ইসলাম প্রচার ও মহানবী (সা)
রচনায়: এ. জেড. এম. শামসুল আলম
রাসূলদের মহানেতা সাইয়েদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনসাধনা ছিল অতি ব্যাপক। মহানবী (সা)-র সীরাত বা জীবনচরিত বিশ্লেষণ করলে আমরা তাঁকে পাই একজন ঈমানদার, মুক্তাকী, নামাযী, রোযাদার, হাজী হিসেবে। তাঁকে দেখি রাষ্ট্রপরিচালক, সেনাপতি, সমাজসেবক হিসেবে। তাঁকে পাই সদা সত্যবাদী, আমানতদার, দানশীল, ক্ষমাশীল, বিনয়ী, সলজ্জ, বুদ্ধিমান, রুচিশীল মানুষ হিসেবে। আমল ও আখলাক বিশ্লেষণ করলে তাঁকে আরও বহুগুণে গুণান্বিত দেখতে পাব। মহানবী (সা)-র জীবন-সংগ্রাম পরীক্ষা করলে তাঁকে আমরা পাব বহু কর্মসাধনার মহানায়করূপে।
আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র ইবাদতের জন্যে। নামায, রোযা, তাসবিহ, তাহলিল, হাজ্জ, যাকাত, সাদাকাহ, মানব কল্যাণ, সুন্দর চরিত্রবান হওয়া ইত্যাদি অবশ্যই ইবাদত এবং ইবাদতসম কর্ম- এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ধরনের ইবাদতের জন্যেই কি আল্লাহ নবী-রাসূল প্রেরণ করেন?
নবী-রাসূলদের মৌলিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কি? বেনামাযী, বেরোযাদার কোন ব্যক্তি কখনও নবী-রাসূল হতে পারে না, এটা সত্য। কিন্তু নামাযী হওয়া, তাহাজ্জুদগুজার হওয়া, রোযাদার হওয়া, রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া বা সমাজ- সংস্কারক হওয়ার মাধ্যমেই কি নবী-রাসূলদের, বিশেষ করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কি প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ (সা)-কে রাজ্য পরিচালনা, সেনাপতি, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষা বিস্তারক বা সমাজনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং আদর্শ স্থাপনের মুখ্য উদ্দেশ্যে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছিলেন?
উপরোক্ত কাজগুলো অবশ্যই আল্লাহর রাসূল (সা)-কে করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল রিসালত-এর দায়িত্ব পালন। আল্লাহর নবীর মৌলিক এবং প্রত্যক্ষ কাজ ছিল ইসলাম প্রচার। নবী-রাসূলগণ হলেন আল্লাহর প্রেরিত ধর্মপ্রচারক। আল্লাহর দীন প্রচার করাই হলো তাঁদের প্রধান এবং মৌলিক কাজ।
মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুকরণীয় সাইয়েদুল মুরসালীন-এর কর্মমুখর জীবনের বহু দিক-দিগন্ত আলোচনা মুসলিম সমাজে কমবেশি হয়ে থাকে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহানবী (সা), সামরিক নেতা হিসেবে মহানবী (সা), জিহাদের ময়দানে মহানবী (সা) ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ-পুস্তক রচিত এবং পঠিত হয়। কিন্তু নবুয়তী জিন্দেগীর অন্যতম প্রধান কাজ আল্লাহ্ দীনের প্রচারে মহানবী (সা) বা রাসূল হিসেবে হযরত মহানবী (সা) শীর্ষক প্রবন্ধ কিংবা পুস্তক খুব কমই দেখা যায়৷
বর্তমান দুনিয়ার খ্রিস্টানদের সংখ্যা মুসলিমদের দ্বিগুণের বেশি। খ্রিস্টধর্মের তুলনায় ইসলাম ধর্ম প্রচারে অনগ্রসরতা, বিফলতা এবং ব্যর্থতার বড় কারণ হলো মুসলিমদের মধ্যে নবী-রাসূলগণের মূল কাজ ধর্মপ্রচারের প্রতি উপক্ষো এবং তাদের মধ্যে তাবলীগী এবং দাওয়াতী চেতনা হ্রাস, এমনকি বিলুপ্তি।
সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন এবং তাবে-তাবেয়ীনদের পর ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আউলিয়া কিরাম, সূফী-দরবেশগণ। সূফী-দরবেশগণ ধর্ম প্রচারের কাজ এত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেন যে, তাঁরা চিরকালের জন্যে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে হিজরত করেছেন, রাসূল (সা)-এর বিবাহ সংক্রান্ত সুন্নাহ পালন তাঁরা করতে পারেন নি; বরং চিরকুমার বা মুজাররদ থেকেছেন এবং সংসারত্যাগী সাধক হিসেবে দীন প্রচারের কাজে লিপ্ত ছিলেন। তাঁরা তাবলীগ এবং দাওয়াহ সংক্রান্ত আল্লাহ তা’আলার হুকুম তামিলের জন্যে রাসূল (সা)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন। বিয়ে-শাদী করে ঘরসংসার করা এবং খণ্ডকালীন হিসেবে তাবলীগ এবং দাওয়ার কাজ না করে সার্বক্ষণিকভাবে তাবলীগ এবং দাওয়ার কাজে তাঁরা আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের এই ত্যাগ এবং কুরবানীর ফলেই সারাবিশ্বে দীন ইসলামের ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়।
নবীদের পেশা
ইহজগতে জীবিকা নির্বাহের জন্যে আমাদের সবার একটা না একটা পেশা আছে। আমরা কেউ কৃষক, কেউ চাকুরে, কেউ ব্যবসায়ী বা অন্য কিছু। আমাদের নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পেশা কি ছিল? নবুয়তের পূর্বে আমাদের নবী করীম (সা) ছিলেন ব্যবসায়ী ও কৃষিবিদ। অন্যান্য নবী নবুয়তের পূর্বে বিশেষ বিশেষ কাজে উৎসাহ দিতেন। কারো কারো বিশেষ গুণাবলী ছিল। ঈসা (আ.) ছিলেন উত্তম চিকিৎসক। হযরত সুলায়মান (আ.) ছিলেন সম্রাট। হযরত নূহ (আ.) ছিলেন নৌকা নির্মাতা। হযরত মূসা (আ.)-র সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত ছিল ফেরআউনের অত্যাচার থেকে ইয়াহুদীদের রক্ষায়। হযরত দাউদ (আ.) সুগায়ক ও কর্মকার ছিলেন। হযরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন রাজার উপেদেষ্টা ও মন্ত্রী।
উপরে যে কাজগুলোর কথা বলা হল, এগুলোই কি নবীদের পেশা ছিল? আল্লাহর সব নবীর প্রকৃত পেশা ছিল এক এবং অভিন্ন। ঐ একটি পেশা দিয়েই প্রেরণ করা হত তাঁদের এ পৃথিবীতে। তারপর সেই পেশাকেই তাঁরা রূপান্তরিত করতেন মিশনে, ধর্মপ্রচার কার্যে। সেই মিশন বা পেশা ছিল দীনের প্রচার। দীনের নিজস্ব ভাষায় এর নাম তাবলীগ ও দাওয়াহ্। আমাদের নবী করীম (সা) ও তাঁর সাহাবীদের প্রধান কাজ ছিল তাবলীগ ও দাওয়াহ্। তাঁদের বাকি সকল কর্ম ছিল গৌণ।
নবুয়তের দায়িত্ব
আমাদের নবী করীম (সা)-কে আল্লাহ অর্পণ করেছিলেন দীন প্রচারের পবিত্র দায়িত্ব। নবুয়তের দরজা বন্ধ হবার পর সেই দায়িত্ব কে পালন করবেন? পৃথিবীতে সমস্ত মানুষ আল্লাহর সিফাতের খলীফা, আর নবী করীম (সা)-এর প্রতিভূ। মানুষের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ও চরিত্রসম্পদের শ্রীবৃদ্ধির জন্যে তৎপর থাকতেন নবীগণ। আল্লাহর কাছ থেকে কিতাব অবতীর্ণ হওয়া বন্ধ হয়ে গেলে পথভোলা মানুষকে পথনির্দেশের দায়িত্ব কার উপর বর্তাবে? দীনের পথে আহ্বানের দায়িত্ব বর্তাবে সমগ্র উম্মাহ্র উপর। দা’য়িঈগণ এই দায়িত্বের কিয়দংশ পালন করে থাকেন। নবুয়তের দ্বার রুদ্ধ হওয়া হযরত মুহাম্মদ (সা)- এর উম্মতদের জন্যে এক বিরাট আশীর্বাদবিশেষ। নবী করীম (সা)-এর পূর্বে আল্লাহ্ তাঁর দীন প্রচারের জন্যে নবী প্রেরণ করতেন। মহানবী )সা)-এর সহচরবৃন্দও এই পেশা অবলম্বন করেছেন। তারা দা’য়িঈ হতেন। যে দাওয়াত ছিল নবীদের পেশা তা হলো সকল পেশার সেরা পেশা। পূর্ণ বা খণ্ডকালীন ভিত্তিতে এ পেশা গ্রহণ করে দায়িঈ হওয়ার জন্যে সকল মুসলিম তাঁদের সন্তানদের উৎসাহিত করতে পারে।
অন্ধ লোকের চলাফেরার জন্যে লাঠি বা ছড়ির দরকার হয়। যদি এমন হয়, বিছানার পাশে বেশ সুন্দর একটি জিনিস স্পর্শ করে সে মনে করে এটি একটি বেত, আর চক্ষুষ্মান লোক তাকে ওটা ধরতে বারণ করে; কারণ ওটা একটা ঘুমন্ত সাপ, তাহলে অন্ধ লোকের সে-কথা শুনতে এবং মানতে হবে। আর যদি অন্ধ লোক গোয়ার্তুমি করে বলে, ‘কে বলে ওটা সাপ? এখানে সাপ আসবে কোত্থেকে, এটা একটা বেত।’ তারপর সেটা ধরে, তাহলে নিজেই মজা টের পাবে। ঘুম ভাংতেই সাপ তাকে দংশন করবে। যাদের চোখ আছে, তাদের কথা অন্ধ মানুষদের শুনতে হয়। এ জন্যে দীনের ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ, অন্যদের তাদের হিদায়ত গ্রহণ করতে হয়। এভাবে, প্রচারের মাধ্যমে দীন জারি থাকে; সজীব ও জীবন্ত থাকে। রসূল (সা) সারাজীবন এই প্রচার বা তাবলীগের কাজ জোরদার রেখেছিলেন।
দীন প্রচারের শুরু
আল্লাহ্ তা’আলা নির্ধারিত দীন আল ইসলাম বিশ্ব মানবের কাছে নতুনভাবে প্রচার শুরু হয় হেরা গুহায় সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল থেকে। সময়টি ছিল ৬১০ ইসায়ী সনের রমযান মাসের লাইলাতুল কদর বা মুবারক রজনী। (২:১৮৫; ৯৭:১)। অনেকের মতে ২৭ শে রমযানের রজনী।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে সর্বপ্রথম নাজিলকৃত পাঁচটি আয়াত হলো:
১. পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
২. সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক হতে।
৩. পাঠ কর, তোমার প্রতিপালক মহা মহিমান্বিত।
৪. যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।
৫. শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জনাতো না। (সূরা আলাক ৯৫: ১-৫)
প্রথম মুসলিম
মানবতার জন্যে মানবস্রষ্টার এই সওগাত নিয়ে ত্রস্তপদে ও কম্পিত দেহে হীরা গুহা থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন তদানীন্তন আরবের উৎকৃষ্টতম মানুষ মুহাম্মদ (সা)। শুনালেন অনুষ্ঠিত ঘটনা পবিত্ৰ ভাৰ্য্যা (স্ত্রী) খাদিজা তাহেরা বিনতে খোয়াইলিদকে।
মহা পবিত্র বাণী পুনশ্চ শ্রবণ এবং পাঠমাত্র খাদিজা তাহেরা (রা) বিশ্বাস করলেন আল্লাহর নাজিলকৃত সত্যে। স্বামীকে দেখলেন নতুন রূপে, আল্লাহর পবিত্র বাণীবাহক রাসূল হিসেবে। বিশ্বাস করলেন তাঁর নবুয়ত এবং রিসালতে। আশ্বস্ত করলেন স্বামীর অশান্ত চিত্তকে। আবৃত করলেন তাঁর কম্পিত দেহ কম্বল দিয়ে। পনরটি বছর ধরে দেখেছেন যে মহৎ মানুষকে, তাঁর মাঝে নতুন সত্তা আবিষ্কারে পবিত্রাত্মা খাদিজা তাহেরা (রা.)-র বিন্দুমাত্র বিলম্ব হলো না। আল্লাহ্ ও রাসূল (সা)-এর উপর ঈমান এনে তিনিই লাভ করলেন প্রথম মুসলিম হওয়ার দুর্লভ গৌরব।
ওহীর প্রথম আলোর ঝলকানিতে ভীতসন্ত্রস্ত মুহাম্মদ (সা) নবুয়তের দায়িত্ব ও ক্লান্তি হতে শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। জীবনসংগিনী খাদিজা (রা.)-র বিশ্বাস ও আস্থায় স্বস্তি ফিরে পেলেন। কিন্তু বেশ কিছু কাল আর কোন ওহী আসা বন্ধ থাকলো।
সূরা দুহা
রাসূল (সা) আবার ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। যে মহাসত্যের ইংগিত তিনি পেয়েছেন, তা কি তাঁর সম্মুখে উন্মোচিত হবে না? যে মহা মহিমান্বিত প্রতিপালক তাঁকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি তাঁর প্রতি বিরূপ হয়েছেন বা তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন? তিনি কি মহাপ্রভুর আশ্রয়, শিক্ষা এবং পথনির্দেশ আর পাবেন না! মহা চিন্তিত, বিচলিত হলেন নবী মুহাম্মদ (সা)। কিছুকাল পরেই বৃষ্টিধারার মত নাজিল হওয়া শুরু হলো আল্লাহ্ অহী, ঐশী বাণী। প্রথমেই নাজিল হলো সূরা দুহা (মধ্যাহ্ন)।
আল্লাহ্ নবীকে জানালেন: শপথ পূর্বাহ্নের ও নিঝুম নিশীথ রজনীর। তোমার প্রতিপালক তোমাকে পরিত্যাগ করেন নি। তোমার প্রতি বিরূপও হননি তিনি।
তোমার পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময় হতে হবে উত্তম। অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে অনুগ্রহ দান করবেন। আর তুমি সন্তুষ্ট হবে। তোমার প্রতিপালকের নিয়ামতের (নবুয়ত) কথা জানিয়ে দাও।
(আল-কুরআনঃ সূরা দুহা, আয়াত ১-১১)।
যে নিয়ামতের কথা এখানে বলা হয়েছে, তা হলো নবুয়ত-এর নিয়ামত। অপরকে জানিয়ে দিতে এবং প্রচার করতে নবী আদিষ্ট হলেন। এ আয়াতের ‘হাদ্দাছা’ শব্দ (অর্থাৎ প্রচার কর, জানিয়ে দাও) হতেই আল্লাহ্ নবীর কথা, কাজ এবং অনুমোদিত কর্মের বর্ণনা পরিভাষাগতভাবে হাদীস নামে অভিহিত হয়েছে।
প্রাথমিক মুসলিম
সূরা দুহা বা মধ্যাহ্নের সূরা (৮৩) নাজিল হওয়ার পরই আল্লাহর রাসূল (সা) আতি গোপনে বিশ্বস্ত লোকদের কাছে দীনের বাণী পৌঁছাতে লাগলেন। বিবি খাদীজা (রা.)-এর পর ইসলাম গ্রহণ করেন দশ বছর বয়স্ক বালক আলী (রা.)-যাঁরা রাসূলকে অতি কাছে থেকে বহুকাল দেখেছেন, মানুষ হিসাবে তিনি কেমন তা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরাই প্রথম ইসলাম কবূল করেছেন।
হযরত আলী (রা)
শিশুকাল থেকেই আলী (রা) থাকতেন মুহাম্মদ (সা)-এর পরিবারে। আবূ তালিবের পরিবার ছিল বড়। তার ভ্রাতা আল-আব্বাস ছিলেন ভাইদের মধ্যে ধনী। এক দুর্ভিক্ষের সময় হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর চাচা আব্বাসের কাছে প্রস্তাব দেন যে, আবূ তালিব পরিবারের কিছু দায়িত্ব তারা ভাগ করে নিতে পারেন। আলীর ভরণ- পোষণের দায়িত্ব নিবেন তিনি নিজে। আরও প্রস্তাব করেন যে, আবূ তালিবের দু’টি সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারেন আল আব্বাস। পিতৃব্য আব্বাস তাতে রাযী হলেন। প্রস্তাবটি আবূ তালিবের কাছে পেশ করা হলে তিনি তার পুত্র জাফরের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দিলেন আল আব্বাসকে এবং আলীর দায়িত্ব দিলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সা)- কে। তখন থেকেই বালক আলী নবী-পরিবারের সদস্য হিসাবে বড় হচ্ছিলেন।
ইবনে কাসিরের বর্ণনানুযায়ী নবুয়তের অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আলী (রা) দেখতে পান যে, রাসূল (সা) এবং বিবি খাদিজা (রা) আল্লাহর যিকির করছেন এবং সিজদা করছেন, সালাত আদায় করছেন। বালক আলী (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, এসব কি মুহাম্মদ (সা)? রাসূল (সা) জবাব দিলেন, ‘এটা আল্লাহ্ দীন। এই দীন তাঁর নিজস্ব। এই দীন প্রচারের জন্যে আল্লাহ্ নবী প্রেরণ করেন। আমি সেই এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর পথে তোমাকে আহ্বান করছি। আস, আল্লাহর ইবাদত কর’। (ইবনে ইসহাক)।
একরাত অপেক্ষা করার পর দিনই বালক আলী কালিমা তাইয়েবা ও শাহাদত পাঠ করে ইসলাম কবূল করেন। রাসূল (সা) মাঝে মাঝে আলী (রা)-কে নিয়ে মক্কার উপকণ্ঠে কোন উপত্যকায় চলে যেতেন এবং সেখানে দীর্ঘ সময় প্রকৃতির নীরবতায় আরাধনা এবং সালাত আদায় করতেন। আল্লাহর যিকির করতেন। ফিরতে কখনও কখনও রাত হয়ে যেত। তাঁদের নতুন ধরনের ইবাদতের পদ্ধতি সম্বন্ধে আবূ তালিব বা তার আত্মীয়-স্বজন অবহিত ছিল না।
একদিন তাঁদের ইবাদতের সময় সেখানে হাজির হন আবূ তালিব। আবূ তালিব রাসূল (সা)-কে তাদের আরাধনার পদ্ধতি এবং ধর্মকর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন। রাসূল (সা) উত্তরে বলেন, “এটা আল্লাহর ধর্ম, তার ফেরেশতাদের ধর্ম, তাঁর নবীদের ধর্ম, আমাদের পিতা ইবরাহীমের ধর্ম।” অতপর তিনি তাকে আল্লাহর দীনের দিকে আহ্বান করেন। (সীরাতুল ইবনে ইসহাক)
জবাবে আবূ তালিব বলেছিলেন, “আমি আমার পিতা, পিতামহ ও পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করতে পারব না। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছি, কেউ তোমার কোন অসুবিধা করতে পারবে না।”
আবূ তালিব তার পুত্র আলী (রা)-কে বলেছিলেন, “ভালো ছাড়া অন্য কোন কিছুতেই ও (রাসূল সা) তোমাকে জড়াবে না। সুতরাং তুমি তাঁর সঙ্গে লেগে থাকো। ইবনে ইসহাক পৃঃ ২১।
যায়েদ বিন হারিসা (রা)
হযরত আলী (রা)-র পর যায়েদ ইবনে হারিসা (রা) অতি শিগগিরই ইসলাম কবূল করেন। যায়েদ ইবনে হারিসা ছিলেন বিবি খাদিজার ক্রীতদাস। রাসূল (সা)-এর সঙ্গে বিয়ের পর বিবি খাদিজা জায়েদ ইবনে হারিসাকে স্বামীর খিদমতের জন্যে উপহার দেন। রাসূল (সা) তাকে সঙ্গে-সঙ্গেই মুক্ত করে দেন। খোঁজ নিয়ে, খবর পেয়ে যায়েদের পিতা হারিসাও তাঁকে নিয়ে যেতে আসেন। কিন্তু জায়েদ বিন হারিসা পিতৃগৃহে গমন না করে রাসূল (সা)-এর সঙ্গে থাকাই শ্রেয় মনে করেন।
যাযেদ বিন হারিসা (রা)-এর পর ইসলাম গ্রহণ করেন আবু বকর ইবনে আবূ কুহাফা (রা)। কারও কারও মতে বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর অন্য নাম আতিক। তাঁর মাতার নাম উম্মে আল খায়ব। পিতা উসমান ছিলেন আবূ কুহাফা নামেই অধিকতর খ্যাত। তাঁর পূর্ণ নাম উসমান ইবনে আমির ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তায়ুম ইবনে মুররা ইবনে কা’ব ইবনে লুয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর। (সীরাত ইবনে ইসহাক, পৃ. ২১৫)।
আবূ বকর (রা)
