সলাতে মুবাশ্শির (পর্ব ২১)
রচনায় : আবদুল হামীদ ফাইযী
কিয়ামের বিবরন
আল্লাহর রসূল (সা) ফরয ও সুন্নত নামায দাঁড়িয়েই পড়তেন। মহান আল্লাহ বলেন,
حَافِظُوْا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلاَةِ الْوُسْطى وَقُوْمُوْا للهِ قَانِتِيْنَ
অর্থাৎ, তোমরা নামাযসমূহের প্রতি এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি যত্নবান হও। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দন্ডায়মান হও। (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং- ২৩৮)
অবশ্য অসুস্থ বা অক্ষম হলে বসে এবং মুসাফির হলে সওয়ারীর উপর বসে নামায পড়েছেন।
ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন, আমার অর্শ রোগ ছিল। আমি (কিভাবে নামায পড়ব তা) আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “তুমি দাঁড়িয়ে নামায পড়। না পারলে বসে পড়। তাও না পারলে পার্শ্বদেশে শুয়ে পড়।” (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ১২৪৮ নং)
সুতরাং সক্ষম হলে ফরয নামাযে কিয়াম (দাঁড়িয়ে পড়া) ফরয। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উসাইমীন ৪/১১২)
তাকবীরে তাহরীমা
নামাযে দাঁড়িয়ে নবী মুবাশ্শির (সাঃ) ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে নামায শুরু করতেন। (এর পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ্’ বা অন্য কিছু বলতেন না।) নামায ভুলকারী সাহাবীকেও এই তকবীর পড়তে আদেশ দিয়েছেন। আর তাকে বলেছেন, “ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষেরই নামায পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঠিক যথার্থরুপে ওযু করেছে। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলেছে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮৬পৃ:)
তিনি আরো বলেছেন, “নামাযের চাবিকাঠি হল পবিত্রতা (গোসল-ওযু), (নামাযে প্রবেশ করে পার্থিব কর্ম ও কথাবার্তা ইত্যাদি)হারাম করার শব্দ হল তকবীর। আর (নামায শেষ করে সে সব)হালাল করার শব্দ হল সালাম।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০১নং)
এই তকবীরও নামাযে ফরয। ‘আল্লাহু আকবার’ ছাড়া অন্য শব্দে (যেমন আল্লাহ আজাল্ল্, আল্লাহু আ’যাম প্রভৃতি সমার্থবোধক) তকবীর বৈধ ও যথেষ্ট নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৬)
ইবনুল কাইয়েম (রহঃ) বলেন, ‘তাহ্রীমার সময় তাঁর অভ্যাস ছিল, ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দ বলা। অন্য কোন শব্দ নয়। আর তাঁর নিকট হতে কেউই এই শব্দ ছাড়া অন্য শব্দে তকবীর বর্ণনা করেন নি।’ (যাদুল মাআদ ১/২০১-২০২)
তাকবীরে তাহ্রীমা বলার সময় (একটু আগে, সাথে সাথে বা একটু পরে) মহানবী (সাঃ) তাঁর নিজহাত দু’টিকে কাঁধ বরাবর তুলতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৯৩নং) আর কখনো কখনো কানের ঊর্ধ্বাংশ বরাবরও ‘রফ্য়ে ইয়াদাইন’ করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৯৫নং) হাত তোলার সময় তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো লম্বা (সোজা) হয়ে থাকত। (জড়সড় হয়ে থাকত না)। আর আঙ্গুলগুলোর মাঝে (খুব বেশী) ফাঁক করতেন না, আবার এক অপরের সাথে মিলিয়েও রাখতেন না। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৪৫৯নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)
