পরিবারে দাওয়াহ : কিছু কৌশল
এই নোটের পাঠকদের মধ্যে বিভিন্ন মানহাজের ভাইবোনেরা আছেন। আসলে আমরা কেউই কিন্তু এই আদর্শিক প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত নই। ভালো লাগার দিক থেকে কেউ তাবলীগী, তাসাউউফপন্থী, সালাফী, রেজভী, জামাআতে ইসলামপন্থী, কোন না কোন আদর্শঘেঁষা আমরা সবাই। সবার আদর্শের দালিলিক অংশটুকুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শুরু করছি। নোটের প্রথমে কিছুটা তবলীগের কথা আছে। বিরক্তি ওভারকাম করে শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ। রতন পেতে সমুদ্র সেঁচতে হয়, যমীন খুঁড়তে হয়। শুভকামনা।
বিরক্ত হবেন না :
২০১৫ সালের কোন এক এশার নামাযের পর। লালকুঠি জামে মসজিদ, মাজার রোড, গাবতলী। ৩ দিনের জামাতের আজ শেষ দিন। এই ৩ দিন জামাত মসজিদের বারান্দায় ছিল, আমল বারান্দায়ই হয়েছে। ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি, মাজারপন্থী কমিটির নিষেধ, ওহাবীদের থাকতে দেয়া যাবে না। এশা বাদ তালিম শেষে মহল্লার জনা পঞ্চাশেক লোকের মজমা। শুনেছে এই জামাতে সরকারের ইন সার্ভিস একজন জয়েন্ট সেক্রেটারী সাহেব আছেন।
– স্যার, আপনি কেন তবলীগে আসলেন সেই কাহিনী শোনান।
সবার অনুরোধে সফেদ দাড়িবিশিষ্ট অফিসার ভদ্রলোক প্রায় আধাঘণ্টা নিজের ঘটনা শোনালেন। সারাংশ আপনাদের খিদমতে তুলে ধরছি ওনার জবানীতেই:
“ আমার বড়ছেলে কিছুটা উগ্র জীবনযাপন করত। ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে বাপমাকে আতঙ্কে রাখার মত যা যা আছে সবই করত। কর্কশ ব্যবহার তো আছেই। নামাযকালামের তো খবরই নেই। মেডিকেলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে আমার ছেলে এসে বলে, আব্বা, চিল্লায় যাব, জামাকাপড় বানিয়ে দাও। পারিপার্শ্বিক দেশের অবস্থা দেখে আমার মনের সায় ছিলনা, কিন্তু ছেলে দীনের কাজে যাবে। বাধা দিলে আল্লাহ আবার নারাজ হয় কি না এই ভয়ে অনুমতি দিলাম। রেজাল্ট খারাপ করে ফেরত আসল, পরীক্ষা দিয়ে আবার গেল। তাও বাধা দিলামনা, কিন্তু মনে মনে ওর এসব কীর্তিকলাপ মোটেও পছন্দ হচ্ছিল না। ৩ চিল্লা শেষে যখন ফেরত আসল, মা-বোনকে নিয়ে প্রতিদিন তালিম করত। আমার কিছুটা বিরক্তই লাগত, একই বই প্রতিদিন পড়ার কি আছে। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই ফলাফল দেখতে শুরু করলাম। বাসার টিভিটা একন আমি ছাড়া আর কেউ দেখেনা, আমার স্ত্রী জি-বাংলার আর মেয়ে কার্টুন দেখার পোকা ছিল। ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া মেয়েটাও ফুল পর্দা করে বাইরে যাওয়া শুরু করল, এমনকি কাজের মেয়েটাও। আমি বুঝতে পারছিলাম যা হচ্ছে ভালই হচ্ছে কিন্তু কেন যেন মানতে পারছিলাম না।
