মাহে রামাযানের আগমন ও বিশ্বময় প্রস্তুতি

মাহে রামাযানের আগমন ও বিশ্বময় প্রস্তুতি

– মুহাম্মাদ সাঈদুর রহমান*

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ [٢:١٨٣]

‘হে ঈমান্দারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হ’ল, যেমনভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পুর্ববর্তীগণের উপরে। যেন তোমরা পরহেযগার হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩)।

সুরা বাক্বারাহ্র আলোচ্য আয়াতটি চিয়ামের ঐতিহাসিকতারই সাক্ষ্য বহণ করে। তাক্বওয়া অর্জনের জন্য এই ছিয়াম বস্তুত বান্দার জন্য মহান আল্লাহর বিরাট নে’মত। আরবী রামাযান মাসে মুমিনের উপর ছিয়ামব্রত পালন করা অপরিহার্য করা হয়েছে। বছর ঘুরে এই মুবারক মাসটি যখন আগমন করে, তখন জগদ্বাসীর অলক্ষ্যেই আল্লাহ্‌র সৃষ্টিরাজির মাঝে স্বর্গ-মর্ত ব্যাপী ঘটে যায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মাহে রামাযানের শানে স্বয়ং রাব্বুল আ’লামীন গ্র০হণ করেন প্রস্তুতিমুলক কিছু কর্মসুচী। আল্লাহ্‌র দুনিয়ায় পরে যায় এক সাজ সাজ রব।

বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহে বিরানপ্রায় পৃথিবী বর্ষার এক পশলা বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে পত্র-পল্লবে যেমন সজীব হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি মাহে রামাযানের পশ্চিম গগনের এক ফালি রূপালী হেলাল মরদুদ শয়তানের ওসওয়াসা ক্লিষ্ট পাপ বিদগ্ধ দুনিয়ায় ঘোষণা করে শান্তির জয়গান। রহমত ও মাগফেরাতের ছায়া জগদ্বাসীকে করে আচ্ছাদিত। আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রামাযান মাস আগমন করলে রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,

‘এ মাসটি তোমাদের মাঝে আগমন করেছে। এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাযার মাসের চেয়েও উত্তম। যাকে এ রাত থেকে বঞ্চিত করা হ’ল, তাকে যেন সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হল’.।১

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বর্নিত রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন রামাযান মাস আগমন করে তখন (তার সম্মানে) আসমানের দরজা সমুহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অপর বর্ণনায় আছে, জান্নাতের দরজা সমুহ উন্মুক্ত করা হয়, জাহান্নামের দরজা সমুহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। অপর এক বর্ণনায় আছে, রহমতের দরজা সমুহ উন্মুক্ত করা হয়’।২

হাদীছের ব্যাখ্যা গ্রন্থ সমুহে উক্ত হাদীছের ব্যাপক ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। সবচাইতে প্রণিধানযোগ্য দিকটি হ’ল এ মাসের সম্মান ও এর অবস্থানের অনুকূলতা নিশ্চিত করা। সেকারণেই শয়তানকে আবদ্ধ করা হয়, যাতে পাপের উৎসগুলি বন্ধ হয়ে যায়, আর বান্দারা তুলনামুলক পাপ মুক্ত পরিবেশে ছিয়াম পালন করে এই মাসের মর্যাদা রক্ষা করে নিজেকে ধন্য করতে পারে তথা মুত্তাক্বী হ’তে পারে।

রামাযানের সম্মানে এবং এমাসে যাতে সুষ্ঠুভাবে ছিয়াম পালন করা যায় সেজন্য স্বয়ং আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকেই গ্রহণ করা করা হয় এহেন প্রস্তুতি। কিন্তু যে মুসলমানের জন্য এ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় বিশ্বময় তারা কি এ মাসের সম্মানে ও এর আগমনে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে?

صوم শব্দটি আরবী। বহুবচ صيام এর আভিধানিক অর্থ امسك অর্থাৎ বিরত থাকা বা রাখা।৩ অনেক বৈধ কাজকর্ম থেকেও এ মাসে বিরত থাকতে হয়। যেমন দিবাভাগে পানাহার, স্ত্রী-সহবাস ইত্যাদি। আর অশ্লীলতা, ব্যাভিচার, মিথ্যাচার, মদ্যপান, সুদ, ঘুষ এগুলি চিরতরেই হারাম এবং থেকে সবসময়ই বিরত থাকতে হয়।

পরিপুর্ণ ছিয়াম পালনের জন্য যে মাসে অনেক হালাল কাজ থেকেই বিরত থাকতে হয়, সেই রামাযান মাসে অন্তত একটি মাসের জন্য হ’লেও হারাম থেকে বিরত থাকা বা না রাখার কোন সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। এছাড়া ছিয়ামের অস্তিত্বই কল্পণা করা যায় না। আর মূলত ঐ সমস্ত কাজগুলি থেকে বিরত থাকার নামই ছিয়াম।৪

রাষ্ট্রীয় অনুমোদন নিয়ে ৯০% মুসলমানের এদেশে ১২ মাস ব্যভিচার চলে। ছিয়াম রেখে যারা জাতির ভাগ্য নির্ধারণে সংসদে বসেন অন্তত একটি মাসের জন্য হ’লেও এই জঘন্য পাপাচার বন্ধ করার কিংবা এত্থেকে মানুষকে বিরত রাখার চিন্তা তাদের মাথায় আসে কি? এ মাসে কিছু কিছু রেস্তোরাঁ মালিক ইমানী তাকীদে দিনের বেলা তাদের রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখেন, তাদেরকে মোবারকবাদ জানাই। ঈমান রক্ষার খাতিরে তাদের এই নীতি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু মাহে রামাযানের শানকে বৃদ্ধাংগুলি প্রদর্শন করে যথারীতি প্রেক্ষাগৃহে চলে অশ্লীল পর্ণ ছবির প্রদর্শনী। নোংরা পোষ্টারে নারীর নগ্নদেহ ছিয়াম পালনকারী মুসলমানের সুচিশুভ্র ঈমানী অনুভূতিতে আঘাত হানে। সকল পাপাচারের জননী মদ্যপান থেকেও বিরত হয় না এ রামাযান মাসে। ধূমপান করে ছিয়াম পালনকারী মানুষের মুখের উপর অনেকে ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। রাষ্ট্রীয় আইনের অসহায়ত্বের কারণে এসবের প্রতিবাদ করাও বিপদজনক।

এ সমস্ত সমাজ ও রাস্ট্র দূষণ মুসলিম দেশের সরকারের ভাবনার কোন বিষয় নয় কি ? দেশের নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন কি ? অবশ্য রামাযান মাসে অসাধু-নির্লজ্জ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিভাষাগত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । ছিয়ামের সম্মানে তারা উৎকোচ চাইতে উৎকন্ঠা বোধ করে বলেন যে, দেখুন! রামাযান মাস একটু ইফতারীর ব্যবস্থা দিয়ে যাবেন । কি নৈতিক অবক্ষয় অথবা অজ্ঞতা । সারাদিনের কষ্টার্জিত ছিয়াম পালন করে হারাম দিয়ে ইফতার করতে চায় ।

ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, ব্যবিলনীয় যুগে ও পরে ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, প্রথম জেমস ও এলিজাবেথের যুগে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে সাওমের দিনগুলিতে মদ্য পান ও গোশত ভক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ।

অথচ আমাদের মুসলিম পার্লামেন্টিরিয়ানরা কি করছেন ? বিশেষ করে ‘আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার শ্লোগানধারী দলটিও কি আজ পর্যন্ত পার্লামেন্টে এ দাবিগুলি তুলে ধরতে পেরেছে ? অন্তত রামাযান মাসের জন্য কি কিছু করতে পেরেছে ?

রামাযান মাসের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর বান্দারা যদি রামাযানের মাহাত্ম বুঝত, তাহলে পুরো বছরটাই রামাযান হওয়ার আকাংখা করত’ ।এজন্যই মহান আল্লাহ বলছেন, ‘ছিয়াম সাধনা আমারই জন্য । আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব’।

এক্ষণে বিদগ্ধ পাঠকদেরকে একটি বিষয় ভাবতে অনুরোধ করি । তা হল যে ছাওমের এত মাহাত্ন তা কেন ২য় হিজরীর শা’বান মাসে মদীনাতে ফরয করা হল ? অর্থাৎ অহি নাযিলেরও অন্তত ১৫ বছর পরে । এর রহস্যটা কি ? আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীছটিতে এর সমাধান পাওয়া যায় ।

‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও অনুরূপ কার্য পরিত্যাগ করল না তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই’ ।

মক্কায় যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা চালু ছিল তাতে হাদীছে বর্ণিত অবস্থা থেকে পরিপূর্ণ বিরত হয়ে সিয়াম পালন সম্ভব ছিল না । হিজরতের পর যখন তিনি মদীনাকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে ও ঘোষণা দিতে সক্ষম হলেন, তখনই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ছওমের ফরযিয়াতের ঘোষণা আসল । আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ । ৯০% মুসলমানের এদেশে ইসলামের অবস্থা মক্কী জীবনের চাইতে ভিন্নতর কিছু কি ? এখানেও ইসলামী দল, দাওয়াত ও আন্দোলন আছে । কিন্তু দেশটাআ চলছে ঐ আবু জাহেলের উত্তরসূরী লর্ড ক্লাইভ আর তার প্রেতাত্নাদের তৈরি আইন দ্বারাই । ইসলামী সমাজ ও রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে আপনারা যারা ক্ষমতার ভাগিদার হলেন তাদের জন্য আফসোস ? ইসলামের জন্য তেমন কোন কার্যকর দাবীই আপ্নারা মহান সংসদে উঠাতে পারলেন না?

মাহে রামাযানের শানে মহান আল্লাহর প্রস্তুতি কর্মসূচীর সাথে একাত্ন হয়ে এদেশের সহীহ সুন্নাহর অনুসারী হিসেবে আমরাও কি কিছু করতে পারি না ? আমাদের চেতনার দুয়ারও কি সুপ্ত থেকে যাবে ?

‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল । আর তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এ বাণী বিস্মৃত হয়ে আমরাও কি আত্নকেন্দ্রিক হয়ে বসে থাকব? আসলে কুর’আন সুন্নাহর আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুগে যুগে আমাদের উত্তরসূরীদের তাজা খুনই আল্লাহর সবুজ ধরণীকে বার বার সিক্ত করেছে । সুতরাং বসে থাকলে চলবে না। আসুন মাহে রামাযানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি । দিবা ভাগে অবাধ পানাহার, মদ্যপান, ধূমপান, ব্যভিচার, মিথ্যাচার, পরচর্চা, সুদ, ঘুষ প্রভৃতির বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি করি । আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন ! আমীন !!

* উপাধ্যক্ষ, বানিয়াপাড়া কামিল মাদরাসা, জয়পুরহাট।

তথ্য সূত্র :

১, ইবনু মাজাহ, সনদ হাসান, মিশকাত হা ১৯৬৪ ‘সাওম’ অধ্যায়।

২, মুত্তাফাকুন আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৬ ‘সাওম’ অধ্যায়।

৩. আল-মুফরাদাতু ফী গারীবিল কুরআন ২/২৯৯ পৃঃ।

৪,তদেব, ৪/১০২ পৃঃ।

৫. জিউস ইনসাইক্লোপেডিয়া, ই,ই, ডাইজেস্ট ৫৯-৬২ পৃঃ ।

৬. ইবনু খুযায়মা ৩/১৯১ পৃঃ ।

৭. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৫৯ ‘সবর’ অধ্যায় ।

৮. বুখারী, মিশকাত হা/১৯৯৯ ।

৯. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৩০০ ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button