অভ্যাসগত সুন্নাহ বনাম ইবাদাতগত সুন্নাহ

প্রশ্নঃ মহান আল্লাহ আপনাকে বারাকাহ দান করুন, ইসলামী শারী’আহ অনুযায়ী কোন সুন্নাহ যা অভ্যাস/প্রথা হিসেবে বিবেচিত এবং কোন সুন্নাহ যা ইবাদাত হিসেবে বিবেচিত, এই দু’টির মাঝে পার্থক্য করার শারঈ মানদণ্ড আসলে কী?
উত্তরঃ যে ব্যক্তি কোন ইবাদাতগত সুন্নাহ এবং অভ্যাসগত/প্রথাগত সুন্নাহ এর মাঝে পার্থক্য করতে চায়, সেক্ষেত্রে এই মানদণ্ডটি একটি উঁচু স্তরের জ্ঞানের দাবি রাখে।

এটা উল্লেখ করা হয় যে, রাসুল (স) এর যাবতীয় কর্ম যা তার নিকট থেকে আমাদের নিকট এসেছে এবং তিনি সেগুলো মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য করেছেন, এই ধরনটি হচ্ছে ইবাদাতগত সুন্নাহ। এর বিপরীতে আরো একটি ধরন রয়েছে যেটি রাসূল (স) এর কর্মসমূহকে উল্লেখ করে, সেক্ষেত্রে আমরা অন্তত এটা বলতে পারি যে, সেগুলো ইবাদাতের আওতায় পড়বে না বরং সেগুলো অভ্যাস/প্রথার আওতায় পড়বে অথবা সেগুলো কোন ব্যক্তির ইচ্ছা-অভিরুচির দিকে ফিরে যাবে যার সাথে ইবাদাতের কোন সম্পর্ক নেই। এই ধরনটি পরিষ্কার এবং স্পষ্ট, এর সাথে ইবাদাতের কোন সম্পর্কে নেই। কাজেই এটা অভ্যাস/প্রথার আওতায় পড়বে এবং এই দুইয়ের মাঝে যে সব বিষয় রয়েছে সেগুলো সন্দেহযুক্ত (তা ইবাদাত নাকি অভ্যাস/প্রথা)।
আমরা যদি একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে এসব সন্দেহযুক্ত বিষয়ের দিকে নজর দেই, তখন হতে পারে কোন ব্যক্তি কোন একটি কাজকে ইবাদাতের দিকে সম্পর্কযুক্ত করবে এবং আমরা যদি পুনরায় এসব সন্দেহযুক্ত বিষয়ের দিকে নজর দেই, তখন হতে পারে আমরা সে সব কাজকে এমন সুন্নাহ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করার দিকে ঝুকে পড়বো যা আসলে কেবল অভ্যাসগত/প্রথাগত। আর ত্বলিবুল ইল্‌ম (ইল্‌ম অন্বেষণকারী) ব্যক্তির জন্য এই ২য় প্রকারে এসে থেমে যাওয়াটা যথেষ্ট হবে, যা ১ম প্রকারের বিপরীত।
উদাহরণস্বরূপঃ রাসূল (স) দুই ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল পরিধান করতেন (বুখারীঃ হা/৫৮৫৭)। কাজেই প্রথম দেখায় এটা মনে পারে যে, যদি কোন ত্বলিবুল ইল্‌ম এক ফিতাওয়ালা সেন্ডেল পরিধান করে তাহলে সে সুন্নাহ্‌র খেলাফ কাজ করছে! আর সুন্নাহ হচ্ছে দুই ফিতাওয়ালা সেন্ডেল পরিধান করা! এটা মনে হতে পারে যে, এর সাথে ইবাদাতের সম্পর্ক রয়েছে, অথচ এটা শুধুই আরবদের একটি প্রথা। তারা এ ধরনের সেন্ডেল পরিধান করতো। আর তারা এমন কোন ধরনের পাদুকা পরিধান করতো না যা বর্তমানে ‘শু’ (জুতা) হিসেবে পরিচিত অথবা অনুরূপ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে যা পরিচিত। আর ত্বলিবুল ইল্‌ম এর জন্য বাকি থাকলো সেই ধরনটি যা ১ম বা ২য় প্রকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যায়। এই পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য ইল্‌ম থাকা প্রয়োজন যে, এটা ১ম প্রকারে পড়বে এবং এর বিপরীত ২য় প্রকারে পড়বে না অথবা এটা ২য় প্রকারে পড়বে এবং ১ম প্রকারে পড়বে না।