আমার স্ত্রী-কন্যা পাশেই এক বাসায় সাপ্তাহিক তালিমে যেত। আমার ছেলে যখন বেটার-বউকে নিয়ে চিল্লায় গেল তখন এমন রাগ হল, স্ত্রী-কন্যার তালিমে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। বড়ছেলের উপর আরও রাগ হল যখন আমার আপত্তি সত্তেও ছোটছেলেটাও চিল্লায় গেল।
কিন্তু আমি টের পাচ্ছিলাম আমার উচ্ছৃঙ্খল বড়ছেলের জীবনে আশ্চর্য এক শৃঙ্খলা এসেছে। তার পোশাকআশাক, চলাফেরা, কথাবার্তায় গাম্ভীর্য, ম্যাচুরিটি, শান্তভাব, নম্রতা, আত্মবিশ্বাস, সুবিবেচনা, সহনশীলতা এসেছে। যা আগে চিন্তাও করা যেত না। একই প্রভাব ছোটছেলের জীবনেও পেলাম। ছেলেদের ভিতর যে গুণগুলোর স্বপ্ন দেখতাম, তা বাস্তবে লক্ষ্য করলাম। মানুষ গড়ার, সুকুমারবৃত্তি অর্জনের জায়গা তাহলে এটাই। আমিও নিয়ত করেছি রিটায়ারমেন্টের পর ৩ চিল্লার জন্য যাব ইনশাআল্লাহ। আমার জন্য দুআ করবেন।“
শুনে মজমায় একজন কেঁদেকেটে একসা হচ্ছে। জামাতের আমীর সাপ। শোকরের কান্না। ইয়া রাব্বি, আমি কিছু করিনাই। সব আপনে করেছেন। আপনে একাই করেন। কেউ কোন ক্ষমতা রাখে না। “লাা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহ, সাদাকাল্লাহু ওয়াহদাহ, ওয়া নাছারা আবদাহ”। ২০১৬ সালে আব্বু অবসরে যান, ৩ চিল্লা পুরা করেন। ২টা টিভি বাসা থেকে বের করে দেন। আম্মুকে নিয়ে ১৫ দিন সময় দেন তবলীগে। আমার বাসায় মহল্লার মহিলাদের সাপ্তাহিক তালিমের পয়েন্ট অনুমোদন হয়। বিল্ডিংয়ের মেয়ে বাচ্চারা আমার স্ত্রীর কাছে কুরআন শিখতে আসে। প্রতি রমজান বাসায় খতম তারাবীহ হয়, বিল্ডিংয়ের পুরুষ-মহিলা দুই ফ্ল্যাটে। আলহামদুলিল্লাহ। হেদায়েত দেনেওয়ালা একমাত্র আল্লাহ। বান্দা এমনকি নবীরাসূলগণও হেদায়েত দেবার ব্যাপারে অসহায়। নবীর নিজ পিতৃসম চাচা, নবীর স্ত্রী, নবীর সন্তানও হেদায়েত পায়নি। আমাদের উপর হুকুম হল আমরা দাওয়াত দিব, হিদায়াতের মাধ্যম হব, আসবাব তৈরি করব, পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করব। দাওয়াহর ব্যাপারে নিজ পিতামাতা, স্বামী বা স্ত্রী, এডাল্ট সন্তান এরা প্রথম হকদার দাওয়াহ পাবার। কিন্তু এদের দাওয়াহ বিষয়টা কিছুটা নাজুক। আলাদা কিছু হিকমাহর প্রয়োজন হয়। কাট কাট দাওয়াতে, চাপাচাপিতে অন্তর কঠিন হয়ে যাবার সম্ভাবনাও থেকে যায়। এটা নিয়েই আজকের আলোচনা।
