ঈদ-ই- মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম): একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ( শেষ পর্ব)

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

ঈদ-ই- মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম): একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ( শেষ পর্ব)

গ) প্রথম মীলাদ গ্রন্থ লেখক: ব্যক্তি ও জীবন:

মীলাদ অনুষ্ঠান প্রচলন করার ক্ষেত্রে আরেক ব্যক্তিত্বের অবদান আলোচনা না করলে সম্ভবত: আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি হলেন “মীলাদুন্নবী”র উপরে সর্বপ্রথম গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান, ইবনে দেহিয়া আল-কালবী (৬৩৩হি:), যার গ্রন্থ পরবর্তীতে “মীলাদ” কেন্দ্রীক অসংখ্য গ্রন্থ রচনার উৎস ছিল।

ইবনে দেহিয়া ৫৪৪ হিজরীতে (১১৫০খ্রী) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩৩হিজরীতে (১২৩৫খ্রী) মিশরে ইন্তেকাল করেন। প্রায় ৯০ বৎসরের জীবনে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ভ্রমন করেন। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন এবং ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানে তাঁর অবদান রাখেন। তবে লক্ষ্যনীয় যে ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তক হযরত কুকবুরী যেরূপ অধিাকাংশ ঐতিহাসিকের প্রশংসা লাভ করেছেন, ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রথম পুস্তক লেখক ইবনে দেহিয়া তদরূপ সমসাময়ীক বা পরবর্তী আলেম ও লেখকদের প্রশংসা অর্জন করতে পারেন নি। বরং সকল ঐতিহাসিক ও লেখক তাঁর কর্মময় জীবনের বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর কিছু কিছু আচরণ ও কর্মের সমালোচনা করেছেন। আমি এখানে তাঁর জীবনালেখ্য ও কর্মাবলীর আলোচনা করছি।

ইবনে দেহিয়া স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজেকে প্রখ্যাত সাহাবী দহিয়া কালবীর বংশধর বলে দাবী করতেন। তদুপরি তিনি মাতার দিক থেকে নিজেকে হযরত ইমাম হুসাইনের বংশধর বলে দাবী করতেন। তবে সমসাময়ীক ও পরবর্তী ঐতিহাসিকগণ তাঁর প্রদত্ত নসব নামাকে অবিশ্বাস্য ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন।”

বংশ বা নসবনামা নিয়ে যত মতবিরোধই থাক, সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ- যাদের মধ্যে অনেকে তাঁর ছাত্র ছিলেন- লিখেছেন যে, তিনি তিনি স্পেনে প্রাথমিক লেখাপড়া করেন। স্পেনের তৎকালীন প্রখ্যাত আলেমদের নিকট তিনি হাদীস, ফিকহ, আরবী ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে লেখাপড়া করেন এবং সনদ গ্রহণ করেন। তাঁর হস্তাক্ষর খুবই সুন্দর ছিল এবং তিনি আরবী ভাষায় ও আবরী ব্যাকারণে পারদর্শী ছিলেন। মালেকী মযহাবের একজন অভিজ্ঞ ফিকাহবিদ ছিলেন। পরবতীতে তিনি মযহাব ত্যাগ করেন এবং মযহাব বিরোধী যাহেরী মত অবলম্বন করেন। হাদীস শাস্ত্রে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন। হাদীস শিক্ষা ও চর্চায় তাঁর আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশী। তিনি স্পেনের “দানিয়া” শহরের বিচারক (কাজী) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হলে তিনি বিচারকের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পান। এরপর তিনি কিছুদিন উত্তর আফ্রিকায় মরক্কো ও তিউনিসিয়ায় অবস্থান করেন। ৫৯৫ হি: (১১৯৯খ্রী:) তিনি তিউনিসিয়ায় হাদীস শেখাতেন বলে যানা যায়। এরপর তিনি হজ্জ আদায় করেন। হজ্জ পালনের পরে তিনি মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলের প্রধান শহর সমূহ সফর করেন। তিনি মিশর, সিরিয়া, ইরাক, ইস্পাহান, ইত্যাদি সকল অঞ্চল সফর করেন। তাঁর জ্ঞানার্জনের আগ্রহ এতই প্রবল ছিল যে, এ সময়ে তিনি একজন অভিজ্ঞ আলেম হিসাবে গণ্য হওয়া সত্বেও মরোক্কো, তিউনিসিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ইস্পাহান, বিভিন্ন দেশে সফর কালে এ সকল অঞ্চলে অবস্থানকারী প্রখ্যাত আলেমদের নিকট থেকে হাদীস, ফিকহ ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। পাশাপশি তিনি এসকল এলাকায় বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করেন।

হজ্জ পরবর্তী সফরের সময়েই ৬০৪ হিজরী সালে (১২০৭খ্রী:) তিনি ইরবীল শহরে আগমন করেন। তিনি দেখতে পান যে, সেখানকার শাসক কুকবুরী মহা সমারোহে রবিউল আউয়াল মাসে “ঈদে মীলাদুন্নবী” উৎসব উদাপনের প্রচলন করেছেন। তখন তিনি বাদশাহ কুকবুরীর প্রেরণায়  “আত-তানবীর ফী মাওলিদিল সিরাজিল মুনীর” নামে মীলাদুন্নবীর উপর একটি গ্রন্থ রচনা করে কুকবুরীকে প্রদান করেন, যে গ্রন্থটি মীলাদুন্নবীর উপর লিখিত প্রথম গ্রন্থ। মীলাদের উপরে লিখিত গ্রন্থের জন্য কুকবুরী তাকে একহাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) পুরস্কার প্রদান করেন।

মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন দেশ সফর শেষে তিনি মিসরে আসেন এবং সেখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। এ সময়ে মিশরের বাদশাহ ও মুসলিম বিশ্বের প্রধান শাসক ছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইঊবীর ভাই বাদশাহ “আল-মালিক আল-আদিল” সাইফুদ্দীন আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে নাজমুদ্দীন আইঊব (শাসন কাল: ৫৯৭-৬১৫হি:/ ১২০০-১২১৮খ্রী:) তিনি ইবনে দেহিয়াকে তাঁর পুত্র যুবরাজ নাসিরুদ্দীন আবুল মায়ালী মুহাম্মাদ (আল-কামিল) এর গৃহশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দান করেন। ৬১৫হিজরীতে (১২১৮খ্রী:) আল-আদিল-এর মৃত্যু হলে যুবরাজ নাসিরুদ্দীন আবুল মায়ালী মুহাম্মাদ “আল-মালিক আল-কামিল” উপাধি গ্রহণ করে মিসরের সিংহাসনে আরহন করেন। রাজত্বকাল: ৬১৫-৬৩৫হি: (১২১৮-১২৩৮খ্রী:) তাঁর রাজত্ব তাঁর শিক্ষক ইবনে দেহিয়ার জীবনে নিয়ে আসে বিপুল গৈারব। বাদশাহ কামিল তাঁর শিক্ষক ইবনে দেহিয়াকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। তিনি তাঁকে প্রভুত মর্যাদা ও সম্পত্তি দান করেন। এছাড়া তিনি কায়রোতে “দারুল হাদীস আল-কামেলীয়া” নামে একটি হাদীস শিক্ষার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইবনে দেহিয়াকে এর প্রথম প্রধান নিযুক্ত করেন। বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পরে তিনি বিভিন্ন কারণে বাদশাহের বিরাগভাজন হন। বাদশাহ তাঁকে চাকুরীচ্যুত করেন। বাদশাহের শাস্তির ভয়ে তিনি  পালিয়ে যান এবং আত্মগোপন করেন।

বাদশাহ কামিলের বিরাগের কারণ কি ছিল? এখানে আমরা জানতে পারি ইবনে দেহিয়ার গৌরবময় জীবনের অন্য দিকটি। তাঁর জ্ঞানস্পৃহা, জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ, বিভিন্ন ইসলামী জ্ঞানে তাঁর বিপুল পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও সমসাময়িক আলেমগণ দুইটি কারনে তাঁর প্রতি বিরাগ ছিলেন:

১ম কারণ হলো পূর্ববতী আলেম ও ইমামগণের ব্যাপারে তাঁর অমার্জিত ব্যবহার ও কুটুক্তি। তাঁর সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবনে নাজ্জার (৬৪৩হি:) লিখছেন: “তিনি যাহেরী মযহাব অবলম্বন করতেন, (চার মাজহাবের কোন মাজহাব মানতেন না, মযহাব মানার বিরোধিতা করতেন), সালফে সালেহীনদের সম্পর্কে  (সাহাবী, তাবেয়ী ও পূর্বযুগের আলেমদের) ও পূর্ব বর্তী ইমামদের সম্পর্কে  খুব বেশী কুটুক্তি ও অবমাননাকর কথা বলতেন। বড় জ্ঞানী হওয়া সত্তেও তিনি ছিলেন অত্যন্ন অহংকারী। তাঁর কথাবার্তা ছিল নোংরা ও কুরুচীপূর্ণ। ধর্মপালনে তিনি অবহেলা করতেন। তিনি তাঁর দাড়ী কাল রঙে খেজাব করতেন।”

আল্লামা জিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহেদ আল-মাকদেসী (৫৬৯-৬৪৩হি:) বলেছেন: “আমি ইস্পাহানে তাকে দেখেছি। তবে তাঁর থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করিনি। কারণ তাঁর অবস্থা আমার ভাল লাগেনি। তিনি ইমামদের খুবই নিন্দামন্দ করতেন।”  আল্লামা যাহাবী লিখেছেন: “তিনি বিভিন্ন ইসলামী শাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, আরবী ভাষা ও হাদীস শাস্ত্রে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তবে তিনি হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে জয়ীফ বা দূর্বল ছিলেন।”  তাঁর এই স্বভাবের কারণে তিনি যখন মরক্বো ও তিউনিসিয়া অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন তখন সে দেশের আলেমগণ একত্রে তার বিরুদ্ধে, তাঁকে অগ্রহণযোগ্র ঘোষনা দিয়ে একটি ঘোষণাপত্র লিখেন।

দ্বিতীয় বিষয় ছিল তিনি নিজের ব্যক্তি গৌরব, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সম্পর্কে এমন কিছু দাবী করতেন যা সে যুগের আলেমগণ মিথ্যা বলে বিশ্বাস করতেন। তাঁর বংশ সম্পর্কে আগেই উল্লেখ করেছি। সমসাময়িক ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল গনী, ইবনে নুকতা (৬২৯হি:) লিখেছেন: “তিনি বড় জ্ঞানী ও মর্যাদার অধিকারী হিসাবে সমাজে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের বিষয়ে এমন অনেক বিষয় দাবী করতেন যা ছিল একেবারেই অবাস্তব। তিনি দাবী করতেন যে, সহীহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিযী  তাঁর মুখস্ত রয়েছে। একজন ছাত্র পরীক্ষামূলক ভাবে সহীহ মুসলিমের কয়েকটি হাদীস, সুনানে তিরমিযীর কয়েকটি হাদীস ও কয়েকটি বানোয়াট বা মাওযু হাদীস একত্রে লিখে তাঁকে দেন। তিনি হাদীসগুলো পৃথক করতে বা কোনটি কোন কিতাবের হাদীস তা জানতে পারেন নি।”  আল্লামা যাহাবী বলেন: “তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে সহীহ ও জয়ীফ বর্ণনার ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা খুবই আপত্তিকর।”

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২হি:) ঐতিহাসিক ইবনে নাজ্জার (৬৪৩হি:) থেকে বর্ণনা করেছেন: “আমরা দেখেছি, সকল মানুষ একমত ছিলেন যে, ইবনে দেহিয়া মিথ্যা কথা বলেন এবং বিভিন্ন অসত্য দাবী করেন।”