এছাড়া আমরা কিছু আলেমকে দেখতে পাই তারা একমত যে, এগুলো সুন্নাহ কিন্তু তারা এর প্রকারের ক্ষেত্রে মতভেদ করেছেন, সেগুলো কি অভ্যাসগত/প্রথাগত সুন্নাহ নাকি ইবাদাতগত সুন্নাহ? এর একটি উদাহরণ হাজ্জের সাথে সম্পর্কিত, আমরা ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই হাজ্জে যাবো। এতে রয়েছে যে, রাসূল (স) হাজ্জে ‘আল-বাত্বহা’ নামক স্থানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার জন্য নেমেছিলেন। এজন্য কিছু কিছু সাহাবী, আমার মনে হয় ‘আয়েশা (রা) বলতেনঃ ‘আল-মুহাসসাব’ এ অবস্থান করাটা সুন্নাহ নয় (বুখারীঃ হা/১৭৬৫)। তারা কেবল এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে, তিনি (স) সেখানে একটি তাঁবু স্থাপন করে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু কিছু লোক যারা হাজ্জে আসে তারা বিশ্বাস করে যে, আল-বাত্বহা নামক স্থানে বিশ্রাম করাটা হাজ্জের পরিপূর্ণতার অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে মতভেদ হতে পারে, কারণ এই কাজটি ১ম প্রকারের সুন্নাহ কিংবা ২য় প্রকারের সুন্নাহ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করতে চাইলে আরো কিছু স্পষ্ট বর্ণনার প্রয়োজন।
এখন আমরা সমসাময়িক কিছু উদাহরণ পেশ করবো। কারণ তরুণ প্রজন্মের অনেকে, আলহামদুলিল্লাহ তাদের পোশাককে ছোট করে ফেলেছে এবং তা লম্বা করছে না (শাইখ এখানে বর্তমান প্রজন্মের টাখনুর উপর পোশাক পরার যে স্টাইল তার দিকে ইশারা করেছেন)। তারা এমনটি করে সুন্নাহ (রীতিনীতি) কে অনুসরণের উদ্দেশ্যে। কাজেই এটা কি প্রথাগত সুন্নাহ নাকি ইবাদাতগত সুন্নাহ?
আমরা যদি (পোশাক ছোট করা বিষয়ে) রাসূল (স) এর কর্মের দিকে তার কিছু উক্তির আলোকে আলাদা আলাদা করে নজর দেই, তাহলে সম্ভবত আমরা এই কাজকে ইবাদাতগত সুন্নাহ অথবা প্রথাগত সুন্নাহ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্থ হবো। কিন্তু যখন রাসূল (স) এর কথা সম্বলিত হাদীসটি চলে আসলো, যে হাদীসে তিনি বলেনঃ
‘মুসলিমের পরিধেয় ‘ইযার’ (লুঙ্গি/পায়জামা/প্যান্ট) নলার মধ্যভাগ পর্যন্ত থাকবে, তবে টাখনুদ্বয় পর্যন্ত রাখলেও কোন গুনাহ হবে না। কিন্তু টাখনুদ্বয়ের নীচে গেলে তা জাহান্নামের আগুনে যাবে…’। (সুনান আবু দাউদঃ হা/৪০৯৩, অধ্যায়ঃ ‘লুঙ্গি-পাজামার নিচ দিকের সীমা’, আলবানী একে সহীহ বলেছেন)
এই হাদীসটি আলোচ্য কাজটি ইবাদাতগত সুন্নাহ নাকি প্রথাগত সুন্নাহ, এই দোদুল্যমান অবস্থাকে দূর করে। এটা নিশ্চিত যে, এটা ইবাদাতগত সুন্নাহ। কারণ যখন তিনি (স) মুসলিমদের পোশাক পরিধানের পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন তখন তিনি বলেছেন যে, এটা নলার মধ্যভাগ পর্যন্ত থাকবে, তবে টাখনুদ্বয় পর্যন্ত রাখলেও কোন গুনাহ হবে না। কিন্তু টাখনুদ্বয়ের নীচে গেলে তা জাহান্নামের আগুনে যাবে। এর বিপরীতে রাসূল (স) এর আরেকটি সুন্নাহ রয়েছে। আর তা হচ্ছে, তিনি লম্বা চুল রাখতেন। কখনো কখনো তার চুল তার কানের লতি পর্যন্ত চলে আসতো (বুখারীঃ হা/৩৫৫১)। আর যদি এর চেয়ে বড় হতো তাহলে তা তার দুই কাঁধের উপর পর্যন্ত চলে আসতো (সুনান আবু দাউদঃ হা/৪১৮৩, আলবানী একে সহীহ বলেছেন)। বরং এটা প্রমাণিত আছে যে, রাসূল (স) যখন মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন তখন তার চুলে ৪টি বেণী করা ছিল (সুনান আবু দাউদঃ হা/৪১৯১, আলবানী একে সহীহ বলেছেন)। কাজেই প্রথমত চুলকে লম্বা করা এবং দ্বিতীয়ত একে বেণী করা কি ইবাদাতগত সুন্নাহ নাকি প্রথাগত সুন্নাহ?
এর উত্তর হচ্ছে যেমনটি আমি মনে করি, এতে এমন কোন কিছু নেই যা এই প্রথাগত সুন্নাহ বিষয়ে কোন ধরনের দ্বিধা তৈরি করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে আহবান করে কিংবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। তা কেন? এর কারণ হচ্ছে প্রথমতঃ নবী (স) ১ম ব্যক্তি নন যিনি এই সুন্নাতকে চালু করেছিলেন। বরং রাসূল (স) নবী হওয়ার পূর্ব থেকেই কেবল নয়, বরং তার জন্মের পূর্ব থেকেই এর প্রচলন ছিল। এটা ছিল আরবদের প্রথা। তারা তাদের চুলকে লম্বা করতো। বর্তমানকালেও কিছু যুবক এবং সিরিয়ার মরুভূমিতে কিছু যুবক যাদেরকে আমরা দেখেছি, তারা তাদের চুলকে গুচ্ছ তৈরি করে বেণী করে রাখে। কাজেই এটা হচ্ছে এমন একটি প্রথা যা নবী (স) চালু করে যান নি, বরং তিনি কেবল আরবদের প্রথা অনুযায়ী তা করে গেছেন এবং তিনি যখন মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন তখন তার মাথায় ৪টি বেণী ছিল। একে যদি আমরা ইবাদাতগত সুন্নাহ এর বিপরীতে প্রথাগত সুন্নাহ হিসেবে বিবেচিত করি, তাহলে এতে এমন কিছু নেই যা আমাদেরকে কষ্ট দিবে।
আরো একটি উদাহরণঃ নবী (স) সাদা রঙের পোশাক পরিধান করতেন। এটা কি ইবাদাতগত সুন্নাহ নাকি প্রথাগত সুন্নাহ? যদি তার এই কথাটি বর্ণিত না হতো যে, ‘তোমরা সাদা রঙের কাপড় পরিধান করবে। তোমাদের জীবিতরা যেন সাদা কাপড় পরিধান করে এবং মৃতদেরকে সাদা কাপড় দিয়ে দাফন দেয়। কেননা, সাদা কাপড় তোমাদের সর্বোত্তম পোশাক’ (সুনান নাসাঈঃ হা/৫৩২৩, আলবানী একে সহীহ বলেছেন) অর্থাৎ এই উক্তিটি না থাকলে আমরা বলতে পারতাম এটা তার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় ছিল। আর নবী (স) সাদা রঙের কাপড় পছন্দ করতেন যেমন তিনি মধু পছন্দ করতেন এবং উদাহরণস্বরূপ তিনি ‘দ্বব’ (মরুভূমির এক শ্রেণীর সরীসৃপ প্রাণী) এর গোশত অপছন্দ করতেন, এটা ছিল তার ব্যক্তিগত অভিরুচি। কিন্তু যখন তার বাণী চলে আসলো এই মর্মে যে, ‘সাদা কাপড় তোমাদের সর্বোত্তম পোশাক’ এবং এরপর তিনি তা পরিধান করার নির্দেশ দিলেন। আর অন্ততপক্ষে এই নির্দেশ প্রমাণ করে যে, এমনটি করা মুস্তাহাব। এজন্য তিনি বলেন, ‘তোমাদের জীবিতরা যেন সাদা কাপড় পরিধান করে এবং মৃতদেরকে সাদা কাপড় দিয়ে দাফন দেয়’। কাজেই এটি প্রথাগত সুন্নাহ না হয়ে ইবাদাতগত সুন্নাহ্‌তে পরিণত হলো।
