ইসলামে পরিবারের মর্যাদা ও নারীর স্থান
রচনায় : আবুল হাশিম, ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকা
ভূমিকা
কোনো কানুন, যে কোনো আদেশ-নিষেধ, নির্দেশ বা ব্যবস্থাপত্রের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে তার সংগে সুসমঞ্জস সমাজ-ব্যবস্থা। আদর্শ যত সুষ্ঠু ও প্রগতিশীল হোক না কেন, তা কখনো এমন। সমাজে বাস্তবায়িত হতে পারে না যার সংগে আদর্শটি সুসমঞ্জস নয়। উদাহরণত, বৃটিশ জাতির আইনের শাসন সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রচলন করা সম্ভব নয় ; আবার ব্যক্তি-স্বাধীনতার অস্বীকৃতিমূলক সোভিয়েত আইন গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া যাবে না। ইসলামের বেলায়ও এ কথাই খাটে। আল-কুরআনের আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধ, নির্দেশ বা ব্যবস্থাকে আল-কুরআন-পরিকল্পিত সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে, ব্যাখ্যা ও বিচার করতে হবে।
এই আল্লাহ-প্রদত্ত পবিত্র গ্রন্থ কারো প্রতি কোনরূপ যথেচ্ছ অনুগ্রহ দেখায় না বা নির্বিচারে কারো প্রকৃতিদত্ত সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেয় নো। আল-কুরআন বাস্তবেরই বর্ণনা করে এবং মানুষের সত্যিকার প্রকৃতির ব্যাখ্যা করে ও মানুষের মৌলিক প্রকৃতির ভিত্তিতে তার মানবিক বিকাশের সহায়ক একটি সমাজ-ব্যবস্থার নির্দেশ দেয়। কেউ যখন বলে যে, গরুর দুটো শিং বা বানরের কোন শিং নেই, তার মানে এ নয় যে, সে গরুর মাথায় দুটো শিং যুক্ত করেছে বা বানরের মাথার প্রকৃতিদত্ত শিংগুলি উপড়ে ফেলে দিয়েছে। গরুর শিং না থাকলে বা বানরের শিং থাকলে ভালো হতো কিনা সে হচ্ছে অলস কল্পনার বিষয়বস্তু।
কোন জিনিস তখনই ভালো, যখন সে জিনিসটি তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। একটি কলসীকে তখনই ভালো বলব, যখন তা পানি ধারণ করতে সক্ষম। কসলীতে যতই কারুকার্যের চমৎকারিত্ব থাকুক না কেন, তলায় যদি একটা বড়ো ফুটো থাকে, তা নিশ্চয়ই খারাপ। মানুষকে বিচার করবারও এই একই নিয়ম নারী যখন তার নিজস্ব মন্ডল বা বৃত্তের মধ্যে থাকে, তখনই সে ভালো—ঠিক যেমন, পুরুষও ততক্ষণই ভালো যতক্ষণ সে নিজস্ব গণ্ডী অতিক্রম করে না। সে সীমারেখার মধ্যে থেকে যে নারী বা যে পুরুষ সুষ্ঠুভাবে জীবন যাপন করে চলেছে, তাকেই বলা হবে সৎ। সৃষ্টি-জগতে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা অভিন্ন নয়। বিশ্ববিধাতা তাঁর অন্তহীন জ্ঞানের আলোকে পুরুষ ও নারীর দেহমন ও বুদ্ধিকে এমনভাবে তৈরী করেছেন, যাতে করে তারা উভয়েই নিজ নিজ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে প্রশংসনীয়ভাবে চরিতার্থ করার উপযোগী হয়। কিন্তু কোনো পুরুষ যদি নিজ সীমালংঘন করে নারীর নিজস্ব জগতে প্রবেশ করতে চায়, অথবা নারী যদি সেভাবে পুরুষের নিজস্ব গণ্ডীতে অনুপ্রবেশ করে, তা হলে দু’জনেই নিজ নিজ স্বাভাবিক বৃত্তি থেকে বিচ্যুত হবে এবং নিজেদেরকে চূড়ান্ত হীন অবস্থায় অধঃপতিত করবে।
ধনতন্ত্রবাদ তার অবিচ্ছেদ্য ও পরিণামী পাপগুলোর সংগে সংগে পারিবারিক জীবনকেও প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে একটি অর্থনৈতিক ইউনিটে (Unit) পর্যবসিত করেছে। এখন পরিবার বলতে বুঝায় একজন পুরুষ, তার স্ত্রী ও অপ্রাপ্তি-বয়স্ক ছেলেমেয়েদের একটা ক্ষুদ্র সংস্থা। ধনতন্ত্রবাদ আজ পারিবারিক জীবনের শুধুমাত্র বৈষয়িক মূল্য ছাড়া আর সব মূল্যকেই ধ্বংস করেছে। ইসলামে পরিবার একটি অর্থনৈতিক একক মাত্র নয়-বরঞ্চ এ হচ্ছে সমুদয় মানবিক মূল্যের মৌলিক অনুশীলন-পরিশীলনের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ। সমাজবিবর্তনের সামগ্রিক ধারায় মানুষের সামাজিক জীবনের মৌলিক ইউনিট হিসাবেই পরিবার প্রথা মর্যাদা পেয়ে এসেছে এবং মানব জাতি যদি কখনো, আল-কুরআনে যেমন বলা হয়েছে ? ‘মানুষকে একটি মাত্র জাতিরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই রকম একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হয়, পরিবার প্রথা তখনো সে মর্যাদা ভোগ করবে। এ কথা বুঝতে এমন কোনো প্রজ্ঞার প্রয়োজন করে না যে, পারিবারিক জীবনে সুখ-শান্তি না থাকলে মানুষের জন্য ব্যক্তি বা জাতি হিসাবে অথবা এক বিশ্ব-জাতির অন্তর্গত একজন সদস্য হিসাবে সুখ-শান্তির কল্পনা করা বাতুলতা মাত্র। এ স্বতঃসিদ্ধ যে, ‘সমগ্র’ যেসব উপকরণ দিয়ে তৈরী সে উপকরণগুলো উৎকৃষ্ট না হলে ‘সমগ্র’ কখনো উৎকৃষ্ট হতে পারে না। ইসলাম ধর্ম পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা, সংহতি, শান্তি ও উৎকর্ষকে মুগ্ধ করার স্বাভাবিক প্রবণতা যা কিছুর মধ্যে আছে, আপোষহীন ভাষায় তারই নিন্দা করেছে।
পুরুষ ও নারী
আল-কুরআনে রয়েছে–“পুরুষেরা তাদের (নারীদের চেয়ে এক ধাপ উপরে।”
আবারঃ “পুরুষদের নারীদের উপর কিছুটা প্রাধান্য রয়েছে, কেননা—আল্লাহ একজনকে অন্য জন থেকে অধিক দান করেছেন”। ( সুরা নিসা, ৩৪ নং বাক্য)
এ সব কথা বাস্তব সত্যের সহজ বর্ণনা মাত্র ; যেমন, গরুর দুটি শিং আছে বা বানরের কোনো শিং নেই। প্রিয় হোক বা অপ্রিয় হোক, সত্য-সন্ধানীকে অকপট চিত্তে এবং সৎসাহসের সাথে সত্য যেমন তাকে তেমন ভাবেই স্বীকার করে নিতে হবে। নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্য রয়েছে—এ একটি নির্জলা সত্য কথন। অন্য সব কথা ছেড়ে দিলেও অন্ততঃপক্ষে দৈহিক ক্ষেত্রে এটা সত্য। আল-কুরআন এই প্রাকৃতিক সত্যকে স্বীকার করেছে এবং পুরুষ যাতে নিজের দৈহিক শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগ নিয়ে নারীর প্রতি অন্যায় ব্যবহার না করতে পারে তার জন্যে সর্বপ্রকার সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রকৃত পক্ষে, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সমন্বয় সম্পকিত আল-কুরআনের সকল বিধানেরই উদ্দেশ্য এই। যেখানেই নারীর উপর পুরুষের কোনো অধিকার স্বীকার করা হয়েছে, তার সাথে সাথেই পুরুষের উপরও নারীর অনুরূপ অধিকার ঘোষিত হয়েছে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্যকে পুরুষ যখন তার একটি অধিকার বিবেচনা করে, তখন স্বামী কর্তৃক যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মানের সাথে ভরণ-পোষণের অধিকারও। নারীর একটি অধিকার বলে গণ্য হবে।
বহু বিবাহ
যৌন সম্পর্ক হলো প্রজননের উপায় স্বরূপ। স্বাভাবিকভাবে স্তন্য দানের কাল সমেত বিচার করলে একটি সুস্থ সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রসুতির আড়াই বছর সময়ের দরকার হয়। অন্য পক্ষে, একজন পুরুষ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কয়েকজন স্ত্রীলোককে গর্ভবতী করতে সক্ষম। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, প্রজনন ক্ষেত্রে পুরুষের সামর্থ অত্যন্ত উঁচু স্তরের। যৌন কার্যের উদ্দেশ্য হলো প্রজনন ; এর সাথে যে ভাবালুতার সংযোগ রয়েছে তা আনুষংগিক মাত্র। যৌন আবেগের অন্ধ দাসত্ব থেকে যে ভয়ানক যৌন বিকৃতি দেখা দেয়, তা যেন নিরোধজনিত মানসিক বিকৃতিরই অনুরূপ। মেয়েদের বেলায় স্বাভাবিক যৌন আকাঙ্ক্ষা তখনই প্রবল হবার কথা, যখন তারা দেহতঃ সন্তান ধারণের যোগ্য থাকে। অথচ যখনই পুরুষ নারীর গর্ভাধান করতে সমর্থ, তখনই নারীর সংগে সংগমের স্বাভাবিক ক্ষমতা তার রয়েছে। অবশ্য সামাজিক ন্যায়বিচার বজায় রাখার প্রয়োজনে পুরুষের এ অধিকার খর্ব করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রিত স্বাভাবিক অধিকারই সামাজিক অধিকার। প্রতিটি জীবন ব্যবস্থাতেই স্বাভাবিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের এবং সামাজিক অধিকার ও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির নিজস্ব পন্থা রয়েছে। ইসলাম মানুষের স্বভাবের এসব মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েই প্রকৃতি-দত্ত অধিকারকে সীমাবদ্ধ করেছে এবং নতুন সামাজিক অধিকার ও বাধ্য-বাধকতার জন্ম দিয়েছে। অস্বাভাবিক তথা অবাস্তব নীতি-শাস্ত্র অউড়িয়ে ইসলাম ধর্ম মানুষকে এমন কোন শূন্যোদান রচনায় সহায়তা করে না, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হলো স্বভাবের বিকৃতি। তাই ইসলামে একাধিক বিয়ের প্রথা পুরুষকে যথেচ্ছভাবে চার বিয়ের অধিকার দেয় না, বরং পুরুষের অবাধে যথেচ্ছ সংখ্যক নারী সম্ভোগের প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। পুরুষের অসংখ্য বিবাহের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে ও অধিকারকে এখানে চার স্ত্রীতে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং একাধিক স্ত্রীর প্রতি যখন সুবিচার করা সম্ভব নয়, তখন এ অধিকারকে আরো সংকুচিত করে মাত্র একটি বিবাহে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। অতএব ইসলামসিদ্ধ এই সীমাবদ্ধ বহুবিবাহ প্রথা নারীর স্বাভাবিক যৌন অধিকারকে সামান্য ক্ষুন্ন না করেও এক দিকে যেমন পুরুষকে তার যৌন সামর্থের ন্যায়সংগত তৃপ্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনিই যৌন বিকৃতির পথও সাফল্যের সাথে রুদ্ধ করেছে। একথা পুনরাবৃত্তিযোগ্য যে, যৌন বৃত্তি হলো সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রকৃতির একটা কৌশল বিশেষ এবং যৌন ব্যাপারে ভাবাবেগ একটা অনুষংগিক ব্যাপার মাত্র। নারীদেহের যেসব অংগ সন্তান ধারণ ও সন্তান পালনের জন্যে পরিকল্পিত, পুরুষের কাছে সেসব অংগের যৌন আবেদনই সর্বাধিক। বয়সের একটা নির্দিষ্ট স্তরে নারী যখন সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন তার আর কোনো যৌন আবেদন থাকে না, কিন্তু পুরুষের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বজায় থাকে। এ ক্ষেত্রে এ কথা স্মরণ করা প্রয়োজন যে, মানব জীবনের ইসলামী ব্যবস্থার মধ্যেই ইসলামী নৈতিকতার বাস্তবায়ন সম্ভব। ধনতন্ত্রবাদী অর্থনৈতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিবাহ-ব্যবস্থাকেই অপছন্দের দৃষ্টিতে দেখে এবং যৌন পবিত্রতা বা যৌন সততা সম্পর্কে তা উদাসীন। যৌন আকাঙ্খার নিবৃত্তি উদ্দেশ্যে বিবাহ-বহিভুত দায়িত্ব মুক্ত যৌন সম্পর্ককে এ প্রশ্রয় দিয়ে থাকে এবং প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত উভয়বিধ বেশ্যাবৃত্তিকে দেয় উৎসাহ। ‘স্বামী’ ও ‘স্ত্রী’ এ দুটো শব্দের স্থান গ্রহণ করে ‘বালক বন্ধু’ বা ‘বালিকা বন্ধু’। এই পরিবেশে ইসলামী যৌন নৈতিকতার যথার্থ তাৎপর্য উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন অকল্পনীয়।
নাবালেগাহ, মেয়ের বিবাহ
