আমাদের সালাতে খুশূ’ নিয়ে আসব কীভাবে (পর্ব-১)
লেখক: কবীর আনোয়ার
দ্বীন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠার পর থেকে যে বিষয়টা মাথাতেই আসেনি সেটাই এখন থেকে প্রায় বছর দেড়েক আগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। দ্বীনের বেসিক আহকামগুলো পালন করলেও নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সচেতনভাবে আত্মশুদ্ধির চিন্তা করা ও লেগে থাকা দরকার এই বিষয়টা সেসময়ই প্রথম আমার মাথায় আসে। তো যখন ভাবলাম যে নিজের এত এত নেগেটিভ অভ্যাসগুলি দূর করার কোন দ্রুততর উপায় আছে কিনা তখন আবার মনে হল যে আত্মশুদ্ধির তো কোন শর্টকার্ট নেই এবং থাকতে পারেও না। তবুও কীভাবে শুরু করলে দ্রুততম সময়ে নিজের পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে [নিজের চোখে, কাউকে দেখানোর জন্য নয়] সে চিন্তা থেকে মনে হল আমার সালাতের Quality [Quantity কিংবা Fiqh নয় কিন্তু] পরিবর্তন করা দরকার। কারণ, সালাত যে মানুষকে সকল মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এটাতো কোন মানুষের কথা নয়, স্বয়ং আল্লাহর কথা। তাই ঠিক করলাম সালাত দিয়েই হোক এই সচেতন পরিবর্তনের সূচনা।
কিন্তু বিপত্তি বাধল আরেক জায়গায়। অনলাইনে সালাতের উপর যত ম্যাটেরিয়ালস পাই সবই দেখি শুধুমাত্র সালাতের আহকামের উপর, সালাত ছেড়ে দিলে কী হবে, না ছাড়লে কী পাওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্যই এগুলো খুবই দরকার কিন্তু দীর্ঘদিন এগুলো জানার পরও যখন সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে Connected হতে পারছিলাম না তখন নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম যে পরিবর্তনটা দরকার সালাতের খুশূ’তে। খুশূ’র উপর অনলাইন-অফলাইনে Effective & Practical Tips খুবই দুর্লভ। শেষমেষ সামান্য যা পেয়েছি তার সাথে নিজের এই অল্পদিনের অভিজ্ঞতার মিশেলে বেশ কিছু প্র্যাক্টিকাল বিষয় গুছিয়ে আনতে পেরেছি আল্লাহর ইচ্ছায় যেগুলো সালাতের খুশূ’-র উন্নতিতে খুব সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস। এগুলো নিছক কোন তাত্ত্বিক আলোচনা নয় কিংবা মুখস্থ করে ফেলে দেওয়ার মতও নয় এমনকি লাইক-শেয়ার দিয়ে দায়িত্ব পালনের বিষয়ও নয় বরং ঘনঘন রিভাইস করার মাধ্যমে নিজেকে ক্রমাগত মূল্যায়ন করার শক্ত নিয়্যাহ নিয়ে পড়ার বিষয়। দুটি বিষয় না বললেই নয়-
# আমি এখানে কোন ফিক্বহী বিষয় আলোচনা করিনি, সেগুলোর আলোচনাও এখানে অপ্রাসঙ্গিক আর তার যোগ্যতাও আমার নেই।
# আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি গৎবাঁধা তাত্ত্বিক কথাগুলো এড়িয়ে যেতে এবং একেবারে প্র্যাক্টিকালি করণীয়গুলো বলতে।
নিজের অভিজ্ঞতা [অন্য কথায় ঠেকে ঠেকে শেখা] ছাড়া আর কোন কোন ম্যাটেরিয়ালস থেকে আমি উপকৃত হয়েছি সেগুলো শেষ পর্বের নোটে লিখব ইনশাআল্লাহ্। চলুন তবে শুরু করা যাক বিইযনিল্লাহ।
খুশূ’ কী?
প্রথমেই খুশূ’ বলতে আমরা কী বুঝব সেই সম্পর্কে খুব খুব সংক্ষেপে জেনে নিই।
খুশূ’=ধীরতা, প্রশান্তি, স্থিরতা, বিনয় ও সম্ভ্রম নিয়ে মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো । খুশূ-র স্থান হল অন্তরে আর তার প্রতিফলন ঘটে দেহে। শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ বলেন, অন্তর হল রাজা আর দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হল তার সৈন্যবাহিনী। রাজা পদচ্যুত হলে যেমন সৈন্যদের কোন মূল্য থাকে না তেমনি অন্তর যদি আল্লাহর অবাধ্য হয়ে যায় তবে দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলোও আর ইবাদাতে মগ্ন হতে পারে না। তাই অন্তর ও দেহ সবকিছু দিয়ে সালাতে নিমগ্ন হতে হলে ২৪/৭ আল্লাহর নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকা হল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত।
খুশূ’র প্রকারভেদ কিংবা কেন আমাদের সালাতে খুশূ’ নেই এসবের আলোচনায় লিখা বড় না করে আমরা সরাসরি চলে যাই ধীরতা, প্রশান্তি, স্থিরতা, বিনয় ও সম্ভ্রম নিয়ে মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর জন্য সালাতের আগে থেকেই কী প্রস্তুতি আমাদেরকে নিতে হবে সেদিকে। সালাতে খুশূ’ অর্জনের জন্য সালাতের মাঝের সময়টুকুর চেয়ে পূর্বের সময়টুকু কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় অথচ আমরা এই পূর্বের সময়টাতেই যত অবহেলা করি।
সালাতের পূর্বে করণীয়ঃ
- আযানের জবাব দিন
ð আযান শুরু হলে সমস্ত কাজ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করুন এমনকি ইসলামিক লেকচার শোনা কিংবা ইসলামিক বই পড়াও। মনে রাখবেন, এসবের চেয়েও খুশূ’ আপনার জন্য অনেক বেশি জরুরী।
- আযানের পর দূয়া পাঠ করুন
- টয়লেটের প্রয়োজন শেষ করে ফেলুন। টয়লেটের চাপ নিয়ে সালাতে দাড়াবেন না। এতে খুশু ব্যহত হতে বাধ্য।
- আযান ও ইক্বামাতের মধ্যে ইচ্ছামত দূয়া করতে থাকুন
- মিসওয়াক ব্যবহার করুন
- প্রতিটি অংগ ৩ বার ধুয়ে ওযূ করুন এবং এরপর কালিমা শাহাদাহ পড়ুন।
ð ওযূ করার সময় আপনার পাপগুলির কথা চিন্তা করুন। ভাবুন, প্রতিটি অঙ্গ ধোয়ার সাথে সাথে আপনার গুনাহগুলি ধুয়ে যাচ্ছে, আপনি গুনাহমুক্ত হচ্ছেন।
ð মুখ ধোয়ার সময় আপনার বলা কটু কথাগুলি স্মরণ করুণ আর ভাবুন ঐ সমস্ত পাপ ধুয়ে যাচ্ছে।
ð মুখমণ্ডল ধোয়ার সময় ভাবুন চোখ দিয়ে আপনি কত হারাম দেখেছেন! সেগুলোর জন্য লজ্জিত হোন।
ð হাত ধোয়ার সময় হাত দিয়ে করা পাপগুলির কথা ভাবুন এবং সেজন্য লজ্জিত হোন। আল্লাহ সেসব পাপ মাফ করে দিচ্ছেন বলে মনে মনে কৃতজ্ঞ হোন।
ð ওযূর পর চিন্তা করুন [visualize] যে আপনার হাত-পা-মুখ জ্বলজ্বল করছে। ভাবুন, কিয়ামাতের দিনও এমনই জ্বলজ্বল করবে, এই ওযূর চিহ্ন দেখেই রাসূল(সা) আমাদেরকে চিনবেন এবং হাউযে কাউসারের পানি পান করাবেন। মনে এক পবিত্র অনুভূতি আনুন যে, ওসবই আপনার এই ওযূর প্রতিদান। কতই না উত্তম এক ইবাদাত এই মাত্র করলেন!
ð ওযূর দূয়া পাঠের সময় ভাবুন আপনার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করুন, আকাশের দিকে তাকান। গভীরভাবে চিন্তা করুন জান্নাতের অসীম নি’মাতের কথা, জান্নাতের সুঘ্রাণ অনুভব করুন আর ভাবুন সবই এই ওযূর ফলাফল!
- আপনার সুন্দরতম পোশাকটি পরে মাসজিদে রওনা দিন। সালাতের খুশূ’-র উপর পোশাকের অনেক বড় প্রভাব আছে। স্কিন টাইট পোশাক এবং শর্ট গেঞ্জি-টি শার্ট পরে সালাতে যাবেন না। বারবার এগুলো টানাটানি করে আওরাহ ঢাকার চেষ্টা করলে খুশূ’ ব্যহত হবে।
- ফরয সালাতের আগে যথেষ্ট সময় রেখেই মাসজিদে প্রবেশ করুন। মাসজিদে যাওয়ার সময় দৌড় না দিয়ে ধীরে-সুস্থে যান, আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন এই পবিত্র অনুভূতি নিয়ে যান! মাসজিদে যাওয়ার মাসনূন দূয়াটি পাঠ করুন। প্রতি কদমে নেকী লাভ করার এবং গুনাহ ঝরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতে যান।
- মাসজিদে প্রবেশ করে তাহিয়্যাতুল মাসজিদের প্রস্তুতি নিন। তবে এর আগে ২-৩ মিনিট মানসিক ব্যয়াম করুন। গভীরভাবে অনুভব করুন যে আপনি আসমান-যমীনের স্রষ্টার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছেন। আপনার সামনে সেই সিরাত কল্পনা করুন যা চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম এবং তরবারী অপেক্ষা ধারালো আর যার নিচে রয়েচে জাহান্নামের আংটা। এসবই visualize করার চেষ্টা করুন। ভাবুন, আপনার পিছনে অপেক্ষায় আছে মালাকুল মাউত। এটাই আপনার জীবনের শেষ সালাত।
রাসূল(সা) বলেন, “তোমরা সালাতে মৃত্যুকে স্মরণ কর। কারণ, যে ব্যক্তি সালাতে মৃত্যুকে স্মরণ করে সে যথাযথভাবে সালাত পড়তে বাধ্য এবং সেই ব্যক্তির মত সালাত আদায় কর যে জানে তার আর কোন সালাত আদায়ের সুযোগ নেই”। [অথবা এমনটিই বলেছেন। সিলসিলা সহীহাহ, আলবানীঃ১৪২১; ইবনু হাজার এর মতে হাসান]
এরপর “আল্লাহু আকবার” বলে দুনিয়ার সমস্ত কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করুন। তাহিয়্যাতুল মাসজিদ শেষ করে চুপচাপ বসে থাকুন। কারও সাথে গল্প-গুজব না করে ইক্বামত শুরুর আগ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দূয়া করুন।
[চলবে ইনশাআল্লাহ্]
আসসালামুআলাইকুম।ভালো লাগলে পড়ে।আল্লাহ যেন তা কাজে লাগানোর তৌফিক দান করে সবাইকে সাথে বিশেষ করে আমাকে।আমিন