বাইআত কি ও কেন ? (১ম পর্ব)

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম।
আলহামদুলিল্লাহ, ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।

‘বাইআত’ শব্দটির সাথে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। এর সঠিক উচ্চারণ হচ্ছে ‘বাইআহ’ আর এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ক্ষমতা প্রদান ও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ, আনুগত্যের শপথ, চুক্তি, আনুষ্ঠানিক আনুগত্য, আনুগত্যের চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, ক্রয় বিক্রয় করা প্রভৃতি।
‘বাইআহ’ নিয়ে আমাদের সমাজে দুই ধরণের দলের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। একদল হচ্ছে বিভিন্ন পীর-মাজার পন্থি, যাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘পীর ধরতে হবে, পীরের নিকট বাইআহ নিতে হবে’, ‘যার পীর নেই তার পীর শয়তান’ প্রভৃতি এই ধরণের কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে পীর ধরতে হবে, তার নিকট থেকে ফয়েজ হাছিল করতে হবে। আরেকদল হচ্ছে ইসলামী (!) রাজনৈতিক দল, যাদের আমীর থাকে এবং সেই আমীরের আনুগত্য করতে হয়, আর এই ক্ষেত্রে তারা কতিপয় হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করে থাকে, উদাহরণ স্বরুপ: হারেস আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি। যথাঃ ১. মুসলিমদের জামাত এবং সংগঠনের সাথে নিজেকে জড়িত রাখবে। ২. আমীরের নির্দেশ মেনে চলবে। ৩. শরী’আতের নির্দেশ ভঙ্গ না করা পর্যন্ত আমীরের আনুগত্য করবে। ৪. হিজরত করবে। ৫. আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। আসলেই যে ব্যক্তি মুসলামনদের জাম’আত হতে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরল, সে নিশ্চয়ই তার গলদেশ থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল। যে পর্যন্ত না সে ফিরে এসে পুনরায় ঐ জাম’আতের সাথে মিলিত হয়। আর যে ব্যক্তি বর্বর যুগের রীতি-নীতির দিকে অনুষদদেরকে আহবান করবে সে দোযখীদের অন্তর্ভূক্ত। চাই সে সাওমব্রত পালন করুক, ছালাত আদায় করুক এবং নিজেকে মুসলিম বলে ধারণা করুক।” (আহমদ, তিরমিযী, মিশকাত, আলবানী হা/৩৬৯৪, সনদ সহীহ)
আধুনিক কালে বিভিন্ন সংগঠন ও দলে দলীয় প্রধান বা আমীর কর্তৃক কর্মীদের বাইআহ এর বিধান দেখা যায়। তারা এই বাইআহকে ফরজ মনে করেন এবং বাইআহ বিহীন মৃত্যুকে জাহিলিয়াতের মৃত্যু হিসেবে বিশ্বাস করেন।

এহেন পরিস্থিতিতে ‘বাইআহ’ নিয়ে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা আবশ্যক কারণ একদল বাইআহ নিয়ে পীর-মাজার পন্থি হয়ে ঘারে চেপে বসেছে আরেকদল ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিজ নিজ দলের সাপোর্টের জন্যে বাইআহ ব্যবহার করছে। ইসলামী শরীআতে ‘বাইআহ’ বলতে কি বুঝায়, সাহাবীরা ‘বাইআহ’ বলতে কি বুঝতেন আর তারা সেটা কিভাবে আমল করেছেন সেই বিষয়ে আমরা জানার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের নিকট থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ‘বাইআহ’ গ্রহণ করেছিলেন। নিম্নে এসব ‘বাইআহ’ কেমন ছিল তার কিছু চিত্র তুলে ধরা হলঃ

১. ইসলামের প্রতি বাইআহঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের প্রতি বাইআহ গ্রহণ করেছেন। এটি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“হে নবী, যখন মুমিন নারীরা তোমার কাছে এসে এই মর্মে বাইআহ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তারা জেনে শুনে কোন অপবাদ রচনা করে রটাবে না এবং সৎকাজে তারা তোমার অবাধ্য হবে না। তখন তুমি তাদের বাইআহ গ্রহণ কর এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা মুমতাহিনাঃ ১২)

হাদীসে এসেছে, জারীর বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল এর সাক্ষ্য প্রদান, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান, আমীরের কথা শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা এবং সকল মুসলিমের জন্যে শুভকামনার উপর বাইআহ গ্রহণ করেছি। (আহমদ বিন আলী বিন আসকালানী, ফাতহুল বারী, মুসলিম ১/৫৬,৭৫)

জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একজন বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল, ইসলামের উপর আমাকে বাইআহ দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ইসলামের উপর বাইআহ দিলেন। (বুখারী, কিতাবুল আহকাম অধ্যায়, ফাতহুল বারী ১৩/২০৫)

খ. জিহাদের উপর বাইআহঃ
এই বিষয়ে কুরআন এবং হাদীসে অনেক দলীল রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। অতএব তারা মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ ওয়াদা পূরণে আল্লাহর চেয়ে অধিক কে হতে পারে? সুতরাং তোমরা (আল্লাহর সংগে) যে সওদা করেছ, সে সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং সেটাই মহাসাফল্য।” (সূরা তওবাঃ ১১১)

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“আর যারা তোমার কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে, তারা শুধু আল্লাহরই কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে; আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর; অতঃপর যে কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলে তার ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম বর্তাবে তারই উপর। আর যে আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করবে অচিরেই আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।” (সূরা ফাতহঃ ১০)

“অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেছিল; অতঃপর তিনি তাদের অন্তরে কি ছিল তা জেনে নিয়েছেন, ফলে তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করলেন নিকটবর্তী বিজয় দিয়ে।” (সূরা ফাতহঃ ১৮)

হাদীসে এসেছে, মুহাজির ও আনসারগণ খন্দকের যুদ্ধে বলেছিলেনঃ
“আমরাই তারা যারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইআহ নিয়েছি জিহাদের উপর যতক্ষণ আমরা জীবিত থাকব”। (বুখারী, জিহাদ অধ্যায়; মুসলিম)

গ. হিজরতের উপর বাইআহঃ
এটি ইসলামের শুরুতে ছিল। মক্কা থেকে মদিনা আসার পর এটা বন্ধ হয়ে যায়। যেমন: মুজাশিয়ু বিন মাসউদ তাঁর ভাইকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বললেন, তাকে হিজরতের উপর বাইআহ প্রদান করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হিজরত চলে গেছে আমি তাকে ইসলাম, জিহাদ ও কল্যাণের উপর বাইআহ প্রদান করি।

ঘ. পৃষ্ঠ পোষকতা ও প্রতিরক্ষার প্রতি বাইআহঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রতিরক্ষার জন্যে তিহাত্তর জন পুরুষ ও দুজন মহিলার নিকট বাইআহ নিয়েছিলেন। যেটাকে বাইআতুল উকবাতুস সানিয়্যা বলা হয়। এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট বাইআহ নিয়েছিলেন তারা যেভাবে নিজেদের স্ত্রী পরিবার-পরিজন ও সন্তানদের প্রতিরক্ষা করে থাকে তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রতিরক্ষা করবে। (আহমদ, মুসনাদ হা/১৫২৩৭, সনদ সহীহ)

ঙ. শ্রবণ ও আনুগত্যের উপর বাইআহঃ
এটি হল ইসলামী রাষ্ট্রের আমীর কর্তৃক রাষ্ট্র পরিচালক মন্ডলী ও জনগণের বাইআহ। এর প্রমাণে বহু হাদীস রয়েছে। এখানে উবাদা ইবনে সামেত (রা) হতে বর্ণিত একটি হাদীস দেওয়া হলঃ

“তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট প্রতিজ্ঞার উপর বাইআত করেছিলাম যে, আমরা মেনে চলব এবং আনুগত্য করব শান্তিতে অশান্তিতে, সুখে এবং দুঃখে। আমাদের উপর কোন ব্যক্তিকে প্রাধান্য দান করলেও আমরা ধৈর্য অবলম্বন করব, ক্ষমতা ও প্রাধান্যপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিরোধিতা করবো না। সত্যের উপর অটল থাকব, আমরা যখন যেখানে থাকি না কেন, আল্লাহর পথে কোন সমালোচনাকারীর সমালোচনাকে এতটুকু পরওয়া করব না।” (মুসলিম, মিশকাত)

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

– অনুলিখন ও সংক্ষেপায়নে : উমর

এই লেখাটি লিখতে যে বইটির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে-
ইসলামে বাইআত, মোঃ আবূ তাহের, গ্রন্থনা: আব্দুছ ছবূর চৌধুরী।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88