বিভিন্ন ভাষায় আল-কুরআনের তরজমা ও তফসীর

রচনায়: অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক, ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, দিনাজপুর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

পবিত্র কুরআনের তরজমা ও তফসীর সমগ্র বিশ্বের অপব সম্পদ, মুসলিম জাহানের অনন্য দিশা-ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্যের অদ্বিতীয় মহাসনদ।

বিভ্রান্তিকর চিন্তাধারা, সঠিক মূল্যেবোধের অভাব, ঐশী জ্ঞান প্রচায়ের পথে অসংখ্য বাধা এবং পাপাচার ও স্বার্থ শিকারের ঘণ্য বিলাস যেখানে মানবমুক্তির পথ রুদ্ধ করিয়া দেয়, সুখ ও শান্তির ক্ষীণতম রশিটুকুও বিলীন করিয়া দেয়, সেখানে এই তরজমা ও তফসীরই আনিয়া দিতে পারে মানুষের মুক্তি-সওগাত।

অন্যায় ও অবিচার, হত্যা ও লুঠতরাজ, লাম্পট্য ও ব্যভিচার এবং মিথ্যা ও বাতিলের লেলিহান শিখায় এই ধূলির ধরণী যখন ভস্মসাৎ হওয়ার উপক্রম হয়, তখন এই কুরআনের ভাষ্যই বাতলাইতে পারে মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার অমোঘ বিধান। জুলুম ও পাশবিকতার নিষ্পেষণে একটি সমাজ ও সভ্যতা যখন মত যন্ত্রণায় আর্তনাদ করিয়া উঠে তখন এই পবিত্র কালামের পিযুষ ধারাই তাহাদের নিকট তুলিয়া ধরিতে পারে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও স্বাধিকারের আবে-হায়াত।

এই কারণেই বিশ্বনবীর (সঃ) সোনালী যুগ হইতে শুরু করিয়া গোটা মুসলিম জাহানে এই তরজমা ও তফসীরের যে সাধনা চলিতেছে। তাহাতে কোন বিরাম নাই, কোন ছেদ নাই। তাই তো এই সাধনা মুসলিম মনীষার ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।

তফসীর শাস্ত্রের প্রধান পথিকৃৎ রঈসুল মুফাসসেরীন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) যুগ হইতে আরম্ভ করিয়া এই পর্যন্ত সমগ্র পথিবীতে পবিত্র কুরআনের যে কত তরজমা ও তফসীর সংকলিত হইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। গবেষকগণ তরজমা তো দুরের কথা প্রামাণ্য ও সবিস্তৃত যে তফসীরের সন্ধান দিয়াছেন তাহাতে দেখা যায়, কোন না কোন দিক হইতে একক ও অনন্য বলিয়া পরিগণিত তফসীরের সংখ্যাই প্রায় দেড় হাজার।

মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অসংখ্য মনীষীই পথিবীর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ভাষায় পবিত্র কুরআনের তরজমা ও তফসীর করিয়াছেন।

‘ফ্রেন্স-ইসলাম (প্যারিস/১৯৬৮) নামক পত্রিকায় এরুপ তথ্য দেওয়া হইয়াছে যে, বর্তমানে ১০২টি ভাষায় পবিত্র কুরআনের পূর্ণ বা আংশিক অনবাদ রহিয়াছে। বহু ভাষায় একশতেরও অধিক তরজমা রহিয়াছে।

সন্ধানপ্রাপ্ত সকল তরজমা ও তফসীরের বিবরণ দেওয়া কোন পুস্তিকা বা প্রবন্ধের ক্ষুদ্রতম পরিসরে সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনের এই মহান সেবায় মনীষীগণ যে অমর স্বাক্ষর রাখিয়া গিয়াছেন এবং এখনও রাখিয়া যাইতেছেন, তৎপকে কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়ার জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভাষায় কিছু সংখ্যক তরজমা ও তফসীর সম্পর্কে আলোচনা করা গেলঃ

প্রাচ্য জগতে

আরবী :

আরবী পথিবীর সবপেক্ষা নিখুঁত ও সমৃদ্ধশালী ভাষা। ইহার বৈজ্ঞানিক কাঠামো এবং যে কোন ভাব প্রকাশে ইহার অপার নৈপণ্য ও দুর্বার ক্ষমতা এক পরম বিস্ময়। বিশ্ব মানবতার অদ্বিতীয় মুক্তি-সনদ, সমগ্র বিজ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নীতিবোধের জলন্ত প্রতীক পবিত্র ও মহিমান্বিত কুরআন এই আরবী ভাষায়ই অবতীর্ণ হইয়াছে। মহানবী (সঃ) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও এই ভাষায়ই দান করিয়াছেন। তাঁহার পরবর্তী যুগের মুসলিম মনীষীগণও দীর্ঘকাল ধরিয়া এই ভাষায়ই ইহার চর্চা অব্যাহত রাখেন। এই ভাষায় কয়েকখানি তফসীরের উল্লেখ করা হইতেছে।

১। তফসীরে হযরত ইবনে আব্বাসঃ

তফসীর শাস্ত্রের জনক হযরত ইবনে আব্বাসের কুরআনী ইলম ও দ্বীনী প্রজ্ঞা-বুদ্ধির জন্য বিশ্বনবী (সঃ) আল্লাহর নিকট দোয়া করিয়াছিলেন। তাঁহার অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া সমগ্র মুসলিম জাহান তাহাকে ‘তরজমানুল কুরআন’ উপাধিতে ভূষিত করিয়াছেন। তাহার তফসীরের একখানি প্রামাণ্য সংকরণ মিশরে ছিল বলিয়া ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) উল্লেখ করিয়াছেন। অনেকের মতে ইমাম বুখারী (রঃ) ইহার উপর নির্ভর করিয়াই বুখারী শরীফের ‘কিতাবুত তাফসীর’ লিপিবদ্ধ করেন।

আবু তাহের মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব ফিরোজাবাদী হযরত ইবনে আব্বাসের তফসীরের প্রামাণ্য সংস্করণটি সম্পাদিত করিয়া নাম দিয়াছেন ‘তানবীরুল মিকইয়াস মিন তফসীরে ইবনে আব্বাস’। ইহা সংক্ষিপ্ত হইলেও বিশ্বস্ততা ও প্রামাণ্যতার দিক হইতে ইহার স্থান সকল তফসীরের উর্ধ্বে। বড় সাইজে ইহার পৃষ্ঠা সংখ্যা চারিশত।

২। তফসীরে তাবারীঃ

ইহার পূর্ণ নাম ‘জামিউল বায়ান আন তাবীলিল কুরআন’। লেখকের পূর্ণ নাম আবু জাফর ইবনে জারীর তাবারী (২২৪৩১০ হিঃ)। তফসীরে ইবনে আব্বাসের পর বর্তমান তফসীর জগতের ইহাই হইতেছে সবপ্রধান উৎস। মনীষীদের দৃষ্টিতে ইহার কোন তুলনা পৃথিবীতে নাই।