আইন স্বীকৃত অভিভাবক কর্তৃক নাবালেহগাহ (অপ্রাপ্তবয়স্কা) মেয়ের বিবাহ-চুক্তি সম্পাদন সম্পর্কিত যে আইন বিভিন্ন দেশের মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে, তাতে অভিভাবক কর্তৃক নাবালেগাহ মেয়ের বিবাহ-চুক্তি আইন-সমত বলে বিবেচিত হয়। অন্য কোন অভিভাবক দ্বারা যদি এরকম বিবাহ-চুক্তি সম্পাদিত হয়, তবে নাবালেগাহ মেয়েরা বালেগাহ হবার পর স্বামী-সহবাসের পূর্বে সে বিবাহ নাকচ করে দিতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম হচ্ছে ওয়ালী-ই-জাবির বা নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য পিতা বা পিতার পিতা কর্তৃক সম্পাদিত বিবাহ-চুক্তি। সুতরাং কোনো নাবালেগাহ মেয়ের বিবাহ-চুক্তি যদি তার পিতা বা পিতার মৃত্যুতে পিতার পিতা সম্পাদন করেন, তবে সে বিবাহ-চুক্তি অলঙ্ঘনীয়। এ সব কানুন অবশ্যি মধ্যযুগের মুসলিম আইন প্রণেতারা নাবালেগাহর সম্পত্তির তত্ত্বাবধান-সংক্রান্ত সাধারণ মুসলিম আইনের ব্যবস্থানুযায়ী ‘ক্বিয়াস’ বা সাদৃশ্যমুলক যুক্তির সাহায্যে নিষ্পন্ন করেছেন। আল-কুরআন বা সুন্নাহতে এ সম্পর্কে কোনো সরাসরি নির্দেশ নেই। আইন-স্বীকৃত অভিভাবক যে নাবালেগাহ বালিকার বিবাহ-চুক্তি সম্পন্ন করতে পারেন, তা সুন্নাহ কর্তৃক স্বীকৃত। হযরত আয়েশা সিদ্দিকাকে নাবালেগাহ অবস্থায় হযরত রাসূলুল্লাহর সাথে বিয়ে দেন তার পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দিক। কিন্তু পিতা বা পিতামহ কর্তৃক সম্পাদিত বিবাহ-চুক্তি যে পরবর্তীকালে ভংগ করা যাবে না, এ হচ্ছে অনুমানমূলক। যদি কন্যার বয়ঃপ্রাপ্তির পর সম্মতি-অসম্মতির এই অধিকার পিতা-পিতামহ কর্তৃক সম্পাদিত বিবাহের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়, তাতে আল-কুরআন ও সুন্নাহর নীতির বিরোধিতা হবে না। সম্পত্তির তত্ত্বাবধান-সংক্রান্ত সাধারণ কানুন বিবাহের ক্ষেত্রেও সরাসরি প্রয়োগ ন্যায়নীতির দিক থেকে সংগত বলে মেনে নেয়া চলে না। কেননা, বিবাহ ব্যাপারে শুধুমাত্র নাবালেগাহর সম্পত্তির প্রশ্নই জড়িত নয়, তার সাথে সাথে তার দেহ মনের প্রশ্নও সংশ্লিষ্ট। কারণ, নাবালেগাহ কন্যারা খেলার সামগ্রী বা হস্তান্তরযোগ্য সম্পত্তি নয়। তারা মানুষ এবং সকল প্রকার মানবিক মর্যাদার অধিকারীণী। যেহেতু নাবালেগাহর বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়, অতএব আইন করে সহবাস স্বীকৃতির বয়স নির্ধারণ এবং নাবালেগ হর বিবাহ নিষিদ্ধকরণ ইসলাম-বিরোধী হবে না। ইসলামী মৌলিক নীতিসমূহ অপরিবর্তনীয়। কিন্তু সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যবহারিক আইন-কানুন পরিবর্তন সাপেক্ষ। এ ক্ষেত্রে ‘তকলীদ’ বা বহু যুগ পূর্বে বিগত দিনের ফকীহ (আইনবেত্তা) দের অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং ইজতিহাদ বা প্রয়োগ বৃদ্ধির ব্যবহারেরই সতিকার প্রয়োজন।
তালাক
ইসলামী আইনে অনমোদিত সব কিছুর মধ্যে তালাক’ (বিবাহ বিচ্ছেদ) হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণ্য। এ. হলো আবশ্যিক ঘূণ্য কাজ (Necessary evil)। নারীর সন্তান জন্মের পুর্বে বিবাহ-বিচ্ছেদ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিন্তু সন্তান জন্মের পর তালাক অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার। কেননা, সেক্ষেত্রে সন্তানাদির ভবিষ্যতের উপর এক প্রভাব হয় গুরুতর। তালাক বা বিবাহ-বিচ্ছেদের আশ্রয় তখনই নেওয়া উচিত, যখন তার দ্বারা একটা বৃহত্তর বিপর্যয় বা পাপকে বাধা দেওয়া প্রয়োজন। কোনো কোনো মুসলিম আইনবেত্তা বিবাহ-বিচ্ছেদ অনুষ্ঠানকে যতখানি সহজ ও দ্রুত বলে মনে করেছেন, অলি-কুরআনের ব্যবস্থা সে রকম মোটেই নয়। বিবাহ-বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত মাত্র তখনই গ্রহণ করা যেতে পারে, যখন আপোষের সর্ব প্রকার প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। যখন তালাক দেয়া হবে, তখন তা ধীরে-সুস্থে বিচার-বিবেচনা করেই দিতে হবে—আবেগ বা ভাবাতিশয্যের মধ্যে তালাক দেওয়া চলবে না।
কাবিন-নামায় নারীর তালাক দেওয়ার অধিকার পুর্বাহেই স্বীকত না হয়ে থাকলে কোনো স্ত্রীর সরাসরি স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ইসলামী আইনানুসারে বিবাহ কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর্যায়ভুক্তনয়; এ হলো একটি সামাজিক চুক্তি। অতএব কাবিনে স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা স্ত্রীতে অর্পিত থাকলে স্ত্রী সে অনুসারে স্বামীকে তালাক দেওয়ার অপরিবর্তনীয় অধিকার লাভ করে। কাবিনে এ রকম শর্তের অবর্তমানে স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দিতে ইচ্ছুক হয়, তবে উভয়ের স্বীকৃত শর্তে পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক দিতে পারে অথবা আদালতের মারফত, আদালতকর্তৃক উপযুক্ত ও আদালতে যথেষ্ট বলে বিবেচিত শর্তে নিষ্ঠুরতা বা অপবাদ রটান ইত্যাদি কারণে তালাকের অধিকার পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বৈবাহিক জীবনের দায়িত্ব পালনে গুরুতর অবহেলাকেও নিষ্ঠুরতা বলে ধরা হবে। যখন স্বামী নিজে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চায়, তখন তাকে বিয়ের সমুদয় দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে হবে। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার প্রাপ্য পুরোপুরি ‘মোহরানা’, নির্দিষ্ট কালের জন্যে ভরণ-পোষণের খরচ এবং দুগ্ধপোষ্য সন্তান থাকলে সে সন্তানের স্তন্য দানকালীন সময়ের জন্যে যথাযোগ্য মাসোহারা পাবে। সুতরাং স্বামী যদি সৎ হয়, অথবা স্ত্রীর প্রাপ্য আদায়ের জন্যে যদি যথাযোগ্য সহজ ও দ্রুত কার্যকরী সামাজিক বা কানুনী ব্যবস্থা থাকে, তবে তালাক দেওয়ার পূর্বে স্বামী যে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনায় ত্রুটি করবে না, তা বলাই বাহুল্য।
এর পরেও যদি সে তালাক দেয়, সে মারাত্মক বৈষয়িক অসুবিধার সম্মুখীন হবেই। এ সব কারণেই পুরুষের জন্যে স্ত্রীর স্বীকৃতি-নিরপেক্ষ তালাক দেওয়ার অধিকার যুক্তিসঙ্গত। তালাক-আইন পুরুষের পক্ষে অতি কঠোর, অথচ স্ত্রীর পক্ষে সহজ। নারীর পক্ষে এতে কোনো আর্থিক দায়িত্ব নেই ; নিজ ইচ্ছামতে সে পুনরায় বিয়ে করতে পারে। নারীর চরিত্রে কোমলতা ও মাধুর্যমণ্ডিত গুণাবলীচূড়ান্ত পরিমানে বিদ্যমান। তাই স্বভাবতই তারা চূড়ান্ত রকম ভাব-প্রবণ ও উত্তেজনাধর্মী। অবশ্য মাতৃত্বের যোগ্যতার জন্যে এ কোমল গুণগুলো অপরিহার্য। কিন্তু নারীকে যদি একক তালাক দানের ক্ষমতা দেওয়া হতো, তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অতি সামান্য কারণেই এ ক্ষমতার অপব্যবহার করতো, আবেগের প্রতিটি ক্ষণিক উত্তেজনায়ই সে ভেসে যেতো। এখানে আবার বলা দরকার যে, বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রথা ইসলাম-অনুমোদিত সকল কাজের মধ্যে ঘৃণ্যতম। আল-কুরআনে কঠোর নির্দেশ রয়েছে যে, তালাকের আগে আপোষ-মীমাংসার সর্বপ্রকার সম্ভাব্য চেষ্টা করতে হবে, এমন কি, স্ত্রী অবিশ্বস্ততার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হলে শোধরানো এবং স্বামী-স্ত্রীতে সম্ভাব্য পুনর্মিলনের জন্যে শেষ চেষ্টা হিসাবে তাকে প্রহারের অধিকার স্বামীকে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীকে প্রহার করা দোষাবহ, কিন্তু তালাক তার চাইতেও অবাঞ্ছিত। কুরআনে উক্ত হয়েছেঃ
“যে সব স্ত্রীলোক সম্পকে-যাদের আচরণে তোমরা অবিশ্বস্ততা সন্দেহ কর, তাদের ভর্ৎসনা কর, তাদের সাথে একত্রে শয্যাগ্রহণে অস্বীকার কর, তাদের প্রহার কর। কিন্তু তারা যদি পুনরায় বাধ্য হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে আর কিছু করতে যেয়ো না। কেননা, আল্লাহ অতি মহান।” (৪ : ৩৪)
সাক্ষ্য আইন [The Law of Evidence]
ইসলামী সাক্ষ্য-আইনে দু’জন স্ত্রীলোককে একজন পুরুষের সমকক্ষ বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চুক্তি সম্পর্কে নির্দেশ দান প্রসংগে আল-কুরআনের সূরা বাকারায় (২৮২ নং বাক্যে) বলা হচ্ছেঃ
“এবং তোমাদের নিজেদের পুরুষদের মধ্য থেকে দু’জন পুরুষ সাক্ষী আন এবং যদি দু’জন পুরুষ না পাও, তবে সাক্ষ্য দানের জন্যে তোমাদের পছন্দ মতো একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক আন, যাতে তাদের এক জনের ভুল হলে অন্যে তাকে (সে, স্ত্রীলোককে) স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।”
প্রীতিকর বা অপ্রীতিকর, যাই হোক, আসল কথা হলো এই যে, নারী জাতি অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং তারা অল্পেই অভিভূত হয়ে পড়ে। এ কারণে তাদের স্মরণ শক্তি ও সাধারণতঃ ক্ষীণতর, বাস্তবের যথাযথ তাৎপর্য অনুধাবনে দুর্বলতর এবং আবেগ দ্বারা অনুরঞ্জিত না করে বাস্তবের বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা তাদের স্বল্প। অন্য কোনো সমর্থনমূলক সাক্ষ্যের অবর্তমানে, অথবা অবস্থাঘটিত বা অন্য প্রকার সাক্ষ্য সাবুদের সমর্থন না থাকলে শুধু একজন পুরুষের সাক্ষ্য-কোনো ব্যাপারের সপক্ষে বা বিপক্ষে কোনো সিদ্ধান্তে আসার জন্যে যথেষ্ট নয়। বিবাহিতা বা অবিবাহিতা অবস্থায় জিনার শাস্তি অতিশয় কঠোর বলে জিনার অপরাধ প্রমাণের জন্যে চার জন পুরুষের সাক্ষের প্রয়োজন। একজন পুরুষের পরিবর্তে দু’জন স্ত্রী। লোকের সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করে স্ত্রী জাতির প্রতি অন্যায় করা হয়নি, বরং সকলের প্রতি সুবিচারেরই নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে।
উত্তরাধিকারী আইন
ইসলামী উত্তরাধিকার-আইনে পুত্র যে পরিমাণ সম্পত্তির হকদার কন্যার প্রাপ্য তার অর্ধেক বলে নির্ধারিত করা হয়েছে। অপরের উপর নির্ভর করে জীবন-যাপন ইসলাম সমর্থন করে না। প্রত্যেক কার্যক্ষম পুরুষ ও নারীকে কঠোরভাবে নিজ নিজ সমর্থ অনুযায়ী যার যার কার্যক্ষেত্রের স্বাভাবিক সীমানার মধ্যে কাজ করতে হবে। তা সত্ত্বেও পরিবারস্থ নারীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে পরিবারের পুরুষদের উপর। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের কাজ হচ্ছে পরিবারকে সুষ্ঠু আর্থিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টায় পুরুষের কাজে সক্রিয় সহযোগিতা দান করা। স্বামীর সম্পদের উপর স্ত্রীর সর্বপ্রথম দাবী হলো মোহরানার দাবী। স্ত্রী যে কোন সময়ে দাবীমাত্র এ হক আদায় করতে সমর্থ। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী পুনর্বার স্বামী গ্রহণ করে নতুন সংসার গড়তে পারে। পিতার মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততির ভরণ-পোষণের ভার পড়ে পিতামহ বেঁচে থাকলে তার উপর এবং পিতামহের অবর্তমানে পিতার ভ্রাতাদের উপর। এ সব পুরুষ অভিভাবক (তত্ত্বাবধায়ক) বেঁচে থাকাকালে মায়ের উপর সন্তান প্রতিপালনের কোন আইনসংগত দায়িত্ব বর্তায় না। এ সব বিবেচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যার অংশ পুত্রের অংশের অর্ধেক কেন, তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করার জন্যে উল্লিখিত কারণগুলোই যথেষ্ট।
নারী ও অবরোধ
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় পরিবার একটি অর্থনৈতিক একক মাত্র ; কিন্তু ইসলামী জীবন-যাপন পদ্ধতিতে পরিবার সেরূপ নয়। বরঞ্চ যে সব মূল্য দ্বারা মানুষ ও প্রাণীর পার্থক্য নিরূপিত হয়, সে সব মূল্যের প্রাথমিক অনুশীলনের জন্যে পরিবার প্রথা একটা পবিত্র সংস্থা বিশেষ। ইসলামে পরিবার হলো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্র স্বরূপ। এই পরিবার রাষ্ট্রের সন্তান-সন্ততির মধ্যে চর্চিত হয় পরস্পর সাম্য-ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক সুবিচার এবং কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার মনোভাব। এগুলোর অনুশীলনই মানুষের জীবনে সকল প্রকার সুখের কারণ হয়ে থাকে এবং তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও বিশ্বজনীন জীবনে যে অসীম সম্ভাবনা রয়েছে : তারই বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
পারিবারিক জীবন ধ্বংস হলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থায় মানুষের পশু-জীবনে অবনতি অনিবার্য হতে পারে তা সভ্য পশু-জীবন। পারিবারিক জীবনে ধ্বংসের যত প্রকার কারণ আছে, তার মধ্যে সব চেয়ে গুরুতর ‘জিনা’ হলো বিবাহ-বহিভুত যৌন সম্পর্ক। ইসলাম যেহেতু একটা বাস্তবতাবাদী দর্শন, তাই ইসলামের বিবেচনায় পারিবারিক পবিত্রতাকেই সমাজ-জীবনের বুনিয়াদ মনে করা হয়। এ কাবণে সমাজ-জীবনে পুরুষ ও নারীর সম্পকের সুষ্ঠু সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজন হয়। এতদুদ্দেশ্যে পুরুষ ও নারীকে দুটি দৃঢ় সংবদ্ধ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে ; যথা—‘মুহররম’ বা নিষিদ্ধ শ্রেণী এবং ‘গায়ের মুহররম’ বা অনিষিদ্ধ শ্রেণী। মুহররমদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ সম্পর্ক অসিদ্ধ এবং গায়ের মুহররমদের মধ্যে তা সিদ্ধ। ইসলামে চৌদ্দ শ্রেণীর আত্মীয়ের সাথে বিবাহ অসিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ শ্রেণীর নারী-পুরুষের মধ্যে পরস্পর সহজ মেলামেশায় কোন বাধা নেই। কেননা, এদের মধ্যে যৌন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা সব চেয়ে অল্প। অনিষিদ্ধ শ্রেণীর নারী-পুরুষের মধ্যে মেলামেশার ব্যাপারে বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপরিচিত ব্যক্তি ও নিকট সম্পর্কীয় চাচাতে মামাতো ভাই-ভগ্নী একই পর্যায়ভুক্ত। এ বাধা-নিষেধ পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য।[1] শালীনতা ও সম্ভ্রমবোধ বজায় রেখে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলা-ফেরাতে কোন নিষেধ নেই, নিষেধ রয়েছে সমস্ত শালীনতাবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেহ-সৌন্দর্যের উদ্ধত প্রকাশনার মাধ্যমে যৌন আবেদন সৃষ্টির বেলায়। ঘরের চারি দেওয়ালের মধ্যে মেয়েদের অবরোধ করে রাখবার বিধান ইসলামে নেই। মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায় আজকাল যেমন পাশ্চাত্য জীবন-পদ্ধতির অপরিহার্য অংগ নাইট ক্লাবে নারী-পুরুষের অবাধ মিশ্রণের পাঠ নিচ্ছেন, সেকালেও তারা এ ধরনের অবরোধ প্রথা বাইযান্তীয়, ইরানী এবং ভারতীয় রাজপুত সমাজের সংস্রবে এসে আয়ত্ত করেছিলেন।
পরিবার আইন
ইসলামী পরিবার আইনের বিধানাবলী যথাযথরূপে প্রতিপালিত ইলে প্রতিটি পরিবার দুনিয়ায় বেহেশতের মর্যাদা অর্জন করতে বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এ একটি নির্মম সত্য যে, এ সব আইন-কানুন আজকের পৃথিবীর কোথাও অনুসৃত হচ্ছে না। দেশীয় আইনে এ সর্ব নির্দেশের যথাযথ প্রয়োগ-ব্যবস্থা না থাকাতে এবং সামাজিক শৃংখলার অবর্তমানে পুরুষেরা নারীদের উপর তাদের প্রকৃতিদত্ত শ্রেষ্ঠত্বকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে এবং আল-কুরআনের বিধি-ব্যবস্থাকে যথেচ্ছ। লংঘন করে। সমাজ ব্যবস্থাকে ইসলাম সমত করে তুলতে হলে সর্ব গ্রথমেই আইন প্রণয়ণ করে ইসলামী পারিবারিক কানুনাদি কঠোরভাবে কার্যকরী করার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আল-কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন প্রকার নতুন অধিকার বা দায়িত্ব যাতে সৃষ্টি না হতে পারে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
পারিবারিক আইন ও নৈতিকতা কঠোরভাবে অনুসৃত হলে সমাজ-জীবনে নারী আবার তার পূর্ণ মর্যাদা ও ঐশ্বর্য নিয়ে অবিভূত হবে।
ইসলামে নারীর স্থান
ইসলামে নারী হস্তান্তরযোগ্য সম্পত্তি বিশেষ নয়; বরং ব্যক্তি শব্দটির যেসব আইনগত ও সমাজিক তাৎপর্য রয়েছে, সে সব দিক দিয়েই সে একজন ব্যক্তি বা মানুষ। নিজ নামেই তার পরিচয়, পিতা বা স্বামীর নামে নয়। তার দেহ, সম্পত্তি এবং সমান সবই নিরাপদ। ইসলাম কন্যা-সন্তানকে অভিশাপ স্বরূপ মনে করে না; পিতৃগৃহে তার মর্যাদা পুত্র-সন্তানের সমতুল্য ; স্বামীগৃহে সে গৃহের অধিকর্ত্রী। আইনত সে পিতা, মাতা, স্বামী ও পুত্র-কন্যার সম্পত্তির একজন ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী)। তার নিজের সম্পত্তি স্বামীর সম্পত্তির মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায় না। সে নিজের ইচ্ছা মাফিক নিজ সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থার অধিকারিণী। নাবালেগাহ অবস্থায় আইন স্বীকৃত ওলী দ্বারা যদি তার বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে অথবা যদি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাকে বিবাহ দেওয়া হয়, তা হলে প্রথম ক্ষেত্রে বয়ঃপ্রাপ্ত হবার পর এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সহবাসের পূর্বে যে কোন সময়ে সে বিবাহ-বন্ধন অস্বীকার করতে পারে। স্বামী যদি তার সাথে দুর্ব্যবহার করে, তবে সে কাবিনে পূর্বস্বীকৃত অধিকারবলে স্বামীকে তালাক দিতে পারে বা কাবিনে সে অধিকার স্বীকত না থাকলে আদালতের সাহায্যে পূর্ণ ক্ষতিপূরণসহ তালাক পেতে পারে। ইসলামে নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া অতি জঘন্য অপরাধ; তাই এর শাস্তি ও অতিশয় কঠোর। আল-কুরআনে রয়েছে :
“এবং যারা সতী নারীদের বিরুদ্ধে (ব্যভিচারের) নালিশ আনে এবং তার প্রমাণে চারজন সাক্ষী হাজির করতে অপরাগ হয়, তাদেরকে আশি দোররা (বেত্রাঘাত) লাগাও; এবং এর পরে বরাবরের জন্যে তাদের সাক্ষ্য প্রত্যাখান কর। কেননা, এ সব ব্যক্তি দুষ্ট বুদ্ধি সীমা লঙ্ঘনকারী।” (সূরা নূর, ৪র্থ বাক্য)।
“বেহেশত মায়ের পদ তলে অবস্থিত”-এই মহান ঘোষণাবলে ইসলামের প্রেরিত পুরুষ নারীকে মহিমার স্বর্ণশিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
[1] আল-কুরআন, সুরা নুর।
সূত্র : এই পিডিএফ বই থেকে