাহর নাম ও গুণাবলির প্রতি ঈমান আনয়ন করা অর্থাৎ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন অথবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার যেসব নাম ও গুণাবলি উল্লেখ করেছেন, সেগুলোকে বিকৃতি, বাতিলকরণ, আকৃতি নির্ধারণ ও সাদৃশ্য নির্দিষ্ট করা ব্যতীত তার জন্য সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠﴾ [الاعراف: ١٧٩]

“আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাকে সেসব নামেই ডাক। আর তাদেরকে বর্জন কর যারা তার নামে বিকৃতি ঘটায়। তারা যা করত অচিরেই তাদেরকে তার প্রতিফল দেওয়া হবে”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৯] এ আয়াত প্রমাণ করে আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর গুণাবলি রয়েছে।

অন্যত্র তিনি বলেন,

﴿وَلَهُ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٢٧﴾ [الروم: ٢٧]

“আর আসমান ও জমিনে সর্বোচ্চ মর্যাদা তারই এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। [সূরা রূম, আয়াত: ২৭]

এ আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা পরিপূর্ণগুণের অধিকারী। কারণ, المثل الأعلى অর্থ পরিপূর্ণ গুণ। এ দু’টি আয়াত থেকে জানলাম আল্লাহ তা‘আলা সুন্দর নাম ও পরিপূর্ণ গুণের অধিকারী, যার ব্যাখ্যা কুরআনুল কারীম ও হাদীসে নববীর একাধিক জায়গায় এসেছে।

আল্লাহর নাম ও গুণাবলি প্রসঙ্গে উম্মতের মাঝে অনেক বিরোধ ও ইখতিলাফ সৃষ্টি হয়েছে। এসব ইখতিলাফের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। যেমন, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

﴿ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ٥٩ ﴾ [النساء : ٥٩]

“অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যর্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের ওপর ঈমান রাখ”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৯]

আমরা এ বিরোধকে আল্লাহর কুরআন ও নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের নিকট নিয়ে যাই, দেখি এ উম্মতের আদর্শ পুরুষ (সাহাবী) ও তাদের অনুসারী তাবে‘ঈগণ কী বলেছেন? কারণ, তারাই আল্লাহ ও তার নবীর উদ্দেশ্যকে ভালো বুঝতেন। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীদের গুণাগুণ সম্পর্কে যথাযথ বলেছেন:

«مَنْ كَانَ مُسْتَنًّا فَلْيَسْتَنَّ بِمَنْ قَدْ مَاتَ، أُولَئِكَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ كَانُوا أَفْضَلَ الأُمَّةِ، أَبَرَّهَا قُلُوبًا، وَأَعْمَقَهَا عِلْمًا، وَأَقَلَّهَا تَكَلُّفًا، قَوْمًا اخْتَارَهُمُ اللَّهُ لِصُحْبَةِ نَبِيِّهِ وَإِقَامَةِ دِينِهِ، فَاعْرِفُوا لَهُمْ فَضْلَهُمْ، وَاتَّبِعُوهُمْ فِي أَثَرِهِمْ، وَتَمَسَّكُوا بِمَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ أَخْلاقِهِمْ، وَدِينِهِمْ، فَإِنَّهُمْ كَانُوا عَلَى الْهُدَى الْمُسْتَقِيمِ»

“যে আদর্শ গ্রহণ করতে চায়, সে যেন তার আদর্শ গ্রহণ করে যে মারা গেছে। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথী, তারা এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ জামাত, তাদের অন্তর ছিল সবচেয়ে পবিত্র, তাদের ইলম ছিল সবচেয়ে গভীর, তারা ছিল সবচেয়ে কম লৌকিক। তারা এমন জাতি, যাদেরকে আল্লাহ তার দীন কায়েম ও তার নবীর সাথীত্বের জন্য নির্বাচন করেছেন, অতএব তাদের ফযীলত জান, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর, যতটুকুন সম্ভব তাদের চরিত্র ও দীনদারীকে আঁকড়ে ধর। কারণ, তারা ছিলেন সঠিক পথের ওপর”।[3]

আল্লাহর নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের সিদ্ধান্ত ত্যাগকারী মুমিনদের পথ থেকে বিচ্যুত ও গোমরাহীতে লিপ্ত, তারাই শাস্তির উপযুক্ত, নিম্নের আয়াতে যার বর্ণনা রয়েছে:

﴿وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥﴾ [النساء : ١١٥]

“আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়েত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমরা তাকে ফেরাব যে দিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৫]

আল্লাহ তা‘আলা সাহাবীগণের ঈমানকে হিদায়াতের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন,