ইহাতে যেমন সকল কেরাআত উল্লেখ করা হইয়াছে, তেমনি সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনদের তফসীর সংক্রান্ত সকল ভাষ্যই সন্নিবেশিত করিয়া প্রামান্য ও সামঞ্জস্য বিধান করা হইয়াছে। | ১৩২২-১৩৩০ হিজরীর মধ্যে মিশরের বাউলক প্রেস হইতে ইহা ৩০ খণ্ডে মদ্রিত হইয়া প্রকাশিত হয়। মাহমদ শাকের ও আহমদ মুহাম্মাদ শাকেরের সম্পাদিত একটি আধুনিক সংস্করণ মিশরের দারল মা’আরেফ হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।

৩। তফসীরে ইবনে কাছীরঃ

ইহার পূর্ণ নাম ‘তফসীরল করআনিল আযীম’। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার অন্যতম শিষ্য হাফেজ ইমামুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে উমর ইবনে কাছীর আল-কুরায়শী (৭০৫-৭৭৪ হিঃ) ইহা রচনা করেন।

সমগ্র মুসলিম জাহানে ইহা প্রামাণ্য তফসীর বলিয়া অভিহিত। ইহাতে সমস্ত সাহাবা ও তাবেঈনদের রেওয়ায়েত উল্লেখ করার সংগে সংগে বিশুদ্ধ সনদের প্রতিও লক্ষ্য রাখা হইয়াছে। বিভিন্ন মজহাব সম্পকিত আলোচনাও বিস্তৃতরুপে করা হহয়াছে। ইহার ভাষা এত সহজ যে মোটামুটি যাহার আরবী জানা আছে, তিনিও ইহা হইতে জ্ঞান আহরণ করিতে পারেন।

ইহা ১৩০২ হিজরীতে ‘তফসীরে ফাতহুল বায়ানের’ সহিত এবং অতঃপর ‘তফসীরে মাআলিমত তানযীলের’ সহিত মদ্রিত হয়। ১৩ ৫৬ হিজরীতে ইহা পথকভাবে ছাপা হইয়। প্রকাশিত হয়।

৪। তফসীরে বায়যাবীঃ

ইহার পূর্ণ নাম ‘‌আনওয়ারুল তানযীল ওয়া আসরারুত তাবিল। ইহার লেখক আল্লামা নাসিরুদ-দীন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ইবনে উমর আল-বায়যাবী (মত্যু, ৭১১ হিঃ)।

মুসলিম জাহানে ইহা অত্যধিক প্রসিদ্ধ। সকল মাদ্রাসায়ই ইহা পাঠ্য তালিকাভূক্ত। এই তফসীরে মু’তাজিলা মতবাদের অসারতা প্রমাণ করার প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে। ইহা দিল্লীতে ১২৭১ হিঃ, লক্ষ্ণৌতে ১২৭৭ হিঃ, বোম্বাইতে ১২৮১ হিঃ, জার্মানীতে ১৮৭৮ খ্রীঃ এবং মিশরে বিভিন্ন সময়ে মুদ্রিত হইয়াছে।

৫। তফসীরে কবীরঃ

ইহার আসল নাম ‘মাফাতিহুল গায়ব’। ইহার লেখক আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ওমর ইবনে হসাইন (৫৪৪-৬০৬ হিঃ)। তিনি ফখরদ্দীন রাজী নামে অধিক পরিচিত। তিনি এই তফসীর সম্পূর্ণ করিতে পারেন নাই। তাহার ইন্তেকালের পর তাঁহার শিষ্য দামেস্কর প্রধান কাজী শামসুদ্দীন আহমদ ইবনে খলীল ইহার কাজ সম্পূর্ণ করেন। এই তফসীরে যুক্তি-তর্ক, দর্শন প্রভৃতির সাহায্যে আল কুরআনের বক্তব্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে। মু’তাজিলার ন্যায় তৎকালীন বাতিল চিন্তাধারার মূলেও কুঠারাঘাত করা হইয়াছে। প্রশ্ন-উত্তর ও মাসায়েল আকারে ইহার বক্তব্যকে সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া তোলা হইয়াছে।

এই বিরাট তফসীরখানি ১২৮৯ হিজরীতে মিশর হইতে ৬ খণ্ডে মুদ্রিত হয় এবং পরে ১৩৩৮ হিজরীতে ‘তফসীরে ‌আবুস সাউদ’সহ ৮ খন্ডে মুদ্রিত হয়।

৬। তফসীরে কাশশাফঃ

ইহার প্রকৃত নাম ‘আল-কাশশাফ অনি হাকাইকিত তানযীল’। লেখকের নাম মাহমুদ ইবনে ওমর যমখশারী (৪৫৭-৫৩৮ হিঃ)। তিনি ‘জারুল্লাহ’ নামে অধিক পরিচিত।

এই ফসীরে পবিত্র কুরআনের বাচনভংগী, রচনা, বিন্যাস ও অলংকারের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার সংগে সংগে অতি-দীর্ঘতা, মিথ্যা ইসরাঈলী রেওয়ায়েতের অনুপ্রবেশ এবং দুর্বল বর্ণনাকে পরিহার করা হইয়াছে।

ইহা ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা হইতে মুদ্রিত হয় এবং ১২৮৩ ও ১৩৬৭ হিজরীতে মিশর হইতে মুদ্রিত হয়।

৭। আহকামুল কুরআন :

লেখক আহমদ ইবনে আল রাজী। ইনি আবু বকর জাসসাস নামেই অধিক প্রসিদ্ধ। ইনি হানাফী মাজহাবের অন্যতম ইমাম। সূরার ক্রমিকতা ঠিক রাখিয়া ইনি ইসলামী আইন তথা ফেকহ সংক্রান্ত আয়াতসমূহের তফসীর করছেন। এই পর্যায়ে এই তফসীরুখানিই সর্বাধিক প্রামাণ্য ও শ্রেষ্ঠ তফসীর হিসাবে পরিগণিত।

ইহ তিন খন্ডে সমাপ্ত। পৃষ্ঠা সংখ্যা মোট ১৮৫১। প্রতি খণ্ডের শেষ ভাগে সূচীপত্র দেওয়া হয়েছে। ১৩৪৭ হিজরীতেও ইহা মিশর হইতে মুদ্রিত হইয়াছে।

৮। আহকামুল কুরআন :

লেখক আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আরাবী (জন্ম ৪৬৮ হিঃ)। তিনি পবিত্র কুরআনের তাফসীরের সংগে সংগে মালেকী মযহাব অনুসারে ফেকহ সংক্রান্ত আয়াতসমূহের বিশ্লেষণ করিয়াছেন।

ইহার বর্তমান সংস্করণটি ৪ খন্ডে সমাপ্ত। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১২৪। মিশরের প্রখ্যাত আলেম আলী মুহাম্মাদ ইহার সম্পাদনা করিয়াছেন।

৯। আত তফসীরাতুল আহমদিয়া :

ইহার পূর্ণ নাম ‘আত্‌তফসীরাতুল আহমদিয়া ফী জায়াতিশ শারইয়া’। লেখক বাদশাহ আওরঙ্গজেবের উস্তাদ হঘরত শায়খ আহমদ মোল্লা জিউন (মৃত্যু, ১১৩০ হিঃ)।

লেখক পবিত্র কুরআনের শুধু আইন সংক্রান্ত আয়াতসমূহের বিস্তৃত বিশ্লেষণ করিয়াছেন। আর এ পর্যায়ে তিনি হানাফী মজহাবের পক্ষেই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন।

তরজমা ও তফসীর | ইহা বোহ্মাই হইতে ১৩২৭ হিজরীতে প্রকাশিত হয়। কলিকাতা হইতেও ইহা মুদ্রিত হয়।

১০। তফসীরে কুরতুবী:

ইহার পূর্ণ নাম ‘আল-জামি-লি-আহকামিল কুরআন’। ইহার লেখক আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আনসারী কুরতুবী (মত্যু। ৬৭১ হিঃ)।

পবিত্র কুরআনে যে বহুমুখী ইলম রহিয়াছে এই তফসীরে তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখা হইয়াছে। ঐতিহাসিক ঘটনা, আইন-কানুন, দর্শন, হেকমত, কেরাআত, এ‘রাব, নাসেখ-মানসুখ প্রভৃতি বহু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপিত হওয়ায় ইহা তফসীর জগতে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।

মিশরের দারল কুতুব হইতে ইহা ২০ খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে। ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে ইহার তৃতীয় সংস্করণও প্রকাশিত হইয়াছে।

১১। তফসীরে রুহুল মাআনী :

ইহার পূর্ণ নাম ‘রুহুল মা’আনী ফী তফসীরিল কুরআনিল আযীম ওয়াস সাবয়ীল মাছানী’। আল্লামা আবুস সানা শাহাবুদ্দীন মাহমুদ আলূসী বাগদাদী (১২১৭-১২৭০) ইহা রচনা করেন।

আল্লামা আলূসী পবিত্র কুরআনের ৩০ পারার তফসীর ৩০ খণ্ডে সমাপ্ত করেন। বড় বড় ১০ খণ্ডে ইহা প্রকাশিত হয়। সম্ভবতঃ শেষ সংস্করণটি দামেস্কের ইদারাতত তাবাআতুল মুনীরিরা হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।

১২। তফসীরুল মানার :

আল্লামা সাইয়েদ রশীদ রেজা (মৃত্যু ১৯৩৫ খ্রীঃ) তদ্বীয় উস্তাদ হযরত আল্লামা মুফতী আবদুহুর (১৮৪৯-১৯০৫ খ্রীঃ) বিভিন্ন ভাষণ ও দরসে কুরআন হইতে উপকরণ লইয়া ইহা প্রণয়ন করেন।

লেখক বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত ও যুক্তি-তর্ক দ্বারা বিশ্ব মানবতার চিরন্তন মুক্তি সনদরুপে পবিত্র কুরআনকে কালজয়ী হেদায়াত গ্রহ হিসাবে প্রতিপন্ন করিয়াছেন। বস্তুতঃ এই তফসীরখানি ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের এক মহা শক্তিশালী সোপান। আধুনিক কালের সকল সমস্যা ও নবতর জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী জীবন পদ্ধতি যে বৈজ্ঞানিক চিত্র ইহাতে তুলিয়া ধরা হইয়াছে তাহার কোন তুলনা নাই।

দুঃখের বিষয়, তাফসীরখানি সম্পূর্ণ হইতে পারে নাই। সরা ইউসুফ পর্যন্ত লেখা হইয়াছিল মাত্র।

ইহার এক সংস্করণ ১২ খণ্ডে মিশরের ‘মাতবাউল মানার’ হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।

১৩। তফসীরুল জাওয়াহের :

ইহা তফসীরে তানতাভী নামেও পরিচিত। ইহার প্রকৃত নাম ‘আত্‌তাজুল মুরাসসা বেজাওয়াহিরিল কুরআন’। ইহার লেখক আল্লামা শায়খ তানতাভী জওহরী (মৃঃ ১২৭৮ হিঃ)।

এই তফসীরে সাধারণ বিষয়বস্তুকে সংক্ষেপে এবং আধুনিক যুগের সহিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি সমধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে লেখক মানুষ উদ্ভিদ প্রভৃতির যে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহা প্রয়োজনাতিরিক্ত হইলেও বিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামদের জন্য অত্যন্ত উপকারী বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে।

ইহা কায়রো হইতে ১৩২৪ হিজরীতে প্রকাশিত হয়। ইহার দ্বিতীয় সংস্করণ মিসরের ‘মুস্তাফা আল-বাবী’ হইতে ১৩৫০ হিজরীতে প্রকাশিত হইয়াছে।

১৪। ফী যিলালিল কুরআন :

ইহার রচয়িতা হইতেছেন বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ শহীদে ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ কুতুব (১৯০৩-১৯৬৬ খ্রীঃ)। ১৯৫৫ হইতে ১৯৬৫ খীষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বৎসর কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি তিন খণ্ডে এই তফসীর সমাপ্ত করেন।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রতি অহিবান জানানই হইতেছে ইহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইহার প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি বাক্যই যেন ইসলাম ও ঈমানের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি। আধুনিকতাবাদ, দুর্বল সিদ্ধান্ত বা কল্পিত ত্রুটি থাকার ভীরু প্রয়াস এই তফসীরকে কোথাও কলংকিত করে নাই। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার মলে কুঠারাঘাত করিয়া এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান সুপ্রতিঠিত করার আপোষহীন সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার বলিষ্ঠ প্রেরণা রহিয়াছে ইহার ছত্রে ছত্রে ও পাতায় পাতায়। বস্তুতঃ পবিত্র কুরআনের মৌল আহবানকেই তিনি যেন নতুন করিয়া বিশ্ববাসীর নিকট তুলিয়া ধরিয়াছেন। ইহার বর্ণনা ভংগী, বিন্যাস-পদ্ধতি ও দৃষ্টিকোণ অন্যান্য সকল তফসীর হইতেই সম্পূর্ণ রুপে স্বতন্ত্র। এই পর্যায়ে লেখক কাহাকেও অনুসরণ করেন নাই।

ইহার তৃতীয় সংস্করণ বৈরুতের মাকতাবা এহইয়াউত তারাছ হইতে ৮ খন্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

১৫। তফসীর মাআলিমুত তানযীল :

ইহার লেখক আবু মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনে মাসউদ আল-ফাররা মহিউসসুন্নাহ আল-বাগাভী (মত, ৫১৬ হিঃ)। ইহা একবার বোম্বাই শহরে মুদ্রিত হয়। অতঃপর মিশরে ইবনে কাছীর সহ এবং তফসীরে খাজেনের সংঙ্গে মুদ্রিত হয়।

১৬। মাদারেকুত তানযীল ওয়া হাকায়েকে তা’বীল :

ইহা তফসীরে নাসাফী নামে পরিচিত। আবুল বারাকাত আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ নাসাফী (মত ৭১০ হিঃ) কর্তৃক লিখিত এই তফসীরখানি ১২৭৯ হিজরীতে বোম্বাই হইতে দুই খণ্ডে মুদ্রিত হয়। মিশরে ইহা পৃথক ও যুক্তভাবে কয়েকবার মুদ্রিত হয়।

১৭। মাজমুআতুত তাফসীর :

ইহার লেখক অন্যতম বিশ্ববরেণ্য ইমাম শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ)। জীবনের শেষ ভাগে দামেস্কের কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি এই অমুল্য তফসীরখানি রচনা করেন। ইহাতে ছয়টি সুরার তফসীর রহিয়াছে। ইহা সউদী আরব সরকারের অর্থানুকুল্যে ১৩৭৪ হিজরীতে বোম্বাই নগরের কিউ প্রেস হইতে আবদুস সামাদ শরফুদ্দীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

ইহা ছাড়া ইমাম সাহেবের রচিত সুরা এখলাছ এবং অন্যান্য কয়েকটি সুরা ও বহু আয়াতের জ্ঞানগর্ভ তফসীরও প্রকাশিত হইয়াছে।

১৮। তফসীরে খাজেন :

ইহার আসল নাম ‘লুবাবুত তাবীল ফী মা’আনিত তানযীল’। ইহার লেখক সুফী আলাউদ্দীন আলী ইবনে মুহাম্মদ বাগদাদী আল-খাজেন (৬৭৮-৭১৪ হিঃ)। ইহা ‘মা আলিমুত তানযীলের সহিত ৭ খণ্ডে এবং ‘মাদারিকুত তানযীলের’ সহিত ৪ খণ্ডে মিশর হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।

১৯। আত তফসীরুল কাইয়েম :

ইমাম ইবনে তাইমিয়ার প্রধান শিষ্য হাফেজ ইবনে কাইয়েম (৬৯১-৭৫১ হিঃ) বিভিন্ন গ্রন্থ হইতে তফসীর সংক্রান্ত বিষয়গুলি একত্র করিয়া এই নামে গ্রন্থ সংকলিত করেন। পবিত্র মক্কায় বসবাসকারী দিল্লীর বিখ্যাত ব্যবসায়ী শায়খ আবদুল ওহাবের অর্থে ইহা সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে।

২০। তফসীরে জালালাইন :

জালালুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ মাহেলী (৭১১-৮৬৪ হিঃ) সুরা কাহাফ হইতে শেষ পর্যন্ত তফসীর লিখিয়া এন্তেকাল করেন। অতঃপর জালালীন সুয়ুতী (৮৪৯-৯১১ হিঃ) ইহার অবশিষ্ট অংশ সমাপ্ত করেন। এজন্য ইহাকে তফসীরে জালালাইন (দুই জালালের তফসীর) নামে অবহিত করা হয়। সংক্ষিপ্ত অথচ নির্ভরযোগ্য বলিয়া মুসলিম জাহানের সকল মাদ্রসায় ইহা পাঠ্য তালিকাভুক্ত রহিয়াছে।

মিশর, তুরস্ক, ভারত ও পাকিস্তান হইতে ইহা বহুবার মুদ্রিত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে।

২১। আল-বাহরুল মুহীত :

ইহার লেখক মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ আদালসী (৬৪৫-৭৪৫ হিঃ)। ইহা মিশর হইতে ১৩২৮ হিজরীতে ৮ খণ্ডে মুদ্রিত হয়।

২২। জামেউল বায়ান তফসীরুল কুরআন :

ইহার লেখক আল্লামা মইনুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আস-সাফাবী (৮৩২-৯০৫ হিঃ)। ইহা ১৮৭৯ খীষ্টাব্দে লাহোর হইতে এবং ১২৯৬ হিজরীতে দিল্লী হইতে মুদ্রিত হইয়া প্রকাশিত হয়।

২৩। তফসীরে সওয়াতুল ইলহাম :

ইহা ‘তফসীরে বেন্নুকাত’ নামেও পরিচিত। সম্রাট আকবরের বন্ধু শায়খ ফয়জুল্লাহ ওরফে ফৈজী ইবনে মোবারক (৯৫৪-১০০৪হিঃ) কেবল নুকতাবিহীন অক্ষর দ্বারাই এই তফসীর রচনা করেন। ইহা সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য কীতি। ১৩০৬ হিজরীতে ইহা লক্ষে হইতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়।

২৪। তফসীরে ফাতহুল বায়ানঃ

ইহার লেখক ভূপালের নবাব আল্লামা সাইয়েদ সিদ্দীক হাসান খান (১২৪৮-১৩০৭ হিঃ)। ইহার অধিকাংশই ইমাম শওকানীর ফাতহুল বায়ান হইতে গৃহীত। ইহা মিশর হহতে ১৩০০ হিজরীতে তফসীরে ইবনে কাছীরসহ ১০ খন্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

ইহা ছাড়াও আরবী ভাষায় পবিত্র কুরআনের অসংখ্য তফসীর রহিয়াছে। উহাদের বহু সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে এবং হইতেছে। প্রাচীন তফসীরগুলির মধ্যে অনেকগলির ফটোকপি কায়রোস্থ কুতুবখানায় এবং পাকিস্তানের ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।

ফারসী

ফারসী ভাষায় যতগুলি তফসীর ও অনুবাদ পাওয়া যায়, তার মধ্যে ২০টিই রচিত হইয়াছে ১৫শ শতকের আগে। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট অনবাদ হইতেছে তফসীরে তাবারীর ফারসী তরজমা। ইহাতে পবিত্র কুরআনের ফারসী অনুবাদ করেন হযরত শায়খ সা’দী শিরাজী (মত্যু, ৬৯১ হিঃ)।

অতঃপর যাঁহারা অনুবাদ করেন তন্মধ্যে নেয়ামতুল্লাহ তেহরানী, মীর্জা খলীল ইস্পাহানী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, কাজী সানাউল্ল্যাহ পানিপথী, শামসুদ্দীন আবু আহমদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

দিল্লীর ফারুকী প্রেস ১৩১৫ হিজরীতে ‘কুরআন মজীদ তরজমাতুছ ছালাছাহ,’ নামে ফারসী ও উর্দু তরজমা সম্বলিত কুরআন মজীদ প্রকাশ করে। ইহাতে কুরআন মজীদের মূল মতন-এর নীচে দ্বিতীয় ছত্রে ফারসী তরজমা, তৃতীয় ছত্রে উর্দু শাব্দিক তরজমা এবং চতুর্থ ছত্রে উর্দু চলতি ভাষায় তরজমা দেওয়া হয়। এই ফারসী তরজমা ছিল হযরত শাহ রফীউদ্দীনের। এই অনুবাদ গ্রন্থের হাশিয়ায় উর্দু ও ফারসী ভাষায় পবিত্র করআনের বিশ্লেষণমূলক টীকাও দেওয়া হইয়াছে।

জয়নুল আবেদীন রাহনুমার তরজমা রাণী ফারাদিবার সাহায্যে ১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হইয়াছে।

উর্দু

উর্দু ভাষায় পবিত্র কুরআনের অসংখ্য তরজমা ও তফসীর পূর্ণ ও আংশিক উভয় রুপেই প্রকাশিত হইয়াছে। অনেক গ্রন্থের রচয়িতার নাম, রচনাকাল ও প্রকাশ সময় জানা যায় নাই। এতদসত্ত্বেও গবেষকগণ এই ভাষায় ৬২৩ খানি তরজমা ও তফসীরের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। এখানে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কয়েকখানির কথা আলোচনা করা গেল :

১। তফসীরে হক্কানী :

ইহার আসল নাম ‘ফাতহুল মান্নান। তফসীরে হক্কানী নামেই ইহা প্রসিদ্ধ। ইহার লেখক হযরত মওলানা আবদুল হক হক্কানী। উর্দু ভাষায় ইহা প্রথম শ্রেণীর একখানি মুল্যবান তফসীর।

পূর্ববর্তী শতকের প্রথম ভাগে একদিকে খ্রীষ্টানরা ভারতীয় মুসলমানদিগকে ধর্মচ্যুত করার উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারাভিযান শুরু করে এবং অন্যদিকে বিজ্ঞানের উন্নতিতে বিস্মিত হইয়া কেহ কেহ এরুপ ধারণা পোষণ করিতে থাকে যে, কুরআনের বহু কথাই বিজ্ঞানের বিপরীত বিধায় উহাকে শাশ্বত সত্য ও আল্লাহর কালাম হিসাবে গ্রহণ করা যায় না। এই মারাত্মক পরিস্থিতিতে হযরত হক্কানী সাহেব তাঁহার সমগ্র তফসীরে খ্রীষ্টানদের বাতিল চিন্তাধারার মূলে কুঠারাঘাত করেন। এবং প্রমাণ করেন যে, কুরআনের কোন শিক্ষাই বিজ্ঞানের বিপরীত নহে। এবং বিজ্ঞানের সব কথাই যে অভ্রান্ত নহে খোদ বিজ্ঞানই তাহার সাক্ষ্য দিতেছে।

লেখক এই তফসীরের দীর্ঘ ভূমিকায় ইসলামের মৌল চিন্তাধারার বিশ্লেষণ করিয়াছেন, উৎকট আধুনিকতাবাদের প্রতিবাদ করিয়াছেন এবং পবিত্র কুরআন বুঝার জন্য প্রয়োজনীয় ইলম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন।

উর্দু তফসীর জগতে ইহা এতদূর জনপ্রিয় যে, মাঝারী সাইজের ৮ খণ্ডে এই তফসীর সমাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ইহার একাদশ সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে।

২। বায়ানুল কুরআন :

ইহার লেখক হাকীমুল উম্মত হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানবী (মুত্যু, ১৩৬২ হিঃ)। তিনি এই তরজমা ও তফসীর তাঁর ভক্তগণের অনুরোধে এবং যুগের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণয়ন করেন। কিন্তু তিনি শব্দের আভিধানিক বিশ্লেষণ, বালাগাত-ফাছাহাতের মর্ম উদ্ধার এবং তাসাউফ ও মা’রেফাতের রহস্য উন্মোচন করিয়া তফসীরখানিকে অভিনব করিয়া তলিয়াছেন।

ইহা বহুবার প্রকাশিত হইয়াছে। পূর্ণ তফসীর ১২ খণ্ডে সমাপ্ত। প্রকাশকগণ ইহা বিভিন্ন সংখ্যক ভলিউমে প্রকাশ করিয়াছেন।

৩। তরজমানুল কুরআন :

ইহার লেখক মওলানা আবুল কালাম আযাদ (১৮৭০-১৯৫৮ খীঃ)। এই তফসীরে তিনি সাধারণের বোধগম্য সহজ অনুবাদ, মধ্যম শ্রেণীর মেধাবীদের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ এবং আলেম ও জ্ঞানীদের জন্য সমসাময়িক যুগের সমস্যা ও চিন্তাধারার প্রেক্ষিতে বিস্তৃত তফসীর পরিবেশন করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু কার্যতঃ তিনি এই ইচ্ছা পূর্ণ করিতে পারেন নাই। তাহার জীবদ্দশায় সূরা ‘মোমেনুন’ পর্যন্ত তরজমানুল কুরআনের মাত্র ২ খণ্ড প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহার হাশিয়ায় শুধু অতি সংক্ষিপ্ত টীকা রহিয়াছে। তাঁহার প্রকৃত তফসীর শুধু সুরা ফাতেহার তাফসীর। “উম্মুল কিতাব’ নামে ইহা পৃথকভাবেও প্রকাশিত হইয়াছে। সম্ভবতঃ মৃত্যুর পরে তফসীর শেষ হইবে না বুঝিতে পারিয়া লেখক দ্বিতীয় খণ্ডের এক একটি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ৩০-৩২ পৃষ্ঠা ব্যাপীয়াও তফসীর লিখিয়াছেন।

লেখকের মৃত্যুর পর ‘বাকিয়াতে তরজমানুল কুরআন’ এবং তরজমানুল কুরআন ৩য় খণ্ড প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা প্রকৃতপক্ষে লেখকের বিভিন্ন পুস্তকের তফসীরগত আলোচনার সমষ্টি মাত্র। ভারতের বিভিন্ন প্রকাশক ইহা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ করিয়াছেন।

৪। তফসীরে মাজেদী :

ইহার লেখক মওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী। তিনি এই তফসীরে কুরআন মজীদের আয়াতের উপর সংক্ষিপ্ত টীকা সন্নিবেশিত করিয়াছেন। এই পর্যায়ে তিনি প্রামাণ্য তফসীরের গ্রন্থসমূহ থেকে সংক্ষেপে অতি প্রয়োজনীয় অংশসমই বিচক্ষণতার সাহিত্য উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি পাশ্চাত্য সমাজ ও সভ্যতার বিভ্রন্তিকর চিন্তাধারা এবং তথাকথিত প্রাচ্যবিদদের (Orientalists) দুরভিসন্ধিমূলক প্রশ্নাবলীর অকাট্য জবাব দান করিয়াছেন। ইহা ছাড়া তাসাউফ পর্যায়ে তিনি হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানবীর (রঃ) অনুসরণ করিয়াছেন।

এক কথায় বলা চলে, সংক্ষিপ্ত আকারে এই তফসীরখানি অত্যন্ত যুগোপযোগী, তাহাতে সন্দেহ নাই।

তাজ কোপানী প্রথমতঃ এক এক পার করিয়া এই তফসীর প্রকাশ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ণ তফসীর দুই খন্ডে প্রকাশ করে।

৫। মজমুয়ায়ে তাফসীরে ফারাহী :

ইহার লেখক মওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহী। ইহা বিভিন্ন সূরার তফসীরের সমষ্টি। লেখক ‘বিসমিল্লাহ’ এবং ১৪টি সূরার তফসীর আরবীতে লিখিয়াছিলেন। প্রখ্যাত আলেম মওলানা আমীন আহসান ইসলাহী উর্দু ভাষায় ইহার অনুবাদ করেন। তফসীরখানি অত্যন্ত তথ্যবহুল ও দার্শনিক

যুক্তিতর্কে ভরপুর। আয়াতের বিন্যাস ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে বলিয়া ইহার নামকরণ করা হইয়াছে ‘নেজামুল কুরআন’।

তফসীরখানি পূর্ণাংগ হইলে সমগ্র ইসলামী সাহিত্যে যে ইহা এক উল্লেখযোগ্য স্থান লাভ করিত তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।

৬। তাফহীমুল কুরআন :

ইহার লেখক বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী।

এই তফসীরখানি লেখকের আজীবন সাধনার ফল। প্রথমতঃ ইহা ধারাবাহিকভাবে মাসিক তরজমানুল কুরআনে প্রকাশিত হয় এবং পরে ইহা খণ্ডে খণ্ডে বিভিন্ন প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

লেখক প্রথমে নব্য শিক্ষিত লোকদিগকে যুগ-জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত সহজ ভাষায় পবিত্র কুরআনের মূল বক্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করার জন্যই এই তফসীর শুরু করেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে পাঠক মহলের সহস্র জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে ইহার কলেবরকে এমন ভাবে বৃদ্ধি করিতে হয় যে, ইহা এখন একখানি বিস্তৃত ও পূর্ণাংগ তফসীরে পরিণত হইয়াছে। ইহার বৈশিষ্ট্য নিম্নরুপঃ

(ক) পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ সাধারণের বোধগম্য ভাষায় এমনভাবে উপস্থাপিত করা হইয়াছে যে, পাঠক ইহা সহজেই উপলব্দি করিতে পারে যে, ইহা সত্যই আল্লাহর কালাম।

(খ) এই সত্যের প্রতি আলোকপাত করা হইয়াছে যে, কুরআনের শিক্ষা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত শুধু যে অনুসরণ উপযোগী তাহাই নয়, বরং ইহা ব্যক্তি হইতে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্যই একটি পূর্ণাংগ ও সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনপদ্ধতি মানুষের নিকট তুলিয়া ধরে।

(গ) পবিত্র কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাবের শিক্ষাকে তুলনামূলকভাবে আলোচনা করিয়া পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের কোথায় কোথায় বিকৃতি ও পরিবর্তন করা হইয়াছে, তাহা দেখাইয়া দেওয়া হইয়াছে।

(ঘ) পবিত্র কুরআনের ঐতিহাসিক ঘটনা, স্থান ও সংশ্লিষ্ট জাতির কাহিনীকে প্রামাণ্য ইতিহাস এবং নক্সা ও মানচিত্রের সাহায্যে সুন্দর ভাবে বুঝান হইয়াছে। মুসলিম জাহানের সাহিত্য জগতে বোধ হয় এই সর্বপ্রথম প্রাচীন ও আধুনিক তথ্যের সাহায্যে প্রাচীন ইতিবৃত্তকে উদ্ধার করা হইল।

এই তফসীরে পবিত্র কুরআনের মতনের নীচে প্রথমে এমন প্রাঞ্জল ভাষায় ভাবার্থ দেওয়া হইয়াছে যে, ইচ্ছা করিলে যে কেহ উহাকে পথকভাবে অধ্যয়ন করিয়াও করআনের মোটামটি মর্ম উপলব্ধি করিতে পারে। এই ভাবানুবাদের নীচে তফসীরযুক্ত টাকা দেওয়া হইয়াছে। প্রতি খণ্ডের শেষ ভাগে করআনের বিষয়বস্তুর (পৃষ্ঠা উল্লেখসহ) নির্ঘণ্টও দেওয়া হইয়াছে।

ইহা ছাড়া উর্দু ভাষায় যত তরজমা ও তফসীর রহিয়াছে তন্মধ্যে (১) শাহ রফীউদ্দীন, (২) শাহ আবদুল কাদের, (৩) মওলানা আহমদ আলী লাহোরী, (৪) মওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী, (৫) মওলানা আশেক এলাহী মিরাটি, (৬) মওলানা শায়খুল হিন্দ, (৭) মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী, (৮) শামসুল উলামা নযীর আহমদ প্রমুখের লিখিত তরজমা ও তফসীর সমধিক উল্লেখযোগ্য।

বাংলাঃ

বাংলা ভাষায়ও পবিত্র কুরআনের পূর্ণ ও আংশিকভাবে বহু তরজমা ও তফসীর এখন দুষ্প্রাপ্য হইয়া পড়িয়াছে। নিম্নে কয়েকখানি উল্লেখযোগ্য তফসীরের কথা আলোচনা কর গেলঃ

১। তরজমা আম ছেপারা বাঙ্গালা :

বাংলায় কুরআন মজীদের ইহাই প্রথম অনুবাদ। ইহা একখানি পুথিঁ। ইহার লেখক গোলাম আকবর আলী। ইহা ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

২। কোরআন শরীফ (অনুবাদ):

ইহার লেখক ব্রাহ্ম পন্ডিত ‘ভাই’ গিরীশ চন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০ খৃঃ)। দীর্ঘ ৩ খণ্ডে এই অনুবাদ প্রকাশ করিতে তাহার পাঁচ বৎসর (১৮৮১-১৮৮৬ খৃঃ) অতিবাহিত হয়। ইহার ৪থ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে।

৩। বঙ্গানুবাদিত কোরআন শরীফ :

ইহার লেখক করটিয়ার মৌলবী মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন (১৮৩২-১৯১৬ খ্রীঃ) আমপারাসহ তিনি মোট ২৪ পারা অনুবাদ করেন। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে ইহার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়।

৪। কোরআনের অনুবাদ :

অনুবাদক চব্বিশ পরগণা জেলার মৌলবী আব্বাস আলী ১৮৫১-১৯৩২ খ্রীঃ)। বাংগালী মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ কুরআন বাংলার অনুবাদ করেন। এই অনুবাদে আরবী আয়াতের নীচে উর্দু তরজমা ও তারপরে বাংলা অনুবাদ দেওয়া হয়। তাহার অনুবাদে প্রয়োজনীয় টীকা-টিপ্পনীও সন্নিবেশিত করা হয়।

৫। কোরআনের অনুবাদ :

অনুবাদক রংপুরের উকিল খান বাহাদুর তসলীমদ্দীন আহমদ (১৮৫২-১৯২৭)। তিন খণ্ডে তিনি অনুবাদের কাজ শেষ করেন। প্রথম খণ্ড ১৯২২ সনে, ২য় খণ্ড ১৯২৩ সনে এবং ৩য় খণ্ড ১৯২৫ সনে প্রকাশিত হয়। ইহা ছাড়া তাহার অনূদিত আমপারা ১৩১৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।

৬। কোরআন শরিফ :

ইহার লেখক মৌলবী মোহাম্মদ আবদুল হাকিম ও মোহাম্মদ আলী হাসান। তাহাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইহার প্রথম সংস্করণ বাহির হয় ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে। ইহাতে মূল আরবী মতন-এর পাশাপাশি বাংলা অনুবাদ এবং নিম্নাংশে টীকা-টিপ্পনীসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। এই তফসীর নির্ভরযোগ্য বলিয়া সমাদর লাভ করিয়াছে।

আজকাল ইহার দ্বিতীয় সংস্করণ চালু রহিয়াছে।

৭। তফসীরুল কোরআন :

ইহার লেখক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খান (১৮৬৭-১৯৬৮ খৃীঃ)। দীর্ঘ ৫ খণ্ডে তিনি এই তফসীর লিখিয়াছেন। তফসীরসহ এই অনুবাদের ১ম ও ২য় খণ্ড ১৩৭৮ হিজরীতে এবং অন্যান্য খন্ড ১৩৭৯ হিজরীতে প্রকাশিত হয়।

তফসীরকারের কোন কোন মতের সহিত ইসলামী চিন্তাবিদগণ একমত না হইলেও বিষয়বস্তুর বিন্যাস ও সাহিত্যিক মূল্যমানের দিক হইতে ইহা অত্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।

৮। কুরআনুল করীম :

‘ইসলামী একাডেমী’র উদ্যোগে একটি অনুবাদক বোর্ড ইহার অনুবাদ করেন। শামসুল উলামা মাওলানা বেলায়াত হুসাইন, মওলানা আলাউদ্দীন আল-আজহারী, মওলানা এমদাদুল্লাহ প্রমুখ আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইহার অনুবাদে অংশ গ্রহণ করেন। অনুবাদ অত্যন্ত সার্থক হইয়াছে। সাহিত্যিক মূল্যমানের দিক হইতেও ইহা উচ্চ স্থানীয়।

ইহাতে প্রয়োজনীয় টীকা ও তফসীরের অভাব লক্ষণীয়। এই অভাব পূরণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (বর্তমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন) অগ্রসর হইলে ভালো হইত।

৯। হক্কানী তফসীর :

লেখক বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুজর্গ ও ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মওলানা শামসুল হক (মত্যু, ১৯৬৯ খ্রীঃ)। তাঁহার অনুদিত পাঞ্জ সূরার অনুবাদ ও তফসীরের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে তাঁহার সুরা ইয়াসীনের তফসীরও একখানি মুল্যবান দলিল।

১০। তাফহীমুল কুরআন (বাংলা) :

ইহার অনুবাদক হইতেছেন বিশিষ্ট লেখক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম। বাংলা ভাষায় ইহা একখানি অমূল্য তফসীর।

ইহা ছাড়াও যাহাদের তরজমা ও তফসীর প্রকাশিত হইয়াছে তন্মধ্যে (১) টাঙ্গাইল নিবাসী মৌলবী আবদুল করীম (১৮৬২-১৯৩২ খ্রীঃ) (২) খান বাহাদুর আবদুর রহমান (১৮৮৪-১৯৬৪ খ্রীঃ), (৩) চট্টগ্রামের আবদুর রশিদ সিদ্দিকী (৪) মৌলবী আজহার উদ্দীন, (৫) মৌলবী মোহম্মদ নকীবুদ্দীন, (৬) আল্লামা ওসমান গণী বর্ধমানী, (৭) ডক্টক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, (৮) আবুল হাশিম, (৯) মওলানা আলাউদ্দীন আল-আজহারী, (১০) মৌলবী খন্দকার মুহাম্মাদ হুসাইন, (১১) কলিকাতার মৌলবী রফীকুল হাসান, (১২) মওলানা মাহমুদুর রহমান, (১৩) মওলানা মুফতী দীন মোহাম্মাদ, (১৪) অধ্যক্ষ আলী হায়দার চৌধুরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা করা যাইতে পারে।

বর্তমানে বাংলা ভাষায় যে তরজমা ও তফসীর প্রকাশিত হইতেছে তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হইতেছেঃ

১। তফসীর-ই-আজহারী :

ইহার লেখক বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আলাউদ্দীন আল-আজহারী। ইহার সূরা ফাতিহা প্রকাশিত হইয়াছে। অন্যান্য সরার তফসীর প্রকাশের অপেক্ষায় রহিয়াছে।

২। তফসীরুল কোরআন :

ইহার লেখক হইতেছেন বিশিষ্ট আলেম অধ্যক্ষ মওলানা আবদুর রাজ্জাক (জন্ম ১৯৩১ খ্রীঃ)। আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনের শাশ্বত পয়গামকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের যাবতীয় সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান ও পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতিরুপে পেশ করাই হইতেছে এই তফসীরের মূল লক্ষ্য। লেখক আধুনিক ও প্রাচীন কালের সকল তফসীর হইতে মাল-মসলা সংগ্রহ করিতেছেন। তবে উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ মনীষী, প্রাচ্যও প্রতীচ্যের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য ও দর্শন জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সুবিখ্যাত তফসীরবিদ এবং হাকিমুল উম্মত হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানবীর (রঃ) সুযোগ্য খলীফা হযরত মওলানা আবদুল মজীদ দরিয়াবাদী সাহেবের বহল প্রচারিত উর্দু ও ইংরেজী তফসীরই লেখকের প্রধান অবলম্বন।

ইহার সুরা ফাতিহা প্রকাশিত হইয়াছে এবং আমপারার সূরাসমূহ ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী পত্রিকা মাসিক ‘তাহজীবে’ প্রকাশিত হইতেছিল।

এতদ্ব্যতীত প্রসিদ্ধ উর্দু তফসীরের যে বংগানুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে তন্মধ্যে এমদাদিয়া লাইব্রেরী হইতে ৬ খণ্ডে প্রকাশিত তফসীরে আশরাফী (বায়ানুল কুরআনের অনুবাদ), বাংলা একাডেমী হইতে প্রকাশিত ‘উম্মুল কুরআন’ (মূল : মওলানা আবুল কালাম আযাদ অনুবাদঃ আখতার ফারুক) প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

রুশ :

এই ভাষায় প্রথম তরজমা দুরায়ারের ফরাসী অনুবাদ হইতে ১৭১৬ খ্রীস্টাব্দে সেন্ট পিটাসবুর্গ হইতে প্রকাশিত হয়। এই স্থানে অন্য একখানি অনবাদ বাহির হয় ১৭৭৬ খৃীষ্টাব্দে। ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে টেরোগ্রাড হইতে আরেকখানি অনুবাদ প্রকাশ করেন ডিরিব কাইন। গোর্দী সভলনকব কাসেয়ান হইতে কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ করেন। রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত তাসখন্দ, কাজাখ, সমরকন্দ প্রভৃতি এলাকায় পবিত্র কুরআনের বহু অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে। সোভিয়েত মুসলিম ধর্মীয় বোর্ড ১৯৬৮ খ্রীষ্টাব্দে একটি অনুবাদ প্রকাশ করে। এই বোর্ড আরো দুইটি অনুবাদও প্রকাশ করিয়াছে।

চীনা :

এই ভাষায় পবিত্র কুরআনকে বলা হয় ‘কোননচিয়ান’। সম্রাট তাং চি-এর (১৮৬১-১৮৭৫ খ্রীঃ) রাজত্বকালে মা কুং ফু প্রথম ২০ খণ্ডে পবিত্র কুরআনের অনবাদ সমাপ্ত করেন। ওয়াং চে হাই নামক জনৈক আরবী ভাষাবিদ মূল আরবী হইতে একটি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ইহা খুবই জনপ্রিয় ছিল। মিঃ তীহতান জাপানী অনুবাদ হইতে একটি চীনা অনুবাদ ৩০ খণ্ডে প্রকাশ করেন। মিঃ হার্ডসন নামক জনৈক বৃটিশ ইহুদী ১৯৩১ সালে ৩০ খণ্ডে ৮ জিলদে কুরআনের চীনা অনুবাদ করেন। কিন্তু মুসলমানগণ তাহা গ্রহণ করেন নাই। লইন জেওয়া জেজিম ১৯৩৩ সালে একটি অনুবাদ প্রকাশ করেন।

এ ছাড়া তিয়েন চাং ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে, চীনচকমি ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে কাও মিনচেনচিং ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে এবং তিচিং ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দে কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ করেন। এতদ্ব্যতীত আরো অনেকে এরুপ অনুবাদ প্রকাশ করিয়াছেন।

জাপানীঃ

পবিত্র কুরআনের প্রথম জাপানী অনুবাদ প্রকাশিত হয় মেইজী যুগে (১৮৬৮-১৯১২ খ্রীঃ)। সাকুমতুর আংশিক অনুবাদ ১৯২১ সালে টোকিও হইতে প্রকাশিত হয়। শায়খ আবদুর রহীম ইবরাহীম জাপানী উলামাদের সহায়তায় একটি সম্পূর্ণ তরজমা বাহির করেন। হাজী উমর মিতা ১৯৬৮ খ্রীষ্টাব্দে একটি তরজমা প্রকাশ করেন। রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর সাহায্যেও একটি অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। ইহা ছাড়া কুরআন গবেষণা সমিতির পরিচালক হাজী উমর মিতা, অধ্যক্ষ আবদুল করিম সাইতু এবং আবু বকর মরিমতুর সম্পাদনায় ১৯৬৮ খীষ্টাব্দে একটি প্রামাণ্য অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

তুর্কীঃ

মাওলা আল ফাকিল আশ শিহাব আহমদ আফেন্দী (মৃঃ ৮৫৪ হিঃ) একখানি আরবী তফসীর হইতে সর্বপ্রথম তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করেন। আবুল ফযল মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস ১০০৪ হিজরীতে মুল্লা হুসাইন ওয়াজেব কাশিফীর আরবী তফসীর ‘মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া’ তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করেন। সাইয়েদ আফেন্দী আললুকী ১১৬৬ হিজরীতে সর্বপ্রথম মৌলিক তুর্কী ভাষায় পবিত্র কুরআনের পূর্ণাংগ তফসীর করেন। আশ-শায়খ মুহাম্মাদ হুসাইন ১২৯৪ হিজরীতে একটি তুর্কী তফসীর সম্পূর্ণ করেন। ইহা মিশর হইতে ঐ বৎসর প্রকাশিত হয়। শায়খ আফেন্দী খিযর ইবনে আবদুর রহমান আল-ইজদী (মতঃ ৭৭৩ হিঃ) কৃত ‘তিসবয়ান ফী তফসীরিল কুরআন’ নামক আরবী তফসীরের তুর্কী অনুবাদ করেন। ইহা বুলাকে (মিশর) ৪ খন্ডে ১২৫৬-৭৪ হিজরীর মধ্যে প্রকাশিত হয়।

পাশ্চাত্য জগতে

ল্যাটিনঃ

পাশ্চাত্য জগতে পবিত্র কুরআনের প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয় ফ্রান্সের কুলনী নামক স্থানের আবট পিটারের নির্দেশক্রমে হের ম্যানাস ডালমাট্রর সাহায্যে পাদরী পিটার নিরাবনিস (১১৫৭ খৃীঃ) কর্তৃক। ইহা ৪ শত বৎসর পর সুইজারল্যান্ড হইতে প্রকাশিত হয়। আরবী সহ আরেকটি ল্যাটিন অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৫৭৯ খ্রীষ্টাব্দে। জে, এফ, ফেরিল তদীয় ল্যাটিন অনুবাদ মূল আরবী সহ ১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দে সিপজিপ হইতে প্রকাশ করেন।

ইহা ছাড়া সাইলেসিয়ার ডমিনিকাস, অগস্টাস ফিফের, প্যরিয়ান, সাইকস, স্যামুয়েল গডওয়াল প্রমুখের ল্যাটিন তরজমা ও প্রকাশিত হইয়াছে।

ইংরেজীঃ

ইংরেজীতে পবিত্র কুরআনের বহ, তরজমা ও তফসীর প্রকাশিত হইয়াছে। নিম্নে কয়েকখানির কথা আলোচনা করা গেলঃ

১। আলেকজাণ্ডার ১৬৪৭ খ্রীষ্টাব্দে এক ফরাসী অনুবাদ হইতে কুরআন পাকের প্রথম ইংরেজী অনুবাদ করেন। ১৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দে ইহা লন্ডন হইতে প্রকাশিত হয়। ইহার ৩০টি সংস্করণ প্রকাশিত

হয়।

২। পবিত্র কুরআনের দ্বিতীয় অনুবাদ করেন জর্জ সেল। তিনি লুইস মরুসীর ল্যাটিন অনুবাদ অনুসরণে এই অনুবাদ করেন। ইহা ১৭৩৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত ইহার বহু সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে।

৩। রেভার জে, এম, রডওয়েল নামক একজন পাদরী কুরআনের ইংরেজী অনুবাদ করেন। ইহা ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

৪। এডওয়ার্ড হেনরী পামার জনৈক অধ্যাপক পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করেন। ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ইহা প্রথম প্রকাশিত হয়। ইহা ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ২ খণ্ডে প্রকাশিত হয় এবং ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে আমেরিকায় ইহার এক সংস্করণ বাহির হয়।

৫। পাতিয়ালা নিবাসী ডাঃ আবদুল হাকীম খান মুসলমান হিসাবে প্রথম কুরআন পাকের ইংরেজী অনুবাদ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে সমাপ্ত করেন।

৬। হাফেজ গোলাম সরোয়ার পবিত্র কুরআনের ইংরেজী অনুবাদ ১৯২৯-৩০ খীটাব্দে প্রকাশ করেন।

৭। মুহাম্মাদ মার্মাডিউক পিকথল নামক প্রখ্যাত ইংরেজ মুসলিম পবিত্র কুরআনের একটি অনবদ্য ও সার্থক ইংরেজী অনুবাদ করেন। ১৯২৪ খীষ্টাব্দে ইহার প্রকাশ শুরু হয় এবং ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের শেষে ইহা আমেরিকা ও ইউরোপে একই সাথে প্রকাশিত হয়। ইহার একটি আরবী বিহীন সুলভ সংস্করণও প্রকাশিত হইয়াছে। এই এই অনুবাদটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছে।

৮। আল্লামা আবদুল্লাহ, ইউসুফ আলী তাঁহার অনুবাদের প্রথম পারা প্রকাশ করেন ১৯৩৪ সনে। ১৯৩০ সনেই তাহার তরজমা ও তফসীরমলক বিস্তারিত টীকা লেখার কাজ সমাপ্ত হয়। ইহাতে মূল আরবী ও ইংরেজী অনুবাদ পাশাপাশি দেওয়ার পর নীচের অংশে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। ইহার অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে।

৯। প্রখ্যাত আলেম ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী বতমান যুগ-জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনের শাশ্বত বিধানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে তফসীরমুলক পর্যাপ্ত পাদটীকা সম্বলিত একটি অনুবাদ লিখিয়াছেন এবং ইহা ১৯৬০ সালে লাহোরের তাজ কোম্পানী কর্তৃক প্রথম প্রকাশিত হইয়াছে।

১০। মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ইংরেজীতে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও তফসীর করেন। ইহার একাংশ করাচী হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।

১১। রাজশাহীর মওলানা আবদুল হামিদ পবিত্র কুরআনের ইংরেজী অনুবাদও প্রকাশ করেন। ইহাতে ব্যাখ্যা নাই বলিলেই চলে।

১২। কানাডার অধ্যাপক, আরবী ও স্পেন ভাষাবিদ টমাস বেলেষ্টাইন আর্ভিং ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দে পবিত্র কুরআনের ইংরেজী অনুবাদ করেন। ইহা বর্তমান আমেরিকার চলিত ইংরেজীতে লিখিত আধুনিকতম অনুবাদ। লেখক ১৯৩০ খীষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই সময় হইতে তাহার নাম হয় তালীম আলী নছর।

লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে এই বই হতে। 

বি.দ্র: বইটি অনেক পুরনো হওয়াতে অনেক তথ্যই পুরনো। তবে ইতিহাসের একটি দলীল।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
kiw kow kan