মায়ের মর্যাদা, অলৌকিক ঘটনা (বাচ্চার কথা বলা) ও জুরায়েজের শিক্ষা

আবু হুরাইরা ( রা ) হতে বর্ণিত । তিনি বলেন , আল্লাহর রসূল ( সা ) বলেছেন ঃ এক মহিলা তাঁর ছেলেকে ডাকল । তখন তাঁর ছেলে গির্জায় ছিল । বলল , হে জুরায়েজ ! ছেলে মনে মনে বলল , হে আল্লাহ্‌ ! ( এক দিকে) আমার মা ( এর ডাক ) আর ( অন্য দিকে ) আমার সলাত ! মা আবার ডাকলেন , হে জুরায়েজ ! ছেলে বলল , হে আল্লাহ্‌ ! আমার মা আর আমার সলাত ! মা আবার ডাকলেন , হে জুরায়েজ ! ছেলে বলল , হে আল্লাহ্‌ ! আমার মা ও আমার সলাত । মা বললেন , হে আল্লাহ্‌ ! পতিতাদের সামনে দেখা না হওয়া পর্যন্ত যেন জুরায়েজের মৃত্যু না হয় । এক রাখালিনি যে বকরি চরাত , সে জুরায়েজের গির্জায় আসা যাওয়া করত । সে একটি সন্তান প্রসব করল । তাকে জিজ্ঞেস করা হল – এ সন্তান কার ঔরসজাত ? সে জবাব দিল , জুরায়েজের ঔরসের । জুরায়েজ তাঁর গির্জা হতে নেমে এসে জিজ্ঞেস করলো , কোথায় সে মেয়েটি , যে বলে যে , তার সন্তানটি আমার ? ( সন্তান্সহ মেয়েটি উপস্থিত করা হলে ) জুরায়েজ বলেন , হে বাবুস ! তোমার পিতা কে ? সে বল্ল , বকরীর অমুক রাখাল । [ সহিহ বুখারি , হাদিস নং ১২০৬ ]
২৪৮২ নং হাদিসে আরও আছে যে , মানুষ জুরায়েজের ইবাদাতখানা ভেঙ্গে দিয়ে তাকে বের করে দেয় এবং তাকে গালিগালাজ করে । পরে , জুরায়েজ ওযু করে সলাত আদায় করে বাচ্চা কে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয় । মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পেরে তার ইবাদাতখানা সোনা দিয়ে তৈরি করে দিতে চায় কিন্তু তিনি বলেন , না তোমরা মাটি দিয়েই তৈরি করে দাও ।
এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে , আমরা যদি নফল ইবাদাতে মগ্ন থাকি হওক সেটা সলাত আর আমাদের মা যদি আমাদেরকে ডাকে তাহলে আমাদেরকে ইবাদাত ছেড়ে দিয়ে মায়ের কথা শুনতে হবে । হে আল্লাহ্‌ ! আমাদেরকে মায়ের সাথে উত্তম ব্যাবহার করার তওফিক দান করো । আমীন ।
এক ছেলেকে তার মা বিয়ের কথা বলত। কিন্তু ছেলেটা বিয়ের কথা শুনলে ই ফোন কেটে দিত। যে ই বিয়ের কথা বলত তার সাথে আর কথাই বলত না। ছেলেটা দেশে আসার পর তার মা যথারীতি তাকে বিয়ের কথা বলল। আর ছেলেটা মায়ের সাথে খারাপ ব্যাবহার করল। এক পর্যায়ে বলে ফেলল যে, আপনি মারা গেলে আমি বিয়ে করব। কি নির্মম পরিহাস! সেই ছেলেটা শেষে বেভিচার করল!!!!! এবং সমাজের মানুষকে ধুঁকা দিয়ে সম্মান বাচাতে বিয়ে করল! কিন্তু সেই বিয়ে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যিনা করলে পেটে বাচ্চা আসলে সেই বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত বিয়ে বৈধ নয়। আর সেই বাচ্চা হবে যারজ সন্তান।মায়ের পরিচয়ে বড় হবে। পিতার পরিচয় দিতে পারবে না। সম্পত্তির কোন অংশীদার হবে না। আর এই অবৈধ বিয়ের ফলে বাকী যেসব বাচ্চা হবে সবাইই অবৈধ।
মায়ের সাথে খারাপ ব্যাবহার করার ফল কি হল???/ বিয়ে ছাড়া সংসার করছে!!!!! একদিনের যিনা ঢাকতে গিয়ে দিনের পর দিন যিনাহ করছে!!! অবৈধ সন্তানকে লালন পালন করছে!!!! এ যেন কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা!!!!!!! আমি শুধু একটা কথাই বলব। সাবধান!!!!!!!!!!!!!!!!!!

আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, (বনী ইসরাঈলের মধ্যে) তিন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই দোলনায় কথা বলেনি।

(১) ঈসা ইবনে মারইয়াম।

(২) ছাহেবে জুরাইজ (জুরাইজের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বাচ্চা)।

(৩) ও আরেকটি একটি শিশু

(১) ঈসা ইবনে মারইয়াম।

মারইয়াম (আলাইহি সসালাম)-এর গর্ভে ঈসা (আলাইহিস সালাম) অলৌকিক ভাবে জন্মগ্রহণ করলে লোকজন তার ব্যাপারে সন্দিহান হ’ল।তখন মারইয়াম (আলাইহিস সালাম)-এর ইঙ্গিতে ঈসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর মাতার পক্ষ থেকে জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমি আল্লাহ্‌র দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন ছালাত ও যাকাত আদায় করতে এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি’। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হব’ {মারিয়াম ১৯/২৯-৩৩}।

(২) ছাহেবে জুরাইজ (জুরাইজের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বাচ্চা)।

জুরাইজ একজন আবেদ বান্দা ছিলেন। তিনি নিজের জন্য একটি ইবাদতগৃহ তৈরী করলেন। তিনি সেখানে থাকা অবস্থায় একদিন তার মা সেখানে আসলেন। এ সময় তিনি ছালাতে রত ছিলেন। তার মা বললেন, ‘হে জুরাইজ! তখন তিনি (মনে মনে) বলেন, ‘হে প্রভু! একদিকে আমার ছালাত আর অন্যদিকে আমার মা’।

জুরাইজ ছালাতেই রত থাকলেন। তার মা চলে গেলেন। পরবর্তী দিন তার মা আসলেন । এবারও তিনি ছালাতে মগ্ন ছিলেন। তার মা তাকে ডাকলেন, ‘হে জুরাইজ’! তিনি (মনে মনে) বলেন, ‘হে প্রভু! একদিকে আমার ছালাত আর অন্যদিকে আমার মা’।

তিনি তার ছালাতেই ব্যস্ত থাকলেন। এভাবে তৃতীয় দিনেও জুরাইজ একই কাজ করলে তার মা বললেন, ‘হে আল্লাহ! একে তুমি যেনাকারী নারীর মুখ না দেখা পর্যন্ত মৃত্যু দিও না’। বনী ইসরাঈলের মধ্যে জুরাইজ ও তার ইবাদতের কথা আলোচিত হ’তে লাগল। এক ব্যভিচারী নারী ছিল। সে উল্লেযোগ্য রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারিণী ছিল। সে বলল, তোমরা যদি চাও, আমি তাকে (জুরাইজ) বিভ্রান্ত করতে পারি। সে তাকে ফুসলাতে লাগল, কিন্তু তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। অতঃপর সে তার ইবাদতগাহের কাছাকাছি এলাকায় এক রাখালের কাছে আসল। সে নিজের উপর তাকে অধিকার দিল এবং উভয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’ল। এতে সে গর্ভবতী হ’ল। সে বাচ্চা প্রসব করে বলল, এটা জুরাইজের সন্তান। বনী ইসরাঈল (ক্ষিপ্ত হয়ে) তার কাছে এসে তাকে ইবাদতগাহ থেকে বের করে আনল, তার ইবাদতগাহ ধূলিসাৎ করে দিল এবং তাকে মারধর করতে লাগল। জুরাইজ বললেন, তোমাদের কি হয়েছে? তারা বলল, তুমি এই নষ্টা মহিলার সাথে যেনা করেছ। ফলে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তিনি বললেন, শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটিকে নিয়ে আসল। জুরাইজ বললেন, আমাকে একটু সুযোগ দাও ছালাত আদায় করে নেই। তিনি ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষ করে তিনি শিশুটির কাছে এসে তার পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই শিশু! তোমার পিতা কে’? সে বলল, ‘আমার পিতা অমুক রাখাল’।

উপস্থিত লোকেরা তখন জুরাইজের নিকটে এসে তাকে চুম্বন করতে লাগল এবং তার শরীরে হাত বুলাতে লাগল। আর তারা বলল, এখন আমরা তোমার ইবাদতগাহটি সোনা দিয়ে তেরী করে দিচ্ছি। তিনি বললেন, দরকার নেই, বরং পূর্বের মত মাটি দিয়েই তৈরী করে দাও। অতঃপর তারা তাই করল।

(৩) একটি শিশু যে তার মায়ের দুধ পান করছিল। এমন সময় একটি লোক দ্রুতগামী ও উন্নত মানের একটি পশুতে সওয়ার হয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তার পোষাক-পরিচ্ছদ ছিল উন্নত। শিশুটির মা বলল, ‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেটিকে এই ব্যক্তির মত যোগ্য কর’।

শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে এসে তাকে দেখতে লাগল। অতঃপর বলল, ‘হে আল্লাহ! আমাকে এই ব্যক্তির মত কর না’? অতঃপর ফিরে এসে পুনরায় মায়ের দুধ পান করতে লাগল। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি যেন এখনও দেখছি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিশুটির দুধ পানের চিত্র তুলে ধরছেন এবং নিজের তর্জনী মুখে দিয়ে চুষছেন। তিনি বলেন, লোকেরা একটি বাঁদিকে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছিল। আর বলছিল, তুমি যেনা করেছ এবং চুরি করেছ। মেয়ে লোকটি বলছিল, ‘আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমার উত্তম অভিভাবক’।

শিশুটির মা বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে এই নষ্টা নারীর মত কর না’।

শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল, অতঃপর বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এই নারীর মত কর’।

এ সময় মা ও শিশুটির মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। মা বলল, হায় দুর্ভাগা! একটি সুশ্রী লোক চলে যাওয়ার সময় আমি বললাম,‘হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ যোগ্য করে দাও’। তুমি প্রত্যুত্তরে বললে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে এর মত কর না’।

আবার এই ক্রীতদাসীকে লোকেরা মারধর করতে করতে নিয়ে যাচ্ছে এবং বলছে, তুমি যেনা করেছ এবং চুরি করেছ। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ করোনা। তুমি বললে ,”হে আল্লাহ্‌ আমাকে এরূপ কর ।” শিশুটি এবার জবাব দিল, প্রথম ব্যক্তি ছিল স্বৈরাচারী যালেম। সেজন্যই আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ! আমাকে এ ব্যক্তির মত কর না? আর এই মহিলাটিকে তারা বলল, তুমি যেনা করেছ। প্রকৃতপক্ষে সে যেনা করেনি। তারা বলছিল, তুমি চুরি করেছ। আসলে সে চুরি করেনি। এজন্যই আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ! আমাকে এই মেয়ে লোকটির মত কর’

{বুখারী হা/৩৪৩৬ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৮, হা/২৪৮২ ‘মাযালিম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৫; মুসলিম হা/২৫৫০ ‘সদ্ব্যবহার ও শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২}

হাদীসের শিক্ষা :

১. আল্লাহ্‌র উপর পূর্ণ আস্থা থাকলে কেউ পদস্খলন ঘটাতে পারবে না।

২. কোন হক্বপন্থী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন, তা একদিন সত্যরূপে প্রকাশিত হবেই এবং ষড়যন্ত্রকারীরা লজ্জিত হবে।

৩. আমরা যাকে ভাল মনে করি, প্রকৃতপক্ষে সে ভাল নাও হ’তে পারে। পক্ষান্তরে যাকে খারাপ মনে করি, প্রকৃতপক্ষে সে খারাপ নাও হ’তে পারে।

৪. সর্বদা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হবে।

অনুলিখন: মাকসুদ বিন আমাল

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button