ইবনে হাজার আসকালানী অন্য এক বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন: “তাঁর সমসাময়িক এক আলেম বলেন: একদিন আমি সুলতানের দরবারে ছিলাম, যেখানে ইবনে দেহিয়াও ছিলেন। সুলতান আমাকে একটি হাদীস জিজ্ঞাসা করলে আমি হাদীসটি বলি। তখন তিনি আমাকে হাদীসটির সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তখন হাদীসটির সনদ মনে করতে পারি না এবং আমার অপারগতা জানাই। পরে আমি দরবার ত্যাগ করলে ইবনে দেহিয়া আমার সাথে আসেন এবং বলেন: যখন সুলতান আপনাকে সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন তখন যে কোন একটি বানোয়াট সনদ বলে দিলে আপনার কি ক্ষতি হতো? সুলতান ও তার দরবারের সবাই জাহেল, তারা কিছুই বুঝতে পারত না। তাতে আপনাকে ‘জানি না’ বলতে হতো না এবং উপস্থিত সভাসদদের কাছে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। উক্ত আলেম বলেন: ইবনে দেহিয়ার এই কথায় আমি বুঝতে পারলাম তিনি মিথ্যা বলতে পরোয়া করেন না।”

ইবনে হাজার আসকালানী অন্য একজন সমসাময়িক আলেমের উদ্ধিৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন: “ইবনে দেহিয়া যখন ইস্পাহানে আসলেন তখন আমার পিতার খানকায় আসতেন। আমার আব্বা তাকে খুবই সম্মান করতেন। একদিন তিনি আমার আব্বার কাছে একটি জায়নামাজ নিয়ে আসেন  এবং জায়নামাজটি তার সামনে রেখে বলেন: এই জায়নামাজে আমি এত এত হাজার রাকাত নামায আদায় করেছি এবং আমি কা’বা শরীফের মধ্যে এই জায়নামাজে বসে কয়েকবার কুরআন করীম খতম করেছি। আমার আব্বা খুবই খুশী হয়ে জায়নামাজটি গ্রহণ করেন এবং মাথায় রাখেন ও চুমু খেতে থাকেন। তিনি এই হাদীয়া পেয়ে খুবই খুশি হন। এ দিকে কাকতালীয় ভাবে সন্ধ্যার দিকে একজন স্পাহানী স্থানীয় ব্যক্তি আমাদের কাছে আসেন। তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেন: আপনাদের খানকায় যে মরোক্কীয় আলেম আসেন তাকে দেখলাম বাজার থেকে অনেক দামে একটি খুব সুন্দর জায়নামাজ কিনলেন। তখন আমার আব্বা (একটু খটকা লাগায়) ইবনে দেহিয়ার প্রদত্ত জায়নামাজটি আনতে বলেন। জায়নামাজটি দেখে ঐ ব্যক্তি কসম করে বলে যে, সে এই জায়নামাজটিই কিনতে দেখেছে ইবনে দেহিয়াকে। এতে আমার আব্বা চুপ হয়ে যান এবং আমাদের মন থেকে ইবনে দেহিয়ার প্রতি সকল সম্মান চলে যায়।”

আল্লামা ইবনে কাসীর (৭৭৪ হি:) লিখেছেন: “ইবনে দেহিয়া সম্পর্কে অনেকে অনেক কিছু বলেছেন। বলা হয় তিনি মাগরীবের নামায কসর করার বিষয়ে একটি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলেছেন। আমার ইচ্ছা ছিল হাদীসটির সনদ দেখব, কারণ সকল মুসলিম আলেম একমত যে, মাগরীবের নামায কসর হয় না… আল্লাহ আমাদেরকে এবং তাঁকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন।”

ইবনে দেহিয়ার মিথ্যাচার সম্পর্কে একটি বিবরণ প্রদান করেছেন সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (৬৮১ হি:) ইবনে দেহিয়ার প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল বলে তাঁর লেখা থেকে প্রতিয়মান হয়। তাঁর লেখা মীলাদের বইটি তিনি ৬২৫ হিজরীতে কুকবুরীর দরবারে বসে পড়তে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করতেন।  কিন্তু  তিনি আশ্চার্য্য হন যে, উক্ত বইয়ের শেষে ইবনে দেহিয়া একটি বড় আরবী কসীদা লিখেছেন কুকবূরীর প্রশংসায়। তিনি দাবী করেছেন যে, কসীদাটি তিনি নিজে লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ইবনে খাল্লিাকান জানতে পারেন যে, কবিতাটি সিরিয়ার হালাবশহরের বাসিন্দা কবি আসআদ বিন মামাতী (মৃত্যু ৬০৬হি:) লেখা ও তাঁর কাব্য গ্রন্থে সংকলিত, তিনি উক্ত কসীদা দ্বার তৎকালীন অন্য একজন শাসকের প্রশংসা করেন।

এ সকল কারণে তৎকালীণ আলেমগণ বাদশাহ কামিলের নিকট ইবনে দেহিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তৎকালীন বহুল প্রচলিত উপদেশ মূলক “আশ শিহাব” গ্রন্থের উপর টীকা লিখতে অনুরোধ করেন। ইবনে দেহিয়া একটি টীকা গ্রন্থ রচনা করেন যাতে তিনি উক্ত্র গ্রন্থে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস ও তার সনদের উপর আলোচনা করেন। বাদশাহ তা পাঠ করেন। কিছুদিন পরে তিনি বলেন যে, আগের টীকাগুলি হারিয়ে গিয়েছে, পুনরায় একটি টীকাগ্রন্থ লিখে দিন। ইবনে দেহিয়া আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন যাতে তিনি আগের মত আলোচনা করেন। কিন্তু প্রথমবারের ও দ্বিতীয়বারের আলোচনা, মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত ছিল পরস্পর বিরোধী। এতে বাদশাহ অভিযোগকারী আলেমদের সাথে একমত হন যে, ইবনে দেহিয়া মন মর্জিমত কথা বলেন এবং বানোয়াট বিভিন্ন দাবী করেন। এরপর তিনি তাঁকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া তাঁর অন্য কিছু কাজেও তিনি অসন্তুষ্ট হন বলে জানা যায়।

কর্মময় সুদীর্ঘ প্রায় ৯০ বৎসরের জীবনে শেষে “মীলাদুন্নবী”র প্রথম গ্রন্থ লেখক হযরত আল্লামা ইবনে দাহিয়া ৬৩৩ হিজরীর ১৪ই রবিউল আউআল (২৬/১১/১২৩৫খ্রী:) তিনি ইন্তেকাল করেন।

সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমরা বলতে পারি যে,  ইবনে দেহিয়া যে যগের একজন অন্যতন আলেম ছিলেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল এবং তিনি অনেক বই পুস্তক লিখেছেন। সমসাময়িক একজন ঐতিহাসিক তাঁর লেখা গ্রন্থসমূহের প্রশংসা করে লিখেছেন: “তিনি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন এবং অনেক সফর করেছেন। উন্নত মানের অনেক গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। সাধারণ মানুষ এবং সমাজের উচুঁ স্তরের মানুষ সবার কাছেই তিনি সম্মান পেতেন।”

তবে নি:সন্দেহে যে গ্রন্থটি তাকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে তা হলো “মীলাদুন্নবী” বা রাসূলে আকরামরে জন্মবিষয়ে লেখা তার বই  “আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর আন-নাযির” কারণ এটিই ছিল “মীলাদুন্নবী” বা রাসূলে আকরামরে জন্মবিষয়ে লেখা প্রথম বই। ইবনে খাল্লিকানের বর্ণনা অনুসারে আমরা দেখতে পাই, ইবনে দেহিয়া ৬০৪ হিজরীতে ইরবিলে প্রবেশ করেন। তিনি বছর দুয়েক সেখানে বাদশাহ কূকুবূরীর রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসাবে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি এই বইটি সংকলন করেন। ৬০৬ হিজরীতে তিনি এই বইটি লেখা সমাপ্ত হলে তা কূকুবূরীকে পড়ে শোনান।

এখানে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে,  মহান নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ বা তৎপরবর্তী মুসলিম সমাজের আলেমগণ ৬০০ বৎসর যাবৎ তাঁর জন্মকে কেন্দ্র করে কি একটি বইও লিখেন নি? যার ফলে এই কৃতিত্ব ইবনে দেহিয়া পেলেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে সেই যুগ গুলির অবস্থা বুঝতে হবে। প্রথম যুগের মুসলিম গণ, সাহাবী ও তাবেয়ী গণের সাবক্ষণিক কর্ম ও ব্যস্ততা ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে। তাঁদের সকল আবেগ, ভালবাসা ও ভক্তি দিয়ে তাঁরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ও কর্ম জানতে, বুঝতে, শেখাতে ও লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাদের কর্মকাণ্ডের যে বর্ণনা হাদীস শরীফে ও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং তাদের যুগে লিখিত ও সংকলিত যে সকল বই পুস্তকের বর্ণনা আমরা পাই বা যে সকল বই পুস্তক বর্তমান যুগ পর্যন্ত টিকে আছে তার আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা মূলত: রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ম, চরিত্র, ব্যবহার, আকৃতি, প্রকৃতি, জীবনপদ্ধতি জানতে বুঝতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁর জীবনী সংকলনের দিকে যে যুগের মুসলিমেদের মনোযোগ দেখা যায় না। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও তাঁর প্রবর্তিত বিধানাবলীর দিকটায় তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁর জীবনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, বা জীবনী রচনার দিকে তারা গুরুত্ব প্রদান করেন নি। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবীগণের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন, জন্ম তারিখ বা জন্মমাস নিয়ে কোন আলোচনাই পাওয়া যায় না। স্বভাবত:ই তাঁর জন্ম কেন্দ্রীক কোন গ্রন্থও তখন রচিত হয়নি। প্রথম তিন শতাব্দীতে রচিত হাদীস গ্রন্থ সমূহে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম সংক্রান্ত যৎসামান্য কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা আগে আলোচনা করেছি। এছাড়া প্রথম শতাব্দীর শেষ থেকে সীরাতুন্নাবী বা নবী জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ লেখা হতে থাকে বলে মনে হয়। তবে এ যুগে মূলত: সীরাতুন্নাবীর মাগাযী বা যুদ্ধবিগ্রহ বিষয়ক বিষয়েই বিশেষভাবে লিখা হত।  দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের উল্লেখ যোগ্য সীরাতুন্নবী গ্রন্থ হল মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (মৃত্যু ১৫১হি:/৭৬৮খ্রী:), আব্দুল মালেক ইবনে হিশাম (মৃত্যু ২১৮হি:/৮৩৪খ্রী:), মুহাম্মাদ ইবনে সা’দ (২৩০হি:/৮৪৫খ্রী:) প্রমুখের লিখা “সীরাতুন্নবী গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। এ সকল গ্রন্থে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মসংক্রান্ত কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া ৩য় হিজরী শতক থেকে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ লিখিত সকল ইতিহাস গ্রন্থে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মসংক্রান্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন খলীফা ইবনে খাইয়াত আল-শাব আল উসফূরী (২৪০হি:/৮৫৪খ্রী:), আহমদ ইবনে ইয়হইয়া আল বালাযুরী (২৭৯হি:/৮৯২খ্রী:), আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে জরীর (৩১০হি:/৯২৩খ্রী:) ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ। ৫ম হি: শতক থেকে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতৃক সংঘঠিত মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনাবলী পৃথক ভাবে সংকলিত করে “দালাইলুন নুবুওয়াত” নামে কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়, যেমন আবু নুয়াইম আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আসফাহানী (৪৩০হি:/১০৩৯খ্রী:) ও আবু বকর আহমদ ইবনে হুসাইন আল- বাইহাকী (৪৫৮হি:/১০৬৬খ্রী:) সংকলিত “দালাইলুন নুবুওয়াত” গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম কালীন অলৌকিক ঘটনাবলীর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। সর্বাবস্থায় আমরা দেখতে পাই যে, রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মকে নিয়ে পৃথক গ্রন্থ কেউই রচনা করেন নি। বস্তুত: তাঁর জন্ম উদযাপন যেমন ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে মুসলিম উম্মাহর অজানা ছিল, তেমনি তাঁর জন্ম বা “মীলাদ” নিয়ে পৃথক গ্রন্থও ৬ষ্ঠ শতাব্দীর আগে কেউ রচনা করেন নি। তাই এই কৃতিত্ব পেলেন ইবনে দেহিয়া।

