বাঙ্গালাহ্ সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা : সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ্

সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহকে নিয়ে সমালোচনার জবাব-
কে ছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহ্? সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ বাঙ্গালাহ্ ছিলেন সার্বভৌম বাঙ্গালাহ্ সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি উপেক্ষিত বাংলা কে পরিণত করেছিলেন শাহী বাংলায়। গঙ্গা একদিন পলিফেলে সৃজন করেছিলো বিশ্বের উর্বরতম ব-দ্বীপ।
একজন সিস্তানি ব্যক্তি যিনি সুদূর সিস্তান থেকে বাংলায় এসে উপেক্ষিত, শোষিত, মজলুম বাঙালির রাষ্ট্রশক্তির উত্থান ঘটিয়ে হয়ে উঠেছিলেন অখন্ড বাংলার প্রথম সম্রাট।
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির নেতৃত্বে মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিহত করে করে হিন্দুস্থান (দিল্লি সালতানাত) পরিণত হয় মহাবিশ্বশক্তিতে, যার বিস্তৃতি ঘটে বাংলা ব্যতীত প্রায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী [বাংলায় তখন বলবানী বংশের স্বাধীন সুলতানদের রাজত্ব ছিলো]

সেই বিশাল দিল্লি সালতানাতের মহাপ্রতিপত্তির কার্যত পতন ঘটে সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের আক্রমণে এবং এরপর দিল্লির প্রতিপত্তির চূড়ান্ত পতন ঘটে ১৩৯৮ সালে আমির তাইমুরের আক্রমণের ফলে। এরপর মুঘল যুগের পূর্বাবধি দিল্লি আর কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের আক্রমণ এবং সামরিক অভিযান এতো তীব্র ছিলো যে, দিল্লির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই তিনি জয় করে নিয়েছিলেন। ইলিয়াসের আক্রমণের সুযোগেই দক্ষিণ ভারতে বাহমনী, বিজয়নগর (সঙ্গম বংশীয়) এবং সিন্ধু-মূলতান বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়ে যায়, যাদের সম্মিলিত আয়তন ছিলো শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের বাঙ্গালাহ সাম্রাজ্যের সমান। ইলিয়াস শাহ্ ১৩৪৭ সালে হিন্দুস্থানের করদ রাজপুত রাজ্য গোরখপুর, ১৩৪৮ সালে তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম হিন্দু রাজ্য উড়িষ্যা বিজয় করেন এবং ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ্ সমগ্র নেপাল দখল করে নেন। তিনি ১৩৪৫ সালে হিন্দুস্থানের অন্তর্গত বৃহত্তম প্রদেশ কারাহ-প্রায়াগ পর্যন্ত বিজয় করে নেন। অত:পর ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইখতিয়ার উদ্দিন গাযী শাহ কে পরাজিত বঙ্গ বিজয় করে পুরো বাংলাকে একত্রিত করেন। সুলতান ইলিয়াস শাহের বিজিত ভূখণ্ডের আয়তন হয়েছিলো ১৩ লক্ষ এবং ১৪ লক্ষ ৮ হাজার ৭০৬ বর্গকিলোমিটার। এতোটাই সুবিশাল ছিলো সালতানাত-ই বাঙ্গালাহর সর্বোচ্চ বিস্তৃতি। অন্যদিকে বিশাল হিন্দুস্থান তখন হয়ে পড়ে মাত্র ৮ লক্ষ এবং ৯ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের মাঝামাঝি। ভাবতে পারেন আমাদের শাহী বাঙ্গালার সর্বোচ্চ বিস্তৃতি কতটুকু হয়েছিলো? আমরা আজ কী আছি আর এককালে কী ছিলাম?
রিচার্ড ইটন ম্যাক্সওয়েল লিখেছেন- “ইলিয়াসের শাহের এতো বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ নগর বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে ছিলো বিশ্ববিজয়ের সমতুল্য। একারণে তাঁকেও আলাউদ্দিন খলজির মতো ‘দ্বিতীয় আলেকজান্ডার’ খেতাবে ভূষিত করা যায়।”
ইলিয়াস শাহ্ উপেক্ষিত বাংলাকে পরিণত করেছিলেন উপমহাদেশের পরাশক্তিতে। তাঁর স্বাধীন সার্বভৌম সালতানাত প্রতিষ্ঠা নিতান্তই কোনো সাধারণ ক্ষমতার দখলের লড়াই ছিলো না এবং সুলতান ইলিয়াস গভর্নর থাকাকালীন বিদ্রোহ করে স্বাধীন হওয়া অপরাপর শাসকদের মতো ছিলেন না।
তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন মালিক ফিরোজ (ফিতোজ শাহ তুঘলক) এক প্রহরী। ১৩২৫ সালে অজ্ঞাত অপরাধের কারণে দিল্লি থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি বঙ্গের বলবানি সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের আনুগত্য স্বীকার করে তাঁর বাহিনীতে যোগদান করেন ও সোনারগাঁয়ে আসেন। তিনি ধীরে ধীরে বাহাদুর শাহের প্রধান সহচর হয়ে ওঠেন। ১৩২৭ সালের শেষদিকে স্বাধীনচেতা বাহাদুর শাহ্ দিল্লির সুলতান মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের বাহিনী বাহাদুর শাহ কে পরাজিত ও হত্যা করে তাঁর মাথা কেটে চামড়া ছাড়িয়ে দিল্লিতে পাঠায় এবং দিল্লির বিজয় গম্বুজে টানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক।
মনিবের প্রতি এহেন নিষ্ঠুর আচরণ হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে হাজি ইলিয়াস কে ক্রুব্ধ করে তোলে। রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে হাজি ইলিয়াস বিহারের প্রাদেশিক বাহিনীতে যোগদেন ও পূর্বে সামরিক অভিজ্ঞতা থাকায় দ্রুত মালিক পদে উন্নীত হন। ১৩৩৭ সালে বিহারের গভর্নর মৃত্যুবরণ করলে হাজি ইলিয়াস প্রাদেশিক গভর্নর হন। তিনি তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি। ১৩৩৮ সালে রাঢ়ের গভর্নর ইজাজউদ্দিন ইয়াহিয়া মৃত্যুবরণ করলে ইলিয়াস দ্রুত সাতগাঁওয়ে এসে ক্ষমতা দখল করেন ও রাঢ় ও বিহার একত্র করে নিজেকে রাঢ়ের সুলতান ঘোষণা করেন।
সুতরাং, ইলিয়াস শাহ্ কোনো বিদ্রোহী ‘গভর্নর’ ছিলেন না। তিনি ক্ষমতার দখল নিয়েছিলেন।
চিত্রে ১৩৯৪-১৩৯৯ সালে সর্বোচ্চ বিস্তৃতিতে বাংলা সালতানাত। জ্বি, এটাই আমাদের বাংলা, আমাদের সাম্রাজ্য- দারুল ইসলাম শাহী বাঙ্গালাহ, আয়তন- ১৪ লক্ষ ৮ হাজার ৭০৬ বর্গকিলোমিটার।
দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ইলিয়াস শাহের বীরত্বের কাছে শোচনীয় পরাজয় ঘটে গোরক্ষপুর, বঙ্গ, উড়িষ্যা, কামরূপের শাসকদের, হিন্দুস্থানের প্রতিপত্তি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ইলিয়াস। এমন নাস্তানাবুদ তিনি করেছিলেন দিল্লিকে যে দিল্লির আমির ও ঐতিহাসিকেরা স্বীয় পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে ইলিয়াস শাহ কে যতভাবে ছোট করা যায় ততভাবে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেই গেছে। শোচনীয় পরাজয়ের বেদনা ভুলতে পারেনি বলেই ইলিয়াস শাহের অবমাননা, তাঁকে যতভাবে সম্ভব খারাপ বানানোর উদ্দেশ্যপ্রণদিত চেষ্টা হিন্দুস্থান করেই গেছে। বাংলার কাছে খাওয়া মার কী আর এতো সহজে ভোলা যায়!
যেমন- সুলতান ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও বিজয়ের পর পুরো বাংলাকে একক ভূখণ্ডে পরিণত করে সালতানাতের নাম “বাঙ্গালাহ” এবং নিজেকে শাহ-ই বাঙ্গালাহ্ ঘোষণাই শুধু করেন নি, তিনি নিজের নামের সাথেই “বাঙ্গালাহ্” কথাটি জুড়ে দিয়ে নিজের রাজকীয় নামকরণই করেছিলেন-“শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাঙ্গালাহ”।বাঙ্গালাহ কেবল তাঁর সাম্রাজ্যেরই নাম নয়, “বাঙ্গালাহ” ছিলো তাঁর নামের একটি উপাধি। এভাবে নিজের নামের সাথে বাংলাকে যুক্ত করে অন্য কোনো শাসক কখনোই সিংহাসনে বসেন নি। আর এভাবেই ইলিয়াস শাহ নিজেকে বাঙ্গালির রাজা (শাহ-ই বাঙ্গালিয়ান) এবং নিজের নামের সাথে বাঙ্গালাহ যুক্ত করে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলার ও বাঙালির একটি স্বতন্ত্র পরিচয় সৃষ্টি করলেন। এর পূর্বে বাংলাভূখণ্ডের অধিবাসীদের কোনো একক পরিচয় ছিলোনা। ইলিয়াসই সর্বপ্রথম এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত করেন।
দিল্লির ঐতিহাসিকেরা ইলিয়াস শাহের “বাঙ্গালাহ” নামটি বিকৃতিভরে “ভাঙ্গাড়া” /”ভাঙ্কারা” হিসেবে উচ্চারণ করতো এবং শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ কে ভাঙসেবী বা ভাঙখোর হিসেবে দিল্লির আমিরেরা বহুবার উল্লেখ করেছেন।
এর কারণ হলো- ইলিয়াস শাহ এতো দ্রুত এতো দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন যে দিল্লির বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিলো যে, ভাঙ সেবন না করলে এতো কম সময়ে এত ভয়ংকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। একদালার প্রথম মহাযুদ্ধের সময় কৌশলগত ত্রুটির কারণে ইলিয়াস শাহের ২ লক্ষ ১২ হাজার সৈন্যের বাহিনীর ২ লক্ষ ১১ হাজার ৯৯৩ জন সৈনিক [প্রধান সেনাপতি সহদেব সহ]
হিন্দুস্থানের বাহিনীর ব্যাপক ক্যাভালরি চার্জের সম্মুখীন হয়ে নিহত হয়েছিলো। সুলতান এবং শাহজাদা সহ মাত্র ৭ জন সৈন্য যখন জীবিত এবং দুর্গের বাইরে যখন ৭ লক্ষ সৈন্যের হিন্দুস্থানি ফৌজ [১০ লক্ষ সৈন্যের ৩ লক্ষ নিহত হয়েছিলো] অপেক্ষা করছে, তখন সুলতান সেই ৭ জন সৈনিক নিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বঙ্গের গভর্নর মালিক মুয়াজ্জিমকে সৈন্য প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন আগেই। বঙ্গের গভর্নর মুয়াজ্জিম খান বাংলার সাধারণ জনগণ কে রাজশক্তির পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানালেন। “সুলতান ডাকছেন”- একথা শুনেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যুবকেরা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার্থে -এতোটাই ছিল সুলতান ইলিয়াসের জনপ্রিয়তা। ১০ লক্ষ সৈন্যের বিশাল বহর নিয়ে একডালা অভিমুখে যাত্রা করলেন মালিক মুয়াজ্জিম খান। হঠাৎ পূর্বদিক থেকে বিশাল সৈন্যবহর আসতে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। এই বিশাল সৈন্যবহর দেখেই প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে হিন্দুস্থানি ফৌজ ছুটে পালাতে থাকলো। ১০ লক্ষ বাঙ্গালি সৈন্য ৭ লক্ষ হিন্দুস্থানি সৈন্যকে তাড়া করে ইলিয়াস শাহী বাঙ্গালাহ থেকে বিতাড়িত করলো। ২ লক্ষ ১১হাজার ৯৯৩ সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে রক্ষিত হলো বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। পরাজিত ফিরোজ শাহ দিল্লি ফিরে ঘোষণা দিলেন- “আর কেউ কারো রাজ্য আক্রমণ করবেনা”।
এই পরাজয় কী ভোলা যায়? আর তাই দিল্লির ঐতিহাসিকরা মহামতি ইলিয়াস শাহ কে ছোট করতে তাঁকে ভাঙসেবী হিসেবে ও বাঙ্গালা কে ব্যাঙ্গভরে ‘ভাঙ্গাড়া’ হিসেবে উল্লেখ করে গেছে।
★ ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টন লিখেছেন- [ হাজি ইলিয়াস নাকি ফিরোজ বিন রজবের এক উপপত্নীকে ধর্ষণ করায় দিল্লি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। – এই তথ্যটি সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্ত। কারণ- হেরেম পাহারা দিতো সশস্ত্র খোজারা এবং কোনো সাধারণ প্রহরী তো দূরের কথা , যার হেরেম তিনি ব্যতীত অন্য কোনো রাজপুরুষের পর্যন্ত হেরেমে প্রবেশাধিকার ছিলো না। সবসময় কড়া পাহারা থাকতো। তাহলে ইলিয়াসের মত একজন প্রাসাদরক্ষীর পক্ষে কোনভাবেই হেরেমে প্রবেশ করা সম্ভব না, মালিক ফিরোজের কোনো দাসীকে বলাৎকার করার তো প্রশ্নই আসে না।
তাই এই তথ্য ইলিয়াস শাহ কে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াস মাত্র ]
★ ইলিয়াস শাহ ক্ষমতার জন্য নিজের দুধ ভাইকে হত্যা করেছেন।
হ্যাঁ কথা সত্য। মুহাম্মাদ বিন তুঘলক বাংলাকে ভাগ করেছিলেন তিনটি প্রদেশে। যথা:-
(১) গৌড়- রাজধানী লখনৌতি
(২)বঙ্গ -সোনারগাঁও
(৩) রাঢ় – রাজধানী সাতগাঁও
১৩৩৮ সালে এই তিনটি প্রদেশই স্বাধীন হয়ে পড়ে। গৌড়ের গভর্নর কদর খান বঙ্গের সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নিহত হলে তাঁরই সামরিক সচিব আলি মুবারাক লখনৌতির ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আলী মুবারাক আলাউদ্দিন আলি শাহ নামধারণ করেন। ইনি ছিলেন ইলিয়াস শাহের দুধভাই। ইলিয়াস শাহ তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য ১৩৪২ সালে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন আলি শাহ উরফে আলি মুবারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন ও আলাউদ্দিন আলি শাহ নিহত হন। ইলিয়াস শাহ লখনৌতি বিজয় করেন এবং ১৩৪৩ সালে তাঁর রাজধানী ফিরোজাবাদে (পান্ডুয়া) স্থানান্তরিত করেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কেউ কারোর আপন না। ভাই কর্তৃক ভাইয়ের, সন্তান কর্তৃক পিতার, ভাতিজা কর্তৃক চাচার হত্যা স্বাভাবিক একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত হত। তাই ইলিয়াস শাহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য-রাজ্য বিস্তারে এটা স্বাভাবিক বিষয়। আর যদি ইলিয়াস শাহকে দোষ দিতেই হয় তাহলে বলব-
(১) সুলতান মুহাম্মাদ বিন তুঘলক নিজে তাঁর বাবা গিয়াস উদদিন তুঘলক কে হীন চক্রান্তমূলকভাবে হাতির খেলা দেখাতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন।
(২) হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন খলজি নিজ চাচা জালাল-উদ্দিন খিলজি কে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন ।
(৩) উসমানিয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান প্রথম সেলিম তাঁর বাবা সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। নির্বাসনে যাবার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
মাত্রাকচি নাসুহ তাঁর ‘সুলাইমাননামা’ তে লিখেছেন- সুলতান বেয়াজিদ খানের মৃত্যুতে সুলতান সেলিম জড়িত ছিলেন।
(৪) বিখ্যাত মৌর্য সম্রাট অশোক তাঁর ৯৯ জন সৎ ভাইকেই হত্যা করেছিলেন। কেবলমাত্র বিতাশোক নামে একমাত্র আপন ভাইকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সৎ ভাই সুসীমকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে খুন করেছিলেন ‘বৌদ্ধধর্মের কনস্ট্যানটাইন’ খ্যাত এই সম্রাট।
(৫) উসমানীয় সুলতান তৃতীয় মুহাম্মাদ তাঁর ২২ জন সৎ ভাইকে হত্যা করেছিলো, যাদের অনেকেই ছিলেন বধির, প্রতিবন্ধী তথা সিংহাসন গ্রহণের অনুপযোগী। তারপরও তাঁরা রেহাই পান নি নিষ্ঠুরতা থেকে । তিনি তাঁর পিতার সাত গর্ভবতী উপপত্নীকেও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন ।
সুতরাং ইলিয়াস শাহকে দোষ দেয়ার পূর্বে উপরের ব্যক্তিদের কথা স্মরণে রাখা উচিত।
ইলিয়াস শাহের বীরত্ব হিন্দুস্থানের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলো বলেই ইলিয়াস কে তারা সবসময় ছোট করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ইলিয়াস শাহের সাম্রাজ্য উত্তর ভারতের অযোধ্যা, বাহরাইচ, নেপাল হয়ে উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক নগর ইলিয়াস শাহ জয় করেছিলেন।
তিনি বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে একটি জাতিকে সুসংবদ্ধ ও শাসক জাতিতে পরিণত করেছিলেন, যার কৃতিত্ব অন্য কারোর নেই। পাল সাম্রাজ্য এবং নন্দ সাম্রাজ্য বাঙালির জন্য তাদের অবদান অনেক- তবে জাতি হিসেবে পৃথিবীতে বাঙ্গালির আলাদা পরিচয় সৃষ্টি এবং
প্রতিষ্ঠা যুদ্ধের মাধ্যমে মজলুম উপেক্ষিত জাতির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে উপমহাদেশীয় পরাশক্তিতে পরিণত করার কৃতিত্ব কেবলমাত্র সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের। ভারতের প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক আখী মাখদুম সিরাজ (রহ.) ছিলেন সুলতানের প্রিয় বন্ধু। তিনি শাইখ আলাউল হক (রহ.) এর স্মরণে বেনিয়াপুকুর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মুসলিম হত্যার প্রতিশোধে তিনি নেপাল তছনছ করে দিয়েছিলেন।
মহান ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম উপমহাদেশে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন শূদ্র সহদেবকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। প্রজাদেরকে তিনি দেখতেন তাঁর কর্মের ভিত্তিতে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। তিনি সর্বপ্রথম বাংলার বাহিনীতে হিন্দুদের নিয়োগদান শুরু করেন।
[১৪,০৮,৭০৬ বর্গকিলোমিটারের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাঙ্গালার বিস্তৃতি সীমা কতদূর যেতে পারে। তবে ইলিয়াস শাহের এই সাম্রাজ্যের আয়তন পরবর্তিতে বিভিন্ন সময় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়,অনেক ভূমি হাতছাড়া হয়ে যায়..আবার দখলে আসে সেসব ভূমির কিছু অংশ আবার কিছু অংশ কখনোই দখলে আসেনি বাংলার। সাইফুদ্দীন হামজা শাহের রাজত্বকালে নেপালে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে এবং ১৪১৩ সালে স্বাধীন হয়ে যায় শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ শাহের আমলে। জৌনপুরের শার্কিরা আজমগড় দখল করে নেয় এবং বাংলার উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। অনেকবার ত্রিপুরা এবং আসাম বিদ্রোহ করে, বিভিন্ন সময় বিদ্রোহ দমনে আসে। উড়িষ্যা স্বাধীন হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, মূল বাংলার উপর আক্রমণও চালাতে থাকে। পরবর্তীতে উড়িষ্যা আবার বাংলার পদানত হয়।]
আর এজন্যই সুলতান ইলিয়াস শাহ বাঙ্গালার প্রতি দিল্লির এতো বিদ্বেষ।
তারিখ- ০৭-০৭-২০২২

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88