ক. পিতামাতাকে দাওয়াহ:
আমি নিজে থেকে আসলে কিছুই করিনি। তবলীগে ৩ চিল্লা শেষে বাড়ি ফেরার সময় “ওয়াপসী কথা” নামে একটা বয়ান হয়। সোজা বাংলায় Lecture on return বা ফিরতি বয়ান। সেখানে ফ্যামিলিতে কাজ করার উপরও একটা অংশ থাকে। সেখান থেকে কিছু পয়েন্ট আপনাদের সাথে শেয়ার করব। যদি কারো কাজে আসে। আল্লাহ আমাদের নিয়তকে কবুল করুন।
- প্রথমে নিজেকে দীনের উপর মজবুত হতে হবে। নিজের জীবনযাত্রা, চালচলনে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসতে হবে। আগের আমি আর বর্তমান আমি-র মাঝে আমার পিতামাতা যেন পার্থক্য ধরতে পারেন।
- যখন আপনি দীন পালন শুরু করেছেন, তখন সবাই আপনাকে অবজার্ভ করছে। আপনি একটা সাদা কাপড়। একটা কালো বিন্দুতেও চোখ আটকাবে। তাই কথাবার্তা ব্যবহারে দীনের খেলাফ যেন না হয়। পিতামাতার সাথে আরও নরম, ভাইবোনদের সাথে আরও আন্তরিক। তাবলীগে দাঈর সিফত মুখস্ত করিয়েছে। শুনবেন? দলিল চাইলে দিতে পারবনা। “আকাশের মত বিশাল/ পাহাড়ের মত অটল/ মাটির মত নরম/বরফের মত ঠাণ্ডা”। শয়তান আপনার পিছনে লাগবে, লাগাবে; রিএক্ট করা যাবে না।
- পিতামাতাকে ক্রমাগত জবানী দাওয়াত দিলে বিগড়ে যাবার উদাহরণ আছে। তোকে পেটে ধরেছি, তোর চেয়ে কম বুঝি? ছেলে হয়ে বাপকে জ্ঞান দিচ্ছি, এটা সব বাবার ভাল না ও লাগতে পারে। মুখে না বললেও মনক্ষুণ্ন হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই পরিবারে আমলী দাওয়াত বেশি কার্যকর জবানী দাওয়াতের চেয়ে। হ্যাঁ জবানী দাওয়াত দিবেন, তবে আপনি না। আসছি সে প্রসঙ্গে। বাসায় আগের চেয়ে বেশি উন্নত আখলাক দেখান।
- বাসায় দিনের নির্দিষ্ট সময় হাদিসের তালিম করুন। রিয়াজুস সলিহীন / মু্ন্তাখাব হাদিস। প্রশ্ন আসতে পারে বুখারী/ মুসলিম কেন নয়? বুখারী/মুসলিমে অনেক হাদিস মাসআলা সংক্রান্ত। যাদের দীনের বুঝ নেই, সে পরদিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। পুরস্কারের কথা শুনলে পরদিন আবার বসবে। এজন্য রিয়াজুস সলিহীন/মুন্তাখাব হাদিস। ফাজায়েলে আমাল নিয়ে কিছু কথা হয় বলে উল্লেখ করলাম না। কিছু জিনিস বাদ দিলে ফাজায়েলে আমাল বইটা অন্তরে খুব প্রভাব ফেলে। ওতে একটা হাদিসের সাথে সাথে সে সম্পর্কিত সাহাবীদের কওল, সালাফদের কওল সব একাসাথে জমা করা আছে। একসাথে এত কথা অন্তরে হিট করে। সম্ভব হলে ইখতিলাফী অংশটুকু মার্ক করে নিয়ে বাকিটুকু তালিম করতে পারেন বাসায়। যে বই-ই পড়ুন চ্যাপ্টার মার্ক দিয়ে সব চ্যাপ্টার থেকে একটা দুটা হাদিস পড়বেন, তাহলে বৈচিত্র থাকবে। আগ্রহ ধরে রাখা যাবে।
এটা খুব ইফেক্টিভ। আপনি নিজে দাওয়াত না দিয়ে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দিয়ে, তাঁর কথা দিয়ে দাওয়াত দিচ্ছেন। নামাযের তাগিদ শোনাচ্ছেন, সাদাকার লাভ শোনাচ্ছেন। নবীজী ও সালাফদের জবানীতে। আপনার দাওয়াতে মাইন্ড করার সুযোগও থাকলো না, দাওয়াত দেয়াও হল। নবীর কথার নূর পরিবারের অন্তরে পৌঁছানোও হল।
পয়লা দিন থেকেই বসবে এমন ভাববেন না। আমার বাবাও প্রথম ২ বছর বসেননি। পারিনি বসাতে। মা-বোনও প্রথম প্রথম নাও বসতে পারে। তখন কি করবেন? একা একাই পড়বেন। প্রতিদিন, নির্দিষ্ট সময়ে। জোরে আশপাশ শুনিয়ে। আর বসার আগে সবাইকে ডাকবেন, আম্মু এসো একটা হাদিস শুনি। এই বল্টু আয়, একটা আয়াত শোন। আব্বু এসোনা একটা হাদিস শুনো, দেখ কত সুন্দর সুন্দর কথা। একদিন-দুইদিন-দশদিন কেউ বসলো না। একদিন না একদিন ছোটভাইটা বসবে, বোনটা বসবে। একদিন মা এসে বসবে, পড়তো বাপ শুনি তুই কি পড়িস। ব্যস শুনিয়ে দিলেন পুরস্কারের ৫টা হাদিস। মজা পেয়ে গেল। আপনার কাজ অর্ধেক শেষ। একবার বসাতে পারলেই হল। আর বলতে হবেনা মাকে সিরিয়াল না দেখতে, বোনকে পর্দা করতে আর বাপকে দাড়ি রাখতে। তালিমের অভ্যাস করান, ব্যস।
- জবানী দাওয়াত নিজে দিলেন না (বাপমাকে)। ভাইবোনদের নাসীহা দিবেন সমস্যা নেই। আরেকজনকে দিয়ে দেয়াবেন। আপনার প্রিয় আলিমকে বাসায় দাওয়াত করেন, বাপকে নাসীহা করান। মহল্লার কোন দীনদার সাথে দুনিয়াবি সম্মানী (দুনিয়ার বড়ত্ব আমাদের অন্তরে বদ্ধমূল বলে) কোন ব্যক্তি থাকলে তাকে বাসায় নিন, পরিচয় করান, নাসীহা করান। তবে অবশ্যই তাকে বাবামায়ের মনমানসিকতার আপডেট জানিয়ে বাসায় নিবেন, তাহলে কোন লাইনে নাসীহা করতে হবে তিনি বুঝে নিবেন। নিজের কথা বলি, যদিও বলা ঠিক না। আমি আমার বাবাকে নাসীহা করার জন্য সাবেক অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, মেডিকেল প্রফেসর ইত্যাদি তাবলীগের মুরব্বিদের বাসায় নিয়েছি, দাওয়াত করেছি। আব্বুর সাথে আলাপ করিয়েছি। মালয়েশিয়ান জামাতের রিটায়ার্ড ভার্সিটি প্রফেসর, চাইনিজ জামাতের উইঘুর আলিম, ইন্দোনেশিয়ান ডাক্তারসহ যত বিদেশী জামাত আসত মহল্লার মসজিদে আমীর সাহেবকে বাসায় নিতাম শুধু আব্বুর জন্য। আব্বুও খুশি হতেন। হোস্টেলে জার্মান জামাত এলো সেবার। নর্ডিক নওমুসলিম হামযার বয়ানে আব্বু অফিস থেকে এলেন শুনতে। এভাবেই নিজে আখলাক দেখান, আর নাসীহার জন্য অন্য কাউকে ব্যবহার করুন। হিদায়াত আল্লাহর হাতে, আমাদের কাজ পরিবেশ বানানো।
- এবার সবচেয়ে বড় জিনিসের কথা বলব। দুআ। পরিবারের জন্য দুআ করতে হবে। আল্লাহর আদেশ: নিজেকে বাঁচাও, নিজের পরিবারকে আগুন থেকে বাঁচাও। আপনার সামনে আপনার পরিবারকে হেঁচড়ে জাহান্নামে নেয়া হবে। সেদিন কেঁদেকেটে লাভ হবে না। আজকে কাঁদুন, যদি হওয়ার থাকে, আজকে কাঁদলে কিছু লাভ হতে পারে। আমি পরের এক চিল্লায় প্রতি ওয়াক্ত নামাযে শুধু আমার পরিবার স্পেশালি আব্বু জন্য দুআ করেছি। সদকা করে করে দুআ করেছি। আবার বুদ্ধি করে এভাবে দুআ করেছি: আয় আল্লাহ, পুরো উম্মাতের আব্বাদেরকে পরিবারকে পুরা পুরা হিদায়াত দাও। সব আব্বুদেরকে কবুল করে নাও। দুআকে প্রশস্ত করলে নাকি নিজের ক্ষেত্রে আগে কবুল হয়। এমন না যে আমার দুআর কারণে, আব্বু আগে থেকেই দীনমুখী ছিলেন। আল্লাহর আযাবের ভয়েই তো আমাকে বাধা দেননি। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সহজ করেছেন। রোজা রেখে রেখে পরিবারের জন্য দুআ করুন। রহমতের দরিয়ায় জোশ উঠলে আর কতক্ষণ।
স্ত্রীকে দাওয়াহ:
কোন এক চিল্লার সফরে একজন আমীর সাহেব পেয়েছিলাম। প্রতিদিন ‘মুযাকারা’ নামের যে আমলটা হত তাতে উনি কোন না কোন কথায় ‘ঘরওয়ালীকে কিভাবে ঠিক করা যায়’ এই টপিকটা তুলে আনতেন। বলতেন, ঘরওয়ালী যদি সহযোগিতা না করে তবে দাওয়াত দেয়া ও নিজে দীনের উপর থাকা কোনটাই সম্ভব হবে না। ওনার বাতলানো টেকনিক থেকে কিছু যদি আপনাদের কাজে লাগে দেখেন:
- মহিলারা স্বামীর অনুগামী হয়। স্বামীর আমলের দ্বারা মুতাসসির (প্রভাবিত) হয়। তাই স্বামীকে আমল ঠিক করতে হবে, দীনের ওপর মজবুত হতে হবে। তা দেখে স্ত্রী প্রভাবিত হবে। স্বামীর পরিবর্তন, নম্রতা, তিলওয়াত, তাহাজ্জুদ, দুআ, কান্নাকাটি দেখে দেখে তার হৃদয়দ্বারে করাঘাত পড়বে। একসময় খুলে যাবে ইনশাআল্লাহ। আপনার মজবুতি দেখে তার অনুভূতি হবে ‘এটা ইম্পর্টেন্ট কিছু’। আর আপনি যদি দীন হালকাভাবে মানেন, সেও গুরুত্ব বুঝবে না।
- তালিমের কৌশলটা ফলো করতেই হবে। বাকি কাজ নবীজীর হাদিসেই করবে।
- বন্ধুদের মধ্যে/প্রতিবেশীদের মধ্যে যার স্ত্রী দীনদার তাকে স্ত্রীসহ বাসায় দাওয়াত করুন। দুজনকে বসিয়ে দিন। বন্ধুত্ব হোক। আস্তে আস্তে নাসীহা হবে পরের দিনগুলোতে। মেয়েরা বাঁকা হাড়ের মত (হাদিস)। বলেকয়ে শেখাতে পারবেন না। ওনারা দেখে শিখবে। দীনী জীবন দেখানোর চেষ্টা করুন। যার বাসায় দীনী পরিবেশ আছে, ছলেবলেকৌশলে বেশি বেশি সে বাসায় নিয়ে যান।
স্যরি। আবার তাবলীগ। তাবলীগে মহিলাদের সাপ্তাহিক জমায়েতের একটা আমল আছে। এক বা একাধিক মসজিদ মহল্লার মহিলারা এক বাসায় সমবেত হয়। পরিচয়, হাদিস পড়া, ঈমানী আলোচনা হয়। মাসে একবার পুরুষ মাইক দিয়ে বয়ান করে। ঐ বাসাটা কাকরাইল থেকে দেখে দীনী পরিবেশ নিশ্চিত করে অনুমোদন দেয়া হয়। আলহামদুলিল্লাহ আমার মহল্লার পয়েন্টটা আমার বাসায় আল্লাহ দিয়েছেন। এক সাথীভাই স্ত্রী নিয়ে বড্ড পেরেশান ছিলেন। অনেক কষ্টে হাতেপায়ে ধরে স্ত্রীকে আমার বাসায় আনলেন। আমি আগে থেকে মা-বউকে বলে রাখলাম অমুকের বিবি আসবে আজ। উনাকে আচ্ছামত স্বাগত জানানো হল, মেহমানদারি করানো হল, কোন নাসীহা দিতে নিষেধ করেছিলাম। এতগুলো পর্দানশীন দীনপালনে সচেষ্ট মহিলা দেখে, ব্যবহার দেখে আল্লাহ তাঁর দিলে মহব্বত ঢেলে দিলেন। পরের সপ্তাহে স্বামী না বলতে নিজেই এলেন। এরপরের সপ্তাহে তাঁকে হাদিস পড়তে দেয়া হল। এখন তিনি রেগুলার আসেন, ফুল পর্দা করেন। ইসলামী জীবনে অভ্যাস্ত হয়েছেন। এমন কেস গত একবছরে আমার বাসায় কয়েকটা ঘটেছে আলহামদুলিল্লাহ। যেসব এলাকায় পুরুষরা দাওয়াতে বেশি এক্টিভ সেখানে ভুরিভুরি এমন উদাহরণ ঘটে।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য মেয়েদের দীনী জীবন প্র্যাকটিক্যালি দেখিয়ে দিতে পারলে তারা পুরুষের চেয়ে বেশি দ্রুত দীনে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
- স্ত্রীর সাথে উত্তম আখলাক দেখান। বললাম না দেখে শিখবে। ঘরের কাজে সাহায্য করা থেকে শুরু করে বউয়ের চুল আঁচড়ে দিন। তার দোষ ধরা একদম বাদ। আপনি যা যা করবেন তিনি তা ফেরত দিবেন, তার চেয়েও বেশি।
ঘরের ঢুকার কিছু সুন্নাহ+আদব শিখিয়েছিলেন ঐ আমীর সাহেব।
– ঢুকে জোরে সালাম দেয়া- ডান পায়ে ঢোকা,
– একটা দুআ আছে, পারলে মুখস্ত করুন
– দরুদ
– সূরা ইখলাস
– স্ত্রীর সাথে মুসাফাহা (সালামের পরিপূর্ণতা মুসাফাহা)
– মুআনাকা (জড়িয়ে ধরা)
– ছোট হলেও কোন হাদিয়া নিন। একটা কিছু এনে বলুন, তোমার জন্য। হোক একটা চকলেট। এত ব্যস্ততার মাঝে তার কথা যে মনে পড়েছে এতেই মুখ ঝলমল করে উঠবে।
– তার প্রশংসা করা
– ঘরে ঢুকে নবীজী সর্বপ্রথম মিসওয়াক করতেন
– ঘরের কাজে অংশ নেয়া
এগুলো করতে পারলে এটাই আপনার স্ত্রীর জন্য আমলী দাওয়াহ হবে।
কঠোর হবেন না। একদম না। সূরা ফুরকানের ৭৪ নং আয়াত বলে দুআ করুন।
স্বামীকে দাওয়াহ:
- স্ত্রীর ক্ষেত্রে যা যা বলা হলো সবগুলো ‘ভাইস ভার্সা’।
- স্বামীর কাছে দীন শিখতে চান। তাকে এটুকু বুঝান, আমাকে ভাত-কাপড় দেয়া যেমন তোমার দায়িত্ব, আমাকে দীন শেখানোও তোমার দায়িত্ব। আপনার মাসআলার প্রয়োজনে তাকে মসজিদে ইমামের কাছে পাঠান।
- তোয়াজ-তমিজ করে ঘরে তালিমে বসান। বাকি কাজ হাদিসই করবে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল তো সবসময়ই করেন। আল্লাহর জন্যও একটু করুন। অনেক সাথী দেখেছি যারা বউয়ের কারণে দীনের পথে এসেছে।
- দীনী কিতাব কিনতে পাঠান। তাফসীর মাহফিলে পাঠান। শুনে এসে বলবা আমাকে কী বলেছে। আবার বেশি প্রেসার দেবেন না। সারাদিন অফিসে কাজ করে। তার ক্লান্তি বুঝে। দুনিয়াবি তাগাদা, বাজার সদাই কমিয়ে দীনের বাজার ধরিয়ে দেবেন মাঝেমধ্যে। আপনার প্রয়োজন মেটাতেই সে গাধার মত খাটে, আপনাকে একটু খুশি দেখতে। আপনার প্রয়োজন যদি দীন হয় তবে সেটার জন্যও সে খাটবে ইনশাআল্লাহ।
- বদমেজাজি হলে জাস্ট খেদমত বাড়ান। এবনরম্যালি খিদমত করুন। অবাক করে দিন যাতে জিগেস করে, কেন এত খিদমত করছ। তখন দীনী প্রয়োজনের কথা বলুন।
বয়স্ক সন্তানকে দাওয়াহ:
- স্বামী/স্ত্রীর প্রসিডিউর ফলো করুন। বয়স্ক সন্তান কথা শুনতে চায় না। তুমি বুড়া হইসো, তুমি আল্লা-বিল্লা করো, আমার টাইম হলে আমিও করবোআনে, এমন মানসিকতা রাখে। সরাসরি নাসীহাহ উপকারী নাও হতে পারে।
- প্রচুর দুআ করুন। সূরা ফুরকান ৭৪ নং আয়াত। সন্তানের জন্য বাপমার দুআ আর আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই (হাদিস)।আলোর বেগে দুআ কবুল হবে। সাদাকা, রোজার সাথে দুআ করুন।
আমাদের দাওয়াহ ও নাসীহাহ পাবার প্রথম হকদার আমাদের পরিবার। নবীজীকেও আল্লাহ আদেশ করেছেন, নিজেকে ও পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। আমাদের হাদিয়া, তোহফা, আখলাক, ইকরাম, ইহসান পাবার প্রথম হকদার পরিবার। অথচ পরিবারেই আমাদের আচরণ সবচেয়ে অশীলিত, রাফ, অমার্জিত, অনিয়ন্ত্রিত। সবাইকে হাদিয়া দিই, বউকে দিইনা। ঘরে ঢুকি বাঘের মত। বউ-সন্তান বমার ভয়ে তটস্থ থাকে। দাঈ এমন হবে না। তাবলীগের আঙ্গিকে কথাগুলো বললাম, ওখান থেকেই শিখেছি বলে। যার যার ভালোলাগা আদর্শে ফেলে ফলো করুন, রেজাল্ট পাবেন ইনশাআল্লাহ। আর লেখকের জন্য দুআ করতে ভুলবেন না। লেখক দুআর খুব বেশি মুখাপেক্ষী। আল্লাহ মাফ করুন। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
লেখায়- শামসুল আরিফিন শক্তি