আমাদের জন্য আবশ্যিক হচ্ছে এই মানদণ্ড এবং মাপকাঠি অনুযায়ী রাসূল (স) এর কর্মসমূহকে ওজন করা। এজন্য যা কিছু তিনি (স) চালু করেছেন এবং এতে যদি এমন কোন প্রাসঙ্গিক বিষয় না থাকে যাতে করে আমাদের নিকট মনে হতে পারে এটা প্রথাগত সুন্নাহ, তাহলে এটা হবে ইবাদাতগত সুন্নাহ। কিন্তু তার কাজগুলো যদি আরব প্রথার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে এই আমলগুলো আরব প্রথা হিসেবে গণ্য হবে। আর কেউ তা পালন করলে কোন সমস্যা নেই এবং কেউ তা ছাড়লেও কোন সমস্যা নেই। আর তার কর্মসমূহ যেগুলো তার স্বভাবগত অথবা তার নিজস্ব পছন্দগত, এগুলোরও ইবাদাতের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।
যেমন পূর্বোল্লেখিত উদাহরণের বিষয়ে বলা যায়, রাসূল (স) মধু পছন্দ করতেন। আর এটা সম্ভব যে, আমরা এমন কিছু মানুষকে পাবো যারা মধু অপছন্দ করে। কিন্তু তারা বলে না যে, তারা সুন্নাহ্‌র বিরোধিতা করে! কারণ মৌলিকভাবে মধু খাওয়া কোন ইবাদাত নয়। এজন্য যদি কোন ব্যক্তির জন্য মধু খাওয়া সহজ না হয় কিংবা তাদের মধু খাওয়ার কোন রুচি না থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা এটা বলি না যে তারা সুন্নাহ্‌র খেলাফ কাজ করেছে। তবে সে রাসূল (স) এর স্বভাব যে তিনি মধু পছন্দ করতেন এর খেলাফ কাজ করেছে।
কিন্তু ভিন্ন একটি দিক থেকে দেখলে আমরা দেখতে পাবো, রাসূল (স) ‘দ্বব’ (মরূভূমির এক শ্রেণীর সরীসৃপ প্রাণী) এর গোশত অপছন্দ করতেন অথচ আরবের লোকদের নিকট তা উপাদেয় খাদ্য ছিল। আর যখন রাসূল (স) এর খাবারের দস্তরখানে তা রাখা হয়েছিল এবং তাকে বলা হয়েছিল যে তা ‘দ্বব’ এর গোশত, তিনি তা স্পর্শ করেন নি। তার সামনে ছিল বিখ্যাত একজন সাহাবী, তিনি আর কেউ নন খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ)। আর খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) এমন বেশি চাহিদা নিয়ে খেতেন যে তা লোকজনের দৃষ্টি কেঁড়ে নিতো। তিনি খেতেন এবং তার দাড়ি বেঁয়ে ঝোল পড়তো। কাজেই তিনি যখন রাসূল (স) কে দেখলেন যে তিনি (স) তা খাচ্ছেন না, তখন তিনি বলেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা খাওয়া কি হারাম?’ কেননা তিনি তার অন্তরে কষ্ট অনুভব করেছিলেন যে, তিনি ভালমত খাচ্ছেন অথচ নবী (স) এর হাত খাবারের দিকে যাচ্ছে না। তাই তিনি জিজ্ঞেস করেন এটা হারাম কিনা। জবাবে রাসূল (স) বলেনঃ ‘না। যেহেতু এটা আমাদের এলাকার প্রাণী নয়, তাই আমি তা অপছন্দ করি’ (সহীহ মুসলিমঃ হা/৪৯২৮)। এজন্য যে ব্যক্তি ‘দ্বব’ খেতে পছন্দ করে তাকে আমরা এটা বলতে পারি না যে ‘তুমি সুন্নাহ্‌র খেলাফ কাজ করেছো’ যেহেতু রাসূল (স) দ্বব খাওয়া অপছন্দ করতেন। আর আমরা তার ব্যাপারেও এমনটা বলি না যে ব্যক্তি মধু খাওয়া পছন্দ করে না। আপনি এমন ব্যক্তিদেরকে পাবেন যারা মধু পছন্দ করে না। আমি আমার এক ছেলেকে পেয়েছি যে মধু পছন্দ করে না। তবে আমি মধু পছন্দ করি এবং সাধারণভাবে সবধরনের মিষ্টি জিনিস আমি পছন্দ করি। তবে আমার এক ছেলে মধু অপছন্দ করে। কিন্তু এজন্য আমি তাকে এটা বলি না যে ‘তুমি সুন্নাহ্‌র খেলাফ কাজ করেছো’। কেননা এর সাথে ইবাদাতের কোন সম্পর্ক নেই।
অনুরূপভাবে আমাদের জন্য আবশ্যিক হচ্ছে রাসূল (স) এর আমলের দিকে নজর দেওয়া। অধিকাংশ ব্যক্তি বিশেষ করে বর্তমান কালের ইল্‌ম অন্বেষণকারীরা এই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র সম্পর্কে গাফেল এবং তাদের কেউ কেউ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য আপনি কোন কোন যুবককে পাবেন যারা নিজেদের চুল লম্বা করে এই বিশ্বাসে যে, এটা নবী (স) এর সুন্নাহ। হ্যা, আমি বলি এটা নবী (স) এর আমলের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এমন কোন দলীল নেই যে, এটা করা উত্তম। বরং রাসূল (স) সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে বলেনঃ ‘হয় তা পুরোপুরি মুণ্ডন করো অথবা পুরোপুরি ছেড়ে দাও’ (সহীহ মুসলিম, আবু দাউদঃ হা/৪১৯৫)। এজন্য যদি চুল লম্বা রাখা হয় তাহলে এটা ইবাদাতগত সুন্নাহ নয় বরং তা কেবল প্রথাগত সুন্নাহ। কাজেই কোন ব্যক্তি যদি সারাজীবন তার মাথা মুণ্ডন করে যায় তাহলে এটা বলা যাবে না যে, তিনি নবী (স) এর সুন্নাতের খেলাফ কাজ করছেন। কারণঃ নবী (স) সারা জীবন তার চুল বড় রেখেছেন, তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে হাজ্জ এবং উমরাহ। কেননা এসব ক্ষেত্রে তিনি মাথা মুণ্ডন করতেন। আর আপনি সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীস জেনে থাকবেন যেখানে নবী (স) বলেছেনঃ ‘হে আল্লাহ! মাথা মুণ্ডনকারীদের প্রতি রহম করুন। হে আল্লাহ! মাথা মুণ্ডনকারীদের প্রতি রহম করুন। হে আল্লাহ! মাথা মুণ্ডনকারীদের প্রতি রহম করুন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যারা চুল ছোট করেছে তাদের প্রতিও। এবার আল্লাহর রাসূল (স) বললেনঃ যারা চুল ছোট করেছে তাদের প্রতিও’ (বুখারীঃ হা/১৭২৭, মুসলিম)। কিন্তু যারা চুল ছোট করেছে তারা কম মাত্রায় প্রতিদান পাবে। আর মাথা মুণ্ডন করাটা হচ্ছে অধিকতর উত্তম। এজন্য কেউ যদি অভ্যাসগত ভাবে তার চুল লম্বা রাখে কিংবা মানবীয় স্বভাব হিসেবে তা লম্বা রাখে, তাহলে এমনটি করার ক্ষেত্রে কোন কিছুই তাকে বারণ করতে পারে না। কিন্তু কেউ যদি তার চুল লম্বা রাখার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চায়, তাহলে আমরা বলবোঃ এটা নবী (স) এর সুন্নাহ্‌র খেলাফ। যে ব্যক্তি তার চুল লম্বা করে তার বিষয়টি বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ রাসূল (স) তার চুল লম্বা করতেন, এজন্য সে বিশ্বাস করে যে, সে চুল লম্বা রাখার মাধ্যমে নবী (স) কে অনুসরণ করছে। কিন্তু আমি খোলামেলাভাবেই এটা বলছি যে, সে নবী (স) এর খেলাফ কাজ করছে। এই খেলাফ বা ভিন্নতা বাহ্যিকভাবে দেখা যাচ্ছে না, বরং এটা ভিতরে লুকায়িত আছে। কাজেই যা কিছু বাহ্যিকভাবে দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সে তার চুল লম্বা করার মাধ্যমে রাসূল (স) কে অনুসরণ করছে। তো খেলাফ কাজটা কি হলো?
