হাদিসের ক্ষেত্রে সালফে সালেহ্/সাহাবী ও তাবেঈদের গুরুত্ব প্রদান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসকে সর্বযুগের ইসলামী মনীষীগণ যথাসাধ্য গুরুত্ব প্রদান করেছেন, তবে এক্ষেত্রে সর্ব প্রথম অবদান রেখেছেন ইসলামী মনীষীদের অনুকরণীয় ও অনুশীলনীয় অগ্রজ সালফে সালেহ্ সাহাবী ও তাবেয়ীগণ, তাঁরা স্বীয়যুগে সর্বশ্রম দিয়ে শিক্ষা, গবেষণা, সংরক্ষণ, সংকলন, প্রচার-প্রসার এবং বাস্তব প্রয়োগসহ সকল পন্থায় সুন্নাহর পূর্ণ গুরুত্ব প্রদান করে এক নযীর স্থাপন করেছেন। নিম্নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হল:
সাহাবীদের যুগে সুন্নাহর গুরুত্ব প্রদান: সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদত্ত কুরআনের ব্যাখ্যার আলোকে ইসলামের হুকুম আহ্কাম শিক্ষা লাভ করতেন। কেননা আল্লাহ তা’আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদানের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤﴾ [النحل: ٤٤] “আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের প্রতি অবতীর্ণ হওয়া বিষয়গুলি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাদান করেন”[1]।
আল্লাহ আরও বলেন, ﴿ وَمَآ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ ٱلَّذِي ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٦٤ ﴾ [النحل: ٦٤]
এ জন্যই সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি কথা ও কাজ, ইবাদাত বন্দেগী এবং আচার-আচরণ অতি গুরুত্ব ও মনোযোগ সহকারে লক্ষ করতেন এবং ইসলামের হুকুম আহ্কাম তাঁর কাছ থেকে যব্ত-রপ্ত করে নিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ইবাদতের নিয়মাবলী শিক্ষা নিতে হবে এ জন্য স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন, صَلُّو كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ أُصَلِّيْ “তোমরা সেভাবে সালাত সম্পাদন কর, যে ভাবে আমাকে সম্পাদন করতে দেখেছ”। তিনি আরও বলেন, خُذُوْا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُمْ “তোমরা আমার হজ্ব সম্পাদনের পদ্ধতি হতে তোমাদের হজ্ব সম্পাদনের পদ্ধতি জেনে নাও”।
সাহাবীগণ এভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেই গ্রহণ করতেন। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ছাড়াই তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কার্যসমূহের অনুসরণ করতেন। যেমন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণের আংটি বানালেন সাহাবীগণ দেখাদেখি স্বর্ণের আংটি বানালেন, অতঃপর যখণ স্বর্ণ পুরুষদের জন্য হারাম হয়ে গেল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণের আংটি খুলে ফেললেন, দেখাদেখি সকল সাহাবীগণও আংটি খুলে ফেললেন”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় এভাবেই সাহাবীগণ তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার প্রাণ-পণ চেষ্টা করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর সাহাবীগণ তাঁর সুন্নাতকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একে অপরের কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহে প্রতিযোগিতায় অবতরণ করতেন। এমনকি সুদূর পথ অতিক্রম করেও হাদিস শিক্ষা হতে বিরত হননি। একটি হাদিসের জন্য এক মাসের পথ অতিক্রম করে হলেও তা সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন। যেমন- সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু একটি হাদিস শিক্ষার জন্য মদিনা হতে শাম এক মাসের পথ অতিক্রম করে সেখানে গেছেন।
আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ, কথা ও কাজ বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পূর্ণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপরের কাছে কখনও বর্ণনা করতেন না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে যেমন উৎসাহ প্রদান করেছেন, তেমনি হাদিস বর্ণনায় মিথ্যার আশ্রয় এর ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَؤّْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার উপর কোন মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান নির্ধারণ করে নিলো”।[2] তিনি আরও বলেন:
كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ
“একজন ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাকিছু শুনে [সত্য-মিথ্যা যাচাই ছাড়া] তাহাই অন্যের কাছে বর্ণনা করে”।[3]
অতএব সাহাবীগণ যেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ সংগ্রহ ও প্রচার-প্রসারে আগ্রহী ও উৎসাহী ছিলেন তেমনি আবার ভুল-ত্রুটি ঘটতে পারে এ আশংকায় চরম সতর্ক ছিলেন। কোন কিছু শুনে বা দেখে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বর্ণনা করতেন না। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ খাদেম সাহাবী আনাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন:
لَوْلاَ أَنِّي أَخْشَى أَنْ أُخْطِئَ لَحَدَّثْتُكُمْ بِأَشْيَاءَ سَمِعْتُهَا مِنْ رَسُولِ اللهِ أَوْ قَالَهَا رَسُولُ اللهِ وَذَاكَ أَنِّي سَمِعْتُهُ يَقُولُ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ
“আমার যদি ভুল ত্রুটির আশংকা না হত তাহলে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অনেক কিছু বর্ণনা করতাম যা তাকে বলতে শুনেছি, কিন্তু ভয় হয় যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার উপর মিথ্যা রোপ করল সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিলো”।[4]
এমনিভাবে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমার সহ অনেক সাহাবী ভুল-ত্রুটির আশংকায় অনেক হাদিস বর্ণনা করেন নি।
অতএব এতে প্রতীয়মান হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ হাদিস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারে অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
তাবেঈদের যুগে সুন্নাহর গুরুত্ব প্রদান
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের বিদায়ের পরই শুরু হল তাবেঈনদের যুগ। তাবেঈদের যুগের শুরুতেই প্রকাশ পেল ইসলামের নামে নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। এ ষড়যন্ত্র মূলত: সাহাবীদের পরেই নয় বরং তা শুরু হয়েছে আরও আগেই। ইসলামের শত্রুরা যখন প্রকাশ্য মুকাবিলায় ব্যর্থতার শিকার হল, তখন শুরু হল সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। এটা মূলত: দ্বিতীয় খলীফা আমীরুল মুমিনিন ওমার রাদিআল্লাহু আনহু-কে মাজুসী/অগ্নিপূজক এর মাধ্যমে হত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ খলীফার ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একে একে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ সহচর বা সাহাবীদের বিদায়ের পাশাপাশি ইসলাম আগ্রাসী অপশক্তির ছোবলের তেজ আরও প্রখর হতে লাগল। খাওয়ারেজ, রাফেযী, মুরজিয়া ও কাদেরীয়া ইত্যাদি ফেৎনার মুখোস উন্মোচন হল। ইসলামী বিষয়াদীতে সংশয়-সন্দেহ অনুপ্রবেশ ঘটতে লাগল। এমতাবস্থায় সুন্নাহ সংরক্ষণ একটি জরুরী ও জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়াল। এ সন্ধিক্ষণে তাবেঈগণ নানাভাবে সুন্নাহ সংরক্ষণ ও সংগ্রহ করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। সুন্নাহ সংরক্ষণে তাঁদের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহ নিম্নরূপ :
১. العناية بحفظها হাদিস মুখস্থ করণে গুরুত্ব প্রদান।
২. السوال عن الاسناد হাদিসের সনদ/ সূত্রের সঠিকটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ, অর্থাৎ সনদ যাচাই করণ।
৩البحث في أحوال الرجال ونقلة الأخبار হাদিস বর্ণনাকারী/রাবীদের জীবন-চরিত সম্পর্কে গবেষণা ও বিশ্লেষণ।
৪.تدوين السنة الذي بدأ بصحف وأجزاء ثم تطور বিভিন্ন পুস্তিকা ও খণ্ড খণ্ড গ্রন্থে হাদিস সংকলন, যাহা পরবর্তীতে বুখারী, মুসলিম ও মুয়াত্ত্বা ইত্যাদি সংকলনে রূপলাভ করে।
সাহাবীদের শেষ লগ্নে তাবেঈদের যুগে বিদ‘আত, খোরাফাত ইত্যাদির বিকাশ ঘটলে সরলভাবে হাদিস গ্রহণ করা হত না, বরং পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই করে ছিকাহ অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত রাবী/বর্ণনাকারীর হাদিসই শুধু গ্রহণ করা হত। কারণ এ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ قَالَ: يَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ يَأْتُونَكُمْ مِنْ الأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلاَ آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ لاَ يُضِلُّونَكُمْ وَلاَ يَفْتِنُونَكُمْ
“সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, শেষ যুগে কতক মিথ্যুক দজ্জালের আগমন ঘটবে, তারা তোমাদের কাছে এমন সব হাদিস পেশ করবে, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষরাও কখন শোনেনি, অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যাও, তারা যেন তোমাদেরকে পথভ্রষ্টটা ও ফিতনা-ফ্যাসাদে নিপতিত করতে না পারে।[5]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সতর্ক বাণীর আলোকে সাহাবীদের শেষ যুগে এবং তাবেঈদের যুগে হাদিস গ্রহণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম শুনলেই যথেষ্ট মনে করা হত না, বরং খুবই সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাই করে হাদিস গ্রহণ করা হত। ইমাম মুসলিম [রাহিমাহুল্লাহ] সাহাবী ও তাবেঈদের হাদিস গ্রহণের অবস্থাসমূহ স্বীয় গ্রন্থ সহীহ মুসলিমের ভূমিকায় সুন্দরভাবে আলোকপাত করেছেন, তন্মধ্যে কয়েকটি বর্ণনা নিম্নে প্রদত্ত হল:
[১] ইমাম মুসলিম [রাহিমাহুল্লাহ] স্বীয় সনদে প্রসিদ্ধ তাবেঈ মুজাহিদ [রাহিমাহুল্লাহ] হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: বাশীর বিন কা’ব আল আদাবী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু-এর কাছে আসলেন এবং হাদিস বর্ণনা শুরু করলেন, বলতে লাগলেন: قَالَ رَسُولُ اللهِ ، قَالَ رَسُولُ اللهِ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ইত্যাদি” কিন্তু সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু তাকে হাদিস বর্ণনার কোন সুযোগ দিলেন না। এমনকি তার দিকে দৃষ্টিপাতও করলেন না। বাশীর বিন কা’ব বললেন, হে ইবনু আব্বাস! কি ব্যাপার, আপনি আমার হাদিস শুনছেন না কেন? আমি আপনাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে হাদিস বর্ণনা করছি, আর আপনি কোন কর্ণপাত করছেন না? তার জবাবে ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, প্রথম পর্যায়ে কোন ব্যক্তিকে যখনই বলতে শুনতাম যে, قَالَ رَسُولُ اللهِ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সাথে সাথে তার কথায় আমরা মনোযোগী হতাম এবং খুব গুরুত্ব দিয়ে তার কথা শুনতাম, কিন্তু যখন মানুষ বিভিন্ন ছলচাতুরী শুরু করল, তখন হতে আমাদের জানা বিষয় ছাড়া সাধারণ মানুষ হতে অন্য কিছু শুনি না এবং গ্রহণ করি না”।
এ বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিস গ্রহণে তাঁরা কত সতর্ক ছিলেন। সাহাবী ছাড়া অন্য কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে বর্ণনা করলেও নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সে হাদিস গ্রহণ করতেন না।
[২] প্রসিদ্ধ তাবেঈ মুহাম্মদ বিন সীরিন [রাহিমাহুল্লাহ] হতে বর্ণিত তিনি বলেন:
إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ “নিশ্চয় হাদিসের জ্ঞান হল দ্বীনের অন্যতম অংশ, অতএব ভালভাবে লক্ষ কর তোমরা কাদের হতে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ”।
[৩] তিনি আরও বলেন, “হাদিসের সনদ/সূত্র ও রাবী বা বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হত না, কিন্তু যখন হতে [কাদেরীয়া, মুরজিয়া, জাবারিয়া ও রাফেযী ইত্যাদি বিদ’আতের] ফিতনা প্রকাশ পেল তখন হতে জিজ্ঞাসা শুরু হল: سموا لنا رجالكم… “যাদের বরাতে হাদিস বর্ণনা করছ তাদের নাম উল্লেখ কর”, ব্যক্তিরা যদি সুন্নাতপন্থী হতেন তাহলে তাদের হাদিস গ্রহণ করা হত, আর যদি বিদ‘আাতী হতেন তাহলে তাদের হাদিস প্রত্যাখ্যান করা হত”।
[৪] আব্দান বিন উছমান মারওয়াযী [রাহিমাহুল্লাহ] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আব্দুল্লাহ বিন মুবারককে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: اَلإِسْنَادُ مِنْ الدِّينِ لَوْلاَ الإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ “হাদিসের সনদ/সূত্র দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ যদি এ সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা না থাকত তাহলে যার যা ইচ্ছা হত তাই বলত”।
তাবেঈদের হাদিস সংগ্রহে এবং সংরক্ষণে এ নীতি অবলম্বন বিদাতী চক্রের ষড়যন্ত্র এবং ইসলামের শত্রুদের সুদূর পরিকল্পিত চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে যায়। হাদিসের নাম দিয়ে বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরাতে মিথ্যাচারের পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে সনদ বিহীন বর্ণনার সুযোগ ও মিথ্যুক দজ্জালদের দাজ্জালি ও মিথ্যাচার বন্দ হয়ে যায়, বা চালু থাকলেও পরিশেষে মিথ্যা প্রকাশ পেয়ে যায়।
তাবেঈদের এ নীতি অবলম্বন করে সর্বপ্রথম হাদিস শাস্ত্রের নীতিমালা প্রণয়ন করেন ইমাম শাফেয়ী [রাহিমাহুল্লাহ] তাঁর “আর রিসালাহ” ও “কিতাবুল উম্ম” গ্রন্থদ্বয়ে। এরপর এ শাস্ত্রের গভীর সমুদ্রে পাড়ি জমান ইমাম বুখারী [রাহিমাহুল্লাহ] ইমাম মুসলিম [রাহিমাহুল্লাহ] সহ আরও অনেকে। আল্লাহ তা’আলা তাদের সকলকে জাযায়ে খাইর দান করুন। আমীন!
তথ্যসূত্র :
[1] [সূরা আন্-নাহল, ৪৪]
[2] মুসলিম: ৩
[3] মুসলিম: ১০
[4] আহমদ: ১২৭৪৬
[5] মুসলিম: ৭
বইঃ সুন্নাহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
লেখকঃ জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের