আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর একটি ঘটনা এবং আমাদের জন্যে শিক্ষা

ঘটনাটি উমর ইবনুল খাত্তাব(রা)এর খিলাফতের সময়ে সংঘঠিত হয়েছিল। রোমান সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেয়ে একদল মুসলিম রোমানদের নিকট বন্দী হয়। রোমান সম্রাট জানতে পারলেন এই বন্দীদের মাঝে একজন নবী ﷺ এর সাহাবী রয়েছে। রোমান সম্রাট সাহাবীদের সম্পর্কে অনেক ভালোগুণের কথা শুনতে পেয়েছিলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল একজন সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করার। তাই তিনি বন্দী সাহাবীর সাথে কথা বলতে চাইলেন। রোমান সম্রাট চিন্তা করলেন সাহাবীরা যেহেতু অনেক মহৎ গুণের অধিকারী তাই তিনি সাহাবীটির সাথে তার নিজের মেয়ের বিয়ে দিবেন যাতে করে মহৎ গুণাবলীগুলো বংশধারা তাদের মাঝে বিদ্যমান থাকে। তিনি সাহাবীটিকে তার সামনে নিয়ে আসতে বললেন। সাহাবীটিকে রোমান সম্রাটের নিকট নিয়ে আসা হলো। এই সাহাবীর নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা)।
রোমান সম্রাট মুগ্ধ নয়নে সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) কে দেখলেন। এরপর তিনি আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) কে তার মেয়েকে বিয়ে করতে বললেন তবে একটি শর্ত জুড়ে দিলেন, শর্তটি হলো তাকে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হতে হবে। আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা(রা)রাজী হলেন না। সম্রাট বললেন, ঠিক আছে আমি আপনাকে আমার অর্ধেক সম্রাজ্যের রাজত্বও দিয়ে দিব! আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা  (রা) এবার আরো জোড় গলায় অস্বীকার করলেন কারণ, আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ছেড়ে তিনি করে কুফরীতে লিপ্ত হতে পারেন?

রোমান সম্রাট আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর উত্তর শুনে অপমানিত বোধ করলেন। কারণ, দুনিয়ার মোহে লিপ্ত মানুষেরা যখন দেখে তাদের দুনিয়ার সফলতাকে গুরত্ব দেওয়া হয় না, তখন তারা ভাবে এই কাজগুলো কি তাহলে অর্থহীন? আমার খ্যাতি, আমার বড়ত্ব, আমার সফলতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না তাহলে এগুলো কি মূল্যহীন? তাই তারা ঈমানদার, আল্লাহ ভীরু, আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর আনুগত্যকারীদের দেখলে অপমানিত, রাগান্বিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে শান্তি অনুভব করে, তাদের ক্ষতি করতে পারলে, তাদের কষ্ট দিতে পারলে মনে পুলক অনুভব করে।

আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, একটি সম্রাজ্যের অর্ধেক রাজত্ব আর সম্রাটের মেয়েকে বিয়ে করার অফার কিন্তু মোটেও কোন মামুলী অফার নয়! কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর নিকট এগুলোর কোনটিই কোন গুরুত্ব ছিল না কারণ, ঈমানের মূল্য যে আর কোন কিছুর সাথে তুলনীয় নয়! আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বর্তমান জামানায় নাম মাত্র সম্পদ কিংবা টাকার জন্যে নিজের দ্বীন, ঈমানকে বিকিয়ে দেওয়া কোন ব্যাপারই না। অর্থকরির লোভে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়া, সুদ-ঘুষ, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ কেড়ে নেওয়া। অর্থের লোভে মানুষকে ভুলভাবে ইসলাম শিক্ষা দেওয়া ইত্যকার এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রকৃত ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন, আমীন।

আবার মূল ঘটনায় ফিরে যাই, রোমান সম্রাট অপমানিত, রাগান্বিত হলেন। তিনি একটি বিশেষ পাত্র আনতে বললেন। যে পাত্রটিতে ফুটন্ত গরম তেলের মাঝে মানুষকে ছেড়ে দেওয়া হতো। পাত্রটিকে এতই গরম করা হয়েছিল যে তা থেকে ধোয়া বের হচ্ছিল। এরপর একজন মুসলিমকে এনে এই ফুটন্ত তেলে ফেলে দেওয়া হলো। বর্ণনাকারী বলেন, তেল এতই গরম ছিল যে, ফেলে দেওয়ার সাথে সাথে হাড়গুলো আলাদা হয়ে গিয়েছিল, দেহের মাংসগুলো ভাজা ভাজা হয়ে গিয়েছিল। আর এর সবগুলো সংঘঠিত হচ্ছিল আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর চোখের সামনে। সম্রাট বললেন, আপনি কি এখন ইসলাম ত্যাগ করতে রাজি আছেন? নাহলে আমরা আপনাকেও এর মাঝে নিক্ষেপ করবো, আপনার পরিণতিও এই ব্যক্তিটির মতো হবে। আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা(রা)রাজি হলেন না। সম্রাট তাকে ফুটন্ত তেলের মাঝে ফেলে দিতে আদেশ করলেন। যখন আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো ফুটন্ত তেলের কাছে তখত তিনি কেদে ফেললেন। যারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তারা সম্রাটকে তার কান্নার কথা বললো। সম্রাট বললেন, সে কাদছে তার মানে সে দূর্বল হয়ে গেছে, আমরা সফল হয়েছি, আমরা তার অন্তরে ভয় দেখাতে পেরেছি, সে অবশ্যই এখন ইসলাম ত্যাগ করবে। তিনি আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা(রা)কে তার নিকট নিয়ে আসতে বললেন। সম্রাট বললেন, আপনি কি এখন ইসলাম ত্যাগ করতে প্রস্তুত? আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) বললেন, এটা মনে করবেন না যে আমি মৃত্যু ভয়ে কাদছি। আমি কাদছি কারণ আমার স্মরণ হলো আমার মাত্র একটাই জীবন আর তা এই মুহুর্তে শেষ হয়ে যাবে। যদি আল্লাহ তাআলা আমাকে আরো একশটা জীবন দিতেন তাহলে আমি আরো একশবার আল্লাহর জন্যে শহীদ হতে পারতাম! আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, আমার দেহে যতগুলো পশম রয়েছে যদি ততগুলো জীবন থাকতো তাহলে আমি সেগুলোকে একটার পর একটা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ করে দিতাম!

আল্লাহু আকবার। কি ঈমান তাদের, যা বর্তমান জামানায় আমরা কল্পনাই করতে পারি না। আল্লাহর দ্বীন তো এমনই। আল্লাহর দ্বীন তো শুধু কথার ফুলঝুড়ি নয়, নয় কোন লোক দেখানো, এমন নয় যে শুধু বাহাদুরী করবো আমি বেশী জানি অথচ মানার ক্ষেত্রে শূণ্য। আল্লাহর দ্বীন তো তাই যেখানে রয়েছে ত্যাগ, যেখানে রয়েছে নিজের পছন্দের জিনিসগুলোকে আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে দেওয়া, সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত থাকা। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বিপদে পড়লে, ফিতনায় পতিত হলে একজন মুসলিমের প্রকৃত পরিচয় ফুটে উঠে। তখন বুঝা যায়, সে কতটুকু আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যকারী। আল্লাহ তাআলা আমাদের হিফাজত করুন, প্রকৃত ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।

আবার মূল ঘটনায় ফিরে যাই, রোমান সম্রাট অবাক হয়ে গেলেন আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর জবাব শুনে! তিনি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন, লজ্জিত অনুভব করলেন আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর সামনে। তিনি আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর নিকট কিছুর বিনিময়ে তাকে বন্দী অবস্থা থেকে স্বাধীন করে দেওয়ার কথা চিন্তা করলেন। তিনি আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) কে বললেন, আমি আপনাকে মুক্ত-স্বাধীন করে দিব তবে একটি শর্তে, শর্তটি হলো আপনাকে আমার কপালে একটি চুমু দিতে হবে! আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, আমি আপনার কপালে চুমু দিবো যদি আপনি সকল বন্দীদের মুক্ত-স্বাধীন করে দিন। রোমান সম্রাট বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজী হয়ে গেলেন। আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) রোমান সম্রাটের কপালে চুমু দিলেন এবং সকল বন্দীদের নিয়ে পরদিন মদীনায় ফিরে উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) কে সব ঘটনা খুলে বললেন। উমর (রা) মসজিদে নববীতে যেয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন আর তারপর বললেন, তোমরা সবাই আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফা (রা) এর কপালে একটি করে চুমু দিবে কারণ সে তার মুসলিম ভাইদের জীবন বাঁচিয়েছে, আর আমি নিজেই চুমু দিয়ে শুরু করছি। ঘটানাটি এখানেই শেষ!

আল্লাহ তাআলা আমাদের হিফাজত করুন। প্রকৃত ঈমানের বুঝ আমাদের দান করুন। পার্থিব সম্পদের লোভে আমরা যেন নিজের সর্বোচ্চ সম্পদ ঈমানটুকু বিসর্জন না দেই বরং আল্লাহর জন্যে নিজের সর্বোচ্চটুকু যেন বিলিয়ে দিতে পারি, সে তৌফিক আল্লাহ তাআলা আমাদের দান করুন। আমীন।

-উমর

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan