আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় [পর্ব-১]

রচনায় : ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম

ভূমিকা :

মানব সমাজের ভিত্তি পরিবার। স্বামী-স্ত্রীকে কেন্দ্র করে যা শুরু হয়। আদম-হাওয়া (আঃ)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রথম মানব পরিবার গড়ে ওঠে। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে আজও এ পরিবার প্রথা চালু আছে। সারা দিনের কর্মক্লান্তি, বিভিন্ন কারণে মানব মনে পাওয়া দুঃখ-বেদনায় যেখানে সবাই শান্তি খোঁজে সেটা হ’ল পরিবার। যদি পরিবারে শান্তি-শৃংখলা থাকে তাহ’লে মানব জীবন সুখময় হয়। পক্ষান্তরে পরিবারে কাঙ্ক্ষিত শান্তি না থাকলে জীবন হয়ে ওঠে বিতৃষ্ণ, বিষাদময়। এজন্য দরকার একটি আদর্শ পরিবার। যা হবে মানুষের আরাম-আয়েশ ও সুখ-শান্তির আকর। তাই শান্তি-সুখের ঠিকানা আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় সম্পর্কে এ নিবন্ধের অবতারণা।

পরিবার পরিচিতি :

স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা ও দাদা-দাদী নিয়ে গঠিত হয় পরিবার। পরিবারের সংজ্ঞায় Oxford ইংরেজী অভিধানে বলা হয়েছে, A group consisting of one or two parents their children. ‘পরিবার হ’ল পিতা বা মাতা অথবা পিতা-মাতা উভয় ও তাদের সন্তান-সন্ততির সমষ্টি’।[1]

পরিবারের সূচনাকাল :

পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ) ও প্রথম মানবী হযরত হাওয়া (আঃ)-কে কেন্দ্র করে মানব জাতির প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল জান্নাতে। এই প্রথম পরিবারের সদস্য স্বামী ও স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ বলেছিলেন,يَاآدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُوْنَا مِنَ الظَّالِمِيْنَ- ‘হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান কর এবং সেখান থেকে যা চাও খুশীমনে খাও। কিন্তু তোমরা দু’জন এই গাছটির নিকটে যেয়ো না। তাহ’লে তোমরা সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে(বাক্বারাহ ২/৩৫)

এই প্রথম পরিবার থেকে মানব জাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। এসম্পর্কে আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوْا اللهَ الَّذِيْ تَسَاءَلُوْنَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا- ‘হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঐ দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা করে থাক এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর সদা সতর্ক তত্ত্বাবধায়ক’ (নিসা ৪/১)। অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَّأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَّقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا- ‘হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। তারপর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)

অনুরূপভাবে সকল নবী-রাসূলের ব্যক্তিগত জীবনে ও সময়কালে পরিবার বিদ্যমান ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلاً مِنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً ‘তোমার পূর্বেও আমরা অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তানাদি দিয়েছি’ (রা‘দ ১৩/৩৮)। হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় পরিবারের জন্য দো‘আ করেছিলেন,رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ- ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদেরকে আপনার আজ্ঞাবহ করুন এবং আমাদের বংশধরগণের মধ্য হ’তেও আপনার অনুগত একটা দল সৃষ্টি করুন। আর আপনি আমাদেরকে আমাদের হজ্জের নিয়ম-পদ্ধতি বাৎলে দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি অধিক তওবা কবুলকারী ও দয়াময়’ (বাক্বারাহ ২/১২৮)

পরিবারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :

পরিবার মানব সমাজের মূল ভিত্তি। পারিবারিক জীবন ব্যতিরেকে মানব সভ্যতা কল্পনা করা যায় না। মানুষের অস্তিত্বের জন্য পারিবারিক জীবন অপরিহার্য। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, উন্নতি-অগ্রগতি ইত্যাদি সুষ্ঠু পারিবারিক ব্যবস্থার উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। পারিবারিক জীবন অশান্ত ও নড়বড়ে হ’লে, তাতে ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিলে সমাজ জীবনে নানা অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হ’তে বাধ্য। তাই বলা যায়, পরিবারই হচ্ছে কল্যাণকর সমাজের ভিত্তি। সুতরাং আদর্শ সমাজ গঠনের অপরিহার্য শর্ত আদর্শ পরিবার গঠন। পরিবারের গুরুত্বের বিভিন্ন দিক নিম্নে উলেলখ করা হ’ল।-

১. মানব বংশ বৃদ্ধি : পরিবারের মাধ্যমে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন,وَاللهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِيْنَ وَحَفَدَةً وَّرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ- ‘আর আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের পুত্র-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র বস্ত্তসমূহ হ’তে রূযী দান করেছেন’ (নাহল ১৬/৭২)

এভাবে রাসূলের উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর উম্মতে মুহাম্মাদীর সংখ্যাধিক্য পরকালে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য গর্বের বিষয় হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَزَوَّجُوْا الْوَدُوْدَ الْوَلُوْدَ فَإِنِّىْ مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ ‘তোমরা  অধিক  সোহাগিনী  ও  অধিক সন্তানদায়িনী মহিলাকে বিবাহ কর। কারণ আমি ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে গর্ব করব’।[2]

২. মানববংশ সংরক্ষণ : পরিবারের মাধ্যমে মানববংশ রক্ষা হয়। আল্লাহ বলেন,وَهُوَ الَّذِيْ خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيْرًا ‘তিনিই মানুষকে পানি হ’তে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বিবাহগত সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। আর তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান’ (ফুরক্বান ২৫/৫৪)। এ পরিবারের সদস্যদের মাঝে স্নেহ-মায়া-মমতা, সম্প্রীতি-সদ্ভাব তৈরী হয়। তাদের পরস্পরের মধ্যে থাকে সুসম্পর্কের সুদৃঢ় সেতুবন্ধন। কারণ সেখানে থাকে পিতামাতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, অনেক ক্ষেত্রে দাদা-দাদী, পৌত্র-পৌত্রী ইত্যাদি সম্পর্কের মানুষ। পরিবারে পিতামাতা সন্তানকে শৈশবে লালন-পালন করেন। তেমনি সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পিতামাতাকে দেখাশোনা করে। পৌত্ররাও দাদা-দাদীর সেবাযত্ন করে থাকে। এভাবে একে অপরের মাধ্যমে মানব বংশ রক্ষা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হ’ল এখন মানুষ বিভিন্ন অযুহাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জন্ম নিরোধ করছে। লাইগেশনের মাধ্যমে বা অন্য কোন উপায়ে স্থায়ীভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জন্ম নিরোধ করা হারাম। কেউবা ভ্রূণ হত্যা করে। শারঈ কোন কারণ  ব্যতীত ভ্রূণ হত্যা মানবহত্যার শামিল। এসব থেকে বিরত থাকা অতীব যরূরী।

৩. শিক্ষা প্রদান : পরিবার এক অনন্য শিক্ষাগার। এখানে পিতামাতা সন্তানকে সুশিক্ষিত করে তোলে। পিতামাতার নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেই সন্তান সুনাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,كُلُّ مَوْلُوْدٍ يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ- ‘প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাতের (ইসলাম) উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বা খৃষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক বানায়’।[3] সুতরাং সৎ ও চরিত্রবান নাগরিক গড়ার প্রথম ভিত্তি হচ্ছে পরিবার। শিশুরা আদর্শবান হয়ে গড়ে ওঠে পরিবার থেকে। তাই পারিবারে যে শিশু সঠিকভাবে গড়ে ওঠে, সে বড় হয়েও সঠিক পথে অবিচল থাকে। পক্ষান্তরে যে শিশু পরিবারে খারাপ শিক্ষা পায়, সে বড় হয়েও খারাপ পথেই চলতে থাকে। এজন্য পিতা-মাতা সন্তানকে আল্লাহভীতি, পরকালীন জবাবদিহিতা, মুসলমানদের দায়িত্ব-কর্তব্য, আল্লাহর হক, বান্দার হক, পারস্পরিক সহমর্মিতা শিখানোর চেষ্টা করবেন। এর পাশাপাশি সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিবেন। যাতে তারা নিজেদের অভিভাবকহীন ভাবতে না পারে এবং সঠিক তত্ত্বাবধায়নের অভাবে বখে না যায়। পাশাপাশি তাদের সার্বিক বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখবেন এবং তাদের সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবদের সম্পর্কেও নযর রাখবেন। যাতে অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ না হয়।

৪. শান্তি লাভ ও পারিবারিক মহববত সৃষ্টি : পরিবারেই মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে এবং তাদের মধ্যে মহববত-ভালবাসা তৈরী হয়। আল্লাহ বলেন,وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجاً لِتَسْكُنُوْا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُوْنَ، ‘তাঁর নিদর্শনের মধ্যে হ’ল এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হ’তেই তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি  করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে’ (রূম ৩০/২১)

পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি একত্রে বসবাস করেন। একসাথে থাকার ফলে একে অপরের সুখে সুখী হয়, এক অপরের দুঃখে দুঃখী ও সমব্যথী হয়। এভাবে পরিবারের সদস্যরা পরস্পরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকে। পরিবারের এ বন্ধন আমাদের দেশে খুবই পরিচিত চিত্র। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, বর্তমানে চিরচেনা এ পরিবার প্রথা বিলুপ্তির পথে। একে সামাজিক বিপর্যয় বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। পারিবারিক বিপর্যয়রোধে অনেকেই সচেষ্ট। নানাবিধ কলাকৌশল প্রয়োগ করে পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত। অথচ মানব চিন্তা যতই শাণিত হোক, উন্নত ও আধুনিক বলে দাবী করা হোক না কেন, আল্লাহ প্রদত্ত নির্ভুল জ্ঞানের সহায়তা ব্যতীত প্রকৃত সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই পারিবারিক বিপর্যয়রোধে ইসলামের বিধান অনুসরণের বিকল্প নেই। এ পথেই রয়েছে সুষ্ঠু সমাধান। ইসলাম আগে ব্যক্তি সংশোধনে গুরুত্বারোপ করেছে। কারণ ব্যক্তি ঠিক হ’লে পরিবার ও সমাজ উভয়ই ঠিক হয়ে যায়। একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পূর্বে যেমন ভিত্তি ঠিক করতে হয়, তেমনি পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হ’লে একটি আদর্শ পরিবার গঠন করতে হয়। কেননা সমাজবিজ্ঞানী ও মুসলিম মনীষীগণের দৃষ্টিতে মানবসমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে পরিবার।

সম্প্রতি আমাদের দেশের অনেক মানুষ পারিবারিক বন্ধনের কথা ভুলতে বসেছে। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। পরিবারের প্রতি মানুষ বৈষ্যমূলক বিভিন্ন অন্যায়-আচরণ করছে। পরিবারের বড়দের সম্মান এবং ছোটদের প্রতি স্নেহসুলভ আচরণ করা হচ্ছে না। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيْرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا، ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদেরকে স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান বোঝে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[4] ইসলামে পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, ইসলামে তার সবকিছু বিদ্যমান। সুতরাং সে বিধান মেনে চলার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত।

পারিবারিক জীবন যে শুধু দুনিয়াতেই কল্যাণ বয়ে আনে এবং এ বন্ধন যে কেবল পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়, বরং সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের জন্য এ বন্ধন জান্নাতেও বিদ্যমান থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন,جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُوْنَهَا وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ، ‘তা হ’ল স্থায়ী বসবাসের জান্নাত। তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি। ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে’ (রা‘দ ১৩/২৩)