﴿فَإِنۡ ءَامَنُواْ بِمِثۡلِ مَآ ءَامَنتُم بِهِۦ فَقَدِ ٱهۡتَدَواْۖ ١٣٧﴾ [البقرة: ١٣٧]

“অতএব যদি তারা ঈমান আনে, তোমরা যেরূপ তার প্রতি ঈমান এনেছ, তবে অবশ্যই তারা হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩৭]

অতএব, যে পূর্বসূরীদের পথ থেকে দূরে সরে গেল, সে তার দূরত্ব পরিমাণ হিদায়াত থেকে বিচ্যুত হলো।

আল্লাহ তা‘আলার নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে যেসব নাম ও সিফাত তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন অথবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য সাব্যস্ত করেছেন, সেসব নাম ও গুণাবলি তার জন্য সাব্যস্ত করা, তার বাহ্যিক অর্থ নেওয়া, তার প্রতি ঈমান আনয়ন করা, যেরূপ ঈমান আনয়ন করেছেন উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক ইলমের অধিকারী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীগণ।

উল্লেখ্য আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে চারটি বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি, যে তার একটিতে ভুল করল, সে আল্লাহর নাম ও গুণাবলির উপর যথাযথ ঈমান বাস্তবায়ন করল না। চারটি বিষয় হচ্ছে: ‘তাহরীফ’, ‘তা‘তীল’, ‘তামছীল’ ও ‘তাকয়ীফ’।

নিম্নে এ নিয়ে সামান্য আলোচনা করছি:

এক. تحريف অর্থ কুরআন ও সুন্নার প্রকৃত অর্থ ব্যতীত ভিন্ন অর্থ নেওয়া, যা আল্লাহ ও তার রাসূলের উদ্দেশ্য নয়। যেমন, কুরআন ও সুন্নায় একাধিক স্থানে আল্লাহর জন্য يد বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে, যার অর্থ হাত। তার অর্থ হাতের পরিবর্তে নি‘আমত অথবা কুদরত বলা এক প্রকার বিকৃতি।

দুই. تعطيل অর্থ বাতিল করা অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার সকল নাম কিংবা তার কতিপয় নামকে অস্বীকার করা। অতএব যে কুরআন কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে প্রমাণিত আল্লাহর কোনো নাম বা সিফাতকে অস্বীকার করল, সে তার নাম ও গুণাবলির উপর যথাযথ ঈমান আনয়ন করল না।

তিন. تمثيل অর্থ আল্লাহর সিফাত ও গুণাবলির সাথে মানুষের গুণাবলির তুলনা করা। যেমন বলা, আল্লাহর হাত মখলুকের হাতের ন্যায় অথবা মানুষের ন্যায় আল্লাহ শ্রবণ করেন অথবা মানুষের চেয়ারের উপরে উঠার ন্যায় আল্লাহ আরশের উপর উঠেছেন ইত্যাদিকে তামছীল বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١﴾ [الشورى: ١١]

“তার মতো কিছু নেই, আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা”। [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১১]

চার. تكييف অর্থ আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলির সীমারেখা ও প্রকৃতি নির্ধারণ করা। যেমন, আল্লাহর প্রকৃত অবস্থা মানুষ স্বীয় অন্তরে কল্পনা করল অথবা আল্লাহর গুণাবলির পরিধি চিন্তা করে বলল আল্লাহ এতেই সীমাবদ্ধ হবেন। এরূপ কল্পনা বা চিন্তা করা সুস্পষ্ট গোমরাহী। কারণ, মানুষের পক্ষে তার পরিধি ও সীমারেখার জ্ঞানার্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا يُحِيطُونَ بِهِۦ عِلۡمٗا ١١٠ ﴾ [طه: ١١٠]

“কিন্তু তারা জ্ঞান দিয়ে তাকে বেষ্টন করতে পারে না”। [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১১]

আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে এ চারটি বিষয় যে পরিহার করল, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়ন করল।

আল্লাহর নিকট দো‘আ করি, তিনি আমাদেরকে ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন ও তার ওপর মৃত্যুদান করুন।

দেখুন: শাইখ ইবন উসাইমীন রচিত ‘শারহু উসুলুল ঈমান’।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং২৬৫৮

[2] ইমাম সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৫৪। একাধিক জায়গায় এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

[3] তালখিসুল মুতাশাবিহ: (৬৬৮); লিল খতিবিল বাগদাদি (৪৬৩হি.)

লেখাটি পিডিএফ ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন

সূত্র

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
kiw kow kan