যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম
রচনায়: শামসুল আলম, যুগ জিজ্ঞাসা সিরিজ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা
প্রসঙ্গত
“যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম” লেখকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসকালীন সময়ে অর্জিত বিচিত্র অভিজ্ঞতা বিষয়ক একখানি পুস্তিকা। লেখক এখানে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম সম্পর্কে লিখতে বসে যে সব তথ্য পাঠকদের সামনে সহজ, অলঙ্কারবিহীন ভাষায় তুলে ধরেছেন তা থেকে সে দেশে পাশ্চাত্য সভ্যতার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আধ্যাত্মিক শূন্যতা এবং আত্মিক অতৃপ্তির একটা চিত্রই শুধু ফুটে ওঠেনি, সেখানে ইসলামী আদর্শের জন্য প্রায় অকর্ষিত উর্বর ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে, এ সত্যটিও সকলের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের দেশের অনেকেই সফর করেছেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের পটভূমি, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে এ ধরনের বাস্তব তথ্য-সম্বলিত লেখচিত্র দিয়েছেন কি না বলা মুশকিল।
আধুনিক সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র মার্কিন মুলুকে ইসলামের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তৃততর আলোচনা দেখলে আমরা অবশ্যই খুশী হব। তবে যতদিন না তা হচ্ছে, ততদিন এই ক্ষুদ্র পুস্তিকা অনালোকিত বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের যতটুকু আলোক দান করে ততটুকুই কৃতজ্ঞতা সহকারে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। অনুসন্ধিসু পাঠকদের কাছে পুস্তিকাখানি সমাদৃত হবে বলেই আমাদের আশা।
-আব্দুল গফুর, ১৪-৫ -৮০, বইটির প্রকাশক।
চার্চের দেশ
ঢাকা শহরে যেমন একটু পরপরই মসজিদ দেখা যায় তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে রাজধানী ওয়াশিংটনেও দেখা যায় চার্চ। তবে চার্চগুলো আকারে বৃহৎ এবং স্থাপত্য শিল্পে আরো অধিক সৌষ্ঠবময়। আর সেসবের ভিতর দিক খুবই – জাকজমকপূর্ণ। রবিবার চার্চগুলো থাকে জনাকীর্ণ।
উপাসনা ছাড়াও চার্চে হাজার রকমের সামাজিক কাজ কর্ম সম্পাদিত হয়ে থাকে। বিয়ে-শাদী, বিভিন্ন সংস্থার আলোচনা সভা, সেমিনার ইত্যাদি একটা না একটা সব সময় লেগেই আছে। উপাসনার জন্য না গেলেও অন্যান্য সামাজিক প্রয়োজনে লোককে চার্চে যেতে হয়। ওয়াশিংটনে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালীদের প্রায় সকল সামাজিক অনুষ্ঠানই অনুষ্ঠিত হয় চার্চে।
সমাজসেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিসগুলো থাকে চার্চের নীচের তলায় : দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রও থাকে বহু চার্চে।
আমাদের দেশের বিত্তশালীরা মারা যাওয়ার সময় কালেভদ্রে সম্পত্তির ছিটেফোটা আল্লাহর রাস্তায় দান করে যান। কিন্তু পাশ্চাত্য দেশসমুহে বিত্তশালীদের সম্পত্তির প্রধান অংশই যায় চার্চে, হসপিটাল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে। অনেক সময় পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক দশমাংশও উত্তরাধিকারীদের ভাগে পড়ে না। তাছাড়া, থাকে চার্চের নিজস্ব সম্পত্তি। বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় চার্চের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। তা থেকেও আয় হয় প্রচুর। এ আয় দিয়ে পাদ্রীরা যে কোন অতি বড় শিল্প-কারখানার ম্যানেজার ডাইরেক্টরের মতই সুন্দর ও ব্যয়বহুল জীবন যাপন করতে পারেন।
আমাদের দেশের মসজিদের ইমামদের মত পাদ্রীদের ভিক্ষুকের জীবন যাপন করতে হয় না। অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা কম হবে, এই ভয়ে পাদ্রী জীবন গ্রহণে অনীহার কোন কারণই পাশ্চাত্য সমাজে নেই। তার ফলে, প্রতিভাবান বহু যুবকই পাদ্রী জীবন গ্রহণ করে থাকে। চার্চের খরচে শুধু ধর্মীয় লাইনে নয়, কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রেও উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে থাকে এবং সমাজের যে কোন শিক্ষিত ব্যক্তির সঙ্গে আত্মবিশ্বাস এবং অধিকতর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে কথা বলতে পারে।
এতো প্রচুর বিভু-সম্পদ জনসাধারণ চার্চের ভাণ্ডারে অর্জন করে যে নিজের দেশে খৃষ্টীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং প্রচারের সমস্ত ব্যবস্থা করার পরও চার্চের বিপুল সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, ফলে তারা বিদেশের বুভুক্ষু মানুষের পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রচুর অর্থ পাঠাতে সমর্থ হয়।
বইপত্র
পাশ্চাত্য দেশসমূহের হোটেলগুলোর প্রতিটি কক্ষে এবং প্রতিটি খাটের সঙ্গে ছোট টেবিলের ড্রয়ারে একটি করে বাইবেল থাকে। খৃষ্ট ধর্ম সম্পর্কিত বইয়ের সংখ্যা এত প্রচুর এবং এত সহজলভ্য যে, কোথায় পাওয়া যায় তা জানা থাকলে এবং চেয়ে পাঠাবার সময় থাকলে, ক্রয় না করেও যে কোন সংখ্যক বই সংগ্রহ করা যায়। শহরের সাধারণ পাঠাগারসমূহে তো ধর্ম বিষয়ক বই পাওয়া যায়ই, তদুপরি শুধুমাত্র ধর্মীয় বই এর লাইব্রেরীর সংখ্যাও প্রচুর। ওয়াশিংটনের ‘ক্যালিফোর্নিয়া এভিনিউ’ এর প্রায় দেড় মাইলের মধ্যে আমার মনে হয় একমাত্র ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স নামক একটি সংস্থারই পাঁচটি রীডিং রুম আছে।
অশান্তি ও শূন্যতা
খৃষ্ট ধর্মে যুক্তিসঙ্গত এবং বৈজ্ঞানিকভাবে এতো বিপুল আয়োজন রয়েছে, তাতেও কি তাদের ধর্মীয় ক্ষুধা মিটেছে। তাদের আত্মা কি তৃপ্ত হয়েছে ? এ বড় কঠিন প্রশ্ন। রকম সকম দেখে মনে হয় না যে, তারা পরম শাস্তি খুঁজে পেয়েছে।
খৃষ্টীয় ভাববাদ এবং পাশ্চাত্য জড়বাদ অঙ্গাঙ্গী জড়িত। একটি আর একটির পরিপূরক। জড়বাদী সভ্যতা এবং খৃষ্টীয় ধর্মমত প্রচার প্রশিক্ষণ এবং মন-মগজ শুদ্ধিকরণের হাজার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মনে হয় তা তাদের আত্মার ক্ষুধা মিটাতে পারছে না। বিশেষত তরুণ সমাজ ভাববাদী ধ্যানধারণা এবং আদর্শবাদের অন্য প্রায় পাগল।
পাশ্চাত্য দেশসমুহে যুব এবং তরুণ সমাজ অনুভব করছে এক বিরাট শূন্যতা। এ শুন্যতা পূরণ করার সামর্থ বোধ হয় তাদের চিরাচরিত এবং প্রচলিত ধর্মীয় আদর্শে নেই।
অন্যান্য ধর্ম
যে ভাববাদী আদর্শিক বুভুক্ষু এবং শূন্যতা পাশ্চাত্য সমাজে বিরাজ করছে তা পূরণ করার চেষ্টা করছে প্রাচ্যদেশীয় ধর্মমতগুলো। ওয়াশিংটন নিউইয়র্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহর বৌদ্ধ ধর্ম, সিন্টো ধর্ম ও শিখ ধর্মীয় চার্চ, প্রচার এবং ধর্মান্তকরণ সংস্থা কাজ করছে। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে আছে হিন্দু ধর্মীয় সংস্থা সমুহ।
যুক্তরাষ্ট্রে এমন কোন মাঝারী শহর নেই যেখানে হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের স্থায়ী মন্দির এবং প্রচার কেন্দ্র নাই। ‘ডিভাইন লাইট মিশনের’ নামে তথাকার তরুণেরা প্রায় পাগল। ডিভাইন লাইট মিশনের চতুর্দশ বর্ষীয় বালক প্রচারক তার পিতার হংসজয়ন্তে উৎসব পালন উপলক্ষে একবার ছয়টি রিজার্ভড জাম্বো জেট ভর্তি ভক্তসহ দিল্লী আগমন করেন।
ভণ্ডামী
মহাঋষি মহেষযোগী তাঁর প্রচার পদ্ধতি অতটুকু উন্নত করেছেন যে, তিনি তখন বিনা পয়সায় তার নৈসর্গিক বা অতিইন্দ্রিয় ধ্যান (ট্রানসেনডেন্টাল মেডিটেশন) প্রক্রিয়া শিক্ষা দেন না, তিনি মাদ্রিদে হিন্দু ধর্মীয় নৈসর্গিক ধ্যান মুলত হিন্দু ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার জন্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কয়েছেন, তাঁর নিজস্ব হেলিকপটার এবং ভক্তদের ব্যবহারের জন্যে প্রাইভেট জেট বিমান আছে। দুর্দিনে দুঘণ্টা নৈসর্গিক ধ্যান শিক্ষা দেওয়ার জন্যে তিনি গ্রহণ করেন ৭৫ ডলার। কি এমন উন্নত পদ্ধতির নৈসর্গিক ধ্যান বা জিকির পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয় তা জানার জন্যে আমি নিজেও মুল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করেছি।
লম্বা দাড়ি, লম্বা চুল বা টিকি, গলায় মালা, হাতে জপ মালা, অর্ধ নগ্ন দেহে পৈতা, কপালে তিলক অর্থাৎ স্থানীয় লোকজন হতে বেশভুষায় স্বতন্ত্র হয়ে গম্ভীরভাবে কোন ট্রাফিক আইল্যাণ্ডে দুচার জন সেবক পরিবেষ্টিত হয়ে দিন কয়েক বসতে পারলে এবং আস্তানায় ঠিকানা দিয়ে হাজার কয়েক পোষ্টার বিশেষ বিশেষ স্থানে লাগাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রে ভক্ত জোগাড়ে অসুবিধা হয় না।
আমাদের পীর ফকিরেরা কেন যে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে মন দিচ্ছেন না তা ভেবে আমার ক্ষোভ এবং অনুশোচনার অন্ত নেই। কারণ আমি ওয়াশিংটনে হরেকৃষ্ণ, শিখ গুরুদ্বার, ডিভাইন লাইট মিশন, আম ইত্যাদি সংস্থা অফিসে বহু সময় ব্যয় করেছি। যে সমস্ত সাধু বা বাবা নিজের দেশে নিতান্ত অবহেলিত এবং ভক্ত-শুন্য তাঁরাও বিদেশে প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
ইসলামের প্রচার :
ইসলামী প্রচার সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রাচীন হলো কাদিয়ানী প্রচার মিশন। এঁরা পূর্বে কিছুটা সুবিধা করেছিলেন। কিন্তু ইদানিং সাধু বাবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় একেবারে পিছনে পড়ে গেছেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ তারা অতিমাত্রায় যুক্তিবাদী। জ্ঞান বিশ্লেষণের অতি উন্নত মার্গে তারা বিচরণ করেন। রং ঢং ভড়ং তাদের মোটেই নেই। তাদের সূক্ষ্ম তুলনামুলক বিশ্লেষণ, চুলচেরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বুঝার সময় সেখানকার ব্যস্ত সমাজে লোকজনের কম। তারা অল্প কথায় অল্প সময়ে ভূ-হতে চায়, ক্ষুধার্ত মনের খোরাক চায়। সূক্ষ্ম যুক্তি-তর্কের চেয়ে আবেগ আর উত্তাপে অশান্ত মন অধিক বিগলিত হয়। যে কথার আবেদন মস্তিষ্কের চেয়ে মনের উপর বেশী তারই প্রভাব থাকায় তরুণ এবং যুব সমাজের উপর বেশী।
ইদানিং তবলিগ জামাত স্বল্প সময়ের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে গমন করছে। তাদের লক্ষ্য ধর্মপ্রচার থেকে আত্মশুদ্ধি এবং দীনি ভাইদেরকে দীনের পথে আহ্বানের মধ্যেই বেশীর ভাগে সীমাবদ্ধ থাকে। ভিন্ন ধর্মীয় লোকদের কাছে বিশেষ একটি উন্নতি এবং শিক্ষিত দেশের মানুষের কাছে যেভাবে দীনের দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন তার ব্যাপক ট্রেনিং বা নুনতম প্রয়োজনীয় ট্রেনিং তাদের দেওয়া হয় না।
তবুও দেখা যায়, রাস্তা-ঘাটে তাদের চোখ নীচু করে লাইন বেঁধে চলার ধরন দেখে উৎসুক্য সহকারে লোকজন তাদের সঙ্গে আলাপ করতে চায় এবং ইসলাম সম্বন্ধে জানতে চায়।
আমি ঢাকা হতে গমনকারী একটি খামারের সঙ্গে ঘোরাফিরা করেছিলাম। সে দলে ইংরেজী জানাদের মধ্যে ছিলেন একজন গ্রাজুয়েট এবং একজন এম. এ. পাশ। তাদের বলার এবং বোঝানোর ভঙ্গি সন্তোষজনক ছিল বলা যায় না। কিন্তু আল্লাহর হাজার শুকরিয়া যে, এ জামাতের নিকট ওয়াশিংটনে অল্প কয়েক দিনেই তেইশজন লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
প্রচারে ত্রুটি :
একদিন দেখলাম একটি ছেলে এসে ইসলাম গ্রহণ করলো। গ্রাজুয়েট ভদ্রলোক ছেলেটিকে বললেন “So long you were a beast of Hell, now you have become a bird of Heaven, মন্তব্যটি ছেলেটির কাছে শ্রুতি-সুখকর হয়নি। তাকে বুঝান হল যে, ইসলাম ধর্ম যারা অবলম্বন করবেন না তারা সকলেই দোযখে যাবে।
খৃস্টান জাতির মধ্যে কিছু কিছু লোক খুবই ভালো আছে কিন্তু পুরা জাতিটাই দোযখে যাবে এ কথাটা তার খুব মনঃপুত হলো বলে মনে হলো না। তবুও সারা খৃস্টান জাতি দোষখে যাক তাতে তার আপত্তির কারণ রইল না। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হলো তার দাদীকে নিয়ে। তার বাবা মা দোযখে যাবে তাতেও তার আপত্তি নেই কিন্তু দাদী দোযখে যাবে এ কথায় কিছুতেই তার মন সায় দিচ্ছিল না। কারণ তার দাদী কারও হক কখনও নষ্ট করেননি কারও মনে ব্যথা দেন না, মাটির ন্যায় সহনশীল। ভোগে নিস্পৃহ, স্বভাবে ত্যাগী, অন্যকে দেওয়ায় তিনি আনন্দ পান, কথনও মিথ্যা কথা বলেন না। অনাত্মীয়ের প্রতিও দরদ-প্রবণ এবং সহানুভূতিশীল। এহেন মহিলা কেন দোযখে যাবে তা যেন তার মন কিছুতেই সমর্থন করতে পারছিলো না।
ছেলেটির মনের ভাব লক্ষ্য করে আমি বলতে চেষ্টা করলাম যে, মুলত ঈসা (আঃ) আর মুহম্মদ (সঃ) এর ধর্মমতে কোন প্রভেদ ছিল না। তবে ঈসার (আঃ) অনুসারীরা সত্য পথ হতে বিচ্যুত এবং পথভ্রান্ত। তার দাদীর মতো যারা আছে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত যদি না পৌঁছে থাকে তবে আল্লাহ হয়তো তাকে মাফ করে দিতে পারেন। এতে আমার তবলিগী ভাই এতো বেশী কষ্ট হলেন যে, তিনি তার অসন্তুষ্টি মনের নিভৃতে রাখতে পারলেন না, সরবে তারই সামনে প্রকাশ করলেন।
ঘটনাটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য এই যে, ঐ ভাবে অমিশনারী পন্থায় যারা ইসলামের কথা বলেন, তাদের কাছেও লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তাতে অনুমিত হয় যে, ইসলামী ধর্মমতের আবেদন সেখানে অত্যন্ত বেশী।
ইসলাম ভীতি
খৃস্টান পাত্রীরা হিন্দু ধর্মীয় বিন্নি সংস্থার ব্যাপায় প্রচারে এবং ধর্মান্তকরণে ভীত নয়। কারণ তারা অনেকটা নিঃসন্দেহ যে কিছুকাল জানাশুনার পর ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু তাদের ভয় ইসলাম সম্বন্ধে। এখানে একবার গেলে আর ফিরে আসে না। তাই তারা আল্লাহর রাসূল সম্বন্ধে এমন সব কুৎসিত এবং গর্হিত অপপ্রচার চালায় যে, তার দু’ একটি নমুনা উদাহরণ স্বরূপ দেওয়া আমায় কাছে শক্ত বেয়াদবি বলে মনে হয়। তাদের যুক্তির সমর্থনে প্রাথমিক যুগের শিয়া সুন্নি তীব্র বিরোধের সময় লিখিত রাসূলের চরিত্রে কলংকলেপনকারী পুস্তক হতে উদ্ধৃতি দেয়া হয়।
এতদসত্ত্বেও আমার মনে হয় ইসলামী আদর্শের জন্যে সেখানকার বহু লোক, বিশেষ করে কৃষ্ণকায় লোকেরা উন্মুখ হয়ে আছে। সঠিক পন্থায় তাদের কাছে ইসলামের আবেদন পৌঁছিলে তা গৃহিত হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক।
ব্ল্যাক মুসলিম আন্দোলন
আমেরিকায় কালো মানুষদের কাছে ‘প্রথম ইসলামের বাণী’ পেীছে ফারাও মোহাম্মদ নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে। অতি প্রতিভাধর এক দুষ্ট প্রকৃতির লোকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। এ ভদ্রলোক খুব নামজাদা অপরাধী ছিলেন। কারাগৃহ ছিল তার দ্বিতীয় বাসস্থান। ফারাজ মোহাম্মদ ভাবলেন এ লোকটিকে যদি ইসলামের আলো দেখাতে পারি তবে তার কাজ হবে সহজ ও সার্থক। ইনিই পরবর্তী কালে ইসলাম গ্রহণ করে এলিজা মোহাম্মদ নামে পরিচিত হন। তার অনুসারীদেরই ব্ল্যাক মুসলিম সম্প্রদায় বলা হয়। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী এ দলেরই অনুসারী।
খৃস্টান ধর্মীয়দের এক বিরাট অংশ অবতারবাদে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে আল্লাহ নিজেই তার পুত্র (?) যিশু খৃষ্টের দেহ ধরে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। এলিজা মোহাম্মদ ছিলেন যিশুখৃস্টের অবতারবাদে পূর্ণ বিশ্বাসী। ফারাজ মোহাম্মদের সময় ছিল কম। যে ভাবে বললে এলিজা মোহাম্মদ আল্লাহর রাস্তায় আসবে সেভাবেই তিনি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তিনি এলিজা মোহাম্মদকে নিজেই খলিফা নিযুক্ত করলেন।
আল্লাহর কালামে আছে যে, প্রত্যেক জাতির প্রতি তিনি নবী পাঠিয়েছেন। আমেরিকার কালো মানুষেরাও একটি জাতি। এ জাতির প্রতি তো কোন নবী এসেছে বলে কোন রেকর্ড নাই। এলিজা মোহাম্মদ হলেন তাই আমেরিকার কালো মুসলিমদের জন্যে আল্লাহর নবী। নবুয়ত দিতে পারেন আল্লাহ।
ফারাজ মোহাম্মদের খেলাফত নবুয়তে পরিণত হলো। যেহেতু আল্লাহ, যিশু খৃষ্টের দেহে আবির্ভূত হতে পারেন এখানেও নবুয়ত দেওয়ায় আল্লাহ অতীর্ণ হলেন ফারাজ মোহাম্মদের দেহে। ব্ল্যাক মুসলিমদের প্রতি রবিবার বারবারই বলা হয় ‘God appeared in the person of Faraz Mohammad.
এলিজা মোহাম্মদ নবী হলেন। তবে ঐশিগ্ৰন্থ ছাড়া। প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ আলাদা কিতাব দান করেননি। সুতরাং এখানেও সমস্যা হলো না। আল কুরআনই হলো এলিজা মোহাম্মদের প্রচলিত ধর্মমতের ধর্ম গ্রন্থ।
এদেশে খষ্টান মিশনারীরা যেভাবে খৃস্টান ধর্ম প্রচার করেন ফারাজ মোহাম্মদেরও অনুরূপ পদ্ধতিতে কাল আদমীদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করলেন। যিশু খৃষ্টকে আল্লাহর পুত্র এবং ত্রাণকর্তা হিসেবে স্বীকার করলে এবং মন্দিরে না গিয়ে চার্চে গেলেই খৃস্টান হওয়া যায়।
কালেমা তাইয়েবা, কালেমা সাহাদাৎ পড়ে এবং আল্লাহর অবতীর্ণ আল-কুরআনকে আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থ স্বীকার করে এলিজা মোহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা ফারাজ মোহাম্মদ’-এর নিকট মুসলিম হলেন। ফারাজ মোহাম্মদ তার কাজ করে গেছেন। অন্যদের জন্য রেখে গেছেন আরদ্ধ কাজকে সঠিক পন্থায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরাট দায়িত্ব।
বিশ্বাস এবং অনুশীলন
ব্ল্যাক মুসলিমরা তাদের মসজিদকে বলে টেমপল (Temple)। সেখানে সাপ্তাহিক জামাত হয়, শুক্রবারে নয় রবিবারে। তাদের মসজিদে সিজদাহ দেওয়ার ব্যবস্থা নাই। কারণ সেখানে থাকে চেয়ার টেবিল। বাড়ীতে বা মুসলিমদের অন্যান্য মসজিদে তারা সিজদাহ দিয়ে নামাজ পড়ে। ইসলামিক সেন্টায় মসজিদে দেখেছি ইমামতি করার জন্যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তারা যে কোন দেশের মুসলিমদের সম্মুখে এগিয়ে যায়।
ব্ল্যাক মুসলিমদের টেমপলে টাই আর কোট ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ। কম্বিনেশন স্যুট তারা কমই পরে। সাত আট বৎসরের বাচ্চারা পর্যন্ত পুরাদস্তুর স্যুট পরে। রাস্তাঘাটে তারা টাই কোর্ট ছাড়া বের হয় না। মজুরের কাজ করলেও তারা এপ্রনের নীচে কোট টাই পরে ছেলে বুড়ো সব ধরে সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে আনুষ্ঠানিক সুবসন পরিহিত কম্যুনিটি খোঁজ করলে নিঃসন্দেহে এলিজা মোহাম্মদের অনুসারিরাই হবে সর্বপ্রথম। মদ সিগারেট শুকর এলিজা মোহাম্মদের অনুসারীরা খায় না। যদিও এগুলো আমেরিকায় প্রবাসী বহু দেশীয় মুসলিমদের অতি প্রিয় খাদ্য।
প্রাচ্য দেশীয় মুসলিম ললনাদের বগল, ঘাড় বক্ষ, স্তনের উচ্চতা প্রদর্শনের যে ৰাতিক আছে তা এলিজা মোহাম্মদের অনুসারী মহিলাদের নাই। বিদেশী শ্রমজীবী মহিলারা প্রদর্শন করেন নিতম্ব এবং উন্নত বক্ষের মধ্যভাগের সরু সুশ্ৰী ক’টিদেশ। আমাদের দেশের অলস মধ্যাহ্নের দিবা নিদ্রায় অভ্যস্থ মহিলারা যা প্রদর্শন করেন তা মনোরম সরু কটিদেশ নয় ভূড়ি কুৎসিত এবং
বিপুল।
এলিজা মোহাম্মদের অনুসারী মহিলারা অফিসে আদালতে, ব্যাংক ফ্যাক্টরী সর্বত্র চাকুরী করে কিন্তু ভূড়ি বক্ষ দুরের কথা তাদের গলা, চুলের আগা বা কানের লতি টি পর্যন্ত কেউ দেখতে পায় না। আলকুরআনে মেয়েদের শরীরের যে যে অংশ ঢেকে রাখার বিধান দেওয়া হয়েছে তা পূর্ণ রূপায়ণ তাদের বেশভুষায়।
এক রবিবার ওয়াশিংটনে ৪নং টেমপল হতে বের হয়ে এসে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের প্রাক্তন মহাপরিচালক ডঃ মঈনুদ্দিন আহমদ খানকে টেক্সিতে তুলে দিয়ে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি -একটু পরেই এসে দাঁড়াল একটি ব্ল্যাক মুসলিম মেয়ে। আমি কত নম্বর বাসে আমার গন্তব্যস্থানে যেতে পারি তা জেনে নিলাম, সে কোথায় যাবে তাও জানলাম। তারপর দু’চারটি প্রশ্ন করলাম খুবই সংক্ষিপ্ত এবং অনুত্তাপ উত্তর। তারপর মেয়েটি বলেই ফেলল তৃতীয় ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে না-মহরম দু’জন মুসলিম নারী পুরুষের শুভেচ্ছামূলক আলোচনায় লিপ্ত না হওয়াই ভালো। খুব প্রয়োজন হলে সে কথা স্বতন্ত্র।
বিচিত্র অভিজ্ঞতা
একবার কদরের রাত্রিতে এশার নামাজের পর ওয়াশিংটনেই বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক সেন্টার মসজিদে বসে আছি। এশার নামাজের পর শশ্রু গুস্ফহীন, মিশরী মুয়াজ্জিন এসে বললেন নামাজ খতম, এখন মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হবে।
ওয়াশিংটনে এ মসজিদটি মূলত আরবদের পরিচালিত। উচ্চ বেতনভুক্ত ইমাম মুয়াজ্জিন বহু আসে। কিন্তু ওয়াক্তিয়া নামাজ হয় না। চার্চের মত শুক্রবারে বা অন্যান্য পর্ব উপলক্ষে নামাজ হয়। অফিস খোলা থাকা কালে জোহর, আসর কখনও মাগরিবের নামাজ হয়।
আমি মুয়াজিনকে বিনীতভাবে বললাম, আজ লাইলাতুল কদর। সারা রাত আমরা মসজিদে থাকতে চাই। মুয়াজ্জিন কিছুতেই রাজী হলেন না। আমিও তার বলা-কওয়াতে রাজি হচ্ছি না। অনেকক্ষণ বাদানুবাদের পরে তিনি বললেন যে, পুলিশ ডেকে আমাকে বের করে দেওয়া হবে। আমি তাকে পুলিশ ডাকতে বললাম, আর জানিয়ে দিলাম যে, লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে মসজিদ হতে পুলিশ দিয়ে নামাজী তাড়িয়ে দেয়াটা একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করবে।
মুয়াজ্জিনের হাকাহাকিতে ইতিমধ্যে সব মুসল্লিই সরে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত দেখলাম আমি আর দু তিনজন স্থানীয় মুসলিম অবশিষ্ট রয়েছি। তারাও চলে যাওয়ার পথে। একজন এসে বলল, সারা রাত একা এই বিরাট মসজিদে থাকাও অসুবিধাজনক হবে। তাছাড়া পুলিশ ডাকিয়ে আমাকে মসজিদ হতে বের করা সকলের জন্যেই হবে অগৌরব। তাই তিনি আমাকে তাদেরই একটি স্থানীয় মসজিদে গিয়ে ইবাদতের আহ্বান জানালেন।
একা থাকার প্রেক্ষিতে আমিও একটু নরম হয়ে আসছিলাম। তার প্রস্তাবে রাজী হলাম। ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার জন্যে ওয়াশিংটনের মসজিদটিতে দুই ঈদে এবং শুক্রবারের নামাজেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ থাকে। আজকাল তবলিগ জামাতের লোকেরা মাঝে মাঝে মসজিদে থাকেন। তখনই এ প্রকাণ্ড মসজিদটি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত এবং জীবন্ত।
ইসলামিক সেন্টার মসজিদ হতে যে মসজিদে গেলাম তা হলো ওয়াশিংটনের এক বিশেষ জামাতে দারুল ইসলাম গ্রুপের মসজিদ। এরূপ ভিন্ন ভিন্ন জামাতের কয়েকটি মসজিদ সেখানে আছে। বাইরে থেকে মসজিদ বলে মনে হয় না। একটি আবাস গৃহ ভাড়া করে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ঐ রাতে ঐ মসজিদে প্রায় পনের বিশজন লোক সেহরী পর্যন্ত ছিল। যারা গাড়ীতে বাড়ী চলে যায় তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হয় না। পনর বিশ জন দেখা গেল সেহরীর জন্যে থেকে গেছে। মুয়াজ্জিন তখন তার ঘরে যা ছিল তা এনে দিলেন। পাঁচ ছয় জনের খাবার বোধ হয় ছিল।
প্রত্যেককে আলাদা প্লেটে বিতরণ করে খাবার দেওয়া হল না। খাবারের পাত্রগুলো সকলের সামনে রাখা হলো। বিসমিল্লাহ বলে বয়োজ্যেষ্ঠ এক ব্যক্তি খানিকটা খাবার এক পাত্র হতে হাতে তুলে নিয়ে পরবর্তী ব্যক্তির দিকে পাত্রটি ঠেলে দিলেন। এভাবে প্রত্যেকটি পাত্রই সবার সামনে আসতে লাগলো। প্রত্যেকে অন্যের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে একটু একটু তুলে নিলেন। এভাবে প্রত্যেকটি পাত্ৰই খাবার নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত সকলের সামনে ঘুরতে লাগল। একই পাত্র হ’তে সকলের এভাবে তুলে নিয়ে খাবার পদ্ধতি বেশ সুন্দর এবং অভিনব।
এ মসজিদে আমি আরও কয়েকবার গিয়েছিলাম। একদিন দেখলাম একটা আলোচনা সভা চলছে। উপস্থিত জনসংখ্যায় অর্ধেকই নারী। তাদেরকে দেখা যাচ্ছিল না। মসজিদের মাঝখানে পর্দা দিয়ে দু’ভাগ করে রাখা হয়েছে।
মেয়েদের মধ্য হতে যদি কেউ কোন প্রশ্ন করতে চাইতেন বা বক্তব্য রাখতে চাইতেন, তখন তিনি ‘মাফ করবেন, আমি কি একটি কথা বলতে পারি?’ আমার একটি প্রশ্ন আছে, ইত্যাদি বলে আমীর অর্থাৎ সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে বলতেন না। তিনি জোরে বলতেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমীরের জন্যে সালামের জবাব দেওয়া হতো ওয়াজেব। তিনি তখন ‘ওয়ালায়কুম আসসালাম’ বলে সালামকারীকে বলার সুযোগ দিতেন।
এতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কয়েকজনকে একসঙ্গে কথা বলতে বা উচ্চস্বরে কথা বলতে হতো না। যিনি একবার সভাপতি বা আমীরকে সালাম দিবেন আমীরকে অবশ্যই তার সালামের জবাব দিতে হবে এবং তাকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সালামের সংখ্যা বেশী হলে আমীরকে তার হিসাব রাখতে হতো এবং ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে প্রত্যেককে সুযোগ দিতে হতো। সভায় সালাম দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পদ্ধতিও আমার কাছে বেশ সুন্দর মনে হলো।
এ দারুল ইসলাম জামাতের এক যুবক আবদুল্লাহ দাউদ। তার সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা এবং যাওয়া আসা ছিল। সেখানকার ইসলামগ্রহণকারী এক একটি গ্রুপকে বলা হয় জামাত এবং জামাতের একজন নির্বাচিত আমীর থাকে। গ্রুপভুক্ত ব্যক্তিদের নানা সামাজিক সমস্যা জামাতে আলোচিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
একদিন শুনলাম জামাতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে মোঃ দাউদকে ইসলাম সম্পর্কে লেখাপড়া করার জন্য পাকিস্তানে একটি মাদ্রাসায় পাঠানো হবে। তাকে তার চাকুরী ছেড়ে দিতে হবে এবং পাকিস্তানে চার বৎসর থাকতে হবে। এ সময় তার স্ত্রী কি ওয়াশিংটনে একক জীবন যাপন করবে? কিন্তু একজন সাবালিকা নারীর স্বামী বিহনে একাকী থাকাটা কারো নিকট মনোপুত হলো না।
পাঁচ বছর পর শিক্ষা শেষে দাউদের জীবনে মোড় কোন দিকে নেয় তায় কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, দাউদ স্ত্রীকে তালাক দেবে এবং জামাত দাউদের স্ত্রীর জন্যে ভালো বর খুঁজে বের করবে। দাউদের স্ত্রী সামীর আব্দুল্লাহর সঙ্গে আমার স্ত্রী বদরুন্নাহারেরও আলাপ হয়েছিল। দাউদের স্ত্রীকে এ জন্যে খুব দুঃখিত মনে হলো না। কারণ দাউদ আল্লাহর রাস্তায় দীনের কাঙ্গে যাচ্ছে। বরং সে ছিল গর্বিতা। কারণ তার এই ত্যাগের দ্বারা সে আল্লাহকে ঋণী করে রাখছে। এবং এর প্রতিদান সে আখেরাতের দিন আল্লাহর কাছ থেকেই আদায় করে নেবে।
আমেরিকার নও মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশীর ভাগই কৃষ্ণকায়। এলিজা মোহাম্মদের ইসলাম ব্যতীত যে ইসলাম তাদের কাছ পৌঁছছে তা হলো প্রধানত জোব্বা জাব্বা, লম্বা কোর্তা, মেছওয়াক, কাঁধে ঝুলানো গলায় জড়ানো জায়নামাযের ইসলাম। ইসলাম সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান খুবই কম। কিন্তু ভক্তি আবেগ এবং রসূলের প্রতি মহব্বত এতো বেশী যে, তাদেরকে দেখে মদিনার মুসল্লিদের কল্পনাই মনে জাগে।
যে পাশ্চাত্য সভ্যতার মোহে আমরা ঈমান হারাই তা পরিত্যাগ করেই তারা ইসলাম গ্রহণ করে থাকে। তারা মুসলিম থাকার জন্যে ভাল ভাল চাকরী ছেড়ে দেয়। আয় কমে যায় বলে বড় বাড়ী ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে ওঠে। নিজের ছেলে-মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে নামমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায় নিয়ে আসে। স্যুট, কোট, টাই ছেড়ে লম্বা জোব্বা জাব্বা ধরে টাকনার উপরে পায়জামা এবং সেলাই ছাড়া লুঙ্গি পরে, টুথব্রাস ছুড়ে মেছওয়াক পকেটে রাখে। ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে যে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করে। তাদের অনেকে ইসলাম গ্রহণের পর ঔষধ মুখে তোলেনি। আল্লাহর উপর অতো বেশী তাওয়াক্কাল যে, অসুখ হলে আল্লাহ রসূলের নামে তসবিহ রূপ মহৌষধ তারা পান করে থাকে। পূর্ণ একীন থাকার কারণে ফলও তারা পায়।
তাদের ঈমান এবং আকিদা দেখে আমাদের দেশের বড় বড় বুজর্গকেও লজ্জা পেতে হবে। অতো অধিক আবেগ এবং দরদের সাথে তাদের অনেকে এক একটি হাদিস এবং সুন্নাহর উপর আমল করতে চায় যে, সাধারণ মুসলিমের কথা তো দুরে থাক—জানা মতে, বহু বড় বড় পীর, দরবেশকেও তাদের সমতুল্য মনে হয় না। কথাটা বেশ রূঢ় শুনাল। কেন বললাম তা উল্লেখ করেই এখনকার মতো এ প্রসঙ্গেয় ইতি টানছি। আল্লাহর রসূল মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথি কাটতেন। কৃষ্ণকায় লোকদের চুল অতো ঘন যে চুল আচড়ে সিঁথি কাটা যায় না। যদি মাথার মাঝখানের চামড়া কেটে চুলশুদ্ধ তুলে নেওয়া হয় তবেই মাথায় সিঁথি কাটা সম্ভব। এ রূপকথার গল্প নয়, সাহায়ে কেরামের আমলের ঘটনাও নয়। নিউইয়র্কের কৃষ্ণকায় লোকদের কেউ কেউ আল্লাহর রসূলের মহব্বতে এরূপ পীড়াদায়ক কাজ করেছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
এই বইটি ১৯৮০ সালে রচিত। সেই সময়ের অবস্থাই বর্ণিত হয়েছে। আশা করি এখন নতুন করে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পাঠকদের কাছে অনুরোধ বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে জানাতে।