হযরত আবূ বকর (রা) ছিলেন অভিজাত পরিবারের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাঁর পরিবারের সকলের আচরণই ছিল সুন্দর ও ভদ্র। ছোট-বড় সকলেরই তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন। বিবাদ-বিসংবাদে তাঁর মধ্যস্থতা জনগণ মেনে নিত। কুরাইশ এবং আরব কবিলার বংশ-বৃত্তান্ত তিনি যত ভালো জানতেন, তত ভালো আর কেউ জানত না। আরব কবিলাগুলোর দোষগুণও ছিল হযরত আবূ বকর (রা)-এর নখদর্পণে। তিনি যেমন ছিলেন বিরাট বণিক, তেমনি বিরাট ছিল তাঁর হৃদয়। দয়ামায়ায় পরিপূর্ণ। আপদে-বিপদে সবাই ছুটে আসত তাঁর কাছে পরামর্শ ও সাহায্যের জন্যে। পর্যাপ্ত ছিল তাঁর জ্ঞান, ব্যবসায়ে ছিল বিরাট অভিজ্ঞতা। সর্বোপরি ছিল তাঁর অপরিসীম ধৈর্য ও সুন্দর মিষ্টি মেজাজ। (সিরাত ইবনে ইসহাক পৃ. ২১৫)
হযরত আবু বকর (রা) ইসলাম গ্রহণ করার পরই তিনি তাঁর পরিচিতজনদেরকে ইসলামের পথে দাওয়াত দেয়া শুরু করেন। তাঁর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় মক্কায় বিপর্যস্ত দরিদ্র দাসশ্রেণী এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ যুগপৎ ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হতে লাগলেন।
হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা), সাদ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা), তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) ইবনে উসমান প্রমুখ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ হযরত আবূ বকরের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলেই ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হন। এই চারজনকে নিয়ে প্রাথমিক মুসলমানদের সংখ্যা হলো আটজন।
নবুয়তের প্রথম তিন বছর ইসলামের দাওয়াতী প্রচার চলে গোপনে, বরং অতি সংগোপনে। অহী নাজিলের তিন বছর পর রাসূল (সা) সর্বপ্রথম হাশেমী বংশীয়দেরকে স্বগৃহে আহ্বান করে আপ্যায়ন করেন এবং তাদের কাছে দীনের দাওয়াত দেন। অতঃপর সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে বিভিন্ন কবিলার নাম উল্লেখ করে মক্কাবাসীদেরকে প্রকাশ্যভাবে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী আটজন সাহাবীর ইসলাম গ্রহণ করার পর আরও যারা নবুয়তের প্রথম তিনবছরের মধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন তাঁদের অনেকের (৬১ জন) নাম এ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হলো। এদের ৫২ জনের নামই ইবনে ইসহাকের সীরাতে উল্লেখ রয়েছে।
ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের দাওয়াত
ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ঈমান আনার পরেই ঈমানদারের আখলাক বা আচরণে পরিবর্তন আসে। দোষে-গুণের মানুষ আরও ভালো মানুষ হয়। ভাই ভাইকে বেশি ভালোবাসে। সন্তানের প্রতি পিতার অনুভূতি গভীর হয়। এক ভাই ইসলাম গ্রহণ করার পর দেখা গেছে, তার প্রভাবে অপর ভাইও ইসলাম গ্রহণ করেছে, এমনকি পিতার অমতেও। আজকাল মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কনিষ্ঠ ভ্রাতা অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রজের অনুগত বা বাধ্য নয়।
নবুয়তের প্রথম তিনি বছরে দুই বা ততোধিক ভ্রাতার ইসলাম গ্রহণ প্রসংগে যাদের নাম উল্লেখ করা যায় তাদের মধ্যে রয়েছেন:
উসমান (রা) ইবনে মাজুন ইবনে হাবিব | তিন ভাই ও এক ভ্রাতুষ্পুত্র |
কাদামা (রা) ইবনে মাজুন ইবনে হাবিব | |
আবদুল্লাহ (রা) ইবনে মাজুন ইবনে হাবিব | |
আশ-শাইব ইবনে উসমান ইবনে মাজুন (রা) | দুই ভাই |
আবদুল্লাহ ইবনে জাহস ইবনে রিয়াব ইবনে ইয়ামার | |
আবূ আহমদ ইবনে জাহস ইবনে রিয়াব ইবনে ইয়ামার
(আবদুল্লাহ এবং আবূ আহমদের মাতা উমাইমা ছিলেন হযরত হামজার ভগ্নি) |
|
(আবদুল্লাহ এবং আবূ আহমদের মাতা উমাইমা ছিলেন হযরত হামজার ভগ্নি) | |
হাতিব ইবনে আল হারিস ইবনে মা’মার ইবনে হাবিব | দুই ভাই |
খাত্তাব ইবনে আল হারিস ইবনে মা’মার ইবনে হাবিব | |
খালিদ ইবন আল বুকায়র ইবন আবদু ইয়ালিল ইবন নাসিব | চার ভাই |
আমির ইবন আল বুকায়র ইবন আবদু ইয়ালিল ইবন নাসিব | |
আকিল ইবন আল বুকায়র ইবন আবদু ইয়ালিল ইবন নাসিব | |
আইয়াস ইবন আল বুকায়র ইবন আবদু ইয়ালিল ইবন নাসিব |
একই পরিবারের দু’বোন নবুয়তের প্রথম তিন বছরে যারা ইসলাম কবূল করেছেন তাদের মধ্যে আছেন:
আসমা বিনতে আবূ বকর (রা)
আয়শা বিনতে আবূ বকর (রা)
প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণ করার পর স্বামীর আখলাক-আচরণও হতো অধিকতর প্রেমময়। ইসলামী আদর্শের উপর একিন এবং পিতা বা স্বামীর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাও কখনও ইসলাম গ্রহণ করতেন। বর্তমানের ন্যায় মুসলিম পরিবারের স্ত্রীর জীবনধারা হতে স্বামীর জীবনধারা তত পৃথক হতো না।
দীনের দাওয়াতে স্বামী-স্ত্রী
প্রথম তিন বছরে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:
স্বামী
সাঈদ ইবনে যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল (হযরত উমরের ভগ্নিপতি)
স্ত্রী
ফাতিমা বিনতে আল খাত্তাব (রা) (সাঈদ ইবনে যায়েদের পত্নী)
স্বামী
জাফর ইবনে আবূ তালিব (রা)
স্ত্রী
আসমা বিনতে উমায়েস ইবনে নুমান ইবনে কাব (রা) (জাফরের স্ত্রী)
সালিত ইবনে আমর ইবনে আবদ শামস ইবনে নসর (রা)
আসমা বিনতে সালামা ইবনে মুগাররিবা (রা) (সালিত ইবনে আমরের স্ত্রী)
আল-মুত্তালিব ইবনে আজহার ইবনে আবদু আউফ (রা)
রামলা বিনতে আবূ আউফ ইবনে সুবায়রা (রা) (আল-মুত্তালিব ইবনে আজহারের স্ত্রী)
খালিদ ইবনে সাইদ ইবনে আল আস (রা)
উমায়না বিনতে খালাস ইবনে আসাদ (রা) (খালিদ ইবনে সাঈদের স্ত্রী)
হাতিব ইবন আল হারিস মা’মার ইবন হাবিব (রা)
ফাতিমা বিনতে আল-মুজাল্লিল ইবনে আবদুল্লাহ (রা) (হাতিব ইবনে আল-হারিসের স্ত্রী)
খাত্তাব ইবনে আল হারিস ইবনে মা’মার ইবন হাবিব (হাতিব ইবনে আল-হারিসের স্ত্রী)
ফুকায়হা বিনতে ইয়াসার (রা) (খাত্তাব ইবনে আল-হারিসের স্ত্রী)
আঠারজন সাহাবীর ইসলাম গ্রহণ
নবুয়তের প্রথম তিন বছরে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীদের মধ্যে আরও রয়েছেন:
আবূ উবায়দা ইবনে আল জাররা (রা)
আবূ হুযায়ফা ইবনে উতবা (রা.) (উতবা ছিলেন আবূ সুফিয়ানের পত্নী হিন্দার পিতা)
উমায়র ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা) (হযরত সাদ ইবন আবূ ওয়াক্কাসের (ভাই)
আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা)
আমির ইবনে ফুহায়রা (রা) (হযরত আবূ বকরের মুক্ত দাস)
খাব্বাব ইবনে আল আরাত (রা)
আবদুল্লাহ ইবনে সামুদ ইবনে আল হারিস ইবনে শাম্স (রা)
মাসুদ ইবনে আল কারি (রা)
উবায়দ ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে আবদু মানাফ (রা)
সামার ইবনে আল-হারিস (রা)
আল-আরকাম ইবনে আবূল আরকাম (রা) (প্রকৃত নাম আবদু মানাফ ইবনে আসাদ)
আবূ সালমা (রা) (প্রকৃত নাম-আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদ)
হাতিব ইবনে আমর ইবনে আবদু শামস (রা)
ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদু মানাফ (রা)
খুনায়স ইবনে হুযাফা ইবনে কায়স ইবনে আদিই (রা)
আমির ইবনে রাবিয়া আমস ইবনে ওযাইল (রা) নুয়ায়ম ইবনে আসিদ (রা)
সুহায়ব ইবন সিনান (রা) (বদর যুদ্ধে সুহায়ব ইবনে সিনান বানু তায়ম কবিলার উমায়র ইবনে উসমান এবং উসমান ইবনে মালিককে হত্যা করেন)
আবদুল্লাহ ইবনে ইসহাক রচিত সীরাত
উপরে ইবন ইসহাকের সীরাত গ্রন্থ হতে নবুয়তের প্রথম তিন বছরের মুসলিমদের যে তালিকা দেওয়া হলো, এ তালিকাটি সবচেয়ে প্রামাণ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, তবে তা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
আবূ আবদুল্লাহ ইবনে ইসহাক ৮৫ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আল্লাহর রাসূল (সা)-এর প্রাচীনতম জীবনী ‘সীরাতুর রাসূলুল্লাহ’-র রচয়িতা হিসাবে খ্যাত।
ইবন ইসহাক-এর প্রদত্ত তালিকা স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে হয় না নানা কারণে। এতে নবীকন্যা সাইয়েদেনা জয়নাব (রা), সাইয়েদেনা রুকাইয়া (রা), সাইয়েদেনা উম্মে কুলসুম (রা) এবং সাইয়েদেনা ফাতিমা জুহরা (রা)-র নাম নেই। আরও উল্লেখ নেই আল্লাহর রাসূল (সা)-এর ধাত্রীমাতা উম্মে আয়মান (রা)-এর নাম। তিনি প্রাথমিক ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন বলে খ্যাত। বিশ্বনবীর ৬ বছর বয়সকালে আবওয়া নামক স্থানে নবীমাতা আমিনার মৃত্যুকালে সাথী ছিলেন ধাত্রীমাতা উম্মে আয়মান (রা)। শিশু মুহাম্মদ (সা)-কে তিনিই মক্কায় এনে পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের কাছে পৌছিয়ে দেন।
ইবনে ইসহাক রচিত সীরাত গ্রন্থে আম্মার ইবনে ইয়াসার (রা)-এর নাম আছে, কিন্তু তদীয় মাতা সুমাইয়া (রা) এবং তাঁর স্বামী ইয়াসারের নাম নেই। বিবি সুমাইয়া (রা) ছিলেন মুসলিম মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম শহীদ। পুরুষদের মধ্যে প্রথম শহীদ ছিলেন সাইয়েদেনা খাদিজা তাহেরার পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত পুত্র হারিস ইবনে আবী হালা (রা)। তিনিও প্রথম দিককার মুসলিম। তাবকাতে ইবনে সাদের বর্ণনা মতে, ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে হযরত আবূ যর গিফারী (রা) ছিলেন পঞ্চম। নবুয়তের প্রথম তিনি বছরে ইসলাম গ্রহণকারী এমনি বহু সাহাবীর নাম ইবনে ইসহাক-প্রণীত তালিকা হতে বাদ পড়া অসম্ভব নয়।
সংগোপনে ইসলাম প্রচার
নবুয়তের প্রথম তিন বছরে সংগোপনে ইসলাম প্রচারের সময় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, মুসলিম সমাজে তাঁদের মর্যাদা অপরিসীম। তাঁদের এবং তাঁদের পূর্বপুরুষদের নামানুসারে মুসলিম শিশুর নামকরণে আপত্তি থাকার কথা নয়, যদি তা ইসলামী মূল্যবোধ-বিরোধী না হয়। আবূ তালিব, আবদুল্লাহ, আবদুল মুত্তালিব, আবদুল মন্নাফ, হাসেম প্রমুখ মুসলিম ছিলেন না। তাদের নামকরণে মুসলিম শিশুর নামকরণ হয়ে থাকে।
ইসলাম কবূল করার পর অন্যদেরকে নবগৃহীত ধর্মমতের দিকে আহ্বান করা ছিল নবুয়তের প্রারম্ভিক বছরসমূহে কষ্টকর। কলেমা তৈয়্যেবা গোপনে পাঠ করা যেত। কিন্তু প্রকাশ্যে দীনের শাহাদাত বা ঘোষণা দেওয়া এবং দাওয়াত দেওয়া কঠিন ছিল।
দীন প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে কাউকে দীন সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝানো যেত না। সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে পর্যাপ্ত সময়ের দরকার। দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু সে পরিবেশ তখন ছিল না।
একবার আলোচনা করে কাউকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মবিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করা যায় না। বারবার আলোচনা করতে হয়। কিন্তু বারবার আলোচনা করলে গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় না। স্বল্পকালীন আলোচনার মাধ্যমে প্রথমদিকে স্বল্পসংখ্যক সাহাবী ইসলাম কবূল করেন।
নবুয়তের প্রথম তিন বছরে দীনের প্রচার ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কারো উপরে গোপনীয়তা সম্পর্কে পরিপূর্ণ আস্থা না থাকলে ইসলামের কথা বলা যেত না। এমন ব্যক্তির কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছানো হতো, যিনি ইসলাম কবুল না করলেও অন্যকে তা বলবেন না। তাই দীন প্রচারের কাজ চলতো সংগোপনে।
পারস্পরিক আস্থার প্রয়োজনীয়তা কত গভীর ছিল এ বিষয়টি পরিষ্কার হয় ছোট্ট একটি ঘটনা থেকে। ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সা)-এর উপর পিতৃব্য আবূ তালিবের স্নেহ- ভালবাসা ছিল সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। রাসূল (সা) এবং বিবি খাজিদা (রা)-র যৌথ সালাত (নামায) দেখে ১০ বছর বয়স্ক আলীর ঔৎসুক্য সৃষ্টি হয়। এটা কোন্ ধরনের ইবাদত তা তিনি জানতে চান। রাসূল (সা) তা ব্যাখ্যা করলেন এবং তাঁকে দীনের দাওয়াত দিলেন। বালক আলী শুনে বললেন যে, এ বিষয়টি তিনি তাঁর পিতা আবৃ তালিবকে জিজ্ঞাসা করবেন। রাসূল (সা) হযরত আলীকে তা করতে নিষেধ করলেন। আবূ তালিবের নিজস্ব প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ইসলাম সম্পর্কে আবূ তালিবের সংগে আলোচনা করাও তৎকালীন প্রেক্ষাপটে রাসূল (সা) সুবিবেচনাপ্রসূত মনে করেন নি। হযরত আলী (রা) অবশ্য পিতাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা না করে নিজেই চিন্তা করলেন এবং পরের দিনই তিনি ইসলাম কবূল করলেন। ইসলাম প্রচারে কতুটুকু গোপনীয়তা প্রয়োজন ছিল তা এই ছোট্ট ঘটনা থেকে কিছুটা অনুধাবন করা যায়।
ইসলামের ভবনটি এখন বড় বেসামাল হয়ে গেছে। মুসলিমদের মধ্যে ঈমান, ইয়াকিন, তাওয়াক্কুল, খুলুসিয়াত ও ইসলামের অন্যান্য মৌলিক মূল্যবোধে বেজায় দুর্বলতা বিদ্যমান। হযরত মূসা (আ) আমাদের নবী (সা)-র উম্মত হতে না পারার কারণে আফসোস করেছিলেন। আর আজ আমাদের ঈমান, আকিদা, ব্যবহার, আচরণ এমন যে, মুশরিক, কাফির, পৌত্তলিকরা আমাদের দেখে আর আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে চায় না।
আধুনিক অনুষঙ্গে দাওয়াতের প্রাসংগিকতা
কালের করাল গ্রাসে প্রাচীন কোন প্রাসাদে ফাটল ধরতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ নকশা বা বাজে নির্মাণকাজের দরুন কোন নতুন দালানেও ফাটল দেখা দিতে পারে। ফাটল বড় হলে দালান ভাঙতেও হতে পারে, নইলে মেরামত করে নিতে হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত বা ফাটল-ধরা দালান মেরামত করতে কি ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয়? ফাটল যদি বীমে হয়, তাহলে তা সারাতে লাগে লোহার রড, সিমেন্ট, সুরকি, বালু ইত্যাদি। যদি দেয়ালে হয় সে ফাটল, লোহার রড হয়ত লাগবে না। বালু আর সিমেন্ট ব্যবহার করলেই চলতে পারে। দালান তৈরি করতে যে ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল, সে ধরনের উপকরণ মেরামত কার্যেও প্রয়োজন হয়।
দেহের অংগ-প্রত্যংগের ব্যাপারেও একই নিয়ম। চোখের কর্ণিয়া নষ্ট হয়ে গেলে তা তুলে নিয়ে মৃত ব্যক্তির কর্ণিয়া এনে সেখানে লাগানো হয়। শরীরের বিভিন্ন অংগে রক্তপ্রবাহ বিঘ্নিত হয় শিরা-উপশিরার অভ্যন্তরে চর্বি সঞ্চিত হওয়ার দরুন। দেহের অন্য জায়গা থেকে এর শিরা-উপশিরা কেটে এনে তা দিয়ে বাই-পাস করা হয়।
ইসলামের বিনষ্ট দেহাংশ মেরামতের জন্যে আমাদের প্রয়োজন সেসব মালমশলা, উপকরণ ও প্রথা যা দিয়ে প্রচার করা হয়েছিল ইসলাম, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দীনের ভবন। ইসলাম প্রচার হয়েছিল নবীদের মাধ্যমে। তাঁরা সে দুরূহ কর্মটি সম্পন্ন করেছিলেন এমন এক প্রকার ইবাদতের দ্বারা যা ছিল মূলত দাওয়াহ, দাওয়াহ-সংশ্লিষ্ট ও দাওয়াতের প্রতি উদ্দিষ্ট। সেই দাওয়াতের সুন্নাহ যদি পারি আমরা পুনরুজ্জীবিত করতে পারি, তাহলে আমরা সমর্থ হব আমাদের ইসলামকে মজবুত করতে। আর তাহলে হয়তোবা যা আমরা হারিয়েছি তা ফিরে পেতেও পারি।
বার্তা যদি পৌঁছানো না হয়
বড় অদ্ভুত ছিল সেই ডাকপিয়ন। প্রতিদিন বিস্তর চিঠি আসে, কিন্তু কোনটিই সে পৌঁছায় না প্রাপকের কাছে। সযত্নে সেসব পত্র সে গুছিয়ে রাখে। লোহার আলমারিতে ভরে রাখে। রেজিষ্ট্রি চিঠি হলে রীতিমত সীল করে ডবল তালা মেরে নিরাপদ রাখে, যেন কিছুই না হারায়। কী ভীষণ ‘কর্তব্যপরায়ণ’ ডাক-পিয়ন!
এহেন কঠিন কর্তব্যপরায়ণ ডাকপিয়ন সম্বন্ধে কি ধারণা হবে চিঠির প্রেরক ও প্রাপকদের? তাদের চিঠি প্রাপকের কাছে না পৌঁছিয়ে এমন সযত্নে নিজের কাছে রেখেছে বলে কি প্রেরক বা প্রাপক খুব খুশি হবে? আমাদের নবী করীম (সা)-এর কাছে আল্লাহ্ তাঁর বাণী প্রেরণ করেছিলেন তাঁর নিজের কাছে রেখে দেওয়ার জন্যে নয়; তা অন্যের কাছে পৌঁছানোর জন্যে। এই কাজটি সম্ভব হয়েছিল কেবল প্রতিনিয়ত দাওয়াতের মাধ্যমে। নবুয়তের দরজা বন্ধ হওয়ার পর এ দায়িত্ব বর্তিয়েছে আমাদের উপর। আমরা আল্লাহর বাণীকে পরম শ্রদ্ধায় নিজেদের কাছে বন্দী করে রেখে সে ‘দায়িত্ব’ পালন করছি!
কেউ যদি ইসলাম সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান আহরণ করে, তাহলে তা অন্যের কাছে পৌঁছানো তার কর্তব্য। এ হচ্ছে আমাদের রাসূল করীম (সা)-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে অবশ্যপালনীয় সুন্নাহ। দীন সম্পর্কীয় জ্ঞান গোপন রাখার বস্তু নয়। কারো ব্যক্তিগত জ্ঞান ভান্ডারে সঞ্চয় করে রাখার ধন নয়, এ জ্ঞান শাহাদাত প্রদানের জন্যে, দাওয়াতের জন্যে।
আর এ দাওয়াতের দ্বারাই ইসলামী কল্যাণ-সমাজ তথা ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব; দাওয়াতের কল্যাণী ধারাকে অবহেলা করে নয়।
***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।