পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ খেজুরঃ ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে
রচনায় :- ইমামুদ্দিন বিন আব্দুল বাছীর**
মহান রাব্বুল আলামীন মানুষকে এই ধরণীতে পাঠিয়ে তাদের স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণের জন্য নানা সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবারের যোগান দিয়েছেন । তাদেরকে দিয়েছেন প্রচুর ভিটামিন সমৃদ্ধ শক্তিবর্ধক নান জাতের ফল । যা খেয়ে মানুষ সুস্থ শরীরে জীবন পরিচালনা করতে পারে । মহান আল্লাহ যে সকল নি‘আমত পূর্ণ ফল মানুষের খাবারের জন্য সৃজন করেছেন তন্মধ্যে ‘খেজুর’ অন্যতম ।এর মধ্যে তিনি দিয়েছেন বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও স্বাস্থ্যসম্মত গুণাগুণ । আবার খেজুর আমাদের ছিয়ামরত অবস্থায় সারাদিন অনাহারে থেকে সূর্যাস্তের মুহূর্তে ইফতার শুরুর অন্যতম ফলও বটে । মহানবী (ছাঃ) খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন ।
বিশ্বের বহু দেশে খেজুরের দর্শন মেলে । চাষাবাদও হয় পর্যাপ্ত পরিমাণে । সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, চির সবুজের দেশ আমাদের মাতৃভূমি ছোট্ট এই বাংলাদেশেও খেজুর উৎপন্ন হয় । যা ভক্ষণ করে আমরা পরিতৃপ্ত হই । আমরা কি খেজুরের গুণাগুন সম্পর্কে একটি বার ভেবে দেখেছি? মহান আল্লাহ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এসব ফল সৃজন করেই ক্ষান্ত হননি; বরং এ সবের মধ্যে রেখেছেন চিন্তাশীল গবেষক ব্যক্তিদের জন্য জ্ঞানের খোরাক । এসব সৃষ্টি মহান স্রষ্টাকে চেনার নিদর্শন বললেও অত্যুক্তি হবে না । অত্র প্রবন্ধে খেজুরের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ।
খেজুরের চাষাবাদঃ Phoenix dactylifera নামক খেজুর শুষ্ক আবহাওয়ায় প্রচুর পরিমাণে জন্মায় । এই খেজুর Palmজাতীয় পরিবারভুক্ত । পামজাতীয় পরিবারভুক্ত নারিকেল গাছের পরেই কার্যকারিতার দিক থেকে খেজুর গাছের স্থান দ্বিতীয় ।১ আরব দেশে খেজুর গাছ (Phoenix dactylifera) সুপ্রাচীন উৎস সম্বলিত এক প্রকার ফলের গাছ । মধ্যপ্রাচ্যে এ গাছের চাষ চলে আসছে খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর থেকে ।২
Date-palm নামক খেজুর গাছ প্রায় ৪০০০ বছর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা থোকায় খেজুর ঝুলতে দেখা যায় । শক্ত খেজুর-বিচির চার পাশে পুষ্টিকর সুমিষ্ট শাঁসালো বস্তু ঘিরে থাকে । ১০-১৫ বছর বয়স হলে খেজুর গাছে ফল ধরে । এসব খেজুর গাছ প্রায় ১০০ থেকে ২০০ বছর পর্যন্ত বেচে থেকে ফল দান করে ।৩
উত্তর আফ্রিকার অনেক অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইরান, সঊদী আরব, পাকিস্তান ও ভারতে খেজুর গাছ স্থানীয় উদ্ভিদ । দক্ষিণ ইরাক, মদীনার কাছাকাছি মরুদ্যান ও উর্বর জমি এবং দক্ষিণ আরবের উপকূলীয় অঞ্চলে খেজুর উৎপন্ন হয় ।ইরাক, সঊদী আরব, ইরান উন্নতমানের খেজুরের জন্য বিখ্যাত ।৪ উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে খেজুরই হল প্রধান খাদ্য । মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সময়কালেও আরবদের নিকট এই খেজুর ছিল প্রধান খাদ্যবস্তু ।৫ খেজুর গাছ আমাদের দেশেও প্রায় সব জায়গায় দেখা যায় । ভারতবর্ষ দেশী খেজুরের আদি নিবাস । বাংলাদেশের যশোর, ফরিদপুর ও উত্তরবঙ্গে খেজুর গাছ বেশী জন্মে ।৬
