রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দৃষ্টিতে সংস্কৃতির রূপরেখা

রচনায়: দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

‘সংস্কৃতি’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দেরই বিশেষ্য (noun); তাতে প্রকাশ করা হয়-অসংস্কৃত বা অপরিচ্ছন্ন শব্দেরই পরিচ্ছন্ন বা বিশুদ্ধ রূপ। এতে একটা নেতিবাচক ভাব প্রকাশ পায়। অর্থাৎ যা ছিল অপরিচ্ছন্ন তাকেই পরিচ্ছন্ন করার ক্রিয়াশীলতা বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একাদশ শতাব্দীতে সেনরাজগণ বঙ্গদেশ অধিকার করার পরে এদেশে উচ্চকোটী মহলে প্রবর্তিত ভাষার বিকৃতি সহ্য করতে না পেরে সে ভাষাকে সংস্কৃত করেছিলেন। এজন্যই এ অঞ্চলে তা সংস্কৃত ভাষা বলে প্রচলিত।

তবে সে ‘দেবভাষা’ সংস্কৃত হয়ে এক নতুন রূপ লাভ করে। এজন্য তাদের রাজধানী গৌড়ে তা গৌড়ীয় রীতি বলে স্বীকৃতি লাভ করে। সুবিখ্যাত কবি জয়দেবের ‘গীত গোবিন্দ’ সে ভাষায়ই লিখিত। এজন্য জীবনের বিভিন্ন দিককে সুঠাম, শোভন ও সুন্দররূপে প্রকাশ করাকে সংস্কৃতি না বলে কালচার বলাই শ্রেয়। এ কালচারের মধ্যে ইতিবাচক ভাব বর্তমান। এতে বোঝা যায়, জীব হিসাবে মানুষের অন্যান্য প্রাণী থেকে তার আচার-আচরণ প্রকাশ করাতে একটা বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। জীব হিসাবে মানুষেরা অন্যান্য জীবের মত আহার নিদ্রা, মৈথুন বা অন্যান্য কাজকর্মও করে, তবে সে কর্মের মধ্যে রয়েছে একটা সুঠাম সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা, যা অন্য প্রাণীর মধ্যে নেই। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মত পূর্বোক্ত কাজ-কর্মাদি করে থাকে। তবে তাদের মত খাপছাড়া বা ছন্নছাড়াভাবে করে না। তাতে রয়েছে লক্ষ্য ও আদর্শের ক্রিয়াশীলতা। তার উপর মানুষের জীবনে রয়েছে তার কৃতকর্মকে স্থায়ী করার জন্য প্রবল বাসনা। সে যেমন অমর হতে চায় তেমনি তার এ অমরত্বকে নানাভাবে চিরস্থায়ী করে রাখার ব্যবস্থা করতে সে চায়। নানা জাতীয় পাখি মানুষের চেয়ে আরও কুশলতা প্রকাশ করে তাদের বাসা বুননকালে। তবে সে বাসাতে তাঁরা দু’বার ডিম প্রসব করে না বা সন্তানকে লালন-পালন করে না। মানুষ তাঁর যৌনসাথী গ্রহণ করে ঘর তৈরি করে, তাতে সন্তান- সন্তুতিকে লালন-পালন করে। এ ঘর নষ্ট হলে বা একে পরিত্যক্ত করতে হলে পথিপার্শ্বেই হউক বা বনপথেই হউক অন্ততপক্ষে থাকা-খাওয়ার জন্য অন্য ঘর তৈরি করে। তেমনি বন্য পশুরাও কোন স্থায়ি বাস তৈরি করে না। মানুষের জীবনের নানা ক্ষেত্রে এবং নানা পর্যায়ে সে স্থায়ীভাবে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সে যেমন ঘরবাড়ি তৈরি করে তেমনি তাঁর জীবনের প্রয়োজনের জন্যে নানাজাতীয় পশু ও পাখিকে পালন করে; সে তাঁর খাদ্য ও বাসের উপযোগী লতাগুল্ম, গাছপালা প্রভৃতিও রোপণ করে। এগুলোকে তাঁর কালচার বলা হয়। এজন্য তার এ সব কাজকর্মকে সংস্কৃতি না বলে কালচার বলাই উচিত।

আল্লাহর রাসূল (সা)-এর জীবনে এ কালচারকে কিভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, তার বর্ণনাই এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। তবে বাংলা ভাষায় কালচার এবং সংস্কৃতিকে সমার্থবাচক মনে করা হয় বলে তাঁর জীবনে সংস্কৃতি বলতে তিনি জীবনের প্রতি পর্যায়ে ও প্রত্যেক ক্ষেত্রে মানব জীবনের সুপরিচালিত ও সুন্দর প্রকাশ মনে করতেন। আহারে, বিহারে, পোশাক-পরিচ্ছদে, আলাপ-আলোচনায় এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি নিজেও তাঁর সঙ্গীয় সাহাবীদের মধ্যে শৃঙ্খলা, সুঠাম ও সুন্দর-অবস্থান পালনের জন্য নির্দেশ দিতেন। এজন্য তাকে এ দুনিয়ার সংস্কৃতি-জগতের শ্রেষ্ঠতম পথনির্দেশক বলা যেতে পারে। তাঁর সম্বন্ধে একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। তিনি বলতেন: আল্লাহ পরম সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। এজন্য তিনি নিজেও অত্যন্ত সুন্দর বদনমণ্ডলের অধিকারী হয়েও সর্বদাই চিরুনী দ্বারা তাঁর দীর্ঘ কেশ ও পরিমিত দৈর্ঘ্যের শ্মশ্রুকে পরিষ্কার করতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ের নামাযের পূর্বে মিসওয়াক দ্বারা দাঁত মাজন করতেন। তিনি সর্বদাই সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। তাঁর চলার সময় তিনি সামনের দিকে একটু ঝুঁকি দিয়ে অগ্রসর হতেন এবং তাঁর পার্শ্ববর্তী লোকদের চলার পথে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করতেন না। তিনি যখন উটের উপর সওয়ার হতেন তখন তাঁর সঙ্গে যারা চলেন, তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম আরোহণ করেছেন, তাকে সর্বশেষ আসন গ্রহণ করতে বলতেন। এতে উদ্দেশ্য ছিল যাতে অন্য আরোহীর পক্ষে আরোহণ করতে কোন প্রতিবন্ধকতা দেখা না দেয়। তিনি একই খাঞ্চাতে অনেক লোককে নিয়ে আহার করতে ভালবাসতেন। তবে আহারের সময় যাতে একের লোকমা বা গ্রাসের দ্বারা অপরের কোন ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। তিনি প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে এমন পরদা ও পুশিদার সহিত সে কাজ সম্পন্ন করতেন যে, তা আজওয়াজ-ই-মুতাহহারাত বা মু’মিনদের মাতৃসমা তাঁর স্ত্রীগণের সম্মুখেও তা করতেন না। আম্মা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তাঁর ও তাঁর স্বামী হযরত রাসূল-ই-আকরাম (সা) সম্বন্ধে বলেছেন: আমরা একে অপরকে দেখি নাই।

এতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যে লজ্জা ও সম্ভ্রম বজায় রাখা দরকার তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাতে দাম্পত্য জীবনেও যাতে সম্ভ্রমশীলতা বজায় থাকে তাঁর প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর জীবনের মোদ্দা কথা হচ্ছে: তাতে সংযম, সংহতি ও সুঠাম পরিস্থিতি গঠন করা উচিত, ইসলামের ইতিহাসে বদর ও ওহুদের যুদ্ধে মুসলিম বীরদের কে কোথায় স্থান গ্রহণ করবেন, তা যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই নির্দেশ করা হয়েছিল। শত্রুপক্ষের মহাবলশালী ও অধিক সংখ্যায় পরাজিত সৈন্যগণ পলায়নপর হলেই মুসলিম সৈন্যগণ তাদের অনুসরণ করতে চাইলে তিনি তীব্রস্বরে তা নিষেধ করেন। কারণ সুসভ্য ও প্রকৃত সংস্কৃতিমনা লোকেরা শত্রুদের সমূলে ধ্বংস কামনা করেন না। এমন কি ওহুদের যুদ্ধে তাঁর কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় মহাবলশালী তাঁর চাচাকে অমানুষিকভাবে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করার পরে সে যুদ্ধ অমীমাংসিত থেকে গেলেও তিনি তাঁর পক্ষের মুজাহিদগণকে শৃঙ্খলার সাথে প্রত্যাগমন করতে আদেশ করেছিলেন। এ যুদ্ধে তাঁর নিজের কয়েকটা দাঁত শত্রুপক্ষের অস্ত্রের আঘাতে নষ্ট হলেও তিনি ধৈর্য হারান নি; বরং শৃঙ্খলার সঙ্গে প্রত্যাগমন করতে নির্দেশ দেন। জীবন-সায়াহ্নে তাঁর জন্মভূমি মক্কা অধিকার করার পরে তাঁর কাছে ঘোরতর অপরাধী শত্রুপক্ষের মধ্যে তাঁর চাচার হত্যাকারী হিন্দা এবং তাঁর পূর্ববর্তী জীবনের ঘোরতর শত্রু আবূ সুফিয়ানের মত লোককেও তিনি ক্ষমা করেছেন।

তাঁর চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাল্যকাল থেকেই তিনি আল্লাহর তরফ থেকে সংযম, সংহতি, প্রেম, দয়ামায়া প্রভৃতির অনুশীলন করার তাগিদ পেয়েছেন। নবুয়ত লাভের পরে সেগুলোকে জীবনের প্রতি পদে রূপায়িত করার তাগিদ খোদ আল্লাহর নিকট থেকে পেয়েছেন। এ জন্যই তাঁকে বলা হয় মানুষের নবী। তিনি মানুষের নবী ছিলেন বলেই তাঁর দৃষ্টিতে মানুষের সংস্কৃতি ছিল উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও আদর্শের ক্রিয়াশীলতা। মানুষের জীবনের সকল পর্যায়েই তাকে এ তিনটি বিষয় কার্যকরী। তাঁর জীবনের আদর্শের প্রভাব থাকে বলেই মানুষ তাঁর জীবনের সকল কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে; পশুপাখির মত প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া বা ইনসান-ই-কামিল হওয়া। এ স্তরে উত্তোলিত হলেই মানুষের পক্ষে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে তাঁর পক্ষে এ জগৎ শাসন করা যায়। তাই তিনি তার জীবনে যে সব কাজকর্ম করে গেছেন- সেসব কাজকর্মের মাধ্যমে তিনি স্বয়ং যেমন ইনসান-ই-কামেল হতে পেরেছেন, তেমনি এ দুনিয়ার মানবজাতিকে ইনসান-ই- কামেল করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। এতে মানবজীবনে আদর্শিক সংস্কৃতি কিভাবে গঠিত হবে তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রকাশ পেয়েছে।

তাঁর জীবনধারা পাঠ করলে দেখা যায়, আহার, বিহার ইত্যাদি নানা কাজকর্মে তিনি মধ্যপন্থা গ্রহণ করেছেন। কোন কিছুই যেন মাত্রার অধিক না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী দু’জন মহামনীষীর জীবনচরিত পাঠ না করেও অনুসরণ করেছেন। তাঁর মতে গ্রীকদেশীয় দার্শনিক এরিষ্টটল ও ভারতীয় ধর্মপ্রবর্তক বুদ্ধও সেই মধ্যপন্থা অবলম্বনকে শ্রেয় বলে গণ্য করতেন। তিনি এ মধ্যপন্থার নির্দেশ কুরআন-উল-করীম থেকে অনুসরণ করেছেন। তাতে আল্লাহ মু’মিনদের উদ্দেশ করে বলেছেন: তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। এ সীমা দ্বারা মধ্যপন্থাকেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ সীমা থেকে সুষম বিষয়ের উৎপত্তি হয়। এ দুনিয়ায় সংস্কৃতির লক্ষ্য হচ্ছে সুষম বিষয় বা সৌন্দর্যের সৃষ্টি। সে সৌন্দর্যের সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে পরিমিতি। আধুনিক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল তাঁর এক বক্তব্যে বলেছেন, অংকশাস্ত্রের মধ্যেই সেই পরিমিতি সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। যখন একটা অংকের মধ্যে লেখা (ট+ঠ)=ট+২টঠ+ঠ তখন বুঝতে হবে তাঁর দু’দিকের মধ্যে সমতা বর্তমান। রাসেল বলেন: সৌন্দর্যের মূলে রয়েছে সমতা। যে সকল বিষয়কে আমরা সুন্দর বলে অভিহিত করি, তাদের মধ্যে নানাদিক দিয়ে সে সমতা বর্তমান। এজন্য মানুষের জীবনে প্রকৃত সংস্কৃতির সৃষ্টি করতে হলে তাঁর কাজকর্মে, আহারে-বিহারে, তাঁর সৃষ্টিতে সে সমতার রয়েছে প্রয়োজন। বর্তমানকালে মানব-সংস্কৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করলে দেখা যায়, তাতে রয়েছে সমতার একান্ত অভাব। এ সমতার অভাবের ফলেই মানব জীবনে দেখা দিয়েছে নানাবিধ দুঃখ-দৈন্য ও কলুষতা। মানব জীবনে এ সমতার অভাবেই দেখা দিয়েছে অসম হিংসা ও বিদ্বেষ। সে হিংসা ও বিদ্বেষের ফলে এক জাতি অপর জাতিকে ধ্বংস করতে সর্বদাই তৎপর।

অতএব আমাদের সংস্কৃতিকে বিদ্বেষমুক্ত করে গঠন করতে হবে। মানুষের জীবনে সৌন্দর্য, প্রেম, দয়ামায়া, দাক্ষিণ্য প্রভৃতিকে সৃষ্টি করে মানব সমাজকে পুনরায় গঠন করতে হবে। রাসূল (সা)-এর আদর্শের আলোকেই।

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত***

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88