ভারতে মুসলমান : কেউ সুবিচার করেনি
[এই প্রবন্ধটি ২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।দুটি প্রবন্ধকে আমরা একত্রে উপস্থাপন করছি যাতে করে ভারতের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার চিত্রটা বুঝতে সহজ হয়।প্রথম প্রবন্ধটির লেখক অভিরূপ সরকার কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতির শিক্ষক।তাঁর লেখার প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় প্রবন্ধটি লিখেছেন অশোক ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক, ইউনাইটেড ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেস (ইউ টি ইউ সি)। লেখার শিরোনামটি এসেছে অশোক ঘোষের লেখা থেকে। মূল শিরোনাম ও উৎসগুলো রইল যাতে করে আগ্রহী পাঠকগন প্রয়োজনে মূল লিংকে গিয়ে দেখে নিতে পারেন –সম্পাদক]
আমাদের মুসলিম, ওঁদের মুসলিম
অভিরূপ সরকার, আনন্দবাজার, ১৩ মে, ২০১৪
নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি বলেছেন, গুজরাতের মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের তুলনায় ঢের ভাল আছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি নানা তথ্য দিয়েছেন, যার মূল সূত্র সাচার কমিটির রিপোর্ট। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাতি মুসলমানদের গড় আয় বেশি, সঞ্চয়ও বেশি। গুজরাতি মুসলিমদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা যতটা ছড়িয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের মধ্যে ততটা নয়। সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাতে অনেক বেশি, যদিও গুজরাতের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত এ রাজ্যের তুলনায় অনেক কম।
মোদীর তথ্য ও পরিসংখ্যানে দু’একটা ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি আছে। যেমন, আমাদের দেশে আয়ের কোনও নির্ভরযোগ্য হিসেব পাওয়া যায় না বলে মাথাপিছু ব্যয় দিয়েই একটি পরিবারের বা সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা বিচার করতে হয়। মোদী হয়তো আয় বলতে ব্যয়কেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু আয়ের বদলে ব্যয়ের দিকে তাকালেও দেখব, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের তুলনায় গুজরাতি মুসলিমরা অনেকটাই সচ্ছল, অর্থাৎ তাঁদের তুলনামূলক মাথাপিছু ব্যয় অনেকটাই বেশি। তেমনই, মোদীর দেওয়া অন্যান্য পরিসংখ্যানগুলিতে যে অল্পবিস্তর গাণিতিক ত্রুটিবিচ্যুতি আছে সেগুলো শুধরে নিলেও দেখা যাবে, তাঁর মূল প্রতিপাদ্যটি কিছু ধসে পড়ছে না, বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও জোরদার হচ্ছে। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় যে গুজরাতের মুসলিমরা অর্থনৈতিক ভাবে সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছেন, মোদীর এই দাবি মেনে নিতেই হবে।
কিন্তু এ ব্যাপারে দু’টি বক্তব্য আছে। প্রথমত, মোদী যদি আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চান যে, গুজরাতের মুসলমানদের আর্থিক সচ্ছলতার পিছনে তাঁর নিজের একটা মস্ত ভূমিকা রয়েছে, সেটা মেনে নেওয়া শক্ত। দ্বিতীয়ত, সচ্ছল হলেই যে ভাল থাকা যায় না, গুজরাতের মুসলমান সমাজ তার মস্ত উদাহরণ। আমাদের বক্তব্য দুটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার।
তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক উতোর-চাপানের বাইরে গিয়ে যদি একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই, তা হলে গুজরাতি-বাঙালি মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক তফাতের রহস্য অনেকটা বোঝা যাবে। আসল কথাটা খুব সহজ।
দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত মুসলমানদের প্রায় সকলেই সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এর একটা কারণ অবশ্যই ভাষার সুবিধে, আর একটা কারণ ভৌগোলিক নৈকট্য। এ ছাড়াও তৃতীয় একটা কারণ আছে। পুব বাংলা থেকে হিন্দু মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা দলে দলে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার ফলে পুব বাংলায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, উচ্চ পদগুলি ভরাট করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, কাজেই সচ্ছল ও শিক্ষিত মুসলমানদের সামনে বহু নতুন সুযোগ এসে পড়েছিল। এত দিন হিন্দু প্রতিযোগিতার চাপে পুব বাংলায় সচ্ছল ও শিক্ষিত মুসলমানরা খানিকটা দমে ছিলেন, হিন্দুরা চলে যাবার ফলে তাঁদের উন্নতিতে আর কোনও বাধা রইল না। এ-পার বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা ও-পার বাংলায় নতুন সুযোগের সন্ধান পেলেন।
পশ্চিমবঙ্গের গরিব মুসলমানদের কাছে ও-পার বাংলায় চলে যাওয়াটা কিন্তু ততটা আকর্ষণীয় ছিল না। একে তাঁদের টাকার জোর নেই, তার ওপর শিক্ষাদীক্ষাও তেমন নেই যে নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে নতুন করে জীবন শুরু করার ঝুঁকি নিতে পারবেন। সব থেকে বড় কথা, তাঁদের জীবিকার মূলে যে কৃষিক্ষেত্র, পুব বাংলায় সেটা তখনই যথেষ্ট ভিড়াক্রান্ত, নতুন করে আসা পরিযায়ীদের চাপ নিতে সে অক্ষম। কাজেই, এ দেশের গরিব মুসলমানেরা মোটের ওপর এ দেশেই রয়ে গেলেন। কিন্তু এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের চেহারাটা একেবারে হতশ্রী হয়ে পড়ল, সে সমাজে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত তেমন করে আর রইলেন না, কেবল পড়ে রইলেন অসংখ্য গরিব মানুষ।
গুজরাতের ব্যাপারটা অন্য রকম। দেশভাগের পর পুব কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে পাকাপাকি ভাবে চলে যাওয়ার উৎসাহ সেখানকার সচ্ছল মুসলিমদের ছিল না। ছিল ভাষার ব্যবধান এবং ভৌগোলিক দূরত্ব। তা ছাড়া, সেখানে বোহরা-খোজা-মেমন সম্প্রদায়ের মতো উচ্চবিত্ত মুসলমানরা পুরুষানুক্রমে ব্যবসাবাণিজ্য করে অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছিলেন, যথেষ্ট সুবিধেজনক অবস্থায় ছিলেন। তাঁরা নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করার ঝুঁকি নিতে যাবেন কেন? এর ফলে গুজরাতি মুসলমান সমাজের চেহারাটা তেমন একটা বদলাল না, যেমন পশ্চিমবঙ্গে বদলেছিল। গুজরাত ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ইতিহাস নির্ধারিত সেই তফাতটা এখনও পুরো মাত্রায় বজায় রয়েছে, এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদীর কোনও ভূমিকা বা কৃতিত্ব নেই।
আমাদের অনুমান ঠিক হলে দেখা যাবে, গুজরাতের মতো অন্যান্য রাজ্য, যেখান থেকে দেশভাগের পর অবস্থাপন্ন মুসলমানরা ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে পাকিস্তানে চলে যেতে উৎসাহ বোধ করেননি, সেখানকার মুসলিমদের অবস্থাও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের তুলনায় ভাল। তুলনার জন্য দক্ষিণের রাজ্যগুলির দিকে তাকানো যেতে পারে। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৪-০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে মুসলমানদের মাথাপিছু মাসিক খরচ ছিল এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মাথাপিছু মাসিক খরচের ৬২%। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে এই অনুপাত বেশি: তামিলনাড়ুতে ৮৭%, অন্ধ্রপ্রদেশে ৭১%, কেরলে ৭৯%, কর্নাটকে ৭০%। গুজরাতে এ অনুপাত ৭১%-এর কাছাকাছি। এই সংখ্যাগুলি আমাদের তত্ত্বকে সমর্থন করে।
এ বার আমাদের দ্বিতীয় বক্তব্যে আসি। হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদী আসল কথাটা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। তিনি এক বারও বলেননি যে, গুজরাতের মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের তুলনায় অবস্থাপন্ন হলেও তাঁরা সতত নিরপত্তাহীনতায় ভোগেন। কারণ, সেখানে ঘন ঘন দাঙ্গা বাধে, সেই সব দাঙ্গায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের ক্ষতি হয় বেশি। অর্থনীতিবিদ অনির্বাণ মিত্র এবং দেবরাজ রায়ের একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধ (‘ইমপ্লিকেশনস অব অ্যান ইকনমিক থিয়োরি অব কনফ্লিক্ট: হিন্দু-মুসলিম ভায়োলেন্স ইন ইন্ডিয়া, প্রকাশিতব্য, জার্নাল অব পলিটিকাল ইকনমি) থেকে জানতে পারছি,
১৯৮৪-৯৮— এই চোদ্দো বছরে সারা ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বলি হন ১৫২২৪ জন। এর মধ্যে ৪৪৯৯ জন, অর্থাৎ প্রায় ৩০% গুজরাতের; ৪০৩৩ জন অর্থাৎ ২৬%-এর কিছু বেশি মহারাষ্ট্রের। এখানে ‘বলি’ অর্থে দাঙ্গায় হত ও আহত দুইই ধরা হয়েছে।
উক্ত প্রবন্ধের লেখকদের প্রতিপাদ্য হল, দাঙ্গার মূল উদ্দেশ্য লুটতরাজ, এবং যেহেতু ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, লুটতরাজে তাঁরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। প্রবন্ধটিতে দেখানো হয়েছে, যখনই মুসলিমদের ধনসম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, তখনই দাঙ্গার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাৎ, আহত-নিহত সহ দাঙ্গার ক্ষয়ক্ষতি এবং মুসলিমদের ধন-সম্পত্তি বৃদ্ধি, এই দুই-এর মধ্যে একটা সরাসরি সংখ্যাতাত্ত্বিক সম্পর্ক আছে। হিন্দুদের সম্পত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে কিন্তু দাঙ্গার কোনও যোগাযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই বিশ্লেষণ বলে যে, গুজরাতি মুসলমানদের সচ্ছলতাই তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা ও দুঃখদুর্দশার কারণ। এর পরও গুজরাতি মুসলমানের সচ্ছলতা নিয়ে বড়াই করা চলে কি?
মূল সমস্যাটা অবশ্য আরও গভীরে। অর্থনৈতিক স্বার্থের ঘেরাটোপ দিয়ে তাকে পুরোটা ধরা যাবে না। দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৪-৯৮ সময়ের মধ্যে দক্ষিণের চারটি রাজ্যের সম্মিলিত দাঙ্গা-আক্রান্তের সংখ্যা ১৯২৪, অর্থাৎ মোট আক্রান্তের মাত্র ১২.৬%। অথচ আমরা আগেই দেখেছি, দক্ষিণে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা গুজরাতি মুসলমানদের তুলনামূলক অবস্থার থেকে কিছু খারাপ ছিল না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, দাঙ্গার উদ্দেশ্য যদি লুটতরাজই হয়, তা হলে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ততটা দাঙ্গা হয়নি কেন?
আসলে সব দাঙ্গার পিছনেই একটা দীর্ঘ সাম্প্রদায়িক বৈরিতার ইতিহাস থাকে, যে ইতিহাস দক্ষিণে ততটা ছিল না, যতটা গুজরাত-মহারাষ্ট্রে ছিল। উপরি-উক্ত প্রবন্ধের লেখকরাও এখানে ইতিহাসের ভূমিকা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁরা এই অবস্থার নাম দিয়েছেন প্রাইমরডিয়াল হেট্রেড বা আদিম ঘৃণা। গুজরাত-মহারাষ্ট্রে মুসলমানদের সচ্ছলতা দাঙ্গাবাজদের প্রলুব্ধ করেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেখানে সর্বব্যাপী ঘৃণার বাতাবরণ না থাকলে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গাগুলো ঘটত না।
মনে রাখতে হবে, গুজরাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই নিয়মিত দাঙ্গা হয়ে আসছে, ১৯৬৯ কিংবা ২০০২-এর দাঙ্গা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। বস্তুত, এই বৈরিতার পরিব্যাপ্ত জমিতেই জন্ম নিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, জনসঙ্ঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি। নরেন্দ্র মোদীও এই দীর্ঘ ঘৃণা ও বৈরিতাকে অতিক্রম করতে পারেননি, সম্ভবত কখনও চেষ্টাও করেননি। উল্টো দিকে, এ কথাও জোর দিয়ে বলা দরকার যে, যে-সব সংখ্যালঘু উগ্রপন্থীরা দেশ জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে, তারাও এই সাম্প্রদায়িক ঘৃণার ঔরসে জাত।
এখানে বলে রাখি, ২০০২-এর পরেও কিন্তু গুজরাতে দাঙ্গার প্রবণতা কমেনি। যেমন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১৩ সময়ের মধ্যে গুজরাতে দাঙ্গার বলি হয়েছেন প্রতি দশ লক্ষ মানুষে তেরো জন। ওই সময়ে এর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দেখা গেছে একমাত্র কর্নাটকে, প্রতি দশ লক্ষে ১৪.৩ জন। কর্নাটক ওই সময় বিজেপি’র শাসনেই ছিল।
একটা ঘৃণা থেকে জন্ম নেয় আর একটা ঘৃণা, তা থেকে আরও একটা। এর কোনও অন্ত নেই। শেষ বিচারে, অর্থ নয়, সচ্ছলতা নয়, শান্তিটাই আসল কথা। কিন্তু এই সরল সত্যটা নরেন্দ্র মোদী বুঝতে চাইবেন কি?
কেউ মুসলমানদের প্রতি সুবিচার করেনি
অশোক ঘোষ, আনন্দবাজার, ১৬ জুন, ২০১৪
অভিরূপ সরকারের রচনাটি (‘আমাদের মুসলিম, ওঁদের মুসলিম’, ১৩-৫) গুজরাত রাজ্যের প্রেক্ষাপটে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের আলোচনা হলে, সমগ্র দেশে মুসলমানদের উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকার প্রসঙ্গ অবহিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।ভারতের মুসলমান সমাজের সামাজিক অবস্থান এবং জীবন ও জীবিকার প্রসঙ্গটি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ জরুরি।
১৮৮৮ সালে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার লিখেছিলেন, ‘অতীতে একজন উচ্চকুলের মুসলমানের গরিব হওয়া ছিল অসম্ভব। এখন ধনী থাকা প্রায় অসম্ভব’। সাচার কমিটির রিপোর্টে (২০০৫) ১১৭ বছর পরেও সেই তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বরং সামগ্রিক ভাবে দেশের মুসলমান সমাজ সারা দেশে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও আরও দরিদ্র হয়েছে।
স্বীকার করা ভাল যে, বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ শাসনেও সংখ্যালঘুদের জীবন ও জীবিকার মৌলিক সমস্যাগুলি ঠিক ভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলেও ভোটের প্রয়োজনে মুসলিমদের ব্যবহার করা হচ্ছে দাবার বোড়ের মতো। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণেই বি জে পি-র কাছে মুসলমান সমাজ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করে না। সাচার কমিটির রিপোর্টকে বিজেপি বিশেষ কোনও গুরুত্ব দেয়নি।
দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলি প্রকাশ্যে দু’ভাবে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করে থাকে। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য মুসলমান ভোট যেখানে সংখ্যায় বেশি, সেখানেই মুসলমান প্রার্থী দেওয়া হয়। সাধারণ ভাবে হিন্দুপ্রধান এলাকায় মুসলমান প্রার্থী দেওয়া হয় না। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলিও সাধারণ ভাবে মুসলমান প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। সেই কারণেই পঞ্চদশ লোকসভায় মুসলমান সাংসদ সংখ্যা মাত্র ৩০ (৬ শতাংশ)। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে ২০টি রাজ্য থেকে এক জন মুসলমানও সংসদে নির্বাচিত হননি। ভারতীয় সংসদে মুসলমানদের সংখ্যা তাঁদের মোট জনসংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক নয়। জনসংখ্যা ১৩.৪ শতাংশ হলেও লোকসভায় ১৯৮০ সালে এক বারই মুসলমান সদস্য ছিলেন ৪৯ জন (প্রায় ১০ শতাংশ)। এটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মুসলমান সাংসদ সংখ্যা।
সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে নানা উপলক্ষে দেশের মধ্যে কোথাও না কোথাও দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে হতদরিদ্র মুসলমানদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফয়দা তোলা।
ভারতের মুসলমান সমাজ স্বাধীনতার পর থেকেই ধারাবাহিক ভাবে কংগ্রেসকে সমর্থন করে এসেছে। দেশভাগের কারণে উদ্ভূত দাঙ্গাহাঙ্গামার পরিস্থিতিতে এক জন মুসলমান মনে করতেন, তাঁর ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনের নিরাপত্তাই প্রধান। তাঁরা মনে করতেন, কংগ্রেসকে ভোট দিলে নিরাপত্তা থাকবে। একই মানসিকতা থেকে পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা বামফ্রন্টকে সমর্থন করতেন। কিন্তু মুসলমান সমাজের প্রাপ্য আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কংগ্রেস-সহ কোনও রাজনৈতিক দলই পালন করেনি। তার আরও একটি কারণ হতে পারে যে, রাজনৈতিক দলগুলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাটি মুখ্যত হিন্দু নেতৃত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমনকী প্রধান দলগুলির নেতৃত্বেও মুসলমানদের অনুপস্থিতি নজরে পড়ার মতো।
ভারতে ৫৯৩টি জেলার মধ্যে (২০০৯) মোটামুটি ১০০টি জেলার মুসলমান জনসংখ্যা বেশি। এই জেলাগুলি নিয়ে সাচার কমিটি যে আলোচনা করেছে, তার মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গের ১৩টি জেলা। এই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, গুজরাতে মুসলমান জনসংখ্যা সেই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৫.৪ শতাংশ হলেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলিম কর্মচারী ৯.১ শতাংশ। তামিলনাড়ুর মুসলিম জনসংখ্যা সেই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩.২ শতাংশ, সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ৫.৬ শতাংশ। অসমে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ, সরকারি কর্মচারী ১১.২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা ২৫ শতাংশের বেশি হলেও সরকারি ক্ষেত্রে ৪.২ শতাংশ মুসলমান। কেরল রাজ্যে বাম শাসন চলাকালীন সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের মংখ্যা ১০.৪ শতাংশ (তথ্যসূত্র: ২০১১ ও সরকারি দফতরের তথ্যের বিশ্লেষণ)।
১৯৬০ সালে আই এ এস এবং আই পি এস কর্মক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৪.৫ ও ৪.০৪ শতাংশ। ২০০৬ সালে সেই অনুপাত হ্রাস পেয়ে হয়েছে যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশ। আই এফ এস কর্মক্ষেত্রে এই অনুপাত মাত্র ১.৮ শতাংশ। দেশের অসামরিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান রেলে হয়েছে। সেখানে মুসলমান কর্মচারীর সখ্যা ৪.৫ শতাংশ। কমবেশি একই ধরনের চিত্র দেখা যাবে ব্যাঙ্ক ও ডাক-তার বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম কর্মচারীর হার ৪.৭ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকেই মুসলমানদের অনুন্নয়নের চিত্রটি বোঝা যায়। ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, তা অনস্বীকার্য।