যেভাবে ফলন বাড়ানো যায়ঃ কৃত্রিম পরাগ-মিলনের মাধ্যমে ফলন বাড়ানো যেতে পারে । এজন্য একজন উৎপাদনকারী পুং-বৃক্ষের মঞ্জুরী কেটে নিয়ে স্ত্রী-বৃক্ষের শাখায় ফুলের থোকায় বেঁধে দেয় । তখন ফুলের শাখাগুলি খোলস বা মোচা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে ।৭ এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
রাফে‘ইবনু খাদীজ (রাঃ) বলেন, নবী করীম(ছাঃ) যখন (হিজরত করে) মদীনায় আসলেন, তখন মদীনার লোকেরা খেজুর গাছের তা‘বীর করছিল । রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এরূপ কেন করছ ? তারা উত্তর করল, আমরা বরাবরই এরূপ করে আসছি । রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,মনে হয় তোমরা এরূপ না করলেই উত্তম হত । সুতরাং তারা এ পদ্ধতি ত্যাগ করল । কিন্তু এতে (সে বছর) ফলন কম হল । তিনি (রাবী) বলেন, লোকেরা এ ঘটনা মহানবীর নিকট উল্লেখ করল । তখন মহানবী (ছাঃ) বললেন, ‘আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ । আমি যখন তোমাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই, তখন তা তোমরা গ্রহন করবে, আর আমি যখন (তোমাদেরকে দুনিয়া সম্পর্কে) আমার নিজের মত অনুসারে তোমাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই, তখন (মনে করবে যে) আমিও একজন মানুষ’ ।৮
হাদীছে আলোচিত তা‘বীরের পরিচয় দিতে গিয়ে মেশকাত শরীফের প্রান্তটীকায় বলা হয়েছে, ‘মূলতঃ আধুনিক কৃষিবিজ্ঞানের পরাগায়ন পদ্ধতিকে তা‘বীর বলা হয় । আরবরা এজন্য স্ত্রী খেজুর গাছের ফুলের কলি ফেড়ে তার মধ্যে পুরুষ গাছের পুষ্পকুঁড়ি লাগিয়ে দিত । এর ফলে খেজুরের উৎপাদন বেশী হত ।৯ বিজ্ঞানে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রত্যেক উদ্ভিদই নর-মাদী দু’রকম থাকে । নরের কেশর মাদীর কেশরের সাথে মিলিত হলেই তাতে ফল জন্মে ।এমনকি কোন কোন গাছে এক সাথে নর-মাদী দু’রকমের ফুল হয় এবং নরের কেশর মাদীতে প্রবেশ করে; কীট ও বায়ুই এই সকল কেশর এক ফুল হতে অন্য ফুলে বহন করে নিয়ে যায়, তাতেই ফল’।১০ প্রকৃতপক্ষে মহানবী (ছাঃ) ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনার উপর ভিত্তি করেই এ পরামর্শ দিয়েছিলেন । এটা কোন শারঈ বিষয় ছিল না; বরং কৃষি সংক্রান্ত বিষয় । বিধায় তা মহানবী (ছাঃ)-এর জানার বাইরে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয় ।
খেজুরের রসঃ বাংলাদেশ সহ এ উপমহাদেশে যে খেজুর পাওয়া যায় তার বিচির গায়ে শাসের পরিমাণ শাঁসের পরিমাণ তত পুরু নয় । তবে রস খুব সুস্বাদু ও মিষ্টি । গাছের গলায় হাঁড়ি ঝুড়িয়ে এই রস সংগ্রহ করা হয় । এই রসে তাপ দিয়ে গাঢ় আঠালো গুড় তৈরি তৈরি হয় ।১১
খেজুরের রস পুষ্টিকর পানীয় । শীত মৌসুমে গাছের উপরিভাগে কান্ডের একটু অংশ চেছে সংগ্রহ করা হয় সুস্বাদু রস । এটি অত্যন্ত সুপেয় পানীয় । প্রচুর ভিটামিন ও শতকরা ১৪ ভাগ শর্করা এতে পাওয়া যায় । টাটকা কাঁচা রস যেমন পাওয়া যায়, আবার রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে তৈরি করা হয় উপাদেয় খেজুরের গুড় । আয়ুর্বেদী মতে খেজুরের রস হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, শক্র ও মুত্র বাড়ায়, বাত ও শ্লেষ্মা কমায় ।১২
আল-কুরআনের আলোকে খেজুরঃ মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে মহান রাব্বুল আ‘লামীন খেজুরের বিভিন্ন দিক নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা মানব জাতির সামনে পেশ করেছেন । এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহরপাক আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকেন । আমি এর দ্বারা সকল প্রকার গাছপালা উৎপাদন করি, সবুজ-শ্যামল ফসল নির্গত করি যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি । এর ফলে বসন্তকালে খেজুর গাছের গলা থেকে খেজুর ছড়া থোকায় থোকায় ঝুলতে থাকে ।
অনুরূপভাবে বেদানা,জলপাই,আঙ্গুর প্রভৃতি গাছের বাগান তৈরি করি । এগুলি শ্রেণীগতভাবে এক ধরনের হলেও বৈচিত্র্যে ভিন্ন । ঐ সমস্ত গাছে যখন ফল ধরে তখন এই ফলের কাঁচা-পাকা দৃশ্য আমাদের চোখে প্রশান্তি এনে দেয় । চেয়ে দেখ! যারা বিশ্বাসী তাদের জন্য ঐসব দ্রব্যের মধ্যে নিদর্শন রয়েছে’ (আন‘আম ৯৯) অত্র আয়াতে খেজুরের সামান্য পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে । সাথে সাথে খেজুর গাছের উৎপাদনের উৎসের কথাও বলা হয়েছে ।
পবিত্র কুরআনে অন্যত্র বিধৃত হয়েছে,
وَمِن ثَمَرَاتِ النَّخِيلِ وَالْأَعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
খেজুর ও আঙ্গুর থেকে তোমরা মাধ্যম ও উত্তম খাদ্য তৈরি থাক, নিশ্চয়ই এতে বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে’(নাহল ৬৭)।
এ আয়াতে বলা হয়েছে খেজুর ও আঙ্গুর থেকে ভাল ও মন্দ উভয় প্রকার খাদ্য প্রস্তুত করা যায় । কুমারী মারয়াম (আঃ) যখন খেজুর গাছের নীচে বাচ্চা প্রসব করে দুর্বল এবং তীব্র ক্ষুদায় কাতর হয়ে পড়েন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে নির্দেশ দিলেন,
وَهُزِّي إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا
‘খেজুর গাছের গোড়া ধরে তোমার নিজের দিকে ঝাঁকুনি দাও, তাহলে সুপরিপক্ক সুস্বাদু খেজুর তোমার কাছে ঝরে পড়বে’ ।(মারইয়াম ২৫)।
প্রসবের অব্যবহিত পরে মা পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব অনুভব করে, কারণ প্রসবকালে জরায়ুর সংকোচন-ব্যথার ফলে যে শক্তি ক্ষয় হয় তা পূরণ করতে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন । তাই মারয়াম (আঃ)-এর সত্বর শক্তি লাভের জন্য আল্লাহ পাক পুষ্টিকর খাদ্য খেজুর সরবারাহ করেছিলেন ।১৩
হাদীছের আলোকে খেজুরঃ খেজুর মহানবী (ছাঃ) নিজে খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়েছেন সাথে সাথে অন্যদেরকেও খেতে উৎসাহ প্রদান করেছেন । ইসলামের প্রথম যুগে দারিদ্রপীড়িত মুসলিম সমাজে খেজুরই ছিল অন্যতম খাদ্য । অনেক সময় খেজুর খেয়েই মহানবী (ছাঃ) ও ছাহাবায়র কেরামকে দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে । যার প্রমাণ হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থে ভূরি ভূরি পাওয়া যায় । যেমন- জামালা ইবনু মুহাইম (রাঃ) বলেন, এক বছর আমরা আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের সাথে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত হয়ে পড়লাম । আমাদেরকে দেয়া হত একটি করে খেজুর। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) আমাদের নিকট দিয়ে যেতেন এবং আমরা তখন আহাররত থাকলে তিনি বলতেন, একত্রে দু‘খেজুর খেতে নিষেধ করেছেন । অতঃপর তিনি বলেন, অবশ্য অপর ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে খাওয়া যায় ।১৪
মহানবী (ছাঃ) নিজেও বিভিন্ন প্রকার খেজুর খেতেন । আব্দুল্লাহ ইবনু জা‘ফর (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কাকড়ীর সাথে তাজা খেজুর খেতে দেখেছি’।১৫
আনাসের রেওয়ায়েতে অপর হাদীছে আছে, ‘তিনি উপুড় হয়ে বসে খেজুর খাচ্ছিলেন । অপ্র বর্ণনায় আছে ‘তিনি উহা খুব তাড়াতাড়ি খাচ্ছিলেন’।১৬
মহানবী (ছাঃ) যেসব জিনিস খেতে বেশী পসন্দ করতেন তন্মাধ্যে খেজুর অন্যতম । সোলামী গোত্রীয় বুসরের দু’পত্র বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিকট আসলেন, তখন আমরা মাখন ও খেজুর তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করলাম । আর তিনি মাখন ও খেজুর খেতে বেশী পস্নদ করতেন’।১৭ আয়েশা(রাঃ) বলেন, ‘মহানবী(ছাঃ) তাজা-পাকা খেজুর দ্বারা খরবুজা খেতেন’।১৮ মহানবী(ছাঃ) খেজুরের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেন, ‘সে গৃহবাসী অভুক্ত নয় যাদের কাছে খেজুর আছে’।অপ্র এক রেওয়ায়েতে আছে ।তিনি বলছেন, ‘হে আয়েশা ! যে ঘরে খেজুর নেই, সে গৃহবাসী অভুক্ত’।১৯
মহানবী (ছাঃ) ও তাঁর পরিবার অনেক সময় শুধু খেজুর খেয়েই জীবন যাপন করতেন । তাও আবার পরিমাণে ছিল খুবই সামান্য । যা খেয়ে ক্ষুদা পূর্ণভাবে নিবারণ হত না । রাসূল (ছাঃ)-এর সহধর্মিনী আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘কখনো কখনো আমাদের পূর্ণ একটি মাস এমনভাবে অতিবাহিত হত যে, তন্মাধ্যে আগুন জ্বালাতাম না,শুধু খোরমা-খেজুর ও পানি দ্বারাই আমাদের দিন গুজরান হত । তবে কোন কোন সময় কিছু গোশত হাদিয়া স্বরূপ পেতাম’।২০ আয়েশা (রাঃ) হতে অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরিবার-পরিজন এক নাগাড়ে দু’দিন আটার রুটি দ্বারা পরিতৃপ্ত হতে পারেননি; বরং দু’দিনের একদিন খেজুর খেয়ে কাটাতেন’ (অর্থাৎ একদিন রুটি অপর দিন খেজুর)।২১ আয়েশা (রাঃ) আরো বলেন, ‘এমন অবস্থায় মহানবী (ছাঃ)-এর মৃত্যু হয় যে, আমরা দু’কা্লো বস্তু (খেজুর ও পানি)ও পেট পুরে খেতে পাইনি’।২২
নো‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি (মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে) বলেন, ‘তোমরা কি ইচ্ছামত পানাহার করছ না? অথচ আমি তোমাদের নবী(ছাঃ)-কে এমন অবস্থায় দেখেছি যে, নিম্নমানের খেজুরও এই পরিমাণ তাঁর জুটেনি, যা দ্বারা তাঁর নিজ উদর পূরণ হতে পারে’।২৩ উল্লেখিত হাদীছগুলি দ্বারা ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে মহানবী (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম বাস্তব অবস্থা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে ।এ সময় দারিদ্রপীড়িত মুসলমানদের ক্ষুধা মেটানোর অন্যতম উপকরণ ছিল বহুগুণে গুণান্বিত এই খেজুর । যা খেয়ে তাঁরা মাসের পর মাস কাটিয়ে দিয়েছেন ।
চিকিৎসা ক্ষেত্রেও খেজুরের কার্যকারিতা বিদ্যমান । কারণ খেজুরের মধ্যেও বহু রোগের প্রতিষেধক রয়েছে । যার প্রমাণ মহানবী (ছাঃ)-এর বাণীতে পাওয়া যায় ।যেমন- সাদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি সকালে সাতটি ‘আজওয়া’২৪ খেজুর খাবে, সেদিন কোন বিষ ও জাদুটোনা তার ক্ষতি করতে পারবে না’ ।২৫ আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে মহানবী (ছাঃ) আরো পরিষ্কারভাবে বলছেন, মদীনার উচ্চভূমির আজওয়া’ খেজুরের মধ্যে রোগের নিরাময় রয়েছে । আর ভোরে উহা (খাওয়া বিষের প্রতিষেধক’।২৬ তিনি এর মাধ্যমে চিকিৎসার পরামর্শও দিয়েছেন ।সাদ (রাঃ) বলেন, এক সময় আমি মারাত্নকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম ।নবী করীম (ছাঃ) আমার খোজ-খবর নেয়ার জন্য আসলেন ।
তিনি তাঁর হাতখানা আমার দু’স্তনের মধ্যখানে(বুকের উপর) রাখলেন । এতে আমি আমার কলিজায় শীতলতা অনুভব করলাম । অতঃপর তিনি বললেন, তুমি একজন হৃদরোগী ।সুতরাং তুমি ছাক্বীফ গোত্রীয় হারেস ইবনে কালদার নিকট যাও ।সে একজন চিকিৎসক ।পরে তিনি বললেন, সে যেন অবশ্যই মদীনার সাতটি ‘আজওয়া’ খেজুর বীচিসহ পিষে তোমার মুখের মধ্যে ঢেলে দেয়’।২৭
উল্লিখিত হাদীছগুলি দ্বারা বুঝা যায়, খেজুর রোগ প্রতিষেধক হিসাবেও অনন্য । বিভিন্ন রোগের মহৌষধী গুনাগুণ মহান আল্লাহ এই খেজুরের মধ্যে সংস্থাপন করেছেন ।
ইফতারী হিসাবে খেজুরঃ মহানবী (ছাঃ) ছিয়াম রত অবস্থান সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে সূর্যাস্তের সময় খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন ।ছাহাবাগণকেও খেজুর দিয়ে ইফতার করতে নির্দেশ দিতেন । একান্তই যদি খেজুর পাওয়া না যায় তবে পানি দ্বারা ইফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন । সালমান ইবনু আমের আদদাবযী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ইফতার করে তখন তার খুরমা-খেজুর দিয়ে ইফতার করা উচিত । তবে যদি সে খুরমা-খেজুর না পায় তাহলে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে । কারণ পানি হচ্ছে পবিত্র’ ।২৮
অন্যত্র আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতের (মাগরিব) পূর্বে কয়েকটি তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন । তিনি তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর (অর্থাৎ খুরমা) দিয়ে ইফতার করতেন। আর যদি তাও না পেতেন তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন’।২৯
হাদীছ দ্ব্যে খেজুর দিয়ে ইফতার করার প্রতি যথেষ্ট শুরুত্বারোপ করা হয়েছে । মূলতঃ এ হাদীছগুলিও খেজুরের গুণাগুণের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে ।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে খেজুরঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই উন্নত যুগে গবেষণায় এ তথ্য উদঘাটিত হয়েছে যে, খেজুরের মধ্যে অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে । বিজ্ঞানীরা খেজুরের উপাদানের তালিকা এভাবে বর্ণনা করেছেন ।৩০
প্রোটিন ২.০০ মাগনেসিয়াম ৫৮.৯০
কার্বোহাইড্রেট ২৪.০০ কপার ০.২১
ক্যালরি ২.০০ আয়রণ ১.৬১
সোডিয়াম ৪.৭০ ফসফরাস ৬৩৮.০০
পটাশিয়াম ৭৫৪.০০ সালফার ৫১.৬০
ক্যালসিয়াম ৬৭.৯০ ক্লোরিন ২৯০.০০
খেজুরের পুষ্টিগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে Scientific Indication in the holy Quran গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে যে,
The chief nutritional value being their light sugar content which varies from 60 to 70 percent and the presence of some quantity of vitamins A, B, B2 and nicotinic acid.
অর্থাৎ ‘খেজুরের চিনি-উপাদান অতিশয় পুষ্টিগুণের অধিকারী, খেজুরে চিনি উপাদানের পরিমাণ ৬০-৭০% ।
এছাড়া খেজুরে আছে স্বল্প পরিমাণ ভিটামিন A,B,B2 এবং নিকোটিন এসিড’।৩১
খেজুরে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন রয়েছে । এসব ভিটামিন নানাভাবে শরীরের স্বাভাবিক গঠন ও স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সহযোগিতা করে । খেজুরের ঔষুধিগুণ হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় । খেজুরে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যসম্মত আদর্শ খাবার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে । খেজুর মধুর শীতল স্নিগ্ধ রুচি রুচি বর্ধক,ক্ষয় ও রক্তপিত্ত রোগ নিবারক ।এটা বল বাড়ায় ও শুক্র বৃদ্ধি করে ।৩২
খেজুরের বহুবিধ পুষ্টিগুণের কারণেই বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ(ছাঃ) খেজুর দ্বারা ইফতার করার প্রতি মুসলিম জাতিকে উৎসাহিত করেছেন । সারাদিন ছিয়াম রাখার পর শরীরের শক্তি কমে যায় । একারণে ইফতার এমন জিনিস দ্বারা করা উচিত যা দ্রুত হযম হয় ও শক্তি বৃদ্ধি করে। সাহারীর পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন কিছু পানাহার করা হয় না এবং শরীরের ক্যালরী অথবা স্নায়ুবিক শক্তি একাধারে কমতে থাকে । এজন্য খেজুর স্বাভাবিক ও উৎকৃষ্টমানের খাদ্য যা ভক্ষণে স্নায়ুবিক শক্তি স্বাভাবিক হয় এবং শরীর বিভিন্ন প্রকারের রোগ ব্যাধি থেকে বেঁচে যায় । যদি শরীরের স্নায়ুবিক শক্তি ও তাপমাত্রা কন্ট্রোল করা না যায় তাহলে নিম্নোক্ত রোগগুলি সৃষ্টি হয়- লো ব্লাড প্রেসার, প্যারালাইসিস, ফ্যাসিয়াল প্যারালাইসিস এবং মাথা ঘোরা ইত্যাদি ।