খেলাফ কাজটি হচ্ছেঃ আমাদের জন্য আবশ্যিক হচ্ছে রাসূল (স) এর বাণীর দিকে মনোযোগ দেওয়া। তিনি বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই আমলসমূহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে। আর যার হিজরত হবে ইহকাল লাভের উদ্দেশ্যে অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে, তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে যে জন্যে সে হিজরত করেছে’ (বুখারীঃ হা/৫৪)।
কাজেই যে ব্যক্তি নবী (স) এর সাথে আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ হিসেবে বের হয়েছে, সেক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে কি দেখা যাবে? এখানে বাহ্যিকভাবে এটাই দেখা যাবে যে, সে মহান আল্লাহর পথের একজন মুজাহিদ। কিন্তু বাস্তবে সে দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা কোন মহিলাকে বিয়ে করার জন্য বের হয়েছে। এজন্য সে নিয়তের ক্ষেত্রে নবী (স) এর খেলাফ কাজ করেছে। কাজেই নিয়তের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ মুজাহিদের খেলাফ কাজ করে সে কি মুজাহিদ হিসেবে প্রতিদান পাবে? এর উত্তর হচ্ছে, না।
এখন যে ব্যক্তি নবী (স) কে অনুসরণ করে তার মাথার চুল লম্বা করে, তার উদাহরণটি হচ্ছে সেই মুজাহিদের মত, যে রাসূল (স) এর সাথে মুজাহিদ হিসেবে বের হয়েছে বটে, কিন্তু সে নিয়তের ক্ষেত্রে নবী (স) এর খেলাফ কাজ করেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে যে, বিষয়টি তার সাথে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে যে তার চুল লম্বা করে? আমরা তাকে বলবোঃ তুমি কি এটা জানো যে, নবী (স) যখন তার মাথার চুল লম্বা করতেন তখন তিনি তার রবের নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে তা করতেন? তুমি যদি এটা বিশ্বাস কর তাহলে তোমার আমলটি সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তুমি যদি তা বিশ্বাস না কর তাহলে তুমি নিয়তের ক্ষেত্রে নবী (স) এর খেলাফ কাজ করলে। মধু পছন্দ করা, ‘দ্বব’ এর গোশত অপছন্দ করা, চুল লম্বা করা ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি (স) মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চাননি। অথচ তুমি তোমার চুল লম্বা করার ক্ষেত্রে তা চাও! এক্ষেত্রে তুমি ইবাদাতের ২টি জোরালো শর্তের ক্ষেত্রে নবী (স) এর খেলাফ কাজ করেছোঃ
(ক) ১ম শর্তঃ নিয়ত অবশ্যই একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে।
(খ) ২য় শর্তঃ তা অবশ্যই রাসূল (স) এর আমল অনুযায়ী হতে হবে।
আমলের দিক থেকে তার (স) সাথে তোমার মিল আছে কিন্তু তুমি নিয়তের ক্ষেত্রে তার খেলাফ কাজ করেছো।
ফজরের সলাতের ক্ষেত্রে বলা যায়, এর ফরয এবং সুন্নাত উভয়ই দুই রাক’আত করে। কাজেই কোন ব্যক্তি ফজরের ২ রাক’আত সুন্নাত যদি ফরয/ওয়াজিব হওয়ার নিয়তে আদায় করে, এটা কি তাহলে সুন্নাহ অনুযায়ী হবে? এর উত্তর হচ্ছে, না। কাদিয়ানীদের অন্যতম একটি পথভ্রষ্টতা হচ্ছে, তারা বিশ্বাস করে ফজরের এই ২ রাক’আত সলাত হচ্ছে ওয়াজিব। কাজেই যখন তারা এই ২ রাক’আত সলাত আদায় করে, বাহ্যিকভাবে মনে হবে তারা রাসূল (স) এর সুন্নাহ অনুযায়ী তা করছে, কিন্তু তাদের অন্তর এবং নিয়ত নবী (স) এর বিপরীত। এজন্য যে ব্যক্তি ফজরের ২ রাক’আত সলাতকে ফরয মনে করে আদায় করে সে তার মত, যে নিয়তের ক্ষেত্রে নবী (স) এর খেলাফ কাজ করে কিন্তু বাহ্যিকভাবে তার মত একইরকম আমল করে। এই বাহ্যিকতার কোন দাম নেই, কারণ যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর এই হাদীসের অর্থ হচ্ছেঃ ‘নেক আমল কেবল নেক নিয়তের মাধ্যমে হয়’। এজন্য আমরা যদি এটা না জানি যে, নবী (স) তার চুল লম্বা করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চেয়েছেন, তাহলে কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় এমন কোন কাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্য করা যা নবী (স) উদ্দেশ্য করেন নি। এটা দ্বীন ইসলামের মধ্যে একটি নবউদ্ভাবিত বিষয় বা বিদ’আত। আর তোমরা সবাই সেই হাদীসগুলো জানো যেগুলো দ্বীন ইসলামে বিদ’আত করার ক্ষেত্রে কতটা ভীতিপ্রদর্শন করেছে। ‘যে কেউ আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কোন নতুন বিষয় সংযুক্ত করবে যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’ (বুখারীঃ হা/২৬৯৭)। কাজেই এটা একটা নবউদ্ভাবিত বিষয়, কারণ কোন ব্যক্তি এমন কিছুর মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চাচ্ছে যার মাধ্যমে নবী (স) তা চান নি। আর বিদ’আতীর প্রকৃতিই এমন, কারণ তারা এমন কিছু আমল নিয়ে আসে যেগুলোর মাধ্যমে নবী (স) মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করেন নি।
আর এভাবেই আমরা ‘ইবাদাতগত সুন্নাহ’ যে বিষয়ে আমরা নবী (স) কে অনুসরণ করি এবং ‘প্রথাগত সুন্নাহ’ যে বিষয়ে তা করা বা না করার ব্যাপারে আমরা স্বাধীন, এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য করি। কারণ প্রথাগত সুন্নাহটি কেবল অভ্যাসগত রীতিনীতি। কিন্তু আমাদের জন্য নবী (স) এর অভ্যাসগত কোন আমলের ক্ষেত্রে কোন কিছু বর্ধিত করা জায়েয নয়, এমন কিছু করার মাধ্যমে যা তিনি করেন নি। কেননা সর্বাপেক্ষা বড় আমল হচ্ছে তা যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। কারণ অন্তরও আমল করে, যেমনটি বলেছেন ইবনু তাইমিয়াহ (রাহঃ) তার অনেক কিতাবে এবং চিঠিপত্র ও পুস্তিকায়। আমার মনে হয় আমাদের জন্য এই বৈঠক এখানেই শেষ করা উচিত। আমাদের ভয় হচ্ছে আমরা আমাদের সাথীদেরকে যারা আমাদেরকে দা’ওয়াত করেছেন তাদেরকে কষ্টে ফেলে দিচ্ছি কিনা। মহান আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!
শাইখ আলবানী (রাহঃ) তার বক্তব্য জারি রাখেন…
আলোচ্য বিষয়ঃ আমাদের জন্য আবশ্যিক হচ্ছে আমরা এটা (ইবাদাতগত সুন্নাহ) এবং ওটা (প্রথাগত সুন্নাহ) এর মাঝে পার্থক্য করবো। এর অর্থ হচ্ছে, নবী (স) কে আমাদের অনুসরণ করাটা হবে দ্বীনী বিষয়াদির ক্ষেত্রে, দুনিয়াবী বিষয়ে নয়। এক্ষেত্রে অনেক ভুল-ত্রুটি দেখা যায়, বিশেষ করে কিছু অজ্ঞ লোক ভয়াবহ ত্রুটি করে থাকে যারা অভ্যাসগত সুন্নাহ এবং ইবাদাতগত সুন্নাহ এর মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করে না। ইবাদাতগত সুন্নাহ অতিরিক্ত কোন কিছু সমর্থন করে না এবং অনুমতি দেয় না। এজন্য নবী (স) বলেনঃ ‘(দ্বীন ইসলামে) প্রতিটি নবউদ্ভাবন হলো বিদ’আত এবং প্রতিটি বিদ’আত হলো ভ্রষ্টতা’ (আবু দাউদঃ হা/৪৬০৭, আলবানী একে সহীহ বলেছেন)। প্রথাগত সুন্নাহ কোন কিছু বাড়ানো, কমানো এবং সবকিছুই সমর্থন করে, কারণ তা কেবল অভ্যাস/প্রথা। আমি আপনার জন্য নবী (স) থেকে প্রথাগত সুন্নাহ্‌র একটি উদাহরণ পেশ করছিঃ
তিনি (স) মক্কা নগরীতে তার চুলে ৪টি বেণী করা অবস্থায় প্রবেশ করেন (সুনান আবু দাউদঃ হা/৪১৯১, আলবানী একে সহীহ বলেছেন)। তোমরা একে কী বল ‘ضفائر বা বেণী’? উপস্থিত ছাত্ররা জবাব দিল ‘ضفائر বা বেণী’। তিনি বলেনঃ বেণী (ضفائر) অথবা গুচ্ছ (غدائر)। তিনি (স) মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন, মক্কা জয় জয় করেন যেদিন মহান আল্লাহ তাকে মক্কাবাসীদের বিপক্ষে সাহায্য করেন। আর তার চুলে ছিল ৪টি বেণী। এটা হচ্ছে আরবদের সুন্নাহ। বর্তমানকালে আপনি কিছু বেদুঈন যুবকের মাঝে এটা দেখতে পাবেন। আমি তাদেরকে মরুভূমিতে দেখেছি। আজ অবধি এই সুন্নাহ তাদের মাঝে রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি স্বাধীন, যদি আপনি দেখেন এটা আপনার জন্য মানানসই, তাহলে তা করেন। আর আপনি চাইলে তা না করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনি নবী (স) এর খেলাফ কাজ করলেন না। কেন? কারণ এটা হচ্ছে প্রথাগত সুন্নাহ, কোন ইবাদাতগত সুন্নাহ নয়।
এ ধরনের প্রকারভেদকরণ দ্বীন ইসলামের অন্যতম একটি পূর্ণাঙ্গ বুঝ এবং উপলব্ধি, যেখানে নবীন জ্ঞানান্বেষীদের অনেকে এ বিষয়ে অজ্ঞ। তারা কোন আলেম নয়। তারা জ্ঞানের দিকে দা’ওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষানবিস, কোন আলেম নয়।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button