প্রকাশ থাকে যে, ‘রফ্য়ে ইয়াদাইন’ করার সময় কানের লতি স্পর্শ করা বিধেয় নয়। যেমন এই সময় মাথা তুলে উপর দিকে তাকানোও অবিধেয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২৩/৯৫) তদনুরুপহাত তোলার পর নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে তারপর হাত বাঁধাও ভিত্তিহীন। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উসাইমীন ৩/৪৩) যেমন তকবীরের পূর্বে নামায শুরু করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলা বিদআত। (ঐ ১/১৩৩)
হস্ত-বন্ধন (হাত বাধা)
এরপর নবী মুবাশ্শির (সাঃ) তাঁর ডান হাতকে বামহাতের উপর রাখতেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫২নং) আর তিনি বলতেন, “আমরা আম্বিয়ার দল শীঘ্র ইফতারী করতে, দেরী করে সেহরী খেতে এবং নামাযে ডানহাতকে বামহাতের উপর রাখতে আদিষ্ট হয়েছি।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ, হাইসামী ২/১০৫)
একদা তিনি নামাযে রত এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে পার হতে গিয়ে দেখলেন, সে তার বাম হাতকে ডান হাতের উপর রেখেছে। তিনি তার হাত ছাড়িয়ে ডান হাতকে বাম হাতের উপর চাপিয়ে দিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৩/৩৮১, আবূদাঊদ, সুনান ৭৫৫নং)
সাহল বিন সা’দ (রাঃ) বলেন, লোকেরা আদিষ্ট হত, তারা যেন নামাযে তাদের ডানহাতকে বাম প্রকোষ্ঠ (হাতের রলার) উপর রাখে। (বুখারী ৭৪০নং)
ওয়াইল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, তিনি ডান হাতকে বাম হাতের চেটোর পিঠ, কব্জি ও প্রকোষ্ঠের উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৭ নং, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
কখনো বা ডান হাত দ্বারা বাম হাতকে ধারণ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৬নং, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান ২৫২, দারাক্বুত্বনী, সুনান)
আল্লামা আলবানী বলেন, উক্ত হাদীস এই কথার দলীল যে, সুন্নত হল ডান হাত দিয়ে বাম হাতকে ধারণ করা। আর পূর্বের হাদীস প্রমাণ করে যে, ডান হাত বাম হাতের উপর (ধারণ না করে) রাখা সুন্নত। সুতরাং উভয় প্রকার আমলই সুন্নত। পক্ষান্তরে একই সঙ্গে প্রকোষ্ঠের উপর রাখা এবং ধারণ করা -যা কিছু পরবর্তী হানাফী উলামাগণ উত্তম মনে করেছেন তা বিদআত। তাদের উল্লেখ মতে তার পদ্ধতি হল এই যে, ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখবে, কড়ে ও বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাম হাতের প্রকোষ্ঠ (রলা) কে ধারণ করবে। আর বাকী তিনটি আঙ্গুল তার উপর বিছিয়ে দেবে। (হাশিয়া ইবনে আবেদীন ১/৪৫৪) সুতরাং উক্ত পরবর্তীগণের কথায় আপনি ধোকা খাবেন না। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮৮পৃ:, ৩নং টীকা)
পক্ষান্তরে উভয় হাদীসের উপর আমল করতে হলে কখনো না ধরে রাখতে হবে এবং কখনো ধারণ করতে হবে। যেহেতু একই সঙ্গে ঐ পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
প্রকাশ থাকে যে, ডান হাত দ্বারা বাম হাতের বাজু ধরারও কোন ভিত্তি নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উসাইমীন ৩/৪৫)
হাত রাখার জায়গা
এরপর মহানবী (সাঃ) উভয় হাতকে বুকের উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৫৯ নং, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৪৭৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ, আবুশ শায়খ প্রমুখ)
প্রকোষ্ঠের উপর প্রকোষ্ঠ রাখার আদেশ একথাও প্রমাণ করে যে, হাত বুকের উপরেই বাঁধা হবে। নচেৎ তার নিচে ঐভাবে রাখা সম্ভব নয়। মুহাদ্দিস আলবানী (রহঃ) বলেন, বুকের উপরেই হাত বাঁধা সুন্নাহতে প্রমাণিত। আর এর অন্যথা হয় যয়ীফ, না হয় ভিত্তিহীন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮৮পৃ:)
বুকে রয়েছে হৃদয়। যার উপর হাত রাখলে অনন্ত প্রশান্তি, একান্ত বিনয় ও নিতান্ত আদব অভিব্যক্ত হয়।