৫. জৈবিক চাহিদা পূরণ ও লজ্জাস্থান হেফাযত : পারিবারিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের স্বভাবসিদ্ধ জৈবিক চাহিদা বৈধ পথে পূরণ করার সুযোগ হয়। ফলে লজ্জাস্থান হেফাযত করা যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা উহা লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে এবং চক্ষুকে অবনমিত রাখে’।[5] আর এই বৈধপন্থায় নারী-পুরুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে উভয়ে নৈতিক স্খলন থেকে বেঁচে যায়, পাপাচার থেকে পরিত্রাণ পায় এবং ছওয়াব লাভ করে।

রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَفِىْ بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ، قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيَأْتِىْ أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ وَيَكُوْنُ لَهُ فِيْهَا أَجْرٌ قَالَ أَرَأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِىْ حَرَامٍ أَكَانَ عَلَيْهِ فِيْهَا وِزْرٌ فَكَذَلِكَ إِذَا وَضَعَهَا فِىْ الْحَلاَلِ كَانَ لَهُ أَجْرٌ، ‘তোমাদের কারো স্ত্রীর সাথে সহবাস করাও ছাদাক্বাহ। ছাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কেউ যদি নিজের কামভাব চরিতার্থ করে তাতেও কি সে ছওয়াব পাবে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের অভিমত কি যে, কোন ব্যক্তি যদি হারাম উপায়ে কামভাব চরিতার্থ করে তাহ’লে সে কি গুনাহগার হবে? ঠিক এভাবেই হালাল উপায়ে (স্ত্রীর সাথে) কামভাব চরিতার্থকারী ছওয়াব পাবে’।[6]

৬. পারিবারিক জীবন যাপন করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য : মুমিন বান্দাদের অন্যতম গুণ সুন্দর পারিবারিক জীবন যাপন। এজন্য তারা মহান আল্লাহর কাছে দো‘আ করে এই বলে,رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَّاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَامًا- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের মাধ্যমে চক্ষুশীতলকারী বংশধারা দান কর এবং আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ বানাও’ (ফুরক্বান ২৫/৭৪)

পারিবারিক জীবনের সুফল :

পরিবারের সুফল অনেক মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাদান ইত্যাদি। পরিবারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব শিশুকে সামাজিক করে গড়ে তোলা এবং ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন শিক্ষা দেওয়া। পরিবারের ধারা ও রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে শিশুর মনোজগত তৈরী হয় এবং পরিবারে তার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। সুতরাং শিশুর সুষ্ঠু শিক্ষা দিতে পরিবার বিশেষ ভূমিকা রাখে।

পরিবার একটি সার্বজনীন পদ্ধতি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। সারা বিশ্বে পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়। পরিবার একজন মানুষের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সকলের দায়িত্ব। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ একেকটি পরিবার বহু হৃদয়ের সমষ্টি, যেখানে আছে জীবনের প্রবাহ, আছে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা, মিলেমিশে থাকার প্রবল বাসনা, আছে নিরাপত্তা, সহনশীলতা এবং পরস্পরকে গ্রহণ করার মানসিকতা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পারিবারিক বন্ধনের প্রভাব বিস্তৃত।

বিশ্বের প্রতিটি দেশে ও জাতির নিকটে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমমর্যাদার নিশ্চয়তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশের মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতি সাধন ও জীবন মান উন্নয়নে পরিবার সমাজের স্তম্ভ ও মৌলিক ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখান থাকে ভবিষ্যত জীবনের পথ নির্দেশনা।

পারিবারিক বন্ধন থেকেই মানব বংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। যদি সকল মানুষ পরিবারে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তবে সে পরিবার সমাজে উত্তম ও আদর্শ পরিবার হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যেখানে বইতে থাকে শান্তির ফল্গুধারা। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জীবন হবে সুখকর ও আনন্দময়।

স্মর্তব্য যে, ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে একটি দেশ বা রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই ব্যক্তি ভালো হ’লে পরিবার ভালো হবে, পরিবার ভালো হ’লে সমাজ ভাল হবে। আর সমাজ ভালো হ’লে দেশ বা রাষ্ট্র ভালো চলবে। সমাজে এখনো বহু ভালো মানুষ আছেন, যারা প্রকৃতপক্ষেই চান যে, সমাজে ভালো মানুষই থাকুক, মানবরূপী কোন দানব না থাকুক। ব্যক্তি সংশোধনের মাধ্যমে পরিবার ঠিক করে ঐসব মানবরূপী দানবদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা এবং মযবূত করতে হবে পারস্পরিক সম্পর্কের সেতু বন্ধন। এক্ষেত্রে একে অন্যের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সুন্দর পরিবার গঠন ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য।

পরিবার নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি শিশু সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। শিশুরা পরিবারে যে শিক্ষা পায় বড় হয়ে সে ঐ শিক্ষানুযায়ী চলে। আর পরিবারে একই সঙ্গে মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি মিলেমিশে থাকে। একজনের সুখে অন্যজন আনন্দিত হয় এবং একজনের দুঃখে অন্যজন অশ্রু ঝরায়। এ নিবিড় বন্ধন থাকে কেবল পরিবারের মধ্যে। ফলে সদস্যরা একে অন্যকে নানাভাবে সাহায্য করে।

পরিবারের মূল চাবিকাঠি থাকে পিতা-মাতার হাতেই। আর সকল পিতা-মাতাই চান তাদের সন্তান ভালো হোক, ভালোভাবে চলুক এবং নিজের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলুক। তাই সুন্দর একটি পরিবার গড়ে তুলতে পিতামাতার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও চিরন্তন। সন্তানকে সুপথে চালিত করতে তাদেরকেই ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পরিবারের সদস্যরা যখন আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকবে; স্ত্রী তার অধিকার পূর্ণভাবে লাভ করবে; স্বামী যখন স্ত্রীর নিকট তার অধিকার পাবে, সন্তান পিতা-মাতার ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করবে ও তাদের অধিকার পাবে; আত্মীয়-স্বজন যখন পরস্পরের যথাযথ সম্মান-মর্যাদা পাবে, তখন কোন স্ত্রী অধিকারের দাবীতে প্রকাশ্য রাজপথে বের হবে না, কোন স্বামী ভালোবাসা ও সুনদর জীবন-যাপনের প্রত্যাশায় অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হবে না, কোন সন্তানই পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করবে না। বরং পরিবারে সবার মাঝে সুসম্পর্কের কারণে আল্লাহর রহমত, অনুগ্রহ-অনুকম্পা বর্ষিত হ’তে থাকবে।

অপরদিকে ইসলাম নির্দেশিত পারিবারিক জীবন হ’ল আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত পারিবারিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হ’লে সমাজ থেকে পরকীয়া, লিভটুগেদার, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ-অপহরণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ও প্রেমে ব্যর্থদের আত্মহত্যাসহ সকল প্রকার অপরাধ নির্মূল হবে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরাণোর মতো দুঃসহ জীবন-যাপন বন্ধ হবে। তাই একটি সুন্দর ও আদর্শ পরিবার গঠনের লক্ষ্যে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।

পরিবার না থাকার ক্ষতিকর দিকসমূহ :

পরিবার মানুষের জন্য যেমন নিরাপদ আশ্রয়স্থল, তেমনি মানসিক প্রশান্তি লাভের স্থান। মানবজীবনে পরিবার তাই এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। কিন্তু পরিবার না থাকলে মানুষকে নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হ’তে হয়। তন্মধ্যে কয়েকটি দিক নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

ক. নিরাপত্তাহীন হওয়া : পরিবার মানুষের জন্য এক সুন্দর আশ্রয়। পার্থিব জীবনে সংঘটিত বিভিন্ন বিপদাপদ, অসুখ-বিসুখ, ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-যাতনা ইত্যাদির শিকার হয়ে মানুষ অনেক সময় দিশাহারা হয়ে যায়। এ সময় পরিবারের অন্যান্য সদস্য তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। অসুখে সেবা করে, বিপদে সাহায্য করে, দুঃখ-কষ্টে সান্ত্বনা দেয় এবং শোকে সমব্যথী হয়। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মানুষের জন্য এসব পাওয়ার উপায় থাকে না। ফলে সে হয়ে পড়ে উদ্ভ্রান্ত। তার জীবনের নিরাপত্তা থাকে না। কখনও কখনও সে কোথাও মরে পড়ে থাকলে তার খোঁজ-খবর নেওয়ার বা তাকে কাফন-দাফন করার মত লোকও থাকে না।

খ. সহযোগিতা না পাওয়া : অর্থ মানব জীবনের এক আবশ্যিক বিষয়। রক্ত ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না অর্থ ছাড়া তেমনি জীবন চলে না। তাই বিভিন্ন সময়ে মানুষের অর্থের প্রয়োজন হয়। পরিবারের লোকেরাই সেই প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসে। তাছাড়া জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানুষ কর্মক্ষম থাকে না। জীবনের সূচনাকালে যেমন সে অক্ষম ও পরনির্ভরশীল থাকে, তেমনি জীবনের শেষ বেলায় সে আবার অক্ষম ও পরনির্ভরশীল হয়ে যায়। এ সময়ে পরিবারভুক্ত মানুষ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য পায়। তার সার্বিক প্রয়োজন পূরণে তারা এগিয়ে আসে। অথচ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মানুষের সাহায্যে তেমন কেউ এগিয়ে আসে না।

গ. বন্ধনহীন হওয়া : একেকটি পরিবার মূলতঃ কতগুলো হৃদয়ের সমষ্টি, যেখানে আছে জীবনের প্রবাহ, মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা, যত্ন-আত্তি, সেবা-পরিচর্যা, নিরাপত্তা, মিলেমিশে থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, সহনশীলতা এবং একে অন্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মানুষ এসব সুযোগ-সুবিধা পায় না।

উল্লেখ্য যে, দেশ-কাল, সমাজ-পারিপার্শ্বিকতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, দায়িত্ব-কর্তব্য ও রীতিনীতির কারণে পরিবারের রূপ ভিন্ন হয়। কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হচ্ছে পরিবারের কাঠামো ও এর আকার-আয়তন। বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গঠিত হচ্ছে একক পরিবার। দেখা দিচ্ছে এক ধরনের বন্ধনহীনতা। যা কোন জ্ঞানী মানুষের কাম্য নয়।

ঘ. নৈতিক অবক্ষয় : বর্তমান সমাজের অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে পরিবারকে কেন্দ্র করে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে ঘরে দাউ দাউ করে জ্বলছে অশান্তির আগুন। পরিবারগুলোর অশান্তির প্রভাব পড়ছে সমাজে। ডিস, সিডি, ইন্টারনেট, মোবাইল, সাইবারক্যাফে ইত্যাদির মাধ্যমে পর্ণোছবি দেখা, ব্লাক মেইলিং, ইভটিজিং বাড়ছে মহামারীর ন্যায়। অশালীন পোশাক, রূপচর্চা, ফ্যাশন, অবাধ মেলামেশা, যত্রতত্র আড্ডা, প্রেমালাপ, মাদক, পরকীয়া, অবৈধ যৌনাচার ও সন্ত্রাসের সয়লাব চলছে সমাজের সর্বত্র। এ সকল কাজে যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, তা জোগাড় করতে গিয়ে পরিবারের সাথে বাক-বিতন্ডা, মনোমালিন্য, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানী, কিডন্যাপ ও খুন-খারাবী কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এর নেতিবাচক পরিণতি হিসাবে পারিবারিক সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটছে। বস্ত্ততঃ এ ধরনের সামাজিক অস্থিরতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় পুরো সমাজকে এক চরম ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

নানা অত্যাচারে অতিষ্ঠ অভিজাত পিতা-মাতা যেন যিম্মী হয়ে আছেন তরুণ-যুবক সন্তান-সন্ততির কাছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও যেন পিতামাতার মতই অসহায়। আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছেন সংশ্লিষ্টরা। সমাজের অবক্ষয়ের কারণে যুব সমাজের কল্যাণময় অবদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলে। এজন্য পারিবারিক ব্যবস্থাকে সংস্কারে নযর দেয়া সকলের জন্য যরূরী।

বর্তমানে যে সকল পরিবার সন্তানের প্রতি উদাসীন, সন্তানের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করেন না, তাদের অধিকাংশের যুবক-তরুণ সন্তান-সন্ততি উচ্ছৃঙ্খল ও অনৈতিক জীবন যাপন করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ধনী ও দরিদ্র শ্রেণী।

এদের মাঝে ধর্মীয় অনুশীলন, ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা, পারিবারিক বোঝাপড়া, পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নেই বললেই চলে। ধনী শ্রেণী বৈধ-অবৈধ পন্থায় টাকা উপার্জন করে এবং ভোগ-বিলাসেই মত্ত থাকে অধিকাংশ সময়। সন্তান চাইলেই তারা টাকা-পয়সা দিয়ে এবং পোশাক-পরিচ্ছদ, দামি মোবাইল, গাড়ি ইত্যাদি কিনে দিয়েই দায়মুক্ত হয়। অন্ধস্নেহে সন্তানের কোন ভুল-ত্রুটি অভিভাবকের চোখে ধরা পড়ে না। বর্তমান সময়ের অভিভাবকগণ এসব ব্যাপারে আগের মত সিরিয়াস নন, তারা কেবল অর্থের পিছনে ছুটছেন। সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের একমাত্র বা প্রধান লক্ষ্য। ধর্মকর্ম, নীতি-নৈতিকতা তাদের কাছে গৌন হয়ে গেছে। সন্তান-সন্ততিকে সময় দেয়ার মত ফুরসত নেই, সন্তান-সন্ততিও তাই কথা শুনছে না। ছোট-বড় সকলে তথাকথিত প্রগতি বা উন্নয়নের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়ায় সমাজ ব্যবস্থা দ্রুত নষ্ট ও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে দরিদ্র শ্রেণীর সন্তানরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অশিক্ষা-কুশিক্ষা পেয়ে বেড়ে ওঠে। সন্তান একটু বড় হ’লেই তারা অর্থ উপার্জনে লাগিয়ে দেয়। এই দুই শ্রেণী সাধারণত নিজেরাও ধর্মকর্ম করে না, সন্তানকে খুব একটা শিক্ষা দেবারও প্রয়োজন অনুভব করে না। ফলে স্বাভাবিকভাবে এই শ্রেণীর সন্তানদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেশী থাকে।

বলা যায় যে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোই মোটামুটি সমাজের সজাগ ও সচেতন শ্রেণী। এসব পরিবারই সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলার ভারসাম্য ধরে রাখে। এ সকল পরিবারের অভিভাবকগণ সন্তানদেরকে লেখাপড়ার পাশাপাশি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও যত্নের সাথে ধর্ম-কর্ম, আদব-কায়দা, ভদ্রতা-শালীনতা, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে থাকেন। সেজন্য এ অংশে সহজে ফাটল ধরে না। কিন্তু ফাটল সৃষ্টি হ’লে তা হবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তাই এ শ্রেণীসহ সমাজের সকল শ্রেণীর পরিবারে নৈতিকতার মানোন্নয়নের মাধ্যমে অবক্ষয় রোধ করার চেষ্টা করতে হবে।

ঙ. সংসার বিরাগী হওয়া : সংসার বিরাগী হওয়া বা বৈরাগ্য জীবন যাপন করার অনুমতি ইসলামে নেই। আল্লাহ বলেন, وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ ‘আর বৈরাগ্যবাদ- তা তারা নিজেরাই নতুনভাবে চালু করেছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। আমরা তাদের উপর এ বিধান অপরিহার্য করিনি’ (হাদীদ ৫৭/২৭)। আয়াতে খ্রীষ্টানদের বৈরাগ্যবাদের কথা বলা হয়েছে। এসব থেকে ইসলাম মানুষকে সাবধান করেছে। হাদীছে এসেছে, সা‘আদ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন,رَدَّ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى عُثْمَانَ بْنِ مَظْعُوْنٍ التَّبَتُّلَ، وَلَوْ أَذِنَ لَهُ لاَخْتَصَيْنَا ‘রাসূল (ছাঃ) ওছমান ইবনু মাযঊনকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের অনুমতি দেননি। তাকে অনুমতি দিলে আমরা নির্বীর্য হয়ে যেতাম’।[7] আয়েশা (রাঃ) বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَهَى عَنِ التَّبَتُّلِ ‘নিশ্চয়ই রাসূল (ছাঃ) নিঃসঙ্গ জীবন যাপনকে নিষেধ করেছেন’।[8]

সুতরাং পারিবারিক জীবন পরিহার করে সংসারত্যাগী হওয়ার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমানে এক শ্রেণীর লোক তাবলীগের নামে পরিবার-পরিজনকে ফেলে রেখে এক মাস, তিন মাস, এক বছর বা জীবন চিল্লায় বের হয়। পরিবারের সাথে তাদের যোগাযোগ এবং ক্ষেত্র বিশেষে খোঁজ-খবরও থাকে না। এভাবে দ্বীন প্রচার করা নবী-রাসূলগণের পদ্ধতি নয়। এটা খ্রীষ্টানদের বৈরাগী ও হিন্দুদের সন্ন্যাসী হওয়ার সাথে তুলনীয়। অতএব এসব পরিত্যাজ্য।

চ. উদ্দেশ্যহীন জীবন : পরিবার মানুষকে একটি স্থানে ও একটি লক্ষ্যে চলতে সাহায্য করে। কখনও সে লক্ষ্যচ্যুত হ’লে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাকে সঠিক পথে চলতে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ফিরে আনতে তৎপর হয়। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে না। সে যা ইচ্ছা তাই করে, যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে চলে যায়। পারিবারিক বন্ধনহীন এই জীবন যেন হাল বিহিন নৌকার মত। সুতরাং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনকে অশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া কোন বিবেকবান মানুষের জন্য সমীচীন নয়।

[চলবে]

তথ্যসূত্র : 

[1]. Oxford Advance Laerners English Dictionary, (New Yeork : Oxford University press, 8th edn, 2010), p-551.

[2]. আবুদাঊদ হা/২০৫০; মিশকাত হা/৩০৯১, সনদ ছহীহ

[3]. বুখারী হা/১৩৬৫; মুসলিম হা/২৬৫৮; মিশকাত হা/৯০

[4]. আবু দাউদ হা/৪৯৪৩; তিরমিযী হা/১৯১৯; ছহীহাহ হা/২১৯৬

[5]. বুখারী হা/৫০৬৬; মুসলিম হা/১৪০০; মিশকাত হা/৩০৮০

[6]. মুসলিম হা/১০০৬; মিশকাত হা/১৮৯৮

[7]. বুখারী হা/৫০৭৩; মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮১, ‘বিবাহ’ অধ্যায়।

[8]. নাসাঈ হা/৩২১৩; তিরমিযী হা/১০৮২; ইবনু মাজাহ হা/১৮৪৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৮৬৭।  

– See more at: http://at-tahreek.com/site/show/1027#sthash.bR62Czab.dpuf

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot gacor skybet88 slot online skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot shopeepay slot gacor skybet88 demo slot skybet88 skybet88 skybet88 skybet88