খাদ্যগুণ কম থাকার কারণে রক্ত স্বল্প রোগীদের জন্য ইফতারের সময় আয়রণ অত্যন্ত প্রয়োজন । আর প্রাকৃতিকভাবেই খেজুরের ভিতর তা রয়েছে ।৩৩
মানুষের শরীরে সুগারের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার কারণে ক্ষুধা লাগে । তাই রোযা রেখে খেজুর দ্বারা ইফতার করার প্রতি ইসলামে উদ্ধুদ্ধ করা হয়েছে । আর দু’টি খেজুর আহারেই সুগারের ঘাটতি পূরণ হয় এবং শরীর তার প্রয়োজনীয় আহার্য লাভ করে ।৩৪
কিছু কিছু লোকের শরীর শুষ্ক হয়ে যায় । এ সব লোক যখন ছিয়াম রাখে তখন তাদের শুষ্কতা আরো বৃদ্ধি পায় । খেজুর যেহেতু স্বাভাবিক প্রকৃতির তাই তা ছায়েমের জন্য বড়ই উপকারী । গ্রীষ্মকালে রোযাদারগণ পিপাসার্ত থাকেন, তারা ইফতারের সময় যদি সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানি পান করেন তাহলে পাকস্থলীতে গ্যাস, তাপ বৃদ্ধি পেয়ে লিভার ফুলে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা থাকে । যদি ছায়েম খেজুর খাওয়ার পর পানি খায় তাহলে নানা রকম বিপদ থেকে বেঁচে যায় ।৩৫
খেজুর বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে । এগুলির রঙ, আকার-আকৃতির যেমন বিভিন্ন তেমনি এর স্বাদও হয় ভিন্ন ভিন্ন । উন্নতমানের কয়েকটি খেজুর হচ্ছে সুখখাল, শাকবী, বরণী, জারী জালী কালকাহ, আজওয়া ইত্যাদি । এগুলির মধ্যে আজওয়া সবচেয়ে উন্নতমানের ।৩৬
সমাপনীঃ উপস্থিত পবিত্র কুরআনের আয়াত ও রাসূলের বাণী তথা হাদীছ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা লব্ধ তথ্য সমূহ পর্যালোচনা করলে একথা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে যে, খেজুর বহু পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং অনেক রোগের প্রতিষেধকও বটে । আর খেজুর গাছ থেকে শীতকালে সংগৃহীত খেজুরের রস একটি সুমিষ্ট ও সুপেয় পানীয় । এ রসেও রয়েছে বিভিন্ন গুণাগুণ । তাই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিজে খেজুর খেতেন এবং জগতবাসীকে খেজুর খাওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন ।
মহান আল্লাহ যত কিছু সৃষ্টি করেছেন সব কিছুই মানুষের উপকারের জন্য । তাঁর কোন সৃষ্টিই অনর্থক নয়; বরং প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যে লুকায়িত আছে অনেক অজানা তথ্য ও গুঢ় রহস্য । বিধায় মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে বিজ্ঞান যতই গবেষণা করবে ততই নতুন নতুন জ্ঞানের উন্মেষ ঘটবে । তেমনি খেজুর নিয়ে আরো ব্যাপক গবেষণা করলে হয়ত আরো অনেক নতুন তথ্য বের হয়ে আসবে ।
তাই আসুন ! আমরা পুষ্টিগুণে ভরপুর খেজুর খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনে মনোনিবেশ করি ।
*আখিরা, নাচোল, চাপাইনবাবগঞ্জ ।
তথ্যসূত্র :
১.Scinence in Al-Quran Board of Researher’s Scientific Indication in the Holy Quran (Dhaka: Islamic Foundation Bnagladesh, 2nd Edition: June, 1995),P.281
২. তদেব, P. 149.
৩. তদেব, P.281.
৪. দৈনিক ইনকিলাব, ২৯ অক্টোবর, ২০০৪, পৃঃ ১৩, কলাম ৫ ।
৫.Scinentific Indication int the Holy Quran, P. 281.
৬. দৈনিক ইনকিলাব, ২৯ অক্টোবর’০৪, পৃঃ১৩ ।
৭. Scinentific Indication in the Holy Quran, P.149.
৮. মুসলিম, মিশকাতুল মাছাবীহ, তাহক্বীক্ব-মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দিন আলবানী (বৈরুতঃ আল-মাকতাবু ইসলামী, তৃতীয় সংস্করণঃ ১৯৮৫ ইং/১৪০৫ হিঃ), হা/১৪৭ ।
৯. ওয়ালী উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-খত্বিব আত-তাবরীযী, মিশাকাতুল মাছাবীহ (ঢাকাঃ ইমদাদিয়া পুস্তকালয় তাবি),পৃঃ ২৮, ১নং টীকা ।
১০. মাওলানা নূর মোহাম্মাদ আজমী (রহঃ), বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকাঃ এমাদাদিয়া পুস্তকালয়, প্রকাশকালঃ আগষ্ট,১৯৯৮ইং),১/১১১পৃঃ, ১নং টীকা ।
১১. Scientific Indication in the Holy Quran,P.281.
১২.দৈনিক ইনকিলাব, ২৯ অক্টোবর ’০৪, পৃঃ১৩ ।
১৩.Scientific Indication in the Holy Quran,P.316.
১৪.বুখারী ও মুসলিম; ইমাম মহিউদ্দিন ইয়াহইয়া আন-নববী (রহঃ), রিয়াযুছ ছালেহীন (রিয়াযঃ দারুল মা‘মুন লিত-তুরাছ,১৯৮৯), হা/৭৪২ ।
১৫. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৮৫ ।
১৬. মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৮৭ ।
১৭. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪২৩২ ।
১৮. তিরমিযী, সন্দ ছহীহ, মিশকাত হা/৪২২৫ ।
১৯. মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৮৯ ।
২০. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৯২ ।
২১. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৯৩ ।
২২. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৯৪ ।
২৩. মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৯৫ ।
২৪. আজওয়া মদীনার একটি উন্নতমানের খেজুর । এর জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিশেষভাবে দো’আ করেছেন । এটা তুলনামূলকভাবে আকারে ছোট ও বর্ণে কালো । দ্রঃ বাংলা মিশকাত, ৮/১৫২ পৃঃ, ৪০০৮ নং হাদীছের ব্যাখ্যা ।
২৫. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৯০ ।
২৬. মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৯১ ।
২৭. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪২২৪ ।
২৮.আবুদাঊদ, তিরমিযী হাদীছকে হাসান ছহীহ বলেছেন, রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/১২৩৮ ।
২৯. আবুদাঊদ ও তিরমিযী, সনদ হাসান, রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/১২৩৯ ।
৩০. ডাঃ মুহাম্মাদ তারেক মাহমুদ, সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, ভাষান্তরঃ হাফেয মাওলানা মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান (ঢাকাঃ আল-কাউসার প্রকাশনী, ১৪২০ হিঃ), ১/১৫৯ পৃঃ ।
৩১.Scientific Indication in the Holy Quran, P.316.
৩২. দৈনিক ইনকিলাব, ২৯ অক্টোবর ’০৪, পৃঃ১৩ ।
৩৩. সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, ১/১৬০ পৃঃ ।
৩৪. ঐ, ৩/১২৫ পৃঃ ।
৩৫. ঐ, ১/১৬০ পৃঃ ।
৩৬. দৈনিক ইনকিলাব, ২৯ অক্টোবর ’০৪, পৃঃ ১৩ ।
যদি রসূল(সাঃ) বলেন তবে সঠিক বলেছেন,সেইটির জ্ঞান তোমার জানা নেই।