বলো, সুখ কোথা পাই

বিয়ের মাস কয়েক পর নিশি যখন প্রথমবারের মতো বরের সাথে বিদেশে গিয়েছিল তখন তার মাঝে ছিল মুক্তির আনন্দ। বিয়ের পর চারপাশের মানুষের অনবরত কটাক্ষ, দোষারোপের মাঝে সে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিল।

এখনো বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে বউদের সাথে কেমন অমানবিক আচরণ করা হয় তা সে ভালোই বুঝতে পেরেছিল নিজের বিয়ের পর। এসব থেকে বের হতে পারার স্বস্তি, সেই সাথে সদ্য বিবাহিত জীবনে প্রথমদিকে বিদেশে সবকিছুই মধুর লাগত।

এভাবেই একসময় নিশি আবিষ্কার করল যে সে অন্তঃসত্ত্বা। স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগার পাশাপাশি অনেক রকম অসুবিধা, অস্বস্তিও দেখা দিল। খেতে ভালো লাগে না, কিন্তু পছন্দের খাবার রেঁধে দেয়ার কেউ নেই। ঘুম হয়না রাতে, কিন্তু দিনের বেলায় ঘরের কাজগুলো ঠিকই করতে হচ্ছে।

মা-কে খুব মনে পড়ত তখন নিশির। একসময় ওর কোলে ছোট্ট একটা মেয়ে বাবু আসল। বর এতদিন ওকে সময় দিতে চেষ্টা করলেও বাবু হওয়ার পর নিজের কাজকর্মে বেশি ব্যস্ত হয়ে গেল। তাকেও তো সময়ের মাঝে পিএইচডি শেষ করতে হবে!

শুরু হোল নিশির নতুন যুদ্ধ। সারাদিন একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে একা ঘরে থাকা, সময়মতো বাচ্চাকে খাওয়ানো, ন্যাপি পালটে দেয়া, ফাঁকে ফাঁকে রান্না করা, ঘরের কাজ করা। তাও আবার বাচ্চার ঘুমের যেন ব্যাঘাত না হয় তাই ঘরে পিনপতন নিরবতার ব্যবস্থা রাখতে হতো।

নিজের মানুষদের বড্ড বেশি মনে পড়ত তখন নিশির। ছটফট করত কবে দেশে যাবে আর কারো কোলে বাচ্চাকে দিয়ে এক কাপ দুধ চা আরাম করে বসে খাবে। মনে হতো যেন, দেশে গেলেই বুঝি ভালো থাকা যাবে …

অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ আসল, নিশির বরের পিএইচডি শেষ হোল। বর চাকরি পেল অন্য এক জায়গায় আর নিশি বেড়াতে আসল পরিবারের মানুষদের কাছে। চাকরিটা এক বছরের জন্য, পরে পার্মানেন্ট হতেও পারে। যেহেতু চাকরিটা তখনও পার্মানেন্ট হয়নি তাই নিশিও আর ছোট বাবু নিয়ে এত অল্প সময়ের জন্য যেতে চাইল না।

টানা কয়েক বছর পর আত্মীয়স্বজন সবাইকে পেয়ে নিশি খুব খুশি। ওর মেয়েটা বিদেশে সারাদিন ছোট ঘরে একা থাকত। এখানে বাড়ির ছোটদের কোলে কোলে বেড়াচ্ছে। বড়দের কাছে বসে গল্প শুনছে। সবার মাঝে হাসিখুশি আছে। নিশির দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

কিন্তু সব ভালোরই কিছু মন্দ দিকও আছে। দেশে এসে কিছুদিন পর পর একা ছোট বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়ি শ্বশুরবাড়ি করে নিশি হাঁপিয়ে যাওয়া শুরু করল। জায়গা বদল হলে বাচ্চাও অসুস্থ হয়ে যায়। এক এক বার বাচ্চা অসুস্থ হয় আর নিশির টেনশন শুরু হয়।

ওর হালকা পাতলা মেয়েটা একবার অসুখের ধাক্কাতেই হাড্ডিসার হয়ে যায়। সেই সাথে গাদাখানেক ওষুধ তো আছেই। মেয়েটা ওষুধ খেতে চায় না একদমই। জোর করে চেপে ধরে খাওয়াতে হয়। প্রায় সময় বমি করে দেয়। নিশি ভাবে, বিদেশে থাকতে ওর এই মেয়েকে কখনো একবার প্যরাসিটামলও খাওয়াতে হয়নি! আর দেশে ইতিমধ্যেই কয়েকবার এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়ে গেছে।

সেই সাথে মুখোশধারী শুভাকাঙ্খীদের জ্বালাতন তো আছেই – তাদের কথা শুনে মনে হয় বাচ্চার অসুস্থতা, শুকনা সাস্থ্যের জন্য নিশিই দায়ী। বর কাছে না থাকায় নানা রকম অসুবিধা হতে থাকলো নিশির। যত যাই হোক, বাচ্চার প্রয়োজন বাচ্চার বাবার চেয়ে ভালোভাবে আর কে মেটাতে পারে? আবারও সেই পুরনো অনুভূতি, সুখ বুঝি অপর পাড়েই …

আবার যেন একসাথে সংসার শুরু করতে পারে মনে মনে চাইতে লাগল নিশি। এমন সময় ওর বর সেই সুসংবাদ শোনাল – তার চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নিশি। ভিসা প্রসেসিং করে, বাসা ঠিক করে ওর বর আসল ওদের আবার নিয়ে যেতে। কিন্তু এবার আর নিশি প্রথমবারের মতো এত উৎফুল্ল হতে পারল না।

হ্যাঁ, সে জানে যে একসাথে থাকাটা খুব দরকার, কিন্তু বিদেশ মানে আবার সেই ভয়ানক নিঃসঙ্গতায় ফিরে যাওয়া। আবার সবকিছুর দায়িত্ব একা নিজের ওপর নেয়া। মেয়ের কান্না, জিদ সব একা সামলানো। নিশি যখন ধৈর্যহারা হয়ে যাবে তখন আর কেউ এসে বলবে না, “চল, আপুমণি তোমাকে ম্যাও দেখাই।” বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ আর কাক দেখাবে না ওর মেয়েটাকে। ওসব দেশে তো বারান্দাই নেই!

তাও তো ভালো যে ওর বর অনেকটা সহযোগী, কিন্তু সেও তো আসে সারাদিন শেষে। বিদেশে যাদের স্বামীরা সহযোগী না বা ঘরের কাজে খুব বেশি আনাড়ী তাদের কথা ভেবে নিশির খুব খারাপই লাগে।

নিজের সংসারে ফিরছে এই আনন্দ আর সব দায়িত্ব একা সামলাতে হবে এই খারাপ লাগা নিয়ে নিশি প্লেনে চড়ল এবার। কাছের মানুষগুলোর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে বার বার। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! প্লেনের চাকাটা যখন চলতে শুরু করল ওর মনে হোল যেন সেটা রানওয়ের ওপর দিয়ে না, ওর মনের ওপর দিয়েই চলছে।

ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিশি বাইরে তাকাল। এবার আর নিশিকে কেউ নববধূ হিসাবে দেখবে না বিদেশে। তার সংসারের অভিজ্ঞতা এখন কয়েক বছরের। নিজের মেয়ের জন্মের দিনের কথা ভাবলে ওর অবাক লাগে, মনে হয় এই তো সেদিন! অথচ মেয়েটা এখন মাশাল্লাহ প্রায় তিন বছরের। ধাপে ধাপে নিশির জীবনও পাল্টাচ্ছে। বয়স আগাচ্ছে। মেয়ের বয়সের দিকে তাকালে এটা আরও বেশি মনে হয়।

জীবনের ধাপগুলো নিশিকে শিখিয়েছে, দুনিয়ার জীবনে নির্মল সুখ কোথাও নেই। প্রতিটা অবস্থানেরই কিছু ভালো আর মন্দ দিক থাকবেই। নিশি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যখন যে অবস্থায় সে থাকবে সে অবস্থার প্রতিকূলতার সাথে মানিয়ে নিয়ে, নিয়ামতগুলোকে কাজে লাগানোর, যেন যেখানে নির্মল সুখ আছে সেখানে যাওয়া যায় – সেই জান্নাতে!

সংসার, ছোট বাচ্চা নিয়ে কর্মব্যস্ত জীবনে কিভাবে জান্নাতে যাওয়ার উপকরণ জোগাড় করে নেয়া যায় এখন সে এটাই ভাবে। আল্লাহ্‌ বলেছেন তিনি এমন আমল ভালবাসেন যা পরিমাণে কম কিন্তু প্রতিদিন করা হয়। নিশি তাই এখন চেষ্টা করে ফরয সালাতের পর, ঘুমের আগে রাসুলাল্লাহর (সাঃ) শিখিয়ে দেয়া যিকরগুলো করতে। প্রতিদিন একশ বার ইস্তিগফার করতে। একবারে পারে না, দৈনিক পাঁচ বার সালাতের পর পড়ে নেয়।

সুরা মূলক মুখস্ত করেছে। রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর সময় আর ছড়াগান না বলে এটাই তিলাওয়াত করে। দুপুরে মেয়ের ঘুমের সময়টা আর আগের মতো ফেসবুকিং করে কাটিয়ে দেয় না। কুরআন নিয়ে বসে। ফোনে কিছু ভালো বই ডাউনলোড করে নিয়েছে। নিজের সুবিধা মতো সময়ে পড়তে চেষ্টা করে।

নিশির এখান এটাই চাওয়া – সে যে অবস্থাতেই থাকুক, যেন প্রোডাক্টিভ থাকতে পারে। সেই প্রোডাক্টিভিটি যা তাকে সেই নির্মল সুখের কাছে নিতে যেতে পারবে ইনশাল্লাহ।

বলো, সুখ কোথা পাই

বিনতে খাজা

Collected from রৌদ্রময়ী গ্রুপ

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88