তাবুক সফরে যা দেখে এলাম

১৪/১ তারিখ রাত থেকে ১৬/১/২০২০ তারিখ রাত পর্যন্ত আমরা শিক্ষা সফরে ছিলাম। ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদিস’ মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা প্রতি বছরের ন্যয় এবারো এ শিক্ষা সফরের আয়োজন করেছিল। এবারের গন্তব্য ছিল, ৯ম হিজরির তাবুক যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চল তাবুক প্রদেশ। এটি সৌদি আরবের ১৩ টি প্রদেশের অন্যতম একটি আবহাওয়া বৈচিত্র্যতায় ভরপুর এক প্রদেশ।

সৌদি আরবের এ প্রদেশেরই কিছু অংশে প্রচণ্ড শীতে তুষারপাত দেখা যায়। আমাদের সফরের একটি অংশ ছিল চর্ম চক্ষে তুষার পাতের নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করা। তবে তাকদির আমাদের জন্য তুষারের শুভ্রতা নয় বরং রৌদ্রজ্বল সুপ্রভাতের আলো ঝলমলে স্নিগ্ধতার ডালি সাজিয়ে অভ্যর্থনা দিয়েছে। তাই আর তুষারপাত দেখা সম্ভব হয় নি। তীব্র শীতের মোকাবেলায় আমাদের যে প্রস্তুতি ছিল, তা দেখে সুয্যি মামা নিশ্চয় চোখ টিপে হেসেছে!
তবে আমরা তাবুক ঘুরে যে সকল স্পট দেখে এলাম-
স্থানীয় অধিবাসীদের নিকট মসজিদটি পরিচিত ‘মসজিদুর রাসূল’ হিসেবে। বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল (সাঃ) তাবুক যুদ্ধে একাধারে দশ দিন এ স্থানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছিলেন। তাঁর সে স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজীজ (রহঃ) এর সময়কালে রাসূল (সাঃ) নামাজের স্থানটিকে মসজিদে রুপ দেওয়া হয়। যুগে যুগে ইসলামী বিভিন্ন শাসনামলে মসজিদটির সংস্কার কাজ সাধিত হয়। মসজিদটির সর্বশেষ সংস্কার করা হয় বর্তমান সৌদি শাসনামলে ১৩৯৩ হিজরিতে।
এ মসজিদের কয়েক হাত দুরেই রয়েছে একটি কবরস্থান। সেখানে কয়েকজন সাহাবীর কবর রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ইতিহাস তাদের নাম সংরক্ষণ করেনি বা আমি পাইনি।
আব্বাসীয় শাসনামলে দূর্গটি নির্মিত হয়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী শাসক সুলায়মান কানুনির সময় মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে বৃহৎ পরিসরে সংস্কার করা হয়। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার হয়ে বর্তমানে দূর্গটি জাদুঘরে রুপান্তরিত হয়েছে। সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে তাবুক অঞ্চলের প্রাচীন মানুষের জীবন যাত্রার সাথে সম্পৃক্ত নানা ধরনের শীলা লিপি, মুদ্রা, পাত্র এবং যুদ্ধাস্ত্র।
এটিকে একটি ডিজিটাল জাদুঘর বলা যায়। প্রবেশ করতেই একজন সুদর্শন যুবকের পেশাদারী অভ্যর্থনায় মুগ্ধ হলাম। পরে যখন বুঝতে পারলাম ওটিকে লাইটিং এর মাধ্যমে একজন যুবকের আকৃতি দিয়ে ডিজিটাল অভ্যর্থনা দেওয়া হচ্ছে তখন কিছুটা হতভম্ব হলাম। ভিতরে গিয়ে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা সহ জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শন দেখলাম। দেখার মাঝে ছিল, শিলা লিপি, মানুষের আবক্ষ মূর্তি, প্রস্তর যুগের পাথরের অস্ত্র, ঈসা (আঃ) জন্মের হাজার বছর পূর্বের ব্যবহৃত তৈজস পত্র সহ আরো অনেক কিছু। সেখানে নাবাতী লিপিতে নিজের নাম লেখার ডিজিটল সিস্টেম রয়েছে। আমি আরবি অক্ষর ক্লিক করে নাবাতী যুগের সাথে ভাষার মেলবন্ধনের জন্য নামটি ঝটপট লিখে ফেললাম।
তাবুক দূর্গের পাশেই রয়েছে সিকির কূপ বা প্রস্রবন। যেটির উল্লেখ রয়েছে তাবুক যুদ্ধের ইতিহাসে। এ প্রসঙ্গে সহীহ মুসলীমে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আসুন মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) এর মুখেই শুনি। তিনি বলেন, তাবুক যুদ্ধের বছর আমরা রসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সাথে যুদ্ধে বের হলাম। এ সফরে তিনি -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- নামায একসাথে আদায় করতেন। অর্থাৎ, যুহর ও আসর একসাথে আদায় করতেন, আর মাগরিব ও ইশা একত্রে আদায় করতেন। পরিশেষে একদিন এমন হলো যে, নামায দেরিতে আদায় করলেন। তারপর বের হয়ে এসে যুহর ও আসর একসাথে আদায় করলেন, তারপর তাঁবুতে ঢুকলেন। অতঃপর আবার বেরিয়ে এলেন এবং মাগরিব ও ইশা একসাথে আদায় করলেন। অতঃপর বললেন, ইনশাআল্লাহ তোমরা আগামীকাল তাবুক জলাশয়ে পৌছবে, তবে চাশতের সময় না হওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে পৌছতে পারবে না। তোমাদের মাঝে যেই সেখানে প্রথমে পৌছবে সে যেন তার পানির কিছুই স্পর্শ না করে- যতক্ষণ না আমি এসে পৌছি।
আমরা ঠিক সময়েই সেখানে পৌঁছলাম। কিন্তু ইতোমধ্যে দু’ লোক আমাদের পূর্বে সেখানে পৌছে গিয়েছিল। আর প্রসবণটিতে জুতার ফিতার ন্যায় ক্ষীণ ধারায় সামান্য পানি বের হচ্ছিল। মুআয বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ দু’জনকে প্রশ্ন করলেন, তোমরা তা হতে কিছু পানি ছুয়েছে কি? … তারা উভয়ে বলল, হ্যাঁ! তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দু’জনকে ভৎসনা করলেন। আর আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই তাদের বললেন।
বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকেরা তাদের হাত দিয়ে অঞ্জলি ভরে ভরে প্রসবণ হতে অল্প অল্প করে পানি তুলল, পরিশেষে তা একটি পাত্রে কিছু পরিমাণ জমা হলো। বর্ণনাকারী বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাঝে তার দু’হাত এবং মুখ ধুলেন এবং তারপরে তা পানি তাতে প্রসবণে উল্টিয়ে ঢেলে দিলেন। ফলে পানির প্রসবণটি প্রবল পানি ধারায় কিংবা বর্ণনাকারী বলেছেন, অধিক প রিমাণে প্রবাহিত হতে লাগল।
পরে নাবী -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বললেন, হে মুআয! তুমি যদি দীর্ঘায়ু হও, তবে আশা করা যায় যে, তুমি দেখতে পাবে প্রসবণের এ জায়গাটি বাগানে ভরে গেছে।
ঐতিহাসিকগণ মতামত দিয়েছেন যে, হাদিসে যেটিকে আইনে তাবুক বা তাবুক জলাশয় বলা হয়েছে সেটিই হল আইনে সিকির বা তাবুক কূপ।
এখানে পাহাড় খোদায় করে নির্মিত ঘরগুলোর সাথে বেশ মিল রয়েছে আল-উলা শহরে অবস্থিত মাদায়ের সালেহ এর ঘরগুলোর সাথে। আর মাদায়েন সালেহ সেহেতু ২০১৬ সালে ভ্রমণ করেছি তাই ঘরগুলো খুব বেশি আকৃষ্ট না করলেও নতুন ঐতিহাসিক জায়গার সাথে পরিচিত হবার মধুর উত্তেজনা ঠিকই হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম।
সাগর আর পাহাড় সবসমই আমার কাছে ভাললাগার এক অপর নাম। সিলেট-মৌলভি বাজার এবং কক্সবাজারের অনেক ছোট-বড় পাহাড়ে উঠেছি। নিজের ক্লান্ত পদযুগলকে ডুবিয়েছি পতেঙ্গা, লাবনী পয়েন্ট এবং সেন্টমার্টিনের অথৈ সাগরের লোনা পানিতে। সারাদিনের ঘোরাঘুরির ক্লান্তিগুলো ধুয়ে মুছে সাফ করেছি বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি দিয়ে। সেই স্মৃতিগুলো আবার মানসপটে ভেসে উঠল যখন আফ্রিকা থেকে এশিয়া মহাদেশকে বিভক্তকারী লোহিত সাগরের তীরে নামলাম। লোহিত সাগরের বুক চিরেই এক সময় সাহাবায়ে কেরাম হিজরত করেছিলেন হাবশায় তথা বর্তমান ইথিওপীয়ায়। ইতিহাসের সে স্মৃতিও মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠল। ধর্ম রক্ষার জন্য নিজের দেশমাতৃকা ত্যাগের মত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল আমাদের পূর্বসূরিরা। তাই ইতিহাসের পাতায় তারা চির-অম্লান।
কল্পনার রাজ্য থেকে সম্বিত ফিরে এলে ঝাপিয়ে পড়লাম নীল জলরাশির বুকে। ধূ-ধূ মরুভূমির দেশে এসে ছোটবেলায় শেখা সাতারের প্র্যাকটিসটাও করতে ভুললাম না। সবাই একসাথে হৈ-হুল্লোড় করে বীচ-ফুটবল খেললাম। অতঃপর গোসল করে ড্রাইভার কর্তৃক বাসের হুইসেল শুনে বুঝলাম আমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। এখন বাসে বসে আবারো রাসূলের শহর মদিনাতে ফেরার পালা। পেছনে রেখে আসলাম আনন্দঘন কিছু মূহুর্ত।
মোঃ রায়হান উদ্দিন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা মুনাওরাহ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button