তাঁর লেখা অন্যান্য বইয়ের কথা ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে ইসলামী গ্রন্থাগার থেকে, কারণ ঐ ধরণের আরো অগণিত বই অন্য আরো অনেক আলেম লিখেছন। কিন্তু মীলাদের গ্রন্থটির কথা ঐতিহাসিকগণ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সমসাময়িক অনেক আলেম ও ঐতিহাসিক বইটি পড়তে পেরে আনন্দিদ ও উপকৃত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (৬৮১হি:) লিখেছেন: “তিনি প্রখ্যাত আলেমদের ও বিখ্যাত মর্যাদাশীল মানুষদের একজন ছিলেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অধিকার ছিল। … তাঁর লিখিত মীলাদের গ্রন্থটি ৬২৫হিজরীতে আমরা ইরবীলের বাদশা কুকবুরীর দরবারে ৬ মাজলিসে শ্রবণ করেছিলাম।”  ৮ম হিজরী শতাব্দীর মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর (৭৭৪হি:) লিখেছেন: “মীলাদের উক্ত গ্রন্থ আমি পড়েছি এবং তা থেকে কিছু সুন্দর ও প্রয়োজনীয় বিষয় আমি লিখে নিয়েছি।”

ঘ) ঈদে মীলাদুন্নবী: অনুষ্ঠান পরিচিতি:

পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা মীলাদ প্রবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সাথে পরিচিত হয়েছি। এখন আমরা দেখতে চাই কিভাবে তাঁরা মীলাদুন্নবী পালন করতেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খাল্লিকান কূকুবূরীরর মীলাদ অনুষ্ঠানের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি এই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন:

কূকুবূরীর মীলাদুন্নবী উদযাপনের বর্ণনা দিতে গেলে ভাষা অপারগ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশের মানুষেরা যখন এ বিষয়ে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টার কথা জানতে পারেন তখন পার্শবর্তী সকল এলাকা থেকে লোকজন এসে এতে অংশ নিতে থাকে। বাগদাদ, মাউসিল, জাযিরা, সিনজার, নিস্সিবীন, পারস্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক আলেম, কারী, সূফী, বক্তা, ওয়ায়েজ, কবি এসে জমায়েত হতেন। মুহররম মাস থেকেই এদের আগমন শুরু হত, রবিউল আউয়ালের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আগমন অব্যাহত থাকত। খোলা প্রান্তরে ২০টি বা তারো বেশী বিশাল বিশাল কাঠের কাঠামো (প্যাণ্ডেল) তৈরী করা হতো যার একটি তাঁর নিজের জন্য নির্ধরিত থাকত, বাকীগুলিতে তার আমীর ওমরাহ, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণের জন্য নিধারিত হতো। সফর মাসের ১ তারিখ থেকে এ সকল কাঠামোগুলিকে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হতো। প্রত্যেক প্যাণ্ডেলের প্রতিটি অংশে থাকত গায়কদের দল, অভিনয়কারীদের দল এবং বিভিন্ন খেলাধুলা দেখানর দল। এ সময়ে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যেত। সকলের একমাত্র কাজ হয়ে যেত এ সকল প্যাণ্ডেলে ঘুরে বেড়ান এবং আনন্দ উল্লাস করা। প্রতিদিন আসরের নামাজের পরে কূকুবূরী মাঠে আসতেন এবং  প্রতিটি প্যাণ্ডেলে যেয়ে তাদের গান শুনতেন, খেলা-অভিনয় দেখতেন। পরে সূফীদের খানকায় রাত কাটাতেন এবং সামা সঙ্গীতের আয়োজন করতেন। ফজরের নামাজের পরে শিকারে বের হতেন। যোহরের পূর্বে ফিরে আসতেন।

এভাবেই চলত ঈদে মীলাদুন্নবীর রাত পর্যন্ত। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মতারিখ নিয়ে মতবিরোধ থাকার কারণে তিনি একবছর ৮ই রবিউল আউয়াল, অন্য বছর ১২ই রবিউল আউয়াল ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করতেন। এই দিনে ২দিন আগেই অগণিত উট, গুরু ও ছাগল-ভেড়া মাঠে পাঠিয়ে দিতেন। তবলা বাজিয়ে, গান গেয়ে, আনন্দ উৎফুল্লাতর মাধ্যমে এ সকল জীব জানোয়ারকে মাঠে পৌছান হত। সেখানে এগুলিকে জবাই করে রান্নর আয়োজন করা হতো।

মীলাদের রাত্রে মাগরীবের নামাজের পরে সামা গান বাজনার আয়োজন করা হতো। এরপর পুরো এলাকা আলোকসজ্জার অগণিত মোমবাতিতে ভরে যেত। মীলাদের দিন সকালে তিনি তাঁর দুর্গ থেকে বিপুল পরিমাণ হাদিয় তোহফা এনে সূফীদের খানকায় রাখতেন। সেখানে রাষ্ট্রের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ ও সমাজের সাধারণ অনেক মানুষ সমবেত হতেন। ওয়ায়েজগণের জন্য মঞ্চ তৈরী করা হতো। একদিকে সমবেত মানুষদের জন্য ওয়াজ নসীহত চলত। অপরদিকে বিশাল    প্রান্তরে তার সৈন্যবাহিনী কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করতে থাকত।কূকুবূরী দুর্গে বসে একবার ওয়ায়েজদের দেখতেন, একবার সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখতেন। এ সময়ে তিনি সমবেত সকল আলেম, গণ্যমান্য ব্যক্তি, বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মেহমানকে একে একে ডাকতেন এবং তাদেরকে মূল্যবান হাদিয়া তোহফা প্রদান করতেন। এরপর ময়দানে সাধারণ মানুষদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হতো, যেখানে বিভিন্ন রকমের খাদ্যের আয়োজন থাকত। খানকার মধ্যেও পৃথকভাবে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হতো।

এভাবে আসর পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া চলত। রাতে তিনি সেখানেই থাকতেন। সকাল পর্যন্ত সামা গানবাজনার অনুষ্ঠান চলত। প্রতি বৎসর তিনি এভাবে মীলাদ পালন করতেন। অনুষ্ঠান শেষে যখন সবাই বাড়ীর পথে যাত্রা করতেন তিনি প্রত্যেককে পথখরচা প্রদান করতেন।

আরেকজন সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইউসূফ বিন কাযউগলী সিবত ইবনুল জাওযী (মৃত্যু: ৬৫৪হি: ১২৫৬খ্রী:) লিখছেন: “তিনি ফজর থেকে জোহর পর্যন্ত সূফীদের জন্য “সামা” (ভক্তিমূলক গান) এর আয়োজন করতেন এবং নিজে সূফীদের সাথে (সামা শুনে) নাচতেন।”  তিনি আরো লিখেছেন: “কুকবূরীর ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে আয়োজিত দাওয়াতে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের একজন বলেন: তার দস্তরখানে থাকত পাঁচশত আস্ত দুম্বার রোস্ট, দশ হাজার মুরগী, একলক্ষ খাবারের পাত্র, ত্রিশহাজার মিষ্টির খাঞ্চা। তাঁর দাওয়াতে উপস্থিত হতেন সমাজের গণ্যমান্য আলেমগণ এবং সূফীগণ, তিনি তাঁদেরকে মুক্তহস্তে হাদিয়া ও উপঢৌকন প্রদান করতেন। তিনি ফজর থেকে জোহর পর্যন্ত সূফীদের জন্য “সামা” (ভক্তিমূলক গান) এর আয়োজন করতেন এবং নিজে সূফীদের সাথে (সামা শুনে) নাচতেন।”  অন্য এক বর্ণনাকারী বলেন: “তাঁর খানার মাজলিসে আমি একশত ভুনা ঘোড়া, পাঁচশত ভেড়া, দশহাজাজ মুরগী, একলক্ষ খাবারের পাত্র ও ত্রিশহাজার মিষ্টির খাঞ্চা গুনেছি।”

আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, এই যুগ ছিল মুসলিম উম্মার জন্য অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল যুগ। আভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহ, অশান্তি ও বহির্শত্র“র আক্রমনে বিপর্যস্ত মুসলিম জনপদগুলিতে কূকুবূরীর মীলাদ উৎসব অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেত। বিপর্যস্ত ও মানসিক ভাবে উৎকণ্ঠিত বিভিন্ন মুসলিম দেশের মানুষেরা এই অনষ্ঠানের মধ্যে প্রেরণা খুঁজে পান। ফলে দ্রুত তা অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমরা উপসংহারে এ বিষয়ে আলোচনা করব। তার আগে আসুন ১ম ও ২য় পর্যায়ের মীলাদুন্নবী উদযাপনের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করে সে যুগের মীলাদ উৎসবের মৌলিক দিকগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করি।

ঙ) ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন: ২ পর্যায়ের তুলনা:

আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, কায়রোর ফাতেমী ইসমাঈলী শিয়া শাসকগণ যখন সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের শুরু করেন তখন তাদের অনুষ্ঠান ছিল রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড বা প্রটোকলের অংশ। এ অনুষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় কায়দায় পালন করা হতো। অনুষ্ঠানের মূল দিকগুলি ছিল:

১) অনুষ্ঠান ছিল বাৎসরিক, প্রতি বৎসর ১২ ই রবিউল আউয়াল এই অনুষ্ঠান করা হতো।

২) অনুষ্ঠান ছিল শুধমাত্র এক দিনের। দিনের কিছু অংশে এই অনুষ্ঠান পালন করা হতো।

৩) অনুষ্ঠান একান্তভাবেই কায়রোর মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

৪) রাষ্টের গণ্যমান্য, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও ইচ্ছুক সাধারণ নাগরিক সমবেত হয়ে খলীফাকে এ উপলক্ষে সালাম প্রদান করতেন

৫) কুরআন তিলাওয়াত করা হতো।

৬) রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদেরকে বিশেষ সম্মান ও উপঢৌকন প্রদান।

৭) বতৃতা প্রদান। বিভিন্ন মসজিদের খতিব, রাষ্ট্রীয় কর্মকতাগণ, প্রচারকগণ এ উপলক্ষে বক্তৃতা প্রদান করতেন।

৮) মুক্ত হস্তে দান করা। এ উপলক্ষে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের মধ্যে মুক্ত হস্তে মিষ্টি, খাবার, অর্থ ও পোষাক পরিচ্ছদ বিতরণ করা হতো।

প্রত্যক্ষদশী ঐতিহাসিদদের বর্ণনা আলোকে কূকুবূরীর মীলাদ অনুষ্ঠানের বিবরণ আগেই লিখেছি। উক্ত বিবরণের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে,কূকুবূরীর মীলাদ অনুষ্ঠানের মূল দিকগুলি নিুরূপ:

১) অনুষ্ঠান ছিল বাৎসরিক, কিন্তু সব বৎসর একই দিনে পালন করা হতো না। কোন বছর ৮ তারিখে কোন বছর  ১২ তারিখে অনুষ্ঠান করা হতো।

২ মূল অনুষ্ঠানের আগে প্রায় দেড় মাস উৎসব পালন করা হতো।

৩) অনুষ্ঠানটি গণ উৎসবের রূপ গ্রহণ করে। শুধু ইরবিলের জনগণই নয়, পার্শবর্তী সকল মুসলিম জনপদের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করত।

৪)  খোলা প্রান্তরে গণ জমায়েত ও গণ উৎসবের আয়োজন করা হতো।

৫)  উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল খেলাধুলা, গান, ইত্যাদি আনন্দ উৎসব

৬)  মীলাদ উদযাপনের মূল কর্মই ছিল খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা।

৭) হাদিয়া তোহফা বিতরণ। মীলাদের আনন্দ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো হাদীয়া তোহফা বিতরণ করা।

৮) ওয়াজ নসিহতের আয়োজন।

৯) সেনা বাহিনীর কুচকাওয়াজ

১০) সামা ভক্তিমূলক গানবাজনার আয়োজন। মূল মীলাদ অনুষ্ঠান ৭ বা ১১ই রবিউল আউয়াল দিবাগত রাতের শুরুতে সামা সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু করা হত। আর পরদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরে ৮ বা ১১ ই রবিউল আউয়াল দিবাগত রাতে সারারাত এ ধরণের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটত। সাধারণত: এ সকল সঙ্গীতানুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ভাবাবেগে আপ্লুত শ্রোতার গানের তালে তালে নাচতেন। একে ওজদ বলা হতো।

উভয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের তুলনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠান মূলত: ছিল  কিছু ধর্মীয় কাজ ও কিছু আনন্দ উৎসব ধরণের কাজের সমষ্টি: একদিকে এতে কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ নসিহত , অর্থদান ও উপহার বিতরণ করা হতো। অপর দিকে মিষ্টি খাওয়া, ঘরবাড়ী সাজান, খেলাধুলা ইত্যাদি উৎসব মূলক কর্মের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করা হতো। খাওয়াদাওয়া ও হাদীয়া বিতরণ সকল পর্যায়ে এই উৎসবের মূল বিষয় ছিল। কূকুবূরীর অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল সামা সঙ্গীতানুষ্ঠান, যা ৪র্থ ও ৫ম শতকের মিশরীয় শিয়াদের মীলাদ অনুষ্ঠানে অপরিচিত ছিল। আমি ইতিপূর্বে এর প্রেক্ষাপট আলোচনা করেছি।

উপসংহার:

এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, মিশরের ইসমাঈলীয় শাসকগণ দ্বারা প্রবর্তিত হলেও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনকে সমস্ত মুসলিম বিশ্বে অন্যতম উৎসবে পরিণত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান ইবরিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরীর। তাঁকেই আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানের প্রকৃত প্রবর্তক বলে মনে করতে পারি। এর অন্যতম প্রমান হলো ৪র্থ হিজরী শতকে মিশরে এই উদযাপন শুরু হলে তার কোন প্রভাব বাইরের মুসলিম সমাজগুলোতে পড়ে নি। এমনকি পরবতী ২০০ বৎসরের মধ্যেও আমরা মুসলিম বিশ্বের অন্য কোথাও এই উৎসব পালন করতে দেখতে পাই না। অথচ ৭ম হিজরী শতকের শুরুতে কুকবূরী ইরবিলে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করলে তা তৎকালীন মুসলিম সমাজগুলিতে সাড়া জাগায়। তাঁর অনুষ্ঠানে তার রাজ্যের বাইরের দূরবর্তী অঞ্চল থেকেও মুসলমানেরা এসে যোগদান করতেন। অপরদিকে পরবর্তী ২০০ বৎসরের মধ্যে এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম সমাজে অনেক মানুষ ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করতে শুরু করেন।

যে সকল কর্ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের যুগে ধর্মীয় কর্ম, আচার বা উৎসব হিসাবে প্রচলিত, পরিচিত বা আচরিত ছিল না, পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় কর্ম হিসাবে প্রচলিত হয়েছে সে সকল কর্মের বিষয়ে সর্বদায় মুসলিম উম্মাহর আলেম ও পণ্ডিতগণ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েন। অনেক আলেম ধর্মীয় কর্ম ও ধার্মিকতার ক্ষেত্রে প্রথম যুগের মুসলমানদেরকে চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মনে করেন। তাঁরা ইসলামী সমাজের ধর্মকর্ম ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদি অবিকল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ও তাঁর সাহাবীদের যুগের মত রাখতে চান। যে কর্ম প্রথম যুগের ধার্মিক মানুষেরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য করেন নি, এদের মতে  সেকাজ কখনো পরবর্তী যুগের মুসলিমদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হতে পারে না। অপর দিকে অন্যশ্রেণীর আলেমগণ কেবলমাত্র প্রথম যুগে ছিল না বলেই কোন কর্ম বা অনুষ্ঠানকে নিষিদ্ধ বলে মনে করেন না। বরং নতুন প্রচলন বা প্রচলিত কর্ম বা অনুষ্ঠানের পক্ষে যুক্তি প্রমানাদি সন্ধান করেন এবং সম্ভব হলে সমাজের প্রচলনকে মেনে নেন।

যেহেতু মিশরের শাসকগণ ও পরবর্তীকালে হযরত আবু সাঈদ কূকবুরী প্রবর্তিত ঈদে মীলাদুন্নবী জাতীয় কোন অনুষ্ঠান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের যুগে প্রচলিত বা পরিচিত ছিল না তাই স্বভাবত:ই এ বিষয়েও আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। কোন কোন আলেম ৭ম শতাব্দী থেকেই ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের বিরোধিতা করেছেন এই যুক্তিতে যে, সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ তাঁদের প্রচণ্ডতম নবীপ্রেম সত্ত্বেও কখনো তাঁদের আনন্দ এভাবে উৎসব বা উদযাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন নি, কাজেই পরবর্তী যুগের মুসলমানদের জন্যও তা শরীয়ত সঙ্গত হবে না। পরবর্তী যুগের মুসলমানদের উচিৎ প্রথম যুগের মুসলমানদের ন্যায় সার্বক্ষণিক সুন্নাত পালন, সীরাত আলোচনা, দরুদ সালাম ও হার্দিক ভালবাসার মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার অঘ্য জানান, অমুসলিমদের অনুকরণে জন্মদিন পালনের মাধ্যমে নয়। তাঁদের যুক্তি হলো এ সকল অনুষ্ঠানের প্রসার সাহাবীদের ভালবাসা, ভক্তি ও আনন্দ প্রকাশের পদ্ধতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা সৃষ্টি করবে, কারণ যারা এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভালবাসা ও আনন্দ প্রকাশ করবেন, তাঁদের মনে হতে থাকবে যে সাহাবীদের মত নীরব, অনানুষ্ঠানিক, সার্বক্ষণিক ভালবাসা ও ভক্তি প্রকাশ পদ্ধতির চেয়ে তাদের পদ্ধতিটাই উত্তম। এ সকল নিষেধকারীদের মধ্যে রয়েছেন সপ্তম-অষ্টম হিজরী শতাব্দীর অন্যতম আলেম ইমাম আল্লামা তাজুদ্দীন উমর বিন আলী  আল-ফাকেহানী (মৃত্যু: ৭৩৪ হিজরী/ ১৩৩৪খ্রী:), আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ বিন মুহম্মদ ইবনুল হাজ্জ (৭৩৭হি:/১৩৩৬খ্রী:), ৮ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত আলেম আবু ইসহাক ইব্রাহীম বিন মূসা বিন মুহাম্মাদ আশ-শাতিবী (মৃত্যু ৭৯০ হি:) ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম।

অপর দিকে  অনেক আলেম প্রতি বৎসর রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মীলাদুন্নবী বা নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) জন্মদিনের ঈদ পালনকে জায়েয বলেছেন, এই যুক্তিতে যে, এই উপলক্ষে যে সকল কর্ম করা হয় তা যদি শরীয়ত সঙ্গত ও ভাল কাজ হয় তাহলে তা নিষিদ্ধ হতে পারে না। কাজেই কুরআন তিলাওয়া, ওয়াজ নসিহত, দান-খয়রাত, খানাপিনা, উপহার উপঢৌাকন বিতরণ ও  নির্দোষ আনন্দের মাধ্যমে বাৎসরিক ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করলে তা এদের মতে নাজায়েয বা শরীয়ত বিরোধী হবে না। বরং এসকল কাজ কেউ করলে তিনি তাঁর নিয়েত, ভক্তি ও ভালবাসা অনুসারে সাওয়াব পাবেন। এ সকল আলেমদের মধ্যে রয়েছেন: সপ্তম হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল আল-মাকদিসী আল-দিমাশকী হাফিজ আবু শামা (৬৬৫হি:), ৯ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২হি:), আবুল খাইর মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ, শামসুদ্দীন সাখাবী (৯০২হি:/১৪৯৭খ্রী:), নবম ও দশম হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত আলেম আল্লামা জালালুদ্দীন বিন আব্দুর রহমান আস-সুয়ূতী (মৃ: ৯১১হি:) ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম।

তবে আলেমদে মতবিরোধের বাইরে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন মুসলিম দেশে এই অনুষ্ঠান ছড়িয়ে পড়ে।

আমরা আগেই বলেছি যে, জন্মদিন পালনের ন্যায় মৃত্যুদিন পালনও অনারব সংস্কৃতির অংশ, যা পরবর্তী সময়ে মুসলিম সমাজেও প্রচলিত হয়ে যায়। রবিউল আউয়াল মাস যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম মাস, তেমনি তাঁর ইন্তেকালের মাস। বরং তাঁর জন্মের মাস সম্পর্কে হাদীস শরীফে কোন বর্ণনা আসেনি এবং এবিষয়ে কেউ কেউ মতবিরোধ করেছেন বলে আমরা জেনেছি। কিন্তু রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার তাঁর ইন্তেকাল হওয়ার বিষয়ে কারো কোন মতভেদ নেই । এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, ৭ম হিজরী শতকে মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোথাও রবিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুদিন পালন করা হতো, বা “ওরস” পালন করা হতো, জন্মদিন পালন করা হতো না। ভারতের প্রখ্যাত সূফী হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (৬৩১-৭২৫হি:/১২৩৪-১৩২৫খ্রী:) লিখেছেন যে, তাঁর মুরশিদ হযরত ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর (র:) (৬০৯-৬৬৮হি:/১২১২-১২৭০খ্রী:) ২রা রবিউল আউয়াল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকাল দিবস হিসাবে ওরশ পালন করতেন, যদিও মুসলমানদের মধ্যে ১২ই রবিউল আউয়ালই উরসের দিন হিসাবে প্রসিদ্ধ এবং মুসলমানগণ এই দিনেই উরস পালন করেন।

এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ৭ম হিজরী শতাব্দীর শেষে এবং ৮ম হিজরী শতকের প্রথমাংশেও মীলাদুন্নবী পালন অনেক দেশের মুসলমানদের কাছে অজানা ছিল, তারা জন্মদিন পালন না করে মৃত্যুদিবস পালন করতেন। কিন্তু আবু সাঈদ কুকবূরীর জন্মদিন পালন বা ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন ক্রমান্বয়ে সকল মুসলিম দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে রবিউল আউয়াল মাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম মাস হিসাবেই পালিত হতে থাকে। ৮ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত মরক্কো দেশীয় পর্যটক ইবনে বাতুতা: মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (৭০৩-৭৭৯হি:/১৩০৪-১৩৭৭খ্রী:) দীর্ঘ ২৭ বৎসর ধরে সমস্ত মুসলিম বিশ্ব ও বেশ কিছু অসুসলিম দেশ ভ্রমণ করেন। প্রায় নয় বৎসর (৭৩৪-৭৪১হি:/১৩৩৩-১৩৪১খ্রী:) তিনি ভারতে ছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমন কাহিনীতে বিভিন্ন মুসলিম দেশের সামাজিক উৎসবাদি, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, পর্ব ও কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দান করেছেন। তাঁর বর্ণনায় আমরা কোন কোন মুসলিম দেশের মানুষদের মধ্যে রবিউল আউয়াল মাসে মীলাদুন্নবী উদযাপনের কথা জানতে পারি, কিন্তু ভারত বা অন্য কোথাও তার ইন্তেকাল দিবস বা ওরস পালনের কথা দেখতে পাই না।

আমরা জানি, পরবর্তীকালে মীলাদ পালনের পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিবর্তন ঘটে, তেমনিভাবে তা বাৎসরিক অনুষ্ঠান থেকে দৈনন্দিন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। সম্ভব হলে অন্য কোন প্রবন্ধে আমরা এ সকল বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করতে চেষ্টা করব। আল্লাহই আমাদের সহায়ক ও তৌফিক দাতা। দোয়া করি তিনি দয়া করে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন। আল্লাহর মহান রাসূল, হাবীব ও খলীল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর উপর অগণিত সালাত ও সালাম। আল্লাহুম্মা সাল্লি আলাইহি ওয়া সাল্লিম মা যাকারুয যাকিরুন ওয়া গাফালা আন যিকরিহিল গাফিলূন।

সূত্র

সম্পূর্ণ লিখা পিডিএফ আকারে পড়তে চাইলে ক্লিক করুন।    ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উদযাপন একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan