টোকিও জামে মসজিদের ইতিহাস

টোকিও জামে মসজিদটি নির্মাণশৈলী এবং সূক্ষ্মতার দিক দিয়ে একটি চমৎকার দর্শনীয় স্থান। লোভনীয় তুর্কি নকশা সত্ত্বেও মসজিদটি তার প্রতিবেশী ইয়োগি ইউহেরার শান্ত নিরিবিলি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের মধ্যে অনেকটা নীরবে লুকিয়ে রয়েছে। ২০০০ সালে মসজিদটির বর্তমান কাঠামো নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু মসজিদটির রয়েছে অনেক লম্বা ইতিহাস। ১৯৩০ সালের দিকে জাপানিরা প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম জনসংখ্যার আবাসিক এলাকা প্রত্যক্ষ করে এবং প্রথম সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় মুসলিম অভিবাসীরা ১৯৩১ সালে নাগোয়া মসজিদ এবং ১৯৩৫ সালে কোবে মসজিদ নির্মাণ করেন।
রাশিয়ায় বিপ্লব সংগঠিত হলে সেখান হতে তাতার মুসলিম অভিবাসীরা পালিয়ে জাপানে আসে এবং পরে এখানে একটি বৃহত্তম জাতিগত গ্রুপ তৈরি করে। ১৯৩৮ সালে তারা টোকিওর মূল মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত করে।

11217956_886664301415188_8663554321318853615_n

হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং জাপানের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ হান্স মার্টিন ক্রামার মনে করেন, টোকিও জামে মসজিদটি জাপানের অন্যতম একটি বিশিষ্ট মসজিদ। বিশিষ্ট এই মসজিদটি নির্মানে শুধুমাত্র জাপান সরকারই সহায়তা করেনি, জাপানি অনেক কোম্পানিও আর্থিকভবে সাহায্য করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিত্সুবিশি। মসজিদটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাপান এবং ইসলামী বিশ্বের বিশিষ্টজন ও কূটনীতিকেরা উপস্থিত ছিলেন।

তবে টোকিও ক্যামি সমসাময়িক সময়ে জাপানি সরকার এবং বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানির একই রকম সমর্থন ও সংস্পর্শ পায়নি। তুর্কি সরকার এবং একটি ধর্মীয় সেন্টার ও একটি জাতিগত প্রতিষ্ঠানের অর্থ সহায়তায় মসজিদটি পুনর্নির্মিত হয়। জাতিগত প্রতিষ্ঠানটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিবাহের আয়োজন, ফ্যাশন শো, নাটক, প্রদর্শনী এবং সম্মেলন ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে।

টোকিও জামের কর্ণারের একটি ছোট সরু গলি যার মেঝ মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এবং অভ্যন্তরীণ ভাগ অত্যন্ত সুসজ্জিত এর পাশেই ড. মুসা ওমেরের ইউআই ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। স্কুলটি কোলাহলপূর্ণ এবং অনেক শিশুতে পরিপূর্ণ। এখানে শুধু শনিবার সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। অদূর ভবিষ্যতে স্কুল কর্তৃপক্ষ পুরো সপ্তাহ জুড়ে শিক্ষা প্রদানের কথা ভাবছে। এখানে পড়ানোর বিষয় হচ্ছে ইসলামিক স্টাডিজ, আরবি, কারাতে এবং লিপিবিদ্যা। জাপানের ইসলামিক সেন্টার (আইসিজে) কর্তৃক স্কুলটি পরিচালিত হয়। মুসলিম ইন্সটিটিউশনটি ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।  প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ওমর সৌদি রাষ্ট্রদূতের একজন উপদেষ্টা এবং জাপানে সুদানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে দুবার নিযুক্ত ছিলেন।

ওমরের ছোট্ট অফিসে এক তরুণ যুগলের বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বর একজন সৌদি যুবক এবং কনে হলেন একজন জাপানি নারী। ওমর এই তরুণ যুগলের বিবাহ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়েছেন। স্কুলটির পরিবেশের মতোই বিবাহ অনুষ্ঠানটিও অনানুষ্ঠানিকভাবে হচ্ছে এবং বর ও কনে উভয়ে সাধারন পোশাকে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। নববধূ ইসলামে রূপান্তরিত হচ্ছেন এবং শীঘ্রই বরের সাথে সৌদি আরব চলে যাবেন।

সংক্ষিপ্ত একটি বিরতিতে নারীটিকে জিজ্ঞাসা করা হয় কখন তার ইসলামের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে। জবাবে তিনি বলেন, দুই বছর আগে অনলাইনের মাধ্যমে সৌদি যুবকটির সঙ্গে তার সম্পর্ক হয় এবং তারপর তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওমরের সাথে সৌদি দূতাবাসের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই যুগলের বিবাহ অনুষ্ঠানে সহায়তার ভার পরেছে ওমরের উপর। জাপানি সেই বধূ ইসলাম গ্রহণ করেন।

জাপানে মুসলমানের সংখ্যা কত তার সরকারি কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এই সংখ্যা ৭০,০০০ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার বলে মনে করা হয়। মুসলমানদের ১০ শতাংশই জাপানি বংশোদ্ভূত। জাপানে লোকসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৭০ লাখ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসেবে গত বিশ বছরে জাপানে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০১১ সালে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখের বেশিতে দাঁড়িয়েছে। এসব বিদেশি শ্রমিকের মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক মুসলমানও রয়েছেন। ১৯৬৪ সালে খার্তুমে জাপান-সুদান মৈত্রী সমিতি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭০ সালে জাপানি বৃত্তি নিয়ে স্থাপত্য বিভাগে পড়াশোনার জন্য জাপান এসেছিলেন ওমর। তিনি গর্বের সাথেই বলছিলেন যে কিভাবে জাপানে ইসলাম বিকশিত হয়েছে এবং মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলেছে।

‘১৯৭০ সালে দিকে যখন আমি জাপানে আসি তখন টোকিওতে মসজিদের সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। এখন এখানে ২০০টি মসজিদ ও মুসাল্লা (অস্থায়ী নামাজঘর) আছে।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছেন ওমর। সাবেক কূটনীতিক হিসেবে তিনি বেশ অগ্রাধিকারও পেয়ে থাকেন। উপসাগরীয় অঞ্চলে তার রয়েছে ব্যাপক যোগাযোগ। মসজিদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়তে বিভিন্ন সংগঠনকে তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করেছেন তিনি। তবে ইসলামিক সেন্টার অব জাপারেন নিজস্ব কোনো মসজিদ নেই।

তিনি বলেন, তবে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে কোনো জায়গায় নামাজ পড়া যায়। তবে ঊনিশশত নব্বইয়ের দশক থেকে এই সেন্টারের বাজেট অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছে। এখন একজন মাত্র পূর্ণকালীন কর্মকর্তা দিয়ে এটি পরিচালিত হচ্ছে, আগে যেখানে এই সংখ্যা ছিল ২৫। উপসাগরীয় দেশগুলোর নাগরিকদের ব্যক্তিগত অনুদানে চলছে এটি। অনেক গবেষক বলছেন, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলমানদের সম্পর্কে গৎবাঁধা যে নেতিবাচক ধারণা প্রচার করা হচ্ছে তার প্রভাব পড়েছে জাপানেও। জাপানে মুসলমান ও মসজিদের ওপর পদ্ধতিগতভাবে নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন।

পুলিশ মসজিদে গুপ্তচর নিয়োগ করেছে। লোকজনের বাসাবাড়িতেও নজরদারি করা হচ্ছে। তারা ৭০ হাজার লোকের তথ্য সংগ্রহ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ মসজিদ ও অন্যান্য স্থানে গোয়েন্দা ক্যামেরা স্থাপন করেছে। ওমর বলেন, নাইন ইলেভেনের পর পরিবেশ বুঝতে এবং জাপানে তার ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে লোকজনের সাথে খোলামেলা কথা বলতে এবং ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মের মত জাপানে ইসলামের পদচিহ্ন একই রকমের না হলেও অষ্টম শতাব্দী থেকেই এখানে ইসলামের সন্ধান পাওয়া যায়। মেইজি শাসনামলে (১৮৬৮-১৮৯০) জাপান যখন বিশ্বব্যাপী তাদের উপস্থিতির অংশ হিসেবে ওসমানীয় সাম্রাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য ও তথ্য বিনিময় মিশন শুরু করে তখন থেকেই তারা ইসলামের স্পর্শে আসতে থাকে।

এ সময় থেকেই জাপানে মুসলমানদের প্রবেশের নানা তথ্য মেলে। টোকিও মসজিদ, ওমর, ইসলামিক সেন্টার অব জাপান এবং ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশুরা জাপানে ইসলামের এই প্রাচীন এবং অনুদঘাটিত ইতিহাসেরই অংশ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88