কোরআন আল-কারীম এর অলৌকিকতা!

বিষয়বস্তু উপস্থাপনের দিক থেকে কোরআন আল-কারীম এক অনন্য সাধারন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও কোরআন নিজেই অলৌকিকতায় ভরপুর এক বিস্ময়কর গ্রন্থ। “অলৌকিক” বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি তা হল, অতিপ্রাকৃতিক কিংবা বিস্ময়কর কোন ঘটনা যা মানুষের পক্ষে কখনই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। নবী কারীম (সা) তৎকালীন আরবদেরকে কোরআনের ভাষা, ছন্দ ও বিষয়বস্তুর অলংকারের সমতুল্য সাহিত্য রচনার জন্য চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন অথচ তারাই কাব্যসাহিত্যে ব্যাপক পারদর্শী ছিল।
কিন্তু কাব্য রচনায় নিজেদের এতো সাফল্য আর উৎকর্ষতা থাকার পরেও তারা উক্ত চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কোরআন এর অবিকল কিছু সৃষ্টির ঐ চ্যালেঞ্জ আরবসহ পুরো মানবজাতির উপর তিনটি পর্যায়ে দেয়া হয়েছেঃ
১. সম্পূর্ণ কোরআনঃ
কোরআন আল-কারীমে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন প্রিয় নবী (সা) কে প্রথমে এই বলে সকল মানুষকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে বলেছেন যে, পারলে তারা যেন কোরআনের সমমর্যাদার কোন গ্রন্থ বানিয়ে দেখায়ঃ
“বল, যদি সকল মানুষ ও জিন মিলে
কোরআনের অবিকল কিছু বানিয়ে আনার চেষ্টা করে, তবুও তারা পারবেনা, এমনকি যদি তারা একে অপরকে সাহায্যও করে। [সূরা আল-ইস্রা; ১৭:৮৮]
২. দশটি সূরাঃ
যারা এর সত্যতাকে এরপরও অস্বীকার করে যাচ্ছিল তাদেরকে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন নিদেনপক্ষে কোরআনের মত করে দশটি সূরা রচনা করতে বললেনঃ “অথবা তারা কি এটা বলে নাকি যে সে (মুহাম্মাদ) নিজেই এটা রচনা করেছে? (তাদের) বল, ‘যদি তাই হয়, তাহলে তোমরাও এর অনুরূপ (মাত্র) দশটি সূরাহ নিয়ে আসো এবং আল্লাহ্ ছাড়া তোমারা আর যাদের উপাসনা কর তাদেরকেও সাহায্য করতে বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” [সূরা হূদ; ১১:১৩]
সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ ছিল, অন্তত পক্ষে কোরআন-এর একটি সূরার অনুরূপ তারা যেন বানিয়ে আনে, আর কোরানের সবচাইতে ছোট সূরা হচ্ছে সূরা আল-কাউসার, যার আয়াত সংখ্যা মাত্র তিনটি।
“এবং আমার বান্দার (মুহাম্মাদ) উপর আমি যা নাযিল করেছি, তার ব্যাপারে তোমাদের মনে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে, তাহলে এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আসো, এবং আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের আর যেসব সাহায্যকারী আছে তাদের সাহায্যের জন্য ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” [সূরা আল বাক্বারাহ্; ২:২৩]
এই চ্যালেঞ্জগুলা কিন্তু নিছক কথার কথা ছিল না যে, কেউ এর জবাব দিতে চায়নি কিংবা কোরআনকে ভুল প্রমাণিত করতে চায়নি। প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা) মানুষদের আল্লাহ্র একত্ববাদ, সকল ধরণের মূর্তিপূজা বাতিল এবং দাস-দাসী ও মনিবের মধ্যে যে সাম্যবাদের ডাক দিচ্ছিলেন তা সাধারণভাবে মাক্কার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠী কুরাইশ গোত্রের জন্য তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আরবের প্রধান বাণিজ্য ও ধর্মীয় কেন্দ্র মাক্কার অধিবাসীরা রাসূল (সা) এর সেই সাম্যবাদের বিস্তার রোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ছিল। এর জন্য তাদের শুধু এটুকু করলেই চলত, যদি তারা কোরআনের অনুরূপ মাত্র একটি সূরা বানিয়ে আনতে পারত! বহু কুরাইশ কবি ও বাকপটু লোক উক্ত চ্যালেঞ্জের উত্তর দিয়ে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হয়ে তারা বরঞ্চ তাঁকে অনেক সম্পদ, সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসন এমনকি গোত্রের সবচাইতে অভিজাত এবং সুন্দরী মেয়েদেরকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। আর তা করেছিল শুধুমাত্র এই জন্যে যে, যাতে তিনি ইসলামের এই দা’ওয়াত বন্ধ করে দেন। উল্টো তিনি তাদের সূরা ফুসসিলাত এর প্রথম তেরটি আয়াতের আবৃত্তির মাধ্যমে তাদের জবাব দেন। এতে তারা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে তাঁকে থামতে বলেন [ আল হাকীম, আল-বাইহাক্বী, আবূ ইয়’লা ও ইবন্ হিশাম কর্তৃক সংগৃহীত, ইব্রহীম আল-‘আলী তাঁর সহীহ্ আস-সীরাহ্ আন-নাবাওয়ীয়্যাহ-তে এই বর্ণনাকে ‘হাসান’ বলেছেন, পৃঃ৬৪]। প্রিয় নবী (সা) কে প্ররোচিত করতে ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা তাদের দাস-দাসী ও আত্মীয়দের মধ্যে যারা ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করছিল, তাদেরকে পৌত্তলিক ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য নির্যাতন করে যাচ্ছিল। যদিও তারা ইসলাম থেকে ফিরে আসেননি। এতো কিছুতে না পেরে পরবর্তীতে তারা প্রিয় নবী (সা) এবং তাঁর অনুসারী ও তাঁর বংশ বানূ হাশীম গোত্রের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যাতে করে তারা অনাহারের কষ্টে তাদের কাছে মাথা নত করে। বলাবাহুল্য, তাদের এই চেষ্টাও বিফলে গিয়েছে। শেষমেশ তারা তাঁকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে তারা কুরাইশদের সকল বংশ থেকে একজন করে সশস্ত্র লোককে পাঠায়, যাতে করে পরবর্তীতে নবী কারীম (সা) এর নিজস্ব বংশের লোকেরা আর তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে না পারে।
যাইহোক, এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন রাসূল (সা) সহ তাঁর সকল অনুসারীগণকে মক্কা থেকে উত্তরে ইয়াসরিব নামক শহরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন যেখানে আগে থেকেই বেশ কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছিল। ইয়াসরিব এর লোকজনদের মধ্যে ইসলাম খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল এবং বছর না ঘুরতেই মুসলিমরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেলে। প্রিয় নবী (সা) কে সেখানকার শাসক বানানো হয় এবং ইয়াসরিব শহরটিকে মাদীনাহ্ আন-নবী [নবী (সা)-এর শহর] এই নামে নতুন করে নামকরণ করা হয়। পরবর্তী আট বছরের বিভিন্ন সময়ে মক্কা এবং এর আশেপাশের বিভিন্ন গোত্র ও বংশের অধিবাসীরা ক্রমবর্ধমান মদীনাহ্-এর মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ব্যর্থ যুদ্ধাভিযান চালায়। যার পরিসমাপ্তি ঘটে মুসলিমদের মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে।
কুরাইশ এবং তাদের মিত্র বাহিনী কেউ যদি শুধুমাত্র কোরআনের সূরা এর অনুরূপ মাত্র তিনটি কবিতার লাইন কিংবা পুঁথি রচনা করতে পারত তাহলেই কিন্তু এতো রক্তারক্তির আর দরকার পড়ত না। সুতরাং, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোরআনের ভাষাশৈলীর অনুপম মর্যাদা, শব্দের মাধুর্য এবং ছন্দের গতিশীলতার এই অলৌকিক বিস্ময় কোন মানুষের পক্ষে অনুকরণ করা সম্ভব নয়।
অনেকে এমনটা ধারণা করে যে, কোরআনের অসাদৃশ্যতা এমন কোন অনন্য বৈশিষ্ট্য নয়। যেমন, বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেক্সপীয়ার, চসার অথবা যে কোন ভাষারই যে কোন বিখ্যাত কবির প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা রচনাশৈলী থাকে যা তাদের সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের থেকে পৃথক করে রাখে। কিন্তু যদি এমন হয়, আজকের দিনের শীর্ষস্থানীয় কোন কবি শেক্সপীয়ার এর সাহিত্যকর্মের উপর গভীর পড়াশুনা করে এবং পুরাতন কালি দিয়ে পুরাতন কোন কাগজে শেক্সপীয়ারের রচনাশৈলী নকল করে নিজে কোন ‘সনেট’ লিখে সেটা শেক্সপীয়ারের নামে দাবী করে, তাহলে তার সেই দাবীকৃত কবিতাটি ভালভাবে দেখার পর হয়তো সেটা শেক্সপীয়ারের বলেই মেনে নেয়া হবে। একজন কবি যতই বড় হোকনা কেন, এভাবে ঠিকই তাঁর রচনাশৈলীর অনুকরণ করা যায়। অনেক বড় এবং বিখ্যাত চিত্রকরের চিত্রকর্ম ঠিক যেমন অনুকরণ করা সম্ভব হয়েছে। [প্রকৃত পক্ষে অনেক ইংরেজ সাহিত্যিকদের মতে শেক্সপীয়ার এর সাহিত্যকর্ম হিসেবে যেগুলা ধরা হয়, তার বেশকিছু আসলে তারই সমসাময়িক লেখক ক্রিস্টোফার মার্ল এর লেখা।] কোরআন এই ক্ষেত্রে অনেক বেশীই উপরে। কেননা, ১৪০০ বছর আগ থেকে এখন পর্যন্ত অনেকেই কোরআন এর অনুরূপ সূরা নকল করে লেখার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভাল করে পরীক্ষা করার পর দেখা গেছে ওগুলো নিরর্থক পণ্ডশ্রম; নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কোরআনের সামান্য একটি আয়াতের ধারেকাছে যাওয়ারও ক্ষমতা এদের নেই। যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তখন কোরআন এর অনুকরণ করার চেষ্টা ছিল এখনকার যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় সময়ের দাবি, যখন কোরআন নাযিল হচ্ছিল, যখন সাহিত্যের চর্চা ছিল সর্বোচ্চ শিখরে। অথচ তখনই কেউ এর অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি, আর এখনতো প্রশ্নই উঠে না!
______________________________
সংকলক: শাইখ ড. আবু আমীনাহ বিলাল ফিলিপস।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member