সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা)
রচনায়: মাওলানা জাকির হুসাইন
পৃথিবী তখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। অশান্তি আর অনাচারের মহা উৎসব চলছিল সর্বত্র। ইনসানিয়াত আর মানবতা বিদায় নিয়ে কায়েম হয়ে গিয়েছিল সেখানে পশুত্বের রাজত্ব। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেমে এসেছিল অবক্ষয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথাও ছিল না শান্তির লেশমাত্র। ছিল না জান-মাল ও ইজ্জতের সামান্যতম নিরাপত্তা। সকল শ্রেণীর মানুষ সার্বিকভাবে ছিল স্ব-স্ব অধিকার থেকে বঞ্চিত।
মালিকের নির্যাতনে শ্রমিক, সবল ও শক্তিমানের নির্যাতনে দুর্বল শক্তিহীন, পুরুষের নির্যাতনে নারী, শাসকের নির্যাতনে শাসিত, বিত্তশালীর নির্যাতনে বিত্তহীন-এ এক সর্বনাশা চরম অবস্থা বিরাজ করছিল বিশ্বব্যাপী- যে যুগকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘আইয়ামে জাহিলিয়া’-তমসা, অজ্ঞতা, বর্বরতা ও কুসংস্কারের যুগ। শিকড় গেড়ে বসেছিল বর্বরতার সর্বনাশা থাবা সমাজের পরতে পরতে। বিশেষ করে তখনকার আরব ভূ-খণ্ডের অবস্থা ছিল ত্রাহি ত্রাহি। হেন গর্হিত কাজ ছিল না যা আরবরা করত না। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গোত্রে গোত্রে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। তারা একত্ববাদের শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল শিরক ও পৌত্তলিকতার অতল গহ্বরে। পবিত্র কা’বা ঘরে স্থান করে নিল ৩৬০টি দেবতা। এ চরম যুগসন্ধিক্ষণে বিশ্বমানবতা অধীর প্রতীক্ষায় আকাশ পানে তাকিয়েছিল যুগ যুগ ধরে। কখন আসবে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, শান্তি, নিরাপত্তা ও মুক্তির মহান পয়গাম নিয়ে এক মহামানব-যিনি এ অশান্ত পৃথিবীতে প্রবাহিত করবেন শান্তির হিমেল হাওয়া। শুনাবেন মুক্তির বাণী। দিবেন জান, মাল, ইজ্জত ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। ফিরিয়ে আনবেন সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তির সৌরভ, মুক্তির চিরন্তন সওগাত।
মানবতার সে ব্যাকুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটল, যুগ যুগ ধরে মানবতার চির প্রত্যাশিত ও চির কাঙ্ক্ষিত মহান সত্তা রাহমাতুললিল আলামীন নিয়ে আসলেন শান্তি-মুক্তির অফুরন্ত রহমত। তাঁর আগমনে মানবতার চূড়ান্ত ইনকিলাব ঘটল। মানবতা আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠল পৃথিবীর চৌদিকে।
মহানবী (সা)-এর যৌবনকাল। তদানীন্তন আরবের সামাজিক নৈরাজ্যের করুণ চিত্র তাঁকে ভাবিয়ে তুলত। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তখনই তিনি উদগ্রীব থাকতেন। মুক্তি ও শান্তিকামী রাসূল (সা) সামাজিক নৈরাজ্য ও দুরবস্থা দেখে বলতেন: এ সমাজের পরিবর্তন কিভাবে হবে! তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে, বলিষ্ঠ পদক্ষেপে যুবকদের নিয়ে গঠন করেন ঐতিহাসিক ‘হিলফুল ফমূল” সেবা-সংঘ। এর সদস্যরা যে সমস্ত কাজ আঞ্জাম দেয়ার শপথ ও প্রতিজ্ঞা করেছিল তা নিম্নরূপ :
(ক) আমরা দেশের-সমাজের অশান্তি দূর করব।
(খ) আমরা বিদেশী পর্যটকদেরকে রক্ষা করব।
(গ) আমরা গরীব-দুঃখীদেরকে সাহায্য করব।
(ঘ) আমরা শক্তিশালীদেরকে দুর্বলদের উপর অত্যাচার করতে দেব না।
বস্তুত এখান থেকেই শুরু হলো মহানবী (সা)-এর শান্তি প্রতিষ্ঠার গৌরবদীপ্ত অভিযান। এ সেবা-সংঘের সদস্যবৃন্দ দীর্ঘদিন যাবত কাজ করতে থাকেন। এর দ্বারা দেশ ও সমাজের অনাচার-অবিচার বহুলাংশে হ্রাস পেল। রাস্তা-ঘাট নিরাপদ হয়ে উঠল। একবার খাসআম বংশীয় এক ব্যক্তির সুন্দরী কন্যাকে জনৈক দুর্বৃত্ত ছিনিয়ে নেয়। পিতা জনতার পরামর্শে হিলফুল ফল-এর সদস্যবৃন্দের কাছে ফরিয়াদ করল। সদস্যরা উক্ত দুর্বৃত্তের গৃহে উপস্থিত হয়ে বলল: ওরে পাপিষ্ঠ-দুরাচার, তুই জানিস না আমরা কারা? আর আমরা কি প্রতিষ্ঠা করেছি? এখনই মেয়েটিকে ফিরিয়ে দে। উক্ত সেবা সংঘের সদস্যদের যে কত শক্তি, তাদের প্রতিজ্ঞা যে কত অটল-অবিচল দুর্বৃত্ত বুঝতে পারেনি। এতদিন নিয়ম ছিল-‘জোর যার মুল্লুক তার, এত শীঘ্র কি অন্যায়- অবিচার তিরোহিত হবে? যার শক্তি আছে সে হয়ত কিছু দুরাচারবৃত্তি করতে পারবে। তাই সে বলল: এ মেয়েটিকে মাত্র একটি রাত রাখব, অনুমতি দিন। সদস্যরা উত্তর করল, এক মুহূর্তের তরেও নয়। মেয়েটিকে বের করে দাও। অবশেষে সে মেয়েটিকে বের করে দিতে বাধ্য হলো। (হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা) সমকালীন পরিবশে ও জীবন দ্র:)
শায়খুল হাদীস মাওলানা তফাজ্জল হুসাইন (র)-এর ভাষায়: নিখিল বিশ্বের তরুণ মুহাম্মদ বিশ্ব-তরুণের জন্য এ অধ্যায়ে কি সুন্দর আদর্শই না রেখে গেলেন! দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা, গরীব-দুঃখীকে সাহায্য করা, সাম্প্রদায়িকতা বিসর্জন দিয়ে আপন-পর, দেশী-বিদেশী নির্বিশেষে সমভাবে সকলের সেবা করা, অত্যাচারীকে বাধা দেয়া, উৎপীড়িতের সহায়তা করা-এ-ই হল তরণের কর্তব্য, এই হল তরুণের ধর্ম। তরুণ জাগ্রত হও, চক্ষু খোল, ঐ দেখ তোমার মহান আদর্শ তরুণ মুহাম্মদ সংঘবদ্ধ হয়ে সহকর্মীদেরকে নিয়ে কি করছেন! কোথায় কোন পিতৃহীন এতিম ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদছে, কোথায় কোন নিঃসহায় বিধবা নারী অন্ন-বস্ত্রের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে, কোথায় কোন শয্যাশায়ী দুস্থ-রুগ্ন পরিচর্যার অভাবে আর্তনাদ করছে, কোথায় কোন বিদেশী পথিক কোন দুর্বৃত্ত কর্তৃক প্রতারিত হচ্ছে-তিনি তাই অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছেন। শান্তি- দূত তরুণ মুহাম্মদ (সা) কোথাওবা কোন অনাথ শিশুকে কোলে নিয়ে দোলা দিচ্ছেন, কোথাওবা রোগীর শয্যাপার্শ্বে বসে তার পরিচর্যা করছেন, কোথাওবা কোন জনহিতকর কর্মে আত্মনিয়োগ করে সমাজসেবার কর্তব্য পালন করছেন। এই তরুণকেই আমরা কামনা করি, আমাদের দেশ কামনা করে, সারাবিশ্ব কামনা করে। (হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা) : সমকালীন পরিবেশ ও জীবন)
বস্তুত যুবক মুহাম্মদ (সা) হচ্ছেন গোটা পৃথিবীর যুবকদের অনুসরণীয় আদর্শ ও প্রতিকৃতি। সমস্ত যুবকের জন্য তিনি মহাউত্তম আদর্শ রেখে গেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আদর্শ রয়েছে।” পৃথিবীর সকলের জন্য জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে রাসূল (সা) অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন।
আজকের আমাদের সমাজের যুবকদের সে এক বীভৎস করুণ চিত্র এবং আমাদের যুবসমাজের দ্বারা প্রতিষ্টিত সেবা সংঘের দু’চারটি ছাড়া কি এক সর্বনাশা অবস্থা! যদি আজকের যুবসমাজ এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত সেবা-সংঘ রাসূল (সা)-কে সার্বিক জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে আর রাসূল (সা)-কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “হিলফুল ফল” সেবা সংঘের গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে সমাজকল্যাণে ও মানবকল্যাণে এগিয়ে আসে, তাহলে সমাজের এ নৈরাজ্যকর অশান্তিময় অবস্থার অবসান ঘটবে- প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা, বিদূরীত হবে সমাজিক অত্যাচার-উৎপীড়নসহ যত সব অনাচার- অবিচার।
রাসূল (সা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক “হিলফুল ফল” সংঘের সার্বিক কার্যক্রম নবুওয়ত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল। অতঃপর এ সেবা-সংঘ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল। কারণ সর্বপ্রকার অনাচার-অবিচার, পাপ ও পংকিলতার মূলোৎপাটন করার এবং সর্ববিধ ন্যায় ও কল্যাণ সাধনের মহান দায়িত্ব নিয়ে যখন মহানবী (সা) কর্তৃক প্রবর্তিত ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটল তখন আর উক্ত সেবা সংঘের কোনরূপ প্রয়োজনীয়তা রইল না।
অনন্তর কাল-পরিক্রমায় নবুওয়তের সুমহান যিম্মাদারী অর্পিত হলো তাঁর উপর। এবার খোদায়ী নির্দেশনার ভিত্তিতে শুরু হলো ইসলামের সার্বজনীন দাওয়াত, নতুন ইনকিলাব ও সামগ্রিক মুক্তির মহা পয়গাম। নব চেতনায়, অদম্য স্পৃহায় মানবতাকে অহ্বান জানাতে লাগলেন অনাবিল শান্তি ও চিরন্তন মুক্তির রাজপথে।
বস্তুত শান্তি-মুক্তি পেতে হলে, নৈরাজ্যমুক্ত সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব গড়ে তুলতে হলে মানবতার ব্যক্তিগত জীবনে আনতে হবে ইসলাহ ও সংশোধনের চূড়ান্ত বিপ্লব। যেহেতু ব্যক্তি জীবনের শান্তিই পর্যায়ক্রমে আনয়ন করে সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তি-মুক্তি। তাই মহানবী (সা) এ পথেই এগুলেন, মানুষকে তিনি দাওয়াত দিলেন একত্ববাদের। আহ্বান জানালেন মিথ্যা, অনাচার, অন্যায়-অবিচার, সকল প্রকারের বীভৎস অশ্লীলতা পরিহার করে পরিশোধিত এক পরিচ্ছন্ন জীবনের দিকে। কিন্তু সমাজ সংস্কারের এ ইনকিলাব, সামাজিক শান্তি ও মুক্তির এ মহাপয়গাম বাধাগ্রস্ত হলো চরমভাবে; মেনে নিতে পারল না তদানীন্তন আরবের আল্লাহদ্রোহী জনগোষ্ঠী মহানবী (সা)-এর চির শান্তির চিরন্তন আহ্বানকে।
এরপর তিনি আল্লাহর হুকুমে মদীনায় হিজরত করেন। তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সাহাবাদেরকে নিয়ে শান্তি-মুক্তির বৃহত্তর কর্মসূচি নিয়ে সম্মুখপানে এগুতে থাকেন। অশান্ত পৃথীবীতে, বিশৃঙ্খল সমাজে, শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানব- ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কল্যাণ- রাষ্ট্রের বুনিয়াদ পত্তন করেন। আর এখান থেকেই তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার বিশাল পরিমণ্ডল ব্যাপ্তি লাভ করল। ব্যাপক ও বিপুল গতিশীলতায় অগ্রসর হয় ন্যায় ও ইনসাফ, সত্য ও সুন্দরের মহান বিপ্লব।
ইসলাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী, ইসলাম কখনো অনর্থক সংঘাতকে প্রশ্রয় দেয় না। সর্বোপরি আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রমাণ করতে হলে মদীনার সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত হওয়া প্রয়োজন। তাই শান্তি-মুক্তির মহান দিশারী মহানবী (সা) মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমান, ইয়াহুদী ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সর্বজাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এবং সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে সকলের শান্তি ও নিরাপত্তাদানে গঠিত হয় একটি ঐতিহাসিক চুক্তি, যা আমাদের কাছে তথা বিশ্ব-ইতিহাসে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ হিসাবে পরিচিত। একটি কল্যাণ-রাষ্ট্র, একটি আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এটিই পৃথিবীতে প্রথম লিখিত ‘শাসনতন্ত্র–সংবিধান’, যার মৌলিক দফাগুলো ছিল নিম্নরূপ:
১. মদীনার পৌত্তলিক, ইয়াহুদী এবং মুসলমান এক উম্মত।
২. এ সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়গুলো স্ব-স্ব ধর্ম বিষয়ে স্বাধীন থাকবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না।
৩. এ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায় শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে সকলে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করবে।
৪. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের মিত্রদের স্বত্বাধিকারের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। ৫. মদীনা আক্রান্ত হলে সকলে মিলে যুদ্ধ করবে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ যুদ্ধব্যয় বহন করবে।
৬. উৎপীড়িতকে রক্ষা করতে হবে।
৭. মদীনা রাষ্ট্রে আজ থেকে রক্তপাত হারাম (অবৈধ) বলে গণ্য হবে। ৮. দিয়ত বা খুনের বিনিময়পণ পূর্ববৎ বহাল থাকবে।
৯. স্বাক্ষরকারী কোন সম্প্রদায় কোন শত্রুর সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না।
১০. নিজেদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহী হলে অথবা শত্রুর সাথে কোনরূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তার উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা হবে, সে যদি তার প ত্র ও হয় তবুও ক্ষমা করা হবে না।
১১. স্বাক্ষরকারী কোন সম্প্রদায় কুরায়শদের সাথে কোন প্রকার গোপন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হবে না, কেউ তাদের কোন লোককে আশ্রয় দিবে না।
১২. অমুসলিমদের মধ্যে কেউ কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।
১৩. মুহাম্মদ (সা) এ সাধারণতন্ত্রের প্রধান নির্বাহী নির্বাচিত হলেন। যে সব বিষয়ের মীমাংসা সাধারণভাবে না হয় সেগুলোর মীমাংসা তাঁর উপর ন্যস্ত থাকবে। তিনি আল্লাহর বিধান মতে মীমাংসা করবেন।
১৪. স্বাক্ষরকারী যেকোন সম্প্রদায় এ চুক্তি ভঙ্গ করবে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত।
এ চুক্তিপত্রে প্রণিধানযোগ্য, বাহ্যিকভাবে এটি একটি সর্বজাতীয় সাধারণতন্ত্র হলেও এর ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলামী নীতি-আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ সনদ ইসলামকে উপেক্ষা করে না; বরং তা পরোক্ষভাবে ইসলামেরই বিকাশের পথ উন্মুক্ত করেছে।
মদীনা সনদ মদীনার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। প্রতিষ্ঠিত হয় অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্য ও সংগতি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি। সৃষ্টি হয় পরমতসহিষ্ণুতার এক নির্মল পরিবেশ। বিদূরীত হয় দীর্ঘদিনের নৈরাজ্য ও সংঘাতের। যুগ যুগ ধরে যারা যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিল, তারা সন্ধান পেল শান্তিময় ও নিরাপদ জীবনের।
অধঃপতিত সমাজের উন্নয়নে মহানবী (সা) যে যুগান্তকারী ও অনবদ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর বিস্ময়কর সংস্কারমূলক কার্যক্রমে শোধিত হয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনসহ শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান, লেনদেন, পোশাক-আশাক, চালচলন, আহার-নিদ্রা, চলাফেরা–এক কথায় মানব- জীবনের সকল ক্ষেত্র। তিনি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্টিত রাষ্ট্রের সামাজিক সুবিচার, সামাজিক শান্তি ও সংহতি নিশ্চিত করেন এবং অর্থিৈনতক শ্রেষ্ঠত্ব, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার এক মহান ও অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন সৃষ্টি করেন। তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে, মহানবী (সা) ছিলেন একজন আদর্শ সমাজ- সংস্কারক, আদর্শ রাজনীতিবিদ, আদর্শ সমরনায়ক, রাষ্ট্রনায়ক, আদর্শ সমাজবিচারক, আদর্শ প্রশাসক, আদর্শ স্বামী ও আদর্শ পিতা।
মদীনার ঐতিহাসিক সনদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ব্যক্ত হয়েছে তা হলো: ধর্মীয় স্বাধীনতা। মহানবী (সা) প্রত্যেক সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বীকে স্ব-স্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা প্রদান করে সর্বপ্রথম বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ইসলাম মূলত শান্তি-সংহতি, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার ধর্ম। বিশ্বজনীন ধর্ম ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতাকে মানুষের মৌলিক অধিকাররূপে শুধু স্বীকৃতিই দেয়নি; বরং সে অধিকার- দানের বাস্তব ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। কুরআনে ঘোষিত হয়েছে— “ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে কোনরূপ বাধ্যবাধকতা নেই, সঠিক পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।” এ জন্যই ইসরামের ইতিহাসে এমন কোন নযীর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোন অমুসলিমকে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। আজো যদি আমাদের জাতীয় জীবনে ইসলামী অনুশাসনের যথার্থ প্রতিফলন ঘটে, তাহলে কোন অমুসলিম তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না; বরং তারা পাবে তাদের প্রকৃত মর্যাদা ও যথার্থ অধিকার। যেমনটি পেয়েছিল তারা মহানবী (সা)-এর যুগে। অমুসলিমদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মনিরেপক্ষতার ভূয়া শ্লোগান তুলতে হবে না। আজকে আমাদের ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা)-এর রাষ্ট্রনীতি ও শাসননীতি জানা না থাকার কারণে ঐসব শ্লোগান দিচ্ছি আমরা। আসলে যে ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা) অমুলমানদের মানবিক ও ধর্মীয় সর্বপ্রকারের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তা সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগ ও বাস্তবায়িত করেছেন, তা আমাদের জানা নেই।
মহানবী (সা)-এর সংস্কার-বিপ্লবে ও শান্তি-সংগ্রামে প্রাক-ইসলামী যুগে চরমভাবে অবহেলিতা, নিপীড়নের বুলডোজারে নিষ্পেষিতা ও অধিকার বঞ্চিতা নারী জাতি সামগ্রিকভাবে লাভ করেছে তাদের নিজ নিজ অধিকারসমূহ। ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থিৈনতক, রাজনৈতিক তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করেন। তাঁর মুক্তি-বিপ্লবে নারী পেয়েছে মর্যাদার শ্রেষ্ঠ আসন।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য চিন্তা ও মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ দান করে মহানবী (সা) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রিকভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। রাসূল (সা) বলেন: সাদা-কালো, ধনী-গরীব, প্রভু-ভৃত্য, শাসক-শাসিত, মালিক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ সমঅধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
যে সমাজ ব্যবস্থায় জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা ছিল না, কুণ্ঠিতও হতো না নর হত্যার মত জঘন্য কর্মেও কেউ, মহানবী (সা) জীবনের নিরাপত্তা বিধানে ঘোষণা করে বলেন: জীবনদাতা আল্লাহ; মানুষ তো এক পিপড়ার ডানাও সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না, সুতরাং যে মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না তার পক্ষে অন্যের প্রাণ হরণের কি অধিকার থাকতে পারে? তাই তিনি বলেন, নরহত্যা হারাম, কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল। আর কেউ কাউকে বাঁচালে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই বাঁচালো।
যে সমাজব্যবস্থায় অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা কোন দূষণীয় কাজ বলে গণ্য হতো না; চুরি-ডাকাতি ও দস্যুতা পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছিল। আর সম্পদের নিরাপত্তার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি অধিকার। সমাজ উন্নয়নে এর অপরিসীম গুরুত্ব। তাই মহানবী (সা) এ অধিকার বাস্তবায়নে ঘোষণা করেন: যদি কোন ব্যক্তি কারো এক বিঘত জমিও জবরদস্তি দখল করে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত-স্তর জমীন ঝুলিয়ে দেয়া হবে। অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি স্বীয় ধন-সম্পদ হিফাযত করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে সে শহীদ।
মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলো ইজ্জতের নিরাপত্তা। যে সমাজে মানুষের এ গুরুত্বপূর্ণ ইজ্জতের কোনরূপ নিরাপত্তা ছিল না, মানুষের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হতো, সে সমাজে মহানবী (সা)-এর আমূল সংস্কারে মানবতা লাভ করেছে পরিপূর্ণভাবে ইজ্জত ও সম্মানের নিরাপত্তাপূর্ণ নিশ্চয়তা। এক হাদীসে রাসূল (সা) হযরত আদী (রা)-কে (ইসলাম গ্রহণের পর) বললেন: “ইসলামের কল্যাণে এমন একদিন আসবে যে, একজন পর্দানশীন রমণী নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিন্তমনে হিরা (শহর) থেকে ‘হাযরামাওত’ (নগর) পর্যন্ত দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে পারবে।” এটি শুনে আদী (রা) অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। কারণ তিনি তাঈ বংশীয় সরদার ছিলেন। তাঈদের লুটতরাজ ও ডাকাতির কথা তাঁর জানা ছিল। এতসব ডাকাতের মধ্য দিয়ে একাকিনী একটি যুবতী নিরাপদে ভ্রমণ করবে কিরূপে? এসব ডাকাত কোথায় যাবে, কি হবে? এ জন্যই তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কয়েক বছর পরেই রাসূল (সা)- এর উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন।
যে সমাজে ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচারের লেশমাত্র ছিল না; জোর যার মুলুক তার–এর করুণ চিত্র ছিল সর্বত্র। গোটা সমাজ জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতনে বিষাক্ত হয়ে পড়েছিল। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল মরুর আকাশ-বাতাস। শোষকের শোষণে ঢেকে গিয়েছিল মানবতা।
মহানবী (সা) জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য ন্যায়পরায়ণতার সাথে ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: “তোমরা যখন বিচার কর, তখন ন্যায়বিচার কর।” একদা মাখযুম বংশীয় জনৈকা নারী চুরিতে ধরা পড়লে রাসূল (সা)-এর কাছে এর বিচার ভার পেশ করা হয়। এ সম্ভ্রান্ত মহিলার শাস্তি বিধান হবে মনে করে কুরায়শগণ বিচলিত ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। হযরত উসামা (রা)-কে তারা সুপারিশের জন্য তাঁর কাছে প্রেরণ করে। সুপারিশ শুনে রাসূল (সা) বলেন, তোমরা কি আল্লাহর নির্ধারিত বিধানেও সুপারিশ করবে? অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন: পূর্ববর্তী উম্মতরা শুধু এ জন্যই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে যে, বড় লোক চুরি করলে তাকে শাস্তি দেয়া হতো না, আর কোন গরীব লোক চুরি করলে তার জন্য শাস্তির বিধান হতো। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি : যদি মুহাম্মদ (সা)-এর কন্যা ফাতিমা চুরি করত তবে আমি তার হাতও কেটে ফেলতাম।
চৌর্যবিদ্যায় প্রায় লোকই সুপণ্ডিত ছিল। এ জন্যই ইসলাম গ্রহণ করতে আসলে রাসূল (সা) স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কাছ থেকে চুরি না করার অঙ্গীকার গ্রহণ করতেন। পবিত্র কুরআনেও আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে এরূপ প্রতিশ্রুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
অর্থনৈতিক সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করা সম্ভব নয়। সুদের মত সমাজ ও জাতিবিধ্বংসী অভিশাপে যখন পুরো সমাজ আক্রান্ত। ঘুষ, লটারি বাজি, জুয়া, মওজুদদারী, কালোবাজারী ইত্যাদি দ্বারা যখন গোটা সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল তখন মহানবী (সা) সুদ, জুয়া ও মওজুদদারীসহ সমস্ত জুলুম- অত্যাচারের মূলোৎপাটন করে একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেন এবং প্রতিটি নাগরিকের জন্য ছয়টি অর্থনৈতিক অধিকার ঘোষণা করেন: (ক) বাসস্থান (খ) খাদ্য (গ) বস্ত্র (ঘ) শিক্ষা (ঙ) চিকিৎসা ও (চ) বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থা।
সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য তিনি সম্পদের সুষম বন্টনের ব্যবস্থা করেন। জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা এবং সম্পদে ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি দেন। আবার ব্যক্তিমালিকানার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা রোধের জন্য নৈতিক প্রশিক্ষণ এবং আইন প্রণয়ন করেন।
বস্তুত যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন এর উৎস ছিল পাঁচটি : (১) যাকাত (২) গনীমতের সম্পদ (৩) জিজিয়া (কর) (৪) সাদাকাহ (৫) খারাজ (৬) ফায়৷
ইসলামপূর্ব আরবে শ্রমিকের কোন মর্যাদা স্বীকৃত ছিল না। সকল প্রকার অধিকার থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। মালিকশ্রেণীর নির্যাতনে শ্রমিকশ্রেণীর প্রাণ হয়ে গিয়েছিল ওষ্ঠাগত। তার থেকে মালিক শুধু কাজই আদায় করবে, বিনিময়ে দিবে না তাকে মর্যাদার সাথে জীবন-যাপনের ন্যূনতম অধিকারটুকু।
পক্ষান্তরে মহানবী (সা) শ্রমিকদের জন্য মর্যাদার সাথে জীবনযাপনের সব রকম অধিকার নিশ্চিত করেন। সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত; কোন বিশেষ মালিকের অধীনে কাজ করতে সে বাধ্য ছিল না। রাসূল (সা)-প্রবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকদের মনে করা হতো মর্যাদাশীল নাগরিক। তাকওয়ার কারণে মর্যাদার পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া ছাড়া অন্য কোন কারণে ইসলাম মর্যাদার পার্থক্য স্বীকার করে না। রাসূল (সা) ঘোষণা করেছেন: শ্রমিকরা তোমাদের ভাই। আলাহ্ তাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করেছেন। তোমরা যা খাবে তাই তাদের খেতে দিবে, তোমরা যা পরবে তাই তাদের পরতে দিবে। আর তাদের পক্ষে যে কাজ করা কষ্টকর তা করতে তাদের বাধ্য করবে না। তিনি আরো বলেন: শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু। তার পারিশ্রমিক ঘাম শুকাবার পূর্বে পরিশোধ করে দাও। মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ কর না।
শ্রমিকের ব্যাপারে এরূপ শত শত অধিকারের কথা হাদীসে ব্যক্ত হয়েছে। বস্তুত এমন সুন্দর কথা, অধিকারের কথা, মর্যাদার কথা মহানবী (রা) ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কেউ বলতে পারেনি।
শাস্তি প্রতিষ্ঠার অবিরাম সংগ্রামে মহানবী (সা) অনন্যোপায় হয়ে কখনো কখনো যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি যুদ্ধের রক্তারক্তির বীভৎস অবস্থা কখনো পছন্দ করেন নি। মানবদেহের কোন অঙ্গে পচন ধরলে যেমনিভাবে গোটা দেহ রক্ষা করার জন্য উক্ত অঙ্গ কেটে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না, অনুরূপভাবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে সব আল্লাহদ্রোহী অপশক্তি বাদ সেধেছিল তাদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধারণে তিনি কুণ্ঠিত হন নি। তাঁর যুদ্ধনীতির ছিল ভিন্ন এক চিত্র। তাঁর সমরনীতির ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্য, যার নজীর পৃথিবী আজো পেশ করতে পারেনি। মহানবী (সা)-এর যুদ্ধনীতির ও সমর অভিযানের মৌলিক কয়েকটি দিক হলো: তিনি বলেছেন, আক্রমণের জন্য কখনো আকাঙ্ক্ষা পোষণ কর না। নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর শরণাপন্ন হও। শত্রুপক্ষের নির্দোষ নারী, অসমর্থ বৃদ্ধ ও শিশুদের হত্যা কর না, কোন শত্রুকে আগুন দিয়ে শাস্তি দেয়া যাবে না। মারা যাবে না। অনুরূপভাবে তিনি শত্রুদের ফলন্ত গাছ না কাটার জন্য এবং পরাজিতদের সম্পদ নষ্ট না করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এমনভাবে প্রতিপক্ষের কেউ নিজেকে মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিলে তাকে হত্যা করার পক্ষপাতী ছিলেন না মহানবী (সা)। একবার এক যুদ্ধে এরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর তিনি হত্যাকারীকে শাসিয়ে বললেন, তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছ? তুমি কি করে বুঝলে যে, তোমার তরবারির ভয়ে সে মুসলমান পরিচয় দিয়েছে?
মূলত মহানবী (সা)-এর যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল একান্তভাবে শান্তি ও স্থিতিশীলতার মহান লক্ষ্যে। তাঁর সমরনীতিতে অনর্থক রক্তক্ষয়ের উন্মাদনা ছিল না। তাঁর জীবনে অনুষ্ঠিত যুদ্ধগুলোতে উভয়পক্ষের নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৬২। অথচ এরই মধ্য দিয়ে সংঘটিত হলো আরব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক বিপ্লব, শান্তি ও মুক্তির উন্মুক্ত রাজপথ, ঐক্য ও সংগতির বিস্ময়কর পরিস্থিতি, কল্যাণবাদী মহা ইনকিলাব, অভূতপূর্ব অনুকরণীয় সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা।
মক্কা বিজয়ের মধ্যদিয়ে মহানবী (সা) শান্তি-বিপ্লবের পরিণতির দিকে এগিয়ে হুদায়বিয়ার সন্ধি-চুক্তি ভঙ্গ করে তখন মহানবী (সা) মক্কা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি সমর-প্রস্তুতরি সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা করেন। কারণ যদি মক্কাবাসী জানতে পারে তাহলে তারাও বিপুল সমরায়োজন করবে এবং এতে মারাত্মকভাবে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হবে। কুরায়শরা এতে সমূলে বিনাশ হয়ে যাবে। মহানবী (সা) রণাঙ্গণে দাঁড়িয়েও শান্তির পরিপন্থী বিজয় চাননি; বরং তিনি চেয়েছেন প্রেম-ভালবাসা দিয়ে মক্কা বিজয় করতে।
অনন্তর মক্কা বিজয় হল। মক্কার অধিবাসীরা ভাবল আজ আর রক্ষা নেই। সুদীর্ঘ একুশটি বছর ধরে যাঁর প্রতি আমরা সীমাহীন অবিচার-অনাচার, জুলুম-নির্যাতন করে এসেছি আজকের এ মহাবিজয়ের দিনে তিনি আমাদেরকে কোনক্রমে রেহাই দিবেন না। কিন্তু বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক, দয়ার মূর্তপ্রতীক মহানবী (সা) সে দিনও তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন : “আজ তোমাদের প্রতি কোন প্রকার অনুযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন। তিনি সমস্ত দয়ালু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু। যাও, তোমাদেরকে মুক্তি প্রদান করলাম, তোমরা স্বাধীন।”
কী অপরূপ করুণা, কী অসামান্য মহিমা! এত বড় ক্ষমা বিশ্ব-ইতিহাসে বেনজীর, এরূপ মহানুভবতা কি পৃথিবী কোনদিন প্রত্যক্ষ করেছে? ধর্মগ্রহণের জন্য বলপ্রয়োগ নেই, প্রতিশোধ গ্রহণের কোন কথা নেই। প্রাণের শত্রুকে হাতে পেয়ে এমনভাবে ক্ষমা করার ইতিহাস কে সৃষ্টি করতে পারে? মহানবী (সা)-এর অপূর্ব ও অপরূপ ক্ষমা এবং করুণা দর্শন করে কুরায়শরা অভিভূত হয়ে পড়ল। তারা সজল নয়নে নির্বাক বদনে মহানবী (সা)-এর পবিত্র মুখ পানে চেয়ে রইল। বিশ্ববিবেক এখানে স্তম্ভিত, বিমূঢ়। এও কি কোন মানবসত্তা দ্বারা সম্ভব! মানবাত্মা কি এত বিশাল হতে পারে! মনুষ্যবিবেক যা কল্পনা করতে পারে না মহানবী (সা) তা-ই করলেন।
বস্তুত পৃথিবীর ইতিহাসে বহু চমকপ্রদ বিজয়-কাহিনী লেখা হয়েছে। অনেক দিগ্বীজয়ীর বিজয়-কীর্তি সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এরূপ রক্তপাতহীন এবং হত্যাযজ্ঞ-মুক্ত মহা বিজয় কি পৃথিবী দেখেছে? কত সুন্দর এ বিজয়! রক্তপাত নেই, ধ্বংস -বিভীষিকা নেই, শুধু প্রেম ও মমতা দিয়ে এ বিজয়, এ সাফল্য।
মক্কা বিজয় নিছক কোন-একটা দেশ বা ভূখণ্ড বিজয় নয়; বরং এটি আদর্শের বিজয়, অন্ধকারের উপর আলোর বিজয়। অন্ধকার ধরণী যুগ যুগ ধরে এ আলোর স্বপ্ন দেখেছিল-এ দিগ্বিজয়ী মহামানবের প্রতিক্ষায় প্রতীক্ষমাণ ছিল। এ বিজয় বিশ্বে যুগান্তর এনেছে। এ বিজয় জগতে নতুন জাতি, নতুন সভ্যতা গড়েছে।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অবিস্মরণীয় সংগ্রাম, মুক্তি-বিপ্লবের গতিশীল উত্তরণ, সামাজিক সংস্কারের ধারাবাহিকতায় মহানবী (সা)-এর মহাযাত্রার সময় ঘনিয়ে এল এবং যখন তিনি মহান বন্ধুর নেপথ্য আহ্বান শুনতে পেলেন তখন তিনি পরম বন্ধুর সাথে মিলনের কিছুকাল পূর্বে ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানের বিশ্বসম্মেলনে অন্যান্য ছিল আঁধার যুগের সমস্ত ধ্যান-ধারণাকে ভুলে নতুন আলোকে পথ চলার আহ্বান। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন: হে মুসলমানরা, আমার মনে হয় আমি এবং তোমরা এরপর এই মজলিসে পুনর্বার কখনো সমবেত হব না। মনে রেখ, অন্ধযুগের সমস্ত নিয়ম-পদ্ধতি আমার পদতলে পদদলিত। তদানীন্তন পৃথিবীর মানব জাতির উচ্চ সভ্যতা লাভে জাতিভেদ, জাত্যাভিমান, উঁচু-নিচুর পার্থক্য এবং ছোট-বড়র তারতম্য ছিল প্রধান অন্তরায়। রাজার সম্মুখে প্রজা, দর্শযাজকের সম্মুখে সর্বসাধারণ, অভিজাত সম্প্রদায়ের চক্ষে নীচু বংশীয়গণ এবং প্রভুর সম্মুখে দাসগণ ছিল পশুতুল্য।
তিনি এ জাতিভেদ ও অসাম্যের মাথায় কুঠারাঘাত করে বলেন: হে মানব সম্প্রদায়, নিশ্চয় তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা এক। সাবধান, অনারবের উপর আরবের কিংবা আরবের উপর অনারবের, কালোর উপর সাদার কিংবা সাদার উপর কালো মানুষের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যার মধ্যে আল্লাহভীতি আছে সে-ই শ্রেষ্ঠ। প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সুতরাং সমস্ত মুসলমান পরস্পর ভাই- ভাই। তোমাদের দাসগণ তোমাদেরই দাস। অতএব, তোমরা যা খাও তাদেরকে তাই খেতে দাও, তোমরা যা পরিধান কর তাদেরকে তাই পরিধান করতে দাও।
অন্ধযুগের সমস্ত খুন অর্থাৎ প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল করা হলো। আমি সর্বপ্রথম (আমার নিজ গোত্রের) রবী’আ ইবন হারিসের পুত্রের খুন অর্থাৎ তার খুনের প্রতিশোধ গ্রহণ বাতিল করলাম।
অন্ধযুগের সমস্ত সুদ বাতিল করা হলো। সর্বপ্রথম স্বগোত্রীয় মহাজনের সুদ অর্থাৎ (আমার চাচা) আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করলাম।
নারীদের সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমাদের যেমন নারীদের উপর হক (অধিকার) আছে, তদ্রূপ নারীদেরও তোমাদের উপর অধিকার আছে।
হে মানবগণ! তোমাদের এ পবিত্র শহরে (মক্কায়) বর্তমান যুলহজ্জ মাসের আজকের পবিত্র দিনটি যেমন মর্যাদাপূর্ণ, তদ্রূপ কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের একের প্রাণ ও ধন-সম্পদ অপরের কাছে এরূপ মর্যাদাপূর্ণ। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত কারো প্রাণ কিংবা ধন-সম্পদ হানি করা তোমাদের জন্য কঠোর হারাম।
অতএব, আজকের সংঘাতময় পৃথিবীতে, অশান্ত রাষ্ট্রে, নৈরাজ্যকর সমাজে ও কলহপূর্ণ পরিবারে এবং মানুষের নিরাপত্তাহীন ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি ও মুক্তির বিপ্লব ঘটাতে হলে মহানবী (সা)-এর অমর নীতিমালার ভিত্তিতে এগুতে হবে আমাদেরকে। কারণ আজো আমাদের সামনে তাঁর সামগ্রিক নীতিমালা ও কালজয়ী আদর্শের অবিকল চিত্র রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের অন্য কোন পথ নেই। এর অনুসরণের মাধ্যমেই কেবলমাত্র গড়ে তোলা সম্ভব একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ, ভীতিহীন ও কল্যাণকর সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা।
***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।